তোমাকে,পর্ব 21.1,22.1

তোমাকে,পর্ব 21.1,22.1
অনিমা হাসান
পর্ব 21.1

বিকেলের দিকে সবাই চলে যাওয়ায় অনিমার হঠাৎ খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে আরম্ভ করলো I নাজমা, রেহানা বেগম আর বাচ্চাদের নিয়ে গাজীপুরে যাচ্ছে I গাজীপুরে ওর শ্বশুর বাড়িI শাশুড়ি একাই থাকেন I কাঠের দোতলা বাড়ি , বাড়ির সামনে পুকুর I বাচ্চারা সবাই মিলে একটু আনন্দ করবে এটাই উদ্দেশ্য I ইচ্ছে করে অনিমা আর মুনিরকে যেতে বলেনি I ও চাইছিলো ওরা দুজন একটু নিজেদের মতো সময় কাটাক I অনিমা ব্যাপারটা বুঝে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল Iওদের মধ্যে যে আলাদা কিছু নেই এটা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয় I ওরা শুধুই বন্ধু I অন্তত মুনির তাই চেয়েছে অনিমার কাছে I বিয়ের দিন বলেছেও সে কথা I তারপরও অনিমা আপত্তি করেনি I সবাই রওনা দেবে নাজমার বাসা থেকে I মুনির সবাইকে ওখানে পৌঁছে দিতে গেছে I সবাইকে বিদায় দিয়ে অনিমার হঠাৎ খুব একা একা লাগছে শুরু করলো I কি অদ্ভুত I নিজের বাড়িতে ও সব সময় একাই থাকে I কখনো তো এমন লাগেনা I অনিমা একটা বই নিয়ে পরছিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে I কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও টের পায়নি I মুনির ফিরে এসে দেখল অনিমা ঘুমাচ্ছে I ওকে আর বিরক্ত না করে নিজের লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল I
সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই আবহাওয়া খারাপ হতে আরম্ভ করল I প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো I মুনির ফোন করে খোঁজ নিল I ওরা অনেক আগেই পৌঁছে গেছে I
প্রচন্ড জোরে বজ্রপাতের শব্দে অনিমার ঘুম ভাঙলো I ও একটা খুব মিষ্টি স্বপ্ন দেখছিল I যেন একটা খুব বিশাল ছাদ I ওরা আবার সেই আগের দিনে ফিরে গেছে I ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে I বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মুনির অনিমার কানে কানে কিছু বলছে I কিন্তু অনিমা অনেক চেষ্টা করেও কিছুই শুনতে পাচ্ছে না I বাকি সব শব্দ শোনা যাচ্ছে I বৃষ্টির শব্দ , মেঘর গুর গুর , ব্যাঙের ডাক কিন্তু মুনির কি বলছে ও কিছুতেই শুনতে পারছে না I হঠাৎই খুব জোরে বজ্রপাত হলো I
অনিমা ধরমর করে উঠে বসলো I চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার I প্রচন্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ হচ্ছে I অনিমার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো I দরজার ফাঁক গলে এক চিলতে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে I অনিমা সেদিকেই দৌড়ে গেল I মুনির তখন আলোটা নিয়ে এই ঘরেই আসছিল I অনিমা এসে সজোরে ধাক্কা খেলো I মুনির ওকে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল
– কি হয়েছে ?
অনিমা জবাব দিল না I ওর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল I মুনির দেখল অনিমা কাঁপছে I কতকটা শীতে আর খানিকটা ভয়ে I মুনির আলতো করে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– কিছু হয়নি I ঠিক আছে ঠিক আছে I আমি আছি তো
– এতো অন্ধকার কেন ?
– ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে
– তুমি আমার কানে কানে কি বলছিলে মুনির ?
মুনির একটু অবাক হল কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না I বলল
– অনেক কিছুই তো বলতে চাই I তুমি শুনবে ?
– হু
তারপর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল
– তুমি কি আমার হবে অনিমা ?
-হু
মুনির ওর চিবুক টা ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরল I অনিমা কি চোখ বন্ধ করে আছে ? অন্ধকারে বোঝা গেল না I মুনির দুই হাতে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল I অনিমা সেদিনের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখল না দুই হাতে মুনিরের গলা জড়িয়ে ধরলো I
অনিমা সময়ের হিসাব গুলিয়ে ফেলেছে I ওর মনে হচ্ছে এইমাত্রই তো ও মুনির কে গান শুনিয়েছে I তারপর ওর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে I মুনির তবে সত্যি সত্যি ওকে কাছে টেনে নিল I অনিমার মনে হল মরেই যাবো ও ভালো লাগায় I কিন্তু সেদিন সত্যিই এমন টা হয়েছিল কি ? হয়নি তো I মুনির সেদিন ওকে ফেলে নিষ্ঠুরের মত চলে গেছে I কারণ তার কদিন পরেই ও নিলা কে ……….
অনিমা ছিটকে সরে গেল I
– তুমি এইভাবে কাউকে ঠকাতে পারো না
– কি ?
– তুমি কেন আমাকে বিয়ে করেছ ? তোমারতো উচিৎ ছিল নীলাকে বিয়ে করা I
– কাকে ? তোমার আমার মধ্যে নীলা আসছে কোথা থেকে ?
– তোমার আমার মধ্যে নীলা আসেনি I তুমি তোমার আর নীলার মধ্যে আমাকে টেনে এনেছ I তুমি কেন এটা করলে ?
মনিরের হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হল I এই মেয়েটা এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছে I কিসের নিলা ? ও বলল
– তোমার সমস্যা কি অনিমা ?
– আমার সমস্যা হচ্ছে আমি তোমার দয়া আর নিতে পারছি না I আমি আর এখানে থাকতে চাই না I আমি চলে যাব এখান থেকে
-ঠিক আছে চলে যেও I আমি তোমাকে আটকাবো না I
অনিমা ভীষণ রকম একটা ধাক্কা খেলো I প্রচন্ড অভিমান থেকে ও কথাটা বলেছিল I মুনির ওকে সত্যি সত্যি চলে যেতে বলবে এটা ভাবতেও পারিনি I অনিমা আর একটা কথা ও বলল না দরজা খুলে বেরিয়ে গেল I মুনির ও বারান্দায় গিয়ে বসে রইল দুহাতে মাথা চেপে ধরে I বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়ালই রইল না I
ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে I সাথে সাথে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ I তাপমাত্রা কমে গেছে I মুনিরের মনে হল বিছানায় যে চাদরটা সেটা বেশ পাতলা I অনিমার নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগছে I মুনির ঘরে ঢুকে অনিমা কে কোথাও দেখতে পেল না I ভাবল হয়তো রাগ করে অন্য কোন ঘরে ঘুমিয়ে আছে I মুনির সবগুলো ঘর খুঁজে ও অনিমাকে কোথায় পেল না I হঠাৎ করেই ওর খুব ভয় করতে লাগলো I অনিমা বাইরে কোথাও চলে যায়নি তো এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে I
মুনির দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেল I এতক্ষণ ধরে ও উঠানে দাঁড়িয়ে আছে ? এই বৃষ্টির মধ্যে ? মুনির বেশ কড়া গলায় বলল
– ভেতরে এস অনিমা
অনিমা কিছু বলল না I মুনিরের দিকে তাকানো ও না I আস্তে আস্তে ভেতরে চলে গেল I ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল I
অনিমা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় এসে বসল I ওর মাথায় সাদা তোয়ালে পাচানো I পরনে ফিনফিনে গোলাপি রংয়ের কামিজ সঙ্গে সাদা পায়জামা I মুনির চোখ ফেরাতে পারছেনা I অনিমা কে অসম্ভব আকর্ষণীয় লাগছে I স্বচ্ছ পোশাক ভেদ করে ওর শরীরের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে I গলার কাছে অনেকটা বোতাম খোলা I ফর্সা গলা আর বুকের অনেকটাই দৃশ্যমান I মুনির চোখ ফিরিয়ে নিলো I যদিও অনিমা এখন ওর স্ত্রী I ওকে এভাবে দেখায় দোষের কিছু নেই I তবুও মুনির তাকিয়ে থাকতে পারছে না I ও অস্বস্তি নিয়ে চোখ সরিয়ে নিল I পরমুহূর্তে আবার তাকালো I কিছু একটা যেন স্বাভাবিক নেই I যতক্ষণে বুঝলো ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে I মুনির দৌড়ে গিয়ে অনিমা কে ধরল I অনিমা কাঁপতে কাঁপতে মুনিরের বুকের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল I
অনিমার শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকমের বেশি I ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে I দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে I মুনির ওকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল I মাথার তোয়ালে খুলে চুলটা মুছে দিল I মুনিরের কখনো নিজেকে এত অসহায় মনে হয় নি I ওর চোখে জল এসে গেল I এখন অনিমার কিছু হলে ও কি করবে ? মুনির ডাকলো
– অনিমা কি হয়েছে ? চোখ খোলো I তাকাও এদিকে
অনিমা চোখ খুললো I কিছু একটা বলতে চাইল I হাত বাড়িয়ে মুনির কে ধরতে চাইলো কিন্তু কিছুই করতে পারল না I প্রচন্ড জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে রইল I
পর্ব 21.2
ডিপার্টমেন্টে এসে মুনির যে খবরটা পেল সেটার জন্য ও একেবারেই প্রস্তুত ছিল না I মুনির ডিপার্টমেন্টের হাইয়েস্ট মার্কসের রেকর্ড ভেঙেছে I এই রেকর্ডটা ছিল স্বয়ং চেয়ারম্যান স্যারের I উনি অসম্ভব খুশি হয়েছেন I এমনিতেই চেয়ারম্যান স্যার মুনির কে অত্যন্ত স্নেহ করেন I উনি মুনির কে কাল থেকেই উনার রিসার্চ ল্যাবে কাজ শুরু করতে বললেন I
খবরটা পেয়ে মুনিরের প্রথমে যে কথাটা মনে হল সেটা হল কখন ও অনিমাকে এটা জানাবে I ও না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব ছিল না I ওকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি I স্যারের রুম থেকে বের হয়ে মুনির দেখল সুমন দাঁড়িয়ে আছে I ওর মুখ হাসি হাসি
– কিরে খবর পেয়েছিস ?
– তোরা আগে থেকে জানতিস ?
– জানতাম না তবে আন্দাজ করেছিলাম I রেকর্ড ব্রেক তো ?
– হু
– তোর ডার্লিং কই ? ওকে বলবি না ? তোর সঙ্গেই তো ছিল
মুনির হেসে ফেলল I
-তুইও হাসিবের ল্যাঙ্গুয়েজ বলা শুরু করেছিস ?
ওরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লাস রুমের দিকে চলে গেল
– ওকে যেতে দিলি কেন ?
– বুঝতে পারিনি এরকম একটা খবর পাবো
– ফোন দে I চলে আসতে বল
মুনির একটু দ্বিধায় পড়ে গেল I অনিমা এখন রিক্সায় I এ সময় ফোন করা বোধহয় ঠিক হবে না I
– কিরে আমার ফোনটা দেবো ? ফোন করবি ?
– না এখন না I বিকেলে ফোন করবো বলেছি
– ওকে কিছু বলতে পেরেছিস ?
– কোথায় আর বলতে পারলাম , তোরা তো ডেকে নিয়ে আসলি I
-OH NO . এজন্য নিয়ে গেছিলি টিএসসিতে ? যাক এখন গুডনিউজ এর সাথে বলিস
মুনির একটু হাসলো কিছু বলল না I আরো কয়েকজন ছেলে মেয়ে এগিয়ে এসে মুনির কে অভিনন্দন জানাল I একজন বলল
– কিরে ট্রিট কবে দিচ্ছিস
– কালকে ইনশাআল্লাহ I কোথায় খাবি বল ?
সুমন বললো
-ট্রিট তো ডাবল হবে I সেরকম পার্টি চাই I
– ডাবল কেন ? আশেপাশের কয়েকজন জানতে চাইল
-আজকে আমাদের ভাবিকে প্রপোজ করা হবে
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল I সবাই গিয়ে নীলাকে অভিনন্দন জানাতে আরম্ভ করল I নীলা বলল
– আমার ফাস্ট পজিশন চলে গেল আর তোরা আমাকে কংগ্রাচুলেট করছিস ?
– পজিশনে চলে গেলে কি হবে সেতো তোর কাছেই আসছে I
নীলা একটু হাসলো কিছু বলল না I
******
রিক্সায় উঠে অনিমার মনে হল মুনিরের সঙ্গে যাওয়াই উচিত ছিল I এখন কিছু ভালো লাগছেনা I অনেকটা পথ চলে এসেছে I রিক্সা এখন নিউমার্কেটের জ্যামে পড়েছে I এখান থেকে ঘোরানো ও সম্ভব না I অনিমা ওর হাতের বইটা ব্যাগে রাখছিল তখনই ফোনটা ভাইব্রেট করলো I নীলার মেসেজ এসেছে I অনিমা ভাবল পরে দেখবে কিন্তু ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ওর সারা শরীর জমে গেল I নিলা লিখেছে
– HE IS GOING TO PROPOSE ME TODAY
অনিমা কোনমতে লিখল
-WHO ?
– MUNIR WHO ELSE ?
– ARE YOU SURE ? কে বলেছে ?
– ও নিজেই বলছে সবাইকে
অনিমার মাথা কাজ করছে না I কি লিখবে বুঝতে পারছেনা I ও কাঁপা হাতে লিখল
– ARE YOU GOING TO SAY YES ?
– I DON’T KNOW . MAY BE
অনিমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে I চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে I কি হচ্ছে এসব ? এটা সত্যি না I নিশ্চয়ই কোন দুঃস্বপ্ন I
চলবে…………
লেখনীতে
অনিমা হাসান

তোমাকে
পর্ব 22.1
-একদিন আগেই না বিয়ে করলেন ? একদিনকই এই অবস্থা করে ফেললেন ?
মুনিরের কান গরম হয়ে গেল I মাথা ঝনঝন করতে লাগলো I এই জন্য এই ভদ্রলোককে ও ডাকতে চায়নি I কিন্তু নিরুপায় হয়েই ডাকতে হয়েছে I
অনিমা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর মুনির কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল I মাথা কাজ করছিল না I এখন ও কি করবে ? ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু একা সেটা সম্ভব নয় I কামালকে ও নাজমা দের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে একটা মাইক্রো ভাড়া করে I কামাল ওদের অনেক পুরনো আর বিশ্বস্ত ড্রাইভার I এখন গাড়িটা রাখা আছে কিন্তু এই অবস্থায় ও অনিমা কে নিয়ে ড্রাইভ করে যেতে পারবেনা I আবহাওয়ার যে অবস্থা অ্যাম্বুলেন্স আসতেও অনেকটা সময় লেগে যাবে I তখনই ওর মনে পড়ল পাশের কোয়াটারে মালেক স্যার থাকেন I উনার ছোট ভাই ডাক্তার ,বেড়াতে এসেছে I মুনিরদের 2 ব্যাচ সিনিয়র I কিন্তু এই ভদ্রলোককে মুনিরের একেবারেই পছন্দ না I ভদ্রলোক অতিমাত্রায় রসিক I লাগামহীন রসিকতা করেন I তারপর ও উপায়ান্তর না দেখে ও মালেক স্যার কে ফোন দিল I মালেক স্যার সব শোনার সাথে সাথেই ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন দারোয়ানকে দিয়ে I
ভেতরে ঢুকেই খালেক ভাই জিজ্ঞেস করলেন
– কি বিষয় ? বিবাহ উত্তর জটিলতা নাকি ? হা হা হা
মুনির মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল I এই জিনিস এখন অনেকক্ষণ সহ্য করতে হবে I ও বলল
– খালেক ভাই একটু দেখেন না I অনেক জ্বর I একটু আগেই মাপলাম 104
খালেক ভিতর ঢুকলো I অনিমার গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা I ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে I খালেক বললো
– আরে ,এইভাবে ঢেকে রাখলে রোগী দেখবো কিভাবে ? তবে বলতেই হবে ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর I
খালেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলল
– কিছু দিয়েছেন ?
– হ্যাঁ একটু আগে জ্ঞান ফিরেছিল তখন প্যারাসিটামল সিরাপ দিয়েছি
– আর কিছু ?
– জলপট্টি দিয়েছি
– তাহলে তো সব করেই ফেলেছেন I আমাকে আর কি দরকার ?
– ভয়ের কিছু নেই তো খালেক ভাই ?
– না , অনেকের জ্বরের প্যাটার্ন টা এরকম হয় I ঠিক হয়ে যাবেI কিন্তু হঠাৎ এরকম হল কেন ? কি এমন করলেন ?
– আসলে বৃষ্টিতে ভিজেছিল অনেকক্ষণ I
– ও , তা গান টান গেয়েছেন নাকি দুজন মিলে বৃষ্টিতে ? তারপর যা হয় আর কি সিনেমায় I
খালেক ভাই চোখ টিপ দিলেন I মুনির জবাব দিলে না I
– শোনেন কোন টিপস লাগলে বইলেন I আমরা আছি কি করতে ? নতুন বিয়ে করেছেন একটু এনজয় করবেন না I হা হা হা
– চলেন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি
খালেক ভাই আরো কিছুক্ষণ অশ্লীল ধরনের রসিকতা করে বিদায় নিলেন I শেষের দিকে মনিরের ইচ্ছা করছিল ভদ্রলোককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে I কিন্তু এমন বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন তাই হাসিমুখে সব হজম করতে হল I
অনিমা যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে I ওর শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে তবে মাথাটা এখনো একটু ভার ভার I অনিমা ফ্রেশ হয়ে একটা আরামদায়ক সুতির জামা পরলো I তারপর বের হলে রান্নাঘরের দিকে গেল I মুনির তখন রান্নাঘরে অনিমার জন্য খাবার তৈরি করছিল I অনিমা ওকে দেখে আর ওদিকে গেল না I গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ার টেনে বসে পরলো I কাল রাতে মুনির কে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ওর কারনেI অনিমা কখনোই চায়না ওর জন্য কাউকে ঝামেলায় পড়তে হোক I বিশেষত কালকে ও মনিরের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তারপর I এখানে এসে অবধি মুনির ওদের অনেক টেককেয়ার করেছে I ওর মনিরের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত I কিন্তু মুনির তো ওকে চলে যেতে বলেছে তাহলে আর ক্ষমা চাওয়ার কি হল I চলেই যাবে ও I কাল ই ফ্লাইট বুকিং দেবে I যত দ্রুত সম্ভব চলে যাবে I কার উপগ্রহ হয়ে থাকতে চায়না অনিমা I
মুনির বাটি ভর্তি সুপ অনিমার সামনে রেখে বলল
– সবটা খাবে
তারপর চেয়ার টেনে বসে পত্রিকা খুলল I অনিমা লক্ষ্য করলো মুনির খুব গম্ভীর হয়ে আছে I পেপারের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ঠিক পড়ছেনা I অনিমা কিছু বলল না I সুপের বাটিতে চামচ ঘুরাতে লাগলো I
– তুমি কি আমাকে ভয় পাও অনিমা ?
– ভয় ? তোমাকে? অনিমা বিস্মিত হলে বলল
– তুমি ভয় পেয়ো না I তুমি না চাইলে আমি তোমার কাছে আসবোনা I আমি কথা দিচ্ছি I
অনিমা কিছু বলল না I যেমন চোখ নামিয়ে বসেছিল তেমনি বসে রইল I কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে বলল
– তুমি কাল কাঁদছিলে মুনির ?
– হু
– কেন ?
– তোমার কষ্ট হচ্ছিল I আমি কিছু করতে পারছিলাম না তাই
মুনির লক্ষ্য করলো অনিমার দুই চোখ বেয়ে বড় বড় ফোটায় জল গড়িয়ে পড়ছে I মুনির কিছু বলতে গেলে অনিমা হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল I তারপর বলল
– ছোটবেলা থেকে আমার এরকম ভাবে জ্বর আসে I অনেক টেম্পারেচার উঠে যেত I কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠতো I মিঠু খালা জলপট্টি দিতে দিতে একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো I গভীর রাতে আমার খুব শীত করত I গায়ে কাটা দিত I তারপরে একটু হেসে বলল , আমার জন্য কেউ কখনো কাদেনি I
অনিমার কথাগুলো মনিরের বুকের মধ্যে তীব্রভাবে আঘাত করলো I ও বলল
– এই যে আমি কাঁদলাম I আমি কি তোমার কেউ না অনিমা ?
অনিমার ঠোট কেঁপে গেল, নাকের পাতা ফুলে উঠলো I অনেক কষ্টে কোনমতে ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করল I
মুনির উঠে এসে অনিবার সামনে দাঁড়ালো তারপর কিছুক্ষণ আগে করা প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে অনিমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল
– তুমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছো ?
অনিমা দুই হাত দিয়ে মুনির কে আঁকড়ে ধরল I তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল
– তুমি কি সত্যিই চাও আমি চলে যাই ?
– না , কখনো না I তুমি চাইলেও আমি তোমাকে যেতে দেবোনা I
– কেন ?
– আমি এত কষ্ট করে তোমাকে পেয়েছি I এত সহজে হারাতে পারবো না I আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি………
মুনির কথা শেষ করতে পারল না I তার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো I অনিমা উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিল মনিরের জবাবের অপেক্ষায় I কিন্তু সেটা আর শোনা হলো না I
মুনির ফোন নিয়ে উঠে গেল I হাতের ইশারায় অনিমা কে সুপ খেতে বলল I অনিমা লক্ষ্য করলো মুনির কে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে
– কোন সমস্যা হয়েছে মুনির ?
– হ্যাঁ I ডিপার্টমেন্টে কিছু বহিরাগত ছেলে এসে ঝামেলা করছে I আমাকে একটু যেতে হবে I
– তোমার তো এমনিতেই যাওয়ার কথা ছিল I
– না আমি ছুটি নিয়েছিলাম তোমার শরীর খারাপ বলে
– ও
মুনির চেয়ার টেনে অনিমার কাছে এসে বসল তারপর বলল
– শোনো আমি হাসিনাকে ফোন করে দিচ্ছি ও তাড়াতাড়ি চলে আসবে I তুমি কোন কিছু করবে না I রেস্ট নেবে I কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবে I ঠিক আছে Iবুঝেছ ?
– হ্যাঁ বুঝেছি
– জ্বর আছে ?
– মনে হয় না I
মুনির অনিমার কপালে হাত রাখল I হালকা গরম তবে জ্বর বলা যায় না I মুনির বলল
– একদম পানি ধরবে না I আর গোসল তো করবেই না I
অনিমা হেসে ফেললI বলল
– জি স্যার
মুনির ও হাসল I হঠাৎ করেই দুজনের মধ্যকার মেঘ টা সরে গেল I
পর্ব 22.2
অনিমা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল I ফোনটা এলো চারটার একটু আগেই I মুনির এতটাই এক্সাইটেড ছিল যে অনিমা ভাঙা কণ্ঠস্বর ও লক্ষ্য করল না I
– হ্যালো অনিমা একটা গুড নিউজ আছে
অনিমার বুক কেঁপে উঠলো I তারমানে নীলা হ্যাঁ বলে দিয়েছে ?
– অনিমা শুনতে পাচ্ছ ? আমি বলছিলাম যে ……….
-আমি জানি
মুনির একটু অবাক হল I অনিমা কি করে জানল? পরমুহুর্তেই মনে হোলো কেউ নিশ্চয়ই ফোন করে বলেছে ওকে I
– তুমি জানো ?
– হ্যাঁ I কংগ্রাচুলেশনস I
-অনিমা তুমি না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব ছিল না I
– আমি ?
– হ্যাঁ তুমি I তুমি নিজেও জাননা তুমি কি করছ I
অনিমার মনে হল মুনির তাহলে এই কথাটাই ওকে এতদিন ধরে বলতে চাইছিল I ওকে দিয়ে নীলাকে বলতে চাইছিল I কিন্তু তার আগেই সব ঠিক হয়ে গেল I অথচ ও কি ভাবে রেখেছিল I সবাই ঠিকই বলে ও একটা বোকা মেয়ে I অনিমা বলল
-মুনির এতে আমার কোন কন্ট্রিবিউশন নেই I
– হ্যাঁ আছে I তুমি জানোনা I আমি তোমাকে সব বলতে চাই I তুমি একবার আমার সাথে দেখা করো I আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই I
মুনির এখন ওর সঙ্গে ভদ্রতা করতে চাইছে I উপকারের প্রতিদান দিতে চাইছে I কোন উপহার দিতে চাইছে I ওফ I এইসব ও দেখতে হবে ওকে I
– এসবের কোন দরকার নেই I
অনিমার গলা বুজে এলো I প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে I ইচ্ছা করছে ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে I মুনিরের হঠাৎ একটু খটকা লাগলো I অনিমা এইভাবে কথা বলছ কেন ? কোন সমস্যা হয়েছে কি ? মুনির বলল
– অনিমা তুমি আজকে আমাকে কি বলতে চেয়েছিলে ?
অনিমা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না I বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল I
-অনিমা আমার কথা শোনো I কি হয়েছে আমাকে বল I
মুনির বুঝল অনিমা কাঁদছে I ও আবার ও বলল
– অনিমা প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন I আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি I এ কথাটা বলার জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি I আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ I আমি আর কিছু চাইনা তোমার কাছে I তুমি আমাকে বল কি হয়েছে I
অনিমা চোখ মুছে ফোনটা আবার ধরল I বলল
– মুনির …..
-হ্যাঁ বল
– আমি
– কি হয়েছে বল আমাকে
– আমি ফোনটা রাখছি
– অনিমা শোনো I আমি তোমাকে একটা অ্যাড্রেস টেক্সট করছি I কালকে আমি ওখানে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছি I তুমি এস কালকে ওখানে I তোমার সঙ্গে কথা বলার খুব দরকার I
অনিমার আবারও কান্না পাচ্ছে I এখন তাহলে ওরা দুজন এটা সেলিব্রেট করবে I আর অনিমাকে সেখানে গিয়ে …I অনিমা আর ভাবতে পারছে না I এখন কি হবে ? মুনির নীলাকে নিয়ে রিক্সা করে বৃষ্টিতে ভিজবে , জ্বর হলে ওকে ভাত খাইয়ে দেবে ? অনিমা এটা কিছুতেই দেখতে পারবেনা I ওকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে I এত দূরে যেখানে ওর মনিরের কথা মনে ও পড়বে না I
-তুমি ভালো থেকো মুনির I অনেক অনেক ভালো I
অনিমা ফোনটা কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে রাখল I মনিরের বুকটা ধ্বক করে উঠলো I ও ওই ভাবে বলল কেন ? তাহলে কি ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে ?
চলবে……..
লেখনীতে
অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here