তোমাকে,পর্ব 17.1,18.1

তোমাকে,পর্ব 17.1,18.1
অনিমা হাসান
পর্ব 17.1

-তোমার কি খিদে পেয়েছে সেঁজুতি ? কিছু খাবে ? গাড়িতে উঠেই জানতে চাইল মুনির
– না একবারে বাসায় যেয়ে খাব
– সেই ভালো I তোমার জন্য তোমার ফেভারিট আইটেম করা হয়েছে
– ওয়াও That’s great
অনিমার এসব আলোচনা ভালো লাগছে না I এদের দুজনের মধ্যে কি চলছে ও বুঝতে পারছে না I সেজুতিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে ও মিটি মিটি হাসে I বেশি জোরাজোরি করলে বলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে I বিরক্তিকর লাগছে এসব হেঁয়ালি I মুনিরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে আরো অসহ্য লাগে I কিন্তু এখনই কথা না বললে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে I অনিমা একটু ইতস্তত করে বলল

– তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল
– হ্যাঁ বল না I সামনের দিকে তাকিয়েই বলল মুনির I মুনির ড্রাইভার আনে নি , নিজেই ড্রাইভ করছে
-আমি বলছিলাম যে …
– কি ? হোটেলে উঠতে চাও ?
অনিমা ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়ে রইল কিছু বলতে পারলো না
– RELAX , আমি কোন মাইন্ড রিডার নই I দেশে আসার আগে আমি তিনবার আবরার ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি I কথা বলেই বুঝতে পেরেছি যে তুমি ওখানে থাকতে পারবে না I আর এখানে তোমার এমন কেউ নেই যার কাছে তুমি সেজুতিকে নিয়ে যেতে পারো I তাই একটাই অপশন থাকে I

– আমি আসলে এভাবে.. I ঠিক বোঝাতে পারছিনা তোমাকে

গাড়ি সিগনাল দাঁড়িয়েছে I মুনির হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল

– অনিমা একটা সময় তো আমরা বন্ধু ছিলাম I সেই বন্ধুত্বের খাতিরে না হয় একটা সকাল আমার বাসায় থাকলে I যদি তোমার ওখানে আনকম্ফোর্টেবল লাগে তাহলে আমি নিজে তোমাকে হোটেলে রেখে আসব I

এরপর অনিমা আর কিছু বলতে পারল না I তবে তখনও ও বুঝতে পারেনি যে ওর জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছে I

মুনিরের কোয়াটার টা একতলায় I সামনে একটা বড় উঠোন তারপর মেইন গেট I উঠোনটা দেখে ভালো লাগলো অনিমার I একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার পাতা তবে কোনো গাছ নেই I এখানে গাছ লাগালে খুব সুন্দর হতো I

অনিমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে I মনিরের বাসার কাউকেই ও চেনে না I মুনিরকে ও আজকাল বড় অচেনা লাগে I কি জানি কি হয়েছে I কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই সবটা এমন পাল্টে যাবে অনিমা সেটা ভাবতেও পারিনি I

রেহানা বেগম কে সালাম দেবার পর উনি প্রথমেই এসে অনিমাকে জড়িয়ে ধরলেন I তারপর ওর চিবুক স্পর্শ করে বললেন
– তুমি জানো না মা তুমি আমাকে কত বড় সুখ দিলে I আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াটা পূরণ করলে I বলতে বলতে উনার চোখে জল এসে গেল
অনিমা কি বলবে বুঝতে পারল না I বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই দেখল উনি সেঁজুতি কে কাছে টেনে নিয়েছেন I সেঁজুতি উনাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– তুমি কেমন আছো দাদি ?

অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I কোনমতে সেজুতিকে বলল

– তুমি উনাকে এটা কি ডাকলে সেঁজুতি ?
– কেন ? তনু ও তো তাই ডাকে I এটাই তো উনার নাম

অনিমা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই উল্টোদিকের ঘর থেকে একটা পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে দৌড়ে এসে অনিমাকে জড়িয়ে ধরল তারপর মাথাটা উপরের দিকে তুলে বলল

– আম্মু তুমি চলে এসেছো I তারপর দুই হাত উপরের দিকে তুলে বলল কোলে নাও
অনিমা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল I বুঝতে পারল এটাই মুনিরের মেয়ে তনিমা I তনু প্রথমে অনিমার গাল স্পর্শ করল তারপর ওর গলা জড়িয়ে ধরল I অনিমার চোখ ভিজে আসছে I কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না I তনু ওর ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে অনিমার চোখের জল মুছে দিল তারপর বলল
– তুমি কাঁদছো কেন ?
– এমনি সোনা I তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম যে তাই I তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রেহানা বেগমের দিকে তাকালো I উনি বললেন
– ও আসলে কোনদিন ওর মাকে দেখেনি I তাই তুমি আসবে শুনে ভেবেছে ওর মা আসছে I তারপর বললেন
-তনু মা কে বিরক্ত করো না
– আমি আম্মুর কাছে থাকবো

– ভাবি তুমি আমার আগেই চলে এসেছো I আমিতো আগে আসতে চেয়েছিলাম I কত প্লান ছিল I সব ভেস্তে গেল ভাইয়ের জন্য I কোথায় সে ?
সবাই একযোগে গেটের দিকে তাকালো I নাজমার রাগ অবশ্য স্থায়ী হলো না I ও দৌড়ে এসে অনিমা কে জড়িয়ে ধরল I তারপর বলল
– ভাবি তুমি ছবিতে দেখতে যতটা সুন্দর সামনাসামনি তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর I এই তনু তুই নাম না কোল থেকে I একটু কথা বলতে দে না
-না আমি আম্মুর কাছে থাকবো
– এরকম করলে কিন্তু আম্মু আবার চলে যাবে
– না না আমি আম্মুকে বিরক্ত করব না
নাজমার পেছনে ওর দুই ছেলেকে দেখা গেল I নাজমার জমজ দুই ছেলে ইসতি আর ইফতি I ওরা ও মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে I মায়ের দেখাদেখি ওরাও অনিমাকে জড়িয়ে ধরল I ওদের কান্ড দেখে অনিমা হেসে ফেলল I নাজমা অনিমার হাত ধরে বলল
– তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে ভাবি
রেহানা বেগম মেয়ের কান্ড কারখানা দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন I বললেন
– মেয়েটা মাত্র এসেছে I ওকে একটু বসতে দে I তা না আসতে না আসতেই কথার ফুলঝুরি শুরু হয়ে গেল
– তো কি করব তোমার আদরের ছেলে তো আমাকে বলেনি তা না হলে আমি আরো আগেই চলে আসতাম I কোথায় সে ? তাকে বল আমার ব্যাগ গুলি নিয়ে আসতে I কামাল ভাইকে তো কোথাও দেখলাম না
– কামাল কে আমি একটা কাজ পাঠিয়েছি I মুনির ওর ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল
– আমার ব্যাগ গুলি নিয়ে এস ভাইয়া I আর তুমি বলনি কেন যে ভাবিকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবে I তাহলে আমি আরো আগেই চলে আসতাম I কত প্ল্যান করে রেখেছিলাম I তুই সব নষ্ট করে দিলে I
– আচ্ছা হয়েছে I কয়টা ব্যাগ ?
– চারটা
– দুদিন পর পর তো আসিস এত ব্যাগ নিয়ে আসার কি আছে ? আর ব্যাগের মধ্যে মনে হয় পাথর ভরে আনে এত ভারী I
– দেখলে মা সব সময় আমার সঙ্গে এরকম করে I আর আসবো না আমি
– আছিস না যা চলে যা I মুনির ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
-তোমার জন্য আসিনি আমি I ভাবির জন্য এসেছি I

রেহানা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন

– এদের ঝগড়া চলতেই থাকবে অনিমা I তুমি আমার সঙ্গে এসো I হাত মুখ ধুয়ে নাও I
অনিমা চারদিকে সেজুতিকে খুঁজছিল I রেহানা বেগম বুঝতে পেরে বললেন
– ওকে আমি হাতমুখ ধুতে পাঠিয়েছি I এসে যাবে এক্ষুনি

অনিমা অনেকক্ষণ ধরে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল I তারপর আয়নার দিকে তাকালো I ওর এখন ও বিশ্বাস হচ্ছে না বাইরের যেসব হয়েছে সেগুলি সত্যি I মনে হচ্ছে দরজা খুললেই সব মিলিয়ে যাবে I এরকম একটা পরিবার ও সব সময় চেয়েছে যেখানে সবাই হাসি আনন্দ করে একসঙ্গে থাকবে I

ঘর থেকে বেরিয়েই অনিমা মুনিরের মুখোমুখি হলো I মুনির মুগ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তারপর একটু হেসে সামনে থেকে সরে গেল I অনিমা একটা জলপাই সবুজ কামিজ পরেছে সঙ্গে ম্যাচিং জলপাই সবুজ ওড়না I খোঁপাটা খুলে যাওয়ায় চুল গুলো ছড়িয়ে আছে I কোন প্রসাধনী নেই I অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে ওকে I

– তুমি বসে পড় মাI

ততক্ষনে সেঁজুতি খেতে বসে গেছে I রেহানা বেগম একটা একটা আইটেম তুলে দেখাচ্ছে আর সেঁজুতি কোনটা নেবে বলে দিচ্ছে I অনিমা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো উনি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানেন না I কিন্তু ভালবাসার বোধহয় কোন ভাষার দরকার হয় না I অনিমার চোখে জল এসে গেল I

অনিমা চারিদিকে তাকিয়ে বলল
– আর কেউ বসবে না ?
– মুনির একটু বাইরে গেছে , আর নাজমা বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে I খাওয়ানো হলেই চলে আসবে I তুমি বসে পড়ো I
– একসঙ্গেই বসি

অনিমা পাশের ঘরে গিয়ে দেখল নাজমার গলদঘর্ম অবস্থা I দুই ছেলে আর তনু কে নানান কৌশল করে খাওয়াতে হচ্ছে I অনিমাকে দেখেই তনু বলল
– আমি আম্মুর হাতে খাব
– তনু তুই যদি আর একবার ঝামেলা করিস তো আমি আম্মুকে নিয়ে চলে যাব
অনিমা হাসতে হাসতে ওকে কোলে তুলে নিল তারপর বলল
– আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি I তুমি বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসো না সবাই একসঙ্গে খাই
নাজমা একটু অবাক হল I তারপর মনে মনে বলল এবার বুঝতে পারছি ভাইয়া কেন তোমাকে পছন্দ করেছে I

পর্ব 17.2
নাজমা অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে I দুই ঘণ্টার মধ্যেই একটা নীল রঙের মনিপুরী তাঁতের শাড়ি কিনে ফেলেছে I দাম ও বেশি পড়েনি মাত্র পনেরশো টাকা I 500 টাকা বেঁচে গেছে I নাজমা ওটা দিয়ে নীল আর হলুদ কাচের চুড়ি কিনলো I শাড়িটার সঙ্গে বেশ মানাবে I কেনাকাটা শেষ করে ফেরার পথে ও মুনিরের হলে গিয়ে কল দিল I মুনির তখনও হলে ফেরেনি I কিছুক্ষণ পর হাসিবকে নেমে আসতে দেখা গেল
– কিরে তোর কোন কাজ ছিল I মুনির তো ফেরেনি এখনো
– হ্যাঁ , ভাইয়া এটা কিনতে দিয়েছিল
– কি জিনিস ?
– তোমাকে বললে আবার রাগ করবে নাতো ?
– আরে ধুর I তোর ভাই রাগ করতে জানে নাকিI কি ওর ডার্লিং এর জন্য কিছু ?
– তুমি জানো ? আমার সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দাও না হাসিব ভাইয়া প্লিজ
– নিশ্চয়ই দেবো I তুই ডিপার্টমেন্টে ঘুরতে আয় আমি আলাপ করিয়ে দেবো I তোর ভাইয়ের ভরসায় থাকিস না I এতদিনে কিছু বলতে পারলো না I তিন বছর হয়ে গেল I
– কত দিন ধরে চলছে হাসিব ভাইয়া ?
-মেলা দিন I তুই আমার কাছে এটা দিয়ে যা I রাত করিস না হলে চলে যা I
*******
রিক্সা প্রায় অনিমাদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে I মুনির খুব আস্তে করে অনিমাকে ডাকলো I অনিমা একবার চোখ মেলে তাকালো তারপর মুনির কে দেখে স্বপ্ন দেখছে ভেবে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল I মুনির একটু হাসল তারপর অনিমার গালে হাত ছুঁয়ে বলল
– অনিমা আমরা চলে এসেছি
অনিমা চমকে মাথা সোজা করে বসল I তারপর ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল
– আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ?
-হ্যাঁ সমস্যা নেই I এখন কেমন লাগছে ?
– এখন ঠিক আছি

রিক্সা ততক্ষণে অনিমাদের গেটে এসে থেমেছে I অনিমা মুনির কে ওর চাদরটা ফেরত দিয়ে বলল

– থ্যাঙ্ক ইউ
-তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো অনিমা ?
– আমি তো রেগে ছিলাম না
– অনিমা আই এম সরি
– কি জন্য ?
– আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি I তোমাকে কিছু বলার ছিল I তুমি কাল আসছো তো ?

অনিমার সব অভিমান মুহূর্তে গলে জল হয়ে গেল I
-হ্যাঁ আসছি
– ঠিক আছে I তাহলে কাল কথা হবে I
– তুমি উপরে আসবেনা ?
– অনেক রাত হয়ে গেছে I তুমি একা যেতে পারবে ?
– হ্যাঁ পারব
– আমি দাঁড়াচ্ছি তুমি ভেতরে যাও তারপর আমি যাব I

অনিমা চলে যাওয়ার পর ও মুনির অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল I তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল I

চলবে….

লেখনীতে অনিমা হাসান

তোমাকে
পর্ব 18.1

মুনিরদের বাড়িতে তিনটা শোবার ঘর I মুনিরের ঘরটা সামনের দিকে I ঘরটা বেশ বড় , পুরনো আসবাব দিয়ে সাজান I একটা বড় মেহগনি কাঠের খাট ঘরের মাঝ বরাবর রাখা I দেয়াল ঘেঁষে লেখার টেবিল আর বিশাল বইয়ের সেলফ I অন্যপাশে কাপড়ের আলমারি I ঘরের সাথে লাগোয়া বিশাল বারান্দা I বারান্দা থেকে উঠোনের একটা অংশ দেখা যায় I বারান্দায় একটা বড় 3 সিটের সোফা রাখা I মুনিরের রাতে ঘুম না এলে ও প্রায়ই এখানে বসে বই পড়ে I মাঝে মাঝে বসে বৃষ্টি দেখে I ওর নিঃসঙ্গ রাতগুলো এভাবেই কেটে যায় I

পাশের ঘরটাতে রেহানা বেগম থাকেন নাতনি কে নিয়ে I এই ঘরটা ও বেশ বড় I দুজনের জন্য বড় একটা খাট, কাঠের আলমারি I পাশেই তনুর ছোট গোলাপি রংয়ের পড়ার টেবিল I কোনার দিকে আরও একটা ঘর আছে I নাজমা এ বাড়িতে এলে সাধারণত এই ঘরেই থাকে I ঘরটা ছোট হলেও বেশ খোলামেলা এই ঘরটাই সেঁজুতিকে দেওয়া হয়েছে I

খাওয়ার পর নাজমা অনিমাকে নিয়ে এই ঘরে এলো I বাচ্চারা তখন পাশের ঘরে খেলায় ব্যস্ত I
নাজমা বললো
– ভাবি তোমার সাথে একটু কথা ছিল
– হ্যাঁ বলো না
– মা চাইছে তোমার জন্য একটা নতুন শাড়ি আর একটা আংটি কেনা হোক I আমরাই কিনে রাখতাম কিন্তু তোমার যদি পছন্দ না হয় তাই কেনা হয়নি I তুমি একটু ভাইয়ার সাথে গিয়ে কিনে নিয়ে আসবে ?
– এখন?
– আর তো সময় নেই ভাবি
– আজতো শুক্রবার ও নামাজে যাবেনা ?
– ভাইয়া অলরেডি চলে গেছে
– আচ্ছা, তাহলে আমি নামাজ পড়ে রেডি হচ্ছি
– থ্যাংক ইউ ভাবি

বেরোনোর আগে বিদায় নিতে গেলে রেহানা বেগম অনিমার হাতে দুটো সোনার বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন
– এটা আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন আমি আমার বড় বউকে দেবো বলে এত বছর ধরে তুলে রেখেছিলাম আজ তোমাকে দিয়ে শান্তি পেলাম I

অনিমা দেখল অনেক পুরনো ডিজাইন I অ্যান্টিক জুয়েলারি অনিমার ভীষণ প্রিয় I অনিমা বালা দুটো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল I তারপর বলল
– আমার খুব পছন্দ হয়েছে
রেহানা বেগম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
– যাও মা I তাড়াতাড়ি ফিরে এসো

একটু দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে ও সময় স্বল্পতার কারণে ওদের বসুন্ধরা মার্কেটে যেতে হলো I

– কিছু খাবে অনিমা ? ভেতরে ঢুকে জানতে চাইল মুনির I
– না , আমি তো অনেক কিছু খেলাম সকালে I তুমি কিছু খাও I তোমার তো খাওয়া হয়নি সকাল থেকে I আমি বরং কফি খাই তোমার সাথে I
মুনির একটু অবাক হলো I আসলেই ব্যস্ততার কারণে সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি Iকিন্তু সেটা অনিমা কি করে বুঝলI অনিমা নিজেই বলল
– তুমি তো এত সকালে কিছু খাও না আর আসার পর তোমাকে কিছু খেতেও দেখলাম না I চলো তাহলে আগে কিছু খাবেI
মুনির একটু হাসলো I শুক্রবার বলে টপ ফ্লোরের ফুড কোর্ট এ দারুন ভির I স্বচ্ছ রেলিং ঘেঁষেএকটা দুই সিটের টেবিল পেয়ে গেল ওরা I এই টেবিলগুলো এত ছোট যে দুজন হাত ও রাখা যায়না I মুনির চিকেন স্যান্ডউইচ আর দুটো ক্যাপাচিনো অর্ডার করলো I অনিমা অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য উসখুস করছিল

-মুনির তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল
– কি ? হোটেল এর ব্যাপারে ?
– না, বিয়ের ব্যাপারে
-বল
– তুমি বিয়েটা কেন করছ ? শুধুমাত্র আমাকে সাহায্য করার জন্য ?
– কি করলে তোমার মনে হবে যে সাহায্য করার জন্য বিয়ে করছি না ?
– তাহলে কেন করছ ?
-তুমি কি এই বিয়েটা করতে চাইছো না ?
– না
– আচ্ছা ঠিক আছে I তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব এর একটার ও অ্যানসার যদি ‘না হয় তাহলে আমি আর কখনো তোমাকে বিয়ের কথা বলবো না
– কি প্রশ্ন ?
– তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো ?
– দেখো ব্যাপারটা বিশ্বাসের না ..
– YES OR NO ?
– হ্যাঁ করি
– তোমার কি মনে হয় তুমি আর সেঁজুতি আমার সঙ্গে ভালো থাকবে ?
– ব্যাপারটা সেটা না
– অনিমা হ্যাঁ অথবা না এ জবাব দাও
– হ্যাঁ
– তুমি কি কখনো আমাকে ভালোবেসেছিলে ?
অনিমা বিদ্যুৎ বেগে উঠে দাঁড়ালো তারপর বলল
-THAT’S ENOUGH . আমি তোমার স্টুডেন্ট নই যে তুমি আমাকে এখানে বসিয়ে ভাইবা নেবে I
মুনির হাসতে হাসতে বলল
– আচ্ছা আচ্ছা I এটা আউট অফ সিলেবাস ছিল শুধু তোমাকে রাগানোর জন্য I প্লিজ বস I

অনিমা বসলোI মুনির বলল

-এটাই লাস্ট কোশ্চেন I আমি যদি এখন তোমাকে বলি আমার কঠিন কোন অসুখ হয়েছে আমি আর কয়েক বছরের মধ্যেই মারা যাবো আমি আমার জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তোমার সঙ্গে থাকতে চাই তাহলে কি তুমি বিয়েতে রাজি হবে নাকি তখন ও ভাববে আমি তোমাকে দয়া করছি I

অনিমার মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল I চোখ ছল ছল করে উঠলো I অনিমা হাত তুলে চোখ মুছেতে যাবে তার আগেই মুনির ওর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল I অনিমার গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে I মুনির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলI ওর বিশ্বাস হচ্ছে না অনিমা ওর জন্য কাঁদছে I
কয়েক মুহুর্ত পর মুনির ওর হাতদুটো ছেড়ে দিল তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল
-এবার বল তুমি কি বিয়ে করতে চাও ?
– হ্যাঁ চাই I
-গুড I ফর ইউর ইনফর্মেশন আমার কোন কিছুই হয়নি I তুমি কোন মৃত্যুপথযাত্রী লোককে বিয়ে করছ না I
– আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না
মনির হেসে ফেললো
– একটু আগেই তুমি বলেছ যে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো

অনিমা জবাব দিল না I বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল I মুনির উঠে খাবার আনতে চলে গেল I মুনির ফোন নিয়ে যায়নি I ফোনের আলো টা হঠাৎ করে জ্বলে নিভে গেল I হয়ত কোন মেসেজ এসেছে I অনিমা তাকিয়ে দেখল ওর ফোনের হোম স্ক্রিনে একটা মেয়ের ছবি I সমুদ্রের ধারে I সম্ভবত কক্সবাজারে হবে I ওর বউয়ের ছবি কি ? নিশ্চয়ই হানিমুন করতে গিয়েছিল I এতই যদি প্রেম বউ এর জন্য তাহলে আবার বিয়ে করার দরকার কি I অসহ্য I

পর্ব 18.2

অনিমা সেদিনের ধকলটা নিতে পারল না I রাত গভীর হতেই ওর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল I পুরো তিন দিন ধরে জ্বর রইল I এই তিন দিনে ও শুধুই মুনিরের কথা ভাবল I খুব ইচ্ছা হল ওর সঙ্গে কথা বলতে I ওর একটা ফোন থাকলে বেশ হত I আচ্ছা অনিমা যদি ওকে একটা ফোন কিনে দেয় ও কি নেবে ? মনে হয় নেবে না I হাসিব ওকে বই কিনে দিতে চেয়েছিল ও তাই নেয় নি I তবে অনিমা একটা ব্যাপার বুঝে গেছে I মুনির কে ছাড়া ও থাকতে পারবে না I হয়তো মুনির ওকে এখন ভালোবাসে না একসময় নিশ্চয়ই ভালবাসবে I অনিমা ঠিক করে ফেলেছে ও মুনির কে ওর মনের কথা জানাবে I ও তো কিছু চাইছি না শুধু নিজের অনুভূতিটাই বলবে I

এরমধ্যে একদিন হাসান সাহেব এলেন অনিমা কে দেখতে I অনিমা বেশ অবাক হলো I ওর জ্বর হলে উনি কখনো আসেন না I মিঠু খেলার কাছ থেকে খোঁজ নেন I হাসান সাহেব একটু ইতঃস্তত করে ভেতরে এসে বললেন
– এখন শরীর কেমন ?
– জি ভালো
– তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল
– জি
– আমার বন্ধুর ছেলে এসেছে আমেরিকা থেকে তিন সপ্তাহের জন্য I বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে I আমি চাই তুমি একবার ওর সঙ্গে দেখা কর I ওর যদি তোমাকে পছন্দ হয় তাহলে ..

অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I ওর নিজের পছন্দ অপছন্দের কোন গুরুত্ব
নেই

– আমি এখন বিয়ে করতে চাই না বাবা
– না চাইলে করবেনা কিন্তু একবার দেখা করে এসো

অনিমা জবাব দিল না I ওর মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল I
– ছেলে খুব ভালো I দেখতে সুন্দর I ইঞ্জিনিয়ার I ওখানেই বড় হয়েছে I এখনই যেতে পারলে তোমার পড়াশোনাটা ওখানেই শেষ করতে পারতে I
– আমি এখানেই পড়াশোনা শেষ করতে চাই
– আচ্ছা আচ্ছা এখন বিয়ে করতে না চাইলে করো না
– থ্যাংক ইউ বাবা

হাসান সাহেব চলে গেলেন I অনিমা উঠে আলমারি থেকে একটা বই বের করল I ও ঠিক করল কালকেই মুনিরের সঙ্গে কথা বলবে I

চলবে…..

লেখনীতে

অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here