গল্পঃ #সোনালী [০১]
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
‘আজ থেকে ১৭ বছর আগে বিমান দূর্ঘটনায় এই দেশেই আমি আমার দুই সন্তানকে হারিয়েছি! আমার ছেলে সন্তানটা আমার কোলেই লাশ হয়েছিলো কিন্তু আমার মেয়েটাকে আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমার বিশ্বাস সে এখনো বেঁচে আছে, প্লিজ স্যার আমাকে খুঁজতে সাহায্য করুন।
দিয়ালী নামক একজন ভীনদেশী মধ্যবয়স্কা রমণী শহরের বিরাট ব্যবসায়ী শাহরিয়ার কবিরের সামনে বসে এক নিঃশ্বাসে উপরের কথাগুলো বললো। পাশেই তার ছেলে তাসফিক রোজান আড়চোখা হয়ে কথাগুলো অদ্ভুতভাবে নিচ্ছে, সে এমন পরিপাটি একজন মানুষের থেকে এমন কথাবার্তা গ্রহণ করতে যেন সম্পূর্ণ নারাজ।
তবুও তার কথা শেষ হতেই রোজান তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘ বিমান দূর্ঘটনা! সেখানে আপনি কি করে বেঁচে আছেন? আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি একজন ভীনদেশী হয়ে এতো সুন্দর বাংলা কি করে বলছেন?
দিয়ালী নামক মধ্যবয়সী মহিলাটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
‘ আমি গত ১৭ বছরের ১০ বছরই যে বাংলাদেশে কাটিয়েছি, শুধু আমার মেয়ের সন্ধানে! এর মধ্যে আমি বাংলাদেশের সবকিছুই শিখে গেছি।
আর তুমি দূর্ঘটনাটাকে যেমন ভাবছো এটা এমন ছিলনা। এক মেরু অঞ্চলে পাইলট প্লেন ল্যান্ড করতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু ভেতরের মানুষজন একে উপরের ছিটকে পড়ে, কয়েকজন গুরুতর আহত হয়ে পরবর্তীতে ভেতরেই মৃত্যুবরণ করে।
আবার অনেকেই পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, অজ্ঞান হওয়ার মধ্যে আমিও ছিলাম! আমার কোলে শক্ত করে আমার ছেলে সুজানিতকে ধরে রেখেছিলাম, সে শ্বাস আটকে আমার কোলেই গত হয়!
সেখান থেকে সুস্থ অবস্থায় থাকা ব্যক্তিরা কোনোভাবে বাংলাদেশের প্রশাসন পর্যন্ত সাহায্য চাইতে সফল হয়। তারপর আইনী লোকজন আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে সিটিতে নিয়ে আসে! আমাদের রাষ্ট্রশাসনের নির্দেশে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দেশে প্রেরণ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়।
শুধু আমি চোখ খুলে দেখি আমার আর কেউ নেই, আমি একা হয়ে গেছি, নিজ চোখে ছেলের লাশ দেখলাম! চোখ খুলেই ভীষণ পাগলামি করতে থাকলাম আমার ৪ বছরের মেয়েটার জন্য। কিন্তু ওরা বলে ওর লাশ কোথাও পায়নি! সেবার আমাকে জোর করে দেশে প্রেরণ করা হয়, কিছুদিনের মাথায় আমি আবার বাংলাদেশে আসি, ওই অঞ্চলে তন্নতন্ন করে খোঁজ নেই, টিভিতে প্রচার করি, সংবাদপত্রে প্রচার করি কিন্তু কোথাও পাইনি!
বলেই মহিলা অফিসের টেবিলে কনুই ভর করে ফোঁপাতে থাকে। এবার রোজানের টনক নড়লো। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এখন তো মনে হয় সেই মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। ২১ বছর বয়স!
তার বাবা মাথা নাড়লো!
আর দিয়ালী মাথা উপরে তুলে বললো,
‘ হ্যাঁ তার একুশ বছর দুইমাস আজ! জানিনা আমার মেয়ে কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কার কাছে আছে?!
রোজান কলম দিয়ে নিজের মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললো,
‘ ম্যাম এমনও হতে পারে সে সত্যিই সেই যাত্রায় মারা গিয়েছিলো!
রোজানের কথা শেষ না হতেই দিয়ালী রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাত উঁচিয়ে বললেন,
‘ নাহ এই অলক্ষুণে কথাটা সম্ভাবনার ছলেও বলবেনা। আমার মেয়ে আছে, আমি ঠিক একদিন ওকে পাবো, আমার শূন্য বুকে সেদিন সারা দুনিয়ার পূর্ণতা জড়ো হবে!
রোজানের বাবা কবির মিটমিট করে হেসে বললেন,
‘ আমাদের লোকজন সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে ম্যাম, আপনি চাচ্ছেন আপনার মেয়ের কোনো খোঁজ পেলে যেন তারা আপনাকে জানায় তাইতো? ঠিকানা দিয়েন, ওরা জানাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ওকে চেনার উপায় কি?
দিয়ালী নিজের চুলে হাত রেখে বললো,
‘ এই যে চুল! আমার মেয়ের চুল একদম চকচকে সোনালী! আমার চুলের মতো এমন ধূসর নয়! তার চোখ নীল, পাতলা নাক, ঠোঁট জোড়া যেন রক্তজবার পাপড়ি, হালকা গোল মুখ, এবং একদম ধবধবে ফর্সা গায়ের রং।
রোজান হাসতে হাসতে বললো,
‘ তেতাল্লিশ বছর বয়সে আপনিই যদি এতো অপরূপা হন, আপনার মেয়ে যে কেমন হবে ধারণা করতে পারছি। তবে বাংলাদেশেও এমন বৈশিষ্টের অসংখ্য মেয়ে আছে! আচ্ছা ঠিক আছে এরপরও আমাদের লোকজনদের জানিয়ে দিবো এমন কাউকে পেলে কল করতে। আর ছবি দেখালে আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন?
দিয়ালী চিন্তিত চোখে বললো,
‘ ওর পিঠের ঠিক মাঝামাঝি একটা জন্মদাগ আছে! দাগটা ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্রের মতো।
এটাই ওকে চেনার একমাত্র প্রমাণ হতে পারে।
রোজান চেয়ার ঠেলে উঠে বললো,
‘ ঠিক আছে, সেসব পরবর্তীতে দেখা যাবে।
দিয়ালী আলতো হাসির সাথে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে নিজের ঠিকানা টেবিলে দেখে দ্রুত জায়গা প্রস্থান করলো।
রোজান বাইরের দিকে যেতে চাচ্ছিলো, দিয়ালী বেরুনোর পরে সে থেমে তার বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ বাবা আজকাল নিখোঁজ সংবাদ তোমার কাছে আসে কেন?
কবির সাহেব হাসতে হাসতে বললো,
‘ এই মহিলার রুক্ষমূর্তি অবস্থা দেখে এই কথা বলছো রোজান? কিন্তু তুমি কি জানো উনি কতো বড় মাপের একজন ব্যবসায়ী? তার প্রোপার্টির কাছে আমাদের সবকিছু বিশ অংশের এক অংশ কেবল, হাহাহা!
রোজান ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বললো,
‘ ওই মেয়েকে সত্যিই আমরা খুঁজে দিতে পারলে তো বিরাট কোনো উপহার পেতে যাচ্ছি, যা আমাদের এসবেরও অনেক ঊর্ধ্বে!
কবির সাহেব হেসে বললো,
‘ তোমার বাবা সবসময় সুক্ষ্মজ্ঞানে চলাফেরা করে রোজান! এমনি এমনি একজন সাধারণ ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি এই পর্যন্ত আসেনি।
রোজান মাথা নাড়াতে নাড়াতে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। তার মাথায় ঘুরছে সোনালী চুল! সেই মেয়ের চুল চকচকে সোনালী, নীল চোখ! নিশ্চয়ই এক নিমিষে দৃষ্টি থামিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দরী! এই মেয়েকে একবার দেখার জন্য হলেও খুঁজতে হবে। বেঁচে থাকলে রোজান তাকে খুঁজে বের করবেই! মনে মনে যেন শপথ করে ফেললো।
এদিকে দিন যায়, সপ্তাহ যায় কিন্তু এমন মেয়ের কোনো সন্ধানই নেই। রোজান এবং অন্যরা কৃত্রিম রঙ করা চুল দেখেছে, নীল চোখ দেখেছে, আবার প্রকৃতি প্রদত্ত রুক্ষ সোনালী চুলও দেখেছে, কিন্তু চকচকে কিংবা সাথে অন্যকিছুর মিল পাওয়াকে দুষ্কর বলেই মেনে নিলো । মানে একই মানুষের মধ্যে দিয়ালীর বলা সবগুলো বৈশিষ্ট কোথাও নেই। এদিকে সেই মেয়েটাকে খোঁজার ব্যপারে রোজানের আগ্রহও কমতে থাকে। কবির সাহেবও বুঝেছেন এমন মেয়ে তারা বাংলাদেশে পাবেন না। তার উপর পিঠে ইন্দোনেশিয়ার মতো মানচিত্র থাকতে হবে! দিয়ালীও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়, সে একে একে দেশের সব জায়গায় মেয়েকে খুঁজে দেওয়ার নোটিশ দিয়ে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত এটাও ঘোষণা করেছে, যে খুঁজে দিতে পারবে তাকে তার অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে দিবে!
এদিকে দিয়ালীর স্বামী জানতো দিয়ালী আর মা হতে পারবেনা, তার ছেলে হওয়ার পরবর্তীতে এক অপারেশনে দিয়ালী সেই ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই দিয়ালীর স্বামী সেই বিমান দূর্ঘটনা পর পরে সে যখন পুরোপুরি এলোমেলো, তখনি সে তাকে ছেড়ে ২য় বিয়ে করে নেয়। দিয়ালী অবশ্য এসবে একদম ভ্রুক্ষেপ করেনি। এদিকে তার পিতার একমাত্র মেয়ে হিসেবে বিরাট প্রোপার্টির মালিক হয়! তার বাবা চেয়েছিল সে আবার বিয়ে করুক! কিন্তু দিয়ালী নিঃসন্তান জীবনটা আর কারো সাথে বাঁধাতে চায়নি। তার সম্পত্তি, নতুন পুরনো সব ব্যবসা দেখাশোনার জন্য অসংখ্য লোক লাগিয়ে রেখেছে, তারাই সবকিছুর দেখাশোনা করে, দিয়ালী শুধু হিসাব ঠিকঠাক বুঝে নেয়। আর সে মেয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের এ প্রান্ত ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায়।
‘কবির সাহেবের সাথে দিয়ালীর দেখা হওয়ার প্রায় সাড়ে সাতমাস পর!’
কবির সাহেবের অফিসের একমাত্র বিশ্বস্ত তথ্য সংরক্ষণকারী জাফর আব্দুল মান্নানের বিয়ের অনুষ্ঠানে সে তার বস মানে কবির সাহেবের পুরো পরিবারকে স্পেশাল নিমন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কবির সাহেবের হার্টের অসুখটার কবলে পড়ে বর্তমানে দিল্লি অবস্থান করছেন।
এদিকে বিয়ের দিন রোজান অফিসে না গেলেও তার মাকে একা যাওয়ার অনুরোধ করছিলো, কিন্তু মান্নান নিজের বিয়েরদিন দুপুর ১২ টায় চলে আসে তাদেরকে নিয়ে যাবে বলে। যেভাবেই হোক রোজানকে যেতেই হবে। এদিকে জামাই নিজে নিতে আসছে, না গেলে কেমন দেখায়?
হয়তো মান্নান বুঝেছিলো রোজান নাও যেতে পারে!
অতঃপর এক প্রকার বাধ্য হয়েই রোজান শ্যূট কোট পরে বের হয়।
অনুষ্ঠান শুরুর অনেকটা আগে আগেই তারা সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। কেননা খুব কাছেই বিশাল একটা কমিউনিটির সেন্টারে মান্নান বিয়ের আয়োজন করেছে।
রোজানদের সেখানে নিয়ে গিয়েই সে তৈরি হবে।
সেখানে পৌঁছাতেই রোজানের মা মহিলা সমাবেশে গিয়ে কুশলাদি আর গল্পগুজবে হারিয়ে গেলেন। মান্নানকেও তৈরি হতে ভেতরে নিয়ে গেছে। এদিকে রোজান ফোন হাতে অসহায়ের মতো অফিসের তথ্যাদিই ঘাঁটছে! মানুষজন সাজসজ্জা নিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। রোজান বহুজনের পায়ের ছায়া দেখছে, কিন্তু মুখ তুলছেনা। তার বাবার শরীর নিয়েও তার মধ্যে অনেক চিন্তা, এর ভেতর আজকে অফিসে তিনজন প্রধান দায়িত্বের মানুষরাই অনুপস্থিত, সহকারীরাও অনেকে এসেছে, রোজানই তাদের ছুটি দিয়েছে। আবার অনেকে ইচ্ছে করেই আসেনি আর ছুটিও নেয়নি, তারা ছুটি জমাচ্ছে।
রোজানের এখানে একা একটু অস্বস্তি লাগছে, এসির ভেতরেও তার কেমন যেন গরম লাগছে! ফোনটা পকেটে রেখে সে মাথাটা সোজা করলো। তখনি তাকে পাশ কেটে একটা অদ্ভুত বাতাস ছুঁয়ে গেলো! রোজান দ্রুত পাশে তাকাতেই দেখলো, মসৃণ পাতলা একটা আকাশের রঙের আঁচল তার পাশে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আসলে একটা মানুষের সাথে এটা উড়ছে, কেউ একজন দৌঁড়ে সামনে যাচ্ছে। রোজান চোখগুলো দ্রুত সেই আঁচলের মালিকের উপর ফেলতেই চমকে উঠলো। খোঁপা করা চুলের নিচে বড় গলার ব্লাউজে আধ ঢাকা এক উম্মুক্ত পিঠ, মাঝ বরাবর আঁকাবাকাঁ কালো দাগ! এটা জন্মদাগ? ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্র? কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্র কেমন রোজান এই মূহুর্তে মনে করতে পারছেনা। রোজানের সারা শরীর অদ্ভুত শিহরণে ছেঁয়ে গেলো।
চলবে……