নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৯|
লেখা : মান্নাত মিম
“ধর, ধর শা* রে ধর।”
নন্দিতা যেন হাতের তালুতে নিজের জান-প্রাণ, মান-সম্মান নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। বেঁচে ফিরতে পারলেই হলো। কিন্তু নাহ, ভাগ্যে যেন আজ অন্যকিছুই রেখে ছিল। রাতের গভীরতা ঠাওর করতে পারছে না সে। হাতে মোবাইল, ব্যাগ কিছুই নেই। সবকিছু তো নিশির কাছে দিয়েছিল। কয়েক পলেই সন্ধ্যার তারায় রাতের পরশ তৈরি হলো। নিশি যে তার ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে কোথায় উধাও হলো অনুষ্ঠান ছেড়ে, তাকে খুঁজতে গিয়েই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। নিশির নাকি ক্লাসমেটের জন্মদিন, সেই উপলক্ষে তার ডিপার্টমেন্টের ক’জনকে নিয়ে ছোটোখাটো পার্টি দিবে। সেজন্যই আসা আজকের পার্টিতে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল এটা! এদিকের রাস্তাঘাটে আজ যেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার আর নিঝুম নেমে এসেছে। পুরুষের সাথে কতক্ষণ দৌড়ে পারা যায়, তাও আবার এতগুলোর সাথে। পিচঢালা পথের কিনারায় থাকা ঝোপে মুখ চেপে বসে আছে নন্দিতা। ছয়জন মুখোশ পরা দুর্বৃত্ত কিছুক্ষণ পাইচারি করে নন্দিতাকে না পেয়ে চলে গেল। সেটা দেখে নন্দিতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বুদ্ধি দিয়ে আরো সময় কিছুটা চুপ করে বসে রইল, দেখতে চাইল কেউ কি আবার তাকে খুঁজতে আসে কি না। নাহ, কেউ না এলে সে এবার মুখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বের হয়। দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় এসে পড়ল বুঝতে কিছুটা সময় চলে গেল। পায়ের অবস্থাও নাজুক, গতিমন্থর। মেঘেরডাক শোনা যাচ্ছে, আকাশে পুঞ্জীভূত কালো মেঘরাশি চাঁদ’কে আড়াল করে নিলো। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে, ডানের রাস্তায় হাঁটা ধরবে নাকি যে পথে এসেছিল অর্থাৎ বামে যাবে। তবে মনের মধ্যে বামের রাস্তা নিয়ে দ্বিধা কাজ করছে। যদি সেখানে দুর্বৃত্তরা তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতে থাকে। দোমনা করে বামদিকের উজ্জ্বলতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটা ধরল ডানের রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে নাকাল অবস্থা নন্দিতার, তারচেয়েও বেশি করুণাবস্থা মুখশ্রীর, লালাভা ছেয়ে মুখ জুড়ে নোনাজলের রাশি। এদিকে রাস্তা যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। আরো কিছুদূর হাঁটার পর মনে হলো সামনে থেকে আলোর হদিস দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে দেখল গাড়ির হেডলাইটের আলোর ঝলকানি। সেই ঝলকানিতে নন্দিতার কোমল মুখশশীতে আনন্দের বান ছুটলো। নারীর জানের চেয়ে আত্মসম্মান বড়ো। মৃত্যু ঢের ভালো আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হওয়া থেকে। আজ কতো বড়ো বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে পারল ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গাড়িটা থামানোর জন্য হাত দিয়ে সংকেত করার আগেই গাড়িটা তার পায়ের কাছে এসে থামল। কিছুটা অবাক হতে দেখা গেল তাকে। গাড়ির থেকে কারো বের হওয়ার খবরই নেই, অথচ থেমে আছে সেটা। নন্দিতার কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না। মন বলছে, কিছু খারাবি হতে চলছে তার সাথে। কিছুক্ষণ আগের আনন্দ’টা মাঠে মারা গেল। সেটার রেশটা একটুকরো কালো মেঘের রাশির মতো মনের সুখটাকে পূর্ণগ্রাস করে ফেলল। ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নন্দিতার স্নিগ্ধ, মসৃণ, উজ্জ্বল বদনখানিকে মলিনে পরিণত করল। লেপ্টে থাকা শাড়ির ভেতরের ঢেকে থাকা অগভীরতার গভীরতাকে প্রকাশ করতে ব্যস্ত। তখনই গাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে স্বয়ং যমদূত কাইয়ূম খান।
_____
“কোথায় পেলি ভাই এটাকে?”
বন্ধু সায়েম কথাটা বলতে দেরি থাপ্পড়ের শব্দে স্তব্ধতার পর্দা ভেদ করে নিরবতা বিরাজমান ভাঙতে দেরি নয়।
“যেখানে তোরা এটাকে না পেয়ে চলে এসেছিস।”
অতঃপর নয়তলার নয় নম্বর ফ্ল্যাটে কারো আর্তনাদের চিৎকারের শব্দের সাক্ষী হলো দেয়ালগুলো। অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নন্দিতা। তবুও অজ্ঞান হওয়ার ওপরই চলে পাশবিক নির্যাতন। রূপের সৌন্দর্যের শেষটুকু সুধা পর্যন্ত বিষাক্ত মুখ দিয়ে শুষে নেওয়ার তাড়া সাতজন নরপশুদের। ধর্ষিতার সিল লাগিয়ে চাহিদা মিটে এলে মৃত্যু দিতে ফেলে আসার পায়তারা চলে তাদের মধ্যে। কিন্তু কাইয়ূম কারো অপেক্ষায় থাকে যার জন্য নন্দিতার জ্ঞান ফিরানোর ব্যবস্থা করতে বলে বন্ধু রিফাতকে। যে কি না একজন ডাক্তার।
“কিরে কার অপেক্ষায়?”
“দাঁড়া না মজা দেখ। ভোজন শেষে মিষ্টিমুখের অপেক্ষায়।”
ফোন কান থেকে নামিয়ে কথাগুলো বলেই এগিয়ে গেল ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নন্দিতাকে রাখার রুমে এগিয়ে গেল আগন্তুক ব্যক্তিটি। হাইহিলের খুটখুট শব্দে আধো-আধো চোখ মেলে এই খেলার রচয়িতাকে দেখে বিস্মিত হওয়ার অবকাশ পায় না। এরচেয়ে বুঝি মৃত্যু শ্রেয়তর।
“কোথায় যেন শুনেছিলাম, যখন ধর্ষণ নিশ্চিত। তখন সেটা এনজয় করা উচিত।”
কুটিলতার উর্ধ্বে ছাড়িয়ে হাসির দমকে পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হওয়ার মতো অবস্থা নিশির। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে নন্দিতার। বাতাসের গায়ে যেন বিষাক্ত গ্যাস বহমান। বুক-ও জ্বালাপোড়া করছে ভীষণ। প্রার্থনায় ডাকছে, “হে খোদা! মৃত্যু দাও।” কিন্তু মনে হয় রঙ্গোলীলার আরো বাকি ছিল হয়তোবা তারই আরো বেশি তীক্ষ্ণ ফলার বর্শার আঘাত সহ্য করার বাকি।
“অবাক লাগছে না? স্বাভাবিক, আমি যে কে তোমার! প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কম বোন বেশি। কিন্তু তুই হলি সেই নরপিশাচের রক্তের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যে কি না আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এবং কি আমার মা’কেও পরকীয়ায় লিপ্তকারী৷”
এমনিতেই সারা শরীর জুড়ে অশান্ত ব্যথার হানাহানি। এরমধ্যে নিশির চিৎকার করে বলা কথাগুলো তানপুরার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে বাজছে। কিন্তু বোধগম্য এসবের উর্ধ্বে। তার বাবা, যাকে কি না সে সবচেয়ে ভালোবাসে। স্বাভাবিকই একজন মেয়ের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হলেন পিতা বা বাবা। তারপর আসে স্বামী। কিন্তু এখানে সবকিছু কেন উলটো প্রতিফলিত হচ্ছে? তার কি মাথা ঘুরছে নাকি? মুখ দিয়ে শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে, তারউপর আবার নিশির বলা কথাগুলোকে মিথ্যা সাবস্ত করবে তার জন্যও একটু জোর নেই। হয়তো নিশি সেটা ধরতে পেরেছে তাই মুচকি হাসি দিয়ে পাশেই রাখা সোফায় পায়ের ওপর পা রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলল,
“মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বা ভুলভাল বকছি। উঁহু, একদমই না। কথার সত্যিটা একমাত্র তোকে জানাই ঠিকাছে? তোর বাবার আন্ডারে থেকে আমার বাবা কাজ করত। তোর বাপ অসাধুভাবে ব্যবসা করত। আমার বাবা সেটা দেখে ফেলে সেজন্য তাকে মরতে হলো। আর তাকে হত্যা করার পেছনে কার হাত বুঝতে অসুবিধা নেই তো? এখন আসে আমার মায়ের পরকীয়ার বিষয়টা। তবে এখানে মজার বিষয়, যেটা কেউ-ই জানে না। সেটা হলো আমার মা আত্মহত্যা করেনি, তাকে মেরেছি আমি। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে নাম দিয়েছি আত্মহত্যার। সর্বশেষ এবং ফাইনাল ইন্টারেস্টিং বিষয় অবগত হও বেবস। তোর এই ধর্ষণের পিছনে আমার হাত কিন্তু, কাইয়ূম’কে তোর পিছনে লাগানোও। অবশ্য সেজন্য আমাকে তার হাতে তুলে দিতে হয়েছে, তবুও আমার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট নেই, তোকে এ-অবস্থায় দেখে শান্তি লাগছে। পোষে রাখা এত বছরের কষ্টের শান্তি উসুল হলো। এতশত প্লানিং করে, প্রতিশোধ নেওয়া সার্থক হলো অবশেষে। এন্ড আ’ম স্যাটিসফাইড।”
রিলাক্স মোডে হাত-পা ছড়িয়ে নিশি সোফায় বসল, যেন সে সত্যিই বেশ বড়ো ধরনের কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পাশে থাকা কাইয়ূমের হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিয়ে মুখে দিলো। নন্দিতার যেন নিশির বলা একটা কথাও বিশ্বাস হলোই না উলটো সবকিছু মাথায় ওপর দিয়ে চলে গেল। মনে মনে চাইছে, স্বপ্ন হোক এটা, মিথ্যে হোক সকল কথা আর ব্যথা। নাহ, তাতো হবার নয়। বাবার অপকর্মের শাস্তি হয়তো সন্তান’রা এভাবেই পায়। ধীরে ধীরে অসাড়তা তৈরি হচ্ছে মনে-প্রাণে-দেহে। মাঝে মাঝে কিছু স্মৃতি বদ্ধ চোখের পাতায় খেলা করছে। মা’য়ের, বাবার এবং সবচেয়ে বেশি নিশির সাথে কাটানোর মুহূর্তগুলোর।
চলবে…