নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৪|
লেখা : মান্নাত মিম
রেস্টুরেন্টের কাচের গ্লাস ভেদ করে অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপণের মাধ্যমে প্রিয়জনের জন্য প্রতীক্ষার উত্তেজনায় আজ দ্রুতবেগে হৃৎস্পন্দনে অনুকার শব্দ তৈরি হচ্ছে। এমন তো নয় আগেও আফরোজা বেগমের সাথে লায়লা বেগমের বন্ধুত্বের খাতিরে বহুবার পলকের সাথে দেখা হয়েছে। তখন থেকেই কিশোরী মনে কখন জানি নিজ অজান্তে পলক নামক পুরুষের নাম খোদাই করা হয়েছে। তবুও অতীতে মনের কথা চেপে রেখেছিল কিন্তু আজ যে কি না ভবিতব্য স্বামীর আসনে বসবে, তাকে দেখে অবনত মুখও লজ্জালু হয়ে গেছে।
“তাে বলো, কেমন আছ?”
এটা কেমন কথা হলো? পলক’দের বাসায় তো প্রায়শই আসা-যাওয়া হচ্ছে নন্দিতার খোঁজে। সেটা কি দেখে না সম্মুখে বসে থাকা অবুঝ ছেলেটা? তাও কেমন আছ- ডেটে এসে এটা জিজ্ঞেস করার বিষয় হলো? অসুস্থ হলে কি সে এখানে আসত নাকি? উপরন্তু এতক্ষণ আগে এসে অপেক্ষা করার জন্য কোনো কমপ্লিমেন্ট-ও করল না! মনে মনে তুলোধুনো করল পলক’কে। তথাপি সম্মুখে কিছু বলার জন্য রাগান্বিত হয়ে সেটা বলতে মুখে রোচল না। তাই গাল ফুলিয়ে অভিমানী মুখ করে রাখলে, ক্যাবলাকান্ত তার ভাব তো বুঝলই না উলটে বলল,
“ওহ্হ! ভুল হয়ে গেছে। অর্ডার দিয়ে নেই আগে। বলো কী নেবে?”
তোমাকে নেব, সেটা তো আর বলতে পারবে না বিধায় পছন্দের খাবারের অর্ডার-ই দেওয়া হলো। খাবার আসার আগ পর্যন্ত কথা বলার সুযোগ থাকলেও গর্দভটা কোনো কথাই বলছে না; নিজ স্বগোতক্তিতে বলা কথা এবার মুখ নিঃসৃত করে ফেলে ফারজানা,
“কী হলো, কিছুই বলছ না যে?”
আমতাআমতা করে প্রত্যুক্তিতে পলকের জবাব,
“কেমন আছ?”
বলেই চুপ হয়ে গেল হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছুক্ষণ আগেই কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা আবার এখনও করল বোকার মতো। পলকের বিষয়টা খারাপ লাগছে, ধরতে গেলে অফিসের দুপুরের লাঞ্চ ফারজানার সাথে করার হুকুম তালিমের পেছনে লায়লা বেগমের হাত। বাড়িতে সে থাকেই বা কতক্ষণ? সেজন্য লায়লা বেগম পলক’কে বাইরেও ফারজানার সাথে অল্প সময় কাটানোর মাধ্যমে দু’জনকে ভালো-মন্দ, নিজেদের মাঝে বোঝা-পড়ার ভিত্তিগুলো ভালো করে তৈরি করার জন্য বলেছেন। যার দরুন আজ ফারজানার অভিমুখে বসা। কিন্তু সে মা-বোন ব্যতিত কখনো কোনো মেয়ের সাথে ভালো-মন্দ তো দূরে থাক, ফিরেও তাকায়নি অতিরঞ্জিত কারণ ছাড়া। সেখানে যখন থেকে শুনেছে ফারজানার সাথে বিয়ের কথা, তখন থেকেই নার্ভাসনেস কাজ করছে তার মধ্যে। কিন্তু ইদানীং মনের মধ্যে নারীঘটিত বিষয় হাঁসফাঁস করছে, অথচ মস্তিষ্ক সে- বিষয়ে নির্বাক, নিশ্চল, স্থির।
এদিকে ফারজানা ভাবছে, এই ছেলেকে দিয়ে প্রেম বা ভালোবাসা আশাই করা মুশকিল৷ উলটো দেখা যাবে বাসর রাতে যা করার তাকেই করতে হবে। ফোঁস করে ভেতরে জমা মন খারাপের প্রশ্বাস নির্গতকরণের মাধ্যমে সেটাকে হালকা করার প্রয়াস চালনা করার মাঝেই পলকের প্রশ্ন কর্ণগোচর হলো।
“আমার একটা বিষয় জানার ছিল, অবশ্য বিষয়টা নন্দিতাকে নিয়ে।”
স্বতস্ফুর্তভাবে কথা-বার্তা তাে হলোই না উলটো নন্দিতার বিষয়ে আলাপচারিতা শুরু হলো; মুখ বাকিয়ে মন-ই মনে বললেও সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তির মুখের ওপরে কথাটা উগরে দিতে পারল না। তাও ভালো মেয়েটাকে সে নিজের জন্য লাকি ভাবে। কারণ মেয়েটা আসার পর-ই বা মেয়েটার জন্যই পলক’কে পাচ্ছে, সাথে বিয়ের আগে কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে। সেজন্যই তো বুদ্ধি করে আফরোজা বেগমকে বলেছে পুলিশকে বিষয়টা না জানাতে সাথে পত্রিকায় মেয়েটার ছবি-ও ছাপাতে বারণ করেছে। হোক না একটু স্বার্থপর, তাতে যদি নিজের ভালো নিহিত থাকে; তাহলে সেটাই সঠিকের সমতূল্য। ভালোবাসায় সবকিছুই জায়েজ। এ নিয়ে তো বিশ্ব বিখ্যাত প্রবাদ-ও রয়েছে, “এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।” পলক’কে পেতে সে ভবিষ্যতে নিচুমানের কাজ করতেও পিছ পা হবে না। মাথায় ভূত চেপেছে, আর সেটা অবশ্যই ভালোবাসার।
“বলো, কী জানতে চাচ্ছ?”
টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে পলক জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলল,
“মেয়েটার নাম যে নন্দিতা জানলে কীভাবে?”
যদি-ও পলকের অন্য মেয়েকে নিয়ে কৌতুহলী দিকটা ভালো লাগছে না শুনতে, কারণ সে-ও একটা মেয়ে তবুও মুখে মুচকি হেসে কণ্ঠে রহস্যময় মিশ্রণ করে ফারজানা বলে,
“কেন নামটা নিয়ে এতো কৌতুহল যে?”
“আরেহ, বিষয়টা সহজই। মেয়েটা তো প্রথম থেকেই বোবাকালার মতো বিহেভ করেছে। অবশ্য মেয়েটাই বলেছে, কিন্তু কথাটা তার মুখ দিয়ে বের করলে কীভাবে? সেখানে তার নামটা জানা আশ্চর্যকর লাগল। তাই জিজ্ঞেস করা।”
পলকের কণ্ঠে বিরক্তি ঝেরে পড়ে। বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে ফারজানা-ও প্রসঙ্গ বদলে ফেলে বলে,
“নন্দিতাকে সেদিন বন্ধুত্বের নাম করেও কথা বলাতে পারিনি। দুপুরে খাবার খাওয়াতে গিয়েছিলাম, এই তো কয়েকদিন আগেই। তুমি তো বেশিরভাগ সময় অফিসেই কাটাও, তাই বাড়ির অধিকাংশ খবর-ই তোমার অজানা। তোমাদের বাসায় সেদিন অনেক সময় নিয়ে গিয়েছি, কারণ সায়মা….. থাক বললাম না সেটা টপ সিক্রেট। তো সেদিন দুপুরে নন্দিতাকে নিজ হাতে খাওয়ার উদ্দেশ্যে গিয়ে ঘুমানো অবস্থা। মুখে আঁচড় কাটার কর থেকেই মন-মেজাজ তীক্ষ্ণ হয়ে আছে মেয়েটার প্রতি। তাই গমগমে গলায় ডেকে ওঠি, “এই মেয়ে, এই ওঠো” বলে। মনে হয় সম্ভবত ভয় পেয়েছিল। ধড়ফড়িয়ে ওঠে রাগান্বিত হয়ে মাথার বালিশ ছুঁড়ে ফেলে বলে ওঠে, “আমার নাম এই মেয়ে না, নন্দিতা আমার নাম। বুঝলে?” এই হলো নন্দিতা নাম জানার পেছনে পরিশ্রমের কাহিনি।”
দম ছাড়ল সবটা বলে অতঃপর সামনে থাকা কোল্ড ড্রিংক পান করল। সামনে তাকিয়ে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে আছে পলক। সুযোগের সদ্য ব্যবহারে আলতো হাত স্পর্শ করাল পুরুষালি শক্ত চামড়ার ওপর। ধ্যান ভঙ্গুর হলো পলকের নরম, মসৃণ, কোমল হাতের স্পর্শে। রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলা মানুষের সমাগমের শব্দ কাচ ভেদ করে আসছে না বিধায় ফারজানার স্পর্শসহ বলা কথা তীক্ষ্ণ ফলার মতো কানে বিঁধে ধ্যান ভঙ্গুর হলো।
“কী ভাবছ বলো তো?”
“তেমন কিছু না। তবে নন্দিতাকে ন্যায় দেওয়ার একটা চেষ্টা করার চিন্তা করছি।”
অতিরিক্ত মানব দরদ দেখানোর আয়াসটা ফারজানার পছন্দ তো হলোই না, উলটো মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
“তোমার এত ন্যায় দেওয়ার তাগিদ কেন?”
কথাটা শুনে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিক্ষেপে পলক দেখতে পেল, ফারজানার ওই নিকষ কালো কিন্তু সচ্ছ চোখে মেদুর আভা।
“চলো, এবার ওঠি।”
হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে ফারজানা ব্যক্ত করল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর?”
“তোমার প্রশ্নটা তুমি নিজেকে করে দেখ তো।”
পলকের কণ্ঠে হালকা রোষের আভাস। আসলেই পরে খেয়াল হলো, মেয়ে হয়ে কীভাবে ভুল প্রশ্নটা করে ফেলল? ভেতরকার ক্ষোভ বাইরে বেরিয়ে পলক’কে দগ্ধ করার জন্য ফারজানা নিজেকে নিজেই কয়েকবার দোষী করল। পলক’কে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তার-ও নেই; কিছুক্ষণ আওড়াল কথাটা। অতঃপর অভিমুখী হয়ে বসা পলক’কে অবনত মস্তিষ্ক দুঃখিত শব্দ ব্যবহারে ক্ষমার আশা করল। পলক সেটা সহজ চোখে দেখে তাকে বোঝাতে লাগল,
“দেখ, মেয়েটাকে আমরা যে হালতে পেয়েছি; সেটা ভাবলে এখনো গায়ের পশম কাটা দিয়ে ওঠে। তুমি নিজেকে সেখানে ভেবে দেখত? জিনিসটা কত পীড়াদায়ক! ধর্ষণ এখনকার সময়ে ছকবাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনেই বেশ কয়েক স্থানে রোজকার নিয়মে ধর্ষণের খবর পেপারে ছাপবেই। অনেক জনগণ এখনো সেটাকে রসিয়ে রসিয়ে আমুদেপনায় তৈরি করে গরম চায়ে চুমুক দেয়। তো কেউ সেটাকে এমন প্রতিদিন দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এগিয়ে এসে কেউ ধর্ষিতার সম্ভ্রম ঢাকতে যায় না। সেখানে অন্তত আমি একজনকে-ও তো তার সম্ভ্রম হারানোর বিচারের ব্যবস্থা করে দিতে পারব। এখন তুমি চেষ্টা করো, নন্দিতার কাছ থেকে ধর্ষণের ঘটনা-টা জানতে। আমাদের ঘটনাটা জানা আবশ্যক। সেটা পুলিশের কাছে জানাতে হবে। ভয় দূর করে আগে নন্দিতার কাছ থেকে জানো পরে সেটা পুলিশের কাছে আমরা বলতে পারব।”
বিমুগ্ধ হয়ে পলকের ব্যাখ্যাত কথাগুলো শুনলেও মনের কোণে ভয় উঁকি দিল, যখন খেয়ালই খেয়াল হলো; এসবে জড়ালে জীবন অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। বিষয়টা জানানোর আর সময় পেল না ফারজানা পলক ওঠে চলে গেল কিছু খাবার বাড়ির জন্য প্যাকেট করে বিল পেমেন্ট করতে।
_______
আকাশে ভাসমান জলাধর বাতাসে ভর করে শূন্যে বিচরণ করছে। পাখি তার পক্ষোদ্ভেদ দ্বারা তাদের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে। নির্বিঘ্নে একমনে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে বিন্দুমাত্র ক্লান্তিবোধ করছে না নন্দিতা। কারণ আজ বহুদিন পর খোলা হাওয়ার আবেশে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার উপযোগী অবসর সময় যে পেয়েছে। সুস্থতা শারীরিক দিক দিয়ে হলেও মানষিক দিক দিয়ে এখনো তাকে অসুস্থতায় ঘিরে রেখেছে। কয়েক দিন পরেই পলক’দের বাড়ি হয়ে ওঠবে জমজমাট সাজে সজ্জিত। তখন তো এভাবে ছাদে আসার সময় কিংবা সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠবে না। একতলা ছাদযুক্ত, বেশ বড়োও না আবার ছোটোও না অর্থাৎ মাঝারি আকার নিয়ে গঠিত উঠান বাড়ি পলক’দের। বাউন্ডারি দেওয়া রেলিঙে শ্যাওলার আবরণে চিড় ধরেছে কিছুটা, পুরোনো বলেই হয়তো। নিশ্বাস দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো, পুরোনো হলে জিনিসে ফাটল ধরে অথচ অল্প বয়সেই নিজের মধ্যে কতকিছুই না বয়ে বেড়াচ্ছে সে; ভেবে ফের উদাসীন হয়ে দূর পানে নির্বাক চাহনি দিলো।
“নন্দিতা, এই নেও পেয়ারা খাও।”
পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল ফারজানা এসেছে। আজকাল মেয়েটার সাথে তার ভারি অন্তরঙ্গতা বেড়েছে। সায়মার সাথেও বেড়েছে তবে সে বেশিরভাগ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হবু স্বামী বলে কথা; ভেবে মুচকি হেসে উঠল। নন্দিতার হাসি দেখে ফারজানা সংকীর্ণমনা হয়ে বলল,
“হাসির রহস্য কী?”
মাথা নেড়ে নাবোধক সম্মতি জানালে ফারজানা জেদ ধরে জানার ইচ্ছা পোষণ করলে, মনে বলা কথাটা বাতলে দেয় নন্দিতা। এমন সময় ছাদের সিঁড়ির দিকে এক ছায়ামূর্তি সরে দাঁড়ায়। আজ কতকাল পর এভাবে হাসল নন্দিতা ভাবল খানেক সময়। হাসি-কান্না নিয়ে যে একজন মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা সেটা প্রায় ভুলেই বসেছে সে। কিছুক্ষণ সময় অতিবহিত করে নিম্নগামী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
“এগুলো আজ রেস্টুরেন্ট থেকে ভাইয়া প্যাকেট করে বাসার জন্য নিয়ে এসেছে।”
সবার সাথে এখনো স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে৷ তবুও আজ ব্যতিক্রম ডিনার দেখে প্রশ্ন করেই ফেলে নন্দিতা। সে সম্পূর্ণ বিষয় জানে না সায়মা-দের পরিবার সম্পর্কে, যেটা এখন পলকের সাথে ফারজানার বিয়ে হওয়ার কথা সায়মার বিয়ের পরেই হবে জানতে পারল। লায়লা বেগম, পলক, সায়মা এই তিনজনের পরিবারে ফারজানাকে জানত তার ডাক্তার হিসেবে। এখন নতুন করে জ্ঞান হলো পলকের ভবিতব্য স্ত্রী হওয়ার বিষয়। নিজের রুমে বসেই ডিনার সারল নন্দিতা। বেশি একটা বের হয় না রুম থেকে। তখন তো আরো আগে বের হয় না, যখন ছুটির দিনগুলো পলক বাড়ি থাকে। স্বাভাবিকতায় ভয় পায় পুরুষ মানুষ। মনের মাঝে যে, তাদের নিয়ে তৈরি মন্দ ভাবনা তৈরি হয়েছে সেগুলো তড়িৎগতিতে তো আর ভোলা যায় না। কথায় আছে, “একজনের কারণে আজ দশজন খারাপ।” কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, একজন দোষী নয় সেই দশজন নিজের ভালোর গণ্ডি পেরিয়ে আরো খারাপের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।
“চলার পথে, ভালোর সাথে—
কখনো খারাপ লুকায়িত থাকে।
নিজের মাঝে যদি ধরে না রাখো ভালো,
অন্ধকার রাতে ছড়াতে পারবে না আলো;
হইয়ো গভীর আঁধার কালো।”
চলবে…