#নিশুতি_তিথি,পর্ব ৪,৫
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৪
___________
৭.
নানাবাড়িতে কেমন চুপচাপ সিঁটিয়ে থাকে আঞ্জুমান। না কারো সাথে কথা বলে আর না রুম থেকে বেশি একটা বের হয়। মামাতো ভাই-বোন’দের সাথেও ততোটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। কারণ নানা বাড়ির আর সকলের মতো ছোট-বড়ো মামাতো ভাই-বোনরা-ও তাকে অপয়া, অলক্ষুণে মেয়ে বলে ভাবে। যে কি না জন্মের সময় তার মা’কে খেয়ে ফেলেছে বলে তাদের ধারণা। সকলের এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদী ধর্ম আঞ্জুমানের কিশোরী মনে খুব গভীরভাবে ছাপ ফেলছে। যার কারণে আঞ্জুমান নিজের দুরন্তপনা, হাসিখুশি, উচ্ছলতা নিয়ে ঘুরে ফিরে আনন্দঘন বেলাগুলো হারিয়ে ফেলছে। নিজের মধ্যে সেসব আঁটকে রেখে কেবল সখি লিপির সাথেই খানিকটা উচ্ছাসতা পেশ করে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে, তার লেখাপড়া বন্ধের মাধ্যমে। লেখাপড়ার গুরুত্বটা বেচারির জন্য সিলগালা করে বন্ধ করে দিয়েছে। দাদা ও নানা বাড়ির মধ্যে কোনো রকম সুতোর মতো ছিঁড়ে যাওয়া শুধু একটুখানি ঝুলন্ত সম্পর্ক। সেই সুবাদেই আসা-যাওয়া আঞ্জুমানের তাও বেশিদিন থাকা যাবে না বলে আজ বিকেলে ছোটে ভাই এসে তাকে নিয়ে যাবে। সখি লিপির সাথে আবার কবে না কবে দেখা হয় জানা নেই তার। তাই একটু বাইরে বের হওয়ার চিন্তাভাবনা করছে আঞ্জুমান। যেই ভাবা সেই কাজ লিপির বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
মন্দ ভাগ্য একেই বলে বোধহয়। লিপিকে পাওয়া গেল না। লিমন জানালো, লিপি কাজে গেছে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। বেরিয়ে এলো লিপিদের বাড়ি থেকে। মন খারাপ নিয়ে একটু নিজের মতো করে একা সময় কাটাতে মন চাচ্ছে আঞ্জুমানের। হাঁটতে হাঁটতে সেদিনের পুকুর ঘাটে এসে সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে। কেন জানি আজ একটু কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মন কেমন কেমন অনুভূতি ধারণ করেছে, জানা নেই। হয়তো মনের কোণে জমে থাকা কষ্টরা উপচে পড়ে বেরিয়ে আসার পায়তারা করছে। আজ কেন এত চাওয়ার যোগ হলো জানা নেই কিন্তু জানা আছে কান্নাদের উগড়ে ফেলার ইচ্ছেটা। তার মন বলছে,
‘আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে বোধহয় জীবনটা অন্যরকমই হতো। এভাবে হেলায়ফেলায় দিন কাটাতে হতো না আর না সকলের অভিশাপ শুনতে শুনতে একবুক কষ্ট বাসা বাঁধত মন কোণে।’
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শব্দ তুলে ভিজিয়ে দিচ্ছে আঞ্জুমানের ক্রদনরত মুখশশী। এ যেন বৃষ্টির আড়াল করার ইচ্ছে আঞ্জুমানের কান্নাকে আর ধুয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার বেদনাবিধুর মনকে। বিমূঢ় চিত্তে বেশ কিছুক্ষণ সময় দমকা বৃষ্টির স্রোতে নিজের গা ভাসাল সে। অতঃপর ঝপাৎ শব্দ তুলে পুকুরের পানিতে নেমে পড়ল। অনেক সময় ধরে তাকে পানির ওপর ভাসতে না দেখে এবার যেন উন্মাদনা কাজ শুরু করল আলীর মনে। বদ্ধপরিকর হয়ে আঞ্জুমানের আত্মহনন করার পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়ে সে-ও ঝপাৎ শব্দ তুলে পানিতে নেমে পড়ল। সাঁতরে সাঁতরে ডুবে থাকা আঞ্জুমানকে টেনে ডাঙায় তুলল। সাঁতার জানা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা আঞ্জুমানের নাকেমুখে পানির প্রবেশ বেশ একটা ছিল না উপরন্তু আলী-ও দ্রুতই উঠিয়ে এনেছে। তাই পেটে অল্প-অল্প চাপ প্রয়োগ করতেই কাশি ওঠে সল্প পরিমাণ পানি মুখ নিসৃত হয়ে হুঁশ ফিরে আঞ্জুমানের। তাকে সোজা করে বসিয়েই গালে চপেটাঘাত করে আলী। গালে হাত রেখে নিভুনিভু হতভম্ব হওয়া মুখশশীতে কালো নির্লিপ্ত স্তব্ধতা গ্রাস করে আঞ্জুমানের। সাথে কানে-মাথায় ভোঁভোঁ শব্দ করে থাপ্পড় খাওয়ার কারণ জানার পোকা কিলবিল করতে থাকে। এরমধ্যে ভেতরে ভেতরে বাঁধভাঙা কান্নারা নোনাজলের ফোয়ারা ছুটিয়ে আসতে চায় অক্ষিপট থেকে। কোনোমতে নাক ফুলিয়ে আঁটকে তাদের সংবরণ করছে আঞ্জুমান। আলী এতক্ষণ যাবৎ তার রাগ মিশ্রিত কান্নার আনুষ্ঠানিকতার তোড়জোড় উপভোগ করছিল বৃষ্টির উদ্যমতার সাথে। আঞ্জুমান বয়সের অনুকূলে থাকলেও আলীর অনুভূতিরা তখন তুঙ্গভদ্র। সে আঞ্জুমানের এমন রূপে অভিভূত, আবিষ্ট। অচৈতন্য মোহগ্রস্তের মতো পাজাকোলে তুলে নেয় আঞ্জুমানকে। হতচকিত আঞ্জুমান বৃষ্টির তোড়ে ঠিকমতো চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না, তাহলে সে দেখতে পেত তার জীবনের ধেয়ে আসা সর্বগ্রাসী সর্বনাশ’কে।
৮.
রিমা বাবার বাড়ি এসেছে দু’দিন হলো। সেই কখন থেকে আলীর ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে অথচ বরাবরই ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। যদি-ও জানে বৃষ্টির কারণে হচ্ছে এমন। তবুও মন টানছে না, কোনো অশুভ সংকেত তাকে ভীত করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে, যার অর্থবোধক তাৎপর্য সে বের করতে পারছে না। তাই সেই কখন থেকে ফোন বন্ধ জানা সত্ত্বেও কলের ওপর কল দিয়েই যাচ্ছে, এই বুঝি ফোনটা তুলে আলী। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু’ই বলে যাচ্ছে ফোনের অপাশে থাকা সুমধুর কণ্ঠী নারী। রিমাকে ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করে রুমের এ-মাথা ও-মাথা করতে দেখে এতক্ষণ যাবৎ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো ভাবি সামিয়া। এগিয়ে এসে রিমার পিছনে দাঁড়িয়ে সে বলল,
‘কী গো ননদিনী এমন অস্থির হয়ে আছ কেন?’
ছোটো ভাবির সাথে গলায় গলায় ভাব রিমার। বাকি দুই ভাবির সাথেও ভালো সম্পর্ক, তাঁরা-ও রিমাকে যথেষ্ট আদরযত্ন করেন; তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুপূর্ণ সম্পর্ক হলে খোলামেলা যেসব আলাপ করার মতো সেসব কেবল এই ছোটো ভাবি সামিয়ার সাথেই হয়। এতে অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। হয়তো সামিয়া তার সমবয়সী বলে কিংবা তার স্বামী বিদেশ থাকে বলে। যাইহোক আপাতত নিজের এই অস্থিরতা বলার জন্য কাউকে পেয়ে যাওয়ায় মনটা অর্ধেক চাপমুক্ত হয়ে হালকা অনুভব হলো।
‘ভাবি দেখো না ও আমার ফোনটা ধরছে না।’
রিমার কম্পনরত গলায় কান্নার ঝোঁক শুনতে পেল সামিয়া। এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বিছানায় বসিয়ে রিমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,
‘তো অস্থির হচ্ছো কেন? আবার দেও।’
তবুও সেই অস্থিরচিত্তে রিমা ফের তার ভাবিকে শোধায়,
‘ফোন তো বন্ধ বলছে।’
‘দেখ মেয়ের কাণ্ড। এজন্যই তো ফোন ধরছে না আলী। সে কি জানে নাকি তার বধূয়া ফোন করতে করতে পাগলপ্রায়।’
বলেই হেসে ফেলল সামিয়া। তার হাসি দেখে রিমা কালো মুখ করে বলল,
‘মজা নিবে না তো। মনটা কেমন কেমন জানি করছে আর তুমি আছ মজা নিয়ে।’
রিমার থুতনিতে ডানহাত দুই-আঙুলে উঁচু করে ধরে রসিকতাপূর্ণ কণ্ঠে সামিয়া বলল,
‘তা কেমন কেমন লাগে শুনি? কাছে পাওয়ার আকুলতা নাকি বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়ে গরম শরীরের সাথে মিশে নরম শরীরে উষ্ণতা নেওয়া, কোনটা?’
‘যাও, জানি না।’
লজ্জায় দু-হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফেলে রিমা। তখন সামিয়া তার ঢেকে থাকা মুখ থেকে হাত দু’টো সরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘বাব্বাহ! বিয়ের ছয় বছর হয়ে এলো। তাও এত প্রেম! তোমরা পারোও বটে।’
সামিয়ার কথায় আকস্মিকভাবে মন খারাপের পরতটা আরো ভারি হয়ে এলো। সেটা সম্ভবত সামিয়ার চোখে এড়ালো না তাই সে কথা ঘুরাতে বলল,
‘আচ্ছা, ছাড়ো সেসব। দু’দিন হলো ঘুরে এলে, তোমাকে হাতের কাছে পেলামই না। বলো তো এবার আলী ভাইয়ের আদরযত্ন কেমন খেলে?’
ইশারায় সামিয়াকে এগিয়ে আসতে বলল রিমা। অর্থাৎ কানে কানে হবে সকল কথা। সামিয়া-ও খুশি মনে হাসি মুখে এগিয়ে গেল আগ্রহী শ্রোতার ন্যায়। তখন রিমা তার ভাবির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বাতি নিভানো বন্ধ ঘরে, অল্প খোলা জানালার ফাঁক গলে আবছা আলোতে আমার ভাই তোমায় যেভাবে আদর করে, তুমি-ও সানন্দে তা যেমন গ্রহণ করো। আমার বেলায়ও তাই মনে করো।’
রিমার কথা শুনে হাসি হাসি মুখ করে তাদের গল্প শোনার ইচ্ছেটাই মরে গেল সামিয়ার। মুখ পাংশুটে করে রেখে বলল,
‘যাও যাও, মেয়ে বজ্জাত হয়ে গেছে। আমার কথা আমার ওপরেই এপ্লাই করছ। হুহ্!’
একবার সামিয়ার বাসর ঘরের কথা জানতে চাওয়ায় সামিয়া তাকে এই কথাই বলেছিল। তাই আজ সে-ও সুযোগে সেটাই বলে দিলো সামিয়াকে। উচ্চস্বরে খিলখিল করে হেসে এগিয়ে জড়িয়ে ধরল রিমা তার ভাবিকে। কিন্তু মনে সেই অশুভ সংকেত ডাকা পাখি ডেকেই চলেছে অবধারে। না জানি কোন তছনছ করার খেলায় নেমেছে এই ঝড়।
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৫
___________
৯.
বিশাল বড়োবাড়ি নামক বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে লাগছে আঞ্জুমানের কাছে। এত বড়ো বাড়ি অথচ থাকার মতো নাকি কোনো মানুষই এপর্যন্ত তার চোখে ঠেকল না! এটা আদৌ কোনে বাড়ি কি না সন্দেহ হচ্ছে তার। পুরোনো যুগের জমিদারের বাড়ির মতো মনে হচ্ছে, একদম সুনশান-নিস্তব্ধ। এই বুঝি সময়-অসময়ে তাঁদের আত্মারা এসে ভর করবে আঞ্জুমানের ওপর। তখন আবার চিৎকার করেও কাছে পাবে না বদ লোকটাকে। লোকটা সেই যে তখন আঞ্জুমান এনে একপ্রকার রুমে রেখে গেল, তারপর মাঝ দিয়ে শুধু একবার শাড়ি এনে হাতে ধরিয়ে মুখ ফুটে দুটো শব্দ উচ্চারণ করল,
‘শাড়িটা পাল্টে নে।’
ব্যস! তারপর থেকেই উধাও। তখন যা কাঁপছিল না সে একদম মৃগী রোগীর মতো। তবে সেটা ঠান্ডায় নাকি ভয়ে বলা মুশকিল। ভয়ের দিকের জোড়’ই বেশি হবে হয়তো। সে বর্তমানে এখন নিজেকে রাজপ্রাসাদের কারাগারে বন্দিনীর মতো মনে করছে। জানালায় তাকিয়ে বৃষ্টির প্রকোপ পরখ করে দেখে নিলো। বৃষ্টির কোনো থামাথামি নেই, ভাবল; এই বৃষ্টি কাল পর্যন্তও থামে নাকি সন্দেহ আছে, তাহলে বাড়ি যাবে কীভাবে? ভাই-ও তো মনে হয় নিতে আসতে পারবে না এরমধ্যে। ভাবনার অন্তরাতে এসে বিঘ্ন ঘটায় কাজের লোক করিম মিয়া।
‘ছোটো সাহেব আপনারে ডাকে।’
রিমা শিক্ষিত মেয়ে বিধায় মাঝেমধ্যে এখানে আসা-যাওয়ায় করিম মিয়ার সাথেও কথাবার্তা হয়। সেই সুবাদে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলার করিম মিয়াকে শাসিয়ে রিম তাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার জন্য আদেশ দেয়। নাহলে চাকরি যাবে। সেই ভয়ে করিম মিয়াও যথেষ্ট চেষ্টা করে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করতে, সেখানে অবশ্য আলী’ই তাকে সাহায্য করেছে। এদিকে আলীকে পাছে সবাই বড়োলোক বউয়ের গোলাম বলে। সেদিকে আলীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার ধারণা সে বউয়ের নয়, টাকার গোলাম। আসলে পৃথিবীটা’ই টাকার গোলাম সেখানে বসবাসরত মানুষ তো আর সেটার বিপক্ষে যাবে না। পারতপক্ষে তারা আরো বেশি মুখিয়ে থাকে অর্থকড়ি মুঠোভরতি করতে। এ-যেন যজ্ঞের ধন। আজকাল রাস্তাঘাটের ভিক্ষুক’দেরও পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় না। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে, কখন থালায় বড়ো লোক’দের পকেট খসিয়ে শ’পাঁচেকের নোট পড়বে। যাইহোক ছোটো সাহেব বলতে কাকে সম্মোধন করে গেল করিম মিয়া আঞ্জুমানের সেটা বোধগম্য হলো না। যেই ডাকুক আপাতত নিচে যাওয়া উচিত সাহেব বলেছে যেহেতু তাহলে বাড়ির একজন কর্তা গোছের লোক তো হবেই। সেই ভাবনা থেকেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো আঞ্জুমান। ডুপ্লেক্সের বাড়িটাতে নিচের গেট বরাবর বড়ো হলরুম, কাজের লোকদের থাকার জন্য দুয়েকটা রুম ছাড়া নিচে আর কোনো রুম নেই। বাড়ির লোকদের থাকার আর মেহমান’দের থাকার রুম সব ওপরেই। সেখানের’ই এক গেস্টরুমে আঞ্জুমানকে নিয়ে গিয়েছিল আলী। হলরুমের মাঝে সোফাসেট আর রান্নাঘর ডানদিকে সেখানে অবস্থান ডাইনিং টেবিলের। বামদিক দিয়ে এসেছে ওপর তলার সিঁড়ি। নিচে নেমে আঞ্জুমান ডানদিকে তাকালে রান্নাঘরের সামনের ডাইনিং-এ পায় আলীকে। আলী তার আসার আভাস পায়নি। তা দেখে দুরুদুরু কাঁপন্ত বুক নিয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে যায় আঞ্জুমান সেদিকে। তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের সজাগ মানুষ আলী আঞ্জুমানের এগিয়ে আসার আভাস পায়। যার ফলে মুখ উঁচিয়ে তার দিকে দৃষ্টি ফেরায় যা কি না এতক্ষণ খাবারের দিকে ছিল। এদিকে করিম মিয়া রান্নাঘর থেকে সকল খাবার ডাইনিং-এ সাজিয়ে রাখা শেষ করে আলীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘সাহেব, যাই?’
চোখের ইশারায় সায় দিলে করিম মিয়া কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কিছু পল থম মেরে দাঁড়িয়ে চলে যায় গেট দিয়ে। তার চলে যাওয়ার পর নিস্তব্ধতার ঝংকার নেমে আসে চারিপাশে। যেন একটা সুঁই পড়লেও বাজ পড়ার শব্দ তুলবে। কিন্তু নাহ, সুচের চেয়েও ধারালো ও শানিত গলায় আলী নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে বলল,
‘বস এখানে।’
সম্মুখে আলীর বরাবর বসার চেয়ার ইশারা করে আঞ্জুমানকে বসতে বলল। আঞ্জুমান তাও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেটা দেখে মেজাজ চওড়া হয়ে গেল আলীর। চাপা ধমকে বলল,
‘বসতে বলছি না। কথা কানে যায় না?’
যদি-ও ধমকটা হালকা পাতলা ছিল তবে সেটা নিস্পন্দতার ছন্দের তাল ছিঁড়ে গমগমে শোনাল। এমনিই আতঙ্কে জর্জরিত ছিল আঞ্জুমান এখন আলীর তীক্ষ্ণ ফলার উচ্চ শব্দে দেহে কাঁপন তুলল যেন। ভয়ে কাঁপতে থাকা আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে আলী নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা, শান্ত করার চেষ্টায় নামল সফলও হলো। শান্ত, কোমল স্বর নিয়ে আঞ্জুমানকে শোধাল,
‘বসছিস না কেন? ভয় কীসের? বাঘ-ভাল্লুকের আস্তানায় তো রেখে আসিনি তোকে। শুধু খাওয়ার জন্যই তো বসতে বলছি।’
শেষের কৌতুকপূর্ণ কথায় আঁড়চোখে তাকাল অবনত থাকা আঞ্জুমান। ভেবে দেখল, আপাতত বসেই পড়ি এত সুন্দর সুন্দর খাবার সম্মুখে রাখা। না খেলে আবার সৃষ্টিকর্তা নারাজ হবেন। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনার মাঝেই আলগোছে চেয়ার টেনে বসে পড়ল আঞ্জুমান। তাকে বসতে দেখে আলতো হাসল আলী। সম্মুখে এগিয়ে দিলো খাবারের প্লেট। অতঃপর আঞ্জুমানকে কোনো প্রকার অস্বস্তিতে না ফেলে নিজের খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলো। আলীকে চুপচাপ, নিরব হয়ে নিবিষ্ট মনে খাবার খেতে দেখে আঞ্জুমানের মনে সাহসের কিছুটা সঞ্চার হলো৷ সে হাত রাখল প্লেটে অতঃপর খাবার শুরু করল। খাবার মাঝে একসময় নিশ্চুপ অবস্থার পরিবর্তন হলো আলীর কথায়,
‘মরতে গিয়েছিলি কেন?’
তিন শব্দের কথায় কী ছিল কে জানে কিন্তু আঞ্জুমান কয়েক পল খাওয়া থামিয়ে বলে উঠল,
‘বাড়িত যাইতাম।’
এতক্ষণ যাবৎ আঞ্জুমানের বিমূঢ়তা কেটে বলা এই মাত্র দু’শব্দ আলীর কর্ণকুহরে মিষ্টি, সুমধুর শোনাল। আঞ্জুমানের নত হওয়া মুখশশীর পানে চেয়ে রইল সময় খানেক ধরে অতঃপর আঞ্জুমানের কথার বিরোধিতা করে বলল,
‘এখন তো রাত, তাও আবার উত্তাল হাওয়ার বেগে বৃষ্টি চলছে। যাওয়া সম্ভব না। আপাতত খেয়ে নে, পরে শক্তি পাবি সামাল দেওয়ার।’
রহস্যময় কথার পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্জুমান কেবল ‘খেয়ে নে’ কথাটাই মনে ধরে খাওয়া শুরু করল। বোকা, মাথামোটা মেয়েটার মাথায় শেষোক্ত কথার অর্থ ধরল না।
১০.
সকালের উজ্জীবিত সূর্যের তাপ সহনশীলতার মতো। তবে মানুষ কথার তাপের প্রখরতা বৃদ্ধিতে কুণ্ঠিতবোধ করে না। ঝাঁঝ মেশানো কটুক্তি করা যেন তাদের জন্মগত অধিকার, যা ইতিপূর্বে দেশ স্বাধীন করে স্বাধীন নাগরিকের অধিকারের চেয়েও বড়ো মনে হয়। এসবকিছু সেসব মূর্খ জনগণের কাছে গণ্য। যেমন এখন আলীর বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামীণ মানুষজন। খবরটা তাদের কানে পৌঁছানো মাত্রই শুরু হয় ছোটো থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ’দের হট্টগোল। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমে বিভোর থাকা আলীর কর্ণকুহর সেসব হট্টগোলের চ্যাঁচানো শুনেও নিবৃত্ত মনে বিনাশিত অবয়ব ঘুমে বিভোর হওয়ার প্রস্তুতি নেই।
‘লাজ-লইজ্জা বইলাও একখান কথা আছে নাকি।’
‘বলি হারি বাপু। চেয়ারম্যানের না হয় চরিত্রে দোষ আছে তা তো আমরা জানি’ই। তাই বইলা মাইয়াডারও কি মতিভ্রম হইল যে নিজেও….ছি ছি! আমার বলতেও লজ্জা লাগতাছে।’
গ্রামের লোকজন মুখ উঁচিয়ে থুতু ছিটাচ্ছে আর কথাগুলো বলছে।
‘মাইন-ইজ্জতের রইল না আরকিছু। এত বড়ো বাড়ি খালি দেইখা সেই সুযোগে জোয়ান দু’খান মাইয়া-পোলা কীসব নষ্টামি শুরু করছে, আমাদের গ্রাম পুরা নষ্ট কইরা ফালাইব। যাও কেউ গিয়া চেয়ারম্যান রে ডাক দিয়া লইয়াহো।’
মুরুব্বি গোছের একজন লোক কথাগুলো বলে আলীকে ডাকার জন্য লোক পাঠায়। এসবের মাঝে আঞ্জুমানের করুণ অবস্থা দেখার মতো। মানুষের মৃত্যু হলে যেমন দেখায়, একদম রক্তশূণ্য, স্থির, শান্ত। তেমনই দেখাচ্ছে তাকে। মনে হয় দেহ আছে শুধু আত্মা ছেড়ে দিয়েছে। সে অনুভূতি শূন্য, নিথর ফ্লোরে পড়ে থাকা লাশের মতো। গ্রামবাসী বিচার বসিয়েছে আলীর বাড়ির সামনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকা আঙিনায়। গ্রামের মাস্টার, সাথে মসজিদের ইমাম আরো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের আবির্ভাবও রয়েছে।
‘শুনো আলী মিয়া, তোমার ঘরে এই মাইয়ারে পাওয়া গেছে। বাড়িতে কেউ আছিল না। তুমি আর মাইয়া দু’জনই জোয়ান পোলাপাইন। তাও আবার রাইতে থাকছে মাইয়াটায়। সেইখানে তৃতীয় ব্যক্তি শয়তানের প্ররোচনায় যা কিছু হওয়ার তো হইয়া গেছে, ঠিক না?’
গ্রামেরই মুরুব্বি বিচারে বসে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন। সাথে সাথে ছোটো-বড়ো সকলেই ‘ঠিক, ঠিক’ করে আওয়াজ দিয়ে ওঠে। সকলেই নিজ নিজ তৈরি মতামত ব্যক্ত করল অথচ আঞ্জুমানের অভিমত তো দূরে থাক মেয়েটাকে দেখার জন্যও কেউ নেই। না তার পরিবার আর না এই সমাজের লোক। পরিবারের কথা বলতে গেলে, ‘নিজের জান নিজে বাঁচা’ ধরনের অবস্থা। আঞ্জুমানের এই বিধ্বস্ত ঘটনা নানা বাড়ি কর্ণগোচর হয়ে দাদা বাড়িও পৌঁছে যায়। তা সত্ত্বেও কেউ আঞ্জুমানকে বাঁচার তাগিদ দিতে এগিয়ে আসে না। উলটো নিজেদের সম্মান বাঁচানো মূখ্য হিসেবে গণ্য করে বলে,
‘যা ইচ্ছা করো গা। অপয়া মাইয়া যত নষ্টামির মইদ্দে থাকে। ও’র সাথে আমাগোর কোনো সম্পর্ক নাই। এ-মুখো যে আর না হয় কইয়া দিও।’
আরো নানা ধরনের কটুক্তি করে আঞ্জুমানের নামে যা গ্রামবাসীকে আরো বিষিয়ে তোলে। সেসব শুনেই আঞ্জুমানকে সকলে শাস্তি হিসেবে মাথার চুল কামিয়ে, মুখে কালি মেখে সারা গ্রাম ঘুরানোর প্রস্তাব রাখে। অথচ বিত্তশালী, ক্ষমতাবান আলীর শাস্তি কোথায়? এখানেও নারীর শাস্তি মূখ্য! কারণ কী? তারা অসহায়, নিপীড়িত, দূর্বল এবং তাদের জন্মই পুরুষদের পদতলে পিষ্ট হওয়ার জন্য হয়েছে বলে? কেন, কেন তারা কি আর সকলের মতো মানুষ নয়? তাদের দেহের গঠন, পুরুষদের বিপরীত লিঙ্গ হওয়াই সম্ভবত নারী জীবনের শাস্তি ও অভিশাপ স্বরূপ!
চলবে…