মন_গহীনে পর্ব_২৬/২৭/২৮/২৯/৩০শেষ পর্ব

মন_গহীনে পর্ব_২৬
#সামান্তা_সিমি
#

তুষার ভাইয়ার এমন আচমকা আগমন দেখে সবাই ভড়কে গেছে।সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে ফুপি।হালকা ধমকের সুরে বললেন,

” এত আওয়াজ তুলে দরজা খোলা লাগে?আয় ভেতরে আয়।”

তুষার ভাইয়া শান্ত ভঙ্গিতে ইয়াসির ভাইয়া যেখানে বসেছেন তার বিপরীত সোফায় বসে পড়লেন।মৃদু হেসে বললেন,

” কি খবর ইয়াসির! আছো কেমন?”

” আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন?”

” বেশ ভালো।মেয়ে দেখতে এসেছো বুঝি?”

তুষার ভাইয়ার প্রশ্নের ধরণ শুনে ইয়াসির ভাইয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।সাথে উনার বাবা মা ও।কিন্তু তুষার ভাইয়ার চেহারা হাসি হাসি।একমাত্র আমিই বোধ হয় আন্দাজ করতে পারছি উনার এই হাসি চেহারার অন্তরালে রাগ কিভাবে উপচে পড়ছে।
এদিকে ফুপি দাঁত কটমট করছে।অন্যদিকে আমি বসে আছি এক অসহায় প্রাণীর মত।
ফুপি ধমকের সুরে বললেন,

” তুই ভেতরের রুমে যা তুষার!এখানে কোনো কাজ নেই তোর।”

তুষার ভাইয়া অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠলেন।উনি কি উনার সাইকো রূপে ফিরে যাচ্ছেন নাকি।তাহলে তো এখানের প্রত্যেকেটা মানুষের উপর ঝড় বয়ে যাবে।

” আশ্চর্য তুই এভাবে হাসছিস কেনো?আমি কোনো হাসির কথা বলেছি?”

” অফকোর্স মা।যে মেয়েটাকে তিনটা বছর ধরে আমি আগলে রেখেছি,ছেলেদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখেছি,আমার ইচ্ছেমতো চলতে বাধ্য করেছি আজ তাকে দেখতে ছেলে পক্ষ চলে এসেছে অথচ আমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না।”

” তোর কথা কোথা থেকে গড়িয়ে কোথায় যাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না তুষার।”

ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতা।ইয়াসির ভাইয়া এবং উনার বাবা মা’য়ের কৌতূহলপূর্ণ তিনজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ফুপি এবং তুষার ভাইয়ার দিকে।আমার বাবারও একই অবস্থা।

তুষার ভাইয়া রাগে চাপা গর্জন করে বলে উঠলেন,
” কেনো বুঝতে পারবে না তুমি হুম?আমার মা হয়ে কেনো বুঝতে পারছো না যে নীলাশাকে আমি ভালোবাসি।”

নিঃশব্দে আরেকটা বাজ পড়ে গেল আমার মাথায়।হৃৎপিণ্ডটার ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
আড়চোখে সর্বপ্রথম আমি ফুপির মুখের দিকে তাকালাম।উনি এই মুহূর্তে ভুত দেখার মত চমকে আছেন।কিন্তু ফুপি তো ভূত দেখেনি।ভূতের মত একটা ভয়ানক কথা শুনে ধাক্কা খেয়েছেন।
অন্যদিকে ইয়াসির ভাইয়ার এবং উনার বাবা মা’য়ের মুখ ফ্যাকাসে।আমার কেনো জানি ইয়াসির ভাইয়ার শুকনো মুখটা দেখতে ভালো লাগছে।বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা বন্ধ হয়ে এবার খুশির চোটে ঢোল বাজছে।তুষার ভাইয়ার সাহসের তারিফ করতে হয়।কিভাবে এতগুলো মানুষের সামনে নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে দিল!আহ্! আমার মন তো খুশিতে বলতে চাইছে প্রেমিক হও তো তুষার ভাইয়ার মত হও।

নীরবতা ভেঙে ফুপি গলা খাদে নামিয়ে বললেন,
” এসব কি বলছিস তুই?”

” আমি যা বলার সরাসরি বলে দিয়েছি।তাই এটা নিয়ে অযথা প্রশ্ন করো না।”

ফুপি এবার গর্জে উঠলেন,
” ভালোবাসি বললেই হয়ে গেল, না?দেখ্ তুষার! এটা কোনো ছেলেখেলা ব্যাপার নয় যে তুই নিজের মনমতো কিছু একটা বলে বসবি আর আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটা মেনে নেব।”

” বিনা বাক্য ব্যয় করতে না করেছে কে?এখন তুমি কি করতে চাইছো বলো।ধমকাবে আমায়?বকবে?তাহলে তাই হোক।কিন্তু আমি আমার জায়গায় অটল। তিনটা বছর ধরে ওর জন্য মনের ভেতর ভালোবাসা সাজিয়ে এসেছি। ওকে নিয়ে কল্পনায় হাজারো স্বপ্নে ঘুরে বেরিয়েছি,ওকে ভেবে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। এগুলো তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? ”

তুষার ভাইয়া রাগে ফুঁসছেন।উনাকে দেখতে ভয়ানক লাগছে।উনি তাহলে চরম পর্যায়ে রেগে গেছেন।চোখের দিকেও তাকানো যাচ্ছে না।
সামনে বসা অতিথিরা নীরব দর্শকের মত ঘটনা উপভোগ করে যাচ্ছে।
আমার মনের ভেতর ঢোল বাজানো বন্ধ হয়ে এখন বিষাদের সুর বাজছে।ফুপি কি তাহলে ব্যাপারটা মেনে নেবে না?আমাদের দূরে ঠেলে দিবেন?তুষার ভাইয়াকে ছাড়া তো মরেই যাব আমি।

ফুপি রাগে কাঁপতে কাঁপতে আরো কিছু বলতে নিবেন তখনই বাবা উনাকে থামিয়ে দিল।পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বলল,

” আপা থেমে যাও।অতিথিদের সামনে এমন রাগারাগি না করাই ভালো।তুষার এবং নীলাশার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা পরে শান্ত হয়ে কথা বলব।”

বাবার কথায় ফুপি অনেকটাই শান্ত হলেন।কিন্তু মুখের কাঠিন্য এখনো মুছে নি।একটু পর পর চোখ গরম করে তাকাচ্ছেন নিজের ছেলের দিকে।কিন্তু তাঁর ছেলের সেদিকে কোনো তোয়াক্কা নেই।আয়েশ করে বসে মোবাইল চালাচ্ছে।

ইয়াসির ভাইয়ার বাবা বলে উঠলেন,
” আমরা তাহলে উঠছি।এখানে থেকে শুধু শুধু আপনাদের কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।”

আমার বাবা সৌজন্যতার সহিত বলল,
” এটা বলে আমাদেরই লজ্জা দিচ্ছেন ভাই।এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি আপনাদের কাছে।”

” ঠিক আছে তাহলে আমরা উঠি এখন।”

ইয়াসির ভাইয়ার বাবা মা বেরিয়ে গেলেন।কিন্তু ইয়াসির ভাইয়া বের হতে গিয়েও আবার পিছনে মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।উনার চোখে কেমন যেন উদভ্রান্ত ভাব।বুঝাই যাচ্ছে উনার মনের ভেতর কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া চলছে।
এই প্রথম উনি মুখ খুললেন এবং তুষার ভাইয়াকে বললেন,

” আপনি নীলাশাকে ভালোবাসেন এটা আমি জানতাম না ভাইয়া।এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে।আমিই আপনাদের মাঝে চলে এসেছি।আসলে এখানে ছোট্ট একটা কাহিনী আছে।পড়াশোনার জন্য আমি যখন চীন ছিলাম তখন যেকোনো ভ্যাকেশনে ঘনঘন বাসায় আসতাম।তো বিকেলে প্রায়ই ছাদে হাঁটতে যেতাম।তখন নীলাশাকেও ছাদে দেখা যেত।আমি যতদিন ছাদে গিয়েছি ততদিনই ওকে দেখতাম।প্রথমে ভেবেছি এটা একটা সাধারণ ঘটনা।কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি সে একমাত্র আমাকে দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে।তখন ভাবলাম হয়তোবা ওর মনে আমাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি আছে।শুরুতে এটা তেমন পাত্তা না দিলেও আস্তে আস্তে আমারও ওর প্রতি একটা ভালোলাগা জন্মাতে শুরু হলো।তবে সামনাসামনি কখনো কিছু বলিনি।কারণ আমি নিজেই কনফিউজড ছিলাম।যখন স্টাডি কমপ্লিট করে বাসায় আসলাম, মা জানতে চাইল কোনো পছন্দ আছে কিনা আমার।তখন হুট করেই নীলাশার নামটা বলে ফেললাম।আমি নিজেও বুঝিনি নীলশার নামটা এভাবে বলে ফেলব।এরপর থেকেই মা নীলাশাকে দেখতে আসার জন্য ছটফট করতে লাগল।আমি অনেকবার বলেছি যে নীলশার হয়তোবা আমাকে মনেই নেই।তাই শুধু শুধু এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা না ঘামানো ভালো।কিন্তু মা কোনো কথা শুনলো না।ধরে বেঁধে আজ এখানে নিয়ে আসলো।”

এটুকু বলে ইয়াসির ভাইয়া থামলেন।তুষার ভাইয়া একবারের জন্যও উনার দিকে তাকান নি।অথচ কথাগুলো তুষার ভাইয়ার উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে। মা বাবা এবং ফুপি এতক্ষণ উৎসুক হয়ে ইয়াসির ভাইয়ার কথা শুনছিলেন।উনি থামতে তাঁরা নড়েচড়ে বসলেন।এদিকে আমার অবস্থা শোচনীয়। ছাদ থেকে লুকিয়ে দেখার ব্যাপারটা এখানে না বললে কি হত না?লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে পুরো।তবে একদিক দিয়ে ভালো লাগছে যে ইয়াসির ভাইয়া সমস্ত বিষয়টা ক্লিয়ার করে দিচ্ছেন। কিন্তু তুষার ভাইয়ার হলো টা কি?উনি এখনো চুপ থাকবেন? অন্তত ইয়াসির ভাইয়াকে দুয়েকটা সান্ত্বনা মূলক কথা তো বলা উচিত।

ইয়াসির ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
” একটু আগে আপনার রাগ মিশ্রিত কথা আর জেদ দেখেই বুঝে গেছি নীলাশাকে নিয়ে আপনি কতটা ডেস্পারেট। আপনাদের জন্য শুভ কামনা রইল ভাইয়া।আসছি।”

ইয়াসির ভাইয়া চলে গেলেন।এবার উনার জন্য একটু খারাপ লাগছে।আমি তো ভেবেছিলাম উনি আমার লাভ স্টোরিতে ভিলেন হয়ে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু না উনি তো বাংলা ছায়াছবির বাপ্পারাজের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলেন।

ছি ছি এসব কি বলছি আমি।ইয়াসির ভাইয়া একজন ভালো মনের মানুষ। উনাকে নিয়ে এসব বলা একদম ঠিক নয়।আল্লাহ উনার জন্য একটা ভালো,ভদ্র এবং শিক্ষিত পাত্রী এনে দিও।

তুষার ভাইয়া ফোন পকেটে ঢুুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।উনার ভাবভঙ্গি দেখে ভালোমন্দ কিছুই বুঝার উপায় নেই।উনি এত স্বাভাবিক আছেন কিভাবে?একটু আগেই চিল্লিয়ে চোখ রাঙিয়ে তুমুল কান্ড বাঁধিয়েছিলেন।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,
” অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি।এখন যেতে হবে।অফিস থেকে আমার বাপজান অনবরত কল দিচ্ছে। মা দুপুরে কিন্তু আমি বাসায় লাঞ্চ করব।এক কাজ করো তো!আজ আমার পছন্দের আইটেম টা রান্না করে ফেলো!আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব কেমন!”

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তুষার ভাইয়া বের হয়ে গেলেন।আমি পুরো নির্বাক।উনি এত অদ্ভুত কেনো?ফুপি উনার উপর রেগে বোম্ব হয়ে আছে আর উনি বলছেন পছন্দের আইটেম রান্না করতে।মানে কিভাবে সম্ভব!

ফুপি কাঁদকাঁদ হয়ে বললেন,
” কি ছেলে পেটে ধরেছি আমি।নিজের মা’য়ের রাগ অভিমানকেও গায়ে মাখে না।তোমাদের সামনে আজ আমায় ছোট করে দিল।সে নাকি ভালোবাসে! পিটিয়ে ওর পিঠের ছাল তুলে দেব আমি।ওর বাবা আসুক আজ।”

” আপা মাথা গরম করো না।দুলাভাই আসলে আমরা এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলব।তাছাড়া এটা এমন কোনো কঠিন সমস্যা নয় যে এত হম্বিতম্বি করতে হবে।সব ঠিক হয়ে যাবে।নীলাশা তুমি এখন রুমে যাও।”

বাবার কথামতো চলে আসলাম রুমে। আমার মাথাটা ভনভন করছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।তুষার ভাইয়া পারেনও বটে!
মাকে রুমে ঢুকতে দেখে হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে।বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে মা বলল,

” কিরে তোর টেনশন কমেছে?এখন তো দেখছি মুখে হাসি আর ধরে রাখতে পারছিস না।”

” সত্যি মা।মন চাইছে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।কিন্তু মা একটা জিনিস বুঝলাম না।তুষার ভাইয়া এত স্বাভাবিক আছেন কি করে।উনার আচরণ দেখে আমি তো অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।উনি এমন কেনো?”

” তুষার কি তোর মত গাধী?সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে।সব পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করার পদ্ধতি জানে।তোর ফুপি এখন রেগে আছে কিন্তু এই রাগ সাময়িক।তুষার ভালো করেই জানে তাঁর মা তাঁকে কতটা ভালোবাসে। বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না।তাই সে এখন তাঁর মাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা চালাচ্ছে।”

” কি বলছো মা!আমার তো সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ”

” তোর ফুপি এখন তাঁর ছেলের প্রতি রাগ দেখিয়ে গেল কিন্তু এতক্ষণে বাসায় বোধ হয় ছেলের জন্য পছন্দের আইটেম রান্না করতে বসে গেছেন।”

এসব শুনে আমি পুরো তব্দা খেয়ে গেলাম।তুষার ভাইয়ার সত্যিই কত বুদ্ধি!হাউ সুইট! ইস এমন একজন ছেলে আমাকে ভালোবাসে আমার তো খুশিতে নাগিন ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে যখন করছে তখন ডান্স দিয়েই ফেলি।
মা রুম থেকে চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে গান প্লে করে দিলাম।আমাকে আর পায় কে!বিছানার উপর উঠে লাফাতে আরম্ভ করলাম।নাচতে নাচতে গানের সাথে গলা মিলিয়ে দিলাম,

” ম্যায় নাগিন নাগিন!”

একটু পরেই মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বকাবকি শুরু করল।কিন্তু এসব পাত্তা না দিয়ে আমি আরো জোর গলায় গান শুরু করলাম।মন শুধু বলছে আজ নাচতে হবে।প্রচুর নাচতে হবে।

চলবে…

[ নাচতে হবে প্রচুর।🐍🐍]
😪

যাদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করা হয় নি তাঁরা একটু কমেন্টে জানিয়ে দেবেন।আমার সুবিধা হবে!

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৭

তুষার ভাইয়াদের ড্রয়িংরুমে এই মুহূর্তে সবাই উপস্থিত। সবাই বলতে আমার পরিবার এবং উনাদের পরিবার।ফুপি শুকনো মুখে সোফার এক কোণে বসে আছেন।আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে উনার মন প্রচন্ড ভালো।কিন্তু জোর করে মুখ শুকনো রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কে জানে হয়তোবা আমার মনের ভুল।
ফুপির পাশে ফুপা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন।এই মানুষটার সামনে আমি সবসময়ই অস্থির বোধ করি।ফুপাকে দেখলে খুব রাগী মনে হয়।কিন্তু আসলে তা নয়।উনার সাথে আমার খুব কমই দেখা সাক্ষাৎ হয়।কদাচিৎ যদিও দেখা হয় দুয়েকটা হাসি ঠাট্টা করেন।তবুও উনার সামনে আমি কখনো সহজ হতে পারি না।
আর এই মুহূর্তে তো নয়ই।যার কারণে তুষ্টি আপুর হাত খামচে ধরে আমি শক্ত হয়ে বসে আছি।আপু আমাকে নিম্নস্বরে সাহস জুগিয়ে চলেছেন।
অন্যদিকে যার কারণে আজকের সভা বসেছে সেই মানুষটা দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে বসে বসে আপেল খাচ্ছে। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আমি এদিকে বিরসমুখে বসে আছি আর উনি!

ফুপা হালকা কেঁশে বললেন,

” তুষার! বাপ আমার এখন আমরা কি নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি তা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে।তুমি দয়া আপেল খাওয়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রেখে আমাদের পরিষ্কার করে বলো সবটা।”

তুষার ভাইয়া ঝরঝরে গলায় বলে উঠলেন,

” বলার মত বেশি কিছু নেই আব্বু।শুধু একটা কথাই বলতে চাই।আমি নীলাশাকে ভালোবাসি,ভালোবাসি এবং ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই ওকে ।এর থেকে আর কিভাবে পরিষ্কার করে বলা যায় তা আমার জানা নেই।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আমি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম।ভীষণ ভয় লাগছে।কি হতে চলেছে কে জানে।উনি একটু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বললেই তো পারতেন।সেটা না করে বন্দুকের মত বাক্য ছুড়ছেন।আজব লোক একটা।

” কিন্তু তুমি ভালোবাসলেই তো হবে না।অপর দিকের মানুষটার কথাও তো চিন্তা করতে হবে।আহান এবং আয়েশারও মতামতের ব্যাপার আছে।”

” সেটা তো থাকবেই।তাহলে মামা মামীকে জিজ্ঞেস করেই ফেলো।মামীকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।শুধু মামা হ্যাঁ বলে দিলেই হলো।”

তুষার ভাইয়ার চটপটে কথাবার্তা শুনে আমি একের পর এক শক খেয়ে চলেছি।উনি কিভাবে এমন ফ্রি মাইন্ডে কথা বলে যাচ্ছে! যেখানে নিজের বাবা উপস্থিত সেখানে তো অন্তত মাথা নিচু করে কথা বলা উচিত।

ফুপা কিছু বলার আগেই ফুপি জিজ্ঞেস করলেন,

” মামীকে জিজ্ঞেস করতে হবে না কেনো?আয়েশা কি আগে থেকেই সব জানে?কি আয়শা তুমি জানতে সব?”

” জ্বি আপা।শুরু থেকেই জানতাম।তুষার যে নীলশাকে পছন্দ করে সেটা প্রথমে আমিই টের পাই।”

” তারমানে তুমি তুষারকে সাপোর্ট করেছো।তুমি তাহলে রাজি?”

মা মুচকি হেসে বলল,
” না মানার তো কিছু নেই আপা।তুষারকে অনেকদিন থেকেই চিনি।ওকে আমার বেশ পছন্দ। আমার মনে হয় নীলাশার জন্য এর থেকে ভালো ছেলে পাব না আর।”

ফুপির চোখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল।কিন্তু তিনি তা চাপা দিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

” তুমি মানলেই কি আর হবে?নীলাশা কি চায় সেটাই মুখ্য বিষয়।ওর মতের উপর নির্ভর করছে সবটা।”

সকলের উৎসুক দৃষ্টি এবার আমার উপর নিবদ্ধ হলো।আমি বোধ হয় জ্ঞান হারাতে চলেছি।লজ্জায় নাকি ভয়ে সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।ওদিকে তুষার ভাইয়া দ্বিতীয় আপেলটি নিয়ে কামড় বসিয়েছেন।উনি কি আমার অবস্থা টা দেখতে পারছেন না?উনি বলে দিলেই তো হয় যে নীলশাও রাজি আছে।আসল কাজ না করে উনি আপেল নিয়ে কামড়াকামড়ি করছেন।

ফুপা কোমল গলায় বললেন,
” বলো নীলাশা।তুমি যা চাও সেটাই হবে।তোমার কথার বাইরে কিচ্ছু করনা না আমরা।”

ফুপার কথা উড়িয়ে দিয়ে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” ওকে জিজ্ঞেস করার কি দরকার আব্বু?ওকে জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর পাবে না।তারথেকে আমার কথা শুনো।বিয়ে দিয়ে দাও আমাদের। ”

” তুমি চুপ করবে তুষার?বড়দের মাঝে এসব কি ঠাট্টা তামাশা শুরু করলে?”

” আরে আব্বু…!”

” চুপ থাকতে বলেছি আমি।তুমি চুপ থাকবে।তুমি বলো নীলাশা।”

উসখুস করছি আমি।এতক্ষণে টের পেলাম ভয়ে নয়। লজ্জায় আমি ফ্লোরে থাকা সাদা টাইলসের সাথে মিশে যাচ্ছি।এবার তো তুষার ভাইয়াও আমার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন।আচ্ছা আমি যদি না বলে দেই তাহলে কি হবে?নিশ্চয়ই বড়সড় একটা বোমা বিস্ফোরণ হবে।বোমা বিস্ফোরক হবেন তুষার ভাইয়া নিজে।

” আরে আব্বু এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করছো মেয়ে তো লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছে। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছো না যে ও রাজি!তোমরা তো দেখি ভীষণ বোকা।সবচেয়ে বড় কথা হলো যে নীরবতা সম্মতির লক্ষণ তাই না?তারমানে আমাদের নীলাশাও রাজি!”

তুষ্টি আপুর কথায় ফুপার মুখে হাসি খেলে গেল।ফুপিও হেসে দিলেন!সবার মুখে এত হাসি!তাহলে সবাই মেনে নিয়েছে?
তুষার ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি ভ্রু নাচিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন।যদিও আমি কিছুই বুঝতে পারিনি তবুও লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ফেললাম।

ফুপা উৎফুল্ল কন্ঠে বলতে লাগলেন,
” ছেলে মেয়ে দুজনই যেহেতু রাজি তাহলে আমাদের এখানে দ্বিমত পোষণ করে লাভ কি?তুমি কি বলো আহান?এখনো পর্যন্ত তো কিছুই বলো নি।”

” আপনারা আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলে তবে তো বলব দুলাভাই? আমাকে ছাড়াই তো আপনারা সকল পাট চুকিয়ে ফেলছেন।”

” হাহাহা তা কি করে হয়।তুমি হলে মেয়ের বাবা।তোমার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।”

বাবা আমার দিকে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।বাবার চোখে আমি আমার জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। আমি জানি বাবা কখনো অমত করবে না।একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ছোট থেকেই দ্বিগুণ আদর যত্নে বড় করেছেন আমায়।যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি।মুখ দিয়ে কোনোকিছু চাওয়ার আগেই সামনে জিনিস হাজির করে ফেলতেন।

” আমার মেয়ে যা চায় সেটাই আমার কাছে মুখ্য।ওর মতের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করব না।এই কথাটা আমি অনেক আগেই ভেবে রেখেছি যে আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেনো জোরজবরদস্তি চলবে না।মেয়ে সুখী হলে আমিও সুখী।”

বাবার কথা শুনে আমার চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম। মন চাইছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি বাবা।
ফুপা প্রাণখোলা হাসি হেসে বললেন,

” বাহ্! তাহলে তো মিটেই গেল।কত সুন্দর ভাবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।এবার তোমাকে বলছি তুষার।সবসময় এমন মাথা গরম না করে একটু ধীরেসুস্থে কথা বললেই তো পারো তাই না?শুধু শুধু বাইরের মানুষের সামনে এমন সিনক্রিয়েট না করলে চলত না?”

ফুপার কথা গায়ে না মেখে তুষার ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে রুমে চলে গেলেন।কত্ত ঢং উনার!ছেলে হয়ে এত ঢং দেখানোর কোনো অর্থ হয়?
তুষ্টি আপুকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বললাম,

” তোমার ভাইয়ের ঢংয়ের নমুনা দেখেছো আপু?”

” উপস্ বনু আমার।এটাকে ঢং বলে না।এটা হলো এটিটিউড! বুঝছো?”

মুখ ঝামটা দিলাম আমি।আপু তো দেখি এখন ভাইয়ের পক্ষে চলে গেছে।এমনিতে দিন রাত দুজন ঝগড়া করেই কাটায় আর এখন ভাইয়ের হয়ে কথা বলছে।

আমি পুনরায় সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর আলোচনায় মনযোগ দিলাম।
ফুপা বাবাকে বলছেন,

” আমি কিন্তু আগেই ঠিক করে রেখেছি আমার ছেলের বিয়ে গ্রামের বাড়িতে হবে।বাপ দাদার বিশাল দালান কোঠা অনাদরে পড়ে আছে।বিয়ে উপলক্ষে সেগুলো না হয় নতুন করে সেজে উঠুক।কি বলো তুষারের আম্মু?”

” বিয়ে যখন হবে তখন দেখা যাবে।এখন উঠো।ডিনার করবে।”

বিয়ের কথা শুনে আমি এবার লজ্জায় লাল থেকে বেগুনি হয়ে গেলাম।পাশ থেকে তুষ্টি আপু খুঁচিয়ে যাচ্ছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে।
মা বলল,

” চল নীলাশা।বাসায় যেতে হবে তো।”

আমি উঠতে নিলে ফুপি বলল,
” কোথাও যাওয়া চলবে না।তোমরা ডিনার করে যাবে।যাও ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসো।”

ফুপির কড়া আদেশ মা আর অমান্য করতে পারল না।তুষ্টি আপুর ফোনে কল আসায় সে রুমে চলে গেল।বাবা আর ফুপা গল্প করছে।মা টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে। তাই আমিও একা বসে না থেকে কিচেনে ফুপির কাছে চলে গেলাম।আমার কেনো জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে।কখনো ভেবেছিলাম চেনা মানুষগুলোর সামনে এত লজ্জা পেতে হবে?
ফুপি আমাকে দেখে মায়াবী হাসি দিয়ে বলল,
” আয়।জানিস আমি খুব খুশি আজ।তুষার যখন বলেছিল সে তোকে ভালোবাসে তখন কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়েছিলাম।অবাকের থেকেও আনন্দিত হয়েছি বেশি।কারণ আমারও যে তোকে খুব পছন্দ। কিন্তু ভেবেছিলাম তোর মা বাবা রাগারাগি করবে, মানতে চাইবে না।সেটা চিন্তা করেই দমে ছিলাম।যাই হোক সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে এতেই আমি খুশি।আমার ছেলের মনের কথা যদি বুঝতে পারতাম তাহলে কি ইয়াসিরের বাবা মাকে তোদের বাসায় নিয়ে যেতাম?তখনের ঘটনাটা মনে পড়তেই আমার হাসি পাচ্ছে। ”

আমি নীরবে ফুপির কথা শুনে যাচ্ছি। অতিরিক্ত খুশির সময়ে ফুপি পুরো বাচ্চাদের মত হয়ে যায়।

” নীলাশা তোর তো এখন কোনো কাজ নেই।তাহলে তুষারকে ডেকে নিয়ে আয় যা।ছেলেটা না খেয়ে তখন রুমে চলে গেল।নিশ্চয়ই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাতে দেখলে চিৎকার চেঁচামেচি করে তুলবি।রাতে ভাত না খেয়ে ঘুমানো আমার একদম পছন্দ নয়।”

কথাটা বলেই ফুপি চলে গেল কিচেন থেকে।ভালোই মুশকিলে পড়েছি।তুষার ভাইয়ার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। কেনো তা জানি না।ধুর!

পা টিপে টিপে উনার রুমে ঢুকলাম।কোনো প্রকার নক করা ছাড়াই ঢুকে গেছি।নক করব কেনো?উনি কোন রাজা মহারাজা যে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হবে?

রুমে শুধুমাত্র টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে তুষার ভাইয়া বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন।ঘুমানোর কি স্টাইল।হালকা কোঁকড়া চুলগুলো কপালে পড়ে আছে বিধায় চোখ দেখতে পারছি না।উনি ঘুমিয়ে নাকি জেগে?
আমি বিছানা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগলাম,

” ভাইয়া! উঠুন।খেতে ডাকছে আপনাকে।”

কোনো সাড়াশব্দ নেই উনার।বোধ হয় গাঢ় ঘুমে তলিয়ে আছে।তাই আরেকটু এগিয়ে উনার হাতে স্পর্শ করে বললাম,

” শুনছেন আপনি!উঠে যান।”

এবারের ডাকে কাজ হলো।উনি আড়মোড়া ভেঙে উঠেছেন।চোখগুলো রক্তিম লাল হয়ে আছে।তারমানে সত্যিই উনি ঘুমিয়ে ছিলেন।

” খেতে আসুন।ফুপি ডাকছে আপনাকে।”

যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।দরজা পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তুষার ভাইয়া ঝড়ের বেগে আমার হাত টেনে উনার কাছাকাছি নিয়ে গেলেন।ততক্ষণে উনিও দাঁড়িয়ে গেছেন।আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে গেছি খুব।চিৎকার দিতে গিয়েও দিই নি।
অবাক হয়ে বললাম,

” আর একটুর জন্য আমার হাত খুলে পড়ে যায় নি।আপনার কি মুখ নেই?আমাকে ডাকলেই তো পারতেন!”

তুষার ভাইয়া এবার আমায় পাশের দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরলেন।উনার ঠোঁটে শয়তানি হাসি।আমি বেশ ভড়কে গেলাম।কি করতে চাইছেন উনি?উনার হাসি দেখে কেমন যেন লাগছে আমার।আরেকটু কাছে আসতেই বলে উঠলাম,

” ছাড়ুন আমাকে!কি করছেন?

” কিছুই তো করিনি এখনো। এর আগেই এমন ছটপট করছিস কেনো?”

তুষার ভাইয়ার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম আমি।এ গলার স্বর আমার কাছে নতুন।কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল আমার।

” তুষার ভা..ভাইয়া দূরে যান আপনি।দ..দরজা খোলা।কেউ এসে যাবে।”

” ও আচ্ছা। দরজা খোলা?দাঁড়া দরজাটা তাহলে বন্ধ করে দিই।”

আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে তুষার ভাইয়া সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলেন।
আমি ছুটার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু একবিন্দু পরিমাণ নাড়াতে পারছি না উনাকে।দুইহাত দুই পাশের দেয়ালে রেখে লক করে দিলেন আমায়।
ঝুঁকে এসে বললেন,

” তোর তো একটা পানিশমেন্ট পাওয়ার বাকি আছে।পানিশমেন্ট নিবি না?”

” ম..মানে?”

” আবার মানে জিজ্ঞেস করছিস?আজ ইয়াসিরের বাবা মা তোকে দেখতে এসেছে এর পেছনে তো সম্পূর্ণ তুই দায়ী।ছাদ থেকে ইয়াসিরকে লুকিয়ে দেখার ফল এটা।সামান্য একটা ঘটনা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখেছিস?”

তুষার ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় আমি আর নেই।উনি এত কাছে চলে এসেছেন যে উনার শ্বাস-প্রশ্বাস গুলো গুনতে পারব আমি।

আমাকে চুপ দেখে আবার বললেন,

” আচ্ছা যা তোর শাস্তি মওকুফ করে দিলাম আমি।আজ আমার মন ভীষণ ভালো।”

” আপনি সরে দাঁড়ান প্লিজ! ”

তুষার ভাইয়া আমার কথা বোধ হয় শুনতেই পাননি।হঠাৎই উনি আমার কাঁধের পাশে ছড়ানো চুলগুলো সরিয়ে গলায় পরপর তিনটে চুমু খেয়ে নিলেন।আমি ধাক্কা দিতে পুনরায় আবার একই জায়গায় ঠোঁট বসিয়ে দিলেন।
সাথে সাথে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম।আমি বোধ হয় আর এই দুনিয়াতে নেই।এত ভারী শক আর কখনো পাই নি।দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যেন নেই।
কিছু বুঝে উঠার আগেই তুষার ভাইয়া আমাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন হুড়মুড় করে।আমি দেঁয়াল ঘেঁষে এখনো আগের মতই দাঁড়িয়ে আছি।নিজেকে ধাতস্থ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। একটু আগে আমার সাথে কি হলো এটা!প্রচন্ড গরম লাগছে আমার। শরীরের চামড়া ভেদ করে গরম ভাপ বের হচ্ছে।
ডাইনিং রুম থেকে তুষার ভাইয়ার চিল্লানোর আওয়াজ পাচ্ছি,

” কিরে নীল!আমার রুমে এখনো কি করছিস তুই?ভাত খাবি না?সবাই যে অপেক্ষা করছে সেটা চোখে লাগছে না তোর?জলদি খেতে আয়।”

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৮

বহুকষ্টে মনের সাথে যুদ্ধ করে উপস্থিত হলাম ডাইনিং রুমে।এখানে এসেও পড়লাম বিপাকে।তুষার ভাইয়ার পাশের চেয়ারটা বাদে আর কোনো চেয়ার খালি নেই।কি অসহ্য!সবাই কি ইচ্ছে করেই আমাকে যন্ত্রণায় ফেলতে চায় নাকি?
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুপি বলল,

” বসে যা মা।ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”

আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে বসলাম তুষার ভাইয়ার পাশে।উনি একবারের জন্যও তাকাননি আমার দিকে।তুষ্টি আপুর সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আর একটু পর পর ফুপির হাতের রান্নার বাহবা দিচ্ছেন।
আমি মনে মনে গালি দিয়ে উনার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছি।বদ লোক একটা।একটু আগে রুমে আমায় দম বন্ধ করে মারতে গিয়েছিল। আর এখন দেখো দিব্যি ভালো মানুষ সেজে সকলের সাথে হেসে খেলে ভাত গিলছে।
টেবিলে খাবারের নানা রকমের পদ।মাঝখানে একটা বোলের মধ্যে সর্ষে ইলিশ দেখা যাচ্ছে। মা তাহলে ঠিকই বলেছিল যে ফুপি তুষার ভাইয়ার ফেভারিট আইটেম রান্না করবে।মা’য়ের কথা তো মিলে গেল দেখছি।

খাওয়ার একপর্যায়ে বাম হাতে কারো স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলাম।অন্য একজনের বলিষ্ঠ হাতের বিচরণ টের পাচ্ছি আমার হাতের উপর।সেই অন্য একজনটা যে তুষার ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নয় তা নিমিষেই বুঝে গেলাম।চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে দেখি উনি নিজের মত করে খেয়ে যাচ্ছেন।
হাত টেবিলের নিচে হওয়ায় বাকিরা তা দেখতে পারছেন না।তাই আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরো গভীরভাবে চেপে ধরলেন।কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে সকলের অলক্ষ্যে চোখ গরম করে তাকালাম উনার দিকে।তখনই উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে দিলেন।ব্যস! গলায় খাবার আটকে কেশে উঠলাম আমি।যার ফলে সকলের দৃষ্টি অটোমেটিকলি আমার উপর চলে আসলো।নিজেকে কেনো জানি জোকার মনে হচ্ছে।
তুষার ভাইয়া আমার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

” কি আশ্চর্য! কয়টা ভাত মাত্র মুখে দিলি আর এখনই কাশি উঠে গেল?এর আগেও খেয়াল করেছি খাওয়ার সময়ই তোর কাশি উঠে যায়।আমি বুঝি না খাবার তোর পাকস্থলীতে না গিয়ে শ্বাসনালিতে ঢুকতে যায় কেনো?”

তুষার ভাইয়ার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেললাম।রাগের কারণে চোখে আমি অন্ধকার দেখছি।মন বলছে এই খালি গ্লাসটা উনার মাথায় বারি দিয়ে দু টুকরো করে ফেলি।উনার জ্বালায় ভাত খেতেও পারব না।
যাই হোক মাথা ঠান্ডা করে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলাম।কিন্তু তুষার ভাইয়া তো আজ পণ করেছে যে তিনি আমাকে শান্তিতে ভাত খেতে দিবেন না।কোনো না কোনো উপায়ে বিরক্ত করেই ছাড়বেন।
এবার উনি আমার প্লেটে একগাদা তরকারি দিয়ে দিলেন।আমি যে না করব সেই সুযোগটাও পাই নি।

” এটা কি করলেন তুষার ভাইয়া? এত খাবার আমি খেতে পারব না!শুধু শুধু তরকারিটা নষ্ট হবে।”

আমার কথায় ফুপিও সায় দিলেন,
” কেনো ওকে না জিজ্ঞেস করে দিতে গেলি?ইচ্ছে করেই এটা করলি তাই তো!ওর পেছনে না লাগলে তোর শান্তি হয় না?”

আমি প্লেট ছেড়ে উঠতে যাব তখন তুষার ভাইয়া বললেন,

” খাবার নষ্ট করলে গুনাহ্ হয় জানিস না?একদিন একটু বেশি খেলে কিছু হবে না।বস!”

আমি কাঁদকাঁদ হয়ে মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা তুষার ভাইয়ার পক্ষ নিয়ে বললেন,

” খেয়ে নে না!এতটুকু খাবার নষ্ট করে কি লাভ।”

শেষপর্যন্ত আমাকে আবার বসতে হলো এবং সবটা খাবার শেষ করলাম। পেটে আর একবিন্দুও জায়গা নেই।এক্ষুনি ব্লাস্ট হবে।তুষার ভাইয়া যে এত বজ্জাত তা তো জানা ছিল না।শুধু বজ্জাত নয়।বজ্জাতের হাড্ডি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে নাহলে আবার অন্য কোনো উপায়ে উনি আমায় জ্বালাতে চলে আসবেন।

.

বাসায় যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘরে।ঘুমের তাড়নায় দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও পাচ্ছি না।অন্যদিন তো এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না।নিশ্চয়ই এতগুলো খাবার খাওয়ার কারণে দুনিয়া অন্ধকার করে ঘুম নেমে আসছে।
চটপট লাইট অফ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।চোখ বন্ধ করতেই বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা ভূমিকম্পের মত ভাইব্রেট করে উঠল।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।মোবাইলের স্ক্রিনে তুষার ভাইয়া নামটা জ্বলজ্বল করছে।বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে গেল আমার।এই হনুমান এখন ফোনেও জ্বালাবে নাকি?ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু এটা তো অনবরত বেজেই যাচ্ছে।শেষে বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে কানে লাগালাম। সাথে সাথেই তুষার ভাইয়ার কন্ঠ শোনা গেল,

” কি করছিস নীল?”

তুষার ভাইয়ার গলার কন্ঠ শুনে কিছুটা ধাক্কার মত খেলাম।কি সুন্দর সুমিষ্ট পুরুষালি গলা।উনার ভয়েস কি দিন দিন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে নাকি?
তবে যাই হোক।উনার মুখে নীল নামটা খুব মানায়।আমাকে নীল বলে আর কেউ ডাকে না।আমিও চাই না আর কেউ ডাকুক।এই নামটা একমাত্র উনার মুখেই শোভা পাক।

” চুপ কেনো।কথা বল!”

নিজের নাম নিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে কোথায় যে হারিয়ে গেছিলাম।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

” আপনার গলার স্বর চেঞ্জ হয়ে গেছে?”

” মানে?চেঞ্জ হবে কেনো?”

” না আমার কাছে একটু অন্যরকম লাগছে আর কি।”

” অন্যরকম কেমন?ভালো না খারাপ?”

” ভালোই লাগছে।”

তুষার ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন।আমার চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে গেছে।তাই রুমের সাথে অ্যাটাচড্ থাই গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লাম।
তুষার ভাইয়া বললেন,

” প্রেমে পড়েছিস তো তাই এমন লাগছে।”

” এহ্ মোটেও না।”

” কি মোটেও না?তুই কি বলতে চাইছিস তুই প্রেমে পড়িসনি?”

আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম,

” ঠিক ধরেছেন।”

তুষার ভাইয়া চুপ করে গেলেন।আমি মোবাইল সামনে এনে দেখি এখনো কল কাটেনি। তারমানে লাইনে আছেন।তাহলে চুপ মেরে গেলেন কেনো?উনি কি আমার কথা সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন?

হঠাৎ করেই উনি বলে উঠলেন,

” ভালোবাসিস তো আমায়?”

এমন প্রশ্ন শুনে এবার আমি থেমে গেলাম।কিন্তু কেনো?উনি তো কঠিন কোনো প্রশ্ন করেনি আমায়!তাহলে বুক কাঁপছে কেনো আমার।সাথে লজ্জা লাগছে ভীষণ।গালদুটো গরম হয়ে উঠছে।
কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,

” আপনি তখন আমার সাথে ওইরকম কেনো করলেন হুম?আপনার জন্য আমাকে এক প্লেটের উপর ভাত খেতে হয়েছে।আপনি তো বাচ্চাদের থেকেও বড় শয়তান।”

” বল্ না নীল!শুনতে ইচ্ছে করছে খুব!”

কথা ঘুরানোর বুদ্ধি কাজে লাগল না।উনি নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন।কখনো ভালোবাসার কথাটা উনাকে সরাসরি বলা হয় নি।তাই নার্ভাস লাগছে আমার।ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।আমি জানি উনি অপেক্ষা করে আছেন সেই উত্তর টা শোনার জন্য।
অবশেষে মনে সাহস জুগিয়ে বলেই ফেললাম,

” ভালোবাসি আপনাকে।প্রচন্ড ভালোবাসি।আরো অনেক ভালোবাসতে চাই।”

তুষার ভাইয়া কিছু বলছেন না।কিন্তু আমি স্পষ্ট উনার শ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি না দেখেও বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে উনার ঠোঁটে সেই মনভোলানো হাসি গেঁথে আছে।

তুষার ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
” যদি ভালোবেসে থাকিস তাহলে প্রেমেও পড়েছিস।প্রথমে প্রেম তারপর সেটা থেকে ভালোবাসার জন্ম।তুই বলেছিলি না যে তুই বিভিন্ন উদ্ভট কাজ করে বেরিয়েছিলি!তখন তুই প্রেমের রঙিন হাওয়ায় ভাসছিলি তাই এসব করেছিস।”

” আপনি তো দেখি ভালোবাসায় দক্ষ হয়ে গেছেন।”

” হ্যাঁ তোর ভালোবাসায় জড়িয়ে আমি দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে গেছি।”

প্রশস্ত হাসলাম আমি।এই লোকের সাথে তো কথায় পারা যাবে না।চারদিকে তাকিয়ে দেখি পাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোগুলো আর দেখা যাচ্ছে না।তাই অন্ধকার টা গাঢ় মনে হচ্ছে। এবার বেশ ভয় লাগছে আমার।

” এই যে দক্ষ প্রেমিক! ফোন রাখছি তাহলে।আপনি ঘুমান।”

সাথে সাথেই তুষার ভাইয়ার গর্জন শোনা গেল।
” ফোন রাখবি না নীল!আমার ঘুম নিয়ে তোকে ভাবতে বলেছে কেউ?”

” আরে চিৎকার করছেন কেনো?আচ্ছা আপনি না ঘুমালে নাই। আমি ঘুমাব।আর এমনিতে আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুম কেটে গেছে।এরপর আর কখন ঘুম আসবে কে জানে! এতরাত পর্যন্ত সজাগ থাকলে আমায় ভূতের ভয় কাবু করে ফেলে।”

” ওকে রিল্যাক্স।যা ঘুমানোর ট্রাই কর।আচ্ছা এক কাজ কর তো! বালিশে মাথা রেখে ফোনটা কানের কাছে ধরে রাখ।আমি তোকে একটা গান শুনাই।তাহলে দেখবি ঘুম এসে যাবে।”

এই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।উনি নাকি আমাকে গান শুনাবে।গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে আমায়?মানে বিশ্বাস হচ্ছে না।

” সত্যিই গান শুনাবেন?”

” এত প্রশ্ন না করে যা করতে বলেছি কর।অযথা প্রশ্ন করা তোর বাজে স্বভাব।”

আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে চলে এলাম রুমে।তুষার ভাইয়া আমাকে গান শুনাবে!ভাবা যায়?
বালিশে মাথা রেখে বললাম,

” শুরু করুন!”

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা শেষে তুষার ভাইয়ার মনোমুগ্ধকর কন্ঠ শুনতে পেলাম আমি।

‘ তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়,নিভৃত,পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম’

মম জীবন যৌবন,মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে,নিশীথিনী -সম
তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে………..

গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।কিন্তু গানের রেশ এখনো কানে ক্ষীণ হয়ে প্রবেশ করছে।ঘুমের মধ্যে থেকেও অনুভব করতে পারছি মাথায় শুধু একটা লাইন প্রতিফলিত হচ্ছে,

‘ তুমি রবে নীরবে’

চলবে…

[ গল্পটা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।আর বড় করব না।]

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৯

শুরু হয়ে গেল অ্যাডমিশন টেস্টের প্যারা।প্যারা কত প্রকার ও কি কি তা এখন ভালোই টের পাচ্ছি। গত এক সপ্তাহ ধরে কোচিংয়ে আসা যাওয়া করছি।অনেক চিন্তা ভাবনা করে ভার্সিটির জন্য ভর্তি হয়েছিলাম।তুষার ভাইয়া বলেছিল মেডিকেল ফোকাস করতে। কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি যে মেডিকেলে ঢুকে জীবন তেজপাতা করার ইচ্ছা নেই আমার।এত পড়াশোনা আমার দ্বারা হবে না।আমার ইচ্ছা না থাকায় আর কেউই এই ব্যাপারে জোর করেনি।

এইচএসসি পরীক্ষার জন্য যতটুকু পড়েছি তারচেয়ে বেশি পড়তে হচ্ছে অ্যাডমিশনের জন্য। মাঝেমাঝে মন চায় এসব ছেড়ে বিয়ে করে ফেলি।কি দরকার পড়ালেখার? জামাইয়ের টাকায় খাব বসে বসে।আহা! কি সুখ।
কিন্তু মনের এই লুকায়িত চিন্তা গুলো লুকিয়েই রাখি।বাইরে প্রকাশ করার কথা ভুলেও ভাবি না।তুষার ভাইয়ার কানে এসব গেলে আমার কান আর কানের জায়গায় থাকবে না।উনার এক চড়ে সেটা আকাশে উড়ে যাবে।

তুষার ভাইয়ার সাথে এখন দেখা সাক্ষাৎ কম হয়।এমনিতে রাতের বেলা ফোনে টুকটাক কথা বলি।তা ও খুব অল্প সময়।উনি জোর করে ফোন রেখে দেন।আমার নাকি পড়ার ক্ষতি হবে।উনি এত পাষাণ হলেন কবে থেকে কে জানে।
মাঝেমাঝে উনি এমন সব কান্ড করে যে না হেসে পারি না।যেমন,

সেদিন রাতে ডিনার করার পর উনাকে কল দিয়েছিলাম।বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলেন।আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে উঠলেন,

” ডিনার করেছিস নীল?”

উনার কন্ঠ শুনে মনটা শীতল হয়ে গেল।কিন্তু এত ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে কেনো?উনি কি অসুস্থ?

” আপনার কি শরীর খারাপ তুষার ভাইয়া? ”

” না।অনেক টায়ার্ড আমি।আজ অফিসে একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে।”

” ডিনার করেছেন?”

” এই প্রশ্নটা আগে আমি তোকে করেছি।তাই তুই আগে উত্তর দিবি।”

” জ্বি করেছি।এবার আপনি বলুন।”

” তুই খাওয়া মানেই আমার খাওয়া।”

অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” ফিল্মি ডায়লগ আমার সাথে করবেন না।এগুলো এক সাইডে রেখে আসুন।”

” রেগে যাচ্ছিস কেনো?খেয়েছি। রাতে না খেলে মা কি আমায় আস্ত রাখবে!”

” এখন কি ঘুমিয়ে যাবেন?”

” কেনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে?”

আমি চুপ করে রইলাম।এটা কি আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?উনি তো সবই জানেন।

” তোর পরীক্ষাগুলো শেষ হোক তারপর দেখবি দিনরাত কথা বলব।একটু মন দিয়ে পড় তাহলে দেখবি ভাল একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যাবি।রাখছি এখন।ভালো থাকিস!”

তুষার ভাইয়া কল কেটে দিলেন।মনটাই খারাপ হয়ে গেল।আরেকটু কথা বললে কি এমন হত!যাই হোক উনি যেহেতু অনেক ক্লান্ত তাই এটা নিয়ে মুখ কালো করে লাভ নেই।উনার কষ্টটাও তো আমার ভেবে দেখতে হবে!
বারান্দা থেকে রুমে আসতে নিব তখনই ফোন আবার বেজে উঠল।তুষার ভাইয়া কল করেছেন।সব ভুলে মনটা আবার আনন্দে নেচে উঠল।রিসিভ করে কানে লাগাতে উনি বললেন,

” তুই একবার পরীক্ষাটা দিয়ে নে তারপর সোজা বিয়ে করে ফেলব।এই অপেক্ষা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।দেখ না, ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করেছি কিন্তু তবুও তোর মায়াবী মুখটা বারবার ভেসে উঠছে।মন চাইছে ছুটে যাই তোর কাছে।জাপটে ধরে কানের কাছে বলতে থাকি ভালোবাসি ভালোবাসি! এই রোগের মেডিসিন শুধু একটাই।তোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করে ঘরে তুলে আনা।বিয়ের পর কিন্তু রাতে আমরা এক ফোঁটাও ঘুমাব না।অর্ধেক রাত গল্প করব আর বাকি অর্ধেক রাত রোমান্স! আমি আগেই সব ঠিক করে রেখেছি।আচ্ছা তাহলে রাখি কেমন।শুভরাত্রি আমার ভালবাসা।”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি কল কাটলেন।হাসব না কাঁদব বুঝতে না পেরে আমি বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি।লোকটা কি পাগল?
নিজের অজান্তেই মুচকি হাসলাম।বেশ লাগে উনার এই পাগলামি গুলো।খেয়াল করলাম মন খারাপ ভাবটা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে মুহুর্তেই।তাই আমি উনাকে একটা মেসেজ সেন্ড করে দিলাম,

” আমার মন খারাপের কারণ আপনি আবার মন ভালো হওয়ার কারণও আপনি!”

__________________________

সময়ের স্রোতে ভেসে চলেছি আমি।সেই স্রোত তার নিজস্ব গতিতে পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিল আমায়।আমিও আমার প্রস্তুতি অনুযায়ী ভার্সিটির এক্সামগুলো দিয়েছি।এখন দেখা যাক কোথায় চান্স হয়।পরীক্ষা গুলো খারাপ হয়নি।এইচএসসি’র রেজাল্ট এ প্লাস এসেছিল যার জন্য দুশ্চিন্তাটা একটু কম।তাই মনে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা আসতে দিচ্ছি না।নিয়মিত উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছি যাতে আমার মনের আশাটা পূরণ হয়ে যায়।

.

সন্ধ্যায় রুমে বসে আপনমনে ফেসবুকে নিউজফিডে ঘুরছি।ফ্রেন্ড যারা আছে ওদের সাথে তেমন একটা কথা হয় না।আমি তো শুধু তুষার ভাইয়ার সাথে মেসেজিং করার জন্য অপেক্ষায় থাকি।যখনই দেখি সবুজ বাতি জ্বলছে তখনই নক দেই।সবসময় আমিই আগে মেসেজ দিই।মাঝেমধ্যে রাগ লাগে যে উনি কি একদিনও আমাকে আগে দিতে পারে না?
আমি তো ঠেকায় পড়ে প্রথমে মেসেজ দিই কারণ আমি তো সামনাসামনি উনার সাথে তেমন একটা কথা বলতে পারি না।লজ্জা লজ্জা লাগে।উনার চোখে চোখ রাখতে গেলেও বুক ধুকপুক করে।যেভাবে তাকিয়ে থাকেন বাবারে!

মা’কে রুমে ঢুকতে দেখে ফেসবুক থেকে বের হয়ে গেলাম।মা’য়ের মুখে কেমন যেন চিন্তার ছায়া।কিছু হয়েছে নাকি?
মা আমার পাশে বসে বলল,

” তোকে কিছু জরুরি কথা বলব নীলাশা।আগে পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনবি তারপর সিদ্ধান্ত জানাবি।আগেভাগে চিল্লাচিল্লি করবি না কিন্তু। ”

” কি হয়েছে মা? তাড়াতাড়ি বলো। টেনশন হচ্ছে আমার।”

মা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
” কাল রাতে তো দেখলি তোর বাবা আর আমি তুষারদের বাসায় গেলাম।আসলে তোর ফুপি ডেকেছিল।তো উনারা বলল তুষার এবং তোর বিয়েটা এই মাসেই দিয়ে দিতে চায়।তুষারের চাচাতো ভাই বোন যেগুলো আমেরিকা থাকে ওরা ছুটিতে বাংলাদেশ আসবে।ওদের ভিসা নাকি বেশিদিনের নেই।তাই তোর ফুপা ফুপির ইচ্ছে ওরা থাকতে থাকতেই যেন বিয়েটা হয়ে যায়।ছেলেমেয়ে গুলো আনন্দ করতে পারবে।আবার কবে আসবে না আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই।জানিসই তো তুষারের বেশিরভাগ কাজিন দেশের বাইরে থাকে।”

মায়ের কথা শুনে খুব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম আমি।এত জলদি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না আমার।প্ল্যান ছিল আরো দু তিন বছর যাক তখন চিন্তা করা যাবে।কিন্তু এখন তো দেখি পরিস্থিতি উল্টো হয়ে গেছে।
মা অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন!
আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,

” ত..তোমরা দুজন কি চাও?তোমরা ফুপিদের সিদ্ধান্তে রাজি?”

” দেখ্ আমাদের দিক থেকে তো কোনো সমস্যা নেই।উনারা যদি বলত বিয়ে আরো পাঁচ বছর পর হবে তখনও আমরা রাজি থাকতাম।এখন যেহেতু উনারা চাচ্ছেন বিয়ে এই মাসে হয়ে গেলে সুবিধা হবে তাই তোর বাবা আর আমিও অমত করতে চাইছি না।কিন্তু তোর ফুপি বলে দিয়েছে তোকেও যেন এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়।”

” তোমরা দুজন যেহেতু রাজি তাহলে আমিও রাজি।”

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন।আমিও চোখ বন্ধ করে মা’য়ের আদর উপভোগ করছি।
মা মৃদু হেসে বলল,

” পিচ্চি নীলাশা কত বড় হয়ে গেছে।আজ বাদে কাল শ্বশুর বাড়ি যাবে।”

মা’য়ের চোখ ছলছল করছে।এটা দেখে আমিও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না।মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।

.

সন্ধ্যার পর তুষার ভাইয়াকে কল দিলাম।কল দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো উনাকে রিকোয়েস্ট করে দেখব বিয়েটা আরো কয়েকমাস পেছানো যায় কিনা।অন্তত ভার্সিটিতে ভর্তির ঝামেলা গুলো শেষ হোক তারপর না হয় বিয়ের চিন্তা করা যাবে।তখন তো ঝোঁকের বশে মাকে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম।

একবার রিং হতেই তুষার ভাইয়া রিসিভ করলেন।বরাবরের মত আমি হ্যালো বলার আগেই উনি বললেন,

” নীল! আমি তো বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছি একটু।এখন রেস্টুরেন্টে আছি।ধুমসে খানাপিনা চলবে।তোর জন্য কি আনব বল।পার্সেল করে নিয়ে আসব তোর আর তুষ্টির জন্য। ওই পেত্নী বলেছে পিৎজা খাবে।তুই কি খাবি?”

আমার বিষন্ন মনটা আরো বিষিয়ে গেল।উনি তো দেখি দারুণ ফুর্তিতে আছেন।আর এদিকে আমি বিয়ের চিন্তায় আধমরা।

” আমার কিছু লাগবে না ভাইয়া।আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

” তাহলে বলতে থাক।”

” মা আজকে বলল আপনারা নাকি চাইছেন বিয়েটা এই মাসেই হয়ে যাক।আপনার কাজিনরা নাকি ছুটিতে আসবে বিডিতে।কিন্তু আমার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে মন চাইছে না।আরো এক বছর যাক।আপনি প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করুন না!”

তুষার ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মোবাইল কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি।একটু আগে কি বলেছিলাম সেটা আরেকবার মনে মনে আওড়িয়ে নিলাম।আমি তো কোনো হাস্যকর কথা বলিনি। তাহলে উনার এমন হেসে উঠার কারণ কি?

” এত বুদ্ধি করে প্ল্যান খাটিয়ে বিদেশ থেকে কাজিনদের নিয়ে আসছি আর তুই বলছিস বিয়ে পেছানোর কথা!”

” মানে?”

” মানে হলো এই প্ল্যান টা আমার।বাবা মাকে বিয়ের কথা নিজের মুখে কিভাবে বলবো।তাই বিদেশ থেকে কাজিনদের হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসা লাগছে।জানিস এর জন্য ওদের প্রত্যেককে দামী দামী গিফট কিনে দিতে হবে।এমনই শর্ত দিয়েছে আমায়।আমার একাউন্টের অর্ধেক টাকা মনে হয় ওরাই খেয়ে দিবে।হাহাহা।যাক এটা কোনো ব্যাপার না।”

হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি।রাগে আমার শিরা-উপশিরা দপদপ করে উঠছে।উনি সামনে থাকলে নিশ্চিত উনার গলা টিপে ধরে ভয়ানক কান্ড বাঁধিয়ে দিতাম।

রাগে বেসামাল হয়ে বললাম,

” আপনি…আপনি এত খারাপ!সবকিছুর মূলে আপনি রয়েছেন আর আমি কিনা আপনার কাছেই সাহায্য চাইতে এসেছি।”

তুষার ভাইয়া উচ্চ শব্দে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন,
” আমি যে তোকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না।সবচেয়ে বড় কথা আমার সব বন্ধু-বান্ধব বিয়ে সাদি করে বসে আছে।একমাত্র আমিই এখনো কুমার।এতগুলো বিবাহিত ছেলের মাঝে আমি এক অসহায় ব্যক্তি নিজের কাছেই তো খারাপ লাগে।ওরা আমাকে নিয়ে ননস্টপ হাসি তামাশা করে এটা কি মেনে নেওয়া যায়!তুই বল!”

” আপনি একটা ধূর্ত ব্যক্তি।আপনি একটা অসভ্য। আমি সিরিয়াস মুডে আছি আর আপনি মজা করে যাচ্ছেন? ”

” তোকে সিরিয়াস মুডে থাকতে কে বলেছে?আর তোর জন্য অসভ্য কেনো অসভ্যের বাপ হতে রাজি আমি।”

” আপনি একটা….আপনি একটা অসহ্য প্রাণী!”

” কুল নীল! এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই।চিল মুডে থাক।বিয়ে হবে আনন্দ কর।এই আমাকে দেখ্ , ফ্রেন্ডদের যখন জানিয়েছি বিয়ের কথা ওরা সবাই ঘাড় মটকে ধরেছে ওদের আজ ট্রিট দিতেই হবে।সেই কারণেই রেস্টুরেন্ট এলাম।তোর জন্য কি আনব বললি না যে?”

আমার এই মুহূর্তে মন চাইছে আছাড় দিয়ে ফোনটা ভেঙে ফেলি।তারপর বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করি।এই শয়তান লোক আমার জীবন তেজপাতা বানিয়ে ছেড়েছে।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,
” আপনি আমার জন্য একটা ধারালো ছুরি নিয়ে আসবেন।ওটা দিয়ে আপনাকে খুন করব আমি।আর হ্যাঁ একবোতল বিষও আনবেন।আপনাকে খুন করে আমি বিষ খেয়ে মরে যাব।”

তুষার ভাইয়া আগের মতই উৎফুল্ল মনে হাসতে লাগলেন যা শুনে আমার মাথা আরো গরম হয়ে গেল।

” তাহলে তো ভালোই হবে নীল।তুই হবি পেত্নী আর আমি হব ভূত।আমরা প্রেম করব তারপর বিয়ে করব।ঘুরেফিরে তো একই কাহিনী তাই না?”

নাক মুখ ফুলিয়ে কল কেটে দিলাম আমি।উনার সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বললে আমি পাগল হয়ে পাবনা যাব।সবকিছুর পেছনে যেহেতু উনার হাত তাহলে সেখানে আমি আর কি করতে পারি!

চলবে…

[ নীলাশা এবং তুষারের বিয়েতে আপনাদের সবার দাওয়াত রইল।সবাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে মাস্ক পরিধান করে বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন।😑😑
মনে রাখবেন-নো মাস্ক,নো এন্ট্রি 😂😂]

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৩০ (শেষ পর্ব)

মিষ্টি একটা আওয়াজ খুব ক্ষীণ হয়ে কানে বাজছে আমার।ঘুমের রেশ অর্ধেক কেটে গেল।কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।মন বলছে উঠে গিয়ে দেখি এত মধুর আওয়াজ কোত্থেকে আসছে।
মনের কথায় সায় দিয়ে উঠে পড়লাম।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি মাত্র সাড়ে ছটা বাজে।আওয়াজের উৎস ধরে বারান্দায় যেতে নজর পড়ল একটা চড়ুই পাখি গ্রিলে বসে আপনমনে ডেকে চলেছে।চড়ুই পাখির ডাক কি এত সুন্দর! খুবই সাধারণ ডাক যেটা আমরা সবসময় শুনি।তাহলে আজ কেনো এত মধুর লাগছে আমার কাছে!
পা টিপে টিপে পাখিটাকে ছুয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম।কিন্তু আমার চেষ্টা বৃথা।কারো উপস্থিতি টের পেতেই পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বসল।এই পাখিটা আজ সকলের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তার সকাল শুরু করবে মনে হয়।

বারান্দার এককোনায় টবে লাগানো ছোট্ট গাছটার উপর চোখ পড়ল আমার।মুহুর্তেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল।একটা সাদা ফকফকে ফুল ফুটে আছে।শুভ্র রঙের পাপড়িগুলো চারদিকে মেলে আছে। এই টগর গাছটা কিনে এনেছিলাম প্রায় পনেরদিন হবে।এরমধ্যেই ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছে। সকাল সকাল এমন চমক দেখব ভাবতেই পারিনি।

রুমে এসে এগিয়ে গেলাম ওয়ারড্রবের দিকে।ড্রয়ার টান দিতেই দশ বারোটা শপিং ব্যাগ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাগটা বের করে আনলাম।ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো ডার্ক রেড কালারের গর্জিয়াস একটা লেহেঙ্গা।হ্যাঁ আমার বিয়ের লেহেঙ্গা এটা!পরম ভালোবাসায় লেহেঙ্গাটার উপর হাত বুলিয়ে দিলাম।

গতকালই বিয়ের কেনাকাটার জন্য বের হয়েছিলাম।দুই পরিবার একসাথেই শপিংয়ে গেছিলাম।কিন্তু তুষার ভাইয়া সেখানে অনুপস্থিত ছিল।উনি নাকি কোন কাজে শহরের বাইরে গেছেন।আমার একটু রাগ হয়েছিল।কোথায় ভাবলাম আমার বিয়ের লেহেঙ্গা উনার পছন্দে কিনব!তা আর হলো কই?তবে উনার পাঞ্জাবি টা আমার পছন্দে কেনা।
কাল রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেছিল।প্রচুর টায়ার্ড থাকার কারণে কোনোরকমে ডিনার করে ঘুমে তলিয়ে গেছিলাম।শাড়ি, লেহেঙ্গা, গয়না কোনোটাই খুলে দেখা হয়নি।তাই এবার সবগুলো ব্যাগ বের করে বিছানায় রাখলাম।অন্য কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই সব ভালোভাবে চেক করে নেয়া যাক।যদি আবার কোনোটা বাকি থেকে যায়!

নিজের আনন্দ এবং উত্তেজনা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।এত জলদি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না বলে একটু মন খারাপ হয়েছিল।কিন্তু যখন তুষার ভাইয়ার সাথে আমার আংটি বদলের অনুষ্ঠানটা হল এরপর থেকেই আমার মনে রঙিন হাওয়া বইতে লাগল।আমার বিয়ে এই কথাটা মনে পড়তেই আনন্দে অভিভূত হয়ে যাই আমি।
তুষার ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে! বিয়ের পর ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের।একজন ভালো স্ত্রী হতে পারব তো?আমার ফুপির ভালো বউমা হতে পারব তো?এসব অনেক চিন্তায় আজকাল বুদ হয়ে থাকি।বেশ ভালো লাগে যখন এগুলো ভাবতে বসি।একটা মেয়ের জীবনে তাঁর বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে।এই কথাটা এখন খুব সত্যি মনে হয় নিজের কাছে।

.

নানা জল্পনা কল্পনার পর ঠিক হলো ফুপিরা বিয়ে উপলক্ষে গ্রামে যাবেন না।যা করার এখানেই করবেন।তুষার ভাইয়ার কাজিনরা নাকি গ্রামে যেতে চাইছেন না।তাই বাবা মা সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু ফুপিরা এখানেই আয়োজন করবেন তাহলে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাব।এখানে আমাদের ফ্ল্যাটও অত বড় নয়।মানুষের গঞ্জনা হবে বেশি।তাই গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই সাপোর্ট করল।

বিয়ের আর মাত্র অল্প কিছুদিন বাকি!আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে বসে আছি। সকাল আটটার মধ্যেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব।ওখানে আমাদের রিলেটিভ অনেকেই ইতিমধ্যেই উপস্থিত হয়ে আছেন।মা আমাকে বিগত একঘন্টা ধরে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।সব শাড়ি গয়না ঠিকমত নিয়েছি কিনা,কোনোকিছু বাকি রয়েছে কিনা আরো কত কিছু।আমি দুইদিন আগে থেকেই সব গুজগাছ করে রেখেছি।তবুও মা অনবরত হুশিয়ার করে যাচ্ছে।
সব পুটলা পুটলি টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনার পর বাবা দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলেন।দরজার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি এই বাসা থেকে এখন বেরিয়ে যাচ্ছি আমার মা বাবার মেয়ে হয়ে কিন্তু যখন আবার ফিরব তখন শুধু তাঁদের মেয়ে নয়,আমার জীবনের সাথে জুড়ে যাবে আরো গুটিকয়েক আপনজন!

মা বলল,
” তোর বাবা নিচে যাক।আমরা পাঁচতলায় একবার দেখা করে আসি।”

” না মা।আমি যাব না।উনাদের বাসায় বোধ হয় গেস্টরা হাজির হয়ে গেছে।আমার লজ্জা লাগে।”

” গেস্ট এখনো তেমন একটা আসেনি।চল্।”

অগত্যা মা’য়ের পিছু পিছু চলে গেলাম।
মেইনডোর খোলাই ছিল।ড্রয়িংরুমের সোফায় দুটো ছেলে এবং তিনটে আমার বয়সী মেয়ে বসে আছে।ওরা বোধ হয় হাস্যরসাত্মক কিছু নিয়ে কথা বলছিল।আমাদের দেখতে পেয়ে হাসি থামিয়ে দিল।ওদের একজনকেও আমি চিনি না।মনে হয় তুষার ভাইয়ার কাজিন।
মা চলে গেলেন ফুপির সাথে দেখা করতে। হঠাৎ কোথা থেকে তুষ্টি আপু বের হয়ে আমাকে টানতে টানতে তুষার ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেলেন।আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না।তুষার ভাইয়া কাবার্ডে কি যেন খুঁজছিলেন।আমাদের আওয়াজ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন।
তুষ্টি আপু হাসতে হাসতে বলল,

” তোমার কথামত ভাবীকে এনেছি।”

এটা বলে আপু চলে গেল।আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।তুষার ভাইয়া আমার সামনে এসে কিছুটা ঝুঁকে বললেন,

” বিয়ের আমেজে আমার কথা ভুলেই গেছিস তাই না?না কল,না মেসেজ!আমি ফোন দিলেও তোকে পাই না।! দেখা সাক্ষাৎও নেই।এত ব্যস্ত?”

আমি দুইহাতে উড়নার কোণা মুঠ করে ধরে আছি।উনি ভুল কিছু বলেননি।আর এটাও সত্যি যে আমি বিভিন্ন কারণে খুব ব্যস্ত ছিলাম।বিশেষ করে কেনাকাটা নিয়ে।এ পর্যন্ত কয়বার যে শপিং মল যেতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
আমতাআমতা করে বললাম,

” আসলে ভাইয়া কেনাকাটা নিয়ে একটু….”

তুষার ভাইয়া হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।আমার হাত-পা অসার হয়ে আসতে চাইছে।উনার শরীর থেকে আসা পারফিউমের সুগন্ধে আমি মাতাল হয়ে যাচ্ছি। খুব দুর্বল লাগছে নিজেকে।
আমার চুলের গভীরে মুখ গুঁজে উনি বললেন,

” এ কয়েকটা দিন খুব মিস করব তোকে।আমাকে ডেইলি কল দিবি কিন্তু। আর শোন বউ সাজার সময় কোনো ফাঁকফোকর যেন না থাকে।আমার বউকে আমি রানীর মত দেখতে চাই।মনে থাকবে?”

তৃপ্তির সহিত হেসে উনার পিঠে হাত রাখলাম।
” যো হুকুম মহারাজ।”

তুষার ভাইয়ার হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় হলো।তখনই শুনতে পেলাম মা ডাকছে আমায়।তুষার ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললেন,

” যা।মামী ডাকছে।”

.

পাক্কা তিন ঘন্টা জার্নি করার পর পৌঁছে গেলাম গ্রামের বাড়ি।বরাবরই আমার গ্রামের প্রকৃতি বেশ ভালো লাগে।শহরে থাকার সুবাদে যদিও গ্রামে আসা যাওয়া খুম কম।

সারা রাস্তা জার্নি করার কারণে শরীরে নেতিয়ে ছিল।কিন্তু যখন সবুজে ঘেরা মাঠের পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তখন শরীর ও মনের অবসাদ দুটোই দূর হয়ে গেল।যতই ভেতরের দিকে যাচ্ছি ততই যেন মুগ্ধতা গ্রাস করছে আমায়।ভাঙাচোরা ইটের রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম। আমাদের দেখতে পেয়ে সকলে ঘিরে ধরল।চাচাত ভাইবোন যারা আছে ওঁরা ইতিমধ্যে আমার সাথে ইয়ার্কি করা শুরু করে দিয়েছে।এতগুলো মানুষের সামনে হঠাৎই এক বস্তা লজ্জা আমায় কাবু করে ফেলল।বিয়ের কনের যে কতরকমের জ্বালা।আহ্!

.

দেখতে দেখতে চলে এলো গায়ে হলুদের দিন।সন্ধ্যা হতেই বাড়ির আনাচকানাচে জ্বলে উঠল বিভিন্ন রঙের মরিচ বাতি।ঘর এবং উঠোনের পরিবেশ মানুষের কোলাহলে মুখরিত।সাউন্ড বক্সে বিভিন্ন রিমিক্স গান বাজছে। রিলেটিভ সবাই প্রায় উপস্থিত। যারা আসে নি ওঁরা বিয়েতে থাকবে।সবমিলিয়ে বিয়ে বাড়ি একদম জমজমাট!
এদিকে আমি আছি এক ঘোরের মধ্যে! মনের মধ্যে উত্তেজনারা বাসা বেঁধে আছে।শুধুমাত্র আজকের দিনটা।এরপরই তো সেজে উঠব আমি বধূবেশে।আমার বর আমায় নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি!ওই মুহুর্তটার কথা চিন্তা করতেই মনের ভেতরের আনন্দগুলো উল্কা বেগে ছুটতে থাকে।
সন্ধ্যার পরপরই পার্লারের দুটো মেয়ে আমায় সাজাতে বসে গেল।আমি শুধু স্ট্যাচু হয়ে আছি আর ওঁরা ইচ্ছেমতো মুখে আটা ময়দা মাখিয়ে চলেছে।আমাকে কি আজ পেত্নী বানিয়ে ছাড়বে নাকি কে জানে।কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।সাজানো শেষে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কাঁচা হলুদ শাড়িতে খারাপ লাগছে না।চাচাতো বোনগুলো দল বেঁধে আমায় নিয়ে গেল উঠোনে।গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সেখানে বড়সড় একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে।যার চারদিকে ফুলের সমারোহ এবং লাইটের ঝলকানি।ধীরে ধীরে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে শুরু হলো অনুষ্ঠান!কাজিনগুলো জোর করে আমায় উঠোনে নাচতে নামিয়েছে।প্রথমে মানা করলেও কিছুক্ষণ পর সাউন্ড বক্সে পছন্দের গান বেজে উঠায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। নিজের বিয়ে বলি কি একটু নাচানাচি করব না?সারাক্ষণ জড়ভরতের মত বসে থাকা যায় নাকি।আবার এটাও ভাবছি যে এই নাচের ভিডিও তো তুষার ভাইয়া কোনো একসময় দেখবে।তখন লজ্জায় আমি না মাটির ভেতর ঢুকে যাই।কিন্তু আপাতত এসব বাদ।আমার বিয়েতে আমি উরাধুরা নাচব।তাতে কার কি!

__________________________

” বর এসেছে!”

এই বাক্যটা কানে যেতেই শরীরে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল।কেনো জানি না গলা শুকিয়ে আসছে।বুকের ভেতর প্রচন্ড শব্দে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে।

আমি বসে আছি নিরিবিলি একটা রুমের ভেতর।এতক্ষণ মানুষ গিজগিজ করলেও এখন রুম সবটা ফাঁকা।সবাই চলে গেছে বরের কাছে।
আমি ধীর পায়ে উঠে এলাম ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সম্মুখে।কি অপরূপ এই বিয়ের সাজ!গায়ে ডার্ক রেড কালারের লেহেঙ্গা, হাতে-গলায় গয়নার ছড়াছড়ি। নিজের রূপে নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। এত রূপ কোত্থেকে আসলো আমার?সবই কি ভারী মেকাপের জাদু নাকি আমার মনের খুশিগুলো সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পরে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে?

.

তিনবার উচ্চারিত ‘কবুল’ শব্দটির কতই না ক্ষমতা।এক মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে অন্যকারো জীবনের সাথে যুক্ত করে দিল।আজ থেকে সেই মানুষটার সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে গেলাম।দুজনের হাত ধরেই গড়ে উঠবে আমাদের ছোট্ট একটি ভালোবাসার দুনিয়া।সেখানে আমার আত্মার সাথে জুড়ে থাকবে সেই মানুষটি।আমার প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাসে তাঁর বিচরণ থাকবে।

কথায় বলে না যে-কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয়! এটা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই সত্য।যা আমি এই মুহূর্তে অনুভব করছি।নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্য বাবা মা’য়ের আদর ও ভালোবাসার গন্ডি পেরিয়ে চলে যেতে হচ্ছে আমায়।বিদায় নামক শব্দটাকে বরাবরই আমি কিছু কষ্টময় অনুভূতি দ্বারা ব্যাখা দিয়ে এসেছি।নিজের ক্ষেত্রে এখন তা সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে।
বাবা মা’য়ের চোখে পানি দেখে নিজেকে সামলানো খুব দায় হয়ে পড়ল।বাবা দুহাতে জড়িয়ে আমাকে কাঁদতে মানা করছে।তুষার ভাইয়ার হাতের মাঝে আমার হাত রেখে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে আমি তাঁদেরকে ঝাপসা চোখে দেখে যাচ্ছি।
একসময় গাড়ি চলতে শুরু করল।তারই সাথে আমার কান্না উপচে আসছে।পাশ থেকে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” আর যদি এক ফোঁটাও চোখের পানি পড়ে তাহলে তোকে আমি গাড়ির ছাদে বসিয়ে নিয়ে যাব।”

মুহূর্তেই আমার কান্না থেমে গেল।কান্নার জায়গায় স্থান করে নিল হতভম্ব ভাব।নতুন বউকে কেউ এই কথা বলতে পারে সেটা তো আমার ধারণায় ছিল না।উনি কি আমার মনের কষ্টটা বুঝতে পারছেন না?একটু মন খারাপ হলো আমার।

” এত কাঁদার কি আছে বলতো!তোর বাপের বাড়ি হলো চারতলায় আর শ্বশুরবাড়ি হলো পাঁচতলায়।যখনই মন চাইবে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে চলে যাবি বাবা মা’কে দেখতে।সিড়ি দিয়ে যেতে দেরি হলে লিফট দিয়ে যাবি।তুই এমন ভাব করছিস যেন তোকে আমি বিয়ে করে পরদেশে নিয়ে যাচ্ছি। ”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।উনি এই অবস্থাতেও মজা করে যাচ্ছেন? ভালো একটা বর জুটেছে আমার কপালে।আমি মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।তখনই হাতে আলতো স্পর্শ পেতে সেদিকে তাকালাম। তুষার ভাইয়া শক্ত করে আমার হাত ধরে আছেন।ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি ধীর কন্ঠে বললেন,

” এভাবে কাঁদিস না আর। ভালো লাগছে না তো। তোর চোখের পানি সহ্য হচ্ছে না আমার।তুই জানিস বউ সাজে তোকে কি মারাত্মক লাগছে।একদম আমার রাজ্যের রানী!”

উনার ভালবাসা মাখা কথা শুনে গলে গেলাম আমি।মাথাটা হেলিয়ে দিলাম উনার কাঁধে।উনিও আমায় একহাতে আগলে নিলেন।

_________________________

যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম চিরচেনা সেই জায়গায়।এটাই এখন থেকে আমার ঠিকানা।এরাই এখন আমার আপনজন। ফুপি আমাকে পরম আদরে বরণ করে নিলেন।এক বুক প্রশান্তি নিয়ে ঘরের ভেতর পা রাখলাম আমি।তুষার ভাইয়ার কাজিনগুলো ঘিরে আছে আমার চারদিকে।ভিড়ের মাঝে তুষ্টি আপুকেও দেখা যাচ্ছে। নিজের ভাইয়ের বিয়ে বলে তাঁর দাপট পুরো দেখার মত।একে ওকে বিভিন্ন কাজের অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে। ধমকাধমকি করছে।বেশ ভালো লাগছে এগুলো দেখতে।
হাসি ঠাট্টা শেষে ওরা আমায় তুষার ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেল।রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম।মস্ত বড় রুমটা ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে।আনাচে কানাচে ছোটছোট মোমবাতি জ্বালানো। এ যেন কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে গেছি আমি।ওঁরা আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল।সাদা বেডকভারের উপর টকটকে লাল গোলাপের ছড়াছড়ি। গোলাপের গাঢ় গন্ধ নাকে লাগছে।
এদিকে শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে।কখন যে এসব ভারী গয়নাগুলো খুলব।লেহেঙ্গা চারদিকে সুন্দর করে ছড়িয়ে ওঁরা বেরিয়ে গেল।ছড়ানো লেহেঙ্গাটা গুটিয়ে আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।ক্লান্তির কারণে চোখে ঘুম নেমে আসছে।
হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে ধড়ফরিয়ে উঠে বসলাম।তুষার ভাইয়া এসেছেন।এই প্রথম উনার দিকে ভালোভাবে নজর দিলাম।গোল্ডন কালারের পাঞ্জাবিতে উনি পুরো ঝলমল করছেন।ইস এই সুদর্শন ছেলেটা আমার বর।ভাবতেই কেমন প্রাউড ফিল হচ্ছে।আমার ঘুম চুটকিতেই উধাও হয়ে গেল।
তুষার ভাইয়া দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসলেন।আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে উনাকে সালাম করার জন্য নিচে ঝুঁকলাম।কিন্তু উনি বাঁধা দিয়ে আবার দাঁড় করিয়ে দিলেন।আমার চিবুকে হাত রেখে মিষ্টি হেসে বললেন,

” পায়ে হাত দেওয়া আমার পছন্দ না।”

” কিন্তু এটাই তো নিয়ম।”

” এই নিয়ম বাদ।আচ্ছা যা আমি তাহলে নতুন নিয়ম তৈরি করে দিচ্ছি তোর জন্য।”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি?”

” জড়িয়ে ধর আমায়।”

উনার ঘোষিত নিয়মে কিছুটা লজ্জা পেলেও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম উনাকে।উনিও বুকের মাঝে আবদ্ধ করে নিলেন আমায়।মাথার একপাশে চুমু খেয়ে বললেন,

” তুই আমার বহুদিনের প্রতীক্ষার ফল।কখনো কষ্ট পেতে দেব না তোকে।নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব।তুই শুধু আমার সাথে থাক প্লিজ।কখনো কোনো কারণে ভুল বুঝিস না আমায়।সহ্য করতে পারব না আমি।”

ছলছল চোখে মুচকি হাসলাম। উনাকে ভুল বুঝার আগে যেন ছারখার হয়ে যাই আমি।উনার কথার প্রতিত্তোরে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বলতে পারছি না।মনের সবকিছু দলা পাকিয়ে আসছে।আমি তো গুছিয়ে কোনো কথাই প্রকাশ করতে পারি না।উনার ঘাড়ে আলতো চুমু খেয়ে বললাম,

” ভালোবাসি খুব।”

তুষার ভাইয়া আরো গভীরভাবে জড়িয়ে নিলেন আমায়।হঠাৎই আমার মনে কোনো এক গানের কিছু লাইন বিচরণ করতে লাগল,

‘তুমি যদি বলো এখনি করিব
বিষয় বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়
দিব অকাতরে বিষয়
দিব তোমার লাগি বিষয়
বাসনা বিসর্জন।’
————————–

(সমাপ্ত)

[ চাইলে গল্পটা আরো দুয়েক পার্ট বাড়াতে পারতাম।কিন্তু আজই শেষ করে দিলাম।যাই হোক।প্লিজ জানাতে ভুলবেন না গল্পটা সর্বোপুরি কেমন লেগেছে।ভালো থাকবেন সবাই।]

1 COMMENT

  1. দারুন একটি গল্প ছিল খুব ভালো লাগলো আপনাকে ধন্যবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here