মন_গহীনে পর্ব_১৩/১৪/১৫/১৬

মন_গহীনে পর্ব_১৩
#সামান্তা_সিমি

ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁইছুঁই। গত একঘন্টা থেকে পড়ার টেবিলে বই সামনে রেখে বসে আছি।তুষার ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।অন্যদিন তো চারটা অথবা সাড়ে চারটার দিকে চলে আসতেন।সময়ের ব্যপারে উনি খুবই সতর্ক।তবে আজ উনি আসছেন না কেনো।ভাবছি সকালে যে উনাকে সরাসরি ইগনোর করে গেছি তারজন্য বোধ হয় আর পড়াবেন না আমায়।

ধুর! আমিও যে কিসব নির্বোধ চিন্তা ভাবনা করি।এমনটা আবার হয় নাকি।
রান্নাঘর থেকে মা চেঁচাচ্ছেন তুষার ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জেনে নিতে আজ পড়াতে আসবে কিনা।কিন্তু মা’য়ের কথা আমি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে টেনে বের করে দিচ্ছি। উনার সাথে সামনাসামনি কথা বলি না তাহলে ফোনে কেনো বলব!

আর ফোন করার প্রয়োজন পড়ে নি।পাঁচটা দশ বাজতেই তুষার ভাইয়া চলে আসলেন।
এবারও আমি সকালের মত ভাব ধরে ফেললাম।আমি ভাইয়াকে বুঝাতে চাই যে আমি উনার ব্যবহার দ্বারা কতটা কষ্ট পেয়েছি।তাই এই অভিনয়ের সূত্রপাত।
তাও একবার আড়চোখে উনাকে দেখে নিলাম।উনি মোবাইল টিপায় ব্যস্ত।ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা দেখছেন।নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
গায়ে ফরমাল লুক।তারমানে অফিস থেকে সোজা চলে এসেছেন।ভাইয়াকে এই ড্রেস আপে দেখতে আমার বরাবরই ভালো লাগে।উনার গায়ে হালকা বেগুনি রঙের শার্ট।ব্লেজারটা কোথায় রেখে এসেছে কে জানে!

এলোমেলো চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে।ফর্সা চেহারায় অবসাদ এবং ক্লান্তির ছোঁয়া।
হঠাৎ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ফেললেন।চোখে চোখ পড়ে গেল উনার।আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।লুকিয়ে চুড়িয়ে দেখতে গেলে বোধ হয় এমনই হয়!আমারো যে হঠাৎ কি হলো।

তুষার ভাইয়া কৌতুকময় কন্ঠে বলে উঠল,
” তুই তো আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস!দিলি তো নজর লাগিয়ে।দেখ আমার চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে।ভালো করে দেখ চোখগুলো লাল হয়ে আছে না?”

উনার ঝরঝরে কন্ঠ শুনে বেশ অবাক হলাম আমি।হঠাৎ করে উনার কি হলো!আজ সকালেও তো অপরাধবোধে ভুগছিলেন আর বিকেল হতে হতে তা গায়েব হয়ে গেল।তবে উনার চোখগুলো সত্যিই লাল হয়ে আছে।চেহারাও বিবর্ণ।

” চুপ করে আছিস কেনো?আমার দিকে যে কূটনীর নজরে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলি এতে আমার সৌন্দর্য তো একধাপ নষ্ট হয়ে গেল।সাধে কি আর বলি তোর পেটে মাথায় শয়তানি বুদ্ধির আবাসস্থল! হিংসুটে মেয়ে একটা।”

ভাইয়ার কথা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছি না।কত সাহস!আমাকে হিংসুটে বলল।
বেশ চড়া গলায় বলে উঠলাম,

” ও হ্যালো মিস্টার! নিজেকে কি সুপারস্টার ভাবেন আপনি?বস্তির ওই দাঁত উঁচুওয়ালা মুহিব নামের ছেলেটার চেহারাও আপনার থেকে ভালো। শুধু ফর্সা হলেই সুন্দর বলে না।এগুলাকে বলে ফার্মের মুরগি।কিন্তু আপনাকে তো মুরগি বলা যাবে না।আপনার জন্য ধলা বিলাই নামটা পারফেক্ট। আর কি বলছিলেন আমি নজর দেওয়াতে আপনার চেহারা শুকিয়ে গেছে,চোখ লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই আপনি রাতে না ঘুমিয়ে পুরো এলাকার পাগলা কুকুর গুলো তাড়া করে বেড়িয়েছেন। যার জন্য চোখমুখের এই হাল।খবরদার আমাকে যদি আর একটাও কথা বলেছেন ভালো হবে না কিন্তু। ”

একশ্বাসে কথা গুলো বলে তবেই দম নিলাম।নিজেকে নিয়ে প্রশংসা করতে করতে একেবারে তালগাছের মাথায় উঠে গেছে।এ কেমন মানুষ! নিজের ঢাক নিজে পেটায়।
তুষার ভাইয়া হা করে আমার দিকে চেয়ে আছেন।নিশ্চয়ই শক খেয়েছে।একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে।

উনি ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলেন।তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন,

” তুই তো একটা ভুল কথা বললি নীল! রাতে আমি কুকুর তাড়াই না।রাতে আমি তোর যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না।চোখ বুজলেই স্বপ্ন দেখি।সেখানে তোর শানের মত সাদা সাদা চুল,হাতির দাঁতের মত বিশাল দুটো দাঁত, চোখগুলো তো গনগনে আগুনের মত জ্বলতে থাকে।আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করতে করতে আমায় আক্রমণ করতে ছুটে আসিস।ভাব একবার, এই ভয়ানক পেত্নী রূপ দেখলে ঘুম দূরে থাক আমার তো কোমায় চলে যাওয়ার কথা।কিন্তু তবুও আমি ফিট বডি নিয়ে চেয়ারে বসে আছি।”

তুষার ভাইয়ার মুখে আমার রূপের বর্ণনা শুনে শিউরে উঠলাম।এসব শোনার আগে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরে গেলাম না কেনো!
উনার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে বললেন,

” যাক অবশেষে তুই কথা বললি আমার সাথে।”

চমকে উঠলাম আমি।কোথায় গেল আমার অভিনয়,কোথায় গেল আমার অভিমান?
উনার কথার তালে তালে এতক্ষণ আমিও তাল দিয়ে গেছি। এখন তো নিজের উপরই রাগ লাগছে।

তুষার ভাইয়া করুণ গলায় বলে উঠলেন,
” রাগ কর যা-ই কর।প্লিজ কথা বলা বন্ধ করিস না।পাগল হয়ে যাই আমি।”

আমি সূক্ষ্ম নজরে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনার চোখের পর্দায় একরাশ আকুতি।উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না তাহলে আমি কথা না বললে উনি কেনো পাগল হবেন।ঢং!আমাকে আজেবাজে কথা শুনাবে আর আমি রাগ করেও থাকতে পারব না?


আকাশে সন্ধ্যে নামার হাতছানি।চারদিকে শীতল হাওয়া বইছে যার ফলে শরীরে হালকা কাঁপুনি উঠছে।তিন্নির সাথে ছাদে ঘুরাঘুরি করছি আমি।তিন্নি আমার এক ক্লাস জুনিয়র।বড্ড চটপটে এই মেয়েটা।আমি ছাদে আসতে চাইছিলাম না।ও জোর করে নিয়ে আসলো।তিন্নি তখন থেকে বকবক করে মাথা-কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।আমি নাকি পড়তে পড়তে শুকিয়ে যাচ্ছি।আমাকে দেখতে নাকি এখন রোগী রোগী লাগে।
এরকম অর্থহীন কথাবার্তার কোনো মানে হয়?

আমার স্বাস্থ্য শরীর নিয়ে গবেষণার টপিক শেষ হতেই সে এবার তুষার ভাইয়াকে নিয়ে শুরু করল।

” নীলাপু আমার তো জানাই ছিল না তুষার ভাইয়া এত রাগী।গতকালের ঘটনা আমি দূর থেকে খেয়াল করেছিলাম।খুব ভয় পেয়েছি আমি।জানো আপু তুষার ভাইয়া এতদিন আমার ক্রাশদের লিস্টে একদম টপে ছিল। কিন্তু এখন দশ নাম্বারে চলে গেছে।”

” তোর ক্রাশের লিস্ট এত বড়?তুই তো আমার থেকেও একধাপ এগিয়ে আছিস।ভার্সিটি যখন উঠবি তখন তো….”

ছাদের দরজা দিয়ে সাদনান ভাইয়াকে ঢুকতে দেখে আমার কথা মাঝপথে আটকে গেল।
তিন্নি আর আমি দুজনই কৌতুহল নিয়ে দেখলাম উনি এখানেই আসছেন।এই ছোকড়া আবার কি জন্য হাজির হলো কে জানে?আর জানলো কিভাবে আমরা ছাদে আছি।

সাদনান ভাইয়া শুকনো মুখে সামনে এসে বলতে লাগল,
” কালরাতের ঘটনাটার জন্য আমি খুবই লজ্জিত নীলাশা।কি বলতে কি বলে ফেলেছি।তুমি মনে কিছু নিও না।আমার তুষারের দিকটা ভেবে দেখার দরকার ছিল।সব জানার পরও আমি তোমাকে প্রপোজ করেছি যা খুবই বিশ্রি হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি সত্যিই দুঃখিত।তুষার আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।জানি না কিভাবে ওর কাছে ক্ষমা চাইব।”

সাদনান ভাইয়ার ইনোসেন্ট মার্কা চেহারা দেখে আমি একটুও নরম হলাম না।বরং ঠাস করে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” এক মিনিট!আমাকে একটা জিনিস ক্লিয়ার করুন তো!বারবার যে বলছেন ‘সব জানার পরও’ এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।আপনি সবার প্রথমে এই তিনটা শব্দের ব্যাখ্যা দিন।”

সাদনান ভাইয়ার চেহারা আগের চেয়ে আরো দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল।
” এটা আমি বলতে পারব না।এমনিতেই তুষার আমার উপর ক্ষেপে।তোমার কৌতূহল দমাতে গেলে আমার অবস্থা আরো করুণ হয়ে যাবে।ভালো থেকো।আমি এখন যাই।”

আমাকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে উনি চলে গেলেন।মন চাইছে একটা ইটের টুকরো নিয়ে লোকটার মাথায় ঢিল মেরে রক্তাক্ত করে দিই।
পাশ থেকে তিন্নি বলল,
” তুষার ভাইয়ার ভয়ে সে জর্জরিত হয়ে আছে।একদম ঠিক হয়েছে।সে জানে তুষার ভাইয়ার সাথে ঝামেলা করলে ওরই বিপদ।তাই তোমার কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলল।জানো আপু সাদনান ভাইয়ার আগে কয়টা প্রেমিকা ছিল?”

” তিন্নি তুই কি থামবি?এমনিতেই মাথা হট হয়ে আছে তার উপর তোর ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনে ছাদ থেকে লাফ দিতে ইচ্ছা করছে।উনার প্রেমিকা সম্পর্কে জানতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার।”

ধমক খেয়ে তিন্নি চুপসে গেল।আমার মাথায় শুধু সাদনান ভাইয়ার বলা তিনটে শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে।

__________________________

কেটে গেছে আরো বেশ কয়েকটা দিন।ধীরে ধীরে আমার পড়ালেখার চাপ আরো বাড়ছে।পরীক্ষা তো প্রায় এসেই গেল।মাঝেমধ্যে খুব ভয়ে থাকি।না জানি রেজাল্ট কেমন আসে।একটু উনিশ-বিশ হলেই মানুষের সামনে মুখ দেখানোর জায়গা পাব না।
আমার মা প্রত্যেকদিন একবার করে মনে করিয়ে দেয় যে রেজাল্ট যদি খারাপ আসে তাহলে ধরে বেঁধে আমাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবে।কি ভয়াবহ কথা।মনে পড়লেই কলিজা কেঁপে উঠে।
অন্যদিকে তুষার ভাইয়া তো আছেনই।উনার কথা আর কি বলব।ডেইলি এত এত পড়া দিয়ে যায় আমি পড়তে পড়তে বেঁহুশের মত হয়ে যাই।তবে মায়ের হুমকিতেই হোক আর তুষার ভাইয়ার চাপেই হোক আমি কিন্তু হেব্বি পড়াশোনা করছি।

কিন্তু তুষার ভাইয়ার সাথে আমি এখনো অনেকটা রেগে আছি।যদিও মুখে সেটা ততটা প্রকাশ করি না।উনাকে যখনই দেখি তখনই ওইদিনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়।তাই প্রয়োজন ছাড়া উনার সাথে কোনো বাড়তি কথা বলি না।এই ব্যপারটা তুষার ভাইয়া খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন।
প্রথমদিকে উনি আমাকে মানানোর অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন।একদিন তো আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যরি পর্যন্ত বলেছে।কিন্তু তবু আমার মন বিন্দুমাত্র টলে নি।মাঝেমধ্যেই আমাকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন উদ্ভট কথা বলেন।ঝগড়া লেগে আমাকে রাগিয়ে দেওয়ারও সুযোগ খুঁজেন।কিন্তু আমি তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাই।যার ফলে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন।আর সেই হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পাই।

__________________

ঘুমের মধ্যে দরজা নক করার আওয়াজ ক্ষীণভাবে কানে প্রবেশ করছে।ব্রেইন সিগন্যাল দিচ্ছে চোখ খুলার জন্য। কিন্তু ঘুমের তাড়নায় পারছি না।
হঠাৎ করেই দুমদাম শব্দ টা আরো বেড়ে গেল।ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়লাম।ইস!পায়ের হাড়গোড় যেকোনো একটা নিশ্চয়ই ভেঙেছে। চোখ কচলে পড়ার টেবিলের উপর রাখা ছোট ঘড়িটাতে তাকাতেই দেখি বারটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি।
দরজা খুলে দিতেই তড়িঘড়ি করে মা রুমে ঢুকলেন।

” কখন থেকে ধাক্কা দিচ্ছি।কানে কি তুলো গুঁজে ঘুমাস?”

অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে মা’কে বললাম,
” এত রাতে আমার ঘুম নষ্ট করে জানতে এসেছো আমি কানে তুলা দেই কিনা তাই তো?তাহলে শুনো আমি তুলা দেই না।হয়েছে? এবার যাও প্লিজ।আমার কালকে ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে যাবে তো!”

” এখন ঘুমাস না।তুষ্টি এসেছে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওর সাথে ঘুমাতে বলছে।যা তাড়াতাড়ি। ”

আমি বড় করে একটা হাই তুললাম।আপুও যে কি করে না!আগে ফোন করে বলে দিলেই তো হয়।

তুষ্টি আপুদের বাসায় ঢুকতেই আপু আমাকে ড্রয়িংরুমে মাঝে দাঁড় করিয়ে বলল,

” এখানে একটু দাঁড়া।আমি এক্ষুনি আসছি।”

এটা বলেই আপু চলে গেলেন।আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবাই কি কাহিনী করছে এসব।আমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখছি নাকি।এমনও তো হতে পারে যে আমি এখন স্বপ্নের দেশে ঘুরাফেরা করছি।আল্লাহ্!স্বপ্ন কি এত স্পষ্ট হয়!
কিন্তু পরক্ষণেই নিজের হাতে চিমটি কাটতেই বুঝতে পারলাম না আমি বাস্তবেই আছি।

এক মিনিটের মাথায় আপু ফিরে আসলেন।কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরে বলল,

” কোনো কথা বলবি না।আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেদিকে শুধু পা চালা।”

আপুর কথামত আমি হেঁটে চলেছি রোবটের মত সোজা হয়ে।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৪

আপুর কথামত আমি হেঁটে চলেছি রোবটের মত সোজা হয়ে।
চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছি আপু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়।একটা দরজা খোলার শব্দ পেলাম।তারমানে কোনো একটা রুমে নিয়ে এসেছে।

” ওয়ান-টু-থ্রি! সারপ্রাইজ!

অতিমাত্রায় চিৎকার দিয়ে আপু আমার চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিলেন।এই চিৎকারে বোধ হয় মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে।তাহলে আমার কানের কি হাল হবে?
পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনের দৃশ্যটা দেখে আমার দুই ভ্রু কুঁচকে গেল।
তুষার ভাইয়া প্রশস্ত হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার পাশেই ছোট টেবিলটায় একটা গোল সাইজের কেক রাখা।সাথে খুব সুন্দর একটা কালারফুল মোমবাতি।বিছানার উপর রঙিন কাগজে মোড়া বক্স।দেখে মনে হচ্ছে গিফটের বাক্স।
দ্বিতীয়বারের মত প্রতিটা জিনিসের উপর নজর বুলিয়ে নিতেই হঠাৎ আমার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল।আজ ২০ জানুয়ারি। আমার জন্মদিন!
নিজের জন্মদিনের কথা নিজেই ভুল মেরে বসে আছি আর ওঁরা দুজন মনে রেখেছে!এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম।

কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন,

” শুভ উনবিংশতম জন্মদিন নীল!

দুই পাটি দাঁত বের করে হাসলাম আমি।পাশ থেকে আপু জাপটে ধরে বলল,

” জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা বনু।সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে বলতো!”

” খুব ভালো লেগেছে আপু!বেস্ট ছিল এটা!”

তুষ্টি আপু হেসে বলল,
” তুই কি ভুলো মনের মেয়ে রে নীল!নিজের জন্মদিনের কথা তোর ব্রেইন তোকে মনে করিয়ে দিল না।ভারি অদ্ভুত তো!”

” এজন্য তো আমার ব্রেইনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আপু।যদি বার্থডে’র কথা আমার মনে থাকত তাহলে সারপ্রাইজ টা এত জমজমাট হত না।এখন যে পরিমাণ খুশি লাগছে তখন এক ছটাকও লাগত না।”

আপু এবং আমার কথোপকথন তুষার ভাইয়ার সহ্য হলো না।উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,

” দুই পেঁচীর দল তোদের প্যাঁচাল শেষ হলে আমার দিকে তাকা।আর এই যে বার্থডে গার্ল! আপনার কেক কাটার অপেক্ষায় আমরা বসে বসে সারারাত পার করতে পারব না।দয়া করে কেক টা কেটে আমাদের ধন্য করুন।”

আড়চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমি মুখ ঝামটা দিলাম।যতই সারপ্রাইজ অ্যারেঞ্জ করুক আমাকে ভুলে গেলে চলবে না যে আমি উনার সাথে রেগে আছি।

তুষ্টি আপু তাড়া দেওয়ায় আমি কেক কাটার জন্য এগিয়ে গেলাম।তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে আমার হাতে ছুড়িটা ধরিয়ে দিলেন।
কেকের একসাইড একটু কেটে তুষ্টি আপুকে খাইয়ে দিলাম।
আপুও আমাকে এক টুকরো খাইয়ে দিয়ে বলল,

” তোর জন্য একটা গিফট আছে।দাঁড়া নিয়ে আসছি।”

আপু চলে যেতেই তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি দুই হাত বুকের সাথে ভাঁজ করে চোখ ছোট ছোট করে দেখছেন আমায়।কারণটা অবশ্য আমি জানি কিন্তু পাত্তা দিলাম না।
আরেক টুকরো কেক কেটে নিজের মুখে ঢুকিয়ে নিলাম।
এবার তুষার ভাইয়া মুখ খুললেন,

” তোর আমাকে চোখে লাগছে না?আমাকে কেক খাওয়ালি না যে?খাদকের মত নিজেই খেয়ে চলেছিস।”

আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলাম,
” একটু আগেই বললেন না যে আমি বার্থডে গার্ল।তো কেক টা তো আমার জন্যই আনা হয়েছে তাই না!”

” তুই যে কতটা পাষণ্ড মানবী তা আজ বুঝতে পারলাম।এত কষ্ট করে আমি অ্যারেঞ্জ করলাম সবকিছু আর আমার সাথেই মামদোবাজি? ”

চোখ গরম করে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।আমি এত ইগনোর করার পরও উনি আমার সাথে ঝগড়া করার রাস্তা খুঁজেন। কত ধৈর্য্য উনার!
হাতের ছুড়িটা নিয়ে কেকের উপর এলোপাথাড়ি ভাবে চালিয়ে দিলাম।ছোট একপিস নিয়ে ভাইয়ার সামনে ধরতেই উনি আতঙ্ক মিশ্রিত গলায় বললেন,

” কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তুই!আমার তো মনে হচ্ছিল তুই কেক না আমার শরীরের উপর ছুড়ি চালাচ্ছিস।”

আমি কোনো কথা বললাম না।কারণ উনার সাথে তর্কে যাওয়া মানেই বিপদ।আমি যদি ডেঞ্জারাস হই তাহলে উনি কি?ডাবল ডেঞ্জারাস।
উনার মুখে কেক তুলে দিতেই আমার আঙুলে বিরাট এক কামড় বসালেন।

” আল্লাহ! কি করলেন এটা!”

যন্ত্রণায় চিল্লিয়ে উঠলাম।
উনার কোনো ভাবান্তর নেই।মনের সুখে কেক চিবিয়ে যাচ্ছেন।
অসভ্য লোক একটা!আমি খুব ভালো করে জানি এই কাজটা উনি ইচ্ছে করেই করেছেন।আল্লাহ! এই অমানুষ টার দাঁতগুলো যেন অকালে খুলে পড়ে যায়।আমার মনের বাসনা পূরণ করে দিও তুমি।তবে উনার বউয়ের তো কপাল পুড়বে।দন্তহীন জামাই নিয়ে রাস্তায় হাঁটা চলা করবে কিভাবে। তুষার ভাইয়ার ভবিষ্যৎ বউয়ের দুদর্শার কথা চিন্তা করে একটু খারাপ লাগল।

তুষ্টি আপু রুমে ঢুকে বলল,
” নীলাশা তুই চিৎকার দিয়ে উঠলি কেনো।আরেকটু হলে তো আব্বু আম্মু জেগে যেত।”

দাঁত কটমট করে বললাম,
” তোমার ভাইকে কি বাসায় খাবার দাবার কিছু দাও না তোমরা?উনি একটু আগে আমার আঙুল খাওয়ার চেষ্টা করেছিল।কোনো রকমে আঙ্গুলটা উনার কবল থেকে রক্ষা করেছি।”

তুষ্টি আপু হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে।এদিকে তুষার ভাইয়া একের পর এক কেক মুখে ঢুকিয়ে যাচ্ছেন। আমার উত্তপ্ত চাহনি এবং নালিশ উনার ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারছে না।যেন কেকের সাথে আঙুল কামড় দেওয়া দোষের কিছু নয়।বরং স্বাভাবিক ব্যপার।অসহ্য।

” সিরিয়াসলি ভাইয়া! তুমি নীলাশার সাথে এমন বাচ্চা টাইপের দুষ্টুমি গুলো করো? যাই হোক। নীলাশা দেখ তো এই ঘড়িটা কেমন?তোর জন্য কিনেছি।”

আপুর কেনা ঘড়িটা দেখে মুগ্ধ হতে হল।পাথরের ঘড়িটা কি সুন্দর!

” দারুণ হয়েছে আপু।সত্যি খুব খুশি হয়েছি আমি।”

তুষ্টি আপু হালকা করে আমার গাল টেনে দিলেন।ইস! আপু যদি আমার আপন বড় বোন হত!
অবশ্য আপন না হয়ে ভালোই হয়েছে।পরে দেখা যেত দিনরাত দুইজন এটা সেটা নিয়ে চুলোচুলি করতাম।এমন দৃশ্য কল্পনা করতেও খুব ভয় লাগে।

চোখ জ্বালা করতেই মনে পড়ল আমি তো কাঁচা ঘুম ভেঙে এখানে এসেছি।এখন বিছানা বালিশ আমাকে চিৎকার করে ডাকছে।কোনোরকমে মাথাটা বালিশে লাগাতে পারলেই হলো।ঘুম আমি আসছি।
মস্ত একটা হাই তুলে তুষ্টি আপুকে বললাম,

” আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।চলো রুমে।”

” হ্যাঁ চল।”

আমার ঘুমের মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে দিলেন তুষার ভাইয়া।উনি বললেন,

” তুষ্টি তুই যা।নীল একটু পরে যাবে।”

আপু মুচকি হেসে চলে গেলেন।এমন রহস্যময় হাসি দেখে আমার খটকা লাগল।যদিও তেমন পাত্তা দিলাম না।
চেহারায় জোর করে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুষার ভাইয়াকে বললাম,
” যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আপনি যদি কোনো উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাকে পচানোর চিন্তা করে থাকেন তাহলে এই প্লাস্টিকের ছুড়ি আপনার গলায় বসিয়ে দিব।”

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” ভালোই তো সাহস বেড়েছে তোর।আমাকে মারার হুমকি দিচ্ছিস।তাও প্লাস্টিকের ছুড়ি দিয়ে?আর তোকে আমি পচাতে যাব কেনো?আমাকে কি তোর মাটিতে বাস করা ব্যাক্টেরিয়া মনে হয়?”

” আপনার কথাগুলো ব্যাক্টেরিয়াকেও হার মানায়।শুনলেই শরীরে জ্বালা ধরে।”

” তাহলে সেটা তোর সমস্যা।শরীরের চামড়ায় সমস্যা। ”

দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম।এই লোকটা আবার আমাকে হাইপার করে দেওয়ার ফন্দি আঁটছে।তাই এখন কথার পিঠে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

মুখ ভার করে চলে যেতে নিলেই তুষার ভাইয়া আমার হাত টেনে ধরলেন।
কোমল স্বরে বললেন,

” আমার নীলের যে এত রাগ তা তো জানতাম না! রাগলে নীল আর নীল থাকে না।লাল হয়ে যায়।”

আমি কিছুই বললাম না।উনার উল্টো দিকে মুখ করে আছি।তখনই অনুভব করলাম উনি আমার হাতে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছেন।

” বাহ্! তোর ফর্সা হাতে বেশ মানিয়েছে তো!”

বাম হাতটা সামনে আনতেই অবাক হয়ে গেলাম।পাথর বসানো চিকন একটা ব্রেসলেট। লাইটের আলোয় চিকচিক করছে।
তুষার ভাইয়া একটা মাঝারি সাইজের বক্স আমার সামনে এনে বললেন,

” এটার ভেতর তোর পছন্দের কিছু জিনিস আর একটা ডায়রি আছে।ডায়রিটা এখন খুলবি না।যেদিন আমার কথা তোর অনেক বেশি মনে পড়বে, যেদিন খুব মিস করবি সেটা যে কারণেই হোক শুধু ওইদিনই ডায়রিটা খুলবি।প্রমিস কর!”

ভাইয়ার কথা শুনে মনে মনে হাসি পেল।উনি কি পাগল নাকি।উনার কথা আমার কেনো মনে পড়বে?মনে করার মত কিছু করেছে নাকি?আর মিস করার তো প্রশ্নই উঠে না।উনি আমার থেকে শত হাত দূরে থাকলেই ভালো।

” লাগবে না আমার কোনো গিফট্।আপনার থেকে আমি কোনো গিফট্ নিব না।”

” এগুলো তোর জন্য কিনে এনেছি।তাই তুই নিতে বাধ্য। এবার এগুলো নিয়ে তুই কি করবি তোর ব্যাপার।মন চাইলে নিজের কাছে রাখতে পারিস আবার মন চাইলে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারিস।ইট ডিপেন্ডস অন ইউ।”

তুষার ভাইয়ার শক্ত গলার কন্ঠ শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আবার যদি সেই সাইকো রূপ ধারণ করে?তাহলে আমার উপর দিয়ে আবারও তুফান ছুটবে।
বাক্সটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে তুষ্টি আপুর রুমে চলে গেলাম।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৫

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্রেসলেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি।মানতেই হবে তুষার ভাইয়ার পছন্দ আছে।সেই বক্সটা এখনো খুলিনি।ডায়রী ছাড়া আর কি থাকতে পারে?
আমার পছন্দের জিনিস তো অনেক কিছুই আছে।কোনটা হতে পারে।

” ব্রেসলেট টা কি ভাইয়া গিফট্ করেছে?দারুণ হয়েছে তো!”

তুষ্টি আপুর আওয়াজ পেতেই ব্রেসলেট থেকে মনযোগ সরিয়ে নিলাম।এটা এত খুঁটিয়ে দেখার কিছু নেই।
তুষ্টি আপু টেবিলে বসে কি যেন লেখালেখি করছে। মুচকি হেসে বলল,

” ওই বক্সটায় কি থাকতে পারে বলতো!আমাকে তো বলেনি কিছু।কতবার বললাম একটু দেখাতে।কিন্তু দেখায় নি।উল্টে আরো আমার বেনী ধরে টান দিয়েছে।বজ্জাত ভাই একটা।আমিও দিয়েছি নখ দিয়ে আঁচড় কেটে।ওকে ঘায়েল করার জন্যই হাতের নখ বড় রাখি।এগুলো আমার অস্ত্র।”

আপুর কথা শুনে হেসে উঠলাম।কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেছে।দুই ভাইবোনের খুনসুটিময় ঝগড়া দেখতে এবং শুনতে ভীষণ ভালো লাগে।
মাথায় একটা প্রশ্ন উঁকি দিতেই আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আমার জন্মদিনের কথাটা তোমরা কিভাবে মনে রেখেছো আপু? মা’র থেকে জেনেছো নাকি?”

তুষ্টি আপু মেকি হেসে বলল,
” সত্যি কথা হলো আমারও মনে ছিল না।আমি ভাইয়ার থেকে জানতে পারলাম।সারপ্রাইজের প্ল্যানটা মূলত ওরই ছিল।”

আমার কিছুটা খারাপ লাগল।উনি আমার জন্য এতকিছু করল আর আমি একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলাম না।কত্ত খারাপ আমি!না না আমি কালকেই ভাইয়াকে থ্যাংক ইউ বলব।যেভাবেই হোক।

___________________________

পরেরদিন সকালে ঘরে এসে মা’কে ওদের সারপ্রাইজের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। মা তেমন কিছুই বলল না।কিন্তু যখন গিফটের বক্সটা সামনে রাখলাম তখন মা’য়ের মনেও কৌতূহল উঁকি দিল।
তাই সময় নষ্ট না করে কাগজে মোড়ানো বক্সটা খুলে ফেললাম।
ভেতরের বস্তুগুলো দেখো আমার চক্ষু চড়কগাছ।কিটক্যাট আর ডজনখানেক কানের দুলে বাক্স ভর্তি। এতগুলো কানের দুল দেখে খুশিতে আমি পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ছোট বড় সব সাইজের ঝুমকা।আমি আরো একবার স্বীকার করতে বাধ্য হলাম ভাইয়ার পছন্দ অসম্ভব সুন্দর!
এত ঝুমকা কবে পড়ব আমি?ডেইলি নতুন নতুন একটা পড়েও শেষ করা যাবে না।দেখে মনে হচ্ছে উনি দোকানের সব ঝুমকা নিয়ে এসেছেন।
খুশিতে গদগদ হয়ে মা’কে বললাম,

” তুষার ভাইয়া কিভাবে জানল আমার ঝুমকা পছন্দ? কিটক্যাট কত্তগুলো!আহা..আনন্দে আমার কেঁদে দিতে ইচ্ছে করছে।”

মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভ্রু কুঁচকে বলল,

” এই ডায়রীটাও দিয়েছে তোকে?”

ডায়রীর কথা মনে পড়তেই আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।ঝুমকাগুলোর একপাশে নীল সাদা সংমিশ্রণের একটি ডায়রী উঁকি মারছে।দেখে মনে হচ্ছে এটা নতুন কোনো ডায়রী।ভাইয়ার হাতে যেটা প্রায়ই দেখা যায় ওটা নয়।
মা’কে তো সব খুলে বলা যাবে না।মা আবার কি থেকে কি ভেবে বসবে।
আমতাআমতা করে বললাম,

” তাই তো দেখছি।ডায়রীও গিফট দিয়েছে।ভাইয়া কি যে করে না।আমার ডায়রীর কি দরকার।”

মা’য়ের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল।সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
” ডায়রী দিয়েছে ভালোই তো।লেখালেখি করতে পারবি।”

মায়ের হাসির কারণ আমি বুঝতে পারলাম না।রহস্য রহস্য গন্ধ!

_____________________

শেষ পর্যন্ত ভাইয়াকে আর ধন্যবাদ জানানো হলো না।ধন্যবাদ জানানোর ব্যপারটা মাথা থেকে আউট হয়ে গেছে। পড়ালেখা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।মাঝেমধ্যে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই।যে মেয়ে সারাদিনে চার কি পাঁচ ঘন্টাও ভালোভাবে বইয়ের সামনে থাকত না আর সে মেয়ে এখন ঘন্টার পর ঘন্টা বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে।
এদিকে তুষার ভাইয়াও অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।এ কারণে তিনি ডেইলি আসতে পারতেন না।শেষমেষ উনি নিজেই আমার জন্য একজন টিচার ঠিক করে দিলেন।একবার অফিস আরেকবার আমাকে পড়ানো বিষয়টা আসলেই হিমশিম খাওয়ার মত।
এখন যে টিচার টা আমাকে পড়ায় তিনি ভাইয়ার বান্ধবী। উনারা নাকি ভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিলেন।উনাকে আমি মিহি আপু বলো ডাকি।বেশ ভালোই পড়ায়।অবশ্য আমার টিচারের তেমন প্রয়োজনও ছিল না।সব বিষয়ই মোটামুটি আয়ত্তে আছে আমার।কিন্তু তুষার ভাইয়া সেই কথা কানেও তুললেন না।টিচার না থাকলে আমি নাকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন টিভি দেখায় গা ভাসিয়ে দেব।

.

দিন শেষে মাস পেরিয়ে আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলে আসলো।প্রস্তুতি ভালোই।কিন্তু সকাল থেকেই মনের কোণে একটা ভয় বাসা বেঁধে আছে।কাল পরীক্ষা এই কথাটা মনে হতেই কেমন অস্থির লাগছে।
আজ বেশি কিছু পড়ব না।গতকালই সব রিভিশন দেওয়া শেষ। আজ শুধু বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে কঠিন জিনিস গুলো চোখ বুলিয়ে নিব।

সন্ধ্যা মেলাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষার ভাইয়া বাসায় আসলেন।এখন তো উনার তেমন দেখাই পাওয়া যায় না।উনি নাকি প্রচন্ড ব্যস্ত।তাই বাসায়ও তেমন একটা আসেন না।গত শুক্রবার এসেছিলেন।মাঝখানে উনার দেখা পাইনি।আজ মনে হয় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন।

রুম থেকেই শুনতে পাচ্ছি মা’য়ের সাথে উনি খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছেন।এই আলাপের জন্যই আমার মা-বাবা দুজন আমাকে নিঃস্ব করে উনার বশে চলে গিয়েছে।যাই হোক।এসব প্যাঁচালো জিনিস নিয়ে চিন্তা করে এখন মাথা নষ্ট না করাই ভালো।

কিছু সময় পর ধরাম করে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম।সেটা আর কেউ নয়।আমাদের স্নো ভাইয়া।আমার শান্ত শিষ্ট মনটা এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যই হাজির হয়েছে কি না কে জানে।তাহলে আজকে আমি উনার গলা টিপে ধরব।তারপর ঠেলতে ঠেলতে মেইনডোর দিয়ে বাইরে নিয়ে ফেলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিব।

তুষার ভাইয়া শিষ বাজাতে বাজাতে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লেন।বসার নমুনা দেখে আমার রীতিমতো রাগ উঠে গেল।জলহস্তীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে বসা লাগে নাকি।মুখে কিছুই বললাম না।শুধু শুধু মাথা গরম করলে নিজেরই ক্ষতি।না জানি আমার তুলতুলে বিছানা কতটা কষ্ট পেয়েছে।
তুষার ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

” তোর চেহারা তো শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে রে নীল!শুটকি মাছের মত লাগছে দেখতে।”

আমি কিছুই বললাম না।মুখ উল্টো করে চেয়ারে বসে রইলাম।কিন্তু বসে থাকতে পারলাম না।
বিছানা থেকে ছোট একটা টেডিবিয়ার হাতে নিয়ে তুষার ভাইয়া একবার উপরে ছুড়ে আবার ক্যাচ ধরলেন।এটা দেখে আমার গা জ্বলে উঠল।এগুলো আমার প্রিয় জিনিস।কেউ হাত লাগালেই আমার শরীর রাগে রিরি করে উঠে।

” আপনি এটা নিয়ে এমন করছেন কেনো?যেখানে ছিল সেখানেই রাখুন।ছিড়ে যাবে।এগুলো কি খেলার জিনিস?আপনার এতই খেলতে ইচ্ছে করলে দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসুন।কেনো আমার গুলোর উপর নির্যাতন করছেন।”

তুষার ভাইয়া নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।আমার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলে।আমি সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছি আর উনি সমানে আমায় উপেক্ষা করছেন।খুব অপমান ফিল হচ্ছে আমার।
আমি আরো একবার জোর গলায় বললাম,

” ওটা রেখে দিন।ভাল হবে না কিন্তু। ”

তুষার ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,
” তোকে রাগাতে আমার এত ভালো লাগে।তুই নীল থেকে লাল হয়ে যাস।সেই লালের আভা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মুখে।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আমার মুখ লাল থেকে কালো হয়ে গেল।উনি আমাকে রাগানোর জন্যই এখানে এসেছেন তাহলে।উনার মত এত খারাপ লোক আমি আর দুটো দেখিনি। নীরব মুখে উঠতে গেলেই উনি আমাকে হাত টেনে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

” মামী থেকে শুনলাম তুই নাকি কয়েকদিন ধরে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস না।তোর কি মনে হয় খাওয়া ঘুম ছেড়ে সারাদিন বসে বসে টেনশন করলেই পরীক্ষা ভালো হবে?তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেনো নীল! তুই কাল পরীক্ষা দিতে যাবি।সেখানে প্রশ্ন দেওয়া হবে তুই উত্তর লিখবি।কিন্তু এমন ভাব করছিস যেন কাল অগ্নিপরীক্ষা। তোকে জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটতে বলা হবে।”

আমি কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে তুষার ভাইয়ার উজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকালাম।আমার কাছে তো সত্যিই অগ্নিপরীক্ষা মনে হচ্ছে।
তুষার ভাইয়া এবার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” শোন, পরীক্ষা নিয়ে ভয়ভীতির কারণটা হলো আমরা সবাই পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ফলাফল নিয়ে চিন্তা করি।যেটা আমাদের মনোবল নষ্ট করে দেয়।সেই চিরাচরিত নিয়ম মেনেও তুইও রেজাল্ট নিয়ে ভয় পাছিস।অথচ এখনো পরীক্ষার হলেই যাসনি।এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে অনেকসময় প্রিপারেশন ভালো থাকলেও পরীক্ষার খাতায় ঠিকমতো লিখতে পারে না কেউ।গত কয়েকমাস পড়ালেখা করেছিস তো তাই না?তাহলেই হবে।মাথায় শুধু এটাই রাখবি আমি যেহেতু পড়েছি আমি পারব।বুঝা গেল?”

আমি উপর নিচে মাথা দুলালাম।সত্যিই তো! আমি যেহেতু পড়াশোনা করেছি তাহলে এত ভয় কীসের!আশা করি পরীক্ষা ভালোই হবে।যাক উনার কথায় কিছুটা হলেও ভরসা পেলাম।যতটা খারাপ মনে করেছিলাম ততটা খারাপ নন উনি।

তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
” বেস্ট অফ লাক আমার নীল আশা!! আজ বেশি লেট করিস না।জলদি ঘুমিয়ে যাবি।আর যদি টেনশনের কারণে ঘুম না আসে তাহলে আমাকে ইনফর্ম করিস।তোর টেনশনকে আমি ফুঁ দিয়ে দূর করে দেব।আসি এখন।”

তুষার ভাইয়া চলে যেতেই আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এই লোকটাকে এখন কি ফুরফুরা লাগছে।কিন্তু যখন রেগে যায় তখন পুরো এটম বোম্ব।

.

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। প্রাণপণ চেষ্টা করছি মনটাকে উৎফুল্ল রাখার।
টেনশনকে ধারেকাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছি না।কাঙ্ক্ষিত সময়ে তৈরি হয়ে বসে আছি।বাবা মা দুজনেই আমার সাথে পরীক্ষা হলে যাবেন।তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম।দরজায় লক লাগাতে লাগাতে বাবা বলল,

” তোমার ফুপা ফুপি থেকে দোয়া নিয়ে আসো।পরীক্ষার দিনে গুরুজনদের থেকে দোয়া নিতে হয়।আমরা আর না যাই।নিচে অপেক্ষা করব তোমার জন্য।”

বাবার কথামতো চলে গেলাম পাঁচতলায়।মেইনডোর খোলাই ছিল।ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই তুষার ভাইয়ার সাথে দেখা।উনি ফরমাল ড্রেসে সোফায় বসে ফাইল ঘাটাঘাটি করছেন।আমাকে দেখতে পেয়েও কিছু বললেন না।
ভেতরের রুমে গিয়ে ফুপা ফুপি দুজন থেকে দোয়া নিলাম।ড্রয়িংরুমে আসতেই তুষার ভাইয়া বললেন,

” চল আমিই দিয়ে আসব।মামা মামী কি বাইরে অপেক্ষা করছে?”

আমি মাথা নাড়তেই উনি ফাইলপত্র গুছিয়ে উঠে পড়লেন।
গাড়িতে বাবা মা পেছনের সিটে আর আমি সামনের সিটে ভাইয়ার সাথে বসলাম।সারা রাস্তা উনি তেমন কোনো কথা বলেননি।শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছেন এডমিট কার্ড,কলম,পেন্সিল সব ঠিকঠাক মতো নিয়েছি কিনা।পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে আসতেই আমার বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল।গেইটে ঢুকার আগে বাবা মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি চোখ দিয়ে ভরসা দিলেন আমায়।আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

চলবে….

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৬

সময় কেটে যায় খুব দ্রুত গতিতে।এক ঘন্টা,দুই ঘন্টা পার হতে হতে দিনের চব্বিশ ঘন্টা কখন যে চলে যায় তা টেরও পাওয়া যায় না।
আমার পরীক্ষাকালীন সময় গুলোও এগিয়ে গেছে চোখের পলকে।প্র্যাকটিকেলের ঝামেলাও শেষ।অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।ইন্টারের প্যারাময় জীবন আর আমাকে ভুগতে হবে না।
আজ ছিল আমার লাস্ট প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। অন্যান্য পরীক্ষাও গুলো তেমন খারাপ হয় নি।শুধু হায়ার ম্যাথ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা করছি।জানি না কি হবে।

দুপুরে বাসায় এসে লাঞ্চ করে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছি।ঘুম ভেঙেছে পাঁচটার দিকে।বিছানায় উঠে বসতেই টের পেলাম আমার মনটা আজকে ভীষণ ভালো।ঝরঝরে লাগছে।পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে কিনা কে জানে।বিকেলে আর বাসা থেকে কোথাও বের হয়নি।সন্ধ্যার সময়টা মা’য়ের এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে করতেই কেটে গেল।তারপর বাবা বাসায় আসার পর আরো কতক্ষণ জমিয়ে আড্ডা দিলাম।

রাতে ডিনার শেষে নিজের রুমে এসে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লাম।কতদিন বইগুলোতে হাত দেই না।
কয়েক পাতা পড়তেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল।আমার জন্মদিনে তুষার ভাইয়া যে ডায়রীটা দিয়েছিল সেটা তো এখনো পর্যন্ত খুলে দেখিনি।সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মনেই নেই ডায়রীটা কোথায় রেখেছি।পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে সেটা খুলে দেখারও আগ্রহ বোধ করিনি।কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ ডায়রীর কথা মনে পড়ল কেনো!আমার ব্রেইন কি চাচ্ছে যে আমি ওটা খুলে দেখি!হয়তোবা।

তড়িঘড়ি করে পড়ার টেবিলে এলোমেলো করে রাখা বই-খাতা গুলোর মাঝে ডায়রীটা খুঁজতে লাগলাম।পেলাম না।কোথায় রেখেছি মনেই পড়ছে না।
প্রায় আধাঘন্টার মত পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম।
বিরক্ত হয়ে যখন বিছানায় বসলাম তখনই নজর গেল পড়ার টেবিলের লাগোয়া ড্রয়ারের দিকে।
চাবি নিয়ে তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে ফেললাম।
এইতো সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা!
আহ্! কি অবহেলিত অবস্থায় পড়েছিল এতদিন।

ডায়রীটা সযত্নে হাতে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।মলাট উল্টাতে নিতেই মনে পড়ে গেল ভাইয়া তো আমায় বলেছিল যেদিন উনার কথা অনেক বেশি মনে পড়বে সেদিনই যেন এটা খুলি।
কিন্তু আমি তো এখন উনাকে মিস করছি না।তাহলে?
ধুর এমন আবার হয় নাকি!উনি থাকেন পাঁচতলায় আমি থাকি চারতলায়।এত কাছাকাছি দুজন মানুষ থাকলে মিস করার ব্যপারটা কি করে তৈরি হবে।কোনোদিনও এমন হবে না।তাহলে কি আমি কোনোদিনও ডায়রীটা খুলব না?
ডায়রী যখন হাতে নিয়েছি তখন দেখেই ছাড়ব কি আছে এতে।
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগার পর শক্ত মলাট খুলে দিলাম।সাদা পৃষ্ঠার মধ্যখানে গাঢ় করে লেখা দুটো লাইনের উপর চোখ স্থির হয়ে গেল।

‘ কি করিলে বলো পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে ‘

কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম গোটা গোটা অক্ষরে লেখা লাইনগুলোর দিকে।
ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে আমার।জিভ দিয়ে বারংবার ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করছি।
তুষার ভাইয়া এই লেখা দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছে আমায়?এই লাইনগুলো তো একমাত্র নিজের প্রিয় মানুষকে উৎসর্গ করে লেখা যায়।আমি কি ভাইয়ার প্রিয় মানুষ?
প্রশ্নটা নিজের মনে উঁকি দিতেই হৃৎস্পন্দন উঠানামা করতে লাগল তীব্র গতিতে।এটা কি করে হতে পারে?আমার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরো একবার লাইনগুলোর দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে মৃদু হাত বুলিয়ে দিলাম।এগুলো কি আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

অপর পৃষ্ঠা উল্টানোর আর সাহস নেই আমার।এই দুটো লাইন আমায় উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে। কেনো আমি ডায়েরী টা খুলতে গেলাম।কেনো? কেনো?
ডায়রীটা বন্ধ করে পানির বোতল হাতে নিলাম।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করে বারান্দার কোনায় চেয়ারটায় বসলাম।এবার একটু স্মৃতিচারণ করা যাক।বিগত দিনগুলোতে তুষার ভাইয়াকে নিয়ে আমার সাথে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

মাস কয়েক আগে ছাদে ইয়াসির ভাইয়াকে লুকিয়ে দেখার কারণে উনি আমায় সপাটে এক চড় মেরেছিলেন।এটা মনে পড়লে এখনো আমার মাথা ঘুরে উঠে। এত সামান্য কারণে চড় মারার প্রশ্নই উঠে না।কিন্তু উনি প্রশ্ন উত্তর সব ছাড়িয়ে আমাকে চড়টা মেরেছিলেন।তারপর কলেজের সামনে এক ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করেছিল।ছেলেটাকে আর কখনো আমার সামনে আসতে দেখিনি।তুষার ভাইয়া এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন সামনে আসার মত অবস্থায় থাকলে তবে তো আসবে।তারমানে উনি ছেলেটাকে হয়তোবা আর ডিস্টার্ব না করার জন্য হুমকি দিয়েছে বা অন্যকিছু।
এর কিছুদিন পর বিল্ডিংয়ের গেইটের পাশে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে কথা বলতে দেখে উনি বাজেভাবে শাসিয়েছেন আমায়।তারপর থার্টি ফাস্ট নাইটের কাহিনী তো ভুলার মত নয়।সাদনান ভাইয়া আমাকে প্রপোজ করাতে উনি যথেষ্ট হম্বিতম্বি করেছেন।মোটকথা ছেলেদের থেকে দূরে রাখার জন্য উনি আমার সামনে পিছনে ধারালো এক ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।সমস্ত ঘটনাগুলো কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত দেয়?
এত স্পষ্ট বিষয়গুলো তখন আমার খেয়াল হলো না কেনো?অবশ্য খেয়াল না হওয়ারই তো কথা।উনার প্রতি তো আমার সেরকম কোনো অনুভূতি ছিল না।যার জন্য প্রত্যেকটা ঘটনাকে আমি খুব হালকাভাবে নিয়েছি।
চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিতেই তুষার ভাইয়ার ফর্সা উজ্জ্বল চেহারাটা ভেসে উঠল। যে চেহারা সবসময় প্রাণবন্ত, সদা হাস্যময় থাকে।কিন্তু যখন রাগের সম্পূর্ণ সীমানায় পৌঁছে যায় তখন সেই চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠে।সেই প্রাণবন্ত রূপ মুহুর্তেই তলিয়ে যায় কোথাও।
কি করে আমি উনার সামনে যাব?আচ্ছা এমন যদি হত যে আমি কোনোদিনও ডায়রীটা খুললাম না তাহলে কি উনার এই পাগলামোর কথা আমি জানতে পারতাম?উনি কি আমাকে কখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসে উনার মনের অনুভূতি গুলো শোনাতেন?

হঠাৎ করে আমি যেন একজন জ্ঞানী হয়ে উঠেছি।সবকিছু বুঝতে পারছি।সবকিছু পরিষ্কার আমার কাছে।তুষার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসেন?

উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরছি।আমি যাব না আর কখনো উনার সামনে।কক্ষনও না।উনার চোখে চোখ মেলানোর ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে আমার।

উনি তো প্রায় অনেকদিন হলো এই বাসায় পা রাখেন না।মা’য়ের থেকে শুনেছিলাম উনি কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত।খাওয়ারও নাকি টাইম পায় না।
আল্লাহ! উনি যেন কখনো এই বাসায় না আসে।উনার সামনে গেলে আমি যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই।

একরাশ ভালোলাগা, একদফা উত্তেজনা, একরাশ দ্বিধা যুক্ত মন নিয়ে আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।কিছুদূরেই নীল সাদা রঙের ডায়েরী টাও আমার মত হাত-পা ছেড়ে বিছানার সাথে মিশে আছে।ওটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।আমার এলোমেলো মন বলছে বাকি পৃষ্ঠাগুলো পড়ে ফেলি।কিন্তু শরীরে শক্তি পাচ্ছি না।তাই হাত বাড়িয়ে ডায়রীটা বেডসাইডের বক্সে রেখে দিলাম।
চোখে ঘুমের ঘ ও নেই।



পুরো রাতটা আধোঘুমে আধো জাগরণে কাটিয়ে সূর্যের মিষ্টি আলো ছড়ানো একটি নতুন সকালের সাক্ষী হলাম।কিচেনে যেতেই দেখি মা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে।আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

” চেহারা এমন লাগছে কেনো?রাতে ঘুম হয়নি?”

মা’য়ের চাহনি উপেক্ষা করে আমি জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরায় মনযোগ দিলাম।মা কি জাদু জানে নাকি!এক নিমিষেই সবটা বুঝে যায়।কিন্তু মা কি আমার মনের অবস্থাটাও বুঝতে পারছে?আমার মন যে অশান্ত, ভীষণ অশান্ত!

” হয়েছে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে হয়নি।হয়তোবা পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে।এখন আমার কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।ঠিক করো তাড়াতাড়ি কোথায় নিয়ে যাবা।”

আমার কথা শুনে মা কোনো জবাব দিল না।আমি আবারো বলে উঠে উঠলাম,

” এখন তো তুমি আমার কথা শুনতেই পাবে না।কানের কাছে চিল্লাচিল্লি করলেও শুনবে না।প্লিজ আমি ঘুরতে যাব।একটু মাইন্ড ফ্রেশের দরকার না?কয়েকদিন পর তো এডমিশনের জন্য আবার ধুমসে পড়া শুরু করতে হবে।”

মা নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিল,
” তোর বাবা’কে বলিস।”

মন খারাপ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।আমি জানি যেহেতু মা’য়ের ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে মত নেই তাহলে আমার কোথাও যাওয়া হবে না।
.

ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি আর পরোটা চিবুচ্ছি।বাবা একটু আগেই অফিসে চলে গেছেন।ঘুরতে যাওয়ার কথাটা ফেনিয়ে রসিয়ে বাবার সামনে উপস্থাপন করেছিলাম।বাবা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে চিন্তা না করতে।আমার খুশি আর দেখে কে।নিশ্চয়ই বাবা একটা ব্যবস্থা করবে।মা’য়ের থেকে বাবা আমাকে বেশি ভালোবাসে কিনা!
কলিংবেল বাজার শব্দে টিভি থেকে মনযোগ সরাতে হলো।দরজা খুলে সামনের মানুষটাকে দেখে থমকে গেলাম।তুষার ভাইয়া!!
আমার পেটের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল।মুখের ভেতর পরোটার আধ চিবানো টুকরোটা গিলার শক্তিও পাচ্ছি না।হাত-পা কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে।এমন হচ্ছে কেনো আমার!আমি কি আজ নতুন দেখছি উনাকে?

” তুই এই দুনিয়ায় আছিস?নাকি মঙ্গল গ্রহে ঠাই নিয়েছিস?”

তুষার ভাইয়ার কথায় আমার ঘোর কাটল।উনি ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ জনক চোখে তাকিয়ে আছেন।আমি সাথে সাথেই চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম।
তুষার ভাইয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

” পাগল টাগল হয়ে গেছিস নাকি?এমন হাবলার মত দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

কোনো উত্তর দিলাম না আমি।অন্যসময় হলে হয়তোবা উনার সাথে ঝগড়া লেগে বসতাম।কিন্তু আজ তা পারছি না।চুপচাপ গিয়ে সোফার এককোনায় বসে পড়লাম।
তুষার ভাইয়া আরো একবার সূক্ষ্ম নজরে আমার আপাদমস্তক দেখে ভেতরে চলে গেলেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here