মন_গহীনে পর্ব_২১/২২/২৩/২৪/২৫

মন_গহীনে পর্ব_২১
#সামান্তা_সিমি

ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।নিজেকে দেখছি খুঁটিয়ে খুটিয়ে।না চাইতেও নজর চলে যাচ্ছে চিবুকের গর্তটার দিকে।এই সামান্য গর্তও যে কারো কাছে এতটা প্রিয় হয়ে দাঁড়াবে তা কি কোনোদিনও ভাবতে পেরেছিলাম?
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই লজ্জায় রাঙা হচ্ছি।কিভাবে যাব তুষার ভাইয়ার সামনে।কিভাবে উনার চোখে চোখ মেলাব।নিশ্চিত জ্ঞান হারিয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।

ডায়রীর পাতা গুলো এই চারদিনে হাজারবার চষে ফেলেছি।যতবার পড়েছি ততবারই মনে হয়েছে উনি আমার সামনে বসে আছেন।স্থির চাহনিতে দেখছেন আমাকে।
এখন শুধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে তিনি ফিরবেন।উনি যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত উনার সাথে কথা হয় নি।ধুর! যদি একটা মোবাইল থাকত তাহলে কথা বলতে পারতাম।উনার গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছা হয়।আমাকে পাগল বানিয়ে নিজে তো পরদেশে গিয়ে বসে আছে।
মাঝে মাঝে একলা ঘরে বসে উনার কথা ভাবতে গিয়ে আনমনেই হেসে উঠি।কখনো দুহাত দুইদিকে মেলে অনবরত ঘুরতে থাকি।আবার কখনো আয়নার সামনে বসে নিজেই নিজের সাথে বাক্যালাপ করি।এসব করতে গিয়ে সেদিন তো মা’য়ের সামনে লজ্জায়ও পড়েছি।

সেদিন বিকেলে মা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য রুমে ঢুকতেই আমাকে হাস্যরত অবস্থায় দেখে ফেলেছে।বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পেড়েছিলাম তখন।মা কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুই একা বসে হাসছিস যে?কি হয়েছে তোর?শরীর ঠিক আছে?”

মা’য়ের কথা শুনে মুখ কালো করে ফেলেছিলাম।সবকিছুতেই মা এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেই করবে।দেখা যাবে পানির গ্লাস আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে তখন জিজ্ঞেস করবে শরীর ঠিকঠাক? আবার যদি বলি মা ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কেনো জানি।তখনও বলবে শরীর মনে হয় ঠিক নেই।

.

রাতের বেলা ড্রয়িংরুমে বাবার সাথে বসে টিভি দেখছি।মা কিছুদূরে সোফায় মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।একটু আগে মা এবং বাবার মাঝে ছোটখাটো একটা মিষ্টি ঝগড়া হয়ে গেছে।আমার কাছে এটা মিষ্টি হলেও মা’য়ের কাছে খুবই ভয়াবহ ব্যাপার।
মা এসেছিল টিভিতে সিরিয়াল দেখতে।সেইসময় বাবাও হাজির নিউজ দেখবে বলে।ব্যস! শুরু হয়ে গেল দুইজনের তর্কাতর্কি।রুমে বসে আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছি আসল ঘটনা।এগুলো শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত।তবুও কৌতুহলের কারণে ড্রয়িংরুমে একবার উঁকি দিলাম।বাবা আমাকে দেখে বলে উঠল,

” তোমার মা’য়ের জি বাংলা, স্টার জলসা ছাড়া চলে না।এসব দেখে কি লাভ হয় তুমিই বলতো মা!এগুলো দেখলে ভালো মানুষও কূটনামী শিখে ফেলবে অচিরেই।এরচেয়ে ভালো বসে বসে নিউজ দেখা।দেশ বিদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।”

বাবার কথা শুনে মা সাথে সাথে তেতে উঠল।চোখমুখ পাকিয়ে বলল,

” তোর বাবার কথায় সায় দিবি না নীলাশা।আমাকে উনি নিউজের উপকারিতা শিখাতে আসে!তুই জানিস তোর বাবা কোন পদ্ধতিতে নিউজ দেখে?সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।যখনই আমি রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে যাব তখনই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে।”

” দেখলে নীলাশা! আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।কেমন কূটনীতিবাজ হয়ে গেছে তোমার মা।আরে আমি আবার কখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখলাম।তোমার মা’য়েরই চোখে দেখার ভুল।”

” দেখ্ দেখ্ নীলাশা তোর বাবা ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে কিন্তু কানা বলছে।সরাসরি না বললেও কি আমি বুঝতে পারি না।তোর বাবা মনে করে সে ছাড়া দুনিয়ার সবাই বেকুব,সবাই অবুঝ।”

” নীলাশা সবাই অবুঝ কিনা জানি না।কিন্তু তোমার মা যে অবুঝ এটা স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।”

তর্কাতর্কি আরো বেড়ে গেল।আমি একবার বাবার দিকে আরেকবার মা’য়ের দিকে তাকাচ্ছি। তাদের ঝগড়া দেখে খারাপ লাগছে না।কেমন বাচ্চাদের মত ঝগড়া করছে।
ঝগড়ার শেষ পর্যায়ে মা হেরে গেল।বাবা বিজয়ীর মুখে সোফায় আয়েশ করে বসেছেন নিউজ দেখার জন্য। সাথে আমাকেও বসিয়ে রেখেছেন।সেই থেকে আমিও নিউজ দেখছি।

মা’য়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আমাকে ইশারায় কিছু দেখাচ্ছে। মা’য়ের দৃষ্টি অনুসরণ তাকিয়ে দেখি বাবা সত্যি সত্যিই সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঝিমাচ্ছেন।আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।মাও আমার সাথে গলা মেলাল।দুজনের হাসির আওয়াজ পেয়ে বাবা ধড়ফড় করে উঠে বসলেন।কিছু বলতে যাবে এমন সময় টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে উঠল।স্ক্রিনে ফারদিন তুষার নামটা দেখেই আমার ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করতে লাগল।মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়েছেন উনি।
বাবা হাত বাড়িয়ে কল রিসিভ করলেন।তখনই স্ক্রিনে ভেসে উঠল উনার শক্তপোক্ত গড়নের মুখচ্ছবি। আজ কতদিন পর উনাকে নড়নচড়ন অবস্থায় দেখতে পেলাম।
তুষার ভাইয়া যাতে আমাকে দেখতে না পায় তাই আমি সোফার অপর পাশে চেপে বসলাম।তবে আমি ভালো করেই উনাকে দেখতে পাচ্ছি।
মা বাবা তুষার ভাইয়াকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছে।উনিও হেসে জবাব দিচ্ছেন। আমি শুধু অপলক দেখছি উনাকে।
হঠাৎ করেই তুষার ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,

” নীল কেমন আছে?সে কি কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে?”

বাবা বলল,
” এইতো নীলাশা এখানেই বসে আছে।নে কথা বল।”

বাবা আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন।
তুষার ভাইয়ার মুখ গম্ভীর।চোখে কাঠিন্যতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। উনি এভাবে কেনো দেখছেন আমায়?উনি দেশের বাইরে যাওয়ার আগে কোনো কারণে আমার উপর রেগেছিলেন নাকি?

” ক..কেমন আছেন তুষার ভাইয়া? ”

তুষার ভাইয়া এখনো অদ্ভুত চোখে দেখছেন আমায়।মনে হচ্ছে যেন এই মেয়েটাকে প্রথমবার দেখছেন।
হয়তোবা আমাকে ভিডিও কলে কাজের মহিলার মত লাগছে যার জন্য আমাকে চিনতেই পারছেন না।ধুর!উনি কল দিবে জানলে আমি চুল টুল আঁচড়ে সেজেগুজে বসে থাকতাম।

” ভাইয়া আপনি…”

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তুষার ভাইয়া কল কেটে দিলেন।মুখটা চুপসে গেল আমার।কি হলো এটা?উনি কি ইচ্ছে করেই এমন করলেন?
বাবাকে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে চলে গেলাম নিজের রুমে।মনটাই খারাপ হয়ে গেল।কিছুটা অপমানও বোধ হচ্ছে।

_______________________

বিকেলে চলে গেলাম ফুপির বাসায়।বাসায় বসে বসে বিরক্ত হওয়া ছাড়া তো আর কোনো কাজ নেই।তারচেয়ে ভালো তুষ্টি আপুর সাথে আড্ডা দেব।সুযোগ পেলে তুষার ভাইয়ার কথাও জিজ্ঞেস করে ফেলব।
রুমে ঢুকে দেখি আপু কারো সাথে ফোনে কথা বলায় মশগুল।আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মিষ্টি হাসলেন।আমাকে ফিসফিস করে বলল,

” ভাইয়া কল করেছে কথা বলবি?”

বড়সড় একটা ঢুক গিললাম।মন তো চাইছে একটাবার কথা বলতে কিন্তু উনার প্রতি অভিমান জমে আছে এক বুক।মাথা নেড়ে আপুকে বুঝিয়ে দিলাম কথা বলতে চাই না আমি।কিন্তু আপু তা গায়ে মাখল না।উল্টে বলল,

” নাও ভাইয়া..নীলাশা আমার সাথেই আছে।কথা বলো”

আপু জোর করে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন।এমন ঝামেলায় পড়তে হবে জানলে এখানে কখনোই আসতাম না।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

” হ্যালো ভাইয়া..!”

আমাকে অবাক করে দিয়ে আবারো খট করে ফোন কেটে দিলেন উনি।অসহায়ের মত আপুকে ফোনটা দিয়ে দিলাম।অপমানে কষ্টে এবার আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।আর যাই হোক কেউ আমাকে অবহেলা করলে সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারি না।আর অবহেলা যদি প্রিয় মানুষটা করে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে বললাম,

” তোমার ভাইটা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না তুষ্টি আপু!দেখলে কিভাবে মুখের উপর ফোন কেটে দিল!এজন্যই আমি কথা বলতে চাই নি।খুবই খারাপ লোক উনি।কোনো ম্যানারস্ জানে না।”

” আরে নীল বনু তুই শুধু শুধু মন খারাপ করছিস।ভাইয়ার হয়তোবা কোনো আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছিল।তাই..”

” হ্যাঁ আমি কথা বলার সময়ই উনাকে আর্জেন্ট কাজগুলো ডাকাডাকি করে।আসলে উনি আমার সাথে কথা বলতেই চায় না।অপছন্দ করে আমাকে।”

” প্লিজ থাম নীলাশা। তুই জানিস ভাইয়া তোকে কতটা….”

” কতটা কি?”

” বাদ দে।চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি।এতক্ষণে রোদ পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। একটু হাঁটাহাঁটি করা যাবে।”

ছাদে গিয়ে আপু নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা জুড়ে দিল।আমার সেগুলোতে মন নেই একফোঁটা। শুধু ভাবছি উনি আমাকে প্রত্যেক্ষভাবে এরকম ইগনোর করছেন কেনো?বিদেশে গিয়ে কি নতুন কাউকে পছন্দ হয়ে গেছে। এদিকে আমি উনার জন্য মনের ভেতর হাজারো প্রেমের অনুভূতি সাজিয়ে রেখেছি আর উনি একেকটা অবহেলা দ্বারা দূরে ঢেলে দিচ্ছেন আমায়।ডায়রীর লেখাগুলোর সাথে বাস্তবে উনার আচার ব্যবহারে কোনোই মিল পাচ্ছি না।আমি কি তাহলে উনার মোহ ছিলাম?মোহ কেটে গেছে এখন আর আমাকে ভালো লাগে না।সরাসরি যদি উনি আমাকে এমন অবহেলা করে তাহলে সেটা কোনোমতেই সহ্য করতে পারব না।এখন বুঝতে পারছি প্রথম প্রেম যতটা না খুশির উত্তেজনা নিয়ে আসে তারচেয়েও বেশি কষ্ট দেয়।কেনো উনি আমাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করালো?নিজের ছোট্ট দুনিয়ায় আমি তো ভালই ছিলাম।সেখানে কেউ আমাকে অবহেলা করত না,কেউ কষ্ট দিত না।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২২

কেটে গেছে আরো কয়েকটা দিন।সকালে পূর্বদিকে সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ে।আবার নিয়ম মেনে বিকেলে সেই সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিম পাড়ে। ঠিক এমনই নিয়ম মেনে আমার ছোট্ট মনটাও প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণায় ভুগছে।এ যন্ত্রণা কেউ দেখতে পায় না।কাউকে বুঝানো যায় না।বাইরে থেকে হাসিখুশি থেকে ভেতরে তা চেপে রাখতে হয়।আমি অসহ্য হয়ে গেছি।তুষার ভাইয়ার সেদিনের ব্যবহারের কথাটা মনে পড়লেই চোখের কোণে পানি জমে উঠে।
এরপর আরো কয়েকদিন উনি বাবাকে কল করেছিলেন।তখন আমি আশেপাশেও থাকিনি।কি দরকার?উনি আমার সাথে কথা বলতে চায় না তাহলে আমি কেনো আগ্রহ দেখাবো?
মা বলেছিল উনি নাকি আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে।কি করি,বাইরে কোথাও যাই কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি উনার ব্যপারে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।মনে জমে আছে অভিমানের স্তূপ।উনি কবে ফিরবেন সেটা নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।পনেরদিন পর আসুক আর একমাস পর আসুক তাতে আমার কি!একবছর পর আসলেও আমি খোঁজ নেব না।

যতই নিজেকে এটা সেটা বলে বুঝাই অবাধ্য মনটাকে মানাতে পারি না।ঘুরেফিরে সেই উনার কাছেই ফিরে যায়।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।মাঝেমধ্যে কিছু অদ্ভুত কর্মকান্ডও করে বেড়াচ্ছি। যেমন,
গতকাল পানি খাওয়ার জন্য গ্লাসে পানি ঢালছি।গ্লাস ভর্তি হয়ে পানি উপচে পড়ছে অথচ আমার খেয়াল নেই।পুরো টেবিল ভেসে যাওয়ার পর হুঁশ আসলো।মা এসে কিছুক্ষণ বকাঝকা করেছে।
সন্ধ্যায় বাবাকে চা বানিয়ে দিলাম।কাপে একচুমুক দিয়ে বাবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।জিজ্ঞেস করলাম,

” চা কি ভালো হয়নি বাবা?খাচ্ছো না কেনো?”

চায়ের কাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা হেসে বলল,
” ভালো হয়েছে কিন্তু লবণটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।”

এই কথা শুনে লজ্জায় আমার মাথাকাটা গেল।নিশ্চয়ই মনের ভুলে চিনির বদলে লবণ দিয়ে বসে আছি।ইস! বাবা এখন ভাববে তাঁর মেয়ে এখনো এক কাপ চা বানাতে অক্ষম।নিজের উপর রাগ হচ্ছিল খুব।

রাতে বালিশে মাথা রাখতেই মন খারাপেরা দল বেঁধে হানা দিল।আমি খেয়াল করেছি দিনের বেলাটা যেমনই কাটে,রাতের অন্ধকারে যন্ত্রণা গুলো যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়।মন বলছে তুষার ভাইয়া বিদেশ থেকে তাঁর নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসবে।হয়তোবা বিয়েও করে ফেলতে পারে।যদি এমনই হয় তাহলে ওই ডায়রী আমি আগুনে পোড়াব।
নানা আজগুবি কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তপ্ত দীর্ঘশ্বাস!একসময় চোখে ঘুম জড়িয়ে আসল।

.

মুখের উপর রোদের তীব্র রশ্মি অনুভব হতেই বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে ফেললাম।ঘুমের কারণে চোখ খোলার শক্তি পাচ্ছি না।তবে মেজাজ প্রচন্ড গরম হচ্ছে। আজ মা’য়ের কি হলো!কোনোদিন তো এমন করে না।নিশ্চয়ই জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়েছে।অসহ্য!
চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম,

” পর্দা লাগাও মা!রোদের কারণে গরম লাগছে আমার।”

কোনো সাড়াশব্দ নেই।পাশ ফিরে রোদ থেকে বাঁচার জন্য চেপে গেলাম।এবার তো মনে হচ্ছে রোদের তেজ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
লাফ দিয়ে উঠে বললাম,

” ধ্যাত্! কেউ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না নাকি।আমি যে ঘুমাচ্ছি এটা কারোর সহ্য হচ্ছে না তাই না?আমি থাকব না এই বাসায়!আজকেই বেরিয়ে……”

সামনের মানুষটাকে দেখে থেমে যেতে হলো আমার।আমি কি ভুলভাল কিছু দেখছি নাকি?বোধ হয় স্বপ্নে আছি এখনো।
দুইদিকে মাথাটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে চোখ কচলে নিলাম।আবারো একই দৃশ্য! তারমানে এটা সত্যি!
তুষার ভাইয়া আমার পড়ার টেবিলের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে আরামসে বসে আছেন।গায়ের অ্যাশ কালারের শার্টটা বিভিন্ন জায়গায় কুঁচকে আছে।মাথার চুলগুলোও সামান্য এলোমেলো। উনার হাতে মোবাইল।দেখে মনে হচ্ছে গেইম খেলায় ব্যস্ত।
আমি অবাক হয়ে দেখছি উনাকে।কিন্তু উনি জানপ্রাণ দিয়ে গেইম খেলে যাচ্ছেন। এই সাতসকালে উনার আগমন আমায় অবাকের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।

তুষার ভাইয়া মাথা তুলে একপলক আমাকে দেখে আবার মোবাইলে মনযোগ দিলেন।আমি এখনো কিছুই বলছি না।উনি এবার মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।

” তুই শান্তিতে থাকলে তো সবার আগে আমার সহ্য হয় না।তাই আমিই নিজের হাতে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়েছি।”

আমি কোনো উত্তর দিচ্ছি না।অপলক তাকিয়ে আছি উনার শান্ত গভীর দুটো চোখের দিকে।
তুষার ভাইয়া আবার বললেন,

” চুপ মেরে আছিস কেনো?একটু আগে কি বলছিলি?এই বাসায় থাকবি না তাই তো?সমস্যা নেই।বিয়ের জন্য তৈরি হ।তোকে খুব তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে মামা মামীকে টেনশনমুক্ত করব।বিয়ের জন্য কেমন পাত্র চাই বল।আমার হাতে বর্তমানে একটা সুপাত্র আছে।ছেলেটার সবই ঠিক আছে।শুধু মাথায় টাক।এটা কোনো ব্যাপার না।বিয়ে হলো মনের মিল।মনের মিলের কাছে টাকফাক কিছু না। ”

আমি টের পাচ্ছি আমার চোখ ছলছল করে উঠছে।নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। যে মানুষটাকে এতদিন ভেবে নির্ঘুম রাত পার করেছি,যে মানুষটা আমার ছোট্ট সাজানো দুনিয়ায় অনায়াসে প্রবেশ করে আমাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে সেই মানুষটা এই মুহূর্তে আমার সামনে বসে কি সতেজ মনে ইয়ার্কি করে চলেছে।ঠিক যেমন আগে করতেন।
হঠাৎ করেই ডায়রীর গুটিকয়েক লাইন আমার মনে পড়ে গেল।

‘ বিশ্বাস কর আর পারছি না এভাবে থাকতে।একতরফা ভালোবাসতে গিয়ে ক্লান্ত আমি।আমার পাগলাটে মন তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে আছে।তুই হবি কি আমার?’

নিজেকে সামলাতে পারলাম না আর।তুষার ভাইয়ার প্রতি যত অভিমান জমে ছিল,যত রাগ জমে ছিল সব ভুলে গিয়ে উনাকে দুইহাতে শক্ত জড়িয়ে ধরলাম।উনার অগোছালো শার্টটাকে খামচে ধরে আরো অগোছালো করে দিচ্ছি। একহাতে শার্ট অন্যহাতে এলোমেলো চুলগুলোকে আঁকড়ে ধরলাম।না চাইতেও চোখ দিয়ে নোনা জল বের হয়ে গেল।ফুঁপিয়ে কান্না করছি আমি।

তুষার ভাইয়া কোনো রেসপন্স করছেন না।আমি এমন কিছু করব তা বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবেনি।না ভাবলে না ভাবুক।আমিও আর পারছি না উনাকে ছাড়া থাকতে।আমিও চাই উনাকে ভালোবাসতে।উনি আমাকে যতটা ভালোবাসে তারচেয়ে তিনগুন ভালোবাসতে চাই আমি।

কিছুক্ষণ পর পিঠে উনার হাতের আলতো স্পর্শ পেলাম।মনে হচ্ছে ধরতে গিয়েও ধরছেন না আমায়। ভাঙা গলায় বলে উঠলেন,

” নীল..!”

আমি আরো শক্ত করে উনাকে চেপে ধরলাম।মন চাইছে উনার বুকের ভেতর ঢুকে যেতে।যেখানে শুধু আমার বসবাস।

” আপনি খুব খারাপ তুষার ভাইয়া।পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ আপনি!আপনাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কি পেয়েছেন আপনি?ডায়রী লিখে পাতা ভর্তি করে আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন তাই না?এতই যদি ভালোবাসেন তাহলে সেদিন আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করলেন?খুব কষ্ট পেয়েছি আমি।খুব!”

” নীল…তুই ডায়রী..”

” হ্যাঁ আমি ডায়রী পড়ে ফেলেছি।একবার নয় হাজারবার।আপনার বিখ্যাত ডায়রী আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।মাছকে পানি থেকে ডাঙায় আনলে যেমন ছটফট করে আমার তেমন অবস্থা হয়েছে।নানা উদ্ভট কাজ করে বেরিয়েছি।সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী।”

এবার তুষার ভাইয়া আমাকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন।মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার।মনের ভেতর ভালোলাগার প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।
আমার অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলিয়ে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” তুই ঘুম থেকে উঠার এক ঘন্টা আগে বাসায় এসে পৌঁছেছি।জামাকাপড় চেঞ্জ পর্যন্ত করিনি দেখ্।তোকে দেখার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছিলাম না।তাই ছুটে এসেছি।কিন্তু তুই আমার জন্য এত বড় সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করে রেখেছিস তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।ভালোবাসি নীল।খুব ভালোবাসি তোকে।”

তুষার ভাইয়া আমার মাথায় চুমু খেলেন।উনার ঘাড়ে আমার মাথাটা আরেকটু চেপে বললাম,

” ভালোবাসা একসেপ্টেড মিস্টার তুষার!আমিও কিন্তু সারপ্রাইজড হয়েছি।ঘুম থেকে উঠে আপনাকে দেখে শকড হয়ে গেছিলাম।”

তুষার ভাইয়া আরো নিবিড়ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।আমিও পরম শান্তিতে উনার ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে আছি।ভালো লাগছে এভাবে থাকতে।উনার শরীর থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা স্মেল আসছে।

হঠাৎ করে মা’য়ের কথা মনে পড়তেই উনাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলাম।আমি তো দিনদুনিয়া ভুল মেরে বসে আছি।মা তো যেকোনো সময় রুমে চলে আসতো পারত।হায় আল্লাহ!জোর বাঁচা বেঁচে গেছি।
তুষার ভাইয়া রাগ দেখিয়ে বললেন,

” দূরে গেলি কেনো?কাছে আয়।আমার আরো কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।”

” এহ্! ভুলে গেছেন যে এটা আমার বাসা?যে কোনো সময় মা এসে যাবে।যদি এই অবস্থায় দেখত তাহলে কি ভয়ানক কান্ড হত ভাবতে পারছেন?”

” না ভাবতে পারছি না।কারণ মামী জানে এখন তাঁর মেয়ে এবং হবু জামাইয়ের কথোপকথন চলছে।”

” মানে?”

” মানে কিছু না।”

” বলুন!এত রহস্য নিয়ে কথা বলবেন না।আর সবার প্রথমে আমি এটা জানতে চাই আপনি কেনো সেদিন আমার সাথে ওরকম ব্যবহার করেছিলেন। ”

তুষার ভাইয়া মস্ত একটা হাই তুলে বললেন,
” আমি ভীষণ টায়ার্ড।তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মুড নেই আমার।শোন আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।একটা ধুমধাড়াক্কা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য। ”

আমার মনে এই মুহূর্তে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মা সবটা জানে।হায় হায়! এত ঘটনা কবে ঘটনা কবে ঘটল?এই লোক তলে তলে আরো কি অঘটন ঘটিয়ে রেখেছে কে জানে।
তুষার ভাইয়া উঠে দাঁড়াতেই আমি বললাম,

” শুনুন! আমি ভোরবেলা স্বপ্ন দেখেছি আপনি বিদেশ থেকে কোনো মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুপিকে বলছেন যে মেয়েটা আপনার বিবাহিত বউ।যেহেতু স্বপ্নটা ভোরের দিকে দেখেছি তাই আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে আপনি সত্যিই কাউকে নিয়ে এসেছেন নাকি?জলদি বলেন।আমি আপনাকে আর ওই মেয়েকে কুচিকুচি করে কেটে পাশের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসব হুম।”

আমার লম্বা বক্তৃতা শুনে তুষার ভাইয়ার কোনো ভাবান্তর হলো না।উনি চোখ ছোট ছোট করে দেখছেন আমায়।উনার এমন চেহারা দেখে আমি হেসে ফেললাম।
তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে আমার নাক টেনে বললেন,

” খুব কথা শিখেছিস তাই না?আসছি।”

উনি চলে গেলেন।আমি ঠোঁট টিপে নিজের মনেই হাসছি।আহ্! কি সুখ সুখ লাগছে।দুহাতে মুখ ঢেকে আবার সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৩

তুষার ভাইয়ার রুমে আমি এবং তুষ্টি আপু হাত জড়াজড়ি করে বসে আছি।দুজনের মুখেই দারুণ উত্তেজনা।ফিসফিস করে একে অপরের সাথে কথা বলছি আর তুষার ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

কিছুক্ষণ পর খুট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো।আমরা দুজন সচকিত হয়ে বসলাম।তুষার ভাইয়া শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছেন।উনার গলায় সাদা টাওয়াল ঝুলানো।গায়ে খয়েরি রঙের টি-শার্ট। পরনে ব্ল্যাক ট্রাউজার্স। উনার চুল থেকে টপটপ পানি পড়ে টি-শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
আমি আড়চোখে তাকিয়ে উনাকে দেখে নিলাম একবার।শাওয়ার নিয়ে বের হলে উনার জ্বেল্লা মনে হয় দ্বিগুন বেড়ে যায়।এত রূপ তো আমারো নেই।হুহ্!মাঝেমাঝে বড্ড হিংসা হয় আমার।
তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসলাম।উনার ঠোঁটে বাকা হাসি।

তুষ্টি আপু বলল,
” আমি যা বলেছিলাম সেটা এনেছো তো ভাইয়া?আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না বের করো তাড়াতাড়ি।”

তুষার ভাইয়া এক ভ্রু উঁচু করে মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
” দূর হ ফকিন্নি।আমি নিজের কাজে ওখানে গিয়েছিলাম।তোর জিনিসপত্র আনার জন্য যাইনি।”

” ভাইয়া! না আনলে নাই।ফকিন্নি কেনো বলবা?তুমি জানো আমার কাছে বর্তমানে কত টাকা আছে?আমার সঞ্চয় সম্পর্কে তোমার ধারণাও নেই।”

” এইতো এবার লাইনে এসো বাছাধন। নিজের যখন এতই টাকা তাহলে নিজের জিনিসপত্র গুলো নিজেই কিনে নে।আমাকে বলতে আসবি না।তোর আবদার পূরণ করতে করতে আমার বাপের একাউন্ট শেষ হতে বেশিদিন লাগবে না।এইমাসেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি।শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজের জামাইয়ের টাকা যত ইচ্ছা খরচ কর যা।”

” আমাকে খোঁটা দিলে তুমি ভাইয়া?তোমার একটা মাত্র বোন আমি।আমার বাবার একমাত্র মেয়ে।তোমাকে অভিশাপ দিলাম আমি খুব শীঘ্রই তোমার আইফোন টা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে।দুঃখী মেয়ের অভিশাপ কোনোমতেই মিস হবে না।”

” আহারে! তোকে দুঃখী মনে করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাই না আমি।সব এঙ্গেল থেকে তোকে শকুনি মনে হয়।শকুনির অভিশাপে আইফোনের কিছু হয় না এটা জানিস না?”

তুষ্টি আপু মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন।তাদের ঝগড়াগুলো এতক্ষণ নিঃশব্দে উপভোগ করে যাচ্ছিলাম।কিন্তু তুষ্টি আপুর জন্য বেশ খারাপ লাগছে।কিছু একটা বলতেই হবে।বোন হয়ে বোনের পাশে না দাঁড়ালে হয় নাকি?
তুষ্টি আপুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,

” আমার মিষ্টি আপু।ওই ভাল্লুকটার কথায় কান দিও না তো!চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।আমরা তো এখানে স্বইচ্ছায় অপমানিত হতে আসিনি।”

তুষার ভাইয়া ঠোঁট কামড়ে বললেন,
” এই যে পিচ্চি! সাফাই গাইতে এসেছেন তাই না?আর ভাল্লুক কাকে বলছেন?এতদিন যা বলেছেন ঠিক আছে।কিন্তু এখন থেকে একটু ভেবে চিন্তে কথা বলিয়েন।”

তুষার ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলেন।ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি।শয়তান লোক একটা।

আমাদের অবাক করে দিয়ে তুষার ভাইয়া দুটো ব্যাগ এগিয়ে দিলেন।আমরা নিচ্ছি না দেখে ভ্রু কুঁচকে ইশারা করলেন নেওয়ার জন্য। তুষ্টি আপু খপ করে কেড়ে নিল ব্যাগ গুলো।
ব্যাগ খুলে আরো অবাক হয়ে গেলাম।দুইটা নতুন ফোন!

তুষ্টি আপু আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
” আমি জানতাম ভাইয়া তুমি আনবে আমার জন্য। মাই সুইট ব্রাদার!আমি আমার অভিশাপ তুলে নিলাম ঠিক আছে? আম্মু দেখো..ভাইয়া আমার জন্য নতুন ফোন এনেছে। ইয়াহু..লা লা লা।”

চিল্লাতে চিল্লাতে তুষ্টি আপু রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি হা করে তাকিয়ে আছি।এক মুহূর্তের জন্য আপু যেন বাচ্চা হয়ে গেছে।

” এই যে মিস, শোনেন প্লিজ! ব্যাগ খুলে দেখেন আপনার ফোন পছন্দ হয়েছে কিনা।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আরেক দফা অবাক হলাম।আল্লাহ! আজ অবাক হতে হতে আমি না হার্টঅ্যাটাক করে ফেলি।
ভাইয়া আমার জন্য ফোন কিনে এনেছে!এটাই তাহলে ধুমধাড়াক্কা সারপ্রাইজ ছিল?আহ্! খুশিতে আমি পাগল না হয়ে যাই।
ঝটপট ব্যাগ খুলতেই চকচকে ব্ল্যাক কালারের ফোন বেরিয়ে আসলো।আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বললাম,

” এটা আমার ফোন!থ্যাংক ইউ সো মাচ্ ভাইয়া!খুব পছন্দ হয়েছে।”

তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পড়তে আবারো লজ্জা পেয়ে গেলাম।উনি কেমন ঘোরলাগা চোখে দেখছেন আমায়।এমনভাবে দেখার কি আছে?

” আপনি অন্যদিকে তাকান তো!আমার কেমন যেন লাগছে।”

উনি মুচকি হাসলেন।আমার গাল টেনে বললেন,
” আমার লজ্জাবতীরে!আজ আমি খুব খুশি নীল।এতটা খুশি যে কোন পদ্ধতিতে প্রকাশ করব তা খুঁজে পাচ্ছি না।ইচ্ছে করছে তোকে কোলে নিয়ে নেচে বেড়াই।সারদিন বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি।ইচ্ছামত চুমু খাই।”

উনার কথা শুনে আমি কেশে উঠলাম।উনি কি বলছেন নিজেরই বোধ হয় খেয়াল নেই।তবে উনার আনন্দমাখা চেহারা দেখতে খুব ভালো লাগছে।আমার তুষার ভাইয়ার উপর যেন কারো নজর না লাগে!

বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতে তুষার ভাইয়া আবার ডাকলেন।উনি বিছানায় বসে আছেন।কোলের উপর ল্যাপটপ।আমি সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

” কি?”

ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে উনি বললেন,

” কাছে আয়।তারপর বলছি।”

আমি দুইকদম সামনে এগিয়ে গেলাম।

” হয়নি।আরো কাছে আয়।”

” আরে আমার দুইটা কান আছে তো।আমি শুনতে পাই।আপনি ওখান থেকেই বলুন।”

” আমার কথার উপর দিয়ে কথা বলছিস কেনো?আমি উঠে আসলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”

বিরক্তমুখ নিয়ে উনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি বললেন,

” এবার নিচু হ।সিক্রেট কথা।কানে কানে বলতে হবে।”

নিচের দিকে কিছুটা ঝুঁকতেই তুষার ভাইয়া হঠাৎ আমার গালে চুমু খেয়ে নিলেন।আমি তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে গেলাম।ধাক্কা সামলাতে না পেরে স্ট্যাচু হয়ে গেছি।
চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকাতে বললেন,

” এটাই সিক্রেট কথা।যা এখন ভাগ।আমার অনেক কাজ আছে।তুই সামনে থাকলে কাজে মন বসবে না।যাওয়ার সময় মাকে বলিস আমার জন্য এক কাপ কোল্ড কফি পাঠাতে।”

তুষার ভাইয়ার স্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে আমি আরো বেকুব বনে গেলাম।উনি এমন ভাব করছেন যেন কিছুই হয় নি।গালে চুমু খাওয়া অতি সাধারণ ঘটনা।আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
লজ্জায় আটখানা হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে।

_______________________

কাঁচের দেয়াল ঘেরা রেস্টুরেন্টে তুষার ভাইয়া এবং আমি মুখোমুখি বসে আছি।আমার পাশেই তুষ্টি আপু গভীর মনযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছেন। সকালে নতুন মোবাইল পাওয়ার পর থেকে আপু এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করছেন না।রেস্টুরেন্ট এসেছি প্রায় আধাঘন্টার মত হবে।আপু এখনো মোবাইল চালিয়েই যাচ্ছেন।
আর এদিকে অস্বস্তিতে আমার প্রাণ যায় যায়।তুষার ভাইয়ার মুখোমুখি বসাতে উনি একধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনাকে চোখের ইশারায় অনেকবার বলেছি অন্যদিকে তাকাতে।আমার ইশারা পাত্তা না দিয়ে উল্টে উনি ঠোঁট কামড়ে হেসেছেন।

শেষে বাধ্য হয়ে তুষ্টি আপুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললাম,

” আপু প্লিজ এখন তো অন্তত ফোনটা রাখো।ফোনটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।বাসায় গিয়ে তো চালাতে পারবে।”

আমার কথায় কাজ হলো।তুষ্টি আপু ফোন পাশে রেখে বলল,

” আশ্চর্য ভাইয়া কিছু অর্ডার দিচ্ছো না কেনো?এখানে বসে থাকার জন্য এসেছি নাকি?”

” ওহে জরিনার মা।এমনভাবে বলছিস যেন বসে থাকতে থাকতে তুই ক্লান্ত।এতক্ষণ তো ফোনের দুনিয়ায় ডুবে ছিলি।”

“উফ্ ভাইয়া! অলওয়েজ তুমি আমাকে জরিনার মা ফরিদার মা বলে ডাকো।আজকে নতুন ফোন এনেছো বলে কিছু বললাম না।নাহলে দেখতে।”

দুই ভাইবোনের ঝগড়া আবার শুরু হয়ে গেছে।হে আল্লাহ!লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লাম আমি।
তুষার ভাইয়া তা লক্ষ্য করে বললেন,

” তুই কি খাবি নীল?”

” আমি বার্গার।”

” তুই বার্গার মানে?কবে থেকে তুই বার্গার হলি?”

” আহ হা! বলতে চাইছি আমি বার্গার খাব।”

পাশ থেকে তুষ্টি আপু বলল,
” আমার জন্য লাচ্ছি। বেশিকিছু খাব না এখন।”

তুষার ভাইয়া অর্ডার দিয়ে দিলেন।ততক্ষণে তুষ্টি আপু আবার ফোন হাতে নিয়ে ফেলেছে।আর আমি অসহায়ের মত বসে থেকে আশেপাশের লোকজন দেখছি।
তুষার ভাইয়া নিচু গলায় বললেন,

” এদিক সেদিক কি দেখছিস?আমি তো এখানে।”

চোখ পাকিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।আমার চোখ রাঙানো উনি কিলার হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। আড়চোখে একবার আপুকে দেখে নিলাম।সে কারো সাথে মেসেজিংয়ে ব্যস্ত।

” আজিব তো! আমি কি আপনাকে দেখার জন্য বসে আছি নাকি?”

” বসে থাকতে কে বলেছে?দৌড়াদৌড়ি কর, লাফালাফি কর।তাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি শুধু।”

মুখ ঝামটা দিলাম আমি।উনার যতসব বোগাস কথাবার্তা।
খাবার আসতেই তুষ্টি আপু ঝটপট শেষ করে উঠে পড়লেন।আমি এখনো বার্গারে একটা বাইটও দেই নি।আপু ব্যাগে মোবাইল ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,

” আমি আসছি ভাইয়া।তোরা দেরি করিস না।”

আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আপু বের হয়ে গেলেন।অবাক হয়ে তুষার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপু আমাদের ফেলে চলে গেল কেনো?”

” কেনো গেল বুঝিস নি?তোকে আর আমাকে একা কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিল আর কি।”

” তারমানে আপু সবটা জানে?”

তুষার ভাইয়া আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিলেন।
” জানে।তুষ্টি জানে এবং মামী জানে।”

আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম।আমার অগোচরে তুষার ভাইয়া কোনো একটা তালগোল পাকিয়েছেন সেটা আমি সন্দেহ করেছিলাম।কিন্তু সন্দেহের ফলাফল এত বড় হবে তা তো ভাবিনি।

” আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন ভাইয়া?আপনি কেনো মা’কে বলতে গেলেন।আমি এখন মা’য়ের সামনে কিভাবে যাব?ও আল্লাহ! আমার কি হবে?আপনি আসলেই অনেক খারাপ ভাইয়া। ”

” আশ্চর্য তুই এমন করছিস কেনো?আগে পরে সবাই তো জানবে ব্যাপারটা।আর মামীকে আমি বলিনি।মামী নিজে থেকেই বুঝে গেছিল। আর এটাই তো স্বাভাবিক।দিনের পর দিন আমি যেভাবে তোকে নিয়ে পজিটিভ ছিলাম,যেভাবে তোর সব ব্যাপারে খবরদারী করেছি সেগুলো চোখে পড়ার মতই।মামী আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছে আমি কোনো দ্বিধা ছাড়া স্বীকার করে ফেলেছি।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই নীল।মামী মেনে নিয়েছে।কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো বাকিদের জানানো।তুই এগুলো নিয়ে কোনো টেনশন করিস না।সবটা আমি সামলে নিব।তুই শুধু হাসবি,গাইবি আর আমাকে অনেক বেশি বেশি ভালোবাসবি।সময় আসলে আমি নিজেই ওদের সব বলে দেব।”

তুষার ভাইয়ার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও মনের কোণায় একটা ভয় জমে আছে।সব ঠিকঠাক মতো হবে তো?

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৪

” সেদিন তোর অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেই বুঝে গেছিলাম যে তুই ডায়রী পড়ে ফেলেছিস।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।একটু না।অনেক বেশি। উনার কোনো কথায় বা ব্যবহারে তো ক্ষণিকের জন্যও বুঝতে পারিনি সেটা।আমি কি এত বড়ই গাধী মানব?

” আমি জানি এই মুহূর্তে তোর মনে অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে।সমস্যা নেই।আমি ধীরে ধীরে সব ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। ”

” বলুন!আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না।”

তুষার ভাইয়া মৃদু হেসে কফির কাপে চুমুক দিলেন।কপালে উড়ে আসা চুলগুলোর উপর হাত চালিয়ে বলতে লাগলেন,

” যখনই বুঝতে পেরেছি তুই ডায়রী খুলেছিস তখনি আমি সাবধান হয়ে গেছি।আমি সেটা বুঝতে দেই নি তোকে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার নীল কি কি করতে পারে।মনে মনে চেয়েছিলাম তুই তোর সবটুকু দিয়ে আমার প্রেমে পড়।এতই বেশি প্রেম জাগোক তোর মনে যে প্রতি মুহূর্তে আমার কথা ভেবে তুই উতলা হয়ে থাকিস।তোর ধ্যানে জ্ঞানে শুধু আমিই থাকতে চেয়েছি।তাই ভাবলাম তোকে কিছুটা ইগনোর করি।যাতে মিস করার ব্যাপারটা ভালোভাবে তুই অনুভব করতে পারিস। এজন্যই সেদিন তোর সাথে দেখা না করে চলে গেছিলাম।আমি চেয়েছি আমার প্রতি তোর ভালোবাসা তীব্র হোক।”

উনার কথা শুনে মুখ গোমড়া হয়ে গেল আমার।উনি ইচ্ছে করে তাহলে এমনটা করেছে।আর এদিকে আমার যে করুণ অবস্থা হয়েছিল তা তো আর জানেন না।

” বাহ্! ভালোই তো।আমাকে কষ্টে রেখে আপনি আনন্দেই ছিলেন।”

” কে বলেছে আনন্দে ছিলাম?আমি সারাক্ষণ ফুরফুরা মেজাজে থাকি বলে ভাবিস যে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই তাই তো?তোর এই কয়েকদিনেই এমন অবস্থা আর আমি যে তিনটে বছর কাটিয়েছি। সবসময় অপেক্ষা করে থাকতাম কবে তোর মুখ থেকে ‘ভালবাসি’ শব্দটা শুনব।মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে হত তোর এই স্নিগ্ধ চেহারা একটু ছুঁয়ে দেখি,তোর চুলের শ্যাম্পুর গন্ধের মাদকতায় ডুবে যাই,তোর হাত ধরে নির্জন রাস্তায় হেঁটে বেড়াই।কিন্তু কিছুই করা হত না।মনের বাসনা গুলোকে চাপা দিয়ে রাখতাম।অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটল নীল!”

আমি মুগ্ধ হয়ে তুষার ভাইয়ার কথা শুনছিলাম।উনি থেমে যেতেই চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ফেললাম।
তুষার ভাইয়া উনার হাতের ভাঁজে আমার হাত আবদ্ধ করে বললেন,

” তোকে সারাজীবন আমার পাশে চাই।এই হাত জোড়া যেন কখনো আলাদা না হয় নীল!”

” হবে না।!”

তুষার ভাইয়া তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

.

বাসার মেইনডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।রেস্টুরেন্ট থেকে চলে এসেছি অনেকক্ষণ আগেই।তুষার ভাইয়া আমাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে পাঁচ তলায় উঠে গেছেন।
তখন থেকে আমি এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।
কিভাবে যাব মা’য়ের সামনে!মা তো সব জানে।এতদিন তুষার ভাইয়ার কথা ভেবে যে উদ্ভট কাজগুলো করে বেড়িয়েছি তার কারণও নিশ্চয়ই মা জানত।
কি লজ্জা! কি লজ্জা!

হঠাৎ করেই দরজা খুলে গেল।মা বেরিয়ে আসলেন।আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
মা অবাক হয়ে বলল,

” কিরে এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস যে?কলিংবেল না চাপলে আমি বুঝব কি করে।দিন দিন এই মেয়ে বড় না হয়ে ছোট হচ্ছে কে জানে। আবারো দাঁড়িয়ে আছে!যা ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হ।আমি তোর ফুপির বাসায় যাচ্ছি।”

ঝটপট চলে এলাম রুমে।নিজের মা’য়ের সামনেও এখন অস্বস্তি বোধ হয়।এর চেয়ে কষ্ট আর আছে?

_______________________

ঘড়িতে সকাল দশটা।
আজ শুক্রবার হওয়ায় ব্রেকফাস্ট করার সময় বাবার সাথে ইচ্ছেমত আড্ডা দিয়ে এখন ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইল স্ক্রল করছি।আমার নিজের ব্যক্তিগত একটা মোবাইল আছে এটা ভাবলেই কেমন বড় বড় ফিলিংস আসে।এখন তাহলে আমি আর ছোট নেই।
আজ ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি।ধীরে ধীরে হোয়্যাটসঅ্যাপ,ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট সবই খুলব।আমি হলাম মর্ডাণ যুগের মেয়ে।সবকিছুর সাথেই সম্পর্ক রাখতে হবে।আপাতত মনের সুখে ফেসবুক চালানো যাক।

আমার মনের সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।কেউ একজন ডোরবেল দিচ্ছে। মেজাজ খারাপ হওয়ার মত অবস্থা। একটু আরাম করে বসলাম সোফায় আর এখনই কারো আসার সময় হলো?
মনে মনে চাইছি মা এসে দরজাটা খুলুক।উৎসুক চোখে ভেতরের রুমের দিকে তাকিয়ে আছি।নাহ্ মা বের হচ্ছে না।তাই হালকা চিল্লিয়ে বললাম,

” কে যেন এসেছে মা।একটু দরজাটা খুলো না!”

রান্নাঘর থেকে মা’য়ের ঝাঁজালো গলার উত্তর আসলো,

” কেনো রে?তুই তো ড্রয়িংরুমেই বসে আছিস।উঠে গিয়ে খুলতে পারছিস না?অলস মেয়ে কোথাকার।দেখ গিয়ে তোর থেকে বয়সে ছোট তিন্নি মেয়েটা তাঁর মা’য়ের সাথে কত কাজ করে।ওর মা’য়ের কিছুই করা লাগে না।রান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা সব নিজের হাতে করে।আর তুই?সারাদিন এ রুম থেকে সে রুম হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়াস।কাজের কথা বললেই মুখ অন্ধকার করে ফেলিস।আর এখন তো মোবাইল হাতে পেয়েছিস।তোকে আর পায় কে।”

মা’য়ের বকুনি শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল।একি কান্ড!সামান্য দরজা খোলা নিয়ে এত বড় বক্তৃতা দেবে এটা জানলে ভুলেও বলতাম না।জীবনটাই বেদনার।

তৃতীয়বারের মত কলিংবেল বাজতে তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম।দরজা খুলে সামনের মানুষ গুলোকে হতভম্ব আমি।
দরজার সামনে একজন নয়।চার চারটে মানুষ দাঁড়ানো।আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ফুপি।উনার পেছনে ষাটোর্ধ্ব একজন লোক যাকে আমি আগে একবার দেখেছি।লোকটার পাশে মাঝবয়েসী এক মহিলা।সবার পেছনের মানুষটাকে দেখে চূড়ান্ত পর্যায়ের হতভম্ব আমি।ইয়াসির ভাইয়া!

ফুপি বলল,

” নীলাশা তোর মা বাসায় আছে তো?”

আমি নিচু গলায় জবাব দিলাম,

” জ্বি ফুপি।”

ফুপি এবার তাঁর দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকল।আমি শুধু দেখেই যাচ্ছি। ইয়াসির ভাইয়া উনার বাবা মা’কে নিয়ে কেনো আসলো?
ইয়াসির ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তে উনি আমার দিকে হাসি ছুড়লেন।আমিও বোকার মত একটু হাসলাম।
বহু মাস পর উনাকে দেখলাম।গায়ে ফিটফাট পোশাক।আগের থেকে বেশ সুন্দর হয়েছেন।গাল মুখ পুরো হয়েছে।স্টাইল করে চুল দাড়ি কাটা।গায়ের রঙ টাও বোধ হয় উজ্জ্বল হয়েছে।

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি এসব হচ্ছে টা কি?

ফুপি উনাদের উদ্দেশ্য হাসিমুখ করে বলল,

” আপনারা বসুন এখানে।আমি আসছি।”

ফুপি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ভেতরের রুমে নিয়ে যেতে লাগল।কপট ধমকের সুরে বলল,

” এসব কি শার্ট প্লালাজ্জো পড়ে ঘুরে বেড়াস হুম?যেকোনো সময় যে কেউ চলে আসতে পারে তাই না?”

ফুপির কথায় মাথা দুলালাম।যদিও কথাটা আমার পছন্দ হয় নি।আমি যেটা পড়ে কম্ফোর্ট পাই সেটাই তো পড়ব তাই না!আর আমি যেসব পোশাক পড়ি সেগুলো যথেষ্ট শালীনতার ভেতরেই থাকে।কিন্তু এখন এসব নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার সময় নয়।ওই লোকগুলো আমার বাসায় হাজির হয়েছে কেনো সেটাই জানতে হবে।
ফুপিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি রান্নাঘরে মা’য়ের কাছে চলে গেলেন।ভালোই ঝামেলায় পড়লাম দেখি।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবনা চিন্তা করার পর রান্নাঘরে উঁকি দিলাম।আমাকে দেখে ফুপি স্নেহমাখা কন্ঠে বলল,

” তুই এই শার্ট পাল্টে সুন্দর দেখে একটা জামা পড়তো মা।ওই যে তোর একটা বেগুনি কালারের জামা আছে না?সেটা পড়।দারুণ মানায় তোকে ওই জামাটায়।”

ফুপির কথা শুনে আরেক দফায় হতভম্ব হলাম।গতকাল ছিল আমার অবাক হওয়ার দিন।আর আজ হতভম্ব হওয়ার দিন।বিনা কারণে জামা পাল্টাতে যাব কেনো।

” আমরা কোথাও যাব নাকি ফুপি?ঘুরতে যাব?নাকি কোথাও বেড়াতে যাব?”

” তুই আগে জামা চেঞ্জ করে আয় তারপর বলছি।”

মুখ কালো হয়ে গেল আমার।প্রশ্ন করার সাথে সাথে উত্তর না পেলে আমার অস্থির লাগে।
রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা’য়ের কপালে চিন্তার রেখা। আসলে হচ্ছে টা কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

রুমে এসে দরজা লক করে বেডে শুয়ে পড়লাম।কোথায় ভাবলাম আজ সারাদিন পায়ের উপর পা তুলে শুধু আয়েশ করব।সেটা মনে হয় আর সম্ভব না।প্রচন্ড অলসতা লাগছে।উঠে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করার মুড নেই এক ফোঁটাও।চুলোয় যাক সব।আমি শুয়েই থাকব।

মোবাইলে টুং করে শব্দ হতেই চোখ খুললাম।লক খুলে দেখি তুষার ভাইয়ার মেসেজ।খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।ফুপি আসার মিনিট খানেক আগেই তো উনাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম।এরমধ্যে একসেপ্ট করে ফেলেছে আবার মেসেজও করেছে।বাহ্!
কিন্তু মেসেজ দেখে আমার খুশি ভাবটা নিমিষেই চলে গেল।উনি লিখেছেন,

” কিরে এফবি আইডিও খুলে ফেলেছিস দেখি।ঠিক আছে সমস্যা নেই। তবে প্রোফাইল পিকচার কভার পিকচারে আবার নিজের ঢং করে তোলা পিক দিবি না।মানে তোর কোনো ছবিই দিবি না।মনে থাকে যেন।”

এমন হুমকি দেওয়া মেসেজ দেখলে মন খারাপ হওয়ার কথা না?আজব লোক একটা।ভার্চুয়াল জগতে উনার সাথে এটাই প্রথম মেসেজ।সেটাও শুরু হলো হুমকি দিয়ে।ভালোই।
উনার মেসেজের উত্তরে কিছু খুঁজে না পেয়ে আমি ব্যাঙের মাথা ইমুজি দিয়ে দিলাম।🐸
উনি সাথে সাথেই সিন করেছেন।কি যেন টাইপ করছেন এটা বুঝা যাচ্ছে। বাহ! ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং তো!

” ব্যাঙ তোকে আমি ফ্রাই করে খাওয়াবো।আহাম্মক কোথাকার।”

এবার বেশ হাসি পেল আমার।তাই লিখলাম,

” আহাম্মক হই আর যা-ই হই আপনারই তো!”

মেসেজের পাশেই কিসিং ইমুজি দিয়ে দিলাম।😘

কিছুক্ষণ চুপচাপ। উনি সিন করেছেন কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছেন না।প্রায় এক মিনিট পর লিখলেন,

” তোর এমন মেসেজ দেখলে আমি কাজে মন দিতে পারব না।এক্ষুনি মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে যা।আজ বাসায় আসি।তারপর দেখবি কিস তোকে গুলে খাওয়াব।”

কিটকিটিয়ে হেসে উঠলাম আমি।উনাকে বিরক্ত করার একটা ভালো মাধ্যম পাওয়া গেল।যখনই ইচ্ছে হবে কাজে লাগাব।
হঠাৎই দরজায় ঠকঠক শব্দে আমার হুঁশ আসলো।হায় হায়!নিশ্চয়ই ফুপি এসেছে।যদি দেখে আমি এখনো শুয়ে আছি তাহলে ভাববে আমি খুব ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে।
তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে তৈরি হতে লাগলাম।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৫

ঝটপট ড্রেস চেঞ্জ করে দরজা খুলে দিলাম।ফুপি হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়লেন।
আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বললেন,

” শুধু জামা পড়লে হবে?চুলগুলো তো এলেমেলো হয়ে আছে।চিরুনি কই।দে আমায় আমিই আঁচড়ে দেই।”

ফুপির চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।এবার আমার বেশ সন্দেহ হলো।তাই দেরি না করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,

” প্লিজ ফুপি আমাকে বলবে যে কেনো তুমি আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করতে চাইছো?”

ফুপি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে চিরুনি খুঁজতে ব্যস্ত।মাথা তুলে বললেন,

” উনারা তোকে দেখতে এসেছে।”

বাজ পরল আমার মাথায়।সেই বাজের আঘাতে আমি পুরো জখম হয়ে গেলাম।এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
ফুপি কি বলছে এসব?উনারা কি তাহলে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে আমায়?আর ইয়াসির ভাইয়া কিভাবে….

আমার মাথায় গন্ডগোল লেগে গেছে। ইয়াসির ভাইয়াকে কোনো একসময় ভালো লাগত আমার।জাস্ট ভালো লাগা ছিল।এমন অনেককেই তো ভালো লাগত।কিন্তু যখন আমার জীবনে তুষার ভাইয়ার ভালোবাসার আগমন ঘটে তখন তো এসব আমি ভুলে গেছি।আমার মনেই ছিল না ইয়াসির নামে কেউ আছে কিনা।আজ উনাকে দেখে মনে পড়ল একসময় উনি ক্রাশ ছিলেন।

মনের দুঃখ চেপে রাখতে না পেরে কাঁদকাঁদ হয়ে বললাম,

” তুমি পাগল হলে ফুপি?”

ফুপি ভ্রু কুঁচকে বলল,

” কি বললি?”

চেহারা আগের চেয়েও করুণ করে ফুপির দিকে তাকালাম।কিন্তু আমি তো চোখে অন্ধকার দেখছি।সবকিছু কত ভালোভাবে চলছিল। গতকাল রাতেই তো তুষার ভাইয়ার কথা চিন্তা করতে করতে মনে হাজারো সুখের পাখনা মেলে ঘুমাতে গেছিলাম।আর সকাল হতে না হতেই আমার দুর্ভাগ্যের দিন চলে আসলো।আমি কেনো একটু শান্তিতে থাকতে পারি না!

ফুপিকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলাম।

” ফুপি আমার এখনো বিয়ের সময় হয় নি ফুপি।তুমি কেনো উনাদের এখানে আনলে?”

” বোকা মেয়ে দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?ইয়াসিরকে তো চিনিস!আমাদের পাশের বিল্ডিংয়েই বাসা।মাসকয়েক হলো বিদেশ থেকে পড়া শেষ করে দেশে ফিরল।ভালো চাকরিও পেয়ে গেছে।ছেলেটা দেখতে শুনতেও তো ভালোই।আসলে ওর মা’য়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক আমার।সে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল তোর কথা।আমি বলেছি মেয়ে ছোট এখনো।তো আজ সকালে হুট করেই বাসায় এসে হাজির।তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে এলাম।তুই এত টেনশন করিস না তো!বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না।শুধু দেখে চলে যাবে।”

ফুপি চলে গেলেন রুম থেকে।মুখে একরকম কথা বললেও ফুপির মনে অন্যকিছু চলছে বুঝতে পারছি।উনি হয়তোবা এই ব্যাপারটাতে নিমরাজি আছেন।একটু আগে ইয়াসির ভাইয়াকে নিয়ে যে গুনগাণ গাইলেন সেখান থেকে সব পরিষ্কার বুঝা যায়।
রাগে দুঃখে আমার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।

তখনই মাকে রুমে ঢুকতে দেখে মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো।দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলাম মাকে।

” ফুপি এসব কি বলছে মা?উনারা নাকি আমায় দেখতে এসেছে?আমার কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।তুমি ফুপিকে মানা করে উনাদের চলে যেতে বলো।”

” এভাবে কাউকে চলে যেতে বললে কেমন দেখায়? তোর ফুপি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়।এখন উনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে উনি কষ্ট পাবেন মনে।আর তুই এত চিন্তা করছিস কেনো।মুখচোখের কি হাল বানিয়েছিস।আমি আছি তো।তোকে যা করতে বলা হচ্ছে তুই তা-ই কর।”

মা’য়ের কথা শুনে মাথায় রাগ উঠে গেল।মাকে ছেড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।আমার অবস্থাটা কি মা বুঝতে পারছে না?আমাকে ফেলে সে পড়ে আছে ফুপিকে নিয়ে।
টলমলে চোখে বললাম,

” তুমিও তাহলে ফুপিকে সাপোর্ট করছো!তুমিও চাও যে উনারা আমাকে দেখু্ক।তুমিও চাও যে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে বিয়ে হোক আমার তাই তো?”

” নীলাশা তুই মাথা গরম করছিস বেশি।বিয়ে করতে কে বলেছে তোকে?”

আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলে বসলাম,

” আমি তুষার ভাইয়াকে ভালোবাসি মা।একটু নয়।অনেকখানিই ভালোবাসি।বিয়ে করলে একমাত্র উনাকেই করব।হাজারটা ইয়াসির ভাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি শুধু তুষার ভাইয়াকেই খুঁজব।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলাম আমি।মা’য়ের চেহারার রিয়্যাকশন দেখার জন্যও মাথা তুলছি না।জানি না হঠাৎ কি হলো আমার।মনে এত সাহস কিভাবে এসে গেল যে কথাগুলো আমি বলতে পেরেছি।এখন যা হয় হোক।সত্যি কথাটা বলতে পেরে শান্তি লাগছে মনে।

মা এগিয়ে এসে আমার পাশে বসল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,

” বেশ তো!আমরা তো তোকে জোর করব না কখনো।অন্তত বিয়ের ব্যাপারে।আর ভালোবাসিস এই কথাটা এমন মুখ অন্ধকার করে বলতে হয়? ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবি হাস্যোজ্জ্বল মুখে। অপর পাশের মানুষ টাকে কতটা ভালোবাসিস সেটা যেন তোর চোখমুখ ছাপিয়ে ফুটে উঠে।চোখের দিকে তাকালেই যেন সেই মানুষটার প্রতি অগাধ ভালোবাসার পরিমাণ স্পষ্টবুঝা যায়।তা না করে এমন শক্ত হয়ে বলছিস। আমার তো মনে হলো তুই আমাকে হুমকি দিলি! শুধু শুধু কি আর তোকে বোকা বলি?পায়ে ই যা লম্বা হয়েছিস। জ্ঞান বুদ্ধিতে এখনো ছোট।”

মা’য়ের কথা অবাক হয়ে শুনছি আমি।আজ মাকে বড্ড অচেনা লাগছে।আমার মা এত সুন্দর কথা বলতে পারে সেটা জানতাম না।
মা পুনরায় বলল,

” আমার প্রতি বিশ্বাস আছে তো?”

” আছে মা।”

” তাহলে চল।তোর ফুপির সাথে কোনোরকম রাগারাগি করিস না।হাসিমুখে কথা বলবি।উনাদের সাথেও সৌজন্য ব্যবহার করবি।”

” কিন্তু মা তুমি কি করতে চাইছো আমি সেটা বুঝতে পারছি না।প্লিজ খুলে বলো।ওই ইয়াসির ছোকরা টার সামনে সঙ সেজে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।”

” সঙ সেজে কেনো যাবি।খুব সিম্পল ভাবেই যাবি।”

” উফ মা তুমি আমার সাথে মজা করছো?”

কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আমরা থেমে গেলাম।নাস্তার প্লেট হাতে ফুপি এসেছে।মুহুর্তেই আমার মলিন মুখটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,

” নিজের ছেলের হবু বউকে অন্যকারো সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।বেঁচে থাকতে যে আরো কত কি দেখতে হবে!”

মা আমাকে আড়ালে হাতে চিমটি কাটল থেমে যাওয়ার জন্য। ফুপি বলল,

” তোমরা এখনো বসে আছো?আয় নীলাশা।এই নাস্তার প্লেটটা হাতে নে। উনারা অপেক্ষা করছেন।কিন্তু তুই এমন পাগলের মত বসে আছিস কেনো।উড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নে।”

অনিচ্ছা সত্ত্বে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলাম।এমন অসহ্যকর ঘটনা বোধ হয় আমার জীবনে আর কখনো আসেনি।
.

ফুপি আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। সেখানে বাবাকে দেখতে পেলাম ইয়াসির ভাইয়ার বাবা মা’য়ের সাথে কথা বলছে।বাবা আমাকে তাঁর পাশেই বসিয়ে দিলেন।আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি।প্রচন্ড অস্বস্তিতে উড়না বারবার হাতে চেপে ধরছি।
ইয়াসির ভইয়ার মা জিজ্ঞেস করল,

” এবার কোন ক্লাসে পড়ছো মা?”

বিরক্ততে আমার সর্বমুখ ছেয়ে গেল।এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে এসেছে।তাহলে নতুন করে আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?

মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,

” এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি এবার।”

” খুব ভালো।এবার তো তাহলে ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার পালা।”

মনে মনে মুখ ভেংচিয়ে বললাম,
” না না এবার আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পালা।যতসব আজগুবি প্রশ্ন। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয় এটা তো সবাই জানে।সাধারণ এই কথাটা এমন সিরিয়াস মুড নিয়ে বলছে যা দেখে রীতিমতো গা জ্বলছে আমার।এখন নিশ্চয়ই বলবে ভার্সিটি উঠে যাবে তারমানে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।সেই কথা চিন্তা করেই আজ আমরা হাজির হয়েছি আমাদের খোকাকে নিয়ে।তুমি চোখ বন্ধ করে আমাদের এই প্রতিষ্ঠিত খোকাকে বিয়ে করে ফেল।”

নিজের মনের কথা শুনে দম ফাটানো হাসি আসছে।কি অদ্ভুত আমি! একটু আগেই টেনশনে আমার মর্মর অবস্থা ছিল আর এখন তাঁদের প্রশ্ন শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে।

আরো কিছুক্ষণ ছেলেমানুষী প্রশ্ন উত্তর অদলবদলের পর ইয়াসির ছোকরার বাবা বলে উঠল,

” তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে নাকি ইয়াসির।কথা বলো নীলাশার সাথে।”

আমি এবার চোখের কোনা দিয়ে ছোকরার দিকে তাকালাম।উনার মুখে লাজুক হাসি।এমন ভাব যেন উনার সাথে আমার বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেছে।যে ছেলেটা একসময় আমার ক্রাশ ছিল আজ সেই ছেলেটাকে দেখতে কেমন জড়ভরতের মত লাগছে।হাহাহা।

হঠাৎ করে মেইনডোর প্রচন্ড শব্দে খুলে গেল।দরজার পাশে সু কেবিনেটের উপর রাখা ফুলদানিটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল বোধ হয় ভুমিকম্প চলে এসেছে।আমি সহ ড্রয়িংরুমে উপস্থিত বাকিরাও ভয় পেয়ে গেছে।
তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন দরজা ধরে।উনার চেহারায় লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।উনি শান্ত দৃষ্টিতে একবার ড্রয়িংরুমের সকলের উপর চোখ বুলিয়ে শেষে আমার উপর থামলেন।আমি কাঁচুমাচু চেহারা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ফেললাম।তুষার ভাইয়া হঠাৎ করে এখানে হাজির হলো কি জন্য। দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন।
আচ্ছা উনি কি কোনোভাবে খবর পেয়েছেন যে ইয়াসির ভাইয়ারা দেখতে এসেছে আমায়?তারমানে মা উনাকে সব জানিয়েছেন। এজন্যই বারবার বলছিল চিন্তা না করতে।ওয়াও! মা’য়ের মাথায় কি বুদ্ধি! যাক এখন আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না।আমার হিরো এসে গেছে।সে সবটা সামলে নেবে।
সকলের অলক্ষ্যে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা আমার দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুড়ে দিল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here