কে তুমি মনোহরিণী?,পার্ট-০১
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
পুরো ফ্ল্যাটের ওয়ালপেইন্টিং এর কাজ শেষ হওয়ার পরে মুখের মাস্ক খুলে সোফায় বসলো অমিত। গোসল করতে হবে ভালো করে। গায়ে থেকে রঙের গন্ধ বের হচ্ছে। অমিতের এসব গন্ধে মাথা ধরে যায়। মাথা ঘুরিয়ে বমি আসে। সব কাজই মোটামুটি শেষ। শুধু স্টোর রুমের দিকটা একটু পরিষ্কার করতে হবে। এতো জঞ্জাল জমে আছে জায়গাটায়। আগের মালিক বোধ হয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় কোনো মনোযোগই দেয়নি। এখন তার ফল অমিতকেই ভোগ করতে হবে। কী আর করা! সাভারে থাকাকালীন অমিতের এমন কোনো সমস্যাই হয়নি৷ সুন্দর গোছানো টিপটপ একটা বাসা ছিলো। যদিও সেটা ভাড়া বাসা। বাড়িওয়ালা আঙ্কেলও তাকে খুব পছন্দ করতো। তেরো ঘন্টা থানায় অপরাধীদের লক আপে ঢুকানোর কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে বাসায় এসে খেয়েই লম্বা ঘুম। দুই বছর যাবত পুলিশের কাজ করছে সে। ভালো একটা পোস্টে আছে। সিরাজগঞ্জে মা বাবা থাকেন৷ অমিত অনেক বার বলেছে, তাদের ঢাকায় চলে আসতে। কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে তারা কিছুতেই আসতে চাননা। এক কথা এখন বলতে বলতে ক্লান্ত অমিত। ঢাকায় এসে প্রথমে নিজের কাকার বাসায় উঠেছিলো। সব খানেই মানুষ নিজের স্বার্থ আগে দেখে। অমিতও বিনামূল্যে কিছু পায়নি। কাকার মেয়ে দিপালীকে পড়িয়ে কাকা কাকী ঠিকই টাকা উসুল করে নিয়েছিলো। চাকরি পাবার পর থেকে আর সেখানে যায়নি কখনো। তবে, আজও দিপালী ফোন দিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে বসে তাকে দেখার জন্য। অমিত সবটাই জানে, বুঝে। কিন্তু প্রতিত্তোরে হা বা না কিছুই বলেনা। সেসব পুরনো কথা৷ ধানমন্ডির এই চার কামরার আভিজাত্যপূর্ণ ফ্ল্যাটটা অমিত তার নিজের টাকায় কিনেছে। আগে এই ফ্ল্যাটের মালিক ছিলেন একজন বিধবা মহিলা। একা একা থাকতে পারছিলেন না বলে সুদূর আমেরিকায় পাড়ি জমালেন। তার সহোদর ভাই এতদিন এটি দেখাশোনা করলে সেও এখন অসুস্থ অবস্থায় আছেন৷ বড় বোনের আদেশ মতো এখন ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেয়াই বেশি উত্তম মনে হচ্ছিল। যদিও এটি অমিতের কেনা প্রথম কোনো প্রপার্টি। কিন্তু, সে অনেকটাই আশ্চর্য এটির সস্তা মূল্যে। সাধারণত, এতো বিশাল জায়গার ফ্ল্যাটের মূল্য অনেক বেশি হওয়ার কথা৷ অমিত তারপর ভাবলো, পুলিশ হওয়ার পর সে হয়তো একটু বেশীই সন্দেহবাতিক হয়ে উঠেছে। সন্দেহ মনে পুষে রেখেই ফ্ল্যাটটা কিনলো অমিত৷ এছাড়া আর উপায় কী! তার পোস্টিং এই এরিয়াতেই হলো হঠাৎ করে। সাভার থেকে রোজ এতদূর আসা অনেকটাই অসম্ভব। এক মাস যাবত ভোর পাঁচটায় উঠে চার পাঁচ ঘন্টা জ্যামে আঁটকা পড়ে তবেই থানায় পৌঁছাতে পারে সে। এরকম হয়রানির শিকার হয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে অমিত। সকালে ঠিক মতো খাওয়া হয়না। রাতে ফিরতে দেরি হয়। অনিয়মে জর্জরিত হয়ে চোখের নিচে কালির স্তূপ জমেছে ইতোমধ্যে। মা কয়েকবার তাকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করেছেন। সুন্দরী কম বয়সী পাত্রীদের ছবিও দেখিয়েছেন। মায়ের মতে, এখন যেহেতু সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজে ভালো একটা বেতন আয় করছে তবে এখন বিয়ে করলে সমস্যা কী! কথা খুব একটা ভুল বলেননি তিনি। কিন্তু, অমিত নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিতে চায়। ঘরের জিনিসপত্র সাজিয়ে তারপর সংসার নিয়ে ভাবতে চায়। শান্তশিষ্ট অন্তর্মুখী চরিত্রের মানুষ সে। কখনো কেউ বলতে পারেনি,অমিতের কোনো বাজে স্বভাব আছে। স্কুল কলেজ এমনকি ভার্সিটি পর্যায়েও মাথা নিচু করে আসা যাওয়া করাই রুটিন ছিলো।
সাতাশ বছর বয়সে এসে শরীরে মনে মস্তিষ্কে অনেক পরিবর্তনই এসেছে। শুধু বাজে স্বভাব গুলো বাসা বাঁধতে পারেনি। অত্যন্ত সুদর্শন না হলেও সুন্দর চরিত্রের একজন আদর্শবান মানুষ অমিত।
সব কাজ শেষ করে ক্লান্ত দেহে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলো সে। তারপর হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে বারান্দায় এসে বেতের সোফায় বসলো। আউটসাইডার ভিউটা এখানে থেকে খুব চমৎকার লাগে। রাতে নিশ্চয়ই আরো সুন্দর লাগবে। এখন থেকে বারান্দায় বসে ছুটির দিন গুলো বেশ ভালো ভাবে কাটাতে পারবে আশা করা যায়। অমিত চোখে চশমা পড়ে নেয়। মাঝে মাঝে মাইগ্রেনের ব্যাথা উপশমের জন্য চশমা পড়ে নেয়। ব্যস্ত নগরী নিজের মতো করেই এগিয়ে চলছে। দশ তলার ফ্ল্যাট হওয়ায় ঠান্ডা বাতাস ফুরফুরে করে দেয়। অমিত পরিবেশটা উপভোগ করতে করতে এতোই মগ্ন ছিলো, যে পাশে কারো উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। কফি শেষ হওয়ায় টেবিলে রাখতে গিয়ে সে খেয়াল করে পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাটে হাঁটু পর্যন্ত লাল ফ্রক করা ষোলো কিংবা সতেরো বছর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত আশ্চর্য হলো অমিত। তার নিজের থেকে কিছু বলার প্রয়োজনই হলো না৷ মেয়েটা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি আমাকে ইগনোর করলে কেনো?’
অমিত অপ্রতিভ হয়ে গেলো। প্রথমে মেয়েটার ছোটো পোশাকে বিব্রতবোধ করলেও এখন কথায় আরো বেশি বেকুব হয়ে গেল। এ বয়সী মেয়েরা আবেগি হয় সে জানে। তাই বলে কী, অপরিচিত মানুষের সাথেও! অমিত আমতা আমতা করে বলল,
‘তুমি কী আমাকে কথাটা বললে?’
‘বাহ! এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে! আমাকে কী পাগল মনে হয় যে আমি হাওয়ার সাথে কথা বলবো! ‘
স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে অস্বস্তি আরো বাড়লো অমিতের। সে অবাক চোখে চেয়ে দেখলো, শ্যামলা চেহারার মায়াবী পুতুলের মতো একটা চেহারা। হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক হলেও কেনো জানি খারাপ লাগছেনা। হালকা পাতলা গড়নের হওয়ায় ভালোই দেখাচ্ছে। মাথায় দুই পাশে দুটো উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। পুরো পুতুলের মতো। যদি গায়ের রং ফর্সা হতো তবে একে সবাই বিদেশি ভাবতে বাধ্য হতো। মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে আবারও বলল,
‘এই ছেলে! তুমি বারবার কোথায় হারিয়ে যাও! ‘
অমিত ভ্রু কুচকে বলল,
‘তুমি জানো আমি তোমার কত বড় হবো! আমাকে এই ছেলে বলে ডাকছো যে! ‘
‘ওমা! তুমি কী রাগ করলে? আমি তো তোমার নাম জানিনা। প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু তুমি আমার দিকে তাকালেই তো না। আচ্ছা বাদ দাও, আমি প্রতিমা। তুমি?’
বলেই মেয়েটা হ্যান্ডশ্যাকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। অপ্রতিভ অমিত সাতাশ বছরের জীবনে প্রথম বার নিজ থেকে কোনো মেয়ের হাত স্পর্শ করলো। অজান্তেই বুকের ঢিপঢিপ স্পন্দন তিনগুণে বেড়ে গেলো। পাক্কা দেড় মিনিট মোহগ্রস্ত অমিত হাতটি ধরেই রাখলো। প্রতিমার খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ার আওয়াজে কেঁপে উঠলো অমিত। মাথা চুলকে সেও হেঁসে বলল,
‘সরি, আমি সিনিয়র ইন্সপেক্টর অমিত জুবায়ের। ‘
চলবে-