#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,পর্ব-০৮,০৯
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#অষ্টম_পর্ব
১৩.
রাশেদ ফুরফুরে মনে ঘরে ডুকলো। এতো সুন্দর সকাল তার জীবনে বিয়ের পর আসে নি। আজকের সকালটা এতো সুন্দর কেন? সারারাত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পর চারপাশ আরো সতেজ হয়ে গেছে। ঝকমক করছে বারান্দার গাছের পাতাগুলো। গাছের টবে শুধু পাতাবাহার গাছ লাগানো। এগুলো সব রাশেদ এনে দিয়েছে চন্দ্রাকে। চন্দ্রা খুবই যত্ন করে তাদের। রাশেদকে বারান্দায় দেখে চন্দ্রা চা নিয়ে এলো।
আলতো স্বরে বললো, আপনার চা।
রাশেদ হাসিমুখে চা নিলো। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে। আজ চন্দ্রা চা দিয়ে চলে যায়নি ওর পাশে দাঁড়িয়ে গাছের পাতায় হাত বোলাচ্ছে। হাতের নড়াচড়ায় সোনার চুরিগুলো টুংটাং করে ধ্বনি তুলছে। হালকা গোলাপি রংয়ের শাড়ি তার কোমড়ে গোঁজা। চমৎকার লাগছে চন্দ্রাকে। রাশেদের কেন জানি মনে হচ্ছে আজ থেকে সব পাল্টে যাবে। সম্পূর্ণভাবে ওর জীবন পাল্টে যাবে। এমন মনে হবার কারনটা খুব তুচ্ছ। কারনটা হচ্ছে বিয়ের পর প্রথম চন্দ্রা রাশেদের সাথে এতোটা কথা বলেছে। হয়তো কালকে না বলে যাওয়ার অপরাধবোধ থেকে। তারপরও বলেছে তো। রাশেদ এতোটুকুতেই খুশি। সে চায়ের কাপ চন্দ্রার হাতে দিয়ে গোসলে গেল।
এতো সকাল নয়টা নাগাদ হাসিমুখে টুকু এসে উপস্থিত। এসেই রাশেদ আর চন্দ্রার পা ধরে কদমবুসি করলো। তখন রাশেদ আর চন্দ্রা খেতে বসবে। রাশেদ মনে মনে ঠিক করলো টুকুকে কিছু কঠিন কথা বলবে। তাকে বলবে সে মানা করার পরও চর্তুথবার পালানোর মানে কী? তবে তা অবশ্যই খাওয়ার পর। ছোট মানুষ এতেটা পথ এসেছে। ক্ষিধে পেয়েছে বোধহয়। রাশেদের মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে এতোটা মাথায় তোলা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকালে এতে মায়া লাগে। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা ভুল ঘরে তাকে দিয়েছেন। রাজপুত্রর মতো চেহারা। শহরের আবহাওয়া, খাওয়াদাওয়ায় তার চেহারা পাল্টে গেছে। গায়ের রং ফুটে উঠেছে। আগের চাপা পড়ে যাওয়া রং ফিরে এসেছে। চন্দ্রা যখন রান্না করে তখন টুকু তার ভাষ্যমতে তার আপার সাথে গফ করে। আর রান্নার জিনিস এগিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ছোট কাপড় নিয়ে ঘরের ফার্নিচার মুছে। ঘর ঝাড়ু দিতেও দেখা যায়। ঘর খুব আগ্রহ নিয়ে মুছে মপ দিয়ে। সে নাকি এই কাজে খুবই আনন্দ পায়। তার সবই নিজের ইচ্ছায় করে। রাশেদ আপন মনে হাসলো। করে না করে না করেও অনেক কাজ করে সে। ছেলেটাকে খুবই স্নেহ করে চন্দ্রা। তবে আজকে সে ছাড় পাচ্ছে না। তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
খাওয়া শেষে রাশেদ টুকুকে গম্ভীর গলায় ডাকলো। টুকু কাঁচুমাচু মুখে সামনে দাঁড়ালো।
টুকু কোথায় ছিলি এতোদিন?
ভাইজান বাড়িত গেছলাম।
কেন?
ছোট ভইনরে লইয়া খুবই খারাপ খোয়াব দেকলাম।
শোন মিথ্যে বলে লাভ নেই। দেড়মাসের মধ্যে তুই চারবার একই কথা বলেছিস পালিয়ে ফিরে আসার পর। সত্যি করে বল।
সত্য কইতাছি ভাইজান।
না তুই সত্যই বলছিস না। কী সমস্যা তোর বল? এখানে ভালো না লাগলে বল আমি একেবারে বাড়ি পাঠিয়ে দিব। কেউ কিচ্ছু বলবে না। তোকে কী জোর করে পাঠিয়েছে তোর বাবা?
না ভাইজান। আমি নিজেই আসছি।
তাহলে? সত্যি কথা বল।
না বললে কী থাকতে দিবেন না এনে?
এসব কোন ধরনের কথা টুকু? তোকে নিয়ে সমস্যা হলে আগেই বলতাম। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে সমস্যা তোর।
আসলে ভাইজান?
কী আসলে?
আমি প্রতিবার পলানির লাইগা বাইর হই একদিন বাইরে থাইকা বাড়িতে যাই মনে করি সেইখানতে আবার পলামো কিন্তু তার আগেই আপার চেহারা মনে পইড়া খারাপ লাগা শুরু করে পরে চইলা আসি। মাফ কইরা দেন ভাইজান আর করুম না।
রাশেদ আর চন্দ্রা একে অপরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই ছোট্ট ছেলেটার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে চন্দ্রাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। অথচ আমরা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। ভাবতাম ছোট মানুষ ও হয়তো এমনই।
রাশেদ কিছু বলার আগে চন্দ্রা বললো, রাশেদ আর কিছু বলার দরকার নেই। ছোট মানুষ থাক। পরে দেখা যাবে এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে আপনার।
রাশেদ উঠে দাঁড়ালো তারপর টুকুর মাথয় হাত বুলিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষন পর চন্দ্রা ঘরে এলো।
রাশেদ বললো, চন্দ্রা রেডি হয়ে নাও একসাথে বের হবে৷ আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। নাম কী হাসপাতালের?
চন্দ্রার মুখে হাসপাতালের নাম শুনে রাশেদ আকাশ থেকে পড়লো। সে কাল রাশেদের হাসপাতালে ছিল। কিন্তু একবার তাকে চোখে পড়েনি রাশেদের।
রাশেদ চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কতক্ষণ থাকবে?
বলতে পারছি না। বেশি সময়ও লাগতে পারে আবার কম সময়ও।
আচ্ছা। তৈরি হয়ে নাও।
রাশেদ, চন্দ্রা তৈরি হয়ে হাসপাতালে চলে গেল। চন্দ্রা গেছে বারসাতের মা আমেনা বেগমের কাছে আর রাশেদ গেছে তার কেবিনে।
যাওয়ার আগে রাশেদ বললো, ভেবেছিলাম উনাকে দেখতে যাব। কিন্তু অলরেডি অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তুমি যাও আমি একটু পর আসছি আর কোন দরকার হলে কেবিনে চলে যেও আর কেবিনে না পেলে মনে করবে রাউন্ডে আছি তখন কল করে দিও।
আচ্ছা।
নম্বর আছে তোমার কাছে যে কল করবে।
চন্দ্রা জিবে কামড় দিল।
রাশেদ হেসে বললো, ব্যাপার না। কার্ডটা রাখো। এখানে নম্বর আছে।
চন্দ্রা হাত বাড়িয়ে নিল। রাশেদ সেখান থেকে চলে গেল। চন্দ্রা ভেতরে পা বাড়ালো। হাসপাতাল জায়গাটায় তার আসতেই ইচ্ছে হয় না। কেমন একটা অসুস্থ অসুস্থ গন্ধ নাকে লাগে। বমি চলে আসে। তারপর বারবার আসতে হয়। চন্দ্রা ভেতরে গিয়ে দেখলো কেবিনের বাইরে বারসাতের দুইজন ক্লোজ বন্ধু আরিফ আর সোহান। ওরাই উনাদের সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
চন্দ্রা ওদের দিকে এগিয়ে বললো, আন্টির অবস্থা কী আরিফ?
ভালো না।
কালকেও তো এমনই ছিল।
না আজ ভোররাত থেকে অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে।
সে কী? ডাক্তার দেখে যাননি?
ডাক্তার যা বলার বলে দিয়েছে চন্দ্রা। এখন সব আশা শেষ। ভেতরে গিয়ে দেখে আসো তুমি।
চন্দ্রা নিঃশব্দে ভেতরে গেল। হালকা নীল রংয়ের বিছানার চাদর তার উপর একজন মহিলা শুয়ে আছে। তার চোখ, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। তার মাথার বাম ও ডান পাশে তার স্বামী এবং মেয়ে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের জল শুকিয়ে গেছে হয়তো। শক্ত হয়ে বসে আছে তারা। একফোঁটা নড়ছে না।
বারসাতের মায়ের যে ক্যান্সার হয়েছে তা হচ্ছে একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল। যা খুব দ্রুত ছড়ায় বলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু উনারা বুঝতে পারেন নি। যখন বুঝতে পারলেন অনেকটা দেরি হয়ে গেল। কেমোথেরাপি দেওয়ার পরও সুস্থ না হওয়ায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উনার সাথে কোন ডোনারের এইচএলএ টাইপিং ১০০ ভাগ ম্যাচ হয়নি। সেজন্য এখন আর কিছুই করাই নেই।
চন্দ্রা নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এলো। বেশ কিছুক্ষণ পর রাশেদ এলো। চন্দ্রা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। রাশেদ পাশে এসে বসলো। কারো উপস্থিতিতে সে চোখ খুললো। পাশে রাশেদকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো করলো। তবে কতটুকু সফল হলো বুঝতে পারলো না। তারপর বললো,
আপনার কাজ শেষ?
না এখন একটু ফ্রি। ভেতরে গিয়েছিলে? কী অবস্থা উনার?
ভালো না।
আচ্ছা উনারা বোনম্যারো করছেন না কেন? উনার ভাই, বোন কেউ নেই?
আছে কিন্তু কারো সাথে এইচএলএ টাইপিং মিলে নি।
রাশেদের মন খুব খারাপ হলো। ডাক্তার হতে হলে সবার আগে আবেগ বির্সজন দিতে হয় যা এতো দিনেও রাশেদ আয়ত্তে আনতে পারে নি।
সে চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা আমাকে কী ভেতরে যেতে দিবে উনারা?
উনারা এখন এতোকিছু খেয়াল করেন না। আসুন আমার সাথে।
চন্দ্রা আর রাশেদ কেবিনে ঢুকলো। রাশেদ মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। নিস্তেজভাবে পড়ে আছে বিছানায়। কিছুক্ষনের মধ্যে উনার মধ্যে নড়াচড়া দেখা গেল। তিনি চোখ পিটপিট করে তাকালেন। প্রথমেই চোখ পড়লো উনার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাশেদের উপর।
তিনি বারসাতের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, দেখো বারসাতের বাবা, আমার ছেলে এসেছে।
তিনি চমকে পেছনে তাকালেন। দেখলেন চন্দ্রার পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। গায়ের অ্যাপ্রোন দেখে বুঝলেন সে এখানকার ডাক্তার। তিনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনার স্ত্রী আমেনা বেগমের দিকে তাকালেন তারপর বললেন,
আমেনা উনি ডাক্তার। তোমার ছেলে নয়।
তিনি জেদ ধরে বললেন, না সে আমার ছেলে।
না সে তোমার ছেলে নয়। তোমার ছেলে চলে গেছে।
না যায়নি। ওইযে ওখানে দাঁড়িয়ে।
গিয়েছে। এখন চুপ করে ঘুমাও।
তুমি এমন করছো কেন? সে আমার ছেলে। কোথাও যায়নি সে।
বলেই কাঁদতে লাগলেন। বারসাতের বাবা চন্দ্রা আর রাশেদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো, তোমরা বাইরে যাও আমি উনাকে সামলে নিচ্ছি। কিছু মনে করো না।
চন্দ্র আর রাশেদ নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাশেদ দরজার বাইরে থেকে ভেতরে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার নার্স ছুটে এলো। আমেনা বেগম বেডে শুয়ে বিড়বিড় করছে। খুব সম্ভবত ছেলেকে খুঁজছে। রাশেদ এগিয়ে কেবিনে ঢুকলো।
আমেনা বেগমের পাশে বসে উনার হাত ধরে বললো, মা তোমার ভয় নেই। এই যে আমি।
আমেনা বেগম বললেন দূর্বল গলায় বললেন, কোথায় ছিলি তুই? তোর আব্বা আমার সাথে ঝগড়া করেছে বলেছে তুই নেই।
আব্বার কথা ধরো না তো। আমি এখানে আছি। তোমার পাশে। এই যে তোমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছি। কোন ভয় নেই তোমার।
তিনি দুর্বল হাতে রাশেদের হাত ধরে আঁকড়ে ধরলেন। রাশেদের দুই চোখ থেকে পানি পড়ছে। পাশে থাকা ডাক্তার অবাক চোখে রাশেদকে দেখছে। তার জানা মতে এই মহিলা রাশেদের মা না। তবু কতটা স্নেহে রাশেদ উনার হাত ধরে আছে। খুব বড়জোর পাঁচমিনিটের মাথায় তার হাত রাশেদের হাতে নিথর হয়ে গেল। আশেপাশের সবাই কাঁদতে লাগলো। সবাই বলতে বারসাতের বাবা আর বোন। রোগী মারা গেলে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে পড়ে। কারণ একটা বেড খালি হলে সেখানে আরেকটা রোগী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসে বড়জোর একঘন্টা এর মধ্যেই সব ফর্মালিটি শেষ করে উনারা বাড়ির উদ্দ্যেশে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বারসাতের বাবা রাশেদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো, বাবা তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমেনা অসুস্থ হবার পর থেকে এমন করতো। ওর ছেলের বয়সী কাউকে দেখলেই এমন করতো। তোমাকেই আমি একমাত্র দেখলাম আমার স্ত্রী কাছে এসে ছেলে মতো পাশে ছিলে। তার শেষ সময়ে তার ছেলের মতোই তার হাত ধরে বসে ছিলে। ও এতটুকু শান্তি পেয়েছে এটাই অনেক। তুমি ভালো থেকো।
রাশেদ কিছু বলতে পারলো না। সে তাদের এম্বুলেন্সে তুলে দিলো। তাদের সাথে গেল বারসাতের দুই বন্ধু। দাফন হবে বারসাতের গ্রামের বাড়িতে। উনারা রওনা হবার পর রাশেদ সেখান থেকে তার কেবিনে চলে এলো। তার চোখ জ্বলছে। কান্না পাচ্ছে। সে তার কেবিনের বাথরুমে চলে গেল। চন্দ্রা তার কেবিনের চেয়ারে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর রাশেদ চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো, চন্দ্রা আজ আর হাসপাতালে থাকবো না বাসায় চলে যাব। ভালো লাগছে না। তুমি একটু বসো আমি জানিয়ে আসি।
চন্দ্রা মাথা নাড়লো। সে নিঃশব্দে চোখের জল ফেললো। মিনিট দশেক পর রাশেদ এসে চন্দ্রাকে নিয়ে সিএনজিতে বসলো। চন্দ্রা একমনে রাশেদের দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু পর রাশেদ চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো, কী দেখছো তখন থেকে?
চন্দ্রা চমকে বললো, কই কিছু না তো।
ভাবছো হঠাৎ করে আমি বারসাতের মায়ের কাছে গিয়ে এই কান্ডটা করলাম কেন?
হ্যাঁ।
চন্দ্রা উনি অসুস্থ মানুষ ছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন উনি মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তখন উনার মনে হলো আমি উনার মৃত ছেলে। কিছুক্ষণের জন্য উনার মনে হলো বারসাত ফিরে এসেছে। আমাকে যখন ডাকছিলেন তখনই যেতাম কিন্তু বারসাতের বাবা আটকে দিল। কিন্তু যখন অবস্থা খুব খারাপ হলো নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। উনি যদি আমাকে নিজের ছেলে মনে করে কিছুক্ষন স্বস্তি পেতে চান তবে তাই হোক। কিছুক্ষণের জন্য বারসাত হয়ে গেলাম। চন্দ্রা আমি কোন দিন অভিনয় করিনি। আজকের অভিনয়টা আমার জীবনের প্রথম অভিনয়। তোমার মনে হয় না এরজন্য আমার অস্কার পাওয়া উচিত।
এটা অভিনয় ছিল?
হ্যাঁ।
চন্দ্রার চোখে জল চলে এলো কিন্তু তা সে রাশেদকে দেখাতে চাইলো না বলে সিএনজির বাইরে তাকালো। সে জানে রাশেদ অভিনয় করেনি। যা করেছে মন থেকে করেছে। আমেনা বেগমের মধ্যে সে অন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছিল তাই গিয়েছিল। কাকে খুঁজছিল তা চন্দ্রার জানা নেই কিন্তু কাউকে খুঁজছিলো সেটা সে জানে।
চারদিকে ভাপসা গরম। আকাশ অন্ধকার। ছাই রঙ্গের মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। এখন বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চারদিক অন্ধকার রাস্তা ফাঁকা কিন্তু সময় মাত্র বিকেল তিনটা। তার মধ্যে সিএনজিতে পাশাপাশি বসে আছে দুই কপোত-কপোতী। এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসুক তাদের জীবনেও যাতে এই বৃষ্টি তাদের জীবনে সমস্ত গ্লানি দূর করে দিয়ে একটি ভালবাসাময় জীবন উপহার দেয়।
মেঘ আমার জীবনে ভেসে ভেসে আসে কিন্তু অন্ধকার নিয়ে না; বরং আমার জীবনের সূর্যাস্তে এক নতুন রঙ যোগ করতে।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চলবে………
#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#নবম_পর্ব
১৪.
দিন বিশেক কেটে গেল। এর মধ্যে রাশেদ আর চন্দ্রার সম্পর্কে অনেকটা বদল এসেছে। ইমারজেন্সি থাকায় আজকে রাশেদের ফিরতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল। চন্দ্রা জেগে বসে আছে। টুকু প্রতিদিন নয়টা বাজতেই ঘুমে ঢুলতে থাকে। তাই ওকে খাবার দিয়ে দিয়েছে খাওয়া হয়ে যাওয়ার ওর ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঘুমাতে। চন্দ্রা বসে বসে অপেক্ষা করছে রাশেদের। রাত আড়াইটা নাগাত রাশেদ এসে চন্দ্রাকে কল দিলো গেইট বন্ধ। চন্দ্রা চাবি নিয়ে গেইট খুলে দিল। রাশেদ খুবই ক্লান্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে রাশেদ হাসলো। চন্দ্রাও হাসলো। রাশেদ ভেতরে ঢুকে চন্দ্রার হাত থেকে তালা চাবি নিয়ে গেইট বন্ধ করলো। তারপর রাশেদ চন্দ্রা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।
চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো, এতো দেরি হলো কেন?
ইমারজেন্সি ছিলো তাই। চলে আসবে এই সময় পেশেন্ট এলো। খুবই খারাপ অবস্থা ফেলে রেখে তো আর চলে আসতে পারি না।
ও আচ্ছা।
কথা বলতে বলতে ঘরে চলে এলো। রাশেদ ফ্রেশ হতে গেলো। এই ফাঁকে চন্দ্রা সবকিছু গরম করলো চুলায় তারপর টেবিলে সাজিয়ে দিল। রাশেদ এসে বসলো। চন্দ্রা খাবার বাড়তে লাগলো।
রাশেদ বললো, টুকু কী ঘুমিয়ে পড়েছে?
হ্যাঁ।
খেয়েছে?
হ্যাঁ।
তুমি খেয়েছো?
এইতো এখন খাবো।
রাশেদ বেশ রাগী গলায় বললো, এখন খাবে কেন? এতসময় কী করেছো?
খেতে ইচ্ছে করে নি তাই খাইনি।
যেদিনই দেরি করে আসি তুমি না খেয়ে থাকো। এমন করার কী দরকার? তোমাকে তো আগেই বলেছি আমি গেইটের চাবি, বাসার চাবি নিয়ে যাব। তোমার কষ্ট করে উঠতে হবে না।
আমার ইচ্ছেতেই করছি। কষ্ট হবে তা তো বলি নি।
ঠিক আছে গেইট খুলে দাও। কিন্তু আর কোনদিন না খেয়ে থাকবে না।
সে দেখা যাবে। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। মুখে নিন তাড়াতাড়ি।
হ্যাঁ খাচ্ছি।
চন্দ্রা কোন দিনই রাশেদকে ছেড়ে খাবে না সেটা রাশেদ জানে। রাশেদ একদিন বলেছিল একা একা খেতে পারে না। যখন ওরা কথা বলতো না তখন রাশেদ দেরি করে আসলে কখনোই ভাত খেতো না। চা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু যেদিন থেকে বললো একা খেতে পারে না তখন থেকে চন্দ্রা বসে থাকে। রাশেদ এলে একসাথে খায়। তাছাড়া রাশেদ প্রতিদিন লেট করে না। মাঝেমধ্যে বেশি দেরি হয়ে যায়। অপেক্ষা করতে চন্দ্রার খারাপ লাগে না। বরং ভালোই লাগে। রাশেদ খেয়ে ঘরে চলে গেল। চন্দ্রা সব গুছিয়ে চা নিয়ে গেল। ঘুমানোর আগে এই লোক চা খায় কীভাবে কে জানে? ঘুম চলে যায় না?
রাশেদের হাতে চা দিয়ে চন্দ্রা বিছানা ঠিক করছে৷ রাশেদ চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা?
চন্দ্রা কাজ করতে করতে উত্তর দিলো, কী?
তুমি আর পড়বে না?
চন্দ্রার হাত থেমে গেল সে বললো, হঠাৎ এই কথা কেন?
আমার কথার উত্তর চাইছি কিন্তু তুমি তো নিজেই প্রশ্ন করছো।
না আর পড়বো না। অনার্স কমপ্লিট তো করা আছেই।
কেন?
ইচ্ছে নেই। তাছাড়া এখন সময় চলে গেছে। ভর্তির ডেট আগেই চলে গেছে।
তাহলে নতুন ব্যাচে হবে।
হঠাৎ পড়া নিয়ে এতো কথা কেন?
কারন আমি ভেবেছিলাম তোমার সময়ের প্রয়োজন তাই দেরি করছো কিন্তু এখন তো দেখছি তোমার ইচ্ছেই নেই।
না নেই।
কেন?
জানা নেই।
চন্দ্রা?
কী?
তোমার সাথে তোমার বাসার সবার কথা হয়?
হ্যাঁ।
তোমার বাবা আজকে আমাকে কল করেছিল।
আমি এটাই সন্দেহ করেছিলাম।
তুমি জানতে?
না আজ বাবাও আমাকে কল দিয়ো বললো আবার শুরু করতে পড়াশোনা। কিন্তু আমি না করে দিয়েছিলাম। সে জন্য হয়তো আপনাকে বলেছে যাতে আমি রাজি হই। তাই না?
কিছুটা সেইরকমই। তুমি পড়াশোনা করতে চাইছো না কেন?
প্রশ্নটা তোলা থাক। পরে কোনদিন বলবো। রাত তিনটার উপর বাজে। ঘুমিয়ে পড়ুন।
রাশেদ আর কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। থাক বেশি ঘাটাঘাটি করলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। একবার যখন বলেছে বলবে তার মানে পরে নিশ্চয় বলবে। তিন দিন ধরে প্রতিদিন খুব সকালে হাসপাতালে যায় আর গভীর রাতে ফিরে। ঘুম ঠিকমতো হয় না। কালকের দিনটা ছুটির দিন তাই রাশেদ ঠিক করলো হাসপাতালে খুব দরকার না হলে যাবে না। বাসায় থেকে ঘুমাবে।
১৫.
রাশেদের ঘুম ভেঙে গেল নয়টার দিকে। সে ভেবেছিল তিন দিনের ঘুম আজকে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিবে। কিন্তু তা আর হলো না। ঘুম তার প্রতি বিদ্রোহ ঘোষনা করে দিয়ে শরীরকে জাগিয়ে দিলো। মিনিট দশেকের মতো বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে চন্দ্রা দক্ষ হাতে বিছানা গোছাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। বেশ লাগছে দেখতে। আজকে রাশেদের বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চন্দ্রা রাজি হবে কিনা বুঝতে পারছে না। চন্দ্রা কখনোই তার সাথে বাইরে যায় না। তারপরও জিজ্ঞেস করতে ক্ষতি কী!
চন্দ্রা?
হুম।
চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
হাসপাতালে যাবেন না?
আজ ছুটির দিন।
ও ভুলে গিয়েছিলাম। কখন যাবেন?
যখন তোমার ইচ্ছে।
তাহলে বিকেলে যাই। সাড়ে তিনটা চারটার দিকে।
বিস্ময়ে রাশেদ কথা বলতে পারলো না। সে নিজের মনকে প্রশ্ন করলো, চন্দ্রা কী সত্যিই যাবে নাকি ভুল শুনছে?
চন্দ্রা কাজ করতে করতে বললো, এখন আমার অনেক কাজ আছে। সেগুলো শেষ করতে করতে দুপুর হয়ে যাবে। সব কিছু শেষ করে বিকালে বের হবো। এখন চলুন ঝটপট খেয়ে নিবেন।
তুমি যাও আমি আসছি।
আচ্ছা।
চন্দ্রা চলে গেল। রাশেদের খুব খুশি হয়েছে। চন্দ্রা তার সাথে ঘুরতে যাবে বলেছে। এই প্রথম ওরা একসাথে সময় সময় কাটাবে। একান্ত ব্যাক্তিগত সময়। যেখানে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। রাশেদ খুশিমনে নাস্তা করতে গেল।
বিকেল সাড়ে তিনটায় সবকিছু গুছিয়ে চন্দ্রা ঘরে এসে দেখে রাশেদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে কাছে গিয়ে বললো,
রেডি হবো?
হ্যাঁ। তৈরি হয়ে নাও। তোমার হয়ে গেলে আমাকে বলো আমি তখন রেডি হবো। মেয়েদের তো সময় বেশি লাগে।
আচ্ছা।
বলেই চন্দ্রা আগ্রহ নিয়ে চলে গেল। রাশেদ এই চন্দ্রাকে দেখে অবাক। এটাই কী সেই চন্দ্রা যাকে শত বলার পরও সে বাইরে নিয়ে যেতে পারে নি? সেই চন্দ্রা হলে তো এতো আগ্রহ নিয়ে তৈরি হতে যেত না। আচ্ছা চন্দ্রা কী সব জোর করে মনের বিরুদ্ধে করছে? যদি করে থাকে তাতে রাশেদ সবথেকে বেশি কষ্ট পাবে। ও চায় চন্দ্রা নিজের মন থেকে সব করুক। নিজেই উপলব্ধি করুক এই সংসার তার, একান্ত তার নিজের। তা উপলব্ধি করে সে সব কিছু মেনে নিক। সময় যত প্রয়োজন তাকে দেওয়া হবে। কিন্তু দিনশেষে সব কিছু মন থেকে মানবে। না হলে এক সময় এই সম্পর্ক, সংসার তার কাছে গলায় কাঁটার মতো বিঁধবে। না পারবে গিলতে, না পারবে উগরে ফেলতে। এই কাজ গুলো চন্দ্রা কারো কথায় করছে কিনা তাও বুঝতে পারছে না রাশেদ।
চন্দ্র দশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। এসে রাশেদকে ডাকলো। রাশেদ অবাক হলো এতো তাড়াতাড়ি সে কীভাবে তৈরি হলো? সে ভেতরে গিয়ে তাকিয়ে দেখে হালকা কমলা রংয়ের সুতি তাঁতের শাড়ি পড়েছে। মুখে কোন প্রসাধনী নেই। কিন্তু খুব সম্ভবত ক্রিম দিয়েছে তা হাত দিয়ে মাখছে আর অন্য হাতে ফেস পাউডার। একহাতে সোনার চিকন চারটা চুড়ি অন্য হাতে ঘড়ি। চন্দ্রার বোধহয় ঘড়ি খুব পছন্দ সে সবসময় হাতে ঘড়ি পরে বাইরে যায় তা রাশেদ খেয়াল করেছে। চুড়ি খুব কমই দেখা যায় তার হাতে। রাশেদ তৈরি হয়ে গেল। হালকা আকাশী রংয়ের শার্ট তার গায়ে চমৎকার মানিয়েছে। চন্দ্রা বিছানায় বসে ফোন দেখছে। রাশেদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে বললো, চন্দ্রা তুমি কী তৈরি?
হ্যাঁ।
চন্দ্রা দিকে রাশেদ তাকালো আয়নার মধ্য দিয়ে। সে একটুও সাজেনি। শুধু সেই সময় দেখা পাউডার আর ক্রিমই বোধহয় দিয়েছে আর ঠোঁটে লিপবাম। তার কী সাজার কিছু নেই নাকি দেয়নি ইচ্ছে করে নাকি সে সাজেই না? তার মনে প্রশ্ন জাগছে। বিয়ের সময়ই যা সাজতে দেখেছে তারপর কখনোই দেখে। অবশ্য সে বাইরেই যায় না শুধুশুধু সাজবে কেন?
চন্দ্রা চলো বেরিয়ে যাই। টুকুকে বলে আসো আসতে দেরি হলে সে যেন ভয় না পায়।
চন্দ্রা টুকুকে এই কথা বলতেই সে জ্ঞানী স্বরে বললো, আফামনি আফনে আমি থাকতে কোন টেনশন নিয়েন না।
চন্দ্রা হাসতে হাসতে বললো, তুই আছিস তাই তো টেনশন। ভয় পাবি না তো। সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।
এইডা কী কইন আফা? মাঝরাইত ওইলেও ভয় পাইমু না। আমি টুকু থাকতে আফনের কোন ডর নাই।
আচ্ছা। কিছু খাবি? নিয়ে আসবো?
জ্বে না।
মন চাইলে বল নিয়ে আসবো।
তাইলে কেক বিস্কুট নিয়া আয়েন।
তুই কী ড্রাই কেকের কথা বলছিস নাকি কেক কোনটা?
ড্রেরাই কেক।
আচ্ছা। দরজা লাগিয়ে রাখ। নিজে নিজে চুলা ধরাতে যাবি না। ঠিক আছে?
আইচ্ছা।
যদি ক্ষিদে পায় ঘরে কোথায় কী আছে তোর তো জানাই আছে খেয়ে নিস।
চন্দ্রা টুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। রাশেদ নিচে অপেক্ষা করছে। চন্দ্রা নিচে গিয়ে দেখে রাশেদ রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। চন্দ্রা হাসিমুখে রিকশায় উঠলো। রাশেদ রিকশায় উঠে চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা কোথায় যাবে বলো?
আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।
তোমার কোন ইচ্ছে নেই?
না।
কাছেই একটা দিঘী আছে। যাবে?
যাবো।
আচ্ছা সেখানেই চলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সেখানে পৌঁছায়। চারপাশটা গোধূলির আলোতে রাঙা। দীঘির টলটলে জল দেখে চন্দ্রার ইচ্ছে করছে ঝাপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে৷ আজ বেশ গরম। গ্রীষ্ম এখনো আসে নি। মাত্র ফাল্গুন মাস। এখনোই এতো গরম। তাই আরো বেশি ইচ্ছে করছে সাঁতার কাটতে। সে পানি দেখতে এতই ব্যস্ত হয়ে গেল যে খেয়ালই করলো না রাশেদকে পিছনে রেখেই সে সামনে এগিয়ে এসেছে। রাশেদ রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে চন্দ্রা এগিয়ে গেছে।
রাশেদ চন্দ্রা পাশে গিয়ে বললো, কী দেখছো এতো মনোযোগ দিয়ে?
দীঘির জল। কী সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ খুব সুন্দর। তুমি এর আগে আসো নি কখনো?
না। এই জায়গাটার নাম কী?
ছয়সিড়ি দীঘি।
এটা কত বড়ো?
অনেক বড়। এখান থেকে হাঁটা শুরু করলে বেশ খানিকটা যেতে হবে তারপর দীঘির শেষ সীমানা।
তাহলে চলুন যাই।
চলো।
বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে চন্দ্রা বললো, রাশেদ আমার দীঘির জলে পা ভেজাতে ইচ্ছে করছে।
তাহলে ভেজাবে। না করেছে কে?
আছাড় খেয়ে যদি পড়ে যাই।
সেক্ষেত্রে আমি হেল্প করতে পারি। করবো?
অবশ্যই।
জুতো খুলে আমার সাথে এসো।
চন্দ্রা জুতা খুলে এগুলো দীঘির জলের দিকে। রাশেদ তার হাত বাড়িয়ে চন্দ্রার হাত শক্ত করে ধরলো। কী প্রচন্ড অধিকারবোধ থেকে সে হাত ধরেছে! কোথাও না কোথাও চন্দ্রার ভালো লাগা কাজ করলো। ভাল লাগার রেশ ততক্ষণ রইলো যতক্ষণ রাশেদ হাত ধরে রাখলো। চন্দ্রা মনে মনে গুনলো ১, ২, ৩……….৬০। পাক্কা একমিনিট পর রাশেদ হাত ছাড়লো। চন্দ্রার কিছুটা খারাপ লাগলো। এতো তাড়াতাড়ি ছাড়লো কেন সে হাত? চন্দ্রা পা এখন দীঘির টলটলে জলের উপর। এতো স্বচ্ছ সেই জল যে পা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দীঘির পাড়ের মতো জায়গাটায় চন্দ্রা বসলো। পাশে রাশেদকে ইশারায় বললো বসতে। রাশেদ পাশে বসলো। রাশেদ চন্দ্রার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালো। কনে দেখা আলোয় এই মেয়ের রুপ যেন বেড়েই চলেছে।
সে চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো, চন্দ্রা?
হুম।
চন্দ্রার কাছে তার নামটা খুব প্রিয়। কেউ যখন তার নাম ধরে ডাকে তার কাছে সেটা তার কাছে আরো লাগার সৃষ্টি করে। রাশেদ যতবার তার নাম ধরে ডাকে কানে সংগীতের মতো বাজতে থাকে। মনে হয় সে শুধু ডেকেই যাক চন্দ্রা বলে।
রাশেদ আবার বললো, তুমি কী জানো এই বিকেলের রোদকে কী বলে?
হ্যাঁ। গোধূলি।
আরেকটা নাম আছে? সেটা জানো?
না তো সেটা কী?
কনে দেখা আলো।
ও হ্যাঁ ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ এই কথা কেন?
তুমি জানো কেন এই আলেকে কনে দেখা আলো বলে?
না। কেন বলে?
কনে দেখা আলো কথা শুনতে যতটা সুন্দর তার পিছনের কারণটা খুব দুঃখের। বঙ্গদেশীয় কন্যারা কখনোই খুব ফর্সা হয় না। শ্যামলা হয় বেশিরভাগ মেয়েই৷ আগের যুগে শ্যামলা মেয়েদের বিয়ে দিতে বাবা মায়ের খুব কষ্ট করতে হতো। তাই যখন পাত্রপক্ষ আসতো কনেকে কুসুম রঙের শাড়ি পরিয়ে বাড়ির উঠোনে পশ্চিম দিকে মুখ করে বসানো হতো ঘটকের পরামর্শে । বিকেলের পশ্চিম দিকে অস্ত যাওয়া সেই সূর্যের আলোর কনের মুখ উজ্জ্বল দেখাতো। তাই এই আলোকে কনে দেখা আলো বলে।
এর পেছনে এতো মন খারাপ করা গল্প আছে জানলে শুনতামই না।
এমন ছেলেমানুষী কথা শুনে রাশেদ হাসলো।
চলবে…………