আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,পর্ব-০৬,০৭

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,পর্ব-০৬,০৭
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#ষষ্ঠ_পর্ব

১০.

ছুটির দিন। চন্দ্রা রান্নাঘরে কাজ করছে। রাশেদ ঘরেই আছে। এমন সময় কলিংবেল বাজলো। চন্দ্রা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এগুলো দরজার দিকে।

রাশেদ চন্দ্রা আসতে দেখে বললো, আমি দেখছি।

চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। চন্দ্রা জানে এই বাসার মালিক এসেছে। উনি যদি খেয়াল করেন রাশেদ বাসায় তাহলে প্রায় সময় আসেন। চন্দ্রা গিয়ে চুলায় চায়ের জল বসালো। একটু পরেই রাশেদ এসে বলবে চা দিতে। দরজা খুলতেই রাশেদ দেখলো ছোট একটা বাচ্চা ছেলের সাথে শাহাবুদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে।
রাশেদের বাড়ির মালিক আট নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে চন্দ্রাদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ছেলেটিকে তিনি মাটিতে বসতে দিয়েছেনরাশেদ দরজা বন্ধ করে এসে দেখে।

রাশেদ বললো, তুমি সোফায় বসো। মাটিতে বসেছো কেন?

শাহাবুদ্দিন সাহেব বিজ্ঞের মতো বললেন, আরে রাশেদ সাহেব এদের এতো সম্মান দিতে নেই। সম্মান দিলেই দেখবেন এরা আপনার পশ্চাৎদেশে লাথি দিয়ে চলে গেছে।

না না। সেটা হয় না। এই বাবু তুমি সোফায় বসো। উঠো মেঝে থেকে।

সে সোফায় বসলো। তা দেখে শাহাবুদ্দিন সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, এই পোলা সালাম দে স্যাররে। বল আসসালামু আলাইকুম।

ছেলেটি রোবটের মতো বললো, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো তুমি?

জ্বে ভালা।

শাহাবুদ্দিন সাহেব বললেন, তুমি কইছিলা মাইয়া খুঁইজা দিতে কিন্তু আমি পাইনাই । তাই এটারে নিয়া আইলাম।

আচ্ছা। কিন্তু ও তো বেশ ছোট। কোন সমস্যা হবে না।

কিসের সমস্যা?এরা দেখতে ছোট কিন্তু কাজ ভালো পারে। শোন এরে বেশি পাত্তা দিবা না। পরে দেখবা এখন ঘাড়ে উইঠা নাচতেসে আর পরে জিনিসপত্র নিয়ে ভাগছে।

আচ্ছা দিবো না। তোমার নাম কী?

জাহাঙ্গীর আলম টুকু।

দেখছো রাশেদ কারবারটা। ওর বাপ মাটি কাটে আর হে পোলার নাম রাখছে রাজা বাদশাগোর নামে।

রাশেদ খুবই বিরক্ত হলো। এই লোক মাঝে মাঝে খুবই বাজে ভাবে কথা বলে। মানুষকে ছোট করে উনি খুবই আনন্দ পান। সেই আনন্দ পাবার জন্য উনি নিজের ছেলেদেরও বাদ দেন না। রাশেদ তবুও হাসি মুখে কথা বলতে লাগলো। একসময় উনি উঠলেন। রাশেদ তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল।

উনি দরজার কাছে এসে রাশেদকে আবারও ফিসফিস করে বললেন, রাশেদ ওকে দেখে রেখো। ব্যাটা এক নাম্বারের চোর। এখন থেকে টাইট না দিলে পরে কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে ভাগবে।

রাশেদ সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো, ঠিক আছে।

উনি চলে যেতেই রাশেদ চন্দ্রাকে ডাকলো। রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের দূরত্ব রয়েছে বেশ। তাই সে কথাবার্তা কিছুই শুনেনি। চন্দ্রা ভেতরে এসে দেখে দেবশিশুর মতো একটা ছেলে অতি আগ্রহে তাদের ঘর দেখছে। গায়ের রং যত্নের অভাবে ময়লা হয়ে গেছে। চোখেমুখে তার বিম্ময়। তাদের ঘর দেখে বিস্মিত হবার কোন কারন চন্দ্রা খুঁজে পেল না। তার পরনে লুঙ্গি আর কনুইয়ের কাছে ছেড়া পুরাতন ময়লা একটা শার্ট। হয়তো এটাই তার কাছে থাকা একমাত্র ভালো কাপড়। ছোট্ট একটা পুঁটলি তার হাতে। যে কাপড়টা দিয়ে পুঁটলিটা করা সেটাও ময়লা। চন্দ্রা কাছে গিয়ে বললো, তোমার নাম কী?

টুকু খুব আগ্রহ নিয়ে তার নাম বললো।

চন্দ্রা আজ থেকে ও আমাদের সাথে থাকবে। তোমার কাজে সাহায্য করবে।

চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।

তারপর টুকুর দিকে তাকিয়ে বললো, টুকু ইনি হচ্ছেন চন্দ্রা মানে চাঁদ ইংরেজিতে মুন। বুঝেছো?

টুকুও মাথা নাড়লো মানে সে বুঝছে।

চন্দ্র টুকুর দিকে তাকিয়ে বললো, এই বাবু কেমন আছো তুমি?

জ্বে ভালা। আফনে কেমন আছেন আম্মাজান?

আমিও ভালো৷ কিন্তু তুমি আমাকে আম্মাজান বললে কেন?

কেন? আমার আম্মায় তো কইয়া দিলো যে বাসায় কাম করতে যাইমু হেই বাসার মালকিনরে আম্মাজান আর মালিকরে আব্বাজান ডাকতে।

আমাকে আপা বলে ডাকবে। ঠিক আছে?

জ্বে আইচ্ছা।

আসো তোমাকে ঘর দেখিয়ে দেই।

বলেই চন্দ্রা টুকুর হাত ধরলো। ধরে বাসার ছোট্ট স্টোররুমে নিয়ে গেল।

রাশেদ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলো চন্দ্রা খুবই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। টুকুও খুব জড়তা নিয়ে বসে ছিল শাহাবুদ্দিন সাহেবের সামনে। কিন্তু উনি চলে যেতেই সে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
সেই টুকুকে নিয়ে চন্দ্রা কী খুশি? সে সারাক্ষণ তার সাথে গল্প করে। টুকুও তার সাথে কথা বলে। তবে তার সব কথা তার ছোট “ভইন” টুকিকে নিয়ে। টুকির বয়স একবছর। কিন্তু এই বয়সে সে টুকুকে ভাইজান বলে ডাকে এবং টুকু যখন আসবে তখন নাকি তাকে বলে দিয়েছে, ভাইজান আসার সময় আমার লাইগা মজা নিয়া আইসো।। টুকুর কথা যে আদোও বিশ্বাসযোগ্য না তা রাশেদ জানে। কিন্তু চন্দ্রা খুব সহজেই তা বিশ্বাস করলো এবং আগ্রহ নিয়ে টুকুর কাছে টুকির গল্প শুনছে এবং তাকে আশ্বাস দিয়েছে বাড়ি যাবার সময় টুকির জন্য সে অবশ্যই চকলেট কিনে দিবে। রাশেদ তাকিয়ে রইলো অসহায় ভাবে। এই মেয়ের মাথায় কী? সে এই কথাটা কীভাবে বিশ্বাস করলো তা রাশেদের মাথায় ধরছে না? যাক কিছু তো কথা বলছে এটাই অনেক। না হলে কদিন পর দেখা যেত সে কথাই বলতে ভুলে গেছে। কথা বলতে শুরু করলেও তার সম্পর্ক রাশেদের সাথে আগের মতোই আছে।
শাহাবুদ্দিন সাহেব খুব সম্ভবত ভবিষ্যৎবানী করতে পারেন। কারন পাঁচদিনের মাথায় এক ভোরে টুকু পালালো। সাথে কিছু নিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না রাশেদ। কারন ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তবে পালালোর কারন কী তাও রাশেদ বুঝলো না। শাহাবুদ্দিন সাহেব খুবই রেগে গেলেন।

তিনি রেগে বললেন, হারামজাদারে আমি জেলের ভাত খাওয়ামু। কত বড় সাহস। নাক টিপলে দুধ বাইর হইবো। আমার বাড়ি থেকে চুরি করে পালাইলো।

রাশেদ খুবই বিরক্ত হয়ে বললো, চাচা সে চুরি করেনি। করলে ঘরের জিনিসপত্র মিসিং থাকতো। তা কিন্তু নেই।

যদি নাই করবো তাইলে না কইয়া গেলো কেন?

সেটা অন্য কারন হতে পারে। তার বাবার কাছে কল করুন। দেখুন সে সেখানে কিনা?

তার বাবার কাছে কল করা করা হলো কিন্তু ফোন বন্ধ। রাশেদ খুবই চিন্তিত। পরের ছেলের কিছু হলে এর দায়ভার তার উপর পড়বে। তাই সে ঠিক করলো টুকুর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে কালই সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে। চন্দ্রা খুবই মন খারাপ করলো। তার মনে হচ্ছে কোন কারনে টুকু তার উপর রাগ করে চলে গেছে।

নানা কারনে রাশেদ দুইদিন আটকে গেল। তৃতীয় দিন যেদিন রাশেদ যাবে সেদিন ভোরে টুকু এসে হাজির তার ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে। রাশেদ এনে দিয়েছিল সেটা। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে করে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুম দিলো। চন্দ্রা এমনই মেয়ে রাশেদকে কিছুই বললো না। সকালে রাশেদ খেয়ে চলে গেল তখনো সে জানে না টুকু ফিরে এসেছে। রাশেদ যখন রাতে বাসায় ফিরলো তখন টুকু দরজা খুলে দিলো তারপর ঝাড়ু হাতে নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে লাগলো। রাশেদ বিস্মিত। সে টুকুর হাত থেকে ঝাড়ু ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে সোফায় বসলো। তারপর না রেগে শান্তস্বরে কথা বললো যাতে সে ভয় না পায়।

কখন এলি তুই?

আইজকা ভোরে।

রাশেদ অবাক হলো। চন্দ্রা একবারও বললো না এই কথা। অথচ আজ রাতে ও খেয়ে টুকুর খোঁজে যেত।

কোথায় ছিলি তুই এই দুইদিন?

ভাইজান ভইনরে দেখতাম গেছিলাম।

একা একা গিয়েছিস কেন? আমাকে বললে আমি কী না করতাম?

ভাইজান খুবই খরাপ খোয়াব দেকছি ভইনরে নিয়া। তাই কোন কিছু না ভাইবা চইলা গেছি।

একা একা গেলি কিছু হলে কী হতো? তোর বাবা মাকে আমি কী বলতাম?

ভাইজান এতো ডরের কিছু নাই। আমি আমার মামার বাস দিয়া গেছি।

তোর মামা মানে?

আমগো বাড়ির সামনে দিয়া যে বাস ঢাকা আয়ে ওই বাস আমার এক মামার।

তোর মামা কী বাস চালায়?

জ্বে না। বাসে সবার কাছ তে ভাড়া নেয়।

এত সকালে কীভাবে এলি?

আব্বায় বাসে তুইলা দিছে।

তোর আপা যে কষ্ট পেয়েছে তুই জানিস? সে মনে করেছে তার কোন ব্যবহারে তুই কষ্ট পেয়ে চলে গেছিস।

আপার উপর রাগ করুম কে? আপা আমার আম্মার লাহান। আমারে কত আদর করে। কিন্তু ভাইজান আপা আমার লগে কতা কইতাছে না। আফনে একটু বলেন তারে আমি খুবই কষ্ট পাইতাছি।

তার রাগ ভাঙে নি এখনো?

জ্বে না।

আচ্ছা আমি বলে দিব। আর তুই কখনো এমন করবি না। কোথাও যেতে হলে আমাকে বলবি। কাল আমার সাথে গিয়ে তোর মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি।

আইচ্ছা।

রাশেদ গেল ফ্রেশ হতে। অনেক টেনশনে ছিল সে। আজ কমলো। শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বলতে হবে টুকু ফিরে এসেছে। চন্দ্রা যে মেয়ে সে তাকেই বলেনি শাহাবুদ্দিন সাহেবকে তো আরো আগে বলবে না। চন্দ্রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ চন্দ্রার কাছে গেল। চন্দ্রা আগেই কলিংবেলের শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছে রাশেদ এসেছে। পরিচিত পারফিউম গন্ধ পেয়ে পেছন না ফিরেই বললো, ফ্রেশ হয়ে নিন খাবার খেয়ে নিবেন।

চন্দ্রা, তুমি নাকি টুকুর উপর রাগ করেছো আর রাগ করে থেকো না। ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। তার উপর তুমি কথা বলছো না সে খুবই কষ্ট পাচ্ছো। যাও ওর সাথে কথা বলো।

চন্দ্রা রাশেদের কথা মতো চলে গেল ড্রয়িং রুমে। রাশেদ ফ্রেশ হয়ে খেয়ে এসে দেখে চন্দ্রা আর টুকু গল্প করছে। তাদের মান অভিমান ভেঙেছে তবে। টুকু হাত নাড়িয়ে গল্প করছে আর চন্দ্রা শুনছে। রাশেদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে।

চলবে……..

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#সপ্তম_পর্ব
১১.
রাশেদ আরেকবার ঘর ভালো করে দেখলো। ছাদে গেল কিন্তু চন্দ্রা কোথাও নেই। ফোন বন্ধ। এমন তো কখনো হয় না। সে ঘর থেকেই বের হয় না। আজ কোথায় গেল? বাইরে গেল ভালো কথা জানিয়ে গেলেই হতো। ফোনও বন্ধ দেখাচ্ছে। রাশেদের খুবই ভয় লাগছে রাস্তাঘাটে বিপদে পড়লো কিনা তাও বুঝতে পারছে না। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিকশা নিয়ে আশেপাশে দেখলো। কোথাও নেই। চন্দ্রা কী তাদের বাসায় গেছে? একটা কল দিয়ে কী দেখবে? যদি সেখানে না যায় তাহলে তো বাড়ির সবাই চিন্তা করবে। তারপরও একটা কল করে দেখা যাক। খুব কৌশলে জানতে হবে চন্দ্রা সেখানে গিয়েছে কিনা। রাশেদ তার মাকে কল করলো। দুইবার রিং হতেই তার মা ফোন ধরলো।

হ্যালো মা, কী করছো?

রান্না করছি। তুই কী করছিস?

বাসায় এলাম।

এতো তাড়াতাড়ি আজকে?

হ্যাঁ। আজ ফ্রী ছিলাম তাই চলে এসেছি।

ও আচ্ছা। চন্দ্রা কী করছে?

রান্নাঘরে।

ও কেমন আছে?

ভালো। আচ্ছা মা রাখি। ভালো থেকো।

আচ্ছা তুইও সাবধানে থাকবি। চন্দ্রাকে দেখে রাখবি।

আচ্ছা।

রাশেদ এতোটুকু বুঝতে পারলো চন্দ্রা সেখানে যায়নি। এখন সে তাকে কোথায় খুঁজবে? রাশেদ দিশেহারার মতো চারদিকে খুঁজছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েছে। আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ। যেকোন সময় বৃষ্টি বাড়বে। রাত দশটা নাগাদ রাশেদ গেল এই বিশ্বাসে যে চন্দ্রা নিজে থেকেই বাসায় ফিরবে। টুকুও বাসায় নেই। সে বাড়িতে গেছে। এবারও পালিয়ে গেছে। বাসা একদম খালি খালি লাগছে। রাত এগারোটা নাগাদ কলিংবেলের শব্দ হলো। রাশেদ গিয়ে দরজা খুললো। চন্দ্রা এসেছে। ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। চন্দ্রা রাশেদকে দেখে চমকে উঠলো। বাইরে থেকেই বুঝতে পারছিলো রাশেদ চলে এসেছে। কারন টুকু বাসায় নেই।

সে ভেতরে যেতেই রাশেদ তাকে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো, কোথায় গেলে কাউকে বলে যেতে হয় না হলে কেউ টেনশনে থাকতে পারে এটা কী আপনার জানা ছিল না?

চন্দ্রা শিউরে উঠলো রাশেদের ঠান্ডা গলায়। রাশেদ কখনোই তাকে আপনি করে বলে না আজই প্রথম। তারমানে খুবই রাগ করেছে।

সে আস্তে আস্তে বললো, সরি মনে ছিল না।

রাশেদ এবার খুবই রেগে গেল। সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, মনে ছিল না মানে কী? তোমার এই মনে না থাকার জন্য আমার কী অবস্থা হয়েছে তুমি জানো। তোমাকে বাসায় না দেখতে পেয়ে আমার কেমন লেগেছে তুমি জানো। রাত আটটা থেকে দশটা পযর্ন্ত এদিক সেদিকে ঘুরেছি। আর তুমি ছোট্ট করে বলে দিলে সরি।

আমার কাছে আপনার নাম্বার ছিল না।

তোমার কাছে থাকলেও তুমি আমাকে জানাতে না।

রাশেদ হনহন করে বারান্দায় চলে গেল। চন্দ্রা মাথা তুলে রাশেদের যাওয়া দেখলো। সে বৃষ্টিতে ভিজেছে সেই শার্ট এখনো পড়ে আছে। গায়ে থেকে সেই শার্ট কিছুটা শুকিয়ে গেছে। চন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রাশেদ বারান্দা এখনো দাড়িয়ে। চন্দ্রা রান্নাঘরে গিয়ে সব কিছু গরম করলো৷ তারপর চা বানালো দুইকাপ। সেটা নিয়ে বারান্দায় গেল। ততক্ষণে রাশেদ কাপড় পাল্টে বারান্দায় গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চন্দ্রা চা নিয়ে রাশেদের পাশে দাঁড়ালো।

চা এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনার চা।

রাশেদ কিছু না বলো ভেতরে চলে যেতে চাইলো। চন্দ্রা বারান্দার গ্রিলে রাখা রাশেদের হাতের উপর তার হাত দিয়ে বললো, প্লিজ কথাটা একবার শুনুন।

রাশেদ চন্দ্রার কথা রাখলো। সে দাঁড়িয়ে রইলো। চন্দ্রা চা এগিয়ে দিল। সে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

চন্দ্রা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, জানতে চাইবেন না কোথায় ছিলাম?

রাশেদ থমথমে গলায় বললো, বলার প্রয়োজন মনে করলে হলে আগেই বলতে। এখন আমি জিজ্ঞেস করলে তখন বলবে স্বামী দেখে সবকিছুর ডিটেইলস জানতে চাইছি। অধিকার ফলাচ্ছি।

সেটা কী কখনো আমি বলেছি?

রাশেদ নির্লিপ্ত গলায় বললো, তুমি কথাই তো বলো না। কীভাবে ও কথা বলবে?

চন্দ্রা চুপ করে রইলো। রাশেদের অভিযোগ মিথ্যে নয়। সে কখনোই তার সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলেনি। অনেক সময় সেটাও বলে না। তবে সে যে চেষ্টা করেনি এমন না। অনেক চেষ্টা করেছে সবকিছু স্বাভাবিক করার। প্রতিদিন ভেবেছে আজ থেকে অন্তত তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে কিন্তু যখন রাশেদ সামনে আসে সে স্বাভাবিক কথা দূরে থাক প্রয়োজনীয় কথাও বলতে পারে না। কেন জানি খুব জড়তা কাজ করে। রাশেদের প্রতিদিন অভ্যাস ইস্ত্রি করা শার্ট পড়া। প্রতিদিন গোসলের পর সে শার্ট ইস্ত্রি করতে বসে। চন্দ্রা অনেক দিন ভেবেছে রাশেদ গোসলে গেলে সে নিজে করে দিবে শার্ট ইস্ত্রি। যাতে রাশেদ বুঝতে পারে একটু একটু করে চন্দ্রা তাকে এবং এই সংসারটাকে মেনে নিতে চলেছে। কিন্তু কোনদিনই তা করতে পারেনি। কারন ঐযে জড়তা।

মিনিট দশেক পরে রাশেদ ঘরের ভেতরে পা বাড়াতেই চন্দ্রা বললো, রাশেদ?

রাশেদ থমকালো। চন্দ্রা তাকে এই প্রথম নাম ধরে ডাকলো৷ সে আবার আগের জায়গায় এসে দাড়ালো। তারপর বললো, কিছু বলবে?

আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম।

রাশেদ অবাক হলো। সে হাসপাতালে কেন গেল? কার কী হলো?

সে জিজ্ঞেস করলো, কেন?

বারসাতের মা অসুস্থ। ব্লাড ক্যান্সার লাষ্ট স্টেজ। আজ কয়েকদিন ধরে উনারা ঢাকা। এখানকার হাসপাতালে ভর্তি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম।

তুমি কীভাবে খবর পেলে?

আমার এক ফ্রেন্ডের থেকে।

এখন কেমন অবস্থা?

ভালো না। খুবই খারাপ।

আমি কী কোনভাবে সাহায্য করতে পারি? যদি তুমি কিছু মনে না করো। আসলে আমার অনেক চেনা জানা।

সেটার প্রয়োজন হবে না। ভালো ডাক্তারই দেখানো হয়েছিল। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সব কিছু বির্সজন দিয়েছে। বাড়ি, জমি, টাকাপয়সা।

ও আচ্ছা।

আপনি কী আমার উপর বেশি রাগ করেছেন? আর যাব না কখনো।

চন্দ্রা তুমি যেখানে খুশি যেতে পারো। আমি তোমাকে জিজ্ঞেসও করতাম না কোথাও যাচ্ছো? শুধু বের হবার আগে একবার বলে যেতে আমি বাইরে যাচ্ছি। তাহলে হতো। তুমি জানো আমার কতটা টেনশন হচ্ছিল।

আমি নিজেও ভাবিনি এতোটা দেরি হবে৷ আর আপনি তো দেরি করে বাসায় আসেন আমিও ভেবেছি আজও দেরি করে আসবেন। আচ্ছা যাইহোক আসুন খেয়ে নিবেন।

রাশেদ চন্দ্রা পিছনে পিছনে গেল। চন্দ্রা খাবার দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

তুমিও বসো একসাথে খাই।

আমি খেতে পারবো না। ইচ্ছে নেই।

চন্দ্রা আমি একা খেতে পারি না তুমি জানো কিনা জানি না। তুমি যদি খেতে না বসো আমি খেতে পারবো না। আজকে লাঞ্চও করিনি আমি। বসো।

রাশেদ চন্দ্রার হাত ধরে বসালো চেয়ারে তারপর নিজে বেড়ে দিলো খাবার অল্প করে। চন্দ্রা অনিচ্ছার সত্বেও খাবার মুখে তুললো। এই মানুষটাকে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার খুব গুরুত্ব দেয় তার বিনিময়ে তার কথা না রাখলে খুবই খারাপ দেখায়। চন্দ্রা কোনমতে খেয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। রাশেদের অভ্যাস ঘুমানোর আগে লিকার চা খাওয়ার। রাশেদ এই ফাঁকে টেবিল গুছিয়ে সব খাবার ফ্রিজে রেখে দিল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো চন্দ্রা চুলার পাশে দাঁড়িয়ে একমনে ফুটন্ত পানির দিকে তাকিয়ে আছে আর কী যেন ভাবছে?

রাশেদ সিংকে প্লেট রাখতে রাখতে বললো, চন্দ্রা এখন আর চা খাবো না। তুমি ঘুমাতে চলে যাও।

আপনি এগুলো নিয়ে এলেন কেন? আমিই পারতাম।

আমি জানি তুমি পারতে। কিছু হবে না। যাও ঘুমাতে যাও।

চন্দ্রা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। রাশেদ ঘরে এসে দেখে বিছানার পাশে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাশেদ কাছে গিয়ে দেখলো ভারী নিঃশ্বাস তার মানে ঘুমিয়ে গেছে। সে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো চন্দ্রার পাশে। রাশেদের মন খুবই ভালো লাগছে। চন্দ্রা আজ তার সাথে অনেকগুলো কথা বলেছে তবে বারসাতের মায়ের জন্য খারাপও লাগছে। কাল একবার দেখা করতে যাবে ভাবছে। কিন্তু চন্দ্রা সাথে নিবে কিনা বুঝতে পারছে না। না নিলে না যাবে এতো ভাবার কিচ্ছু নেই আপাদত ঘুমানো যাক।

১২.

খুব সকালে চন্দ্রার ঘুম ভাঙ্গলো। সে উঠে তাড়াতাড়ি ঘরের সব কাজ করে নিলো। আজ আরেকবার গেলে ভালো হতো। কিন্তু রাশেদের যদি আপত্তি থাকে তাহলে তো যেতে পারবে না। তবে রাশেদ মনে হয়না মানা করবে।

রাশেদ উঠে দেখলো চন্দ্রার রান্না প্রায় শেষের দিকে। রাশেদ ভেবেছিল চন্দ্রাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিন্তু চিন্তা করছে কালকে না হয় কথা বলেছে অনেক তাই বলে আজকেও বলবে এমন তো নাও হতে পারে। তারপরও চেষ্টা করতে দোষ কী?

চন্দ্রা এতো তাড়াতাড়ি রান্না করছো কেনো?

টুকু আজ চলে আসবে। এসেই তার ক্ষিদে পাবে সে তো পাউরুটি পছন্দ করে না। ঘরে ময়দা আটা কোনটাই নেই তাই রান্না করে নিয়েছি।

তারপর আবার ইতস্তত করে বললে, আর আপনি অনুমতি দিলে হাসপাতালে যাব। সেজন্য রান্নাটা করে নিয়েছি।

চন্দ্রা আমি তোমাকে কালই বলেছি আমার অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। শুধু ইনফর্ম করলেই হবে।

থ্যাংক ইউ। আপনার চা হয়ে গেছে একটু অপেক্ষা করুন আমি ঘরে গিয়ে দিয়ে আসবো।

আচ্ছা।

বলেই রাশেদ চলে গেল। রাশেদ চলে যাবার পর চন্দ্রা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। অনেক কষ্টে সে এতোগুলো কথা বলেছে। কারন সে নিজেও চাইছে সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে। এভাবে আর কতদিন। সবার সামনে কথা বললেও তার সাথে চন্দ্রা ফ্রি হয়ে কথা বলতে পারে না। অথচ বারসাত ওর জীবনে না এলে বিয়ের পর এই মানুষটার সাথে সে দ্বিধাহীনভাবে কথা বলতো। সবথেকে কাছের মানুষ হতো রাশেদ। না এবার থেকে সে একটু একটু করে সব কিছু মানিয়ে নিবে। রাশেদ নিজেও অনেক চেষ্টা করে সেটা চন্দ্রাও বুঝে। কতদিন হাসপাতাল থেকে এসে চন্দ্রাকে আগ্রহ নিয়ে বলেছে, চন্দ্রা চলো ঘুরে আসি। চন্দ্রা আগ্রহ দেখায় নি। কতদিন সে আগে ছুটি নিয়ে এসেছে চন্দ্রার সাথে বিকালে সময় কাটাবে বলে চন্দ্রা কাছে এসে বসেনি। তখন রাশেদ একা একাই বসে ছিল না হয় বই পড়তো। খুব বেশি বোরিং হলে নিচতলার চাচাকে ডেকে আনতো। কিন্তু এবার থেকে ঠিক করেছে রাশেদের কাছে এসে বসবে গল্প করবে। ঘুরতে যেতে বললে আগ্রহ নিয়ে তৈরি হবে। বারসাত ওর জীবনের একটা অধ্যায় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চাইলেই সে তাকে ভুলতে পারবে না। কিন্তু তার মানে এই না তার জীবন থামিয়ে দিতে হবে। এইসব কিছু চন্দ্রা নিজে ভেবেছে। কেউ তাকে বলে দেয়নি।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here