মন_গহীনে পর্ব_৫
#সামান্তা_সিমি
পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছি। বাবা মা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে।পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা। কিছুই ভাল লাগছে না আমার।সেই সময় তুষার ভাইয়ার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা কল্পনা করলেই ভয় ধরে যায়।এখনো পর্যন্ত উনার সাথে দেখা হয় নি।দেখা হলে চড় থাপ্পড় দুয়েকটা খেতে হবে।আর উনি যদি মা’য়ের কাছে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা শব্দও প্রকাশ করে তাহলে মা আমায় কচু কাটা করবে।আমার জননীর কাছে পৃথিবীর সবকিছু শেয়ার করলেও ছেলে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কখনো কথা হয় না।মা এগুলো পছন্দ করেন না।
যাই হোক।আমার এখন একটাই কাজ।ভাইয়ার সাথে দেখা হলে সোজা উনার পায়ে পড়ে যাব।অনুরোধ করব যেন মা’য়ের কাছে কিচ্ছু না বলে।বিনিময়ে ভাইয়ার জিম করা শক্ত হাতের কয়েকটা চড় খেতেও রাজি আছি।আর আজকের ঘটনায় তো আমার কোনো দোষ ছিল না।আমি কি ইয়াসির ভাইয়ার সাথে নিজে থেকে কথা বলেছি?এমন সাহস আমার কোনোদিনও হয় নি।ভবিষ্যতেও হবে না।কিন্তু এত ব্যাখ্যা তুষার ভাইয়াকে কে বুঝাতে যাবে।উনি বুঝার পাত্র নন।সবার আগে আমার দোষ উনার চোখের সামনে কিলবিল করবে।দোষ না থাকলেও বলবে আমারই দোষ।
ঘড়িতে প্রায় এগারোটার উপর বাজে।ঘুমে চোখ ঢুলুমুলু।আজ আর পড়া হবে না।
বই বন্ধ করে বিছানায় যেতেই কলিংবেল বেজে উঠল।শুনশান নীরবতার মাঝে টিংটং শব্দে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম।কার কি দরকার পড়ল এত রাতে?উফ্!
রুম থেকেই শুনতে পেলাম মা দরজা খুলেছে।কোনো মেয়েলি গলার আওয়াজ পাচ্ছি। কে হতে পারে?
বিছানা থেকে উঠতে নিব এমন সময় মা’য়ের সাথে তুষ্টি আপু রুমে ঢুকলেন।
মা আমাকে নির্দেশ দিলেন,
” আজ তুষ্টির সাথে গিয়ে ঘুমা।মেয়েটা তোকে নিতে এসেছে।”
” হঠাৎ? ”
আপু মুচকি হেসে বললেন,
” বা রে! এমন ভাবে বলছিস যেন এর আগে আমার সাথে ঘুমাস নি?পরীক্ষার মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ পেয়েছি।জানিস তো এ কয়েকদিন পড়তে পড়তে আমি আধমরা হয়ে গেছিলাম।আমার মাথায় ভূত চেপেছিল যে আমি মেডিকেলে পড়তে গেছি।জীবন তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে রে!আর যাই কর কখনো মেডিকেল পড়তে যাস না বোন!
” সেকি! তখন তো মেডিকেল পড়ার জন্য উন্মাদের মত হয়ে গেছিলে তুমি।আর এখন উল্টো সুর গাইছো!বেশি বেশি না পড়লে মানুষের চিকিৎসা করবে কিভাবে?”
আমার কথা শুনে মা বলল,
” থাক হয়েছে।তোমার আর ভাষণ দিতে হবে না।মনে হচ্ছে পড়তে পড়তে বিদ্যাসাগর হয়ে গেছো।”
” মা..ভুল বললে।মেয়েরা বিদ্যাসাগর কিভাবে হবে।মেয়েরা হবে বিদ্যাসাগরী।”
তুষ্টি আপু খিলখিল করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ রাগি চোখে তাকিয়ে হাসি চাপতে না পেরে মা ও হেসে দিলেন।
আপু আমার মাথায় চাটি মেরে বলল,
” বেশি দুষ্টু তুই।আচ্ছা চল আমাদের বাসায়।আজ দুইবোন গল্প করতে করতে ঘুমাব।খুব মজা হবে।”
আপু আর আমি চলে এলাম পাঁচ তলায়।আপুর রুমটা আমার খুব পছন্দের। আনাচে কানাচে বারবি ডল,টেডি বিয়ার রাখা।ছোটবেলার সব পুতুল আপু যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে।আর আমার ছোটবেলার পুতুল, খেলনা এতদিনে বোধ হয় মাটির গভীরে আটকে আছে।খুব অগোছালো আমি।নিজের রুমে ঢুকলে মাঝেমধ্যে নিজেই চিনতে পারি না এটা মানুষের রুম নাকি কোনো গৃহপালিত পশু-পাখির আবাসস্থল।
আজ আপু ল্যাপটপে মুভি দেখার প্ল্যান করেছে।আহ্! ভাবতেই কত আনন্দ লাগছে।কিন্তু এত খুশির মাঝেও মনের কোনায় তুষার ভাইয়ার ভয় ঘাপটি মেরে আছে।এখনো পর্যন্ত উনার সম্মুখীন হয়নি।কোথায় আছে কে জানে।
” নীলাশা যা তো ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।না ডাকলে পরে বলবে ওঁকে ছাড়া আমরা মজা মাস্তি করে ফেলেছি।ভাইয়া রুমেই আছে।তুই যা।আমি ততক্ষণে সিলেক্ট করি কোন মুভিটা দেখা যায়।”
আপুর কথা শুনে আমার আনন্দ মুহূর্তেই কাঁচের মত ভেঙে খানখান হয়ে গেল।ওহ্ খোদা! সাহায্য করো আমায়।
” কিরে যা তাড়াতাড়ি। দৌড়ে যাবি দৌড়ে আসবি।”
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।প্রবাদ বাক্যটা অক্ষরে অক্ষরে আমার সাথে মিলে যাচ্ছে। অবশ্য আমি তো এখন বাঘের গুহাতেই আছি।শুধু বাঘের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা।
এক পা দুই পা ফেলতে ফেলতে তুষার ভাইয়ার রুমের সামনে চলে আসলাম।রুম পুরো অন্ধকার।ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দও আসছে না।ফুপা ফুপি হয়তোবা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।প্রায় সব রুমেরই লাইট অফ।কিন্তু তুষার ভাইয়াও কি ঘুমিয়ে গেলেন নাকি।সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে গেলাম রুমের ভেতর।
” ভাইয়া আপনি কি ভেতরে আছেন?”
কোনো আওয়াজ নেই। এবার তো ভুতের ভয় আমাকে জেঁকে ধরেছে।তুষার ভাইয়ার রুমটা এমনিতেও অন্যান্য রুমগুলো থেকে বেশ প্রশস্ত।লাইটের অভাবে এটা এখন বড় কোনো হলরুমের মত লাগছে।ভয়ের চোটে অজ্ঞান না হয়ে যাই।তারচেয়ে ভালো অতিসত্বর এই অন্ধকার কুঠুরি থেকে নির্গমন করি।বাপরেহ্!
বের হতে যাব এমন সময় কেউ একজন শক্ত হাতে পেছন থেকে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরল।
চিৎকার দিতে গিয়ে দেখি গলার স্বর কন্ঠনালিতেই ঠেকে গেছে।শেষ আমি শেষ।অবশেষে আমি ভুতের খপ্পরেরই পড়লাম।
আমি যখন ভয়ে ঠকঠক করে কাপছি তখনই তুষার ভাইয়ার ভারী কন্ঠস্বর কানে বাজল।
” ভয় পেয়েছিস?আরো ভয় পা।ভয়ে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যা।ভয় পেয়ে অজ্ঞান না হলে আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে সিউর অজ্ঞান হবি।খাবি থাপ্পড়? ”
তুষার ভাইয়ার কথা শুনতে পেয়েই অনেকটা স্বস্তি পেলাম।মন থেকে ভুতের ভয় কেটে গেছে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পরল বাস্তবের ভুতটাই তো আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে যে এক্ষণি থাপ্পড় দেওয়ার কথা বলল।
উনার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম,
” বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি কিছু করিনি।ইয়াসির ভাইয়া নিজে থেকে কথা বলতে এসেছিল আমার সাথে।আপনি তো সবটা দেখেছেন উপর থেকে।তাহলে কেনো ধমকাচ্ছেন আমায়?”
” নিজে কেনো কথা বলতে আসলো?বিগত তিন বছর ধরে এই এলাকায় আছিস।কখনো কথা বলেছে তোর সাথে?তাহলে আজ কেনো আসলো?কি উদ্দেশ্য ছিল ছেলেটার?নাকি তুই কোনো ইশারা করেছিস।সত্যি করে বল আমায়।”
বাজ পড়ল আমার মাথায়। সেই আঘাতে আমার মাথার ভেতরের যন্ত্র গুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।তুষার ভাইয়া এসব কি বলছে।যে কাজটা আমি করিই নি সেই কাজের অপবাদ দিচ্ছে আমায়।বাজে লোক একটা! যা মন চায় বলবে আর আমি সেটা দাঁতে দাঁত ঘষে সহ্য করব নাকি?
” ছাড়ুন আমায়! আপনি এত খারাপ তা জানলে এই রুমে আমি পা ও ফেলতাম না।সবসময় আপনি আমার সাথে এমন করেন।কিসের এত শত্রুতা আমার সাথে?
কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলা প্রায় ভারী হয়ে আসলো।প্রাণপণে চেষ্টা করছি উনার হাতের বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার।কিন্তু দানবটার সাথে শক্তিতে হেরে যাচ্ছি।
এবার তিনি কিছুটা নরম গলায় বললেন,
” কাঁদছিস?প্লিজ কাঁদিস না।রাগ উঠে গেছিল মাথায়।”
” হ্যাঁ রাগ উঠেছে আর আপনার যা মুখে আসবে তাই বলে দিবেন?সত্যি মিথ্যা যাচাই করে দেখবেন না?একবার ভাববেন না যে যাকে কথাগুলো বলছেন সে কতটা কষ্ট পেতে পারে?”
তুষার ভাইয়া হাত কিছুটা আলগা করতেই আমি এক ঝটকায় উনার থেকে দূরে সরে আসলাম।রাগ উঠেছে মাথায় তাই আমাকে এসব বলবে! বুলেট মারি উনার ওই রাগে।ধ্যত্! মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার।
যেরকম পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করেছিলাম তারচেয়ে দ্বিগুন গতিতে বের হয়ে গেলাম।পেছন থেকে তুষার ভাইয়া আকুল আবেদনে নীল নীল বলে ডাকছে।আমি ফিরেও তাকাই নি।
আপুর রুমে ঢুকতেই দেখি আপু বেশ আয়োজন করে মুভি দেখার ব্যবস্থা করেছে।বেডের উপর ল্যাপটপ রেখে সোফায় বসে আছে।পাশেই ছোট ছোট তিনটা প্লেটে ভ্যানিলা আইসক্রিম।
আমাকে দেখেই আপু চেঁচিয়ে উঠলেন,
” এই তোকে কখন পাঠিয়েছি। এত দেরি করলি কেনো।তোদের জন্য বসে থাকতে থাকতে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি।ওই মহারাজ কোথায়?”
হায় হায়! আমি তো ভাইয়াকে আসল কথা না বলেই চলে এসেছি।দ্বিতীয়বার উনার রুমে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।তখন রাগের চোটে কি কি বলে এসেছি সব ভুলে গেছি।
” আসলে…আপু..”
” আচ্ছা থাক।ভাইয়ার যখন মন চাইবে তখন আসবে।এখন আয় আমরা মুভি দেখি।”
আপু আর আমি বেডের উপর পা তুলে বসলাম।দুইজনের মাঝখানে ল্যাপটপ।
” আপু এটা কি ধরনের ছবি?”
” জানি না।আগে দেখিনি।নতুন রিলিজ হয়েছে বোধ হয়।”
তখনই তুষার ভাইয়ার আগমন।এসেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।এমন ভং ধরছে মনে হয় যেন কিলো কিলো ওজনের আলুর বস্তা উনি বহন করে তারপর এখানে এসেছে।আমি একপলক তাকিয়ে আবার ছবি দেখায় মনযোগ দিলাম।
” আমাদের বাসায় একটা চোর এসেছে রে তুষ্টি।চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। ”
তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আপু আর আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।উনি একই ভঙ্গিমায় বসে আছেন।ঠোঁটে ঝুলছে গা জ্বালানো হাসি।
” চোর কোথায় ভাইয়া।কি বলছো এসব?ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছো নাকি?”
” এই যে তোর সাথে বসে আছে।এর চেয়ে বড় চোর দুনিয়াতে দুটো খুঁজে পাবি না।”
চোখের কোনা দিয়ে ভাইয়ার দিকে চেয়ে আছি।কি আবোলতাবোল বলছেন উনি।ইচ্ছে করে পা’য়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে এটা ভালোই বুঝতে পারছি।এই লোকের যন্ত্রণায় শান্তি নেই আমার।
চোখ গরম করে বললাম,
” কি চুরি করেছি আমি যে আমাকে চোর বলছেন?”
” তুই তো আমার সবচেয়ে বড় জিনিসটা চুরি করেছিস নীল।”
” প্রমাণ দেখান।শুধু শুধু আমার নামে আজেবাজে কথা বলবেন না তুষার ভাইয়া।”
আমার কথা শুনে ভাইয়া কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ বুকের বাম পাশে হাত রেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।
আমি কিছু বলতে নিব তখনই তুলি আপুর ঝাঁজালো কন্ঠ শোনা গেল।
” এই তোরা দুইজন থামবি?নীলাশা শোন! ভাইয়া তোর সাথে মজা করছে।তুই সিরিয়াস হোস না।আর এই যে আমার গুণধর ভাই।তুমি একটু চুপ থাকো।তোমার অর্থহীন ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে একটুও ভালো লাগছে না।যাও গিয়ে নিজের ঘরে ঘুমাও।”
” ভ্যাজর ভ্যাজর আবার কেমন শব্দ? মেডিকেল পড়ে শুধু দা-বটি,ছুড়ি-কাঁচি চালানো শিখছিস।শব্দভান্ডার একটু উন্নত কর।নাহলে তোর এই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনে রোগী তোর কাছে আসতে চাইবে না।রোগী না আসলে তোর মেডিকেল পড়ে ডাক্তার হয়ে লাভ কি?শুধু শুধু আমার বাবা’র টাকা নষ্ট করা।এরচেয়ে ভালো বিয়ে করে সংসার কর।যা যা।”
” কি বললে তুমি ভাইয়া?এই নীলাশা শুনলি তুই !এই ভাই নামক জন্তুটা আমায় কি বলল।তুই সাক্ষী থাক।আমি কাল আম্মুকে বিচার না দিয়েছি তাহলে আমার নাম তুষ্টি নয়।তুষ্টি নাম বদলে আমি তুষ্ট রেখে দেব।”
তুষার ভাইয়া আর তুষ্টি আপুর তর্ক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।হে আল্লাহ! আমার মত নিরীহ প্রাণীটার উপর একটু দয়া করো।ওদের চেঁচামেচিতে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। তুষার ভাইয়ার আজকে কি হয়েছে কে জানে।সবার সাথে ইচ্ছে করেই ঝগড়া লাগতে চাইছে।
চলবে….
#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৬
রেডি হয়ে চারতলার গলির এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিচ্ছি। পাঁচটার দিকে আমার ম্যাথ প্রাইভেট।এখন সাড়ে চারটা বাজছে।তুষার ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।পরে যদি প্রাইভেটে পৌঁছাতে লেট হয় তাহলে স্যারের সুমিষ্ট বকাগুলো আমায় গিলতে হবে।বিকেলের প্রাইভেটে তুষার ভাইয়া আমাকে দিয়ে আসে আবার নিয়েও আসে।বেশি দূরে নয়।এই এলাকার শেষ মাথায় ম্যাথ স্যারের বাসা।আমি মা’কে বলেছিলাম এত অল্প রাস্তা আমি একাই আসা যাওয়া করতে পারব।এই কথাটার বিনিময়ে মা আমায় চোখ মুখ পাকিয়ে এক রামধমক দিলেন।তার কারণ মা’য়ের দু চোখের মনি ফারদিন তুষার ঘোষণা দিয়েছে উনি আমায় প্রতিদিন আনা নেওয়া করবেন।মা ও চোখ বন্ধ করে সেই ঘোষণা শিরোধার্য করে নিয়েছে।
মাঝেমধ্যে মাথাটা হাই ভোল্টেজে গরম যায় আমার।মানে আমি কি ক্লাস ওয়ান টু’তে পড়ুয়া বাচ্চা যে বড়দের হাত ধরে বাইরে যেতে হবে?আমার এই বক্তব্য শ্রবণ করার ন্যূনতম সময়টুকু কারো নেই।
শেষবারের মত হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে লিফটের কাছে চলে গেলাম।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে উনাকে বাসা থেকে ডেকে আনাই উত্তম। একা একা চলে গেলেও বিপদ।তুষার ভাইয়ার জ্বলন্ত চোখের সামনাসামনি হওয়ার সাহস নেই আমার।
লিফটের বাটন চাপার কিছুক্ষণ পরই লিফট হাজির।দরজা খুলতেই ঢুকতে যাব এমন সময় আবার থেমে গেলাম।
ভেতরে তুষার ভাইয়া এবং সাদনান ভাইয়া।সাদনান ভাইয়াকে চিনি আমি।উনি এই বিল্ডিংয়েই থাকেন।তুষার ভাইয়া এবং উনি সেইম এইজের।একই বিল্ডিংয়ে থাকার কারণে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে।
আমি সন্তর্পনে ভেতরে এক সাইডে দাঁড়িয়ে গেলাম।হঠাৎ সাদনান ভাইয়া বলে উঠলেন,
” তুমি তো নীলাশা, রাইট? তুষারের মামাতো বোন। ”
আমি আড়চোখে একবার তুষার ভাইয়াকে দেখে নিলাম।উনি ভাবলেশহীন চেহারায় সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছোট করে উত্তর দিলাম,
” জ্বি ভাইয়া।”
সাদনান ভাইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন,
” ইন্টারে পড়ছো এবার?পরীক্ষা তো আর কয়েকমাস আছে।ভালো করে পড়ো।এ প্লাস কিন্তু পেতে হবে।”
মনে মনে মুখ ভেংচি দিলাম।সবার শুধু এক কথা।এ প্লাস পেতে হবে, এ প্লাস পেতেই হবে।তাজ্জবের কারবার। এ প্লাস পেতেই হবে কেনো?সবাই যদি এ প্লাস পেয়ে বসে থাকে তাহলে বাকি যে গ্রেড গুলো আছে ওগুলো কাঁদের জন্য?
আমি মৃদু হেসে মুখস্থ করা বাক্যটা প্রকাশ করলাম।
” জ্বি ভাইয়া।দোয়া করবেন।”
কিন্তু পরক্ষণেই তুষার ভাইয়ার দিকে তাকাতে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।উনি এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেন নি।প্রতিক্রিয়া শূন্য চেহারায় এখনো চুপচাপ। এসব তো ভাল লক্ষণ নয়।আবার কি কারণে রেগে আছে কে জানে।
লিফট থেকে বেরোতেই সাদনান ভাইয়া আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু তুষার ভাইয়া তাঁকে থামিয়ে অন্য দিকে টেনে নিয়ে গেলেন।চোখ দিয়ে ইশারা করলেন আমি যেন গেইটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।
আমি আগে আগে হাঁটছি আর আমার পেছনে তুষার ভাই। রাস্তার আশেপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে।ওদের বেশিরভাগকেই আমি চিনি।ওঁরা এই এলাকাতেই থাকে।প্রতিদিন প্রাইভেটে যাওয়ার সময় বাচ্চা গুলোর ছুটাছুটি দেখা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।ওদের দস্যিপনা দেখলে চট করে একটা লাইন মাথায় আসে। আহা! শৈশব কত মধুর!নেই কোনো পড়ালেখার কঠিন বেড়াজাল, নেই কোনো কড়া শাসন।অফুরন্ত ভুল করলেও তাঁদের কেউ কিছু বলবে না।তিরস্কার করবে না।কারণ তাঁরা বাচ্চা।
” তুই রেড কালারের ড্রেস কেনো পড়েছিস নীল?”
তুষার ভাইয়ার শক্ত কন্ঠের আওয়াজ পেতেই আমার চিন্তা ভাবনার ঝুলি বন্ধ করলাম।
নিজের দিকে তাকাতেই দেখি লাল কালো’র সংমিশ্রণের থ্রি-পিস আমার গায়ে।সামনে যে জামাটা পেয়েছি সেটাই পরে চলে এসেছি।আমার নিজেরই তো ভালভাবে খেয়াল নেই কি রঙের ড্রেস পড়েছি আজ।উনার কথায় বুঝতে পারলাম আসলেই লাল ড্রেস আমার গায়ে।কিন্তু লাল ড্রেস পড়লে সমস্যা কোথায়?
চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন ছুড়লাম,
” এখন কি আপনার থেকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে যে কোন কালারের ড্রেসটা আমি পড়ব?”
উনি দু পা সামনে এসে বললেন,
” হ্যাঁ জিজ্ঞেস করতে হবে।তুই লাল ড্রেস পড়ে ঘুরাঘুরি করবি আর দূর থেকে সবার নজর তোর উপরই পড়বে।তোর মতলব আমি ভালোই বুঝি।তোর এই সুন্দর মুখশ্রী সকলের সামনের তুলে ধরার জন্যই এই প্ল্যান তাই না?কিন্তু তুই কি জানিস তোর চেহারা বাংলা ছায়াছবির রিনা খানের মত?নিজেকে সুন্দরী প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা কেনো করিস?”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।তুষার ভাই এসব কি ছেলেমানুষী কথা বলছে।আর কি আমি রিনা খানের মত দেখতে?আমার সময় কি এতই খারাপ চলছে যে শেষমেষ উনি আমায় এই উপাধি দিলেন!
রাগের চোটে মাথাটা চিড়বিড় করে উঠল।চোখ গরম করে বললাম,
” মানুষের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে ওঁরা রাস্তাঘাটে খুঁজে বেড়াবে কে লাল জামা পড়েছে।আর আমি রিনা খানের মত দেখতে হলে আপনার তাতে কি!আপনার তো কিছু যায় আসে না।”
” যায় আসে।আমারই তো সব।শোন এত বকরবকর না করে মূল কথাটা ব্রেইনে ঢুকিয়ে নে।লাল জামা পড়ে আর বাসা থেকে বের হবি না।”
আমি বিরক্তমুখে সামনের দিকে দৃষ্টি দিলাম।মন চাইছে একটা ঘুষি মেরে উনার নাসিকা ফাটিয়ে দেই।আমার ব্যাপারে এত খবরদারী করতে কে নির্দেশ দিয়েছে?
” আপনি তো দেখি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে করতে আমাকে একদম পিষে ফেলছেন।”
” পিষে ফেলব।নিজের অস্তিত্বের সাথে পিষে ফেলব তোকে।”
ফিসফিসিয়ে কথাটা বলেই উনি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।আমিও কিছুই বুঝতে পারলাম না।মাঝেমধ্যে উনি এরকম উদ্ভট কথাবার্তা কেনো বলেন!
আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর স্যারের বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম।গেইটের এক পাশে পূজা দাঁড়িয়ে আছে।এই মেয়ের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।প্রতিদিন একই কাহিনী।কিভাবে পারে এত ন্যাকামো করতে!তুষার ভাইয়াকে দেখলেই ওর লজ্জারাঙা চেহারা নজরে পড়ে।সে পুরো দিওয়ানা হয়ে আছে ভাইয়ার জন্য।
গেইটের কাছে আসতেই ভাইয়া বলল,
” ছুটি হলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি।দুনিয়া উল্টে গেলেও এক পা অন্যদিকে দিবি না।আমি সময়মত চলে আসব।”
আমি ঠোঁটে হাসি চেপে বলে উঠলাম,
” দুনিয়া উল্টে গেলে তো আমিও উল্টে যাব ভাইয়া।তখন এখানে চুম্বকের মত সেঁটে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
তুষার ভাইয়া চোখ পাকিয়ে ডানের রাস্তায় মোড় নিলেন।পাশে তাকিয়ে দেখি পূজা’র উজ্জ্বল দৃষ্টি ভাইয়ার যাওয়ার পানে নিবদ্ধ। ঠোঁটে প্রানবন্ত হাসি।ওর মাথায় বড়সড় একটা চাটি মেরে বললাম,
” হয়েছে? চল এবার ভেতরে যাই।”
পূজা হড়বড় করে বলতে লাগল,
” দোস্ত, তোর এই ভাইকে দেখলে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারি না।প্রতিদিন একপলক দেখার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকি।কিছুক্ষণ আগে তোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো সেটা দেখেই আমি ফিদা। ”
” আহারে কি প্রেম তোর মনে! ডেইলি এভাবে সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে ডিরেক্ট অ্যাকশনে নেমে পড়লেই তো পারিস।প্রপোজ করে দে।”
কাঁদোকাঁদো মুখ করে পূজা বলল,
” আমি যদি মুসলিম হতাম তাহলে কবেই তুষার ভাইয়াকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম।আর উনি এত নিরামিষ কেনো বলতো!প্রত্যেকটা দিন আমি মাছের চোখের মত উনার দিকে তাকিয়ে থাকি আর উনি একপলক ফিরেও দেখে না।কত কষ্ট করে সাজুগুজু করে আসি জানিস?”
” তোর জন্য অনেক সমবেদনা রইল।ভাইয়ার প্রেমিকা আছে।তাই তুই বিশ্ব সুন্দরীর রূপ নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও উনি চোখ তুলে দেখবে না।বুঝেছিস? চল এবার।”
‘
‘
‘
ছুটির পর ভাইয়ার সাথে হাঁটছি।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।রাস্তায় তেমন একটা লোকজন দেখা যাচ্ছে না।দুই পাশের উঁচু বিল্ডিং গুলো মিনারের মত দাঁড়িয়ে আছে।তুষার ভাইয়া নিঃশব্দে হাঁটছেন।চোখের চাহনিতে উদাস দৃষ্টি।উনার কি মন খারাপ নাকি!অন্যসময় হলে তো কিছু না কিছু বলে আমাকে রাগানোর চেষ্টা করতেন।উনার চুপচাপ থাকাটা আমার ভালো লাগছে না।কেনো জানি মনে হচ্ছে উনি উনার আগের ক্যারেক্টারেই ফিরে যাক।আবার আমাকে বিরক্ত করুক।বিরক্ত করে নিজেই হেসে উঠুক আর আমি চেহারায় রাগী ভাব আনার অভিনয় করে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসব।
হঠাৎ তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,
” দীঘির পাড়ে যাবি নীল?”
আমি কৌতূহল চোখে উনার দিকে তাকালাম।এতদিন ধরে উনার সাথে আসা যাওয়া করি কখনো তো দীঘির পাড়ে যাওয়ার কথা শুনিনি।উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে গেলাম।বেচারার মন খারাপ।হয়তোবা মন ভালো করার চেষ্টায় যেতে চাইছেন।
পাঁচ মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম দীঘির পাড়।এই এলাকার ভেতরেই দীঘি।জায়গাটা এমনিতে খুব ভালো লাগে আমার।চারদিকে রাস্তা মাঝখানে টলমলে পানি।লাইটের আলোয় পানিতে একধরনের বিচ্ছুরণ তৈরি হচ্ছে। দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
তুষার ভাইয়ার পিছু পিছু আমি গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম।উনি দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে দিলেন।তাই আমি কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এলাম যাতে উনার বাহুতে আমার শরীরের স্পর্শ না লাগে।
অনেকক্ষণ থেকে ভাইয়া চুপ করে আছেন।তাই ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কি মন খারাপ ভাইয়া?”
উনি যন্ত্রের মত উত্তর দিলেন,
” কিছুটা।”
আমি চুপ মেরে গেলাম।কারো মন খারাপ থাকলে কি করে তাঁর মন ভালো করতে হয় তা আমার জানা নেই।তারউপর ভাইয়া আমার থেকে বয়সে কত বড়।সমবয়সী হলে একটা কথা ছিল।কিছু না কিছু বলে হাসানোর চেষ্টা করতাম।কিন্তু উনার সাথে এমন কিছু করলে সেটা বড্ড বেমানান লাগবে।
হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একজন লোক বাদাম বিক্রি করছে।
আর কিছু চিন্তা না করেই বলে উঠলাম,
” ভাইয়া বাদাম খাব।এনে দিন না।অনেকদিন থেকে খাই না।দশ টাকার কিনবেন।অর্ধেকের বেশিগুলো আমি খাব।যেহেতু বাদাম আমার পছন্দের। আর আপনি অল্প খাবেন।আমার থেকে ভাগ বসাতে পারবেন না কিন্তু। ”
তুষার ভাইয়া ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই হেসে উঠলেন।আমার গাল টেনে বললেন,
” এত কিউট কেনো তুই?”
উনি উঠে চলেে গেলেন বাদাম কিনতে।জানি না কেনো আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।
চলবে….
#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৭
তুষার ভাইয়া এবং আমি দীঘির পাড়ে বেঞ্চিতে বসে আছি।দুজনের মধ্য অনেকটা দূরত্ব। আমার হাতে বাদামের প্যাকেট।
প্রায় আধাঘন্টার মত হলো এখানে বসে আছি।বেশ ভালোই লাগছে।চারদিকে আলো আঁধারের খেলা।আকাশে গুটিকয়েক তারা উঁকি মারছে।সাথে আছে মৃদুমন্দ বাতাস।এত চমৎকার একটা সময়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা যায় নাকি।কিন্তু তুষার ভাইয়ার মুখে সেই কখন থেকে কথা নেই।আমার তো সন্দেহ হচ্ছে উনি বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কিছুটা নড়েচড়ে বসতেই তুষার ভাই বলে উঠলেন,
” আচ্ছা নীল! তোকে যে মাঝেমধ্যে এত ধমকাই, কখনো কখনো রুড বিহেভ করি তোর খুব কষ্ট হয় তাই না?”
উনার কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।কি জবাব দেওয়া যায়?রুড বিহেভ করলে কিছুটা কষ্ট তো লাগেই।তবে সেটা সাময়িক।এসব আমি কিছুক্ষণ পরই ভুলে যাই।বরাবরই আমি এমন।
উত্তর দিতে যাব তখনই উনি আবার বললেন,
” সাদনান কে দেখলে এড়িয়ে যাবি।ও কথা বলতে চাইলেও পাশ কাটিয়ে চলে আসবি।বুঝা গেল?”
” হঠাৎ সাদনান ভাই কোথা থেকে আসলো?”
” যেখান থেকেই আসুক।তোকে যেটা বললাম সেটা মাথায় ঢুকিয়ে নে।”
উনার রাগ মিশ্রিত ধমক শুনে চুপসে গেলাম।এখন বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো।একে তো উনার মন ভালো নেই তার উপর বেশি প্রশ্ন করতে গেলে যদি ঠাটিয়ে চড় মেরে দেয়!
” ঠিক আছে।আপনার কথা মাথায় রাখব।কিন্তু এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকবেন?বাসায় গেলে তো মা আমায় বকতে বকতে ফালা ফালা করে দেবে।”
তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
” আমি বুঝিয়ে বলব মামীকে।টেনশন করিস না।চল।”
ভাইয়ার মুখের হাসি দেখে আমিও হাসলাম।রাস্তার লাইটের আলোয় আর রাতের অন্ধকারে উনাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
উনি সামনে হাঁটছেন। আমি কিছুটা পিছনে।পেছনে থেকেই ভাইয়াকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।
উনি আমার থেকে বেশ লম্বা।চোখে চোখ রাখতে গেলে মাথা কিছুটা উপরে করে দিকে তাকাতে হয়।
বাতাসের কারণে উনার হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো উড়ছে।গায়ের নেভেব্লু টি-শার্টে খুব মানিয়েছে।হাতের ঘড়িটা…..
হঠাৎই থেমে গেলাম।আমি কেনো উনাকে এত সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছি?ছি ছি! কি লজ্জার ব্যাপার।ভাগ্যিস একজনের মনের কথা অন্যজন শুনতে পারে না।নাহলে তো আমার সব গোপনীয় চিন্তা ভাবনা এক্ষুনি ফাঁস হয়ে যেত।
চৌরাস্তা পেরিয়ে খোলা মাঠের কাছে আসতেই তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে পড়লেন।পেছনে ফিরে আমার ডান হাতটা উনার হাতের মুঠোয় নিয়ে আবার হাঁটা দিলেন।আমি তো পুরো বোকা বনে গেলাম।
উনি কখনো এভাবে হাত ধরে হাটেন নি।
তাই সোজা প্রশ্ন করে বসলাম,
” হাত ধরেছেন কেনো? আমি কি কোনো বাচ্চা যে হাতে ধরে হাঁটতে হবে? ”
তুষার ভাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
” তুই কি মনে করিস তুই বড় হয়ে গেছিস?মাত্রই তো ইন্টারে পড়ছিস।”
উনার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।ইন্টারে পড়ুয়া মেয়ে বাচ্চা হয় কিভাবে?এত বড় মানুষ টাকে উনার চোখে লাগে না নাকি।যত্তসব!
” শুনুন! আমি কোন ক্লাসে পড়ি বড় কথা নয়।বড় কথা হলো আমি আঠারোতে পদার্পণ করেছি কিনা।হিসাব মতে যেহেতু আমার আঠারো হয়ে গেছে সো আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। বুঝে শুনে কথা বলবেন আমার সাথে।”
” মারব ধরে এক চড়।এইটুকুন মেয়ে তাঁর সাথে আবার বুঝে শুনে কথা বলতে হবে।কি স্টাইল কথার! কলেজে গিয়ে এসবই শিখিস তাই না।বড়দের কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে আগে সেইটা আয়ত্ত কর তারপর ভাষণ দিতে আসিস।”
আমি মুখ কালো করে ফেললাম।উনি উনার ফুল ক্যারেক্টারে চলে এসেছেন।এখন মনে হচ্ছে উনি তখনের মত মন খারাপ করে বসে থাকলেই ভালো ছিল।যেই মন ভালো হল অমনি আমাকে পচানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আজকে বাসায় গিয়েই মায়ের সাথে একদফা যুদ্ধ করতে হবে।এখন থেকে প্রাইভেট, কলেজ সবজায়গায় আমি একা চলাচল করব।মা এবং তুষার ভাই এই দুজন মিলেই তো আমাকে বড় হতে দিচ্ছে না।যেখানেই যাই সেখানেই গার্ড দিয়ে রাখে।এমন পরাধীন জীবন মেনে নেওয়া যায় না।
________________________
বিছানার এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। একটু পর পর খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারছি।ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।আবহাওয়া ঠিক লাগছে না।যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড় হানা দিতে পারে।তখন আমার অবস্থাটা কি হবে!কেউ বাঁচাও আমায়।
ড্রয়িংরুম থেকে তুষার ভাইয়া এবং মা-বাবা’র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রুমে থেকে বুঝতে পারছি ওদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু আমি এবং আমার টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট।
গতকাল রেজাল্ট দিয়েছিল।আমার পয়েন্ট আসছে ৩.৯৫। এটা দেখেই সবার প্রথমে তুষার ভাইয়ার ভয়ানক রাগী চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।উনি যদি রেজাল্টের এই হাল দেখে তাহলে জায়গাতেই আমায় কতল করে দেবে।সাথে অপমানজনক কথা তো আছেই।আমি জানতাম রেজাল্ট বেশি সুবিধার আসবে না।কারণ পরীক্ষা গুলো তো একটাও ভালো হয় নি।
ভেবেছিলাম আরো কয়েকদিন যাক ধীরে সুস্থে বাবা’কে খবরটা জানাব।কিন্তু আমার প্ল্যানে কাঁদা ছিটিয়ে দিল তুষার ভাই।উনি কিভাবে যেন জানতে পেরে গেছে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে।তাই আজ সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় হামলা দিয়েছে।
রুমে ঢুকেই এমন জেরা শুরু করে দিল যে আমার পুরো দিশেহারা অবস্থা। শেষপর্যন্ত উনার চাপে পড়ে সেই নিম্নমানের পয়েন্টের খবরটা প্রকাশ করতে হলো।সাথে সাথে মাথা নিচু করে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছিলাম।এই বুঝি তুষার ভাইয়া থাপ্পড় মেরে গাল ফাটিয়ে দিলেন।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।উনি চুপচাপ উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।এরপর থেকেই বসার ঘরে মা বাবা এবং উনার কথার সুর ভেসে আসতে লাগল।আমি নিশ্চিত উনি সব বলে দিয়েছে তাঁদের।
আতঙ্কে অস্থির হয়ে একবার বিছানায় বসছি আবার রুমে পায়চারি করছি।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পরল।ড্রয়িংরুম থেকে মা জোর গলায় ডাকছেন।ঘূর্ণিঝড় তাহলে হানা দিয়ে দিল।
তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হলাম।নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি গায়ে উড়না নেই।দৌড়ে আবার রুমে গেলাম উড়না আনতে।আমার নিজেকে এখন পাবনা থেকে পালিয়ে আসা পাগল মনে হচ্ছে।
টলমলে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরে পৌঁছলাম।মা বাবা দুজনই গম্ভীর মুখে বসে আছেন।তুষার ভাইয়া আমার দিকে একপলক তাকিয়ে হাতে থাকা ফোনে মনযোগ দিলেন।নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী লাগছে। একটু পরই বিচার শুরু হবে আমার।
বাবা শান্তস্বরে বলতে লাগলেন,
” তুষার থেকে তোমার রেজাল্টের খবরটা শুনলাম নীলাশা। তোমার তো পয়েন্ট ভালো আসে নি।রেজাল্ট এত খারাপ আসার কারণ কি?”
আমি মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোরে খুঁচাচ্ছি। এসির নিচে থেকেও খুব গরম লাগছে।
বাবা’র প্রশ্নে মা তেতে উঠে বলল,
” তোমার মেয়ে বাসায় কি পড়ালেখা করে?সে তো টিভি দেখা নিয়ে ব্যস্ত।কি যেন এক কার্টুনের চ্যানেল আছে সারাক্ষণ সেখানে মটু পাতলু দেখবে।তাহলে রেজাল্ট ভালো আসবে কি করে।দেখো গিয়ে পরীক্ষার খাতায় মটু পাতলু’র ডায়লগ লিখে দিয়ে এসেছে।”
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। মা সবসময় একটু বেশি বেশি করে।বকবে ভালো কথা অন্য কিছু নিয়ে বকো।মটু পাতলু’র কথা তুষার ভাইয়ার সামনে না বললেই নয়?এমনিতেই উনি আমায় বাচ্চা বলে ক্ষেপায়।এখন তো আরো একটা ক্লু পেয়ে গেল।
বাবা চোখের ইশারায় মা’কে থামতে বলে আমাকে কাছে ডাকলেন।
” তোমার নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ঘাটতি আছে নীলাশা।হয়তো তুমি পড়ায় ভালোভাবে মনযোগ দিচ্ছো না আর নয়ত যেখানে প্রাইভেট পড়ছো সেখানে পড়াটা ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছো না।তোমার সমস্যা টা কোথায় সেটা তুমিই ভালো বুঝবে।ফাইনাল পরীক্ষা তো এসেই গেল।এখন একটু সিরিয়াস হওয়া দরকার না?আমার মনে হয় তোমাকে গাইড দেওয়ার জন্য বাসায় একজন শিক্ষক রাখলে ভালো হবে।সেটা নিয়েই এতক্ষণ তুষারের সাথে আলোচনা করছিলাম। তুষার বলল যে এখন ওদের অফিসে কাজের চাপ কিছুটা কম। তাই সে তোমাকে বাসায় কয়েকঘন্টা টাইম দিতে পারবে।তাহলে সমস্যা তো মিটেই যায়।তুষার তোমাকে বাসায় ইম্পর্টেন্ট বিষয়গুলো পড়াবে।আবার তুমি যদি বাইরে দুয়েকটা বিষয় পড়তে চাও তাহলে পড়তে পারো।কিন্তু বাসায় তুষারই তোমাকে গাইড দেবে।”
বাবা’র গুছিয়ে বলা কথাটা আমাকে এলোমেলো করে দিল।গত কয়েকমাসেও এত বড় শক পাইনি।যার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাই তাঁর কাছেই পড়ব।ওহ্ আল্লাহ! আমার সাথেই কেনো এমন হয়?এই অসহায় দুঃখী মেয়েটার উপর দয়া করো।
এখন তো বাবা’র কথার উপর দিয়েও কিছু বলতে পারব না।একে তো রেজাল্টের এই অবস্থা অন্যদিকে তুষার ভাই আমার সামনে বসে আছে।
উনি এখনো জানপ্রাণ দিয়ে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ফোন ছাড়া এই মুহূর্তে উনার সাথে কেউ নেই।কিন্তু আমি জানি উনি কান খাড়া প্রত্যকেটা কথা শুনছে।
বাবা কিছুটা জোরে বলে উঠল,
” কি বলেছি বুঝতে পেরেছো তো নীলাশা।তোমার রেজাল্ট দেখে কিন্তু আমরা সবাই বেশ হতাশ।তাহলে এবার দম নিয়ে পড়া শুরু করে দাও।কাল থেকেই তুষার তোমাকে পড়াতে আসবে।”
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম ‘ঠিক আছে’।রুমে যাওয়ার জন্য সামনে এগুতেই আবার পেছনে ফেরলাম।তুষার ভাইয়া হিংস্র বাঘের মত চেয়ে আছেন।আমি তাড়াতাড়ি ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম।উনার চাহনি দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছেন।আমাকে একা পেলে হয়তোবা ঠাসঠুস মেরে দিতেন।
কাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আমার প্যারাময় জীবন।উনার হাতের কত মার যে খাওয়া লাগবে কে জানে।ভাবলেই আমি টুরু ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি।
চলবে….
#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৮
পড়ার টেবিলে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি। সামনে অঙ্কে ভর্তি খাতায় এখানে সেখানে কাটাছেঁড়া। কয়েক জায়গায় লাল কালি দিয়ে গোল বৃত্ত আঁকা যেগুলো দেখতে ছোটখাটো আলুর মত লাগছে।
আমার মুখোমুখি টেবিলের অপর প্রান্তে বসে আছেন দ্যা গ্রেট তুষার ভাইয়া।উনার চোখে শান্ত দৃষ্টি। দেখতে শান্ত হলেও সেই চোখ দিয়ে অদৃশ্য গোলাবর্ষণ হচ্ছে। আর তাতে আমার শরীর জ্বলেপুড়ে ছারখার।
কিছুক্ষণ আগেই উনি আমায় দুটো ম্যাথ করতে দিয়েছিলেন।আর আমি একটা অঙ্কের চার-পাঁচ জায়গায় ভুল করে বসে আছি।
ঘুমের যন্ত্রণায় আমার খুব হাই উঠছে।কিন্তু তুষার ভাইয়া সামনে থাকার কারণে চেপে বসে থাকতে হচ্ছে।হাই চেপে রাখা যে এত কষ্টের তা জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলাম। সবই আমার ভাঙাচোরা কপালের দোষ!
আজ সকাল সাতটার দিকে এসেই তুষার ভাইয়া আমায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছেন।ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলাম মা ডাকছে।তাই খুব জোরেসোড়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,
” দয়া করে ঘুমুতে দাও আমায়।প্লিজ যাও এখান থেকে।”
তারপরেই সব চুপচাপ। কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলাম আমার হাতের আঙুলে গরম উত্তাপ লাগছে।ক্রমেই তা গভীরভাবে শিরায় শিরায় পৌঁছে যাচ্ছে।
আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।চোখ মেলতেই দেখি পাশের সোফায় তুষার ভাইয়া গরম কফির মগ হাতে বসে আছেন।
আঙুলের জ্বলুনি অনুভব হতেই আমার কাছে সব পরিষ্কার। উনিই তাহলে আমার আঙুল কফির মগে চুবিয়ে দিয়েছেন।কি নির্দয় লোক!আমাকে সুন্দর ভাবে ডাকলেই তো পারত। আজব প্রাণীতে দেশটা ভরে গেছে।চোখে মুখের বিরক্তি লুকিয়ে বই খাতা নিয়ে বসে গেলাম।আর তারপরেই তো এই অঘটন ঘটল।
দীর্ঘক্ষণ গোলাবর্ষণ শেষে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,
” তোর কি পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না?”
আমি চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিলাম।সত্যি কথা বলতে আমার তো পড়ায় মনই বসে না।বই খুলে বসলে কল্পনায় সাজানো হাজারো রূপকথায় ভেসে যাই আমি।তারপর একসময় প্রচুর ঘুম পায়।
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই উনি বললেন,
” তোর মত এমন গেছো বাঁদর আমি আর দুটো দেখিনি।মুখে হ্যাঁ বললেও মনে অন্যকিছু চলছে।তোকে কাল যাওয়ার সময় বলে গেছিলাম এই চাপ্টারের অঙ্কগুলো দেখে রাখবি।তুই কি তা করেছিস?”
দারুণ অস্বস্তিতে ডানে বামে তাকাতে লাগলাম।কাল তো ঘুমের যন্ত্রণায় আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম যার জন্য বই নিয়ে বসা হয় নি।রাতে ভাতও খাওয়া হয়নি।
” তোর কপালে দুঃখ আছে নীল!তুই ভাবিস না পড়া না পারলে তোকে ছেড়ে দিব।আমি যে কাজে হাত দিই তা সফল না হওয়া পর্যন্ত দম নেই না।তুই তো দেখি পড়ালেখায় গাধার থেকেও অধম।আমার টার্গেট তোকে গাধা থেকে মানুষ বানানো। এরজন্য যা করা লাগে করব।তোকে আগেভাগেই রেড এলার্ম দিয়ে রাখলাম কিন্তু। এই যে আমি এত গুলো কথা বললাম তুই এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করছিস তা আমি ভালোই বুঝতে পারছি।হোমাওয়ার্কও করিস নি।এমনটা যাতে আর কখনো না হয় তাই হাত পাত এখন।”
আমি চমকে উঠলাম।চেয়ে দেখি উনার মুখ রাগে থমথম করছে। হাতে কাঠের স্কেল।তার মানে ভাইয়া আমাকে এখন মারবেন!প্রথম দিন পড়াতে এসেই মারামারি! তাহলে বাকি দিনগুলোতে তো মাথায় তুলে আছাড় মারবেন।এ কেমন শিক্ষক উনি?হার্টলেস! হৃদয়হীন! অমানুষ!
শুকনো গলায় ঢোক গিলে বলতে চেষ্টা করলাম,
” ভা..ভাইয়া স..সরি।কাল থেকে…!”
” হাত পাত নীলাশা।”
উনার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি।ভাইয়া হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক রেগে গেছেন।এই মুহূর্তে কথার পিঠে কথা বলা মানেই বিপদ।
ধীরে ধীরে কম্পিত হাত টা সামনে বাড়িয়ে দিলাম।উনি সর্বশক্তি দিয়ে পরপর দুটো আঘাত করলেন।হাতটা জ্বলে গেলো আমার।শুধু রক্ত বের হওয়ার বাকি আছে।আর একটা বারি দিলে নিশ্চয়ই স্কেলটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে যেত।
হাতের যন্ত্রণায় চোখে প্রায় পানি এসে গেল। ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে পড়ল খাতার উপর।
কিন্তু আমার চোখের মুল্যবান পানি উনার মন টলাতে পারল না।আগের চেয়ে দ্বিগুন জোরে ধমক দিলেন।এবার তো কান্নার চোটে হিঁচকি উঠে গেল।
ভুল করা অঙ্কগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আবার করতে বললেন।ভাগ্যিস এবার আর ভুল হয় নি।নাহলে আরো মার খেতে হত।
আরো কিছুক্ষণ ম্যাথ করিয়ে তুষার ভাইয়া চলে গেলেন।
আমি অসহায় ভঙ্গিতে হাতটা দেখতে লাগলাম।ফর্সা হাতটা কেমন লাল হয় হয়ে আছে।নিষ্ঠুর লোকটার মনে দয়া মায়া নেই একফোঁটা। মনে মনে অভিশাপ দিলাম ঘুমের মধ্যে উনি যেন খাট থেকে ধুপ করে নিচে পড়ে যায়।এই অবলা মেয়েটার মনের বাসনা পূরণ করে দিও আল্লাহ।
‘
‘
‘
সন্ধ্যা হতেই বই নিয়ে বসে গেলাম।তুষার ভাইয়ার হোমওয়ার্ক গুলো একের পর এক শেষ করছি।নাহলে কাঠের স্কেলটা কাল আমার মাথায় ভাঙবেন।
দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন।চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়।কেসটা কি?মা’য়ের আবার কি হলো!
ফোঁড়ন কেটে বললাম,
” কি হলো মা?আজ কি আমার রূপ এক ছটাক বেড়ে গিয়েছে?না মানে তুমি যে এমন ভাবে তাকিয়ে আছো আমার দিকে।”
বিস্ময় কাটতেই মা বলে উঠল,
” থাম তো!সারাক্ষণ শুধু অর্থহীন কথাবার্তা। তোর রূপ বাড়বে কোনদিক দিয়ে বুঝা আমায়।তোর দিকে তাকালে আমার সর্বপ্রথম রাস্তার ধারের ওই পাগলি টার কথা মনে পড়ে।সবসময় বলি একটু পরিপাটি হয়ে থাক।কিন্তু তুই…আচ্ছা যাই হোক।আমি যে কারণে অবাক হয়েছি সেটা হলো তুই তো দেখি একদিনেই পড়ার প্রতি ভালোই মনযোগী হয়েছিস।প্রথমদিনেই এত উন্নতি।ইস!তুষারকে যদি আরো আগে থেকে পড়াতে বলতাম।ওই ছেলেই পারবে তোর মত ত্যাঁদড় মেয়েকে সোজা করতে।কাল তুষার আসলে অনুরোধ করে দেখব তোকে আরো একবেলা পড়াতে পারবে কিনা।তাহলে ফাইনাল পরীক্ষা আসতে আসতে প্রিপারেশন ভালোভাবে নিতে পারবি।এভাবে হা করে তাকিয়ে আছিস কেনো?নে পড়া শুরু কর। ”
মা চলে গেল।আমি তব্দা মেরে বসে রইলাম।গতকাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত একের পর এক ঝটকা খেয়েই চলেছি।একবেলা পড়তে গিয়েই তুষার ভাইয়ার হাতের মার খেলাম।তাহলে দুইবেলা পড়তে গেলে আমার অবস্থা কি হবে।
কিছুক্ষণ পর মা আবার রুমে আসল।
” যে জন্য এসেছিলাম সেটা বলতেই ভুলে গেছি।তোর ফুপি ফোন করে বলল ওঁদের বাসায় যেতে।যা দেখে আয় কি জন্য ডেকেছে।”
” এখন পারব না যেতে।প্লিজ মা।আমি এখন ম্যাথ করছি।”
মা এসে জোড় করে বই খাতা বন্ধ করে দিলেন।আমার গায়ে উড়না জড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” বড়দের কথা না শোনা খুবই খারাপ নীলাশা।জলদি গিয়ে শোনে এসো কি কারণে ডেকেছে।”
মুখ গোমড়া করে চলে গেলাম পাঁচ তলায়।সবাই আমাকে শাসন করে।মা করে,তুষার ভাই করে,বাবা মাঝেমধ্যে করে।কি পেয়েছে টা কি সবাই!আমার মতামত কেউ শুনে না।আমি পরাধীন। আমার আকাশে স্বাধীনতা নেই।হায়!
ডোরবেল বাজাতেই ফুপি দরজা খুলল।আমাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলল,
” এত দেরি লাগে আসতে?কখন ডেকেছি!চিকেন নুডুলস্ বানিয়েছি। খাবি আয়।”
আমি ড্রয়িংরুমে সূক্ষ্মভাবে নজর বুলিয়ে নিলাম।মনে মনে যার অনুপস্থিতি কামনা করছি সে নেই।যাক বাঁচা গেল।তুষ্টি আপু বোধ হয় নিজের রুমে পড়া নিয়ে ব্যস্ত।তাই ওখানে না যাওয়াই সঠিক কাজ।
ফুপি আমার হাতে নুডুলসের বাটি দিয়ে বলল,
“মন খারাপ করিস না নীল মনি।তুষার নাকি আজ মেরেছে তোকে?বেয়াদপ ছেলেটাকে ইচ্ছামত বকে দিয়েছি।এগুলো কোন অভ্যাস!এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলে কেউ?দাঁড়া না তোর ফুপা আসুক বাসায়।তখন দেখবি ওঁর খবর ছুটাব আমি।”
ফুপির কথা শুনছি আর গপাগপ নুডুলস মুখে ভরছি।ফুপি কি আর জানে তাঁর ছেলের চোখে আমি একটা নবজাতক শিশু ছাড়া কিছু নই।এজন্যই তো ঠাস ঠাস দিয়ে আমার সফট গাল ফাটিয়ে দেয়।
ফুপি কিচেনে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় তুষার ভাই হাজির।আমার সামনের সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন।
আমার নুডুলস খাওয়া মাঝপথেই আটকে গেল।উনি গভীর চোখে তাকিয়ে আছেন।খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার।
মুখের নুডুলসটা কোনোমতে গিলে বললাম,
” ভাইয়া…”
আমাকে থামিয়ে উনি বলে উঠলেন,
” তোর হাতে এক মিনিট সময়।খাবারটা শেষ করে আমার রুমে আয়।”
যেভাবে দমকা হাওয়ার মত এসেছিলেন সেভাবেই তিনি চলে গেলেন।সকালে মেরে টেরে ভর্তা বানিয়ে দিয়ে এখন রুমে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাচ্ছে কেনো!
ধুর এটা নিমন্ত্রণ হলো কোথায়?উনি তো আমাকে হুমকি দিয়ে গেলেন।হুমকির কথা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি নুডুলসের বাটি খালি করলাম।
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হাজির হলাম তুষার ভাইয়ার রুমের সামনে।দরজা নক করতেই উনি বললেন,
” আয়।”
ভেতটে ঢুকতেই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।উনি নিজের রুমকে সবসময় ভুতুরে বানিয়ে রাখে কেনো বুঝি না।সেদিন এসে দেখলাম অন্ধকার।আর আজকে বেডের কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো। আবছা আলোয় রুমটা ছেয়ে আছে।
” দাঁড়িয়ে না থেকে আমার কাছে এসে বোস।”
তুষার ভাইয়ার আওয়াজ পেতেই সাবধান হয়ে গেলাম।বেড থেকে কিছুটা দূরে একটা সোফায় উনি বসে মোবাইল ঘাটছেন।
আমি উনার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলাম।
ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন,
” তোর চুলগুলোকে সবসময় পাখির বাসা বানিয়ে রাখিস কেনো বলতো!এগুলো আঁচড়ানো যায় না?কোনোদিন দেখবি পাখি এসে ভুল করে তোর মাথায় ডিম পেড়ে চলে গেছে।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।উনি কি চুল প্রসঙ্গে কথা বলার জন্যই রুমে আসতে বলেছেন?চারতলা থেকে পাঁচতলায় আসতে হলে কি কেউ চুল আঁচড়িয়ে সেজেগুজে আসে?বাসায় যে অবস্থায় ছিলাম সেভাবেই তো চলে এসেছি।হঠাৎ উনি আমার চুল নিয়ে গবেষণা শুরু করল কেনো।উফ্! আমিই পাগল হয়ে গেছি নাকি আমার চারপাশের মানুষ গুলো পাগল?এটা নিয়ে আমি কনফিউজড।
গলায় বিনয়ী ভাব এনে জিজ্ঞেস করলাম,
” ভাইয়া..শুধু এজন্যই ডেকেছেন?”
উনি ফোন রেখে এবার মুখোমুখি সোজা হয়ে বসলেন।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার ডান হাতটা টেনে সামনে আনলেন।আমি রোবটের মত বসে ভাইয়ার কীর্তি- কলাপ দেখে যাচ্ছি।
হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে তুষার ভাইয়া আমার হাতের তালুতে পরপর চারটে চুমো খেলেন।
চরম বিস্ময়ে আমার মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল।
আবুলের মত তাকিয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
” এটা কি করলেন ভাইয়া?”
উনি আামর হাত উল্টে পাল্টে কি যেন দেখছেন।হাতের তালুতে খুব আলতো করে স্পর্শ করে যাচ্ছেন।
তুষার ভাইয়া কি পাগল হয়ে গেল নাকি।আমার হাতে কি কোনো গুপ্তধন লুকানো আছে?নাকি উনি ইদানীং জ্যোতিষিবিদ্যা আয়ত্ত করছেন?আর সেটা আমার উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
” তোকে সকালে এই হাতেই মেরেছিলাম না?তাই চেক করছি হাতে কোনো জখম হয়েছে কিনা। নাহলে তো পড়ে আবার বলবি তুষার ভাইয়া মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দিল।এখন দেখছি হাতে কিছু হয়নি।তাই তোরও আমার নামে বদনাম রটানোর কোনো চান্স নেই।”
” কিন্তু ভাইয়া একটু আগেই যেটা করলেন….”
উনি মুচকি হেসে বললেন,
” বাচ্চাদের মারলে আদর করতে হয়।তাই তোকে আদর করে দিলাম।স্কেল দিয়ে দুইবার আঘাত করেছি না?তাই এর ডাবল আদর করে দিলাম।”
তুষার ভাইয়ার মুখে বাচ্চা শব্দটা শুনতেই আমার দুই ভ্রু বিরক্ততে কুঁচকে গেল।রাগে মাথা দপদপ করছে।সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে উনার দিকে আঙুল তুলে বলতে লাগলাম,
” আপনার আজাইরা আদরের আমার কোনো দরকার নেই। শুনে রাখুন! আমি বাচ্চা না।আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি।আর কখনো যদি আমাকে বাচ্চা বলেছেন তো..”
” এই ফাজিল মেয়ে! তোর সাহস তো কম না।আমার দিকে আঙুল তুলে কথা বলছিস?দেই এখন আঙুল টা মট করে ভেঙে?
তুষার ভাইয়ার ধমক শুনতেই চুপসে গেলাম।আঙুল তুলে কথা বলা একদম ঠিক হয় নি।উনি আমার বড়।এটা একধরনের অভদ্রতা হয়ে গেল।মায়ের কানে এই খবর পৌঁছালে আমায় চুলের গোছা ধরে টান মারবে।
” সরি.. ভাইয়া!”
তুষার ভাইয়া আবারো ধমকে উঠে বললেন,
” কাল যদি সবগুলো পড়া ঠিকমত না পাই তাহলেই না বুঝবি কত ধানে কত চাল। সারাদিন বসে বসে মটু পাতলু দেখিস তাই না?পড়ায় যদি কোনো ফাঁকি দিস তাহলে তোকে আমি পিটিয়ে পিটিয়ে একবার মটু বানাব। এরপর মটু থেকে আবার পাতলু বানাব।রূপান্তর প্রক্রিয়া এভাবে চলতেই থাকবে।যা বাসায় গিয়ে পড়তে বস এখন।”
কোনো দিকে না তাকিয়ে একদৌড়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম।বুকটা এখনো ধড়ফড় করছে।কি ডেঞ্জারাস লোক! কবে যে উনার হাত থেকে মুক্তি পাব আমি।কষ্টে আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
চলবে….