মন_গহীনে পর্ব_২/৩/৪

মন_গহীনে পর্ব_২
#সামান্তা_সিমি

সকালে ঘুমের ঘোরে অনুভব করছি আমার মুখে ভেজা ভেজা কিছু গড়িয়ে পরছে। হাত দিয়ে ভেজা গালটা মুছে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলাম।কিন্তু এবার আরো জোর গতিতে পরতে লাগল যেন আমি খোলা ছাদের উপর শুয়ে আছি আর বৃষ্টির ফোঁটা টপাটপ আমার মুখে পতিত হচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।গালে হাত দিয়ে দেখি পানি।গায়ের টি-শার্ট টাও অনেকটা ভিজে আছে।

” কিরে নীল! তুই কি আশেপাশের সবাইকে চাকর ভাবিস নাকি যে সকাল বেলা তাঁরা অন্য কাজ বাদ দিয়ে তোকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য বসে থাকবে?”

তুষার ভাইয়ার আওয়াজ শুনতেই চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল।চোখ কচলে দেখি তুষার ভাইয়া বোতল থেকে পানি নিয়ে আমার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। মুহুর্তেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

” এসব কি তুষার ভাইয়া! সাত সকালে কি শুরু করেছেন এগুলো?”

” চড় মেরে গাল ফাটিয়ে দেব।ঘড়ির দিকে তাকা।”

ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি সাড়ে আটটা বাজে।হায় হায়! সাড়ে নয়টার দিকে আমার একটা প্রাইভেট আছে।মাঝে মাঝে রাস্তায় জ্যাম থাকে তাই একটু আর্লি বেরিয়ে পরি।কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে অনেক লেট হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি কাঁথা বালিশ ছুড়ে ফেলে কাবার্ড থেকে জামা নিলাম।অন্যদিকে তুষার ভাইয়া চেঁচাচ্ছেন।

” আস্তে যা নীল! পড়ে গিয়ে যদি ব্যথা পাস তাহলে কিন্তু খবর আছে তোর।”
উনার কথা পাত্তা না দিয়ে আমি ওয়াশরুমের দিকে ছুটলাম।

রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি তুষার ভাইয়া বাবা’র সাথে কথা বলছেন।উনার গায়ে ফরমাল ড্রেস।এতক্ষণ তো খেয়ালই করিনি। অবশ্য প্রতিদিনই উনাকে এই পোশাকে দেখি।কারণ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় উনি আমায় প্রাইভেটে নামিয়ে দিয়ে যান।তারপর আমি কলেজ চলে যাই।
আর যাই হোক তুষার ভাইয়াকে সব পোশাকেই দারুণ লাগে।উনার সব জামা-কাপড় একদম হাইফাই লেভেলের।আর হবে না-ই বা কেনো।কোটিপতি বাবার হীরের টুকরো ছেলে তো।উনি দেখতেও খুব স্মার্ট।উনার হেয়ার কাটিং এবং গালের দাঁড়ির কাট টা আমার খুব ভালো লাগে।এই দুটি জিনিসের কারণে উনার সৌন্দর্য মনে হয় দ্বিগুণ উজ্জ্বল দেখায়।আমি মনে মনে প্রার্থনা করি আমারও যাতে এমন সুদর্শন একজন লাইফ পার্টনার হয়।তবে তুষার ভাইয়ার মত বদমেজাজি না হলেই চলে।প্রথম প্রথম তো আমিও তুষার ভাইয়ার উপর ক্রাশ খেয়ে বসেছিলাম।তবে এই ব্যাপারটা উনাকে ভুলেও বুঝতে দেই নি।
চোখের সামনে এত সুন্দর একজন লোক থাকলে ক্রাশ খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে উনার স্বভাবের কারণে তাঁর প্রতি আমার বিরক্তির শেষ নেই।অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর উপর থেকে আমার মন উঠে গেছে।এখন তো আমার ক্রাশ ইয়াসির ভাইয়া।তবে যতই ক্রাশ খাই প্রেম করার মত বাজে ইচ্ছা আমার নেই।হিহিহি।
সমস্ত জল্পনা কল্পনা বন্ধ করে আমি মা’য়ের কাছে গেলাম।মা কিচেনে পরোটা বেলতে ব্যস্ত।

” মা! তুমি আমাকে আরো আগে ডেকে দিলে কি হত?দেখলে তো আজ দেরি হয়ে গেল।তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও।”

আমার কথা শুনে মা পরোটা বেলা থামিয়ে দিলেন।কঠোর গলায় বলতে লাগলেন,

” যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর! তোকে ডাকতে ডাকতে সকাল বেলা আমার গলা শুকিয়ে যায় আর তুই বলিস আমি ডাকিনি! দাঁড়া আজ তোর বাবা’র থেকে তোকে বকা খাওয়াব।আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়ে রেখেছে একেবারে।”

মা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাত টেনে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।হায় হায়! কি থেকে কি হয়ে গেল।

” শুনেছো তোমার মেয়ের কথা?প্রতিদিন ওর থেকে আমার এই অপবাদ শোনা লাগে আমি নাকি ওঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি না।”

মা’য়ের উচ্চ স্বরের আওয়াজ শুনে বাবা এবং তুষার ভাইয়া দুজনেই কথা বন্ধ করে তাকালেন।
মা আবার বললেন,

” তুষার তুই তো আজ সামনে ছিলি।তুই বল কিছু!”

আমি একপলক তুষার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলাম।আমাকে বকা দেওয়ার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছে তাহলে ছাড়বে কেনো।

” মামী ওঁকে বিয়ে দিয়ে দাও!বিয়ের পর জামাইয়ের হাতের উত্তম-মাধ্যম খেয়ে দেখবে একেবারে লাইনে এসে গেছে।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে বাবা হাহা করে হেসে উঠলেন।মাও বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের দিকে গেল।

” বিয়ে ছাড়া আর কোনো গতি নেই এই মেয়ের।বিয়ে দিলেও তো আমার জ্বালা হবে।একটা ঘরোয়া কাজ এই মেয়ে করতে পারে না।ওঁকে নিয়ে যে আমার কত দুর্দশা সইতে হবে কে জানে।”

আমি তো একদম আবুল হয়ে গেছি।যে যেভাবে পারছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে আমায়।একটা অবলা বাচ্চার প্রতি ওঁরা কিভাবে এত কঠোর হতে পারে!

” তুই এভাবে পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজকে কি তোর প্রাইভেট না যাওয়ার ধান্ধা? এমন কোনো প্ল্যান থাকলে সেটা ভুলে যা।জলদি নাস্তা কর।”

তুষার ভাইয়ার কাটা কাটা কথাগুলো বিষের মত লাগছে আমার।বাবার সামনেও এভাবে কথা বলছে আমার সাথে! অমানুষ ছেলে একটা! এত রুক্ষ মেজাজের ছেলেটা কি করে প্রেম করে কে জানে!কোন অভাগিনী উনার গার্লফ্রেন্ড তাঁকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

আমি নাস্তার প্লেট নিয়ে সোফায় বাবা’র পাশে এসে বসলাম।আমার খালি পরোটা খুব পছন্দের। সকালে আমি শুধু একটা পরোটাই খাই।
তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পরতেই দেখি তিনি একবার আমার দিকে একবার প্লেটের দিকে দেখছেন।কি ব্যপার!উনার পরোটা খেতে মন চাইছে কিনা কে জানে।

” পরোটা খাবেন তুষার ভাইয়া?”

উনি আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন।
” তুই শুধু একটা পরোটা খেয়ে দুপুর পর্যন্ত থাকবি নাকি?”

” ঠিক ধরেছেন।সকালে আমি অল্প করেই খাই।”

” তাতো খাবিই।ছুঁচোর মত মানুষ ছুঁচোর মতই তো খানা খাবি।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম হওয়ার মত অবস্থা। উনি আমাকে ছুঁচো বলল?আমার বাসায় এসে আমাদের সোফায় বসে আমাকেই সরাসরি ছুঁচো বলে দিলেন!
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

” বাবা দেখেছো তুষার ভাইয়া আমাকে ছুঁচো বলেছে।তুমি কিছু বলবা না?এই যে শুনুন।আমার পেটে যতখানি জায়গা ধরে আমি ততখানিই তো খাব নাকি।আমি তো আর আপনার মত হাতি না যে বেলায় বেলায় এত্ত এত্ত খাবার খাব!”

পাশ থেকে বাবা বললেন,
” একি মা! এসব কি বলছো?তুষার তোমার থেকে বয়সে বড়।এগুলো আর বলবে না।আর তুষার তো ভুল কিছু বলেনি।দুপুর পর্যন্ত এভাবে খালি পেটে থাকলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হবে।তোমাকে তো কত বলি।কিন্তু তুমি তো শোনার পাত্রী নও।”

চোখ পাকিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তিনি শান্ত চোখে আমাকে দেখছেন।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।সাথে কান্নাও আসছে।আমার ধারণা মা বাবা সবসময় উনাকে আমার থেকেও বেশি আদর করে।উনি হাজার দোষ করলেও তাঁরা স্বীকার করবে না।আমার সহজ সরল বাবা মা দুজনকে এই লোক বশ করে ফেলেছে।



রাস্তায় জ্যামের মধ্যে আটকা পড়ে আছি।ঢাকা শহরের জ্যাম যে কত বিরক্তিকর। আজ মনে হয় প্রাইভেটটা মিস যাবে।পাশে তাকিয়ে দেখি তুষার ভাইয়া একহাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অন্য হাতে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছেন।ইস যদি আমারও একটা মোবাইল থাকত!বাবা’কে কত রিকোয়েস্ট করেছিলাম।মা অবশ্য রাজি ছিল না।শেষমেষ কিন্তু বাবা’কে পটিয়ে ফেলেছিলাম।তারপরও কেনা হলো না।হবে কিভাবে! একটা বিরাট মাপের ভুত যদি ঘাড়ে চেপে বসে থাকে তাহলে কোনো প্ল্যান সাকসেসফুল হয় নাকি।
সেদিন মোবাইল কেনার জন্য ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তে দরজার সামনে তুষার ভাই হাজির।উনাকে দেখেই আমার মন কু ডাকছিল।
অবশেষে দেখি আমি যা সন্দেহ করেছি সেটাই ঠিক। আমার সামনেই তুষার ভাইয়া বাবা’কে সুন্দর সাবলীল ভাষায় মোবাইলের অপকারিতা সম্পর্কে একটা মস্ত বড় থিওরি দাঁড় করিয়ে দিলেন।
মোবাইল হাতে পেলে নাকি আমি গোল্লায় যাব।আমি নাকি পরীক্ষায় ফেল করে বসব।ব্যস্! বাবাও উনার কথা শুনে বেঁকে বসলেন।আর মোবাইল কেনা হলো না।অভিমানে-কষ্টে সেদিন ভাত পর্যন্ত খাই নি।তবুও বাবা’কে মানাতে পারিনি।মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমি তাঁদের মেয়েই না।ওই তুষার না ফুষার নামের বনমানুষটা তাঁদের সবকিছু।

” নে এটা শেষ কর তাড়াতাড়ি। ”

তুষার ভাইয়ার ডাকে হুঁশ ফিরল আমার।তাকিয়ে দেখি উনি একটা কেকের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

” এখন কেক খাব কেনো?আমি তো পরোটা খেয়ে এসেছি।”

” তুই যে পরোটা খেয়েছিস সেটা আমি সচক্ষে দেখেছি।বেশি কথা না বলে কেকটা খা।পেছনের সিটে পানির বোতল আছে।”

আমি বিরক্ত মুখে কেক টা নিলাম।উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি ডেইলি আমাকে জোর করে গাড়িতে কিছু না কিছু খাইয়ে ছাড়বেন।সকালে বেশি কিছু খেলে আমার কেমন কেমন যেন লাগে।কিন্তু এই লোক কি আর আমার কষ্ট বুঝবে!কিছু বলতে গেলেই কেকের সাথে একদফা ধমক খেতে হবে।

কেক শেষ করে পানির বোতল হাতে নিতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

” সেদিন কলেজের সামনে একটা ছেলে তোকে ডিস্টার্ব করেছিল তাই না’রে নীলাশা?”

আমি আঁতকে উঠলাম।তুষার ভাইয়া এই খবর কিভাবে পেল?
চোখের কোনা দিয়ে চেয়ে দেখি উনি এখনো মোবাইল টিপছেন।দুয়েকদিন আগে কলেজ ছুটির পর একটা ছেলে বারবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল।আমি ইগনোর করেছি।ছেলেটাকে দেখতে সুবিধার মনে হচ্ছিল না।কেমন গুন্ডা টাইপের।শুধু ওই একদিনই ছেলেটা’কে দেখেছি।এরপর আর কখনো ডিস্টার্ব করেনি।
কিন্তু এই কাহিনী তো আমি কাউকে বলিনি।এমনি কি মা’কেও নয়।তাহলে তুষার ভাইয়া পর্যন্ত খবরটা পৌঁছাল কি করে!

” কথা বলছিস না কেনো নীলাশা?”

তুষার ভাইয়ার মুখে নীলাশা ডাক শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।সবসময় উনি আমায় নীল বলেই ডাকে।যখন প্রচন্ড হাইপার হয়ে যায় তখনই শক্ত কন্ঠে নীলাশা বলে ডেকে উঠে। কিন্তু আমার উপর রাগ করার কারণ কি! ওই ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করেছে এতে আমার দোষ কোথায়?

” না ভাইয়া…মানে কথা বলার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি চোখ তুলেও তাকাইনি।শুধু ওই একদিনই দেখেছি ছেলেটাকে। এরপর তো আর কখনো সামনে আসে নি।”

” সামনে আসার মত অবস্থায় থাকলে তবে তো সামনে আসবে। ”

” কেনো ভাইয়া! ওই ছেলের কি হয়েছে?”

তুষার ভাইয়া চোখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন।মাঝে মাঝে উনাকে আমার প্রচন্ড ভয় লাগে।কারণ উনি এমনিতে বকা, ধমক,ঝারি দিলেও এত সহজে হাইপার হন না।খুব কম সময়ই উনাকে বাজে ভাবে রেগে উঠতে দেখা যায়।যেমন এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে।আমি কি এমন বলেছি যে এভাবে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছে!

” ওই ছেলের খবর জানার জন্য তো দেখি ছটফট করছিস! শোন নীলাশা! আমার সাথে কোনো ধরনের চালাকি করতে আসিস না।ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।তুই আসলে যেরকম ভোলা ভালা সেজে থাকিস আসলে তুই তেমন না।তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি।”

আমার চোখে প্রায় কান্না আসার উপক্রম। তুষার ভাইয়া’র মনে আমাকে নিয়ে এত খারাপ ধারণা! কি করেছি আমি? কথার প্রেক্ষিতে ওই ছেলেটা সম্পর্কে একটা সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি।আর এতেই আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল?আজকের পর থেকে আমি আর কখনো উনার গাড়ি দিয়ে প্রাইভেট -কলেজ কোথাও যাব না।আমি তো কোনোকালেই রাজি ছিলাম না।শুধু মা আর উনার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়েছিলাম।কিন্তু উনি আমাকে সেধে এনে এমন অপমান করবে জানলে উনার এই আজাইরা গাড়িতে পা ও রাখতাম না।
আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে কান্না কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।তখনই টের পেলাম জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। আজ আর প্রাইভেট পড়া হলো না।

কলেজের সামনে গাড়ি থামতেই আমি নেমে পড়লাম।উনার দিকে ফিরেও তাকাই নি।আমাকে যে খারাপ মেয়ে মনে করে তাঁর সাথে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।

চলবে……..

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৩

কলেজের সামনে গাড়ি থামতেই আমি নেমে পড়লাম।উনার দিকে ফিরেও তাকাই নি।আমাকে যে খারাপ মেয়ে মনে করে তাঁর সাথে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।
ভেতরে ঢুকব এমন সময় তুষার ভাইয়া ডেকে উঠলেন।

” নীল! ছুটির পর এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করিস।বাসায় পৌঁছে দেব আমি।”

কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলাম।



ক্লাস শেষ করে গেইট দিয়ে বের হচ্ছি।তুষার ভাইয়ার হোয়াইট কালারের গাড়িটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিন তো নিতে আসে না।তাহলে আজ এত আদিক্ষ্যেতা দেখানোর কারণ কি?আমি তো ঠিক করেছি আর কখনোই তুষার ভাইয়ার গাড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করব না।যাক ভালোই হয়েছে উনি এখনো এসে পৌঁছান নি।। আমি এখন নিজেই বাসায় ফিরে যাব।

চারদিকে আরো একবার নজর বুলিয়ে হাঁটা দিলাম।কিছুটা রাস্তা গিয়ে রিকশা নিয়ে নিব।আজকে গরমও পরেছে খুব বেশি।সূর্যের তাপে আধা সিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরতে হবে।ঠান্ডা কিছু খেতে পারল বেশ লাগত।কিন্তু এখন টাকা খরচ করা যাবে না।ইদানীং আমি খুব হিসেব করে চলি।আমার লক্ষ্য একটা দামি মোবাইল কেনা।কিনেই ছাড়ব আমি।হাতখরচের জন্য বাবা তো অনেক টাকাই দেয়।তবে আমি বেশি প্রয়োজন ছাড়া খরচ করি না।
রিকশাওয়ালা মামা’র সাথে ভাড়া ঠিক করছি তখনই একটা প্রাইভেট কার খুব স্পিডে আমার পাশে এসে থামল।আমি ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলাম।গাড়ি দেখেই বুঝে ফেলেছি এটা তুষার ভাইয়ার। দেখেও না দেখার ভান করে রিকশাওয়ালাকে বললাম,

” আমি রিকশায় উঠলে হুড টা তুলে দিবেন।আর একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেবেন।”

তখনই তুষার ভাইয়া নেমে আসলেন গাড়ি থেকে।দাঁত কটমট করে বলে উঠলেন,
” সাহস তো কম না তোর! আমার কথা অমান্য করিস?মেসেজে কি বলেছিলাম আমি?”

এহ্! কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।একশবার অমান্য করব আমি।উনি কেনো আমার উপর এত অধিকার খাটাতে আসে তা আজও বুঝলাম না।কিসের ভিত্তিতে এমন করে?সে তো আর আমার আপন ফুফাতো ভাই নয়।তাহলে?
সব হয়েছে মা বাবা’র জন্য। তাঁদের আশকারা পেয়েই তো উনি এত বাড় বেরেছে।আমাকে বাদ দিয়ে উনাকে এত আদর না করলেই হয়।এই নিয়ে আমি কিছু বলতে গেলে এক দফা বকা খেয়ে আসি।মা একটু বেশি করে।তুষার ভাইয়াকে যেন দুচোখে হারায়।হুহ্!

আমি দম নিয়ে বললাম,
” অন্যদিন তো ছুটির পর নিতে আসেন না।তাহলে আজ কেনো? এমনিতেও আমি আর আপনার গাড়িতে উঠতে চাই না।কোনোদিনও না।”

” রাস্তার মধ্যে সিনক্রিয়েট করিস না নীল।যা গাড়িতে গিয়ে বস।”

তুষার ভাইয়ার কথা আমি ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলাম।উনার গাড়ি দিয়ে যাব না আমি।ঠাডা পরুক ওই গাড়িতে।
রিকশায় উঠতে যাব ওমনি তুষার ভাইয়া আমার হাত চেপে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।

” আরে হাত ছাড়ুন! যাব না আপনার সাথে।আমি একাই যেতে পারব।”

আমার চিল্লানো একটাও গায়ে মাখলেন না তিনি।গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দরজা লক করে দিলেন।আজ আমি অসহায় বলে আমার উপর এত জুলুম,এত অবিচার।ঠিক আছে সময় আমারও আসবে।তখন দেখে নিব।
তুষার ভাইয়া গাড়িতে উঠতেই আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।গাড়ি চলতে লাগল।

কিছুদূর যেতেই ব্রেক কষলেন উনি।বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা লেকের পাড়ে গাড়ি থেমে আছে।বাসায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে আমায় কোথায় নিয়ে এল?
আমি কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।একটু পর নাকে একটা পরিচিত মিষ্টি গন্ধ আসতেই আমার চোখ আপনাআপনি তুষার ভাইয়ার দিকে ঘুরে গেল।উনি তিনটা কোন আইসক্রিম হাতে নিয়ে বসে আছেন। চোখে চোখ পরতেই বললেন,

” খাবি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম এগুলোতে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।সকালে কতগুলো কথা শুনিয়েছে আমায় আর এখন কত ঢং!উনার আইসক্রিম উনিই গিলুক। যদিও আইসক্রিমের ঘ্রাণটা সহ্য হচ্ছে না আমার।মন তো বলছে ছোঁ মেরে একটা নিয়ে নেই।কোণ আইসক্রিম আমার ফেভারিট।

” তুই না খেলে আমার জন্যই ভালো।যা গরম পরেছে আজ।এই তিন তিনটা আইসক্রিম এখন আমার পেটে যাবে।”

বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখি তিনি অলরেডি একটা আইসক্রিমে কামড় দিয়ে ফেলেছে।আমি জানি তো ইচ্ছে করেই এমন নাটক করছে।ও আল্লাহ! আইসক্রিমের স্মেলটা তরতর করে আমার নাকেই প্রবেশ করছে মনে হয়।উনার খাওয়া দেখে তো তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

” আহ্! এত সুস্বাদু আইসক্রিম আমি বোধ হয় আর কখনো খাই নি রে নীল!”

আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।তড়িৎ গতিতে উনার হাত থেকে তিনটা আইসক্রিম ছিনতাই করে নিলাম।আমাকে লোভ লাগানো হচ্ছে তাই না?এবার খালি হাতে বসে থাকুক।এগুলো তো এখন আমার পেটে হজম হবে।হুহ!

” এই তুই না বললি খাবি না! তাহলে আইসক্রিম গুলো নিলি কেনো?”

উনার বলা একটা বাক্যও গায়ে মাখলাম না।জানি হয়তোবা আমাকে খাদক মনে করছে।করলে করুক!

” তুই তো দেখি আস্ত একটা রাক্ষুসী।তিনটা আইসক্রিম একাই খাবি?”

ভালোই জ্বালায় পরলাম তো।নিজেই তো প্রথমে তিনটা সেধেছিল। আর এখন উল্টো দিকে মোড় নিচ্ছে!
আমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

” আপনি এটা থেকে একটু খেয়েছেন।নিন এটা।বাকি দুইটা আমি খাব।”

” না।এটা তুই খা।আমায় ওইটা দে।”

বলেই তুষার ভাইয়া আমার অর্ধেক খাওয়া আইসক্রিমটা নিয়ে নিলেন।বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার তো! যাই হোক! বাকিগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।উনি যদি নিজেরটা খাওয়ার পর আবার আরেকটা চেয়ে বসে থাকে তখন!
গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে।আমার সামনের ছোট চুলগুলো উড়ে এসে বারবার মুখের উপর লাগছে।যতবারই সরিয়ে দিচ্ছি ততবারই যেন ওরা অবাধ্যতা প্রকাশ করছে।
হঠাৎ তুষার ভাইয়ার স্পর্শ পেতেই থেমে গেলাম।উনি হাত দিয়ে এলো চুলগুলো সুন্দর করে কানের পিছনে গুঁজে দিলেন।
উনার দিকে তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,

” তখন যে বকেছিলাম রাগ করেছিস?”

আমি উসখুস করতে লাগলাম।আইসক্রিম খাওয়ার চক্করে রাগ অভিমান তো কখন ভুলে বসে আছি।কিন্তু তুষার ভাইয়াকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না।তাই যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললাম,

” রাগ করব না তো কি করব?আপনি না জেনে না শুনে কথা বলবেন আমি রাগ না করে আনন্দ পাব নাকি?”

” ইন ফিউচার ভুলভাল প্রশ্ন করলে এর চেয়েও ডাবল বকা খাবি।মনে থাকে যেন।”

আমি তো পুরাই টাস্কি খেয়ে গেলাম।কোথায় ভাবলাম রাগ করেছি বলে আমায় সরি বলবে।তা না করে আগের চেয়েও সুন্দর ভাবে ঝেড়ে দিলেন।উনি কখনো মানুষ হবেন না।আজীবন বনমানুষ হয়েই থাকবেন।অসহ্যকর লোক একটা!



বাসায় ঢুকেই দেখি ড্রয়িংরুমে সোফায় ফুপি আর মা বসে বসে গল্প করছেন।ফুপিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।বাইরের দিক থেকে তিনি খুব স্ট্রিক্ট মহিলা।নিজের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই কড়া শাসনে মানুষ করেছেন।যখন শাসনের দরকার তখন চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়েছেন।আবার মিষ্টি হাসি দিয়ে তার চেয়েও দ্বিগুণ পরিমানে ভালোবেসেছেন।এরজন্যই বোধ হয় ফুপির ছেলেমেয়ে দুটো এত শিক্ষিত হয়েছে।মাঝেমধ্যে ফুপি আমার সাথে এসব নিয়ে গল্প করে।ওখান থেকেই এগুলো জানতে পেরেছি।

দৌড়ে গিয়ে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
” আই মিসড্ ইউ সো মাচ ফুপি।একদিন তোমাকে না দেখলে আমার কেমন কেমন যেন লাগে।”

ফুপি হেসে বললেন,
” এই দূরে যা! তুই মাত্রই বাইরে থেকে আসলি।গায়ে অনেক ধুলো-বালি।জলদি গোসল করে আয়।”

” না ফুপি!এখন আমি কিছুক্ষণ এসির নিচে বসে থাকব।তারপর গোসল।”

ফুপি ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
” এগুলো ভাল অভ্যাস নয় নীলাশা! বাইরে থেকে এসে প্রথমেই নিজেকে ফ্রেশ করে নিতে হয়।আজ কিন্তু তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি।খেতে চাইলে তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়।আমি অপেক্ষা করছি তোর জন্য। ”

” সত্যি ফুপি? আজ তো দুপুরের লাঞ্চ একদম জমে যাবে। নো টেনশন।মাত্র দশ মিনিট।এরমধ্যেই তোমার বান্দা তোমার সামনে হাজির হয়ে যাবে।”

দৌড়ে চলে এলাম রুমে।এখান থেকেই শুনতে পাচ্ছি মা আর ফুপি আমার কথা শুনে হাসাহাসি করছে।
ফুপির হাতের মুরগির রোস্ট জাস্ট অসাধারণ! যতবারই খাই মন ভরে না যেন।তাই যেদিন ফুপি এই আইটেম টা রান্না করে সেদিনই ফুপি আমাকে তাঁদের বাসায় নিয়ে যায়।
চটপট গোসল সেরে ফুপির সাথে চলে গেলাম।



লাঞ্চ শেষে ফুপিদের ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি।বাসায় তুষার ভাইয়া, তুষ্টি আপু কেউই নেই।ভাইয়া না থাকলে আমি বাঁচি।কিন্তু তুষ্টি আপু বাসায় না থাকলে একটুও ভালো লাগে না।পরীক্ষার কারণে ইদানীং আপু একটু ব্যস্ত।
টিভি অফ করে উঠে দাঁড়ালাম।ফুপি নিজের রুমে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আমাকে বলেছিল ঘুমাতে কিন্তু দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই আমার।কি করে সময় কাটাব এখন? ফুপি জেগে থাকলে বাসায় চলে যেতাম। দরজা খোলা রেখে তো আর যাওয়া যাবে না।আমি এ রুম সে রুম ঘুরতে লাগলাম।ফুপিদের বাসাটা খুবই সুন্দর। সব জিনিস পরিপাটি করে সাজানো।

তুষার ভাইয়ার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটা জিনিস আমার মনযোগ কেড়ে নিল।ডেস্কটপ কম্পিউটারের পাশে একটা নীল ডায়রি।মূলত এটার কারণেই রুমে ঢুকতে বাধ্য হলাম।
হাতে নিয়ে আরও অবাক হয়ে গেলাম।কি সুন্দর ডায়রি!এটা ভাইয়ার রুমে ঠিক মানাচ্ছে না।কখনো তো শুনিনি উনি গল্প কবিতা লেখে।কি আছে এই ডায়েরির ভেতর?
কৌতুহল দমাতে না পেরে নীল কালার মলাট টা উল্টিয়ে দিলাম।

‘ তোমার খোলা চুলের মাদকতায়
ঝড় বয়ে যায় এই হৃদয়ে!
তোমার উজ্জ্বল চোখের চাহনি
এলোমেলো করে আমায়।’

ডায়রিতে লেখা এই চারটা লাইন পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।এগুলো তো তুষার ভাইয়ার হাতের লেখা।কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন লাইনগুলো?
আরে আমিও না ভুলে যাই ভাইয়ার তো প্রেমিকা আছে।সেই মেয়েকে ভেবেই লিখেছে হয়তো।বাহ্! তুষার ভাই তো দেখি সাচ্চা প্রেমিক হয়ে গেছে।

” তুই আমার রুমে কি করছিস?”

হঠাৎ ভাইয়ার আওয়াজ পেতেই ভয় পেয়ে গেলাম।হাত ফসকে ডায়রিটা নিচে পরে গেল।হায় হায়! নীলাশা তৈরি হও বকা খাওয়ার জন্য।উনি কখন আসলো আমি তো টেরই পেলাম না।সব দোষ এই নীল ডায়রিটার।

চলবে………..

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৪

ডায়রিটা ফ্লোর থেকে তুলে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালাম।তুষার ভাইয়ার এক হাতে ব্লেজার অন্য হাতে অফিসের ব্যাগ।সন্দেহজনক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
পিছন থেকে ডায়রিটা বের করে মেকি হেসে বললাম,

” কিছু করছি না ভাইয়া।শুধু এই ডায়রিটা একটু দেখছিলাম।”

” পারমিশন ছাড়া ডায়রিতে হাত দেওয়ার সাহস পেলি কিভাবে?”

এই যে শুরু হয়ে গেল।আমাকে যে কোন শয়তানে ধরেছিল উনার ডায়রি তে হাত দিতে গেছি।
” আচ্ছা সরি ভাইয়া।আমি সত্যি কথা বলে দিচ্ছি। আমি শুধু প্রথম পৃষ্ঠার ওই চারটা লাইন পড়েছি।তখনই আপনি এসে পরেছেন।”

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

” তাই? চারটা লাইন পড়ে তাহলে কি বুঝলি?”

” বুঝেছি এটাই যে এগুলো আপনার ভালোবাসার মানুষকে ডেডিকেট করে লেখা।ঠিক বলছি তো ভাইয়া!বলুন বলুন।লাইনগুলো কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে। আচ্ছা আপনি কবিতা লিখলেও তো পারেন।চারদিকে একদম সাড়া পরে যাবে।”

” বাহ্! দিনে দিনে তোর মাথার বুদ্ধি খুলছে তাহলে।আমি তো ভাবতাম তোর ওই ব্রেইনে হাঁস-মুরগি’র বিষ্ঠা ছাড়া আর কিছুই নেই।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে রাগে ব্রহ্মতালু গরম হয়ে উঠল।আমাকে অপমান করা ছাড়া উনি আর কিছুই পারেন না।আমি উনার এক বালতি প্রশংসা করলাম আর উনি! উনি আমায় এক ড্রাম পচানি দিলেন।সহ্য করা যায় এসব?নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিশ্চিত মধু মাখিয়ে কথা বলে।আর আমার সাথে কথা বলতে গেলে মনে হয় উনার মুখ দিয়ে বিষ উদগীরণ হতে থাকে।

তুষার ভাইয়া ব্লেজার রেখে ঘড়ি খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।এমন একটা ভাবভঙ্গি করছেন যেন রুমে অন্য কোনো প্রাণী নেই।

” আমি গেলাম তুষার ভাইয়া।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপমান সহ্য করতে আসিনি এখানে।”

” এই দাঁড়া! তোকে আমি যেতে বলেছি?”

দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে তাকালাম।আমাকে এখন উনার থেকে পারমিশন নিতে হবে নাকি।কি মনে করে নিজেকে?

” আপনি না বললে কি আমি যেতে পারি না?”

” না পারবি না।নিজে তো খেয়ে পেট পুরে বসে আছিস।আমি এখনো অভুক্ত। সেদিকে একটু খেয়াল দে।যা টেবিলে ভাত তরকারি সাজিয়ে রাখ।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

” মানে? আমি?”

” হ্যাঁ তুই।তোর সাথে বকবক করার এনার্জি নেই এখন।তাড়াতাড়ি যা করতে বললাম সেটা কর।”

তুষার ভাইয়া টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।এ তো দেখি মহা বিপদ সংকটে পরলাম।বাসায় তো এক গ্লাস জলও নিজের হাতে খাই না।আর এই লোক আমাকে ভাত বেড়ে দেওয়ার কথা বলছে।



টেবিলে ভাত বেড়ে চারদিকে পায়চারি করছি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে যাওয়া ভালো।তুষার ভাইয়া আমাকে হেনস্তা করার সুযোগ পেলে আর ছাড়তে চাইবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে দেখা গেল।চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছেন।সামনে এসেই ভেজা টাওয়ালটা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন,

” যা এটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আয়।”

তুষার ভাইয়ার কর্মকান্ডে আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি তিনি আমাকে একের পর এক অর্ডার করে যাচ্ছেন।
চুপচাপ তোয়ালেটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে আসলাম।দরজা দিয়ে বের হতে যাব তখনই আবার তুষার ভাইয়ার রাগ মিশ্রিত কন্ঠ।

” তুই আমাকে শুধু ভাত দিলি সাথে অন্য কিছু দিলি না যে?আমি কি খালি ভাত চিবিয়ে চিবিয়ে খাব?”

” ভাইয়া আপনার চোখে কি ছানি পড়েছে?দেখতেই তো পাচ্ছেন টেবিলে তরকারি রাখা আছে।ওখান থেকে নিয়ে নিন।”

তুষার ভাইয়া মস্ত একটা হাই তুলে বললেন,
” আমি নিলে কি আর তোকে বলতাম?আর তুই এমন ছ্যাত করে উঠছিস কেনো?আমি সারাদিন অফিস থেকে খেটেখুটে আসি।তুই কি করিস?বাসায় শুধু খাস আর ঘুমাস।মাঝেমধ্যে একটু কাজটাজ তো করতে পারিস।”

” কাজ করলে নিজের বাসায় করব।আপনার হুকুম দারী পালন করব কেনো?”

” আগে পরে তো আমার হুকুমই পালন করতে হবে তোকে।তাই শুরু থেকেই অভ্যাস করে নে।”

” এহ্! বয়েই গেছে।বিনে পয়সার কাজের লোক পেয়েছেন নাকি আমায়?”

তুষার ভাইয়া উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন।সকৌতুকে বললেন,
” তুই রাজি থাকলে তোকে না হয় মাইনে দিয়েই রাখব।কি বলিস?”

দুঃখে কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেলাম।মা ঠিকই বলে।আস্ত একটা বলদ আমি।কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারি না।

” কিরে তোর চেহারা শ্রাবণ মাসের মেঘের মত কালো হয়ে গেল কেনো?আচ্ছা যা বাসায় যা।তরকারি আমি নিজেই নিতে পারব।”

আমি মুখ ঝামটি মেরে বললাম,
” থাক আমিই দিচ্ছি। পরে তো ফুপির কাছে আমার নামে কুট কাচালি করবেন। আমি আপনাকে অভুক্ত রেখেই চলে গেছি।আমি কোনো কাজ পারি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ”

বিড়বিড় করতে করতে উনার কাছে গিয়ে বোল থেকে তরকারি প্লেটে তুলে দিলাম।পরিমাণে অনেকটাই বেশি দিয়ে দিয়েছি।নাহলে পরে আবার বলবে আমি পরিবেশন করতেও জানি না।আমার সব কাজে খুঁত ধরা তো উনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

” নিন।এবার শুরু করুন।আমি বাসায় যাচ্ছি।”

তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম।উনি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।সদ্য গোসল করে বের হওয়াতে উনার ফর্সা মুখটা আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে।কপালের ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
এরকম চেহারার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।নেশা ধরে যায়।তাই চোখ নামিয়ে নিলাম।
তুষার ভাইয়া ধীর কন্ঠে বলল,

” তুই খোলা চুলে আমার সামনে আসিস না তো নীল।”

কিছুটা অবাক হলাম।খোলা চুলে থাকলেও উনার সমস্যা!
” আমার খোলা চুল আপনাকে কামড় দেয় না আঁচড় দেয় হুম?”

তুষার ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন,

” চুল খোলা থাকলে তোকে ঠাকুমা’র ঝুলির শেওড়া গাছের পেত্নী গুলোর মত লাগে। সামনে দিয়ে দুটো বড় বড় দাঁত থাকলে পেত্নী লুক একেবারে সম্পূর্ণ হয়ে যেত।হাহাহা!

তুষার ভাইয়া ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলেন।আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছি।আমার আর কত উপাধি দেবেন উনি?ছুঁচো,পেত্নী।আরো কি কি শুনা লাগে আল্লাহই জানে।

________________________

দুপুরের গনগনে রোদ মাথায় করে বাসায় ফিরছি।গেইট দিয়ে ঢুকার সময় দারোয়ান আঙ্কেলের সাথে দেখা।আসা-যাওয়ার পথে যখনই উনার সাথে দেখা হয় তখনই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করি।
মিষ্টি হেসে বললাম,

” আজ ভীষণ গরম পরেছে তাই না আঙ্কেল? ”

উনি পান চিবাতে চিবাতে বললেন,

” হ মা! ফ্যানের নিচে বইসা থাকলেও শইল দিয়া ঘাম ঝরে।বিষ্টি নাই এক ফোঁটা। চাইরদিক খাঁ খাঁ করতাছে।”

দারোয়ান আঙ্কেল যে ভাষায় কথা বলে সেগুলো শুনতে ভালো লাগে আমার।কত সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা।

ভেতরে ঢুকতে যাব তখনই আওয়াজ পেলাম একটা প্রাইভেট কার গেইটের সামনে থেমেছে।আমি পেছনে তাকাতেই গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে গেল।ভেতরে ইয়াসির ভাইয়া।পাশের সিটের প্রবীণ লোকটা বোধ হয় উনার বাবা।
ইয়াসির ভাইয়াকে দেখেই আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।কেনো এমন হল সেটা জানি না।
জানালা দিয়ে মাথা বের করে ইয়াসির ভাইয়া বলল,

” দূর থেকে দেখলাম গেইট দিয়ে ঢুকছো তাই ভাবলাম একটু কথা বলে নেই।”

সৌজন্যমূলক হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

” ভা..ভালো আছেন ভাইয়া?”

” ভীষণ! তবে কিছুটা খারাপ। আমি চলে যাচ্ছি আজ।এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট যাব। কয়েকদিন পরই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।এ কারণেই তড়িঘড়ি করে যাওয়া।ভালো থেকো নীলাশা।”

ইয়াসির ভাইয়া চলে গেলেন।আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।যতই উনাকে ভালো লাগুক সামনাসামনি কথা বলার মত দৃশ্য কখনো কল্পনা করিনি।আমার কাছে ক্রাশ মানে হলো দূর থেকে দেখার বস্তু।হিহিহি।

আনমনে হাসতে হাসতে চোখটা পাঁচতলার বারান্দায় আটকে গেল।একি! তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে!কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইলাম।আজকে কি উনি বাসায় তাড়াতাড়ি এসে পড়েছেন?
মস্ত বড় কেলেংকারী হয়ে গেল।ওই বারান্দাটা থেকে নিচের খোলামেলা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়।তাহলে উনি নিশ্চয়ই ইয়াসির ভাইয়াকে দেখে ফেলেছে।আবারও কি থাপ্পড় খেতে হবে আমায়?
এত নিচ থেকে তুষার ভাইয়ার মুখের ভাবভঙ্গি কিছুই বুঝতে পারছি না।আল্লাহ বাঁচাও আমায়!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here