#সুখের_অ-সুখ-২০,২১
#মম_সাহা
বিশের বিস্ফোরণ (পর্বঃ২০)
বিষন্নতার প্রহর ভীষণ বড় আর বিষাক্ত হয়। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে একটু বেঁচে থাকার জন্য হৃদয় থেকে তপ্ত হাহাকার ভেসে আসে। যে মানুষ গুলো পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তারা তো বিদায় নেয় সমস্ত মায়া কাটিয়ে কিন্তু যারা রয়ে যায় পৃথিবীর বুকে, তারা যে বেঁচে থেকেও মরে যায় হাজারবার।
দাদীর মৃত শরীরটা মাটির নিচে রেখে আসার সাথে সাথে সুখ তার প্রাণটাও বোধহয় রেখে এসেছে। দু’দিন সে ঠাঁই বসে আছে দরজা বন্ধ করে দাদীর ঘরটাতে। হাজারবার বলেও বের করা যায় নি। বারবার মেঘ আর তার পরিবারের বাকি সদস্য’রা ডেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে। সাদা শাড়ি’টা ফ্লোরে পরে আছে। সেই শাড়ির বিভিন্ন জায়গায় দাদীজান নামক মানুষটার করুণ মৃত্যুর প্রমাণ ভেসে উঠছে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ ছোপ আস্তরণের মাঝে।
সেদিন যখন সিঁড়ির শেষ প্রান্তে নিথর হওয়া দাদীজানে’র সামান্য নিঃশ্বাস টা পরছিলো তারপর তার কোলো শেষ নিঃশ্বাস টা ফেললো তখন মনে হলো দাদীজান না, তারই প্রান পাখিটা উড়াল দিলো ভীষণ দূরে, একদম ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। বেশ ঘাটাঘাটি করে জানা গেলো মানুষটা সিঁড়ি থেকে নামার সময় বুঝে উঠার আগেই পা পিছলে পড়ে বরণ করে নেয় তার নিষ্ঠুর মৃত্যু টা। সুখ নিরলস চোখে তাকিয়ে রইল বাহিরের আকাশ পানে। ঐ তো দাদীজান, বাবা’র তারাটার সাথে কেমন ঝিলিক দিয়ে জ্বলছে। কী নিষ্ঠুর মানুষটা! ভীষণ নিষ্ঠুর।
যেদিন সে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এসেছিলো, অসহায় এক বৃদ্ধা ভাঙা স্বরে বলেছিলো “মনে রেখো, এক অসহায় বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে দোর ধরে তোমার অপেক্ষায়।” আজ সেই বৃদ্ধা নেই,কোথায় নেই, মন আকাশ খালি করে সে চলে গেছে বহুদূরে। এক অসহায় তরুণী’কে সে সারা জীবন অপেক্ষায় রেখে চলে গেছে। আর ফিরবে না কখনো, আর কেউ বলবে না তোর জন্য আমার বড্ড মায়া হয়, আর কেউ সুখ নামক মানুষটার সুখ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করবে না, আর কেউ সুখের বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিবে না। আর কেউ ফিরবে না কখনো, কেউ একজন আর শাড়ির আঁচলটা দিয়ে সুখের পরিশ্রমের ঘাম মুছে দিবে না। আর কেউ, আর কেউ খুব খারাপ, খুব খারাপ।
সুখ ডুকরে কেঁদে উঠলো। হৃদয় গহীনে যে যুদ্ধ চলছে, যে ভীষন জ্বালাপোড়া করছে তা অসহনীয়। বুড়িটা চলে গেলো। ভীষণ বোঁঝা হয়ে ছেলেদের কাঁধে থাকার জন্য যে মানুষটাকে বউদের কাছে সর্বক্ষণ মৃত্যুর বর পেতো সে মানুষটা সত্যিই চলে গেছে! সুখের হৃদয় মাঝে ভীষণ জ্বলন শুরু করে। সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,
-“ও দাদীজান,ফিরে আসো না। ফিরে আসো দাদীজান প্লিজ। ও দাদীজান,তুমি জানো না? তোমায় ছাড়া সুখ ভীষণ অসহায়। আমি কখনো তোমায় একা ছাড়বো না সত্যি বলছি৷ ফিরে আসো না গো। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলে আসো না গো। আমার যে তুমি ছাড়া কেউ নাই গো, কেউ নাই। তুমি বড্ড পাষাণ গো, ফিরে আসো না।”
সুখের ঘর থেকে আর কোনো শব্দ আসে না। চিৎকার আসে না। সব নিরব। এক, দুই,তিন করে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হলো। একদম চুপ সব। এতক্ষণ কান্নার যে ক্ষীণ শব্দ ছিলো সেটাও এখন নেই। মেঘ অনবরত সুখের দরজায় টোকা দেওয়া শুরু করে। নাহ্,কোনো সাড়া শব্দ নেই। দাদীজানের মৃত্যুর পর মেয়েটা কেবল চুপ করে রইল। আর ক্ষীণ স্বরে কেঁদে গেছে একটানা এই দুইদিন যাবত। কিন্তু এখন সেই রুদ্ধশ্বাস চিৎকারের পর পরিবেশটা জেনো আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মেঘের উৎকণ্ঠিত ডাক শুনে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ভেতর ভেতর মেঘ ভীষণ ভীত। মেয়েটা ভুলভাল কিছু করে ফেলবে না তো!
মসৃন আর মেঘ দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলো। সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপান্তরিত করে তারা দরজা ভাঙতেই ছলাৎ করে উঠে মেঘের প্রাণপাখি। মসৃনের মা “কী সর্বনাশ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো।
সুখের সাদা শাড়ি’টা সিলিং ফ্যানে ঝুলছে সাথে তার ছটফট করা শরীরটা। মেঘ দ্রুত এগিয়ে গেলো। পায়ের নিচে টুল’টা দিয়ে তৎক্ষনাৎ সুখের গলা থেকে শাড়ি’টা খুলে নেয়। সুখ ভীষণ কাঁশতে যখন ব্যস্ত তখন মেঘ ঠাস করে চড় বসায় সুখের গালে। পরিবেশ আবার নিস্তব্ধ। মসৃনের মা এগিয়ে গিয়ে সুখ’কে জড়িয়ে নেয়। মেঘের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে শাসিয়ে বলে,
-‘তোর সাহস কত বড়? আমার সামনে বউ’কে মারিস? আক্কেল জ্ঞান সব খেয়েছিস নাকি?’
মেঘ রক্তচক্ষু নিয়ে সুখের দিকে তাকিয়ে তেজী কণ্ঠে বললো,
-‘আমি আক্কেল জ্ঞান খেয়েছি নাকি উনি খেয়েছে? এগুলো কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাজ? পাগল হয়েছে সে? যদি একটু দেড়ি হতো কী হতো তবে!’
সুখ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মসৃন এগিয়ে এসে করুণ স্বরে বললো,
-‘মরে যাওয়া ভীষণ সোজা,বেঁচে থাকাটা কঠিন। কিন্তু বেঁচে থাকার মতন কঠিন কাজটা আয়ত্বে আনলে মরে যাওয়া কঠিন। আপনার কাছে বেঁচে থাকার কারণ আছে। বাঁচতে শিখুন।’
সুখ হিংস্র চোখ নিয়ে তাকালো মসৃনের দিকে। মসৃন সুখের দৃষ্টি দেখে মাথা আবার নিচু করে ফেললো। মেঘ আচমকা সুখের হাত ধরে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে। মসৃনের মা অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘কী করছিস মেঘ? মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’
মেঘ কোনো উত্তর দিলো না। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে কোথাও চলে গেলো।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ে প্রকৃতিকে শীতল করে দিচ্ছে। দাদীর কবর টা বৃষ্টির পানিতে নরম হয়ে আছে। সুখ অনবরত দাদীর কবরে হাত বুলিয়ে নেয়। মেঘ দূরে দাঁড়িয়ে রয় মূর্তির মতন। বৃষ্টির পানিতে ধুঁয়ে নেয় তার চোখের পানি। মেঘ’র চোখও অশ্রু উপস্থিতি। এ কয়েকদিন’ই বৃদ্ধ মানুষটা বড্ড বেশি মায়া লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তবুও নিজেকে শক্ত করে মেঘ। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-‘এই যেনো শেষ অশ্রু হয়। এরপর যদি আর কান্না বের হয় ঐ চোখ দিয়ে তাহলে চোখ গুলোই আর থাকবে না কান্নার জন্য।’
সুখ কিছু বলে না। কিন্তু মনে মনে সেও কঠোর প্রতিজ্ঞা করে।
——
দুপুরের খাবার খেয়ে একটু শুয়েছিলো সুখ তারপর উঠে আবার গোসল করেই রান্নাঘরে চলে যায় সে। সবার জন্য চা বানায় বেশ সুনিপুণ ভাবে। চা গুলো ট্রে তে নিয়ে সবার ঘরে ঘরে দিয়ে আসে।
মসৃনের বাবা শরিফুল ইসলাম ড্রয়িং রুমে সংবাদপত্র নিয়ে বসেছেন। খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন। সুখ চায়ের কাপটা উঠিয়ে শরিফুল ইসলামের দিকে এগিয়ে দেয়। শরিফুল ইসলাম খবরের কাগজ থেকে চোখ সড়িয়ে সুখের দিকে তাকায়। লোকটার দৃষ্টি জেনো কেমন! পুরো শরীরটা ভাড় হয়ে উঠে সুখের। সে দ্রুত নিজের শাড়ি’র আঁচলের দিকে তাকায়।
শরিফুল ইসলাম বিদঘুটে হেসে সুখের হাত থেকে চায়ের কাপটা নেয়। কাপটা দেওয়ার সময় ভীষণ বাজে স্পর্শ অনুভব করে নিজের হাতে সুখ। দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। দাদী মারা যাওয়ার পর সপ্তাহখানেক হলো। সে এখন স্বাভাবিক। এই এক সপ্তাহ সে খেয়াল করেছে শরিফুল ইসলামের অঙ্গভঙ্গি। লোকটা যে ভীষণ নিম্নমানের তা বুঝতে আর বাকি রইলো না।
নিজেকে ধাতস্থ করে সুখ পাঁচ মিনিট পর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। শরিফুল ইসলাম ততক্ষণে ঘরে চলে গেছে। কার ঘরে যেতে পারেন সেটাও সুখের বেশ জানা আছে। সুখ মসৃনের মায়ের রুমে যায়। মহিলা তখন খাট গুছচ্ছিলেন।
সুখ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো। এ মহিলাটা তাকে এতদিন বেশ আগলে রেখেছে। কেমন মা মা আদল মহিলাটা’ই।
সুখকে দেখে রুমি বেগম হাসেন। স্নেহমাখা কণ্ঠে বললো,
-‘আরে সুখপাখি যে! তা এ অবেলা গোসল করেছিস কেনো?’
সুখের মুখ লজ্জায় আবৃত হয়। ছোটমা’টা না বড্ড বেশিই অবুঝ। অবেলা গোসল করার কারণ যে তার গুণধর ছেলে সেটাও বুঝি বুঝে না?
রুমি বেগম বোধহয় ঘটনা’টা আঁচ করতে পারে। দ্রুত কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
-‘আমায় চা দিলে না আজ? প্রতিদিন তো তুমি’ই চা দেও।’
সুখ মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
-‘চলো না ছোট মা ঘুরে আসি। আজ তুমি আমি বাহিরে চা খাবো। যাবে?’
মহিলাটা এগিয়ে আসে,উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে,
-‘তুমি যাবে? তাহলে তো যেতেই হবে। আর কে কে যাবে?’
-‘আমি তাহলে আন্টি’কে জিজ্ঞেস করে আসি? বিহঙ্গ ভাইয়া তো ঘুমে। আর আঙ্কেল তো বোধহয় যাবে না।’
-‘আচ্ছা সুখপাখি তুমি মেঘের মা’কে মা না বলে আন্টি বলো কেনো?’
সুখ একটু থতমত খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা কণ্ঠে বললো,
-‘আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে তো। আচ্ছা আমি ডেকে নিয়ে আসি। তুমি রেডি হও।’
রুমি বেগম হেসে মাথা নাড়াতেই সুখ মেঘের মায়ের রুমের সামনে গেলো। দরজা ফাঁক করে দৃশ্য টা দেখে নিশ্চিত হয়।
তারপর ছুট লাগায় নিজের ঘরে। মেঘ তখন ফোন স্ক্রোল করছিলো। সুখ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
-‘চলেন না ঘুরতে যাই। ছোটমা যাবে বলেছে।’
মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকালো সুখের দিকে। অবাক কন্ঠে বললো,
-‘আজ চা দিবেন না?’
-‘না,আমি আপনি আর ছোট মা মিলে বাহিরে গিয়ে চা খাবো। চলেন না৷’
মেঘ অবাক হয়। সেদিনের রাতের পরে মেয়েটা একদম পরিবর্তন হয়ে যায়। এই এক সপ্তাহ ভীষণ চঞ্চলতা ভাবে কাটিয়েছে। তাদের মাঝে স্বামী স্ত্রী’র স্বাভাবিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। সে যেহেতু নিজেকে সুযোগ দিচ্ছে তাহলে তাকে সাহায্য করাই উচিৎ কাজ। মেঘ কিছু একটা ভেবে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘আপনি রেডি হোন তাহলে। ঘুরে আসি তিনজন মিলে। তবে,বাকিরা যাবে না?’
সুখ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘নাহ্, আন্টি শুয়ে আছেন। বিহঙ্গ ভাইয়া ঘুমে।’
মেঘ ‘ওহ্’ বলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল গুলো ঠিক করে নিচ্ছে। সুখ দ্রুত শাড়ি বদলিয়ে আসলো। বাহিরে বের হওয়ার সময় সাদা রুমাল আর দাদীর চশমা’টা ব্যাগে ঢুকাতে ভুলে নি সে।
—-
রুমি বেগম,মেঘ আর সুখ আজ অনেক ঘুরেছে। রাত আটটার কাছাকাছি। অনেক শপিংও করেছে। তিনজন মিলে বেশ হাসাহাসি করছে এর মাঝেই মেঘের ফোনটা উচ্চশব্দে বেজে উঠলো। সবাই হাসি থামিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি দিলো। মেঘ ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো।
সুখ উৎকণ্ঠিত গলায় বললো,
-‘কী হয়েছে মেঘ সাহেব?’
মেঘ কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-‘অপরিচিতা, বাড়িতে নাকি আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। পৃরো বাড়ি জ্বলে গেছে।’
সুখ আর রুমিও দাঁড়িয়ে যায় বিষ্মিত হয়ে।
#চলবে
#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ একুশ
ভয়ঙ্কর অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেবল ধ্বংসাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া কালো দু’তালা বিল্ডিং এর অস্তিত্ব। বাড়ির ভিতরে থাকা মানুষ গুলো ঘুমিয়ে ছিলো বিধায় বের হতে পারে নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেশ চেষ্টা করে এই ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড থামিয়েছে।
পথের ধারে বসে আছে মেঘ, রুমি বেগম। সুখ দুজনকে সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। এতক্ষণ চারপাশে অনেক মানুষের ভীড় থাকলেও এখন সেটা খুব স্বল্প আছে। দু’জন মানুষ খুব বেশিই ভেঙে গেছে। মেঘ তো কতক্ষণ কেঁদেছে ঠিক নেই। সুখ দু’জনকেই থামিয়েছে। অবশ্য দু’জনকে থামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে।
বাড়ির ভিতরে কোনো জিনিসই অক্ষত নেই। মানুষ গুলোর অব্দি এক অংশ পরিশিষ্ট নেই। কী ভয়ঙ্কর আগুন ছিলো! গ্রাস করে নিলো সবটা, সাথে গ্রাস করলো একজনের হৃদয়ের জ্বলতে থাকা আগুনও।
হঠাৎ’ই একটা মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রুমি বেগম’কে। মেয়েটাকে ঠিক চেনে না সুখ। সে কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটার পরিচয়। মেয়েটার পিছে এক ভদ্র লোক আর ভদ্র মহিলাও এগিয়ে আসলো।
মেয়েটা রুমি বেগম’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘এটা কী করে হলো মাম! বিহঙ্গ, বিহঙ্গ আর আসবে না মাম? বিহঙ্গ চলে গেলো আমাকে ছেড়ে? ওর প্রতিশ্রুতি ও মিথ্যে করে চলে গেলো? পাপা আর আন্টিও আমাদের একা রেখে দিলো?’
রুমি বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘জানিনা কী সর্বনাশ হয়ে গেলো। আর কখনো আমার সোনার সংসার টা আমি পাবো না রে মোহনা। সব ছাড় খার হয়ে গেলো। সব শেষ, সব।’
ভদ্রলোক এবার মুখ খুললেন, পাথরের ন্যায় বসে থাকা মেঘকে স্বান্তনার স্বরে বললেন,
-‘কীভাবে এসব হলো মেঘ? ওরা বের হতে পারলো না কেনো! তোমরাও বা কোথায় ছিলে?’
-‘জানিনা আঙ্কেল, কী থেকে কী হয়ে গেলো। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছে কারেন্টের তাঁড় থেকে আগুনটা লেগেছে। এ জন্যই কেউ বাঁচতে পারে নি, খুব দ্রুত আগুনটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর মা ও বিহঙ্গ ঘুমে ছিলো বোধহয়। আঙ্কেলও বোধহয় ঘুমিয়ে ছিলেন। সব শেষ হয়ে গেলো, সব শেষ। আমরা যদি ঘুরতে না যেতাম তবে বোধহয় আমরাও পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। সুখের জন্য আমরা বেঁচে গেছি।’
ভদ্রলোক অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তোমরা ঘুরতে গিয়েছিলে মানে! সুখটা কে?’
মেঘ একটু চুপ রয় তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আমার ওয়াইফ সুখোবতী। হঠাৎ করেই বিয়েটা করেছিলাম তাই কাউকে জানাই নি। জানানোর জন্য’ই ঢাকা এসেছিলাম তারপর নানান ঝামেলায় জানানো হয় নি। ভেবেছিলাম বিহঙ্গের আর মোহনার বিয়ের ডেইট ঠিক করবো সাথে আমার বিয়ের কথাটাও জানাবো। সুখ’ই আজ বায়না ধরলো ঘুরতে যাবে, মামুনি আর আমিও রাজি হলাম। ওদেরকেও বলেছিলাম যাওয়ার কথা কিন্তু ওরা সবাই ঘুমে ছিলো। তাই আর যেতে পারলো না।’
সুখের এবার বোধগম্য হলো এই মেয়েটা কে। তার মানে বিহঙ্গের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো! মোহনা নামের একটা মেয়ের কথা সে শুনেছিলো তবে এই সে মোহনা!
মোহনা মেয়েটার কান্না করতে করতে অবস্থা নাজেহাল। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে গেছে তার বাবা মা। মেঘদেরও বলেছিলো তাদের বাড়িতে যেতে কিন্তু মেঘ না করে দিয়েছে। খুব দ্রুতই এ শহর ছেড়ে তারা চলে যাবে। সব ফর্মালিটি শেষ করেই তারা পড়ি জমাবে নিজেদের শহরে। এ’শহর তো সব কেড়ে নিলো, সব।
—–
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আজ পনেরো দিন অতিবাহিত হলো। সুখ একা হাতে সামলিয়েছে মেঘ আর রুমি বেগম’কে। দু’জনই বেশ চুপ হয়ে গিয়েছে। এমন পরিবর্তন বেশ পীড়াদায়ক হলেও মানতে হচ্ছে সবটা। একা হাতে একদম পাক্কা গিন্নীর মতন সংসার সামলাচ্ছে সে।
প্রতিদিনের মতন আজও মেঘ ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়েছে অফিসে যাওয়ার জন্য। তারা যশোর এসে পড়েছে পরেরদিনই। আগের মতন কাজ কর্মে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুরো দমে। সুখ মাত্রই চায়ের কাপ এনে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখেছে তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। মেঘ টেবিলের দিকেই আসতে নিয়েছিলো কিন্তু কলিং বেলের শব্দ শুনে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
দরজা খুলতেই ইউসুফের শুভ্র রাঙা মায়াময় মুখটা ভেসে উঠলো। মেঘও হাসির বিপরীতে ছোট হাসি দিয়ে বললো,
-‘ভিতরে আসো ইউসুফ।’
ইউসুফ যেনো পিছে ঘুরে কাকে ডাক দিলো। মেঘ ভ্রু কুঁচকে সেখানে তাকিয়ে রইলো। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠা মানুষটাকে দেখে মেঘ চমকে গেলো। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। সুখও এবার দু’কদম এগিয়ে আসলো। মানুষটা এবার মেঘেদের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেঘ বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘মিনা, তুই! তুই এখানে কীভাবে!’
মিনা চোখ তুলে তাকালো, অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল মেঘের দিকে নিবদ্ধ করে বললো,
-‘আমারে মাফ কইরা দেন বড়ভাই। আমি একটা ছেলেরে পছন্দ করতাম, তার হাত ধইরাই পালায় গেছিলাম আপনাগো স্বর্ণ গয়না নিয়া। কিন্তু সে ভালো না, তাই আমি তার কাছ থেইকা লুকাইয়া চইলা আইছিলাম আপনাগো বাড়ি কিন্তু আইসা হুনি সর্বনাশ হইয়া গেছি। এ কি হইলো! মানুষ গুলান আমাগো রে ছাইড়া চইলা গেলো। আমি আর টিকতে না পাইরা চইলা আইছি আপনার কাছে। আপনি চাইলে আমারে পুলিশের কাছে দিয়া দেন, মাইরা ফেলেন তবুও আমি আপনারে ছাইড়া যামু না৷’
মেঘ কিছুক্ষণ চুপ রয়। ইউসুফের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-‘তুমি ওরে কই পাইছো ইউসুফ?’
-‘আমাদের বাড়ির সামনেই তো বাস স্ট্যান্ড,সেখান দিয়ে আসার সময় দেখি ও দাঁড়ায় আছে পরে অনেক আকুতি মিনতি করছে তাই নিয়ে আসছি স্যার।’
মেঘ ছোট্ট শ্বাস ফেললো। মিনা’কে সে বরাবরই নিজের ছোট্ট বোনের মতন ভাবতো। কখনো কাজের মেয়ে ভাবে নি। মেয়েটার হয়তো একটু মাথায় সমস্যা কিন্তু তবুও অনেক ভালো। মেঘ ঠিক কি করবে বুঝতে না পেরে সুখের পানে তাকালো। সুখও ঠোঁট উল্টিয়ে বুঝালো সে কিছু বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ করে রুমি বেগমের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসলো,
-‘ওরে থাকতে দেও মেঘ।’
সুখ, মেঘ, ইউসুফ রুমি বেগমের দিকে তাকালো। রুমি বেগম এগিয়ে এসে আশ্বাসের কণ্ঠে বললো,
-‘মিনা আমাদের বিশ্বাসের যোগ্য মানুষ ছিলো। ওর ছোট মস্তিষ্ক হয়তো আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে ভুল করেছে কিন্তু তাই বলে মেয়েটা খারাপ না। আমরা আরেকবার ওরে বিশ্বাস করতেই পারি।’
মেঘ আর কিছু বললো না রুমি বেগমের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কেবল গম্ভীর কণ্ঠে মিনা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তাহলে, আজ থেকে এখানেই থাকিস। আর কখনো বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না। তোকে আমরা সবাই অনেক ভালোবাসি।’
মিনা মেয়েটা কৃতজ্ঞতায় দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। মেঘ’কে সালাম করে মনে মনে বললো,
-‘আমি বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই বড়ভাই। আপনার জন্য-ই তো সব করলাম। আপনারেও যে আমি ম্যালা ভালোবাসি। আপনি খুব ভালা মানুষ, আর ভালা মানুষ গো পৃথিবীতে আরও অনেক বছর বাইচ্চা থাকতে হইবো।’
মেঘ মিনা’র মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার অফিস যেতে হবে, তুই থাক তোর ভাবী আর চাচীর সাথে। অফিস থেকে আসার পর কথা হবে।’
মিনা মাথা নাড়ালো। মেঘ সুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বললো “আসছি”। সুখও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
মেঘ বেরুতেই সুখ রুমি বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আমি একটু একটা কাজে বাইরে যেতে চাই ছোটমা।’
ছোট মা কেবল চোখের ইশারায় সম্মতি দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সুখ দ্রুত তৈরী হয়ে মিনা’কে সাবধানে থাকতে বলে বের হয়ে যায়।
——-
” আপনি আমার মা’কে মেরেছেন তাই না ফুপা!”
সুখের কথায় চমকে যায় লিলুয়ার স্বামী। অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘কী বলছো এসব? তোমার মা পালিয়ে গেছে সেই কবে আর আজ তুমি এসব বলছো। আমাকে তোমাদের বাড়িতে কী এ জন্য ডেকে এনেছো!’
-‘না ঠিক এ জন্য না। আসলে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে তাই ডেকে এনেছি, এবার বলুন আপনিই মেরেছেন আমার মা’কে?’
সুখের সৎমা এগিয়ে এলো,চওড়া কণ্ঠে বললো,
-‘এই মেয়ে কী পাগল হলো? আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করলো,স্বামীর বাড়ি নিয়ে আমার শাশুড়ি’কে মারলো সেটাও আমাদের জানায় নি। এখন আবার এ বাড়িতে সেই সকালে এসে কী খোঁজাখুঁজি করলো পাগলের মতন তারপর এখন আবার ভাইসাহেব’রে ডেকে এনে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।’
-‘একদম চুপ থাকবেন আপনি। আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি? একদম একটা কথা কেউ বলবে না। এই ব্যাপারে শুধু আমি কথা বলবো, সবাই চুপ।’
সুখের এহেন আচরণে সবাই অবাক, এ কোন সুখকে দেখছে তারা! সুখের ছোট চাচা লিয়াকত আলী এগিয়ে আসলেন, ঘড় কাঁপিয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন,
-‘এত বেয়াদব কীভাবে হলে তুমি! বড়দের মুখের উপর কথা বলছো তাও অসভ্যের মতন? চোরের মায়ের বড় গলা। চরিত্রহীন মহিলার মেয়ে এখন মা’কে নিয়ে গলা বাজি করছো? আমার মা’কে তো মেরে ফেললে, আর সেটা আমাদের জানানোর প্রয়োজন করলে না?’
-‘জানালে কী হতো চাচা? সম্পত্তির আরেক দফা ভাগাভাগি হতো তাই তো?’
লীলাবতী’র এহন সত্যি কথায় ভড়কে গেলো চাচা লিয়াকত। কীভাবে কথার যুদ্ধে জিতবে সে ভেবে সে আবারও লীলাবতী’র উপর চেঁচিয়ে বললো,
-‘বড়টার দেখাদেখি ছোট টাও অসভ্য হচ্ছে। সেও পেট বাঁধিয়ে বসে আছে আবার এত বড় বড় কথা।’
-‘তাতে আপনার কী চাচা? আপনার ভাগ থেকে সম্পত্তি দিতে হবে না আমাদের, নিশ্চিন্তে থাকুন।’
লিয়াকত আলী থতমত খেয়ে যায়। সুখ বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,
-‘এবার আসল কথা-ই আসি ফুপা? তা কেনো মেরেছিলেন আমার মা’কে?’
ভদ্রলোক এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টা রুমাল দিয়ে মুছে থতমত চেহারা নিয়ে বললেন,
-‘কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে যে এসব বলছো? সাহস তো কম না তোমার। প্রমাণ দেখাও আগে।’
সুখোবতী বাঁকা হেসে বললো,
-‘এই তো প্রমাণ আপনার পিছের দরজায় দাঁড়ানো মানুষ’টা। দেখুন তো চিনতে পারছেন কিনা অতি পুরোনো প্রমাণ টা?’
ভদ্রলোক পিছে ফিরে চাইলো। অতি বিষ্ময়ে চোখ বড় করে ফেললো। ভয়ার্ত ও অবিশ্বাস্যকর কণ্ঠে বললো,
-“তুমি!”
#চলবে