অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৪

#অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৪
#নাজমুন_বৃষ্টি

ভর্তির সবকিছু ঠিকঠাক করার পরে নেহাল আহমেদ মেয়েকে এক গাদা আদেশ দিয়ে হোস্টেলে তুলে দিলেন নীলাদ্রিকে। এরপর নিজে বাসার উদ্দেশ্যে ফিরে গেলেন।

নীলাদ্রি তার রুমে সবকিছু গুছিয়ে রেখে খাটের উপর বসলো। তার রুমমেটও একসাথেই পড়ে, এটা হোস্টেলে কর্মরত মহিলাটিই বলেছিল। নীলাদ্রি ফ্রেস হওয়ার উদ্দেশ্যে বারবার ওয়াশরুমের দিকে তাকাতে লাগলো, রুমমেট হয়ত গোসল করছে। এখনো দেখা বা কথা হয়নি। জার্নি আর এসব গুছাতে গুছাতে ক্লান্ত লাগছে। দু’চোখে ক্লান্তি এসে ভর করতেই কোন সময় চোখ লেগে গেল আর খেয়াল ছিল না।

ঘুম ভাঙলো কারো ডাক শুনে। নীলাদ্রি ঘুমু ঘুমু চোখে ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে দেখল একটি অচেনা মেয়ে ডাকছে। তার রুমে অচেনা মেয়ে কোথ থেকে আসবে! হোস্টেলের কথা মনে পড়তেই সে নিজের অবস্থান বুঝে উঠতেই হুড়মুড় করে উঠে বসতেই মেয়েটি হেসে উঠল,

-‘আরে আস্তে আপু। সেই কখন থেকে ঘুমাচ্ছেন! আজ আর আপনার গোসল হলো না।’ বলেই মেয়েটি হেসে উঠল।

নীলাদ্রি নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করলো। সে খাটের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানালা দিয়ে চোখ যেতেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এতক্ষন ঘুমালো! সে দুপুরে কাপড় নিয়ে বসেছিল ফ্রেস হওয়ার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। নীলাদ্রি চারপাশ তাকিয়ে কাপড়গুলো খুঁজতেই মেয়েটি বলে উঠল,

-‘আপু, আমি গুছিয়ে রেখেছি আপনার কাপড়গুলো। এতক্ষনে গোসল করলে ঠান্ডা লাগতে পারে। আপনাকে দেখতে ক্লান্ত লেগেছিল তাই আর ঘুম থেকে ডাকিনি। আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।’

-‘আমাকে আপনি আর আপু বলে লজ্জা দিও না। নাম ধরেই ডাকতে পারো। একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি।’

মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় জানাল।

-‘তোমার নামটা কী যেন?’

-‘মৌ আর তোমার?’

-‘নীলাদ্রি। তোমার নামটা সুন্দর।’

নীলাদ্রির কথায় মেয়েটি হাসলো। এরপর মেয়েটি নিজেই আগ-বাড়িয়ে বলতে লাগল।
-‘যাক, এতদিনে একটা সঙ্গী পেলাম। জানো?এতদিন একা একা সময় কাটাতে হতো। এখন আর ক্লাসেও একা যেতে হবে না। আমি কিন্তু অনেক বকবক করি, তোমাকে প্রচুর জ্বালাবো।’

মৌ’য়ের কথায় নীলাদ্রি হাসলো।

———–

কয়েকদিন যেতেই নীলাদ্রি আর মৌ’য়ের মাঝে অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এখন নীলাদ্রির সুখ-দুঃখের একমাত্র সঙ্গী হচ্ছে মৌ। মৌও সবসময় নীলাদ্রির সাথে কথা বলে নীলাদ্রিকে হাসির উপর রাখতে চায়।
এতো এতো পড়াশোনা আর মৌ’য়ের বন্ধুত্বে নীলাদ্রির আর আগের কথা তেমন একটা মনে পড়ে না কিন্তু রাতে মাঝে মাঝে আরিয়ানের সেই অত্যাচার’গুলো নীলাদ্রির ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন-রূপে এসে জ্বালায়। তখন মাঝরাতে মৌ নীলাদ্রিকে এটা-ওটা হাসির গল্পঃ বলে হাসাতে চেষ্টা করে। সে সবসময় নীলাদ্রিকে সময় দিতে চায়, যাতে করে অতীতটা আড়ালে ঢেকে যায়।

আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ মনোযোগ নীলাদ্রি পড়ার উপর দিচ্ছে। ক্লাসেও সে ভালো রেজাল্ট করছে। নেহাল আহমেদ মাঝে মাঝে এসে দেখে যান। রুবিনা বেগম সবসময় স্বামীকে জোর করে, মেয়েকে যাতে এইবার বাড়ি নিয়ে যায় কিন্তু নীলাদ্রির এক কথা, সে আগে ভালো-মতো পড়া শেষ করুক তারপর বাড়ি যাবে। রুবিনা বেগমকে নেহাল আহমেদ আস্বস্ত করলেন, সমাজের দিকটা ভেবেই মেয়ে এখন বাড়ি ফিরছে না। রুবিনা বেগমও আর জোর করেন না এখন।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কিন্তু কয়েকমাস যেতেই নেহাল আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
সেদিন নীলাদ্রি মাসের খরচ এর জন্য যখন কল করলো তখন অপর-পাশ থেকে বাবার নীরবতায় যা বুঝার বুঝে ফেলল। সে আর আগ-বাড়িয়ে কিছু বলল না। বুঝতে পারলো, বাবা-মা’য়ের এখন বয়স হচ্ছে। বয়সের ভারে এখন আর চাকরিও করতে পারে না। মায়ের ওষুধ আর বাবার নিজের খরচ আবার এদিকে নীলাদ্রির শহরে থাকা-খাওয়ার জন্য এতো এতো টাকা। সব মিলিয়ে তিনি কী করবেন, ভেবে পাচ্ছে না। তবুও তিনি নীলাদ্রিকে আস্বস্ত করলো, নীলাদ্রি যেন সব মনোযোগ পড়ার দিকে দেয় -টাকার ব্যবস্থা তিনি করবেন।

নীলাদ্রি টাকার ব্যাপারে আর কিছু না বলে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিল। তার মাথায় এখন আরেকটা চিন্তা এসে ভর করলো। তার আর কোনো ভাই নেই যে বাবা-মাকে চালাবে। বাবার যা জমানো ছিল, ভেবেছিলো নীলাদ্রির বিয়ের পর উনারা স্বামী-স্ত্রী জীবন পার করে দিতে পারবেন কিন্তু তা তো হলো না। মেয়ে ফিরে আসতেই তিনি মেয়েকে এখানে ওখানে ভর্তির ব্যবস্থা করতে গিয়ে প্রায় টাকায় খরচ করে ফেলেছিলেন, এখন সব শেষের পথে। নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিছু করার উপায় নেই।

নীলাদ্রি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোট-খাটো চাকরির খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়লো সেই অচেনা শহরে। চাকরি খুঁজতে গিয়ে সে আরও ভালো করে চিনতে পারলো শহরটাকে। ভালো মানুষের আড়ালে মুখোশ পড়ে থাকা বাবার বয়সী মানুষগুলোকেও চিনতে পারলো নীলাদ্রি।

চাকরির বড়োই কদর। নীলাদ্রি প্রয়োজনে পড়ে চাকরির উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে বুঝতে পারলো, এ শহরে হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক বেকার ঘুরছে, একটা চাকরির আশায়। নীলাদ্রি এসব দেখে ব্যর্থ হলো। সে তো এদের তুলনায় কিছুই না! মাত্রই অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ হলো!তার উপর কেউ কেউ চাকরি দিতে চাইলেও সুযোগ খুঁজে। নীলাদ্রি সারাদিন এখানে ওখানে চাকরি খুঁজে ক্লান্ত হয়ে দিন শেষে হোস্টেলে ফিরত। ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে আসতেই শুয়ে পড়তে গিয়ে বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ধপ করে চোখ খুলে উঠে বসে । তার যে এতো তাড়াতাড়ি আশা ছেড়ে দিলে চলবে না। তার বাবা-মায়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্থান এখন শুধুমাত্রই নীলাদ্রি।

অনেক খোজা-খোঁজির পর অবশেষে একটা চাকরি পেলো নীলাদ্রি।
চাকরির দিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখল, দুজন অল্পবয়স্ক লোক বসে আছে।
নীলাদ্রি পুরোপুরি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে গিয়েছিল যেন প্রশ্ন ধরলে ফটাফট উত্তর দিতে পারে। যাতে করে নীলাদ্রি যেন সিলেকশনে বাদ না পড়ে। কিন্তু তারা নীলাদ্রির ধারণা ভুল প্রমান করে তার কাগজ-পত্র দেখে ব্যক্তিগত বিষয়ে সব প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো। নীলাদ্রি অস্বস্তিতে পড়ে একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। যখন শুনলো, নীলাদ্রি একজন ডিভোর্সি আর বয়স্ক বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, তার চাকরিটা যেভাবেই হোক পেতেই হবে তখনই তাদের দুজনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
তারা তখনোই নীলাদ্রিকে সিলেক্ট করে ফেলল। নীলাদ্রিকে এতো এতো মানুষের ভীড় থেকে চাকরির কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সিলেক্ট করাই সে ভাবতে বসে গেল কিন্তু পরোক্ষনে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়তেই সে হেসে লোকগুলোর দিকে তাকাতেই লোকগুলোর অস্বস্তি-মাখা চোখ দেখে সে যা বুঝার বুঝে ফেলল।
নীলাদ্রি ঘৃণা-ভরা দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে অফিস থেকে সাথে সাথে বেরিয়ে এলো।

সে বুঝতে পারলো, এই শহরে হাজার হাজার ভালো মানুষের আড়ালে মুখোশ পরিহিত মানুষের অভাব নেই।
আবিষ্কার করলো সুন্দর, সুশ্রী শহরটার আড়ালে ঢাকা বি*শ্রী আরেকটা রূপ।

মৌ নীলাদ্রির এমন অবস্থায় এক পরিচিত আঙ্কেলের সাথে কথা বলে একটা অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করলো। নীলাদ্রি প্রথমে না বোধক মাথা নাড়লো। ভাবল, এই শহরে সবাই অসহায়ত্বের সুযোগ খুঁজে। এই শহরে মুখোশের আড়ালে ঢাকা মানুষের অভাব নেই। মানুষ কতটা নিম্নমনের হলে, মেয়ের বয়সীকেও পর্যন্ত ছাড় দেয় না,কুপ্রস্তাব দেয়! তা নীলাদ্রি ভেবে উঠতে পারে না। আচ্ছা, মানুষগুলোর এমন কীসের অভাব যে এমন প্রস্তাব দেয় তাও বা তারই মেয়ের বয়সীকে!

মৌ নীলাদ্রিকে আস্বস্ত করলো, এই চাকরিতে এমন কিছুই হবে না। নীলাদ্রিও শেষবারের মতো চেষ্টা চালিয়ে গেল। সে চাকরিটা যেমন করেই হোক, করবে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here