অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৩

#অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৩
#নাজমুন_বৃষ্টি

রুমে ঢুকেই নীলাদ্রি দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
ঘুমাতে গেলেই সব কথা একসাথে মনে পড়ে। বড্ড অসহায় লাগে তখন নিজেকে। ঘুমটাও তখন স্বার্থপর হয়ে উঠে। পাশের ঘরে শব্দ যাওয়ার ভয়ে যখন বালিশে মুখ গুঁজে গোঙ্গাতে থাকে তখন বারবার করে মনে পড়ে সেই মানুষটার কথা, যাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে শুধুই অবহেলা আর অত্যাচার জুটেছে। আচ্ছা, কাউকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে আগলে রাখার চেষ্টা কী অপরাধ!

রাত গিয়ে ধরণীর বুকে সকাল নামে। নীলাদ্রি ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে নেয়। ভোরের দিকে ঘুম আসাতে চোখগুলো লাল আঁকার ধারণ করেছে।
নীলাদ্রি রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে কফি নিয়ে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। ভোরের সতেজ বাতাস গায়ে লাগতেই এক অন্যরকম অনুভূতি হানা দিল। চোখ বন্ধ করে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া অনুভব করলো। আজ প্রায় এক বছর পর আবারও আগের মতো অনুভূতি আসছে। এই এক বছরের মধ্যে একবারও তার এই প্ৰিয় সময়টা একান্তভাবে উপভোগ করতে পারেনি। রাতে আরিয়ান দেরি করে বাসায় ফিরত আর নীলাদ্রি আরিয়ানের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তো। ঘুমের মাঝেই কারো থা’প্প’ড় খেয়ে উঠে বসতেই দেখতো আরিয়ান চক্ষু লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে উঠে আরিয়ানকে খাবার দিতেই সে খাবারও ভালো হয়নি বলে নীলাদ্রির মুখের উপর ছুঁড়ে মারতো। একবার জিজ্ঞেসও করতো না, নীলাদ্রি খেয়েছে কী না। আরিয়ান সবসময় অকথ্য ভাষায় নীলাদ্রিকে গা’লি দিতো। নীলাদ্রি সব চুপচাপ সয়ে যেত। সে ভাবতো, বিয়ে তো মানুষের একবারই হয়। কষ্ট করে মানিয়ে নিয়ে মানুষটাকে ভালোবাসলে বোধহয় মানুষটাও নীলাদ্রিকে বুঝতে পারবে কিন্তু নীলাদ্রির ধারণা ভুল। আর কয়দিন গেলে নীলাদ্রি বোধহয় মারা’ই যেত! নীলাদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না চাইতেও সবসময় সেই স্মৃতিটা হানা দেয়। সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো। আর ভাববে না এসব, এসব ভেবে ভেবে বাবা-মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না নীলাদ্রি।

পূর্ব আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে। নীলাদ্রি মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। স্মৃতি হাতড়িয়ে বুঝতে পারলো, শেষ কবে এই দৃশ্যটা দেখেছে তার মনে পড়ছে না। তাই বোধহয় আজ মনে হচ্ছে,এই প্রথম সূর্য উদিত হওয়ার দৃশ্য দেখছে নীলাদ্রি।

একটু বেলা গড়াতেই নীলাদ্রি রুম থেকে রান্নাঘরে গেল। আজ সে নাস্তা বানাবে। চটপট নিজের কাজে লেগে গেল সে।
সবকিছু তৈরী করা শেষ হতেই সেগুলো টেবিলে এনে রাখলো। ততক্ষনে বাবা মা দুইজনেই উঠে গিয়েছে।
রুবিনা বেগম তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল নীলাদ্রি প্লেট সাজিয়ে সেগুলো নিয়ে বের হচ্ছে।

-‘কিরে মা?’

-‘প্রতিদিন তো তুমিই করো, আজ না হয় আমিই করি।’

রুবিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। যে মেয়েকে এক বছর আগে হাজার জোর করেও কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে তুলতে পারতো না, সে মেয়ে এখন ডাকার আগেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের নাস্তা-পাতি বানিয়ে নিচ্ছে।

-‘মা, খেতে আসো।’

মেয়ের ডাকে রুবিনা বেগমের হুশ ফিরলো। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, নেহাল আহমেদও এসে বসেছে টেবিলে। তিনিও মেয়ের কাজ-কারবার দেখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এরপর একটা মলিন শ্বাস ফেলে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলেন।

খাওয়া শেষ হতেই নীলাদ্রি সব জিনিস রান্নাঘরে নিয়ে একা একা ধুয়ে মুছে গুছিয়ে রুমে এসে বসলো। সে নিজেকে যথা-সম্ভব ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। তবুও সময়ে-অসময়ে সব মনে পড়ে। আর মাত্র কয়েকদিন! এরপর হোস্টেল জীবন আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে নীলাদ্রি।

———
কেটে গেল আরও কয়েকদিন। এর মধ্যে নেহাল আহমেদ নীলাদ্রির ভর্তির জন্য সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। নীলাদ্রিও মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ডিভোর্সের পর নীলাদ্রি বাসা থেকে আর বের হয়নি। আজ হোস্টেল যাওয়ার পথে রাস্তা-ঘাটে সবাই নীলাদ্রিকে ভিন্ন নজরে দেখছে সে সেটা ওদের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে।

চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক মধ্যবয়স্ক মহিলা আরেকজনের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। তিনি নীলাদ্রির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নেহাল আহমেদকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠল,

-‘কী গো ভাই-সাব! শুনলাম! তোমার মেয়েকে না কি তালাক দিয়ে দিছে? এতো ভালো ছেলে তালাক দিয়ে দিল! মেয়েটাকে তো আগে দেখতে ভদ্র মনে হতো!’ বলতেই দোকানের মানুষগুলোর দৃষ্টি নীলাদ্রির উপর পড়লো।
নেহাল আহমেদ জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই মহিলাটি আবারও বলে উঠল,

-‘বলছি কী! আমার কাছে একটা সম্বন্ধ আছে,এই ধরো একটু বয়স হয়েছে আর কী! কিন্তু তোমার মেয়েকে সুখে রাখবে। মেলা টাকা-পয়সা আছে। ছেলে-মেয়ে সব বিদেশে সেটেল। তোমার মেয়ে রাজরানীর মতো থাকবে। সুখী থাকবে।’ বলতেই চায়ের দোকানে বসা অন্যরা সহ হাসাহাসি করতে লাগল।

নীলাদ্রি রাগে-অপমানে মাথা নিচু করে ফেলল। নেহাল আহমেদ মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে রেগে কিছু বলার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যেতেই নীলাদ্রি বাবার হাত ধরে ইশারা দিয়ে অনুনয় করলো কিছু না বলার জন্য। নেহাল আহমেদ মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রাগটা কোনোমতেই হজম করে নিলেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

নীলাদ্রি মাথা উঁচু করে মহিলাটির উদ্দেশ্যে সেখানে পা বাড়ালো,

-‘আন্টি, শুনছি আপনারও তো একটা মেয়ে আছে। যদি আজ আমার জায়গায় আপনার মেয়েটা থাকতো! বলা তো যায় না, কার কপালে কী লেখা আছে। আজ থেকে এক বছর আগে এই দিনে আমি অবিবাহিত ছিলাম, ঠিক আপনার মেয়ের মতোই চলতাম-ফিরতাম কিন্তু দেখুন একবছর পর কী নিয়তি! হতেও তো পারে, আপনার মেয়েরও আগামী বছর এই দিন দেখতে হবে। তখন এই আপনার মতো আপনার মেয়েকে কেউ যদি এমন প্রস্তাব দেয় তখন কেমন লাগবে আপনার?’ বলতেই মহিলাটির চেহারা ভীতিগ্রস্থ দেখা গেল।
নীলাদ্রি মহিলাটির এমন ঘন মেঘের চেহারা দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো।

-‘এই না না। ভয় পাবেন না আন্টি। আমি শুধুমাত্র আপনাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছি, যাতে আপনার মনে একটু হলেও অনুশোচনা আসে। ভাবেন, আপনার কথায় আমার বাবার কেমন লাগলো! আর জানেন আন্টি? আমি মোটেও ভেঙে পড়িনি, কিন্তু সমাজে চলতে-ফিরতে গিয়ে আপনাদের মতো মানুষের কথা শুনে একটা মেয়ে ভেঙে পড়তে বাধ্য। আপনারা জানেন না, শুধুমাত্র আপনাদের কারণে একটা মেয়ে হতাশার কোন পর্যায়ে চলে যেতে পারে! আন্টি,এমন কিছু করিয়েন না যাতে পরে আফসোস করতে হয়।’

মহিলাটি মাথা নিচু করে ফেলল। এরপর মাথা উঁচিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই নীলাদ্রি বাবার হাত ধরে বলে উঠল,

-‘আপনাদের কথার কারণেই আজ আমি পড়াশোনার জন্য দূরে যাচ্ছি। কাউকে কোনো কথা বলতে গিয়ে সেই জায়গায় আগে একবার আপনাকে বসিয়ে দেখবেন তারপর অন্যকে বলতে আসিয়েন আন্টি। আপনাদের সবারই সন্তান আছে। ভালো থাকবেন, আজ আসি।’ বলেই চলে আসলো নীলাদ্রি।

নেহাল আহমেদ মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। দোকানের মানুষগুলোরও আর কিছু বলার সাহস হলো না। কেউ কেউ মাথা নিচু করে ফেলল। হয়ত নীলাদ্রির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here