#ও_আসবেই আবার
৪র্থ পর্ব
শুরুটা ৭ বছর বয়সের এক অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে ক্লিনিকে ঢুকিয়ে হলেও কয়েক ঘন্টার ভেতরে যে ক্লিনিকের ভেতর এমন ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে যাবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মর্গ রুমের ভয়ানক বিভীষিকাময় মুহূর্ত কাটিয়ে আতঙ্কে সেখান থেকে বেরিয়ে সেই আতংঙ্ক পুরোপুরি মনে গেঁথে রেখেই চেকআপ রুমের দিকে আবার ছুটে যেতে হলো ডাক্তারদের তিন জনেকেই। হ্যা, রুমের দরজা ফাঁকা হয়ে রয়েছে। দ্রুত রুমের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন তারা। উত্তেজিত হয়ে আছেন তিনজনেই। ঐতো বাচ্চা মেয়েটা। বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তবে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়েই সবাই জমে বরফ হয়ে গেল। মানুষের শরীরের অবয়ব যেন মেয়েটার শরীর থেকে উড়ে গিয়েছে। তাকে দেখে ভিনগ্রহের একটা ভয়ানক জন্তুর মতো লাগছে। একটি স্বাভাবিক মানুষের গর্ভ কিছুতেই এতটা প্রসারিত হতে পারে না। হয় মেয়েটার গর্ভে থাকা ভ্রূণ দুটোর আকার এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে নয়তো কোনো এক অদ্ভুত শক্তিতে আবার মেয়েটার গর্ভের ভ্রূণের সংখ্যা আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েটার পাতলা শরীরের বিশাল বড় একটা টিউমারের মতো পেট থেকে ঝুলে আছে মাংস খণ্ডটি। গায়েবি ভাবে যেখানে প্রবেশ করছে একের পর এক মানব ভ্রূণ।
এমন দৃশ্য দেখে কারোই স্বাভাবিক থাকার কথা না। কিন্তু যারা কিছুক্ষণ আগে মর্গে ৪জন মৃত মানুষের শরীরে প্রাণ ফিরে আসতে দেখেছে, তাদের নার্ভ যে এমনিতেই শক্ত হয়ে গেছে না অনুমেয়। ডাক্তার অমিত, ডাক্তার আমিন এবং ডাক্তার মামুন ছোট পা ফেলে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কী বীভৎস চেহারা হয়েছে মেয়েটার! শরীরের অন্যান্য অংশের সমস্ত মাংস যেন কেউ শুষে নিয়ে তার পেটের কাছে এন জড় করেছে। শরীরের সব হাড় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মুখ শুকিয়ে প্রায় কঙ্কালের খুলি আকৃতি হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার চোখদুটো খোলা। সেই চোখ যেন দুনিয়ার সব কষ্ট, যন্ত্রনা, ব্যাথা একত্রে এসে জমা হয়েছে। মেয়েটা কোনো কথা বলবে না জেনেও ডাক্তার আমিন তার দিকে ঝুঁকে করুন কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি তুমি কোনো একটা ভয়ানক বিপদে পড়েছ, আর তোমার পরিণতি হতে যাচ্ছে ভয়ানক কিছু, আমরা নিজ চোখে মৃতদের জীবিত হতে দেখেছি, ভালো মানুষদের উন্মাদ হতে। কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে। তোমার সাহায্য প্রয়োজন তোমার নিজের, আমাদের, তোমার এবং আমাদের বিপদ থেকে বাঁচতে এবং বাঁচাতে। তুমি কথা বলো, নাহলে ইশারায় হলেও কী ঘটছে তা সম্পর্কে আমাদের সামান্য ধারণা দাও।’
মেয়েটা সেভাবেই শুয়ে পলকহীন, ভাবলেশহীন ভাবে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বৃথাই প্রশ্ন, মেয়েটা কিছুই করবে বা বলবে না এতটুকু বোঝা যাচ্ছে। এই ঘরেও মর্গের ভেতর থেকে সেই তছনছ করার শব্দ ভেসে আসছে। তারা কী খুঁজছে ওই মর্গের ভেতর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেন ওই তিনজন উন্মাদের মতো আচরণ করছে, অদ্ভুত কিসব কথা বলছে! কে আসবে! তিনজনেই দিশেহারা বোধ করছেন।
উপর মহলের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্বটা ডাক্তার অমিতের উপরেই ছিল। সে এরমধ্যেই ক্লিনিকের উপর মহলের এক সদস্যের সাথে কথা বলে ক্লিনিক থেকে দুইজন মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। লোকটা বলেছিলেন উপর মহলের বাকিদের সাথে আলোচনা করে আবার তিনি যোগাযোগ করবেন। কিন্তু এখনো লোকটা যোগাযোগ করেনি। বর্তমানের ক্লিনিকের পরিস্থিতি তাকে কিছুই জানানো হয়নি। মর্গে যেভাবে লোহার রোড হাতে মেয়েগুলো উন্মাদের মতো আচরণ করছে। মর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলে তারা বাইরের সবাইকেই খুন করে ফেলতে পারে। দ্রুত তাই ক্লিনিকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি। দ্রুত লোকটার সাথে যোগাযোগ করে সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে হবে। ফোনে সমস্ত ঘটনা শুনলেও তারা বিশ্বাস করবে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ আছে ডাক্তার অমিতের। এখন পর্যন্ত যে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন তারা সবটাই অবিশ্বাস্য।
চেকআপ রুমের থেকে বেরিয়ে ডাক্তার অমিত নিজের চেম্বারে হাজির হলেন। চেম্বারে ঢুকেই তিনি টেলিফোন বাজার শব্দ শুনতে পেলেন। অনেকক্ষণ ধরেই হয়তো কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কলটা ধরলেন। ক্লিনিকের উপর মহলের সেই কর্মকর্তাই কল করেছেন। লোকটা ক্লিনিকের বর্তমান কী অবস্থা জানতে চাইলেন। ডাক্তার অমিত প্রথম থেকে এই পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলে গেলেন। নিজের বলা কথাগুলোই নিজের কাছে পাগলের প্রলাপের মতো শোনালো। কিন্তু তিনি জানেন এটাই সত্যি। উপর মহলের লোকটা বিস্মিত হয়েই কিছুক্ষণ বোবা হয়ে রইলেন। তারপর অমিতের মাথা সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে কিনা যাচাই করতে ফোনটা ডাক্তার মামুনকে দিতে বললেন। ডাক্তার অমিত রুম থেকে বেরিয়ে স্টাফদের নাম ধরে ডাকলেন ডাক্তার মামুনকে ডেকে আনতে। কিন্তু কারোই সাড়া পাওয়া গেল না। শেষে তিনিই চেকআপ রুমে গিয়ে ডাক্তার মামুনকে পাঠিয়ে দিলেন। ডাক্তার মামুন ফোন রিসিভ করে ডাক্তার অমিতের বলা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করলেন। এবং এই মুহূর্তে ৪জন মৃত লাশ আর ৩জন উন্মাদ নারী মর্গের ভেতরে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারা কোনো এক অশুভ শক্তিকে পৃথিবীতে নিয়ে আশার পূর্বপ্রস্তুতি নিচ্ছে, আর বাচ্চা মেয়েটার শরীরের অদ্ভুত পরিবর্তন, ক্লিনিকের সবাই এখন ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে, সবটাই বলে গেলেন। দ্রুত অতিরিক্ত লোক যাতে এখানে পাঠানো হয় তাও বললেন।
ডাক্তার মামুন লোকটাকে অনুরোধ করলেন মেয়েটা সম্পর্কে যত রকম তথ্য আছে তা যাতে তাদেরকে খুব দ্রুত জানানো হয়। নাহলে একটা বড় রকমের অঘটন ঘটে যাবে আজ রাতে। ওপাশের লোকটা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। এবং মুহূর্তেই পুরো ক্লিনিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল। লোড শেডিং! ইমিডিয়েট জেনারেটর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চালু হওয়ার কথা। কিন্তু ৫ মিনিটের বেশি অতিবাহিত হওয়ার পরেও আলো জ্বলে না ওঠায় ক্লিনিকের সবার বুকের ধুকপুকানি কয়েক গুণ বেড়ে গেল। অন্ধকার অশুভ কিছুর সংকেত!
ডাক্তার মামুনের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে অন্ধকারে ডুবে গেছেন তারা। আর কোনোদিন আলোর মুখোমুখি হতে পারবেন না। কিন্তু ১০ মিনিট কাটতেই ক্লিনিকের সমস্ত আলো জ্বলে উঠলো আবার। এই কয় মিনিট জমে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আলো আসতেই তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। পরমুহূর্তেই আবার ফোনের কাছে গিয়ে কল করতেই লক্ষ করলেন নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ এখান থেকে কেউ কল করতে পারবে না কোথাও, আবার বাইরে থেকেও কেউ ক্লিনিকের ভেতর যোগাযোগ করতে পারবে না। ক্লিনিকে আরো ৩টি টেলিফোন আছে। মোবাইল ফোন এখানে নিয়ে আসা নিষেধ। ডাক্তার মামুন দ্রুত বাকি টেলিফোন গুলোর কাছেও ছুটে গেলেন। সব টেলিফোনেরই একই অবস্থা। এখন কোনো বিপদ হলে কারো কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার আশাটাও নষ্ট হয়ে গেল তাহলে। ডাক্তার মামুনের ইচ্ছা করলো ছুটে এই মুহূর্তে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে যায়! আর কোনোদিন এদিকে আসবেন না। কিন্তু সতীর্থদের এই কথা তিনি কী করে বলবেন। তাছাড়া একটা বাচ্চা মেয়েকে এরকম বিপদগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়ার কোনো মানে নেই। আবার যেখানে দুজন নার্স এবং একজন পেশেন্ট মর্গের ভেতর ৪টি লাশের সাথে আটক পড়ে রয়েছে। তিনি চেকআপ রুমে ঢুকে ডাক্তার অমিত এবং আমিনকে টেলিফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে বললেন। তারা উদ্ভ্রান্তের মতো একে অপরের দিকে তাকালেন। কিছুই বলার ভাষা নেই তাদের। তারপর মেয়েটার দিকে মনোযোগ দিলেন। ডাক্তার অমিত বললেন, ‘যাই হোক না কেন, আরেকবার অল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে আমরা মেয়েটার অপারেশন করে ফেলি। আমার মনে হয় ভয়ানক এই মেয়েটাকে কোনো একটা উদ্দেশ্যেই এই গর্ভপাতের ক্লিনিকে পাঠানো হয়েছে। আমরা একমাত্র সফল গর্ভপাত করেই মেয়েটাকে এবং এই ক্লিনিকের সবাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবো হয়তো। নাহলে হয়তো সময় গড়ানোর সাথে সাথে মেয়েটার গর্ভ আরো প্রসারিত হবে। আর মর্গের মেয়েটা বলেছিল, সময় হলে ওরা মেয়েটাকে নিয়ে যাবে। ৭জন মেয়ে যদি রড হাতে বেরিয়ে আসে তখন পরিস্থিতি ভয়ঙ্করের চাইতে ভয়ংকর হবে। তারা এখনো মর্গের ভেতর ভাঙচুর চালাচ্ছে।’ বাকি দুই ডাক্তারও সম্মত হলো। তবে বললেন, আরেকটু অপেক্ষা করি আমরা!
রাত এখন ৩টা ২০ বাজে। ডাক্তার অমিত ক্লিনিকের ভেতরেই এদিক, সেদিক হাঁটাহাঁটি করছেন। অবশ্যই নির্জন পরিবেশ, কিন্তু এই নির্জনের ভেতরেও কেন যেন আরো নির্জন লাগছে এই মুহূর্তে ক্লিনিকটাকে। হঠাৎই তিনি খেয়াল করলেন, মর্গের ভেতর থেকে আসা শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। তার মনে হতে লাগলো এখুনি মর্গের দরজা খুলে ৭জন মেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসবে। চারদিকে তাকালেন তিনি। ক্লিনিকের একজন নার্স আর স্টাফকেও কোথাও দেখতে পেলেন না। দ্রুত এদিক সেদিক খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। আশ্চর্য্য, এরাও সব উধাও হয়ে গেল নাকি! কিছুক্ষণ ধরেইতো কারো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তার অমিত দ্রুত চেকআপ রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ডাক্তার অমিতকে ঘরে ঢুকতে দেখে ডাক্তার মামুন বললেন, ‘দেখলেন মর্গ থেকে ভাংচুরের শব্দ থেমে গেছে! এতক্ষন টাইলস ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। ওরা কী মাটির নিচ থেকে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছিল? আর পেয়েই থেমে গেছে? নাকি এখনই সময় হয়ে গেছে এই মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার? ওরা বেরিয়ে আসবে!’ ডাক্তার অমিত কম্পিত গলায় বললেন, ‘ক্লিনিকে এই মুহূর্তে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই! বাকি স্টাফ, নার্সরাও উধাও হয়ে গেছে।’ ডাক্তার আমিন বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘মানে কী?’
তিন ডাক্তার উদ্বিগ্ন হয়ে আবার ছুটোছুটি করা আরম্ভ করলেন। এই ক্লিনিকে মোট নার্স আছে ৬জন মেয়ে। দুইজন পুরুষ সিকিউরিটিতে। আর ২জন স্টাফ নানান কাজ দেখার জন্য। দুজন নার্স এরমধ্যেই মর্গের ভেতরে উন্মাদের মতো ভাঙচুর কাজে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। বাকি ৪জন নার্স এবং ৪জন স্টাফ এতক্ষণ ক্লিনিকের ভেতরে তাদের সাথেই ছিল। কিন্তু এই কয়েক মুহূর্তে তারাও উধাও হয়ে গেল কী করে! ক্লিনিকের কোথাও তাদের পাওয়া গেল না। তিন ডাক্তারের কারোই মর্গ রুমের ভেতরে গিয়ে খুঁজে দেখার সাহস অবশ্য হলো না। ওখানে গিয়ে তারাও কী যুক্ত হয়েছে! হয়তো রহস্যময় কোনো কারণে বাকি নার্স আর স্টাফরা উধাও হয়ে গেছে বা ক্লিনিকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সকলে একত্রে ক্লিনিক থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু ডাক্তারদের না বলে যাবে কেন!
ঘোলা ঘোলা লাগছে সবকিছু। ক্লিনিক থেকে বের হওয়ার একমাত্র দরজার সামনে গিয়ে হাজির হলেন তারা। দরজাটা লক করা, এর চাবি সিকিউরিটির লোকটার কাছে ছিল। সেই লোক দুজন ছাড়া এখন তাদের ক্লিনিক থেকে বের হওয়ারও কোনো পথ নেই। রক্ত হিম হয়ে গেল তাদের। সেই হিম হওয়া রক্তে ঠাণ্ডা বাতাস দেওয়ার জন্যই ভেসে এলো যেন শব্দগুলো। অনেকজন মানুষের ফ্লোরে হাঁটাহাঁটি করে এগিয়ে আসার শব্দ। শুধু মানুষের পায়ের আওয়াজ না, এর সাথে যুক্ত হয়েছে মেঝেতে লোহার রড ঠোকার ভারী শব্দও! ………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana