#নাগিন_কন্যা
৮ম এবং শেষ পর্ব
চন্দ্রের ১৯ বছর পূর্ণ হতে আর এক সপ্তাহ বাকি। দিনটার হিসাব চন্দ্র , সাপ সাম্রাজ্য আর ওঝা মালেক, সবাই রাখছে। ওয়ালিপুর গ্রামের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। সাপের উপদ্রব ভয়ঙ্কর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে দিনে-রাতে কেউই জঙ্গলের ভেতর যায় না। ওটা যেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে নানা রকমের সাপেরা। ওদের আক্রমণাত্মক ভাব অবশ্য কমে গেছে , জঙ্গলের ভেতর গিয়ে ওদের বিরক্ত না করলে ওরা এখন আর ওৎ পেতে মানুষকে কামড়ায় না। কয়েকজন প্রচণ্ড কৌতূহলী মানুষ দিনের বেলায় চুপিসারে জঙ্গলে ঢুকে পরিস্থিতি আন্দাজ করার চেষ্টা করে। যা দেখে তাতে এদের পুরো শরীর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
গাছ , ঝোপঝাড় , মাটির ঢিবি , মাটি সব জায়গায়ই সাপ গিজগিজ করছে। কয়েকটা ওরা চেনে , কেউটে , খৈয়া গোখরা , কালাচ , শাঁখামুটি , অজগর , শঙ্খচূড়। কিন্তু অধিকাংশ সাপের প্রজাতিই তাদের অচেনা। ওগুলোকে দেখেই শরীর কেমন শিরশির করে ওঠে।
গ্রামে একের পর এক সাপুড়ে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল। পরিকল্পনা করছিল কী করে সাপগুলো বন্ধি করা যায়। একদিন সকালে মুখে ফেনা ওঠা অবস্থায় যার যার ঘর থেকে ৪ জন সাপুড়ে কে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। শোনা যায় লুকিয়ে নাকি এরা জঙ্গলে ঢুকে সাপ বন্ধি করে এনেছিল। ভালো করে আটকানোর পরেও কী করে ওগুলো ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে সাপুরেদের বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছে। আতঙ্কিত হয়ে গেল বাকি সাপুরেরা। বিষধর সাপ ধরে চড়া মূল্যে বিক্রি করার আশা মিইয়ে যেতে লাগলো।
একই কাজ করতে গিয়ে আরো কিছু সাপুড়ে একই ভাবে মারা গেলে বাকিরা আতঙ্ক , ভয় এবং হতাশা নিয়ে এলাকা থেকে চলে গেল।
চন্দ্র এখন পূর্ণ যুবতী একটা মেয়ে। তার সম বয়সী আর সব মেয়েদের থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছে মুখ দিয়ে মানুষের শরীর থেকে বিষ নামানোর ক্ষমতা। তাকে সবাই এর জন্য ভক্তি-শ্রদ্ধা করে যা তার ব্যক্তিত্বে একটা গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে। তাছাড়া অদ্ভুত সেই রাত , নিজে একজন ইচ্ছাধারী নাগিন সে , ১৯ বছর পূর্ণ হলেই সে এই পৃথিবী ছেড়ে সাপ সাম্রাজ্যে চলে যাবে এইসব চিন্তা তাকে আরো বেশি উদাস করে তোলে। মানুষের সঙ্গে সাধারণ ভাবে মেশার ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার ভেতর থেকে। যেই কয়জন সাথী ছিল তার তাদেরও প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেছে। সে খুবই নিঃসঙ্গ বোধ করে। চন্দ্রের দাদি এত বছর পর্যন্ত চন্দ্রের এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার কারণে তার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করেননি। কিন্তু আজকাল তিনি বিছানায় পড়া, গ্রামে এমন সাপের ভয়াবহ উপদ্রব , তারমনে আতংক সৃষ্টি করে ফেলেছে। তিনি চন্দ্রের বিয়ের বিষয়ে নানান পাত্রের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন লোক মারফত। চন্দ্র সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে সে বিয়ে করবে না , তবুও তার দাদি তাকে রাজি করাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছে না।
চন্দ্রের রূপ , অলৌকিক ক্ষমতা যেকোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করবে। চন্দ্র রাজি হয়ে গেলে তার জন্য পাত্র খুঁজে পাওয়া খুব একটা কষ্টের হবে না। চন্দ্র বিয়ের কথা শুনে ক্ষেপে যায়। কারণ সে তার সম্পর্কে এমন কথা জানে যা তার দাদি জানে না। সে যে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক সাপ , অন্য সাধারণ মেয়ে থেকে সে পৃথক এই তথ্য কোনোদিন কাউকে সে জানাতে পারবে না। এর আগেই হয়তো তাকে সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এক সময় তার মনে হয়েছিল তার পিতা-মাতা পরিচয় দিয়ে যে সর্প নর-নারী তাকে সাপ সাম্রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন , তাকে তার জন্মের ইতিহাস বলেছিলেন সবটাই কল্পনা বা স্বপ্ন ছিল তার। বাস্তবে এমন কিছুই হবে না। কিন্তু ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন নিকটে আসতেই সে তীব্র ভাবে অনুভব করছে সবটাই বাস্তব ছিল। সে ইচ্ছাধারী নাগিন। তার নিয়তি অবস্থান করছে সাপ সাম্রাজ্যে , তার সর্প পিতা-মাতার সাথে। আরো আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে গত কয়দিন আগে গভীর রাতে সেই সর্প নারীকে আবার সে দেখেছে তার বিছানায় মাথার পাশে বসে আছে। সে চোখ খুলতেই দেখলো সাপের ফণার আকৃতির মাথাটা তার দিকে ঝুঁকে আছে। আতঙ্কের সাথে বড় বড় চোখ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সে। অন্ধকার ঘরে ওটার মাথার উপরে থাকা পাথর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে । তার সর্প মাতা তাকে আসন্ন তার জন্মরাত সম্পর্কে সচেতন করে দিলেন।
জানালেন , চন্দ্র তাদের সাম্রাজ্যের আর সব নাগিনের মতো নয়। সে একই সঙ্গে মানুষ এবং সাপ দুই সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই বড় সড় একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে দুই জগতের সাপেদের ভেতর চন্দ্রের জন্মরাতে। মানুষের সমাজের সাপেরা ঘোর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে চন্দ্রের ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার রাতে সাপ সাম্রাজ্যের অসংখ্য সাপের এই গ্রামে প্রবেশ ঘটবে এই বিষয়ে। এতে দুই সাম্রাজ্যের দেয়ালের আইনের ব্যতিক্রম ঘটছে। তাই আশেপাশের হাজার হাজার সাপ জড়ো হয়েছে ওয়ালিপুরের জঙ্গলে। চন্দ্রের ১৯ বছর পূর্ণ হলে সাপ সাম্রাজ্য থেকে কয়েক হাজার সাপ উদয় হবে ওকে ঐ জগতে নিয়ে যেতে , তখনই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার সাপ। আক্রমণ করে বসবে নাগ রাজ্য থেকে আসা সাপদের উপর। দুই সাম্রাজ্যের সাপের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হবে।
এটা চলতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত , যতক্ষণ না চন্দ্র এই জগৎ ছেড়ে সাপ রূপ নিয়ে তার সর্প পিতা-মাতার সঙ্গে ওদের সাম্রাজ্যে চলে না যাবে। এরপর সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। চন্দ্রের জন্মের আগে যেমন স্বাভাবিক ছিল সবকিছু , ঠিক তেমন।
এই যুদ্ধ নিয়ে চন্দ্র চিন্তিত এবং তার যে এই জগৎ ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই এটা নিয়েও তার আতঙ্কের শেষ নেই। অপেক্ষা করছে জন্মরাতের। যে রাতে তার ১৯ বছর পূর্ণ হবে। ভয়ঙ্কর পূর্ণিমার সেই রাত!
পিশাচির কাছ থেকে সেই ভয়ঙ্কর পূর্ণিমা রাতের সমস্ত বর্ণনাই জানা আছে ওঝা মালেকের। সে সম্পূর্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সেই রাতে তাকে চন্দ্রের বাড়ির আশেপাশে থাকতে হবে। মানুষের জগতের সাপ আর রহস্যময় অন্যভূবনের সাপ দুইটা থেকেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। পূর্ণিমার রাতে তার পোষা পিশাচ সাপটার সমস্ত ক্ষমতা উবে যায়। তাই ওটা তার কোনো কাজেই আসবে না। অবশ্য দুই শক্তিশালী সাপের দলের যুদ্ধের মাঝে ওটা করতই বা কী! ওদের সংখ্যা এতই বেশি হবে যে একটা একটা করে ওগুলোকে মেরে চন্দ্রের কাছে পৌঁছাতে কয়েক সপ্তাহ লাগবে। অপেক্ষা করছে সে সেই মহা রাতের।
পূর্ণিমার রাত। চারিদিকে ভরা জ্যোৎস্না। জঙ্গলের সবচেয়ে কাছে বাড়ি আমজাদ আলির। সে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে তার। তার স্ত্রী আর ৮ বছরের ছোট মেয়েও এই শব্দে উঠে গেছে। কিসের শব্দ হচ্ছে বাইরে ! জঙ্গলের দিক থেকে আসছে মনে হচ্ছে , ঝড়ের শব্দ। সাপের ভয় থাকায় দৌড়ে বের হওয়ার ইচ্ছা দমন করলো আমজাদ , ধীরে সুস্থে হারিকেন জ্বালিয়ে লাঠি হাতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। যদিও বাইরে ফকফকা চাঁদের আলো। তার ছোট ভাই আলী হোসেনও বউ সহ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একটু সামনে বের হতেই জঙ্গলটা পরিষ্কার দেখা গেল। এটা কী দেখছে তারা, চোখের ধান্ধা নাকি! একটা ছায়ার স্তর যেন ছুটে আসছে এইদিকে! কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো ওগুলো সব সাপ।
অনেকগুলো সাপ , সংখ্যায় শয়ে শয়ে হবে ছুটে আসছে এই গ্রামের দিকে। অবিশ্বাস্য! চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল বাড়ির সবাই এক যোগে। একটা ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দিল। ঝড়ের শব্দ আরো বেড়ে যাচ্ছে , মানে সাপের দলটা মাটি কাঁপিয়ে আরো কাছে চলে আসছে। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো ঘরের সবাই। জন্মের ইতিবৃত্তে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি এরা কেউ। এও কি সম্ভব! তাদের বাড়ির ভেতরে একটা সাপও ঢুকলো না। ওগুলো বাড়ি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। গ্রামের কারো ক্ষতি কিংবা কাউকে আক্রমণ করার কোনো ইচ্ছা ওদের নেই। ওরা ছুটে যাচ্ছে চন্দ্রের বাড়ির দিকে। ভিন্ন জগতের যেই সাপগুলো এই জগতে এসে ভারসাম্য নষ্ট করছে ওগুলোকে শায়েস্তা করতে। হ্যা , আজই সেই রাত যেরাতে চন্দ্র ইচ্ছাধারী ক্ষমতার অধিকারী হবে।
ক্রমে ক্রমে এই শব্দ পুরো গ্রামময় ছড়িয়ে পড়লো। সবাই আতঙ্কিত হয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পথ দিয়ে এই হাজার হাজার সাপকে ছুটে যেতে দেখে আতংকেই যেন মরে যাবে। হুস আসা মাত্রই দরজা-জানলা আটকিয়ে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গেল সবাই। কয়েকজন মূর্ছা গিয়ে উঠানেই পরে রইলো। তাদের কোনো ক্ষতিই করলো না সাপগুলো। ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে দলটা। পুরো গ্রামের সবাইই নিজেদেরকে ঘরের ভেতর বন্ধি করে ফেললো। এই অভিশপ্ত রাতে গ্রামে কী ঘটে গেল তা দেখার অধিকার তাদের দেওয়া হয়নি।
সাপের দলের মাথায় রয়েছে শ’খানেক শঙ্খচূড়, গোখরা। ওগুলো হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো নগ্ন এক পুরুষ মানুষকে তাদের দিকে তাকিয়ে তাদের পথের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে থাকতে দেখে। লোকটার বাম হাত এবং বাম কান কাটা। কোমরে জড়িয়ে আছে একটা মৃত কালাচ সাপ। দুই হাতে পেঁচানো আছে দুটো মৃত শঙ্খিনী , দুই পায়ে দুটো মৃত পদ্ম গোখরা , কপালে পেঁচিয়ে আছে একটা জীবিত শঙ্খচূড়, হিস হিস করছে ওটা নিজের শরীর কাঁপিয়ে। সাপের বড় দলটা থমকে দাঁড়িয়েছে একসাথে। তারা এমন একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছিল না। এটা তাদের পরিচিত জগতেরই একজন মানুষ। এর সঙ্গে কী করা উচিত দ্বন্দ্বে আছে যেন তারা!
ওঝা মালেকের শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এতগুলো সাপ একত্রিত হয়ে দল তৈরি করেছে এক যুদ্ধের জন্য। পিশাচিতো তাই বলেছিল, তবুও। সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করে কম্পন সৃষ্টি করতে লাগলো। মুখ উপরে তুলে অদ্ভুত একটা সুর তৈরি করলো কণ্ঠ দিয়ে। প্রায় ১৫ মিনিট কাজটা করেই ছুট লাগালো সে চন্দ্রের বাড়ির দিকে। আতঙ্কে আছে সে, কাজটা যদি সঠিক ভাবে না হয়ে থাকে তাহলে এখন পেছন থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়বে সাপগুলো। মৃত্যু নিশ্চিত তার।
না! ওগুলো তার উপর আক্রমণ করেনি। তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছে সামনের দিকে। তার কদম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে। মানে সে প্রমাণ করতে পেরেছে সে তাদের বন্ধু , তাদের দলেরই লোক। তাদের হয়ে , মানুষ সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি সে যে তাদের সঙ্গে অন্য জগতের সাপের সঙ্গে লড়বে। এইতো আর বেশি দূরে নয় চন্দ্রের বাড়ি। ছুটছে কয়েক হাজার সর্প নিয়ে ওঝা মালেক।
চন্দ্রের দাদি অচেতন হয়ে পড়ে আছে তার বিছানায়। সেই রাজ নাগ-নাগিনের প্রবেশ ঘটেছে চন্দ্রের বাড়িতে। সর্প নারী একটি গন্ধক দিয়ে অচেতন করেছেন তার দাদিকে। তার যখন ঘুম ভাঙবে , চন্দ্র তখন বসবাস করবে অন্য জগতে। রাতের এই ভয়াবহতার বিন্দুমাত্রও অনুমান করতে পারবেন না তিনি।
চন্দ্রও ঘুমিয়ে আছে গভীর ঘুমে। তাকে ঘিরে আছে সেই রাজ নাগ আর নাগিন। তিনজনের কপালের দিকেই সেই সুন্দর পাথর ঠিকরে আলো বেরোচ্ছে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা টিকে থাকতে হবে ওদের। তারপরেই চন্দ্র ইচ্ছাধারী রূপ পাবে। তখন ফিরে যাবে ওরা ওদের জগতে। আর তারা চলে গেলেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যুদ্ধ থেমে যাবে দুই সাম্রাজ্যের সাপের ভেতর।
ওঝা মালেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরও দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার কাছে । চন্দ্রের পুরো বাড়ি ঘিরে রয়েছে হাজারের উপর নানান জাতের সাপ। সাপগুলো যে তার সঙ্গে আসা সাপগুলোর বিপরীত দলে সেটা ওদের অবস্থান করার ধরন দেখেই যেন সে আন্দাজ করতে পারছে। একই রকম মানুষ দুটো দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করলেও যেমন তাদের প্রভেদ বোঝা যায় , একই রকম সাপগুলো দেখতে হলেও পার্থক্যটা নজরে এলো মালেকের। এইতো ভয়াবহ সেই যুদ্ধের সূচনা! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেই এক ফাক দিয়ে তাকে পৌঁছুতে হবে চন্দ্রের ঘরে। ইচ্ছাধারী ক্ষমতা পাওয়া মাত্রই হত্যা করতে হবে ওকে।
সে দ্রুত এক কিনারে ছুটে গিয়ে আড়াল নিলেন। পিশাচি বলেছিল সাপ সাম্রাজ্যের সাপগুলো এই রাতে শুধুই অন্য সাপকে হত্যা করবে। কোনো মানুষকে হত্যা করার নির্দেশ সর্প রাজ আর রানী দিবেন না। তাই অনায়াসেই সে চন্দ্রের ঘরের কাছে পৌঁছুতে পারবে। আর অন্য দল সাপতো তার বন্ধুই এখন। চোখের পলকে দুটো সাপের দল মুখোমুখি হলো। একটা অন্য ভুবনের সাপ যারা চন্দ্রকে তাদের ভুবনে গ্রহন করতে এসেছে , আরেকটা দল এই ভুবনের , তারা ভাবছে ওরা ওদের জগৎ দখল করে ভারসাম্য নষ্ট করতে এসেছে। ওদের জন্য এটা অস্তিত্বের লড়াই। একটি সাপ ঝাঁপিয়ে পড়লো অপরটির উপর। কামড়ে ধরছে ধর। একটা পেঁচিয়ে ধরছে অপরটিকে , চাপ দিয়েই মেরে ফেলতে চাইছে আরেকটাকে। দুই দলেই সমানে সাপ মরতে লাগলো। পুরো জায়গা জুড়ে গিজগিজ করছে হাজার হাজার সাপ। একটা অপরটার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। ক্ষেপে আছে সবগুলো। দুই সাপ সাম্রাজ্যের মধ্যে এমন লড়াই পৃথিবীতে এর আগে ঘটেনি। এটাই দুই সাম্রাজ্যের ভেতর ঘটা বিশৃঙ্খলার সূচনা।
পা বাড়াবে হঠাৎ মালেক টের পেল তার বাম পাশে ঝোপের পেছন থেকে কিছু একটা নড়ছে। অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো সে। দুটো শঙ্খচূড় বেরিয়ে এলো ঝোপের ভেতর থেকে। আৎকে উঠলো মালেক। এরা কী ভিন্ন কোনো দলের! মনে হচ্ছে তার জন্যই ওৎ পেতে ছিল ওখানে! যত দ্রুত সম্ভব চন্দ্রের ঘরের কাছে পৌঁছুতে হবে তাকে।
তাকে চমকে দিয়ে সাপ দুটো ধীরে ধীরে দুটো মানুষে রূপান্তরিত হলো। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো মালেক। দুটো কিশোরী। এমন অপরূপ কিশোরী সে আগে জীবনেও দেখেনি। এরাও তো ইচ্ছাধারী নাগিন! চন্দ্রের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো অনেক বিপদের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। তাছাড়া চন্দ্রকে হত্যা করলে অনেক বড় একটা সাম্রাজ্যের সাথে শত্রুতাও করা হবে। এদের সাধারণ নাগিন মনে হচ্ছে। এদের শরীরও সেই মহা ঔষধ তৈরিতে একই ভূমিকা রাখবে। তাহলে কষ্ট করে চন্দ্রের কাছে যাবে কেন ! কিশোরীরা তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেললো। নগ্ন দুই কিশোরীকে দেখে এতই মগ্ন হয়ে গেল মালেক যে ভুলেই গেল পিশাচির সেই সতর্কতা। কোনো মায়াতেই জড়ানো যাবে না। এই রাতে লোভী মানুষদের জন্য আছে মহা মহা মায়ার ফাঁদ।
দুইজন কিশোরী আবার সাপে রূপান্তর হয়ে ঝোপের আড়াল দিয়ে ছুটে চললো পুকুরের দিকে। ওঝা মালেক পিছু নিল তাদের। লোভে চকচক করছে তার চোখ। শরীরে জড়ানো মৃত , জীবিত সাপগুলো খুলে ছুড়ে ফেলল দূরে। ছুটলো সাপগুলোর পিছু। ওরা সাধারণ সাপ নয় , ওদের কোনো নিয়ম , আইন নেই। কেবল বড় কোনো শত্রুকে মায়ায় ফেলে হত্যা করার জন্যই তাদের পাঠানো হয় সেই অন্ধকার , গোপন , রহস্যময় সাপ সাম্রাজ্য থেকে!
পরদিন সকালে পুরো গ্রামে হৈচৈ পরে গেল। চন্দ্রের বাড়ির আশেপাশে শয়ে শয়ে মৃত সাপ পরে আছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য ছিল এটা সবার কাছে। আতংক যেন কিছুতেই কাটছিল না কারো। চন্দ্রের দাদি কেঁদে কেটে অস্থির। তিনি অনুমান করছেন চন্দ্রের বড় কোনো বিপদ হয়েছে। পুরো গ্রাম খুঁজেও চন্দ্রকে আর পাওয়া গেল না। চন্দ্রকে আর কোনোদিনও এই গ্রামের লোকেরা দেখতে পায়নি। চন্দ্রের বাড়ির পাশের পুকুরে ওঝা মালেকের মৃত লাশ ভাসতে দেখা যায়। সেই দিনের পর থেকে ওয়ালিপুর গ্রামে সাপের উপদ্রব একেবারেই কমে যায়। পুরো বিষয়টাই একটা ঘোলা রহস্য হয়ে থাকে গ্রামের মানুষদের কাছে।
চন্দ্রের দাদি মারা যায় তার এক বছর পরেই। গ্রামের এক ছোট্ট মেয়ে দাবি করে একটা অদ্ভুত দর্শন সাপকে নাকি একদিন সে চন্দ্রের দাদির কবরের উপর বসে থাকতে দেখেছিল!
• * * * সমাপ্ত * * *
লেখা: #Masud_Rana