মেহের,সূচনা পর্ব
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
জানুয়ারির চৌদ্দ তারিখ। শীতের প্রকোপে লেপের নিচ থেকে বের হওয়া আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার তফাত আমার কাছে নেই বললেই চলে। তবু বেরোতে হলো। মা নামক মানুষটার তো আবার আমার ঘুমের সাথে চিরকালের শত্রুতা। একটামাত্র সকালে দশবার কানের আছে এসে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য চেঁচায়। আমিও এক ঝুড়ি বিরক্তি নিয়ে উঠে সোয়েটার, শাল সামনে যা পাই তাই দিয়ে প্যাকেট হয়ে ফ্রেশ হতে চলে যাই। ব্রাশ করে কোনোরকমে মুখ ধুয়ে যত দ্রুত পারি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। শীতকালে এটা আমার প্রতিদিনকার রুটিন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই আমার চোখ চড়কগাছ। আজ এত বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি! হায় হায়! সাড়ে নয়টায় আমার ক্লাস শুরু। অলরেডি নয়টা বেজে গেছে। না জানি আজ বাবার কত বকুনি খেতে হবে। ব্রেকফাস্টের কথা ভুলে তাড়াহুড়ো করে রেডি হতে লেগে পড়লাম। হিজাব পরার সময় মায়ের ডাক পড়ল।
“মেহের, ক্লাস টাইম হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি খেতে আয়।“
মায়ের ডাক শুনে হিজাবটা তড়িঘড়ি করে পরে ছুটে এসে খাবার টেবিলে বসে পড়লাম। মা খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“আপু খাবে না?”
মা মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলো,
“জানি না।”
“ডাকোনি?”
“ডেকেছিলাম, বলল পরে খাবে।”
“ও তো সকালে এত দেরি করে খায় না। আচ্ছা আমি ডেকে আনছি।”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে বাবা কর্কশ গলায় বলে উঠল,
“নিজের চিন্তা করো। অন্য কারো খাবারের খবর নিতে হবে না তোমায়। যার ইচ্ছা খাবে, যার ইচ্ছা খাবে না। আমার বাড়িতে অত আহ্লাদ চলবে না।”
বাবার ধমকিতে আমি হালকা কেঁপে উঠলাম। অসহায় দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে আবার নিজের চেয়ারে বসে পড়লাম। মায়ের মুখটাও শুকিয়ে গেল। থমথমে গলায় আমাকে বলল,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে কলেজে যা।”
আমি কোনোমতে একটা রুটি শেষ করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
“একটা রুটি খেলি যে? বাকিটা কে খাবে?”
আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা।”
“আচ্ছা যা।”
বাবার অনুমতি পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি সোফা থেকে ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটলাম। ঘুম থেকে এত দেরিতে উঠেছি, তবু বাবা বকলো না ভেবে বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম। গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই হালকা রোদের আলোকরশ্মি এসে চোখে লাগল। অথচ কিছুমাত্র তাপ নেই। দ্রুত গতিতে রাস্তার পাশ ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটা বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেইটে বাঁ পাশের সামনের মুদি দোকানী আমাকে দেখামাত্র এগিয়ে এলেন। একগাল হেসে বললেন,
“কী গো মা জননী? কেমন আছো?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি কাকা। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। প্রত্যেকদিন পারমিতার লাইগা অপেক্ষা করতে বিরক্ত লাগে না তোমার?”
“বিরক্ত তো লাগেই। প্রত্যেকদিন এভাবে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কার ভালো লাগে বলেন? কিন্তু ওকে রেখে একাও তো যেতে পারি না।”
“মাইয়াডা একটু বেশি অলস। ওর আলসেমির লাইগা তোমার কষ্ট কইরা দাঁড়ায়া থাকতে হয়।”
আমাদের কথার মাঝেই হামি তুলতে তুলতে সেখানে উপস্থিত হলো পারমিতা। আমাকে দেখে অলস ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কতক্ষণ ধরে এসেছিস?”
আমি পারমিতার হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বললাম,
“ওসব জেনে কী করবি তুই? অলস মাইয়া! ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি চল।”
“তুইও তো ঘুম থেকে উঠতে চাস না।”
“এছাড়া কোনো কিছুতে আমি তোর মতো অলস না। ঘুম থেকে দেরিতে উঠেও তো আমি এসে তোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।”
তাড়াহুড়ো করে হেঁটে কলেজের গেইটের সামনে আসতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম। আবার সেই লোকটা! এমনিতেই আজ বেশি দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর আবার সেই লোকটাকে দেখে আমি অনেকটা বিরক্ত হলাম। অথচ লোকটার মাথায় কি আর সেসব খেয়াল আছে? সে তো আমাকে দেখেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে ক্লোজ আপ মার্কা হাসি দিয়েছে। পারমিতা কপাল চাপড়ে বলল,
“আজ আর ফার্স্ট পিরিয়ডের ক্লাস করা হবে না মনে হচ্ছে।”
আমি সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললাম,
“আজকের ক্লাস খুব ইম্পর্ট্যান্ট। আমি তো করবই।”
পারমিতা দৌড়ে আমার পিছু নিল। সামনে দাঁড়ানো লোকটা দুপা এগিয়ে এসে হাসিমুখে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, আমি তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। পেছন না ফিরে একপ্রকার দৌড়েই ক্লাসের দিকে ছুটলাম।
দুপুর দেড়টায় ক্লাস শেষ করে কলেজের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি, পারমিতা আর মামুলি।মামুলি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আমার ক্রাশ কই রে আজকে?”
আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,
“কে?”
“আরে স্নিগ্ধ ভাইয়া।”
“ছিঃ! শেষমেষ নিজের ভাইয়ের উপর ক্রাশ খাইলি!”
মামুলি হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে বলল,
“ধুর, উনি কি আমার আপন ভাই না কি? উনি তো চাচাতো ভাই। আমি অনেক আগেই ওনারে দেইখা ক্রাশ খাইছি। কিন্তু উনি তো বছরে গুণে গুণে মাত্র দুইবার বাড়ি আসে। ভালোভাবে একটু কথা বলারও সুযোগ পাই না।”
পারমিতা মামুলির মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল,
“ওই মামু, ওইটা তো মেহেরের। আরেকজনেরটার ওপর নজর দেস ক্যান? অশ্লীল মাইয়া!”
মামুলি বিরক্তি নিয়ে বলল,
“পারু, হাত সামলা তোর। তোর মতো তো বাবুসোনা বলার মতো কেউ নাই আমার। তাই অন্যজনরে দেইখাই সন্তুষ্ট থাকি।”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,
“তুই তো বুড়ির মতো দেখতে। তোরে আবার বাবু কইবো কোন বলদে? তুই বাড়ি গিয়া পান খা মামু।”
মামুলি ঠোঁট উলটে বলল,
“বুড়ি কইছোস মাইনা নিলাম। দয়া কইরা মামু মামু করিস না বইন। নিজেরে মেল বইলা মনে হয় আমার। তোদের কারণে ফুসকা ওয়ালাও এখন আমারে দেখলে মামু বইলা ডাক দেয়। আশেপাশের লোকজন সবাই হা কইরা তাকাই থাকে আমার দিকে। ভাব একবার, তোরা আমার মানসম্মান কেমনে প্লাস্টিক সার্জারি কইরা দিছস!”
মামুলির কথায় আমি আর পারমিতা পেট ধরে হাসতে শুরু করলাম। হাসি যেন থামতেই চাইছে না কারোর। মামুলি আমাদের এমন দমফাটা হাসি দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। সে পায়ে শব্দ তুলে রাগে গজগজ করতে করতে উলটো পথে হাঁটা দিলো। পেছন ফিরে তাকালই না আর। আমি আর পারমিতা তবু হেসে চলেছি। পারমিতা হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল,
“মেহের, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। আজকে ওই স্নিগ্ধ নামক প্যারা আশেপাশে নাই। শান্তিতে হাঁটতে হাঁটতে যাইতে পারমু।”
আমিও তাল মিলিয়ে বললাম,
“ঠিক বলছিস। প্রত্যেকদিন ওই লোক বকবক করতে করতে কান দুইটা ঝালাপালা কইরা ফালায়। চল চল, কখন আবার আইসা পড়ে কে জানে! ওই লোকরে দিয়া বিশ্বাস নাই।”
আমি আর পারমিতা সামনের দিকে এক পা বাড়াতেই আমাদের সামনে জোরেশোরে সাইকেলে ব্রেক কষে দাঁড়াল স্নিগ্ধ। দুজন একসঙ্গে হকচকিয়ে উঠলাম। পারমিতা বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“নাম নিতে না নিতেই বান্দা হাজির।”
স্নিগ্ধ মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“শ্যালিকা, বিড়বিড় করে গালি না দিয়ে জোরেই দাও। আমিও একটু শুনি।”
পারমিতা অবাক হয়ে বলল,
“আপনাকে আমি কখন গালি দিলাম?”
“মাত্রই তো দিলে।”
“আমি আপনাকে গালি দেইনি ভাইয়া। আপনি ভুল ভাবছেন।”
আমি বিরক্তভাব নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার আমি পারমিতার হাত টেনে ধরে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। স্নিগ্ধ সাইকেল চালিয়ে আমাদের পাশাপাশি এগোতে লাগল। আমি বা পারমিতা কেউই স্নিগ্ধর দিকে ভুল করেও তাকালাম না। স্নিগ্ধ হঠাৎ প্রশ্ন করল,
“আজ কলেজে ঢোকার সময় ওভাবে এড়িয়ে গেলে কেন?”
আমি না তাকিয়েই গোমড়া মুখে উত্তর দিলাম,
“ক্লাসে দেরি হয়ে গিয়েছিল।”
“তাই বলে একটা কথাও বলবে না? জানো আমি কতক্ষণ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?”
“আমি তো আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলিনি। প্লিজ আপনি আমাদের সাথে আসবেন না।”
স্নিগ্ধ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“তোমাদের সাথে মানে? তোমাদের সাথে যাব কেন আমি? এটা তো আমাদের এলাকা। নিজেদের এলাকায় যেখান দিয়ে ইচ্ছা সেখান দিয়েই আমি চলাফেরা করব।”
আমি রাগ চেপে গম্ভীর গলায় বললাম,
“তাই বলে আমরা যেদিক দিয়ে যাই আপনারও সেদিক দিয়েই যেতে হয়?”
স্নিগ্ধ ভাব নিয়ে বলল,
“আমার ইচ্ছে।”
আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্নিগ্ধও সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,
“এখন আমাদের সাথে থামলেন কেন? কোথায় যাচ্ছিলেন যান।”
স্নিগ্ধ ত্যাড়াভাবে বলল,
“এটাও আমার ইচ্ছে।”
আমি এবার আরও বিরক্ত হয়ে বললাম,
“ঠিক আছে। বুঝলাম, সবই আপনার ইচ্ছে। থাকুন আপনি আপনার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু প্লিজ, এভাবে ননস্টপ কথা বলবেন না।”
স্নিগ্ধ মুচকি হাসল। স্নিগ্ধর হাসি দেখে রাগে আমার গা জ্বলে উঠল। লোকটার হাসি দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো ফানি জোকস শুনিয়েছি। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর মুখে বললাম,
“দেখুন ভাইয়া, আমি আপনাকে এর আগেও বলেছি এভাবে আমার পিছু নিবেন না। এসব যদি কোনোভাবে আমার বাবা জানতে পারে, তাহলে সে আমার বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিবে। আমি বাড়িতে আটকে থাকতে চাই না। প্লিজ একবার বুঝার চেষ্টা করুন। আমার বাবা প্রচন্ড রাগী মানুষ।”
স্নিগ্ধর মুখটাও এবার গম্ভীর হয়ে গেল। গম্ভীর মুখেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো তোমাদের এলাকায় ঢুকলেও বাড়ির দিকের রাস্তায় যাই না। তার আগেই উলটো পথে আবার চলে আসি। তাহলে তোমার বাবা জানবে কীভাবে?”
“বাবার কানে আমাদের কথা পৌঁছানোর মতো মানুষের অভাব নেই।”
স্নিগ্ধ হয়তো বুঝতে পারল সে বোকার মতো প্রশ্ন করেছে। ঠিকই তো, আমার বাবা না দেখলেও অন্য কারো থেকে শুনতে পারে। স্নিগ্ধ মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে বলল,
“বুঝলাম।”
আমি আর কোনো কথা না বলে পারমিতাকে নিয়ে আবার হাঁটা দিলাম। এবার আর স্নিগ্ধ আমাদের পিছু নিল না। মাত্র দশদিন আগে আমার সাথে স্নিগ্ধর দেখা হয়েছিল। হঠাৎ করেই দেখাটা হয়েছিল। স্নিগ্ধ এবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। গতমাসেই সে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে। আসার পর থেকে সে খুব একটা বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পায়নি। তার বাড়ি আসার খবর শুনে একের পর এক আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এসেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে স্নিগ্ধ রাজশাহী যাওয়ার পর থেকে বছরে মাত্র দুবার বাড়ি আসতো, তা-ও শুধু দুই ইদে। ইদ কাটাতে বাড়িতে এসেও মাত্র সাতদিন পার হতে না হতেই আবার রাজশাহী পাড়ি জমাতো। স্নিগ্ধ বছরে দুবার বাড়ি আসতো শুধু তার বাবাকে দেখার জন্য। তার জেএসসি পরীক্ষার আগেই তার মা হঠাৎ এক বাস দুর্ঘটনায় পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুর মাত্র ছয়মাস পরেই তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু স্নিগ্ধ নিজের মায়ের জায়গা সৎ-মাকে দিতে পারেনি। তবে সে যে চেষ্টা করেনি সেরকম নয়। স্নিগ্ধ চেষ্টা করেছিল সৎ-মাকে আপন করে নেওয়ার। কিন্তু তার সৎ-মা শুরু থেকেই তাকে দুচোখের বিষ মনে করতেন। স্নিগ্ধর বাবা তার সৎ-মায়ের ওপরে একটা কথাও বলতে পারতেন না। স্নিগ্ধর ধারণা বাবাকে তার সৎ-মা কোনোভাবে বশ করে নিয়েছে। একরকম জেদ করেই জেএসসি পাসের পর সে রাজশাহী নিজের মামার বাড়ি চলে গিয়েছিল। তার মামা-মামি দুজনেই খুব ভালো মনের মানুষ। তাদের শুধু স্নিগ্ধর চেয়ে দশ বছরের ছোটো একটা মেয়ে আছে। ছেলে না থাকায় স্নিগ্ধকে তারা নিজেদের ছেলে ভেবে নিয়েছিলেন। মামা-মামির প্রচন্ড আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছে স্নিগ্ধ। মামার বাড়িতে থেকেই স্নিগ্ধ মাস্টার্স শেষ করেছে। দুই ইদে বাড়িতে এসেও স্নিগ্ধ খেয়াল করত, সে যতদিন থাকে ততদিন তার সৎ-মায়ের মুখে এক চিমটিও হাসি থাকে না। কিন্তু তার সৎ-বোনটা তাকে খুব ভালোবাসে। অথচ এই বোনটা তার সৎ-মায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে। রক্তের সম্পর্ক নেই, তবু স্নিগ্ধর প্রতি মেয়েটার সেকি টান! বোনের হাসবেন্ড ওপরে ওপরে স্নিগ্ধর সাথে ভালো ব্যবহার করলেও ভেতরে তার সৎ-মায়ের মতোই। স্নিগ্ধর বাবা জানতেন তার ছেলে বাড়িতে থাকতে চায় না। তাই তিনি কখনও ছেলেকে বাড়িতে থাকতে বলতেন না। বরং নিজেই মাঝে মাঝে রাজশাহী গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতেন। কিন্তু এবার স্নিগ্ধ লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি এসেছে বলে তার বাবা হঠাৎ জেদ ধরে বসেছেন যে, তাকে কয়েকমাস এখানে থাকতে হবে। যদিও স্নিগ্ধর কোনো ইচ্ছেই ছিল না বাড়িতে থাকার। সে ভেবেছিল এক সপ্তাহ পরেই চলে যাবে। কিন্তু বাবাকে এই প্রথম এত অনুরোধ করতে দেখে কিছুটা বাধ্য হয়েই সে থাকতে রাজি হয়েছে। আজ থেকে ঠিক দশদিন আগে এলাকার স্কুল মাঠে হাডুডু খেলার আয়োজন করা হয়েছিল। স্কুলে থাকতে স্নিগ্ধ তার বন্ধুদের সাথে হাডুডু খেলত। এলাকার কিছু ছেলেরা স্নিগ্ধকে তাদের সাথে খেলার জন্য অনুরোধ করেছিল। স্নিগ্ধ সঙ্গে সঙ্গে না করে দিলেও পরে ছেলেদের জোরাজুরিতে খেলতে রাজি হয়েছিল। সেদিন খেলার মাঠে খেলা চলাকালীন হঠাৎ স্নিগ্ধর চোখ আটকে গিয়েছিল মাঠের এক কোণে দাঁড়ানো আমার দিকে। আমি তখন পারমিতার এক হাত চেপে ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খেলার দিকে আমার মনোযোগ ছিল না। বারবার পারমিতার হাত ঝাঁকিয়ে কিছু বলে অনুরোধ করছিলাম। দেখেই বুঝা গিয়েছিল আমি নিজের ইচ্ছেতে খেলা দেখতে যাইনি। পারমিতা জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন না কি হঠাৎ করেই আমি স্নিগ্ধর মনে জেঁকে বসেছিলাম। আমি চোখ ধাঁধানো সুন্দর না। শ্যাম ফরসা গায়ের রং। কিন্তু আমার চেহারায় না কি কেমন একটা মায়া মিশে আছে। সেই মায়াজালেই আটকে গেছে স্নিগ্ধর পুরুষালি মন। স্নিগ্ধর ভাষ্যমতে সবচেয়ে মায়াবী আমার টানা টানা চোখ দুটো। চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধর মন তাতেই আটকে গেছে। স্নিগ্ধ ভাবে, শ্যাম ফরসা মেয়েরাও না কি সুন্দর হয়? আমি ধবধবে ফরসা না হয়েও আমার চেহারায় লাবণ্য মিশে আছে। এসব বর্ননা স্নিগ্ধতা দেওয়া। এলাকায় স্নিগ্ধর যে স্কুল ফ্রেন্ড আছে তাদের থেকে সে আমার খোঁজ নিয়েছে। তার পরদিন থেকেই আমার পিছু নিয়েছে। আর এ সবকিছুই আমি জেনেছি মামুলির থেকে। মামুলি স্নিগ্ধর চাচাতো বোন হওয়ার সুবাদে স্নিগ্ধ মামুলির কাছে সব কথা খুলে বলেছে। আর মামুলি এসে বলেছে আমাকে। অবশ্য স্নিগ্ধও সোজাসুজি বলেছিল যে, সে ওইদিন হাডুডু খেলার মাঠ থেকে আমাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে। অন্য ছেলেদের মতো কয়েকমাস পেছন পেছন ঘুরে তারপর প্রপোজ করা স্নিগ্ধর পছন্দ না। সে স্পষ্টভাষী ছেলে। যখন যেখানে যেই কথা বলা উচিত মনে করে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়। আমাকেও প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিল নিজের মনের কথা। যেহেতু স্নিগ্ধ আমার পার্শ্ববর্তী এলাকার ছেলে, সেহেতু আমি স্নিগ্ধকে চিনতামও না, বা তার সম্পর্কে কিছু জানতামও না। তাই সেদিন স্নিগ্ধর সোজাসাপ্টা কথায় আমি বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু এই দশদিনে সেই বিস্ময় বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে। স্নিগ্ধ এখন প্রতিদিন কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে আমাকে দেখার জন্য, আর কথা বলার জন্য। কিন্তু আমি সেসবে পাত্তাই দিচ্ছি না। এ কদিনে অবশ্য আমি মামুলির কাছ থেকে স্নিগ্ধ সম্পর্কে অনেককিছুই জেনেছি। স্নিগ্ধের সম্পর্কে সবকিছু জেনে যদিও এটুকু বুঝতে পেরেছি যে ছেলেটা সবদিক থেকেই বেশ ভালো। কিন্তু বাবার ভয়ে আমি কোনো ছেলের কথা মাথায় আনতে চাই না। বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েদের সম্পর্ক মানে বাবার চোখের বিষ। আপুও একজনকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিল। কিন্তু বাবা মেনে নেয়নি। আপুকে সাফ সাফ বলে দিয়েছিল, ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক না ভাঙলে যেন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অথচ আপু যাকে ভালোবেসেছিল সে একজন স্টুডেন্ট ছিল। একরকম বাধ্য হয়েই আপু তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। ঘটনাটা আরও এক বছর আগের হলেও, আজও আপু তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য আড়ালে চোখের জল ফেলে। আর বাবা সেই এক বছর আগে থেকেই আপুকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। এসব ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের আগে কোনোভাবেই কোনো ছেলেকে ভালোবাসব না। কিন্তু আমার এই সিদ্ধান্তে বাঁধ সাধল স্নিগ্ধ। সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা বলে আমার জন্য নতুন হোম টিউটর রাখা হলো। কারণ আগের হোম টিউটর তার ব্যক্তিগত কারণে আর পড়াতে পারবেন না। তাই বাবা দ্রুত হোম টিউটর খুঁজে বের করল। তা-ও আবার যাকে তাকে নয়, স্বয়ং স্নিগ্ধকে। বাবা যখন আমার জন্য হোম টিউটরের খোঁজ করছিল, তখনই স্নিগ্ধের কানে কথাটা পৌঁছে গিয়েছিল। আর সে বাবাকে পটিয়ে আমার হোম টিউটর হয়ে গেল। তারপর থেকে শুরু হলো আরেক জ্বালা। প্রত্যেকদিন বিকালে দুই ঘন্টা স্নিগ্ধর সামনে বসে থাকতে হলো। প্রথম প্রথম আমার প্রচন্ড অস্বস্তি লাগলেও দ্রুতই তা ঠিক হয়ে গেল। কারণ স্নিগ্ধ আমাকে পড়ানোর ব্যাপারে প্রচন্ড কেয়ারিং। টানা দুই ঘন্টা সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে পড়ায়। কিন্তু যাওয়ার সময়ে নিয়ম করে প্রতিদিন আমার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে নিজের মনের কথা প্রকাশ করে যায়। তাছাড়া কলেজের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তো আছেই। টানা এক মাসের মাথায় কীভাবে কীভাবে যেন আমিও তার প্রেমে পড়ে গেলাম। কবে, কখন, কীভাবে, জানি না। কিন্তু স্নিগ্ধর নিসঙ্কোচ প্রেম নিবেদন, অনুভূতি প্রকাশ, চাল-চলন, কথাবার্তার ধরণ, প্রত্যেকদিন নিয়ম করে আমার জন্য চকোলেট আর তাজা গোলাপ নিয়ে আসা সবকিছু আমাকে আকৃষ্ট করে তোলে। তখন আর ভালো না বেসে উপায়ান্তর পেলাম না। নিজের সিদ্ধান্তকে ভুলে চুটিয়ে প্রেম করতে শুরু করলাম স্নিগ্ধর সাথে। আমার ফোন না থাকায় মায়ের ফোন দিয়ে রোজ রাতে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তাছাড়া টিউশনির ফাঁকে বা কলেজে যাওয়া-আসার পথে হাঁটতে হাঁটতে কতশত গল্প তো আছেই। এইচএসসিতে আমি বেশ ভালো রেজাল্ট করলাম। সেই খুশিতে বাবা অনার্সেও আমাকে স্নিগ্ধর কাছেই পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আমার অ্যাডমিশনের আগেই স্নিগ্ধকে রাজশাহী চলে যেতে হয়েছে। তার মামা না কি তার জন্য চাকরি ঠিক করেছে। স্নিগ্ধ চলে যাবে শুনে আমার খুব কষ্ট লেগেছে। এই সাত মাসে তার প্রতি ভালোবাসাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তাই তার চোখের আড়াল হওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। স্নিগ্ধ আমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার পরও আমার মন মানতে চাইল না। তবু তো কিছু করার নেই। একটা সান্ত্বনা হলো, চাকরি পেয়ে রাজশাহীতে স্যাটেল হয়ে স্নিগ্ধ আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। এই আশা বুকে বেঁধে আমি স্নিগ্ধকে বিদায় জানিয়েছি। প্রথম তিন রাত মায়ের ফোন দিয়ে তার সাথে ফোনালাপ চলল। কিন্তু চতুর্থ দিনে আর তার ফোন এল না। আমি বার কয়েক ফোন করে ফোন বন্ধ পেলাম। তারপর থেকে প্রত্যেক রাতে এই ঘটনা ঘটে গেল। তার ফোন বন্ধ আর আমার বুকভরা হাহাকার নিয়ে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে দিন যায়, রাত যায়। তবু স্নিগ্ধর ফোন আসে না। মামুলিকে হাজার প্রশ্ন করেও কোনো লাভ হয়নি। কারণ স্নিগ্ধ না কি বাড়িতেও ফোন করে না। স্নিগ্ধের মামার কাছে খোঁজ নেওয়ার পর না কি জানা গেছে সে রাজশাহী যায়নি। এক কথায় সে নিখোঁজ। বুকে একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে আমি হাসিমুখে দিন পার করি। কারণ বাবার কানে গেলে খুব খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কিন্তু রাতে আর কষ্টটা চাপা রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার এক মাস কেটেছে। তবু স্নিগ্ধের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এই এক মাসে আমার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে। প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, আমার চোখ-মুখের এমন অবস্থা কেন? আমি এটা-ওটা বলে কোনোভাবে তার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছি। আমার এই একটা মাস যে কেমন কেটেছে, তা শুধু আমি জানি। তবু আমি অপেক্ষা করি, রোজ অপেক্ষা করি। আমার বিশ্বাস স্নিগ্ধ ফিরবে। আমাদের ভালোবাসার পরিণতি দেওয়ার জন্য হলেও সে ফিরবে। আজ, কাল, পরশু, এক মাস বা বছর পার হলেও ফিরবে। আমি ওর জন্য হাজার জনম অপেক্ষা করতে রাজি। প্রণয় হলো, চোখে চোখে হাজারো অনুভূতি বিনিময় হলো, কিন্তু হাতে হাত রেখে অজানায় হাঁটা যে এখনও বাকি রয়ে গেল।
শেষ, এটুকুই লিখেছিল মেহের। এরপর ডায়েরির সব পাতা ফাঁকা। স্নিগ্ধ নিখোঁজ হওয়ার একমাস পর প্রথমকার কয়েকটা পৃষ্ঠায় এই স্মৃতিগুলো কলমের কালিতে আটকে রেখেছিল সে। দুমাস পর আজ প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে নিজের লেখা ডায়েরি নিজেই পড়ল। স্মৃতিচারণা ফুরালেও চোখের বর্ষণ ফুরাল না। ডায়েরিটা বন্ধ করে বুকে চেপে ধরে সে ফুঁপিয়ে উঠল। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল সেই খেয়াল তার নেই। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে সে চমকে উঠল। কান্না থামিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করল। আননোন নাম্বার। স্নিগ্ধ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলে মেহেরের বুকটা ধক করে ওঠে। মন বলে, এই বুঝি স্নিগ্ধ ফোন করল। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আশঙ্কিত মনে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে অপেক্ষা করল সেই আকাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বরের আশায়। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো এক অপরিচিত পুরুষের কন্ঠ শুনে মেহের পুনরায় আশাহত হলো। ফোনের ওপাশের পুরুষটা হ্যালো হ্যালো করতে থাকায় মেহের নিজেকে সামলে মৃদু কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এল,
“আদ্রিশ সাহরীফ।”
মেহেরের মুখটা শক্ত হয়ে গেল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কেন ফোন করেছেন?”
ওপাশের লোকটা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
“আজ বাদে কাল তুমি আমার বউ হতে চলেছ। ফোন করাটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।”
“অবশ্যই অস্বাভাবিক। কারণ আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। কতবার বলব?”
লোকটা মৃদু হেসে বলল,
“যতবারই বলো, বিয়েটা তোমার আমার সাথেই হবে।”
“আশ্চর্য! আপনি কেমন লোক বলুন তো? আমি তো তেমন সুন্দরীও নই যে আপনি আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাবেন।”
“তোমাকে সুন্দরী হতে হবে না। বিয়ের পর না হয় আমি তোমাকে মেকআপ সুন্দরী করে রাখব।”
“আমি মেকআপ পছন্দ করি না।”
“আরে, ওই মেকআপের কথা বলেছি না কি? আমি তো ইউনিক মেকআপ করাব। এই যেমন ধরো আটা-ময়দা-সুজি ফেইস পাউডার হিসেবে ব্যবহার করবে, পুঁইশাকের পাকা বিজের লাল রং লিপস্টিক হিসেবে ব্যবহার করবে, হাড়ির নিচের কালি দিয়ে কাজল আর টিপ পড়বে। তুমি হবে আমার মেকআপ সুন্দরী।”
মেহের রাগত স্বরে বলল,
“আপনার ফালতু কথা রাখুন।”
“সেকি! এটুকুতেই রেগে যাচ্ছ? আমার এত সুন্দর করে বলা কথাগুলো তোমার ফালতু মনে হচ্ছে? বিয়ের পর তো সারাক্ষণ আমার এমন সুন্দর সুন্দর কথাই তোমাকে শুনতে হবে। হবু বরের সাথে এত রাগ দেখালে কীভাবে চলবে অ্যাংরি বার্ড?”
“বলেছি না আমি আপনাকে বিয়ে করব না?”
“আহা! এত রাগ করতে নেই সুইটহার্ট। তুমি জানো? আমি আমাদের হানিমুন প্ল্যানিংও করে ফেলেছি। তোমাকে না জানিয়ে করেছি বলে আবার এর জন্যও রাগ কোরো না যেন। বিয়ের পর নতুন বউকে সারপ্রাইজ দিব ভেবেছি আর কী।”
লোকটার ত্যাড়া কথায় রেগেমেগে মেহের ফট করে ফোন কেটে দিলো। ফোনটাকে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে দুহাতে নিজের চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে রইল। লোকটা যে দ্বিতীয়বার আর ফোন করবে না, তা সে জানে। গত এক সপ্তাহ ধরে এটাই চলে এসেছে। লোকটা বিভিন্ন আননোন নাম্বার থেকে কল করে এই একই কথা বলে, আর সে রেগেমেগে ফোন কেটে দেয়। অতঃপর বাঁধভাঙা কান্না। আজও তাই হলো। কাঁদতে কাঁদতে আজ মেহের কী মনে করে হাতে কলম তুলে নিলো। ডায়েরি খুলে একটা ফাঁকা পৃষ্ঠায় ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করল,
স্নিগ্ধ,
‘অপেক্ষা’ শব্দটার মধ্যে যে কতটা যমযন্ত্রণা মিশে আছে, তা কি তুমি জানো? তুমিও কি আমার মতোই এই যমযন্ত্রণা অনুভব করো? যদি করেই থাকো, তবে কবে এই যন্ত্রণার উপশম করবে? আমি যে এমন শত যমযন্ত্রণা সহ্য করেও তোমার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি। কিন্তু আমার বাবা? সে তো ওই আদ্রিশ নামক লোকটার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি কী করব বলো তো? না পারছি কিছু বলতে, আর না পারছি সহ্য করতে। তবে কি আমার এত অপেক্ষা বিফলে যাবে? আমি তো তোমার জায়গাটা অন্য কাউকে দিতে পারব না। আচ্ছা? এমনটা কি হতে পারে না যে, আদ্রিশের জায়গায় তুমি বরবেশে এলে। তা না হলে যে ভালোবাসা শব্দটার ওপর থেকে আমার সব বিশ্বাস উঠে যাবে। আমি তো এটা চাই না। আমায় যে ভালোবাসা তুমি শিখিয়েছিলে, সেই ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস রাখতে হলেও একবার ফিরে এসো না প্লিজ। একটিবার ফোন করে বলো না, তুমি অবশ্যই ফিরবে।
তোমার অপেক্ষারত
মেহের
চলবে………………..🍂