কোকিলারা,দুই
মোর্শেদা হোসেন রুবি
-” হাই ? ” বাতাসের মত মৃদু শব্দটা শুনে মুখ তুলল রাজিব। তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে স্ক্রল করছিল। আনাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ওর মুখে কোন কথা যোগালো না। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর নিজেকে সামলাতে। মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে যে একটা মেয়ে এতোটা বদলে যেতে পারে তা আনাকে না দেখলে ওর পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। শেষ যেদিন আনাকে দেখেছিল সেদিনও আনা ছিল নিতান্তই একজন তরুণী যার গায়ে ছিল একটি সুতার কাজ করা সাধারণ থ্রিপীস। অবশ্য আনা এমনিতে সাজগোজ কম করলেও ওর থ্রিপীসগুলো ছিল বেশ রুচিশীল ধরণের। তাতেই ওকে বেশ চমৎকার লাগত। আর আজ তো…! সন্তর্পনে চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে চমৎকার বন্ধুবাৎসল একটা হাসি দিল রাজিব। একই সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অনেকটা সম্মানের ভঙ্গিতে। জানে, মেয়েরা এ ধরণের এটেনশন খুব পছন্দ করে। আনাও করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঐটুকু পরিসরেই গোটা আনাকে এক লহমায় দেখে নিলো সে। হালকা জরির বুটি বুটি কাজের ব্লাউজ পরেছে আনা যার পাড়টা সরু সোনালী কাজের। হালকা ধুপছায়া রঙের শাড়ী পরেছে যার আঁচলটা ব্লাউজের মেরুণ রঙটাকে শুধু সাপোর্টই করছে না, আনাকে রীতিমত ডলারে পরিণত করেছে। তবে এর সবটাই রাজিবের মনে। বাইরে সে শান্ত সমাহিত। মুগ্ধতার দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে হাসল রাজিব।
-” বাপরে, তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছেনা। অামি ভাবছিলাম তোমার কোন যমজ বোন কিনা। আগের আনার সাথে মেলাতে কষ্ট হচ্ছিল।”
-” তাই ? যাক্, তবু ভাল যে মিলিয়ে দেখার কষ্টটুকু করেছ।” আনা হাসছে না। রাজিবের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেটা কাটিয়ে উঠে বলল, ” বসো। কী খাবে সেটা আগে বলো। অর্ডার করে দেই। কথার মাঝখানে ইন্টারাপশন চাই না। ”
-” এখন কিছু খাব না। খিদে পায়নি। দেরি করে নাস্তা করেছি আজ।”
-” বলো কী। এত দেরী করে নাস্তা ? ”
-” ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল আজ।” হালকা চালে কথাটা বললেও রাজিব কথাটাকে লুফে নিলো। ঠাট্টার সুরে বলল,
-” হ্যাঁ, নতুন বিয়ে হয়েছে। ঘুম ভাঙতে দেরী তো হবেই।” বলামাত্রই আনা সরু চোখে তাকাল।
-” কিছু ইঙ্গিত করলে মনে হচ্ছে? ”
রাজিব দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে বলল,
-” আরে না, কোন ইঙ্গিত ফিঙ্গিত না রে ভাই। তোমার সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত আমি। তুমি দেরী করে উঠে এত বেলায় হলেও নাস্তা করেছ আর আমি হতভাগা এখনও নাস্তা করার সুযোগই পাইনি। সাত সকালে উঠেই ইন্টারভিউ দিতে দৌড়েছি।”
-” এই সাত সকালে ইন্টারভিউ ?”
-” সাত সকাল পেলে কোথায় ? এখন তো প্রায় পৌণে বারোটা বাজে। ” মোবাইল ঘুরিয়ে দেখাল রাজিব।
-” ওহ্। ইন্টারভিউ কেমন হলো ? চাকরি হবে এখানে ? কেমন বুঝলে ? “একসাথে কয়েকটা প্রশ্ন করল আনা।
-” আর চাকরি। আজকাল চাচা মামা না থাকলে চাকরি হয় না।”
-” পড়াশোনার কী করবে। ছেড়ে দেবে ? “যেন আনা নিজেই আজ রাজিবের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। রাজিব মাথা নাড়ল হতাশ ভঙ্গিতে।
-” কী করব নিজেও জানিনা। তোমাকেই যখন পেলাম না আর চাকরি পেয়ে কী হবে, পড়াশোনা করেই বা কী হবে।” রাজিবের চেহারায় নিখাদ বিষন্নতা। আনার মুখোভাব কঠিন হলো, ” তোমার এসব মিনমিনে স্বভাবটাই আমার অসহ্য লাগে। আমার বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে। এই বিয়ে হলেও সেটা হয়েছে কাগজে কলমে। বাস্তবে আমি সেই আনাই আছি যে গত এক সপ্তাহ আগে ছিল। ”
রাজিব আনার দিকে তাকাল।
-” এখানে কী করে এলে ? আজ তো কলেজ বন্ধ। ”
-” কিচ্ছু বলিনি। বলেছি কলেজে যাব। ব্যাস্, এখন যা খুশি ভাবুক গে।” কিছুটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে রাজিবের চোখে চোখ রাখল আনা। বলল, ” তোমার এই নিরবতা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে রাজিব। আমি ওকে একদম সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ কিছু একটা করো।”
-” আসলে, আমার চাকরীটা হয়ে গেলে আর দেখতে হতো না। নিজেই চলতে পারিনা। তোমাকে খাওয়াব কী।”
-” সম্পর্ক গড়ার আগে কথাটা ভাবা উচিত ছিল তোমার। মনে আছে তো, কীভাবে আমার পেছনে পড়ে সম্পর্ক গড়েছিলে তুমি ? ” আনার চেহারায় চাপা রাগ।
রাজিব এবার আপোষের সুর তুলল, ” আহ, তুমি চট করে রেগে যাও কেন বলো তো। আমি তো একবারও বলিনি যে তোমাকে বিয়ে করব না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তো মানতে হবে। আপাতত, কয়েকটা দিন ম্যানেজ করে নাও। তারপর..!”
-” তারপর কী ? তোমার চাকরি হয়ে যাবে ? ”
-” হতেও তো পারে। তাছাড়া, তোমাকে ওখান থেকে বেরোতে হলেও সিস্টেমেটিক ওয়েতে বেরোতে হবে। এমনি এমনিই তো আর বেরোতে পারছে না। কাজেই আমাদের দুজনকেই সময় নিয়ে এগোতে হবে। ”
-” তা নাহয় নিলাম কিন্তু চাকরিটা না হলে কী করবে সেটাও তো ভাবতে হবে তোমাকে। তুমি তো অন্য কোন উদ্যোগও নিচ্ছো না। উদ্যোগ না নিলে আমি বাপির কাছে তোমার প্রসঙ্গ তুলব কী করে ?”
আপনমনেই চুলগুলো মুঠো করে ধরল রাজিব। চেহারায় রাজ্যের হতাশা। বলল,
-” ইন্টারভিউ তো একটা দিলাম। দেখি কী রেজাল্ট আসে। আমার হাতে যথেষ্ট টাকা নেই, নয়ত ঠিক ব্যবসায় নেমে পড়তাম।”
-” কী ব্যবসা করবে তুমি ? ” আনার চঞ্চল দৃষ্টি রাজিবের উপর স্থির।
-” আরে, ব্যবসার কী অভাব আছে নাকি ঢাকা শহরে ? এটা নির্ভর করে পুঁজির উপর। ”
শান্ত মুখে রাজিবের বলা কথাটা শুনল আনা। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ” আর ধরো, যদি টাকাটা ম্যানেজ হয়ে যায় ? ”
রাজিবের চোখগুলো এই মুহূর্তে মাছের চোখের মত দেখাচ্ছে। একদম স্থির। অনিশ্চয়তার সুরে বলল, ” কীভাবে ম্যানেজ করবে ? ” ওর চোখে প্রত্যাশার ঝিলিক।
আনা আর ভণিতা করল না। মাথা নেড়ে বলল,” আমিই৷ দেব তোমাকে টাকাটা। এটা আমার জমানো টাকা। খুব বেশি না হলেও একেবারে ফেলে দেবার মত না। ছোটখাট ব্যবসা অনায়াসে দাঁড় করানো যেতে পারে এতে।”
রাজিবের মুখে কথা যোগাল না। আনা ফের বলল,” তুমি চাইলে দু’একদিনের মধ্যেই সেটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। বরং তুমি ভেবে বের করো সেটা দিয়ে কী ব্যবসা খুলবে তুমি। তুমি ব্যবসা চালু করলেই আমি বাসায় জানাতে পারবো তোমার কথা।”
” হম। বুঝলাম কিন্তু তোমার ঐ মেনিমুখো স্বামী সাহেবের কী করবে ? ” রাজিব তাকিয়ে রইল।
আনা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” আজকাল তো শুনি কত রকমের সমস্যা বেরিয়েছে। সেগুলোর একটা বলে দেব। তারপর টুক করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব।” অানাকে সামান্য উত্তেজত মনে হলেও বিপরীতে রাজিবকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। সে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ” তোমার বুদ্ধিটা ইউনিক কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি কী সত্যিই আমাকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দেবে ? ”
-” তবে কী মিথ্যে বলেছি এতক্ষণ ? ”
-” ওকে ফাইন। ’ এক্ষেত্রে আমার একটা শর্ত আছে। ” রাজিবকে বেশ সিরিয়াস দেখালো। “টাকাটা আমি নিতে পারি এক শর্তে।”
-” কী শর্ত ? “আনার কপালে ভাঁজ পড়ল এবার।
-” যদি এটা তুমি আমাকে ধার হিসেবে দাও। পরে আমি যখন ব্যবসা গুছিয়ে ফেলব তখন তোমার টাকাটা সুদে আসলে ফেরত দেব আমি। এবং তখন তোমাকে ঐ টাকাটা নিতে হবে। নইলে এ টাকা নেব না আমি।” রাজিবের চেহারায় দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠতে দেখে আনা হেসে ফেলল।
-” আচ্ছা, তুমি কী বলো তো। এখনই টাকা পরিশোধ করা নিয়ে এত অস্থির হবার কী আছে। তাছাড়া তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে তো আমারই খুঁটি শক্ত হবে। টাকা শোধ নিয়ে এত ভেব না তো। যা আমার তা তোমার।” আস্থার সাথে বলল আনা। এবার রাজিবও হাসল। রহস্যময় রমনীমোহন হাসি। রাজিবের চেহারা এইমুহূর্তে কলেজের সেই পুরোনো রাজিব ভাই এর মত দেখাচ্ছে যাকে দেখলে সব মেয়েরা মাটিতে লুটাতো। আনা নিজেও ঐ হাসির ভক্ত।
রাজিব বলল, ” বুঝে বলছো তো ? ”
আনা আরক্ত মুখে বলল, ” বুঝেই বলছি।”
-” তাহলে কী আমি ধরে নেব, এখন থেকে আমি যা চাইব তাই পাব। টাকা কিন্তু আমি চাইনি তুমি সেধে দিচ্ছো। কিন্তু আমি যেটা চাই সেটা তুমি আমাকে কখনোই দাও নি। ”
আনা জবাব দিলো না একথার। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাকে বাড়ি যেতে হবে। তুমি কবে সময় বের করতে পারবে এসব ঠিকঠাক করে আমাকে জানিয়ো। ”
-” আনা। ” রাজিব হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরল আনার। আনা স্তব্ধ। রাজিব কিছুটা আবেগাক্রান্ত স্বরে বলল, ” নিজেকে যে কীভাবে শাস্তি দিচ্ছি আমি যদি জানতে। তোমার দায়িত্ব নিতে পারবো না বলে নিজের আবেগটাকে প্রতিমুহূর্তে গলা টিপে হত্যা করতে হচ্ছে আমাকে।”
আনা আবছা হাসল, ” আবেগ প্রকাশের অনেক সময় পাবো আমরা। চলো, এখন বেরোই। নয়ত আমার দেরি হয়ে যাবে।”
আনা সরতে গেলেও বাধা পেল। গাঢ় স্বরে বলল,” এতোগুলো টাকা ধার দিতে অনায়াসে রাজি হয়ে গেলে। এবার কিছু ভালবাসা অন্তত ভিক্ষা দাও। দেবে ? ” আনা চোখ তুলে তাকাল। বুকের ভেতর নদীর পার ভাঙার ঝুপঝুপ শব্দ। রাজিবের চোখে স্পষ্ট ঘোর। আনা বুঝতে পারছে সে হেরে যাচ্ছে।
=====
বাড়ি ফেরার পর থেকে আমার মনটা আজ অনেকখানিই শান্ত। হয়ত সে কারণেই লোকটা অফিস থেকে ফেরার পর থেকে এই মাঝরাত অব্দি তার সাথে একটাও খারাপ ব্যবহার করিনি। তবে লোকটার মনটা হয়ত আজ একটু খারাপ। ফেরার পর থেকেই দেখছিলাম মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। পরক্ষণেই ভাবলাম, যা খুশি হোক গে। আমার কী। আমি আমার পথ সুগম করে এসেছি। রাজিব বলেছে, এ সপ্তাহেই সে ব্যবসার কাজ শুরু করে দেবে। ওর নতুন প্রজেক্টের নাম হবে ” আনা এন্টারপ্রাইজ “। ওর ব্যবসা শুরু করার পরই আমি বাবার সাথে কথা বলব। আর কী বলব সেটাও ঠিক করে ফেলেছি। সময় মত প্রয়োগ করা হবে।
বসে বসে পার্স থেকে রুমাল কলম বের করে রাখছিলাম। কানের দুল খোলার সময় আপনমনেই হেসে ফেললাম রাজিবের শেষ মুহূর্তের বিদায়ের কথা স্মরণ করে। অন্তর বিবশ করা একটা অনুভতি ছিল সেটা। যা আমাকে বারবার আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। আচমকা স্বামী সাহেবের ডাকে ঘোর কাটল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। লোকটা বিছানায় এক পা ভাঁজ করে অন্য পা ঝুলিয়ে বসেছে। আমার দিকে সেভাবে তাকাচ্ছেনা। লোকটার কণ্ঠস্বরও যেন কেমন। আমি বরাবরের মত পাত্তা না দেবার ভান করে অন্য কানের দুল খোলার চেষ্টায় মেতে রইলাম। লোকটা হঠাৎ উঠে গিয়ে কিছুটা শব্দ করে দরজা বন্ধ করে আমাকে কড়া স্বরে বললো, ” এই মেয়ে, কানে কম শোনো নাকি ? কতবার ডেকেছি ? ”
আমার মনে হলো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ কী ভাষা ওর। আমাকে অবাক চোখে তাকাতে দেখেও সে স্যরি হলো না। ফের পা ভাঁজ করে বিছানায় বসে পড়ে বলল, ” তাড়াতাড়ি এসে বসো কারণ তোমার সাথে কথা বলার পর আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব।”
মেয়ে হিসেবে আমি যথেষ্ট সাহসী। ভয় ডরের বালাই খুবই কম, প্রায় নেই বললেই চলে। সেই আমিও কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ধীর পায়ে লোকটা মুখোমুখি গিয়ে বসলাম।
সে তখনও চোখ নামিয়ে মোবাইল টিপছে। সেভাবেই অনেকটা হেডমাষ্টারি কায়দায় তাকিয়ে অপলক চোখে আমাকে দেখল কয়েক সেকেন্ড। আমি কঠিন স্বরে কিছু বলতে যাবার চেষ্টা করেও দেখলাম আমার গলার স্বরে আগের জোরটা নেই। এর কারণ কী এখনই ধরা পড়তে না চাওয়ার আশঙ্কা নাকি ধরা পড়ে যাবার পরের ঘটনা সম্পর্কে ভীতি ? যদি সত্যি সত্যিই লোকটা সব জেনে ফেলে আর তুলতালাম করে তাহলে আমাদের প্ল্যান বরবাদ হয়ে যাবে। ভেতরে ভেতরে ঘামতে লাগলাম। লোকটা এবার মোবাইল রেখে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,” তোমার সাথে আজ ক্যাফে রিওতে যে ছেলেটা ছিল সে তোমার কী হয় ? ”
মাথার উপর ছাদটা ধুড়ুম করে ভেঙে পড়লেও বোধহয় এতোটা অবাক হতাম না আমি। কয়েক সেকেন্ড লাগল নিজেকে সামলাতে। কোনোকিছু না হারানোর চেতনাটা জাগিয়ে তুললাম নিজের ভেতর। সদর্পে জবাব দিলাম, ” ওর নাম রাজিব।” বলতে গিয়ে গলাটা শুকনো ঠেকল। নিজেকে বোঝালাম, কুল বেইবি। ডোন্ট উওরি। কী করবে এই ব্যাটা তোর ? বড় জোর বাসা থেকে বের করে দেবে ? দিলে দিক। ”
-” তোমার আত্মীয় ? ” স্বামী সাহেবের কণ্ঠস্বরে মুরুব্বিয়ানা আজ ষোলোআনা।
-” না, আত্মীয় না। আমার ভাল বন্ধু। ” নির্বিকারে জবাব দিলাম। বুকের ভেতরে অবশ্য দুরু দুরু করছে।
উনি মাথা নাড়লেন,” ওহ্, তারমানে তোমরা একসাথে পড়তে ? ”
-” জি না। সে আমার দু’ বছরের সিনিয়র। “সত্যিটাই বললাম।
লোকটা চুপ করে রইল এবার। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” সিনিয়র ভাইয়ের সাথে তোমার এতো কিসের আলাপ যে ক্যাফে শপে যেতে হয় ? নাকি হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছে ? ”
-” আমি আপনাকে এত কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। ” নিজের ভেতর লুপ্ত সাহস ফিরে পেলাম হঠাৎ। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা আপোষের সুরে কথা বলছে। রাগটা শালার ভান। আমাকে ফাঁপর দেবার জন্য।
-” বাধ্য নও ? ” স্থির দৃষ্টিতে দেখল সে আমাকে। আমি ড্যাম কেয়ার ভঙ্গিতে বললাম,
-” অফকোর্স নট।”
-” ওহ্, আচ্ছা।” লোকটা এবার সোজা হয়ে বসল। কিছুক্ষণ ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আমি ভেবেছিলাম তুমি মেয়েটা স্বভাবে রাগি হলেও বিবেকের দিক থেকে সৎ। এখন বুঝলাম তুমি মোটেও তা নও। বরং রাগটা তোমার ভান। এবং তুমি এক নম্বরের মিথ্যুক। ”
-” কী বলতে চান আপনি ? ” জ্বলে উঠতে চাইলেও কাঠির মাথায় বারুদের রসদ কম থাকায় ভিজে কাঠির মত মিইয়ে গেলাম। বরং লোকটা জ্বলন্ত চোখে তাকাল।
-” আমার ছত্রছায়ায় থেকে আমার সম্মান সাথে নিয়ে তুমি গিয়েছ তোমার এক্সের সাথে দেখা করতে। এটাকে কী বলবে তুমি ? ”
-” কেন, আপনারা যান না ? আপনারা ঘরের বউ রেখে বাইরে নষ্টামী করেন না? ”
-” অন্তত আমি করিনা। এখনও করিনি। কখনও করব বলে ভাবিনি। সেটা যারা করে তাদের সাথে গিয়ে করতে আমার সাথে কেন ? আর এটা কেমন নীতি ? আমরা যা করব তোমরাও তাই করবে ? যদি আমাদের কাজ বর্জনীয়ই হয়ে থাকে তবে একই কাজ তোমরা স্বেচ্ছায় আর সানন্দে করে কোন গৌরবের পরিচয় দিচ্ছো ? ”
আমি কোন জবাব দিলাম না। লোকটা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,” আমি মনে করি এক্ষেত্রে তোমাকে একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসা উচিত। আমার স্ত্রী হয়ে তুমি বাইরের ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াবে আর বলবে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। এভাবে অন্তত আমি সংসার করব না। পরকীয়ার নষ্টামী করার যখন এতোই শখ তো বাপের বাড়ি গিয়ে করো। এখানে না। ”
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ তাৎক্ষণিক ভাবে দেবার মত কোন জুঁতসই উত্তর খুঁজে পেলাম না। সে এবার একা একাই স্বগোতক্তির সুরে বলতে লাগল ” ছি। কেউ জানলে যে কী বলবে। ” কিছুক্ষণ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” স্বামী স্ত্রী দুজনের ভালবাসার ভিত্তিই হলো সততা আর বিশ্বাস। এখানে তো দুটোর একটাও নেই।”
এবার আর থাকতে পারলাম না। তীব্র স্বরে বলে উঠলাম, ” এতো যখন বোঝেন তখন বিয়ের আগে কেন জানতে চাইলেন না যে আমি কাউকে ভালবাসি কিনা। এখন যে বড় সততা ফলাচ্ছেন। তখন তো আমার ছবি দেখেই চোখ বন্ধ করে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলেন। আমি তো পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছি। স্বেচ্ছায় হইনি। দোষ কী আমার ? ”
লোকটা এবার শান্ত হয়ে গেল। ঢোক গিলে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, ” সত্যিই, তুমি ঠিকই বলেছ। দোষটা আমারই। সুন্দর সব জিনিসই যে উপকারি হয়না কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।” বলে একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।” কিছু মনে করো না আনা। তুমি যতক্ষন এ বাড়িতে আছো ততক্ষণ তুমি আমার সম্মান। এ বাড়ির সম্মান। এখন থেকে তুমি যেখানেই যাবে আমার সম্মান তোমার সাথে যাবে। যেখানে যা করবে তা আমারই প্রতিনিধিত্ব করা হবে। ”
-” তারমানে মানুষ হিসেবে আমার কোন অবস্থান নেই ! আমি পরগাছা ? ”
-” তা হবে কেন ? ” কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল লোকটা। আমি মোটেও দমে গেলাম না। দাপটের সাথে বললাম, ” তা হবে কেন মানে, তাই তো হচ্ছে। এখানে আমার কোন ভাললাগা মন্দলাগা নেই, নিজস্ব অস্তিত্ব নেই, ব্যক্তিত্ব নেই। আমি মেয়ে বলে আমাকে নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে অপরের সম্মান বয়ে বেড়াতে হবে। একদিন বাপেরটা বয়েছি, আজ আপনারটা বইব। বইবার জন্যই তো বেঁচে আছি। এসব কথা বলে বলেই তো আমার বাবাও আপনার সাথে গছিয়েছে আমাকে। আমি মানা করলে নাকি তার মানসম্মান যাবে। আমি তার বড় মেয়ে। আর আজ আপনি বলছেন। আমি আপনার সম্মান বহন করছি। তাহলে আমার স্বার্থ রক্ষা করবে কে?
(চলবে)