হারানো সুর (৭)
সানজিদা ইসলাম সেতু
ওটির বাহিরে অপেক্ষা করছে পুরো মজুমদার পরিবার। ৪ ঘন্টা হয়ে গেছে বৃত্তকে ভিতরে নেয়া হয়েছে। প্লাস্টিক সার্জারি করে ওকে নতুন চেহারা দেয়া হবে।
অারো ৩ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর ওটি থেকে ডাক্তাররা বের হয়। বৃত্তর পরিবারের একজনকে তারা সাথে নিয়ে যায়। চিত্ত যায় ওনাদের সাথে।
‘মি. প্রলয় মজুমদার এর শারীরিক অবস্থা যে খুব একটা ভালো তা আমরা বলছি না। যেকোনো মানুষিক চাপ তার জন্য খুবই ক্ষতিকর।
২ মাস পর আমরা ওনার ব্যান্ডেজ খুলব। ততদিন আপনারা ওনাকে ওনার নতুন চেহারার ব্যাপারে বুঝাতে থাকুন। এতে করে উনি যখন নিজের চেহারা দেখবে, তখন ওনার মানুষিক চাপ কম হবে।’
‘আমরা চেষ্টা করব। অাসছি।’
বিন্দুর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল গুজে কাদছে মাহবুবা খাতুন। রুমের ভিতর থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ আসছে। বিন্দু আগের থেকে স্বাভাবিক হচ্ছে, কিন্তু এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারছে না। বৃত্তর স্মৃতি ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
‘আপনি এমনটা কেন করলেন বৃত্ত? আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন। আমি কি করে মানব আপনি খুনি? আমার চোখের সামনে আপনি এমটা মানুষকে খুন করেছেন। কিন্তু এটাই তো বাস্তব, তিক্ত সত্যি।
আমি কি করে থাকব আপনাকে ছাড়া? ভালোবাসি আপনাকে, আপনার সাথে সারাজীবন কাটাতে চেয়েছিলাম। আপনি আপনার রাগের কারনে আপনার বিন্দুকে হারালেন, বৃত্ত থেকে বিন্দু হারিয়ে গেছে।
আপনাকে.. আপনাকে আমার ভয় লাগে বৃত্ত। আপনি আমাকেও মেরে ফেলতে পারেন। আচ্ছা আপনার কি একবারও হাত কাপল না?
আপনার যা করার আপনি করছেন, এবার বলুন আমি কি করব? আমি তে আপনার স্ত্রী হয়ে সারাজীবন কাটাতে পারব না? সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে, ওই দেখ খুনির বউ যাচ্ছে। না না আমি পারব না এসব সহ্য করতে। আমি আপনার থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু কি করে?
ডিভোর্স, হ্যাঁ হ্যাঁ ডিভোর্স, একমাত্র ডিভোর্স পারে আমাকে আপনার থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু তার জন্য তো আমাকে আপনার সামনে যেতে হবে আর আমি আমার মুখোমুখি হতে চাই না।
আপনার মুখোমুখি হয়ে আমি আবার আপনার মায়াতে পরতে চাই না। আপনার ওই চোখ আমি চোখ রেখে কোনো কথা বলতে পারব না।
কি করব আমি, কিছু বুঝতে পারছি না। হে আল্লাহ পথ দেখান আমাকে।’
মেয়ের কষ্ট আহসান সাহেব আর মাহবুবা খাতুন কেউই সহ্য করতে পারছে না। এ সব কিছুর জন্য আহসান সাহেব নিজেকে দোষী মনে করেন।
‘আমি যদি জোর করে বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিতাম তাহলে এতো কিছু হতো না। না বৃত্ত অর্পনকে খুন করত না ওদের বিয়ের হত না আমার মেয়েটা কষ্ট পেত।’
‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না। শুধু অামার আগের সেই মেয়েকে চাই যে আমার ঘর আলো করে থাকত।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে মাহবুবা। আমাদের মেয়ে নিজেকে সামলাতে পারবে। ও সব কিছু পিছনে ফেলে নতুন করে বাঁচতে শিখবে।’
বিন্দু সবটা সামলে নিজের পথে এগিয়ে যায়। বৃত্তকে ওর নতুন চেহারার ব্যাপারে সবটা বলা হয়েছে। বিন্দুর অবস্থার সব আপডেট চিত্ত বৃত্তকে দিতে থাকে। ২ মাস ৩ দিন পর বৃত্তর মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়। নিজেকে দেখে অবাক হয় বৃত্ত। নিজের চেহারা দেখে বৃত্ত রাগে ফুসতে থাকে। ওর অবস্থা দেখে চিত্ত ছাড়া সবাই বাইরে চলে যায়।
‘কি হয়েছে তোর?’
‘বিন্দু কোথায়? ‘
‘রাজশাহী তে। ওর ভাই বিশ্ব নতুন বিজনেস রাজশাহীতে করেছে। তাই সবাই এখন ওখানেই থাকে। বিন্দু মানে মৃত্তিকা ওখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ।’
‘রাজশাহী যাব, গাড়ি রেডি কর।’
‘তুই কোথাও যাবি না।’
‘মানে?’
বৃত্তর কন্ঠ শুনে চিত্ত দমে যায়।
‘মানে আজ কোথাও যাবি না। আজ তুই আমাদের সাথে থাকবি। একবার মায়ের কথা তো ভাব। তুই কালকে যাস, কেউ তোকে আটকাবে না।৷ প্লিজ ভাই আমার কথা টা শোন।’
‘আচ্ছা, কালকে কিন্তু আমাকে আটকাবি না।’
‘একদম আটকাব না। পাক্কা প্রমিস।’
‘মা, ও মা, আমাদের দেরি হচ্ছে।’
ডাইনিং থেকে তিন ভাই বোনের চিৎকারের সাথে সাথে চামচ গ্লাসের টুংটাং আওয়াজ পায় মাহবুবা খাতুন। এ গুলো কানে না তুলে নিজের কাজ করছেন। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে হাজির হন তিনি।
‘তোরা ভালো হবি কবে?’
‘ভাইয়া জানে।’
দুই বোনের কথা শুনে বিষম লাগে বিশ্বর।
‘সবসময় আমাকে বলির পাঠা না বানালেই কি হয় না তোদের?’
‘একদমই হয় না।’
‘মা তুমি কিছু বল ওদের।’
‘মাকে টানছিস কেন? সাহস থাকে তো আমাদের সাথে লড়াই কর।’
‘সাহস দাড়া তোকে সাহস দেখাচ্ছি। ‘
বিশ্ব উঠে বিন্দু আর বীনার চুল টেনে দেয়। সে নিয়ে তিনজনের কি মারামারি ঝগড়া।
ওদের দু চোখে ভরে দেখছে আহসান সাহেব আর মাহবুবা খাতুন।
‘বলেছিলাম না মাহবুবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘হুম। আল্লাহর কাছে শুধু এটাই চাই যে আমকর সংসারে যেন কারো নজর না লাগে।’
বৃত্তর রাজশাহী পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বৃত্তর সাথে চিত্তও আসে। হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেস হয়ে বিন্দুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয় দুই ভাই।
‘ভাইয়া বিন্দু আমাকে চিনবে তো?’
‘তোকে তো আমিই চিনলাম না, তোর বিন্দু তো দূরের কথা।’
‘এ জন্যই আজও কোনো মেয়ে তোকে পছন্দ করল না। সব সময় উল্টোপাল্টা বকবক।’
‘আচ্ছা একটা কথা বলতো, ও কি সত্যি তোকে ভালোবাসে? না মানে এতো দিন হয়ে গেল একবারও তোর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করল না। এই যুগে তো সবাই ফেসবুক ইউজ করে, নিশ্চয়ই বিন্দুও করে আর তোর সাথে ওর এডও আছে। আমি তোর এক্সিডেন্ট এর নিউজ ফেসবুকে আপলোড করছি যাতে বিন্দু মানে মৃত্তিকা জানতে পারে। কই ওতো কোনো রিয়েক্ট করল না?’
‘আমি এসব কিছু জানি না ভাইয়া। বিন্দুর সাথে আমাকে কথা বলতে হবে। ওর সাথে কথা না বলে আমি কোনো কিছু বলকে পারব না।
আর কতদূরে? ‘
‘এই সামনের বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে। বৃত্ত, মৃত্তিকা বা ওর পরিবার যদি কোনো রিয়েক্ট করে?’
‘তাহলে আমাকে অন্য কিছু করতে হবে। বিন্দু আমার ওয়াইফ, ওকে অামার থেকে কেউ দূরে রাখতে পারবে না, এমনকি বিন্দু নিজেও না।’
‘সাবধান বৃত্ত, মৃত্তিকা কিন্তু এখনো মানুষিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ না। ডাক্তার কিন্তু ওকে মেন্টাল প্রেশার নিতে এবং দিতে বারবার বারণ করেছে।’
‘হুম’
‘আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।’
‘কি আইডিয়া? ‘
‘আমরা যদি আগে মৃত্তিকার মনে তোর জন্য কি ফিলিংস আছে তা জানার চেষ্টা করি, তাহলে পরে তুই ওর সামনে গেলে ওকে বুঝাতে সুবিধা হবে।’
‘কিসের সুবিধা? দেখ ভাইয়া তোর এই পেট থেকে সব কথা বের কর তো, অর্ধেক অর্ধেক কথা বলে সাসপেন্স বাড়াবি না, আমার কিন্তু রাগ লাগছে।’
‘ দেখ তোদের দুজনের জীবনে যে ট্রাজেডি গেছে তাতে মৃত্তিকার রিয়েক্ট করা স্বাভাবিক। আর এখন তো তোর চেহারা পাল্টে গেছে যদি এখন অনেক বেশি কিউট আর স্মার্ট লাগছে তবুও ওর একটু অসুবিধা হতেই পারে। তাই বলছিলাম আরকি।’
‘ভুল বলিস নি।’
‘হুম। তো এবার তোকে যে করেই হোক মৃত্তিকার রুমে ঢুকতে হবে, চোরের মতো।’
‘তুই কি চাইছিস? প্রলয় মজুমদার বৃত্ত এখন অন্যের রুমে চোরের রুমে ঢুকবে?’
‘অন্যের রুম কোথায়? তোর বউয়েরই তো রুম।’
পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে বিন্দু। মাথায় কারো হাত অনুভব করে মাথা তুলে। বামপাশে তাকাতেই একটা লোককে বসে থাকতে দেখে।
‘কে আপনি? আর রমে অাসলেন কি করে? ম…’
লোকটা বিন্দুর মুখ চেপে ধরে….
‘আরে করছ কি? আস্তে আস্তে, আমার কথাটা তো শুনবে। আমি বৃত্ত, তোমার বৃত্ত।’
বৃত্ত নাম শুনে বিন্দুর চোখ বড় হতে থাকে। হ্যাঁ বিন্দুর সামনে বসে থাকা লোকটা বৃত্ত। চিত্তর লোকেরা একটা মইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, সেটা দিয়েই বিন্দুর রে আসে বৃত্ত। বিন্দু বৃত্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বৃত্ত কিছুটা দূরে সরে যায়।
‘না না আপনি বৃত্ত হতে পারেন না। বৃত্ত খুনি, এ আমাকে মারকে আপনাকে পাঠিয়েছে তাই না। প্লিজ আমাকে মারবেন না, প্লিজ মারবেন না। আমি কাউকে কিছু বলব না। মারবেন না, আমি বাঁচতে চাই, প্লিজ।’
‘বিন্দু কি বলছ তুমি এসব? তাকাও আমার দিকে।’
‘প্লিজ আপনি অামাকে মারবেন না। বৃত্তকে আমার খুব ভয় লাগে। ও মেরে ফেলবে আমাকে, মেরে ফেলবে। ‘
বিন্দুর কথা শুনে বৃত্ত থমকে যায়। কি বলবে কিছু ভেবে পায় না। বিন্দু ওকে ভয় পায়, মনে করে ওকে মেরে ফেলবে।
বিন্দুর চিৎকারে ওর মা আর বীনা দরজায় নক করে। ততক্ষণে বিন্দু অজ্ঞান হয় গেছে। বিন্দুকে বিছানায় শুয়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে আবার মই বেয়ে নিচে নেমে আসে।
চিত্ত এগিয়ে আসলেও বৃত্ত ওকে এড়িয়ে চলে যায়।
চলবে