হারানো সুর (৬)

হারানো সুর (৬)
সানজিদা ইসলাম সেতু

মাত্র ৭ মাসে বৃত্ত আর বিন্দুর জীবন পুরো এলোমেলো হয়ে যায়। দুজন দুজনকে খুব ভালোবেসেছিল, আর দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে। একজন ভালোবেসে অার অন্য জন ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে।

যখন ছেলেটা মেয়েটাকে ভালোবাসে তখন মেয়েটা বুঝে না,
যখন মেয়েটা বুঝে তখন ছেলেটা বুঝে না,
আর যখন দুজনেই বুঝে তখন বাকি পৃথিবী বুঝে না।

বৃত্ত আর ওর লোকেরা পাগলের মতো খুঁজছে বিন্দুকে। কিন্তু বিন্দুকে কোথাও খুজে পাচ্ছে না। রিজভীকে ফোনে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন পুরো পরিবার কর্পূরের মতো উবে গেছে।

ভিডিও ফুটেজ দেখা শেষ করে সাথে সাথেই আবার আহসান সাহেবের অফিসে যায় বৃত্ত, কিন্তু সেখানে তাকে পায় না। জানতে পারে আহসান সাহেব রিটায়ার্ড হয়ে গেছে। বৃত্ত এবার দিশেহারা হয়ে যায়, কি করবে কি না করবে কিছু বুঝতে পারে না। হঠাৎই ওর মনে পরে ইখতিয়ার মজুমদারের কথা। তখনই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। প্লেনের টিকিট না পাওয়ায় গাড়িতে করেই রওনা দেয়।
বৃত্তের কক্সবাজার থেকে বের হওয়ার কথা চিত্ত জেনে যায়। মজুমদার বাড়ির ইখতিয়ার মজুমদার ছাড়া সবারই বিন্দুকে পছন্দ। ইখতিয়ার মজুমদারকে সবাই ভয় পায়। বৃত্তের বাবা সাজিদ মজুমদার আজও তার বাবার সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে না। ইখতিয়ার মজুমদারের কথায় আজও মজুমদারদের পারিবারিক ব্যবসা ‘মজুমদার এন্টারপ্রাইজ ‘ এর শেষ কথা হয়।
বৃত্তের ঢাকায় আসার খবরে চিত্ত ঘাবড়ে যায়। বৃত্ত পুরো ওর দাদার স্বভাব পেয়েছে। চিত্ত বৃত্ত দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব ভাব। সেদিনের ঘটনা বৃত্ত সবটা চিত্তকে জানিয়েছে, এমনকি বিন্দুর শারীরিক অবস্থা, ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাও জানিয়েছে। চিত্তও নিজের মতো করে বিন্দুকে খুঁজছে। চিত্ত সাথে সাথে চিত্রাকে ফোন করে।
‘হ্যাঁ চিত্ত ভাইয়া বল।’
‘বৃত্ত বাড়িতে আসছে।’
চিত্রার হাতে চায়ের কাপ ছিল। বৃত্ত বাড়িতে অাসছে শুনে সেটা হাত থেকে পরে যায়।
‘তাহলে.. ‘
‘তাহলে অার কি? এতোদিন যেটা হওয়ার ছিল, আজ তাই হবে। আমাদের বাড়িতে আজ অনেক কিছু পাল্টে যাবে। বৃত্ত কি করবে তা জানি না, তবে এটা জানি দাদুকে আজ বৃত্তের কাছে মাথা নিচু করতে হবে।’
‘ভাইয়া তুই তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়।’
‘হুম, দাদী, মা অার চাচীকে খবরটা জানিয়ে দিস। অারেকটা কথা দাদুর কানে যেন কথাটা না যায়।’
‘ওকে ডান।’

‘বিশ্ব, মৃত্তিকাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব।’
‘কিন্তু কেনো?’
‘মৃত্তিকা বৃত্তর লিগ্যাল ওয়াইফ। আর আমি চাই না মৃত্তিকা বিন্দুর নাগালের মধ্যে থাকুক।’
‘বাবা বৃত্ত আমাদের খুজেই পাবে না। তুমি অযথা চিন্তা করছ। যদি খুঁজে পাওয়ার হত তাহলে আরো আগে খুজে পেত। এতদিন যখন খুজে পায় নি তখন সামনেও পাবে না।’
‘মৃত্তিকা কোথায়?’
‘রুমে আছে।’

বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে বিন্দু। চোখের নিচে কালি পরে গেছে। মাহবুবা খাতুন শাড়ির আচলে চোখ মুছে আহসান সাহেবের পাশে দাড়ায়।
‘মেয়েটা কোনো কথা বলছে না গো। আমার ফুটফুটে মেয়েটার কি হল গো, ও কি কোনোদিন ভালো হবে না?’
‘এসব কথা বল না মাহবুবা, আমাদের মেয়ের কিছু হবে না। ও আবার আগের মতো হবে, ওর হাসিতে আবার আমাদের ঘর ভরে যাবে।’
‘বাবা আপু আমার সাথে কথা বলছে না। তুমি ওকে বল না, আমি কখনো ওর সাথে ঝগড়া করব না, ওর চকলেট নিয়ে নেব না, ও যা বলবে তাই করব। ও কেন আমার সাথে কথা বলছে না?’

আহসান সাহেব স্ত্রী আর মেয়েকে জরিয়ে ধরে। দুজনেই কাঁদছে। বিশ্ব এসে বাবার পাশে দাড়ায়।
‘আমাদের আগের মৃত্তিকা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। তোমরা প্লিজ নিজেকে সামলাও। তোমরা এভাবে ভেঙে পরলে মৃত্তিকা ঠিক হবে কি করে বল।
বীনা তুই চল আমার সাথে। ‘

বিশ্ব আর বীনা মৃত্তিকার দুই পাশে বসে। মৃত্তিকা ওদের দিকে এবারও ফিরে তাকাল না।
‘এই মৃত্তিকা, মৃত্তিকা, দেখ তোর জন্য কি এনেছি। চকলেট এনেছি।’
‘ভাইয়া তুই শুধু আপুর জন্যই আনলি, আমার জন্য আনলি না।’
‘মৃত্তিকা কিছু তো বল।’
‘আপু..’

‘বৃত্ত..’
মৃত্তিকার মুখে বৃত্ত নাম শুনে বিশ্ব খুবই অবাক হয়।
‘বৃত্ত কি মৃত্তিকা বল?
‘বৃত্ত..’
‘বৃত্ত তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। একদম ভয় পাস না।’
বিন্দুর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে।

চিত্ত সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে অার বৃত্তকে ফোন দিচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কানেক্ট হচ্ছে না। রাত ১২ঃ২০ মি. হয়ে গেছে, এখনও বৃত্ত অাসছে না। চিত্ত গিয়ে ইখতিয়ার মজুমদার এর সামনে দাড়ায়।
‘আমার ভাইর যদি কিছু হয় তবে তোমায় আমি ছেড়ে কথা বলব না।’
‘চিত্ত কি বলছিস এসব? দাদুর সাথে কি কেউ এভাবে কথা বলে?’
‘বাবা, তুমি আর এখন এসবের মধ্যে কথা বলতে এস না। তুমি বা তোমরা জানো এই লোকটা কি করেছে? মৃত্তিকা আর বৃত্তর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে। মৃত্তিকা আজ মানুষিক ভাবে অসুস্থ।
কি মনে করেছিলেন? আপনি মৃত্তিকার বাবার কাছে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন আর এখানে বৃত্তকে আটকে রাখবেন, আর এসব কিছু বৃত্ত বা আমরা কেউ জানতে পারব না বুঝতে পারব না?
আজ একটা কথা বলে দেই বৃত্ত আপনার চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে আছে।’
‘ওই মেয়েকে কিছুতেই আমি বৃত্তর আশে পাশে থাকতে দেব না। তার জন্য আমারকে যা করতে হবে আমি তাই করব।’
‘তাহলে তো একটা খবর এখনও তোমার কাছে পৌছায়নি।’
‘কি খবর?’
‘বৃত্ত অার মৃত্তিকার বিয়ে হয়ে গেছে। ‘
‘আমি মানি না এ বিয়ে। আর..আর কি প্রমান আছে এ বিয়ের?’
‘প্রমান বৃত্তর কাছে আছে। বৃত্তকে আজ আসতে দিন, আজ আপনাকে প্রলয় মজুমদার বৃত্তর সামনে দাড়াতে হবে।দেখি কিভাবে সামলান সবটা।’

‘চিত্ত মৃত্তিকা কোথায় এখন?’
‘আমি বা বৃত্ত কেউই জানি না ও কোথায়, তবে খোঁজ চলছে।
কিন্তু বৃত্ত এখনও আসছে না কেন? এতক্ষণে তো এসে যাওযার কথা।

সারারাত কেটে গেছে, কিন্তু বৃত্ত তখনও বাড়ি ফেরে নি। ড্রয়িং রুমে চিত্ত, চিত্রা আর মম সারারাত বসে ছিল। সকাল ৬ টা নাগাদ ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন আসে। ফোনের ওপাশের কথা শুনে চিত্ত ফ্রিজড হয়ে যায়। তখনই মম অার চিত্রা আসে কফি নিয়ে। কানে ফোন নিয়ে চিত্তকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দুজনেরই শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে যায়। চিত্রা কফির ট্রে রেখে চিত্তর কাঁধে হাত রাখে। হাত থেকে ফোনটা পরে যায় আর ও বসে পরে, চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। চিত্রা ফোনটা উঠিয়ে কানের কাছে নেয়, ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে।

‘ভাইয়া কি হয়েছে?
কিছু তো বল।’
‘এই ভাইয়া, কে ফোন করেছিল?
প্লিজ ভাইয়া কিছু বল। দেখ এবার কিন্তু আমাদের খুব ভয় করছে।’
চিত্ত চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।
‘ইখতিয়ার মজুমদার, কোথায় আপনি? বেরিয়ে আসুন। ইখতিয়ার মজুমদার, ইখতিয়ার মজুমদার। ‘
চিত্তর চিৎকারে সবাই বেরিয়ে আসে।
‘কি হয়েছে চিত্ত? তুই এভাবে তোর দাদুর নাম ধরে ডাকছিস কেন? উনি তোর গুরুজন। ‘
‘কি ব্যাপার, এই সকালে এমন অসভ্যর মতো চিৎকার করছ কেন?’
‘আপনার জন্য খুব ভালো একটা খবর আছে। আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।
আমার ভাই বৃত্ত আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। গতকাল রাতে তেলের ট্রাকের সাথে ওর গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়। বেওয়ারিশ হিসেবে কুমিলার একটা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। আজ সকালে ওকে ঢাকায় শিফট করা হয়েছে, ফোরটি% বার্নড।’

চিত্তর কথা শুনে সবাই কান্নায় ভেঙে পরে। বৃত্তের মা জ্ঞান হারায়। মম আর চিত্রা বসে পরে।

‘দাদু তোমার আনন্দ হচ্ছে তো?
শুধু মাত্র তোমার জন্য আমার ছোট ভাইয়ার এ অবস্থা।
শুধুমাত্র তোমার জন্য ২ টা পরিবার কষ্ট পাচ্ছে। দুটো মানুষের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।
একবার বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখ, এটাও তোমার জন্য হচ্ছে।
আমি তোমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না।’
‘বৃত্তর জীবনের সুর বিন্দুকে তো তুমি আগেই ওর থেকে কেড়ে নিয়েছ, এবার ওর জীবনটাও চাই তোমার। বৃত্ত ওর সুরের সাথে জীবনটাও তোমার জন্য হারাতে বসেছে। বৃত্ত যদি ওর জীবনের হারানো সুর খুঁজে না পায় তবে আমরা কেউ তোমাকে ক্ষমা করব না।’
‘বড় ভাইয়া আমাকে ছোট ভাইয়ার কাছে নিয়ে চল।’
‘হ্যাঁ চিত্ত ভাইয়া, নিয়ে চল।’
‘বাবা তুমি চল আমাদের সাথে। কাকিমা তুমি মাকে সামলাও।’
‘আমিও যাব।’
ইখতিয়ার মজুমদার যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে চিত্ত আটকে দেয়।
‘আর এক পাও তুমি বাড়াবে না। আজ যদি তুমি বৃত্তর আশেপাশে যাও, তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আমার ভাইকে যদি ফিরে না পাই তবে তোমার এবাড়ি থেকে ২টা খাট উঠবে, একটা আমার ভাইর আরেকটা তোমার।’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here