তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৩০,৩১
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩০
” আজ একবছর পাঁচমাস বিশদিন। আপনি নেই আরসাল। আপনিহীন আমার প্রতিটি বেলা এক যুগ সমান। প্রতি প্রহর নিমিষ প্রাণহীন। এই দেহ তো বেঁচে আছে, কিন্তু এতে প্রাণ নেই । নিষ্প্রাণ বেঁচে আছি এতকাল! আমার দিবা কাটে আপনাকে ভেবে, রাত্রি কাটে জেগে। আচ্ছা, আমার অপরাধ কি এতই বড়! যার শাস্তি এত ভয়ংকর! কেন ছেড়ে গেলেন আরসাল! কতটা ভালোবাসি কতটা চাই একবার বলা সুযোগও কি পাওনা ছিল না আমার? আমি আছি, আপনার ছেড়ে যাওয়া সেই গলির মরেই আছি! চিরকাল অপেক্ষায় রইলাম আপনার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি আসবেন,ফিরে আসবেন। আপনাকে যে আসতেই হবে। আপনার পুতুল বউ যে আপনার অপেক্ষায়!”
চোখ মেলে ব্রিজের রেলিং চেপে নিচে জলের গভী্রে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়রা। গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখে মুখে তিক্ত যন্ত্রণার আভাস। ডুকরে কেঁদে উঠে সায়রা। খানিক দূরে তুর্জয়ের গাড়ি থেমে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে আরমিন বসে। এই দেড় বছরে সায়রা নিজেকে ঘর বন্ধী করে নিয়েছে, ঘরের চার দেয়ালই যেন তার দুনিয়া। অন্ধকার যেন তার ভীষণ প্রিয়। আরসালের স্মৃতি জড়িয়ে ঘরের এক কোনে চুপচাপ পড়ে থাকে। এই দিনদুনিয়ার কোন কিছুর ধ্যান নেই তার। কখনো জোর করেও বাড়ির বাহিরে আনা যায়না তাকে, শুধু মাঝেমাঝে এই জায়গাটায় আরসালের স্মৃতিচারণ করতে আসে। যতবার আসে প্রত্যেকবারই খুব করে কাঁদে সায়রা। চাতক পাখির মত ছটফট করে শুধু।
সায়রাকে কাঁদতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলে, তুর্জয় আটকায় আরমিনকে।বলে,
–” ওকে কাঁদতে দেও! খুব করে কাঁদতে দেও। শান্তি পাবে! ভেতরের যন্ত্রণা গুলোকে অশ্রু সাথে বেরিয়ে আসতে দেও।”
আরমিন আর এক পাও বাড়াল না। গাড়িতে গুটিয়ে বসে রইল। ডুকরে কেঁদে উঠল,
–” এই দুনিয়াতে আমি- ই বুঝি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বোন। যে নিজের বোনের জীবন ধ্বংস করতে দিনরাত প্রার্থনা করেছি। আমার জন্যই আজ আমার বোনের জীবন এমন ছন্নছাড়া , এলোমেলো! ঘৃণা হয়, নিজেকে প্রচণ্ড ঘৃণা হয়।”
পাশ থেকে আরমিনের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল তুর্জয়। অন্যহাতে চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল,
–” ভাগ্যের উপর কারো কথা চলে না। নিজেকে দোষারোপ করোনা আরমিন। তোমার প্রার্থনায় আরসাল আমাদের ছেড়ে যায়নি, হয়তো তাদের নিয়তিতেই এক সাথে থাকা লিখা ছিল না! নিজেকে ঘৃণা না ভালোবাসো। নিজের আশেপাশে যারা তোমাকে ভালোবাসে তাদের জন্য বাঁচো দেখবে জীবন কত সুন্দর!”
আরমিন নিমিষ দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই মানুষটা তাকে এত কেন বুঝে? আরমিনের প্রত্যেক অন্যায় অপরাধ সবটাকে এত সুন্দর ভাবে কি করে মেনে নেয়! আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল আরমিন,
–” আমাকে এত কেন বুঝেন? আমার সব অন্যায় অপরাধকে এত ইজিলি কি করে মেনে নেন? কেন?”
তুর্জয় ম্লান হেসে উত্তর দিলো,
–” শুনোনি? তুমি যাকে ভালোবাসো নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসো। তার ভালোটাকেও ভালোবাসো, মন্দটাকেও ভালোবাসো!”
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরমিন। তুর্জয়ের দৃষ্টিতে এক সমুদ্র ভালোবাসা। বেশ কিছুক্ষণ কাটল। সায়রাকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে আরমিনের হাত ছাড়ল তুর্জয়। আরমিন দূরে সরে গেল। সায়রা চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে পিছন সিটে গা এলিয়ে বসল, চোখ বুজে নিলো। আরমিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সায়রাকে দেখছে। মেয়েটা আর আগের মত নেই। ভীষণ পাল্টে গেছে। চেহারায় আগের মত সেই উজ্জ্বল ভাব নেই। শরীর দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। রক্তিম চক্ষু , চোখ জোড়ায় যেম অনন্তকালের ঘুম। শেষবার কবে সায়রাকে হাসতে দেখেছে মনে নেই আরমিনের। চেহারায় সারাক্ষণ গম্ভীর ভাব। সবকিছুতে ছন্নছাড়া অনিয়ম বেখেয়ালি। সেই আগের চঞ্চলা ,হাসি উজ্জ্বল ,লাজুকলতা সায়রা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। প্রিয়জন হারানোর পীড়া বুঝি এমনি তীব্র হয়? চোখ ভরে এলো আরমিনের। আহত আওয়াজে বলল,
–” তুই ঠিক আছিস সায়রা?”
সায়রা চোখ বুজে আগের মত রুখা উত্তর দিলো,
–“আমি ঠিক আছি আপু, বাড়ি চলো! ”
.
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ড্রইং রুমে বসে পান চিবাচ্ছেন জুলেখা বেগম। মুনতাহা বেগমের অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছেন। পানের ছিট ফেলতে ফেলতে বললেন,
–” আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাবী এই মেয়ে একটা অলক্ষি। এই মেয়েই আমাদের ছেলেটাকে খেয়েছে। কেন যে আরসাল এই মেয়েটাকে বিয়ে করল, আর আপনারাও মেনে নিলেন। যদি আরসাল ওকে বিয়ে না করত তবে আমাদের ছেলে আজ বেঁচে থাকত!”
মুনতাহা বেগম বিরক্ত হলো। জুলেখা বেগমকে শক্ত ভাবে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু দরজায় সায়রাকে দেখে চুপ করে গেল। মুনতাহার পাশে এসে বসল সায়রা। টেবিলের উপর থেকে স্ফিগমোম্যানোমিটার নিয়ে বিপি চেক করল। শক্ত আওয়াজে বলল,
–” বিপি লো, দুপুরে খাওনি তাই না? কেন এমন হেলামি করো । এখন কে ভুগছে? কে কষ্ট পাচ্ছে? আমি বাড়িতে না থাকলেই তোমার যত হেলামি আর অনিয়ম। এমন কেন তুমি বলো তো!”
মুনতাহা বেগম বাচ্চাদের মত অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বললেন,
–” তুই বাড়ি ছিলি না। একা একা খেতে ভালো লাগেনা মা।”
সায়রা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। শাসানোর আওয়াজে বলল,
–” আর যেন হেলামি না হয়। তুমি এখনি খাবে। আমি নিজ হাতে তোমাকে খায়িয়ে দিবো। দিনদিন তুমি বড্ড বেখেয়ালি হচ্ছো। এমন হলে কি হবে?”
পাশ থেকে জুলেখা বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
–” বেয়াদব মেয়ে তোমার সাহস কত বড়! ভাবীকে তুমি শাসাচ্ছ! এই মেয়ে এই। তুমি কে হ্যাঁ? এই বাড়িতে কেন পড়ে আছো? এখনো যাচ্ছনা কেন? বুঝেছি এসব নাটক করে সম্পত্তি হাতাতে চাইছ! নিলজ্জ মেয়ে, লজ্জা করেনা! আমাদের ছেলেকে খেয়েছ এখনআবার ভাই ভাবীকে মারতে চাইছ?”
সায়রা চুপ থাকল। আজকাল লোকের এসব কথা আর কানে তুলে না সায়রা। প্রতিনিয়ত এসব কথা শুনতে শুনতে অনুভূতি জিনিসটাই মরে গেছে। সত্যি এখন নিলজ্জ হয়ে গেছে। লোকের এসব অপমান গায়ে মাখে না আর। না অন্যের কথায় ফ্যাচফ্যাচ কাঁদে। এখন শরীর যেন লোহার তৈরি, লোকের হাজারো অপমান অপবাদ কোনকিছুতে ভাঙ্গে না সে! প্রতিবাদী আওয়াজে মুনতাহা বললেন,
–” আমার ঘরের লক্ষি, আমার মেয়ে সায়রা! শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে আছি আমরা। এটা সায়রার বাড়ি। সায়রার যা ইচ্ছে ও করবে। খবরদার! আমার মেয়ের সাথে সাবধানে কথা বলবে জুলেখা। বাহিরের লোক এসে আমার মেয়েকে কথা শুনাবে আমি তা সহ্য করব না!”
প্রচণ্ড অপমানে মাথা নুয়ে নিলো জুলেখা বেগম। মনে মনে বেশ কিছুক্ষণ বিরবির করল। তা কারো কান অবধি পৌঁছাল না।
.
ঘরে ফিরে রিদ্ধিকে দেখে বেশ চমকাল সায়রা। ম্লান হেসে রিদ্ধির ছয় মাসের কন্যা রিধিমাকে কোলে তুলে নিলো। রিধিমাও খালামণিকে দেখে খিলখিল হেসে উঠল। যেন তার কত চেনা। রিধিমাকে আদর করতে করতে বলল সায়রা,
–” তুমি আসবে, আগে বললে না যে! জরুরী কোন কাজে এসেছ কি? ”
রিদ্ধি ছিটকে উঠল। আমতাআমতা করে হাসল। রিদ্ধি হুট করে আসেননি। বিশেষ এক কারণেই এসেছে। কি করে বলবে সায়রাকে, যে তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে! রিদ্ধি আমতাআমতা উত্তর দিলো,
–” অনেকদিন হলো তোকে দেখি না। তাই ভাবলাম একটা রাত তোর সাথে এসে থাকি। জানিস তো সামনে সাপ্তাহে আমরা সবাই সিলেট যাচ্ছি। ফ্যামিলি ট্রিপ! তুইও কিন্তু সাথে যাচ্ছিস! ”
সায়রার ঝটপট উত্তর,
–” আমি যাবো না দি , আমার ভালোলাগেনা। তোমরা যাও!”
–” সবাই যাচ্ছে! খালা খালু আহনাফ আঙ্কল মুনতাহা আন্টিও যাচ্ছে!”
–” আমি যাবোনা রিদ্ধিদি! প্লিজ জোর করোনা আমাকে!”
বিরক্ত হলো রিদ্ধি। তেজি কন্ঠে বলল,
–” আর কতকাল সায়রা! আর কতকাল এভাবে কাটাবি ? অতীত ভুলে সামনে আগা। এটা কোন জীবন না। এটাকে জীবন বলে না। ”
–” শ্বাস নিচ্ছি, হাঁটছি চলছি, এটাই তো জীবন। আমি ভালো আছি দি। আমাকে আমার মত থাকতে দেও!”
–” এটা কেমন জীবন যেখানে কোন রঙ নেই। সাদামাটা রঙহীন!”
–” আমার এই সাদামাটা জীবন- ই সয়ে গেছে! রঙিন জীবনের কথা ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।”
–” ভাগ্যকে পাল্টানো যায়না। তাই বলে কি এভাবেই একাকী কাটিয়ে দিবি সারাজীবন! তোর বয়সী অনেকে এখনো বিয়েই করেনি সায়রা। নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দে।”
–” বিয়ে কয়বার হয় দি? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ আরসাল। উনার স্থান আমি কাউকে দিতে পারবো না দি। তাছাড়া বিয়েই কি সব? একাকী কি বাঁচা যায় না? এই দেখ আমি বেশ ভালো আছি। কি দরকার অন্যকাউকে আমার সাথে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করার? যাকে আমি ভালোই বাসতে পারবো না তাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে কি লাভ!”
চুপ রইল রিদ্ধি। সে বেশ জানে সায়রার যুক্তির সাথে পেরে উঠতে পারবেনা। তাই বলে সে ক্ষান্ত হবে না। এভাবে চোখের সামনে বোনের জীবন কি করে নষ্ট হতে দিবে সে! এটা কোন জীবন না। সায়রাকে স্বাভাবিক হতে হবে। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। জোর করেই সিলেটে নিয়ে যাবে। বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। সিলেটে সায়নের বন্ধু আবিরের বাড়ি। রিদ্ধির বিয়েতে সায়রাকে দেখেছে আবির।সায়রাকে ভীষণ পছন্দ তার। আরসালের সাথে সম্বন্ধ পাকা শুনে ব্যাপারটা আর সামনে আগায়নি। সেদিন কথায় কথায় সায়ন থেকে আরসালের এক্সিডেন্টের কথা শুনে খুব আফসোস করেছে, একটা সুযোগ চাইছে। সায়রার অতীত নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। উনাদের কোন আপত্তি নেই। এখন সায়রা রাজি হলেই হয়।
চলবে………
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩১
যাবেনা, যাবেনা বলেও শেষ অবধি যেতে হলো সায়রাকে। অন্যসবার কথা ফেলতে পারলেও মুনতাহার কথা এড়াতে পারেনি সে। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আসতে হলো। মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেব আসেননি। আহনাফ সাহেবের জরুরী অফিসিয়াল কাজের কারণে শেষ মুহূর্তে এসে ক্যান্সেল করতে হয়েছে তাদের। সায়রাকে জোর করেই পাঠিয়েছেন তারা।
জানালার কাচে হেলান দিয়ে দূর অদূরে চেয়ে আছে সায়রা। এলোমেলো অগোছালো হাওয়ায় চুল উড়ছে তার। গাড়ি চলছে নিরুদ্দেশ অচিন পথে। দুপাশে চা বাগান মাঝবরাবর রাস্তা। দূরে পাহাড় ভেসে আছে। চোখের পলকেই সবকিছু মিলিয়ে যাচ্ছে। এই দেড় বছরে প্রথম এত বড় জার্নি করছে সে। সবার মাঝে থেকেও যেন এখানে নেই সায়রা। নিজেকে বড্ড একা অসহায় লাগছে। বারবার শুরু আরসালের কথা মনে পড়ছে। চোখজোড়া ভরে আসছে। মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করছে। যেন কোন বড় এক ঝড় আসতে চলছে।
ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে আবিরের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চাইল নিপা বেগম। মায়ের ক্রুদ্ধতার কারণ আবিরের জানা। আবিরদের হোটেল বিজনেস। আবিরের বাবা মারা যাবার পর এই হোটেল বিজনেস তিনি একা হাতে সামলেছে। ভীষণ সময়নিষ্ঠ তিনি। সময়কে অবহেলাকারী লোকজন উনার একদম পছন্দ না। অতীত জেনে সায়রাকে খুব একটা পছন্দ করেননি তিনি। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সুযোগ দিচ্ছেন। নিপা বেগম ক্রুদ্ধ আওয়াজে বললেন,
–” কেমন মেয়ে পছন্দ করেছ আবির? উনাদের কি নিম্নতম কমনসেন্স নেই! বিকালের কথা বলে সন্ধ্যা হতে চলল এখনো পৌঁছায়নি। এই মেয়ে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই, শুধু তোমার কথা ভেবে একটা সুযোগ দিচ্ছি, এখানে এসেছি! ”
চুপ রইল আবির। মনে মনে নিজেকে শখানেক গালি দিলো। আজ সায়রারা আসছে, আজই মায়ের সাথে দেখা করানোর পরিকল্পনা করাটা একদম উচিত হয়নি তার। গাড়িঘোড়ার রাস্তা সময় লাগতেই পারে। তার বুঝা উচিত ছিল ব্যাপারটা। মায়ের পাশের চেয়ারটায় বসে। মাকে শান্ত করার চেষ্টায় বলল আবির,
–” গাড়িঘোড়ার রাস্তা এতটা পথ একটু তো সময় লাগবেই। ট্রাস্ট মি মা! তুমি যখন সায়রাকে দেখবে তুমি সব ভুলে যাবে। তোমার সব রাগ জেদ ভ্যানিস হয়ে যাবে!”
নিপা বেগম কিড়মিড় করে উঠল। ছেলেটার মাথা গেছে। একদম পাগল হয়েছে ছেলেটা। না হয় এমন বিধবা মেয়েকে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে! প্রত্যুত্তর করল না নিপা বেগম চুপ করে রাগী তপ্ত নিশ্বাস ফেলল শুধু।
চা বাগানের মাঝে বিশাল বিস্তৃত রিসোর্ট। বড় চওড়া গেট। কার্ড দেখাতেই গেট ছাড়ল দারোয়ান। শুঁ করে ভিতরে ঢুকল গাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই আবিরকে দেখতে পেল সায়ন। আবির চওড়া হেসে এগিয়ে এলো। স্টাফরা এগিয়ে এসে ব্যাগপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলো। সবাই একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করছে। শুধু সায়রাই দূরে দাঁড়িয়ে। নিপা বেগম দূর থেকে সাবধানী চাহনিতে সবটা দেখছিলেন। এত মানুষের মাঝে সায়রার দিকে উনার দৃষ্টি আটকায়। অবশ্য ছবিতে একবার দেখেছিলেন তিনি। তাই চিনতে খুব একটা ভুল হলো না উনার। মেয়েটা ছবি থেকে বাস্তবে বেশি সুন্দরী। চেহারায় অন্যরকম আদুরে স্নিগ্ধ ভাব আছে। চোখজোড়া ভীষণ সরল নিষ্পাপ। এত বছরের মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা আছে উনার। মুখশ্রী দেখলেই ছককাটা হিসাব করে তার চরিত্র ধরে ফেলতে পারেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছে, সায়রা মেয়েটা ভীষণ সরল। মেয়েটার মাঝে কৃত্রিম, ছলচাতুরী ,মিথ্যাচারের বিন্দুমাত্র ছিটাফোঁটা নেই! এমন মেয়ের হাজার কমতি থাকলেও পুত্রবধূ করতে কোন আপত্তি নেই উনার। বরং হেসে হেসে সম্পর্কটা মেনে নিবেন উনি!
এক কথার মানুষ নিপা বেগম। যা বলবেন সরাসরি বলতেই পছন্দ করেন তিনি। সায়রার দিকে এগিয়ে আসতেই ম্লান হেসে সালাম জানায় সায়রা। সালামের উত্তর নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন নিপা বেগম,
–” আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে সায়রা। তোমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি না থাকলে আগামীকালই পাকা কথা সারতে চাই! ”
নিপা বেগমের কথায় হতভম্ব সায়রা। কিছুতেই তার বিস্ময় কাটছে না। কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় মুখে রিদ্ধির দিকে তাকাল। রিদ্ধির করুন চাহনি। সায়রার বুঝতে বাকি রইল না এসব তার পরিবারের প্রি- প্লান। মিথ্যা বলে ট্রিপের কথা বলে সায়রাকে সিলেটে এনেছে তারা। তাই- ই গাড়িতে আবির নামক লোকটার এত প্রশংসা করছিল? ক্রোধে সায়রার চোখ টলমল করছে। আশেপাশে লোকজন দেখে চুপ রইল সায়রা। রাস্তায় সবার সামনে কোন তামাসা করে চাইছে না সে।
.
রুমে পৌঁছিয়ে চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠল সায়রা। ক্রোধিত আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল রিদ্ধির দিকে,
–” কেন এমন করলে দি? এই বিশ্বাসঘাতকতার কোন মানে ছিল? আমি স্পষ্ট বলেছিলাম বিয়ে করব না আমি! তোমরা সবাই আমাকে কি পেয়েছ? খেলনাপুতুল! বিয়ে দিয়ে দিলেই আমি ভালো থাকবো। তোমরা কেন বুঝো না আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি ভালো আছি। ”
সিন্থিয়া বেগম বিরক্তি ভারী ধমক দিয়ে বললেন,
–” কোন কিছু আমাদের চোখে পড়ে না! তোর কি মনে হয় আমরা অন্ধ সায়রা? তোর এই ছন্নছাড়া জীবন দেখতে আমাদের ভালো লাগে? আমি তোর মা। আমি চাই আমার মেয়ের একটা সাজানো গোছানো সুন্দর জীবন হোক। আর কতকাল এভাবে পড়ে থাকবি তুই? একাকী বাঁচা যায়না!”
–” মা তুমি এমন বলছ? তুমি? দেড়বছর কি অনেক সময়? যদি আরসাল কোনদিন ফিরে আসে তখন উনাকে কি বলবে মা? তোমরা কেন বুঝো না আমি আরসালের জায়গা কাউকে দিতে পারবো না। কাউকে না। যদি এরপরও আমাকে জোর করো তাহলে এর ফল খারাপ হবে মা!”
— ” আরসাল আর কোন দিন ফিরবে না সায়রা। ও নেই ! কেন মানছিস না তুই? ওর জন্য বসে থাকা বোকামি! ”
চিৎকার করে বলল সিন্থিয়া বেগম। সায়রা এবার কেঁদেই ফেলল। নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারছেনা সে। নিজের কাছের মানুষ গুলো এমন আচরণ করলে কোথায় যাবে সে? কার কাছে যেয়ে মুখ গুজবে? তারা কেন বুঝেনা, সায়রার আরসাল ছাড়া কাউকে চাইনা! কাউকে না!
কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে ছুটে গেল সায়রা। আরমিন পেছন পেছন যেতে চাইলে আটকাল তুর্জয়। গম্ভীর আওয়াজে বলল,
— ” ওকে ওর মত থাকতে দেও”
.
বাগানের লেকের উপর কাঠের সিড়ি বেয়ে ওপারে চলে গেল সায়রা। ওই আলো ওই লোকালয় অসহ্য লাগছে তার। সব কিছু বিরক্তিকর। সব! অন্ধকারে কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগল সায়রার। মাটিতে ছিটকে পড়ল দুজন। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে সবকিছু অস্পষ্ট। মাটি থেকে উঠতে উঠতে চোখ মুছতে মুছতে মৃদু আওয়াজে বলল “সরি”
ছুটে চলে গেল বাগানের শেষ দিকে। পেছনের মানুষটা পেছন থেকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দিক অনুসরণ করে চিন্তিত মুখ করে পেছন পেছন গেল সায়রার।
বাগানের শেষ মাথায় বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে পড়ল সায়রা। নিরিবিলি জনশূন্য পরিবেশ। সায়রা মুখ চেপে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এলোমেলো ভাবে নিজের হাত খামচাচ্ছে আর কাঁদছে। কাঁদছে তো কাঁদছেই। পৃথিবী সব কিছু মেনে নিতে পারবে সায়রা। আরসাল আর ফিরবেনা এই একটা কথা মেনে নিতে পারবে না সে। এটা তার জন্য অসম্ভব। এই একটা আশা নিয়েই তো বেঁচে আছে সে! এই আশাটাও ফুরিয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচবে সায়রা?
আকাশ পানে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সায়রা। চিৎকার করে বলল,
–” আপনি কোথায় আছেন আরসাল? কেন ফিরছেন না! প্রতিদিন একটু একটু করে ভাঙছি আমি, আমি আর পারছি না আরসাল। আর পারছিনা! নিজেকে আর শক্ত রাখছে পারছিনা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে প্রতিনিয়ত আমার!”
বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। হালকা শীত শীত লাগছে সায়রার। কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে ধ্যান নেই তার। মাথাটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। নাকে চিরপরিচিত সেই চেনা মিষ্টি ঘ্রাণ। আমতাআমতা করে চোখ খুলল সে। কারো বুকে গভীর ভাবে ল্যাপটে আছে। হুশ ফিরতেই ছিটকে দূরে সরে যেয়ে চাইল সে। পারল না। পাশের মানুষটা কোমর চেপে গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলো বুকে। মাথা তুলে পিটপিট দৃষ্টি মেলে উপর দিকে চাইল সায়রা। দূরের আলোয় আবছা স্পষ্ট চারিদিক। বিস্ময়ে থম মেরে রইল। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘আরসাল’।আঁখি জোড়া জলে ভরে এলো। টলমল দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল।কিছু বলতে চাইল। গলা থেকে আওয়াজ এলো না। আরসাল কপালে চুমু এঁকে বলল,
–” আমি আছি পুতুলবউ ! তোর কাছেই আছি!”
সায়রা ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। এটা কি স্বপ্ন! এতটা বাস্তবানুগ স্বপ্নও হয়? যদি এটা স্বপ্ন হয় তবে এই ঘুম কাটাতে চায়না সায়রা। চিরতরে এই স্বপ্নেই রয়ে যেতে চায়।
চলবে…….