তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ২৮,২৯

তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ২৮,২৯
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২৮

থমথমে রাতের আঁধার কাটিয়ে সোনালি ভোরের আলো এসে ছুঁইল ভুবন। ঘুম ভাঙ্গল সায়রার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘুমে চোখজোড়া লেগে আসছে বারংবার! মাথা চেপে ধরল সে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, মাথা এখনো চিনচিনে ব্যথা করছে। আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখল- খালি বিছানা। বালিশের উপর সায়রার ওড়না রাখা। দ্রুত হাতে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াল। মাটিতে পা ছোঁয়াতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠল। গতরাতের চোট এখনো অনেকটাই কাঁচা। শুখাতে সময় লাগবে। এভাবে হুটহাট চলাচলে চোট গাঢ় হয়ে ইনফেকশন হতে পারে! তাই আলতো করে পা নামাল। আরসাল রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের আওয়াজ আসছে। তবে কি উনি ফ্রেশ হচ্ছে? বোধহয়!
অন্ধকার ঘরটায় আবছা আলো। জানালায় ময়ুরপঙ্খীবর্ণ ভারী পর্দার আবরণ। ঘরটা বেগনিলাল বর্ণে রাঙানো। ঘরের একপাশে দেয়াল খোঁদাই করা ছোট লাইব্রেরী, সেখানে নামীদামী দেশবিদেশের বিভিন্ন লেখকের বই। মাঝেই সেগুন কাঠের মেরুন মখমলে মোড়ানো সোনালি রাজকীয় গদি। গদির ঠিক উপরে ছোট সাইজের ঝাড়বাতি, যার টিমটিম আলোয় উজ্জ্বল থাকে চারিদিক! এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দের সায়রার। আরসালের অবর্তমানে ঘন্টার পর এই জায়গায় কাটিয়েছে সে। এই ঘরটায় হাজার বার এসেছে কিন্তু আজকের অনুভূতি অন্যসব বারের চেয়ে একদমই ভিন্ন! আজ অনুভূতিটা তিক্তার মাঝে মধুর। ধীর পায়ে জানালার দিকে পা বাড়াল সায়রা। এক ঝটকায় ভারী পর্দা গুলো গুছিয়ে নিলো। সকালে কমল আলো মুখ ছুঁয়ে দিলো সায়রার। আলোর তেজ সহ্য করতে না পেরে বুজে নিলো আঁখিদ্বয়। ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো। পেছন থেকে একজোড়া হাত কোমর চেপে ধরল সায়রার। আচমকা শীতল পরশে কেঁপে উঠল সে। ঘাড় ফেরাতে গিয়ে পারল না সে। পেছনের মানুষটার উন্মুক্ত বুকে আটকাল। গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা বলে দিচ্ছে, এটাই তার চিরচেনা অতিপরিচীত মানুষটা! আরসাল! যার সাথে গতরাতে তিন কবুল পড়ে বিয়ে হয়েছে সায়রার।
অকস্মাৎ কোমর চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরসাল। সায়রার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আলতো করে কানে ঠোঁট ছোঁয়াল। আরসালের ভেজা চুলের চুপসে পড়া বিন্দু বিন্দু পানি ঘাড়ে পড়ছে সায়রার। শিহরণে কেঁপে উঠল সে। আবেশে চোখ বুজে নিলো!

–” গুড মর্নিং বউ!”

পেছন থেকে আবেগ মাখা গাঢ় কন্ঠ আরসালের। প্রত্যুত্তর করল না সায়রা। অপেক্ষা করল না আরসাল। ধাঁ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সায়রাকে। সায়রার চোখ তখনো বন্ধ। আঁখি পল্লব ভেজা। সায়রাকে কোলে তুলে পাশের ডিভাইনটায় বসল। সায়রা ছাড়া পাবার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে শক্ত করে কোমর চেপে ধরল আরসাল!
আলতো হাতে গাল ছুঁয়ে দিয়ে, মুখ টেনে নিজের কাছে আনল। ম্লান স্পর্শে গাল ছুঁইছে বারংবার! চিন্তিত মুখ করে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে,

–” কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? পায়ে কি ব্যথা করছে? প্রচুর! ”

দুদিকে মাথা নাড়াল সায়রা। যার অর্থ ‘না , ব্যথা করছে না!’। কপালে চিন্তার রেখা গুছল আরসালের। সায়রার অগোছালো চুল গুলো কানের পেছনে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–” তাহলে ফ্যাচফ্যাচ কাঁদছিস কেন? ”

সায়রা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। নাক টানতে টানতে বলল,

–” আমাকে কেন বিয়ে করলেন? খুব কি প্রয়োজন ছিল?”

চমকাল আরসাল। হতভম্ব দৃষ্টিতে কয়েক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে থাকল। এত অবুঝ কেন মেয়েটা! এত অবুঝ হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল! একটু বুঝদার স্বার্থপর হলে কি ক্ষতি হতো?
আরসাল আগের মত গম্ভীর আওয়াজ করে বলল,

–” হ্যাঁ, প্রয়োজন ছিল। অত্যন্ত প্রয়োজন! নিশ্বাস নেওয়াটা যেমন প্রয়োজন তেমনি তোকে আমার জীবনে প্রয়োজন! নিজেকে তুই কি মনে করিস? উদারতার দেবী! উদার মনে বোনের জন্য আমাকে ছাড়ছিলি?”

–” আপনি আমাকে ভালোবাসেন এটা যেমন সত্য, আপুর প্রতি আমার ভালোবাসাটাও ঠিক ততটাই সত্য! আজ আরমিন আপুর আরো সুন্দর জীবন হতে পারতো। শুধু আমার করা একটা ভুলের জন্য আজ আরমিন আপু সবার দৃষ্টিতে দোষী! এই অনুতাপ আমি কি করে গুছাব!”

–” তোদের দুবোনের ভালোবাসা- বাসিতে আমার স্থানটা কোথায় সায়রা? তোদের ভালোবাসা! তোদের অনুতাপ- অনুশোচনা! এসবের মাঝে আমার ভালোবাসা দমে গেল? আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নাই?”

চুপ রইল সায়রা। আরসাল উত্তরের অপেক্ষা করল। মিলল না! বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,

–” আমি জানি তুই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসিস! তুই না বললেও তোর ঐ সরল চোখ তা বলে। তোকে জোর করে আদায় করার ইচ্ছা ছিল না আমার। রাজরানি সাজিয়ে আমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসাতে চেয়েছি! কিন্তু…
আমার তোকে হারানোর ভয় ছিল সায়রা। ছোট থেকে দেখে দেখে বড় করলাম আমি! শেষমেশ আমার চোখের সামনে দিয়ে অন্যকেউ নিয়ে যাবে? এত সহজ! এখন সব ভাবাভাবি বাদ। এখন থেকে তুই শুধু আমাকে ভাববি। শুধুই আমাকে!”

ততক্ষণে মাথা নুয়ে নিয়েছে সায়রা। আরসাল বিছানায় সায়রাকে বসিয়ে দিলো। বড় কাবার্ডের ভেতর থেকে দুইটা ব্যাগ বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো। বলল,

–” এখানে শাড়ি কামিজ দুইটাই আছে বাকি গুলা কাবার্ডে , যেটা ভালো লাগে পর!”

–” কখন কিনলেন এসব?”

–” তোর প্রথম পরিক্ষার পরের দিন”

হতভম্ব চেয়ে থাকল সায়রা। তার মানে সেদিনের সাবধান বানী এমনি এমনি ছিল না! সব কিছু প্রি- প্লান করা ছিল। কাল জাস্ট বোমার মত ফাটিয়েছে। একেই বুঝি, ঠান্ডা মাথার খুনি বলে!
আরসাল ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। সায়রা ব্যাগ থেকে কামিজ বের করে সামনে ধরল। দেখে মনে হচ্ছে একদম ঠিকঠাক সাইজ । এত পার্ফেক্ট সাইজ উনি জানল কি করে! কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা!
আরসাল আয়নায় সায়রার বিস্মিত মুখ দেখে বাঁকা হেসে বলল,
–” ডোন্ট ওয়ারী পার্ফেক্ট সাইজ।”

বলেই চোখ টিপল আরসাল। হাত থেকে সাথে সাথে কামিজ বিছানায় পড়ল। লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। মুখের উপর এই ভাবে কেউ লজ্জা দেয়? লোকটার লজ্জাশরম কম বলে কি , সায়রাও কম নাকি! বিরবির করে বলল সায়রা,

–” আপনি অসভ্য! চরম নিলজ্জ!”

আরসাল সায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

–” একটু বের হচ্ছি! তাড়াতাড়ি ফিরব। তোর যা যা প্রয়োজন কাবার্ডের প্রথম তাক- এ আছে। সাবধান! বেশি হাঁটা চলা করতে হবে না। বেশি খারাপ লাগলে ফোন করবি আমাকে”

সায়রা বাচ্চাদের মত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
সায়রার ফোন গতকাল আবারো ভেঙেছে আরসাল। তাই পকেট থেকে একটা ফোন বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” পাসওয়ার্ড তোর বার্থডেট!”

.

গাছে পানি দিচ্ছিল মুনতাহা বেগম। নাস্তা শেষে এটা উনার নিত্যদিনের কাজ। খুরিয়ে খুরিয়ে মুনতাহা বেগমের পেছনে দাঁড়াল সায়রা। অপরাধি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মনে মনে কথা গুছাচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবে, কি বলে শুরু করবে। আচ্ছা, বড় মাও কি তার উপর রেগে!
পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে। ঘাড় ফিরে তাকাল মুনতাহা। সায়রাকে দেখে প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন,

–” চোট নিয়ে ছাদে আসতে গেলি কেন? দেখি দেখি পায়ের কি অবস্থা এখন।”

বলেই পা দেখতে লাগলেন। আফসোস কন্ঠে বললেন,

–” ইশ কতটা কেটেছে। এত নড়াচড়া করতে কে বলেছে তোকে! আবারো রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। তুই বড় হলি না সায়রা! বাচ্চামো এখনো রয়েই গেল!
চল, নিচে চল ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”

শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” এত কিছু হয়ে গেল! তোমার আমার উপর রাগ হয় না বড়মা?”

মুনতাহা বেগম মিহি হাসলেন। বললেন,

–” রাগ হবে কেন? আমি জানি যা হয়েছে এতে তোর কোন দোষ নেই। আমার রগচটা ছেলেরই দোষ। সেই তোকে জোর করে বিয়ে করেছে তা নিসন্দেহে বলতে পারি। এতে অবশ্য আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি সবসময় চেয়েছি তুই আমার আরসালের বউ হ। একমাত্র তুই- ই যার সামনে আমার এই রগচটা ছেলেটা দুর্বল। আমার ছেলেটা অল্পভাষী, রগচটা ঠিকঠাক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা। কিন্তু সে তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সায়রা। কোনদিন আমার ছেলেটার মনে কষ্ট দিস না। এটা তোর কাছে এক মায়ের আবদার!”

সায়রা মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলো। এই মানুষটা এত বুঝে কেন সায়রাকে!

চলবে……..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২৯

বেশ কিছুদিন কেটেছে। ভার্সিটির বন্ধ কাটিয়ে, দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু। নিয়মিত ক্লাস করছে সায়রা। অল্প কিছুদিনেই পুরোপুরি সংসারী হয়ে উঠেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও বেশ দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে। পুত্রবধূকে নিয়ে মুনতাহা আফনাফ সাহেবের গর্বের শেষ নেই। বাবা মায়ের সাথে সায়রার সম্পর্ক এখনো আগের মতই। মাহির আহমেদ মেয়ের এত বড় সিদ্ধান্তে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। ক্ষত ভড়তে এখনো বেশ সময় লাগবে! আরসাল সায়রার সম্পর্কটাও আপনি- তুই- তে আটকে।

ভার্সিটিতে সায়রা আরমিন মুখোমুখি হলেও, কথা হয় না। দুজন দুজনকে বেশ এড়িয়ে চলে। বাবার বাড়িতে যাওয়া হয়না সায়রার। বাবার রুষ্টতার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দু মাত্র সাহস নেই তার। সম্পর্ক গুলো এত বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে যে, তা পূর্বের রূপে ফিরতে এখনো অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আজ পাখি বায়না ধরেছে, সায়রাকে যেতে হবেই হবে! আজ পাখির জন্মদিন। ছোট বোনের আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি কই সায়রার। তাছাড়া বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সায়রা আজ ঐ বাড়িতে যাবে। আর কারো জন্য না হোক, পাখির জন্য যাবে! বিকালবেলা। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে। পশ্চিমা আকাশে রক্তিম রঙের ছড়াছড়ি। চারিদিকে শেষ বেলার আলোয় আলোকিত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গোছাচ্ছে সায়রা। সেই ফাঁকেফাঁকে নিজেকেও সাবধানী দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে। শাড়ির ফাঁকে কোথায়ও আবার পেট দেখা যাচ্ছে কিনা! আরসাল বাড়ি নেই। পাখির উপহার আনতে বেরিয়েছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। পাখি ফোন করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে পাখির ব্যস্ত আওয়াজ ভেসে এলো,

–” সায়রুপু!! কই তুমি? আমার সব ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে। তুমি এখনো আসোনি! তুমি কি আসবে না?”

–” ওহ পাখি শান্ত হয়ে শ্বাস নে তো আগে! আমি কি বলেছি, আসবো না? উনি বেড়িয়েছে বাড়ি ফিরুক! এক সাথে আসছি। ”

–” সত্যি আসছ তো?”

— ” একদম সত্যি!”

শান্ত হলো পাখি। ফোন রাখল সায়রা। নিজেকে বারংবার আয়নায় দেখছে সে। আজকের দিনটা ভীষণ বিশেষ সায়রার কাছে। পাঁচ বছর আগে এই দিনেই আরসালের সাথে তার বাগদান হয়েছে। আরসালের জীবনের সাথে তার জীবন জুড়েছিল। আর আজ পাঁচ বছর পর আজ এই দিনটাকেই নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তির জন্য বেছে নিয়েছে। আর কতকাল নিজেকে আরসাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? আর কতকাল নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকাবে? সত্যি তো এটাই সায়রা আরসালকে ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে! এক ঘরে, এক বিছানায় থেকে নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকানো দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে সায়রার। মনে মনে অটুট প্রতিজ্ঞা এঁটেছে সে। আজ নিজের মনে সব কথা সকল অনুভূতি জানাবে আরসালকে। নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসবে। নিজেদের মাঝে আর কোন বাঁধা, কোন দূরত্ব রাখবে না!
আজ আরসালের পছন্দের শাড়ি পড়েছে, বেশ সুন্দর করে সেজেছে। হাত ভর্তি শুভ্র কাচের চুড়ি। আরসালের পছন্দ মতই চুল খোলা রেখেছে। সায়রাকে এভাবে দেখে মুগ্ধ হবে কি আরসাল! ভেবেই লজ্জায় আয়না থেকে চোখ সরালো সায়রা। অপেক্ষা করতে লাগল আরসালের ফেরার।

রাত আটটা। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে। বাড়ির সবাই চলে গেছে। শুধু সায়রাই আরসালের অপেক্ষায় বসে। বিয়ের পর এই প্রথমবার বাবার বাড়ি যাচ্ছে সায়রা। আরসালকে ছাড়া বড্ড বেমানান দেখায়। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, আরসাল সেই বাড়ির জামাই! তাছাড়া আরসাল কাছাকাছি থাকলে নিজেকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী লাগে সায়রার। নিজের বড্ড আপনজন মনে হয় আরসালকে। এতদিন যেই মানুষটাকে বাগের মত ভয় পেত আজ সেই মানুষটা তার পরম আপনজন! এটাই বুঝি, বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের শক্তি!
ঘড়ির কাটা নয়ের দিকে। আরসালকে ফোনের উপর ফোন করছে সায়রা। মোবাইল বাজছে তো বাজছেই। তুলছে না সে! প্রথমদিকে বিরক্ত হলেও, এখন ভীষণ ভয় করছে সায়রার। এর আগে এমন কোনদিন হয়নি। যে সায়রা ফোন করেছে আরসাল তুলেনি! মন বড্ড কু ডাকছে। কোন বিপদ ঘটল না তো আবার?
আরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করল। আরসালের কোন খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল সায়রা। ছুটে চলল গেটের দিকে। দরজার সামনে যেতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগল সায়রার। মাথা তুলে দেখল- থমথমে মুখে তুর্জয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ অসম্ভব লাল। সেদিকে গুরুত্ব না দিকে চিন্তাভারী আওয়াজে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” তুর্জয় ভাই! উনি কোথায় ? আপনি কি জানেন! সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। উনি এখনো ফিরছে না কেন? একটা গিফট আনতে এত সময় লাগে? আন্দাজ দেখেছেন আপনার ভাইয়ের! ফোনটাও তুলছে না।”

তুর্জয় থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সায়রার দিকে। চোখজোড়া টলমল করছে। কন্ঠ বারংবার ভেঙে আসছে। বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো তুর্জয়। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল,

–” আরসাল ফোন করেছিল। তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছে সায়রা! বাড়ির সবাই সেখানেই।”

চমকাল সায়রা। ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। মনে সন্দেহ জাগল। রাত দশটা বাজতে চলছে এই রাতে তাকে কোথায় ডাকছে আরসাল। আজ পাখির জন্মদিন সেখানে না গিয়ে এই রাতে বাহিরে যাবে? আর তাছাড়া আরসাল সায়রা কে ফোন না করে তুর্জয়কেই কেন বলল। আর বাড়ির বাকি সবাই বা কোথায় গেল?
বেশ সন্দেহ জাগলেও প্রশ্ন করল না সায়রা। চুপচাপ তুর্জয়ের গাড়িতে চড়ে বসল। মন বড্ড কু ডাকছে তার। হৃদপিন্ড ধপধপ করছে অচেনা এক ভয়ে। চোখ ঘুরিয়ে একবার তুর্জয়ের দিকে তাকাল সায়রা। বারবার চোখ মুছছে তুর্জয়। কাঁদছে কেন তুর্জয় ভাই! সবাই ঠিক আছে তো! ভাবল সায়রা।
মিনিট বিশেকের ব্যবধানে পৌঁছে গেল তারা। গাড়ি থামল এক ব্রিজের সামনে। সামনের দিকে লোকজনের বিশাল ভিড়। এর সামনে আগানো যাবেনা। ধীর আওয়াজে তুর্জয় বলল,

–“এসে গেছি সায়রা!”

–” এখানে?”

শব্দ করল না তুর্জয়। শুধু মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। সায়রাও দরজা খুলে সামনের দিকে পা বাড়াল। এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন তুর্জয় ভাই? কয়েক কদম সামনে যেতেই মুনতাহা বেগমের চিৎকার কানে এলো সায়রার। কাঁদছে কেন বড় মা? আঁতকে গেল সায়রা। ভিড় ঠেলে ভিতরে ছুটে গেল। সামনে যেতেই দেখল- মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে মুনতাহা বেগম। পাশেই বাড়ির সবাই। সবাই এভাবে কাঁদছে কেন? এখানে কি হয়েছে! ব্যস্ত দৃষ্টিতে দিশেহারা হয়ে আরসালকে খুঁজতে লাগল সায়রা। মিলল না। দেখা মিলল না তার। খানিক দূরেই আরসালের চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ি। ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে অর্ধেক গাড়ি ভিতরে বাকি অর্ধেক গাড়ি বাহিরের দিকে। সামনের কাচ ভেঙে সব চুরমার। চারদিকে পুলিশ ঘিরো করে আছে, তবে কি আরসালের…… সায়রা জমে গেছে। পা আর চলছে না তার। সারা শরীর ভেঙে আসছে। কয়েক কদম সামনে যেয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল সায়রা। সায়রাকে দেখা মাত্র মুনতাহা বেগমের কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিন্থিয়া বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরল। সায়রা তখনো শান্ত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ ভীষণ রকম শান্ত। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সবাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ ঠান্ডা আওয়াজে প্রশ্ন তুলল সায়রা,

–” সবাই এভাবে কাঁদছে কেন মা? কি হয়েছে। গাড়ি এভাবে ভাঙল কি করে? আরসাল ভাই উনি কই? কখন থেকে ফোন করছি ফোন তুলছে না কেন?”

মেয়ের প্রশ্নে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন সিন্থিয়া। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

–” তোর কপাল পুড়েছে, আরসাল নেই মা। ও নেই!”

মায়ের কথায় ছিটকে দূরে সরে গেল সায়রা। ধমকে চিৎকার করে বলল,

–” পাগল হয়েছ তুমি! এসব কি আবোলতাবোল বকছ। উনি নেই মানে। উনার সাথে আমার দুপুরের পরও কথা হয়েছে। উনি এখানেই আশেপাশে আছেন। দেখবে এখনি চলে আসবে। আরসাল ! আরসাল! কোথায় আপনি !”

বলেই গাড়ির দিকে ছুটে গেল সায়রা। এক পায়ে জুতা আছে অন্য পায়ে নেই। শাড়ি আঁচল এলোমেলো। গাড়ির ভাঙ্গা কাঁচ পায়ে বিঁধে রক্ত ঝরছে। সেই দিকে খেয়াল নেই সায়রার। সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। কাছাকাছি যেতেই পুলিশ আটকায়। চিৎকার করে বলে সায়রা,

–” পথ ছাড়ুন! আমাকে যেতে দিন, আমার আরসাল ভিতরে!”

পথ ছাড়ল না পুলিশ। মাথা নুয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন,

–” মেডাম, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তুমৃত্যু চিরন্তন সত্য। সত্যিটা তো মেনে নিতেই হবে। আপনার হাসবেন্ডের বডি গাড়িতে মিলেনি। আনুমান করা যাচ্ছে পিছন থেকে গাড়ির প্রচণ্ড ঢাক্কায় সামনের কাঁচ ভেঙ্গে নিচে পানিতে পড়েছে। ডুবুরিরা খুঁজছে। এখনো কোন সন্ধান মিলেনি। গাড়ি থেকে উনার ফোন আর ওয়ালেট পাওয়া গেছে। ”

কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট আর ফোনটা নিলো সায়রা। ফোনের আলো জ্বালাতেই স্কিনে ভেসে উঠল, সায়রার হাসি উজ্জ্বল ছবি। নোটিফিকেশনে মিস কল ভেসে আছে। ‘পুতুল বউ’। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সায়রা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দুহাতে মাটিতে প্রচণ্ড আঘাত করছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। কাচের চুড়ি ভেঙ্গে রক্তাক্ত হাত। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। চিৎকার করে বলছে সায়রা ,

–” সব মিথ্যা! সব মিথ্যা! আপনারা মিথ্যা বলছেন। মিথ্যুক আপনারা। আমার আরসাল আছে। উনি এখানেই আছে”

বুক ফাটা চিৎকার সায়রার। কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল সায়রা। ব্রিজের ভাঙা রেলিং- এর দিকে ছুটে গেল। যেই ঝাপ দিতে নিবে পেছন থেকে আরমিন সিন্থিয়া ছুটে গিয়ে আটকাল। ছাড়া পাবার জন্য চাতক পাখির মত ছটফট করছে সায়রা। চিৎকার করে কাঁদছে। ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা! মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল সিন্থিয়া। সায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই। অসহায় কণ্ঠে বলল,

–” ছেড়ে দেও মা। আমি চিরকাল উনাকে দূরে ঠেলে এসেছি অন্তত শেষ বেলায় উনার সাথে আমাকে থাকতে দেও। এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। আরসাল ছাড়া এই সায়রা অপূর্ণ। আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই মা। কোন অধিকার নেই!”

থেমে যাচ্ছে নিশ্বাস। ক্লান্ত আঁখি মানছে না আর। বুজে আসছে বার বার। নিশ্বাস থেমে আসছে, দুনিয়া গলিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সায়রার। ধীরেধীরে সিন্থিয়ার উপর লুটিয়ে পড়ল। গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল!

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here