#তুমিই_আমার_পূর্ণতা,পর্ব ৫
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা দিন। একদিকে মুনের মনে হলো তাঁর জীবনে সবচেয়ে খুশির দিনের দেখা পেয়েছে সে।
অন্যদিকে আদ্রাফের আজ খুশির দিন। এতদিন অনেক কষ্ট করে নিজেকে ওখানে মানিয়েছিল সে। এই পাঁচদিন ওর মনে হয়েছিল কয়েক’শো দিনের মত। এতদিন কেউ একজনের শূন্যতা অনুভব করছিল। আজ মনে হলো, অনেকদিনের অপেক্ষার অবসান।
অফিসে ঢুকেই ম্যানেজার থেকে আগে অফিসের সব খবরা-খবর নিল। তারপরই নিজের ক্যাবিনের দিকে হাঁটা ধরল। ওর ক্যাবিন মুনের কাজের জায়গাটা পার করেই যেতে হতো। ক্যাবিনে ঢুকার সময় একবার ওই জায়গায় চোখ পড়লো। কিন্তু জায়গাটা খালি। হয়তো মুন এখনো আসেনি। কিন্তু, মুন তো এই একমাস একদিনও দেরি করে আসেনি!যাক, হয়তো বা কোনো কারণে দেরি হচ্ছে, আসবে।তবুও কিছু একটার শূন্যতা অনুভব হচ্ছে আদ্রাফের। এসব ভাবতে ভাবতেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আদ্রাফ। কাল রাতেই ডিল কন্ফার্ম করে রওনা দিয়েছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। মাঝরাতেই পৌঁছেছিল। অন্যসময় হলে কোনোদিনও এইদিনে অফিসে আসতো না ও। কিন্তু আজ এসেছে কোনো একটা বিশেষ কারণে, যেটা না করলে ওর মন শান্তি হবে না। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে ওর।
-‘স্যার, আসতে পারি?’
-‘আঙ্কেল, আপনাকে কয়বার বলবো আমাকে স্যার না ডাকার জন্য? আমি আপনার ছেলেরই মত।’ চোখ-মুখ কুচকিয়ে বলে উঠলো আদ্রাফ।
-‘আচ্ছা বাবা। আসলে আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছি।’
-‘জি বলুন আঙ্কেল।’
-‘আসলে…’
-‘আঙ্কেল ভয় পাওয়ার কী আছে! অফিসে কোনো কিছুর ভুল হয়েছে?আপনাকে আমি আমার বাবার মতোই দেখি, কোনোদিন কোনো ভুল নিয়ে আপনার ওপর আওয়াজ করে কথা বলেছি? আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। বলে ফেলুন, কোনো ভুল হলে আমি সমাধানের ব্যবস্থা করছি।’
-‘আসলে তা না।’
-‘তো!’
-‘এটা মুনের রেজিগনেশন লেটার। ও আপনি বাইরে যাওয়ার দিনই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।’
-‘হোয়াট!আপনি আমাকে আগে বলবেন না?আজ পাঁচদিন হয়ে গেল!’ আদ্রাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে জোরে চিল্লিয়ে বলল।
-‘আসলে ও আমাকে মেয়ের মত করে অনুরোধ করে বলেছিলো, আপনি না আসা পর্যন্ত বলতে বারণ করেছিল। তাই বলতে চেয়েও পারিনি।’
আদ্রাফ জোরে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোথাও যেন ও শূন্যতা অনুভব করছে। চোখগুলো দুইমিনিটে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। এই ট্রমা থেকে ওকে একমাত্র শুভ্রই বের করতে পারবে। আদ্রাফ মোবাইল নিয়েই শুভ্রকে কল করল।
-‘শুভ্র..শুভ্র কই তুই? দ্রুত আমার অফিসে আয়।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো আদ্রাফ।
-‘আঙ্কেল, মুনের ডিটেলসটা আনুন।’
ম্যানেজার ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেল। ওর এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। মুনের কথা মেয়ের মত করে ভাবতে গিয়ে আদ্রাফকে আর বলা হয়নি। ওইদিনই বলা উচিত ছিল। কিন্তু আদ্রাফ কেন মুনের মত একজন সাধারণ মেয়ে কাজ ছাড়াতে এত রিএক্ট করছে। তাঁর মানে কী মুনের কাছে ঐদিনের প্রস্তাব দেওয়ার সাথে আদ্রাফের কোনো সংযোগ ছিল। আদ্রাফ তো মেয়ে জাতিকে ঘৃণা করে তবে বাচ্চাকে নয়। তাঁর মানে কী ওর জীবনের কালো অতীতটার জন্যই মুনের কাছে যেতে শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছিল! ম্যানেজারের কাছে এখন সব পরিষ্কার। ওর এখন আদ্রাফের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে। তাঁর এখন দ্রুত শুভ্রকে সব বলতে হবে আর মুনের ডিটেলসটাও দিতে হবে আদ্রাফকে। এই মুহূর্তে এসব থেকে একমাত্র শুভ্রই পারবে আদ্রাফকে বাঁচাতে। শুভ্রই ওর একমাত্র ছোটবেলা থেকেই কাছের বন্ধু।
——————————-
দিগন্ত নীল আকাশে মাঝে মাঝে শুভ্রর ছোঁয়া। আকাশজুড়ে বিচরণ করছে নাম না জানা অসংখ্য পাখি। পাখিদের এই একটা দিক অনেক বেশিই ভালো লাগে। ওরা যেখানেই যাক না কেন ঝাঁক ধরেই যাবে। ওদের মত পিঁপড়েকেও ভালো লাগে মুনের। তারাও সবসময় সারি ধরে যায় তখন মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য এটাই। ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের সৌন্দর্যে বিমহিত হচ্ছিল মুন। মিম আজ আসেনি। সকাল হতেই না-কি মাথা ব্যথা। মেয়েটার মাথা ব্যথা হওয়ার আর সময় পেল না! আজ নিয়ে তৃতীয় দিন কলেজের। আঙ্কেল অফিসে যাওয়ার সময় নামিয়ে দিয়ে গেল। উনি আবার বিনা কারণে কলেজ মিস দেওয়া পছন্দ করে না তাই তো চলে আসতে হলো একা একা কলেজে। কলেজে এখনো তেমন কারো সাথেই কথা হয়নি। তাই তো বিরক্তি লাগছে ক্লাসটা।
নীল-শুভ্রর গগনে পাখিদের আনাগোনা দৃশ্য বিচ্ছিন্ন করে মুন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়। কিন্তু তাকদীর খারাপ। একই ক্লাসের হয়েও সে এখনো কোনো ছেলেকেই চিনে না। যেখানে ক্লাসের অন্যান্যদের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, পরিচয় হয়েছে।কেউ কেউ তো আবার এক ধাপ এগিয়ে। মানে রিলেশনে।
মুন মৃদু হেসে বলে,
-‘জি?’
-‘পরিচয় হতে পারি?’
-‘শিওর।’
-‘ক্লাসে অনেক হট্টগোল। চলো বারান্দায় যায়।’
মুনের ইচ্ছে করছিলো না উঠতে। তবুও এভাবে কাওকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না তাই অগত্যা উঠতে হলো।
-‘আমি দিমান বড়ুয়া আর তুমি?’
-‘মেহরাফ মুন।’
-‘আনকমন নাম, কিন্তু সুন্দর।’
-‘আপনার নামও সুন্দর।’
-‘আমরা তো সেম ক্লাস, আপনি না বলে তুই বললেই ভালো।’
মুন হেসে বলে,’বাবা রে এক লাফে তুই!’
ওর হাসির সাথে দিমানও একসাথে হেসে উঠলো। এভাবেই কথা চলতে থাকল। ছেলেটার কথার ধরণে মনে হচ্ছে অনেক ফ্রি মাইন্ডের, মিশুকও বটে। যাক, মুন আজকে ক্লাসের জন্য একজন বন্ধু পেল, এখন আর একা ক্লাস করতে হবে না।
—————————–
শুভ্র অফিসে ঢুকতেই ম্যানেজার শুরু থেকেই সব বলল আদ্রাফের ক্যাবিনে আসতে আসতে। শুভ্র আগেই এমন কিছু আন্দাজ করেছিল আদ্রাফ মেয়েটাকে ভালোবাসে কিন্তু স্বীকার করছিল না। কিন্তু তাই বলে মেয়েটাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া কিছুতেই উচিত হয়নি আদ্রাফের। এই মেয়ের জায়গায় যে কোনো কেউই থাকলে রেগে যেত। আর সেই জায়গায় মেয়েটি শুধুই চাকরিটা ছেড়েছে। যাক, এখন এসব ভাবার টাইম নয়। শুভ্র আদ্রাফের ক্যাবিনের দরজা খুলেই দেখল আদ্রাফ চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।
-‘আদ্রাফ।’শুভ্র ডাক দিল।
আদ্রাফ চোখ খুলেই সামনে তাকাতেই শুভ্র থমকে গেল। আদ্রাফের চোখগুলো লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
আদ্রাফ শুভ্রকে দেখেই উঠে এলো চেয়ার ছেড়ে। শুভ্রকে বলল খুব দ্রুতই মুনের হোস্টেলে যেতে
হবে। মুনকে বোঝাতে হবে।
-‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি ওই হোস্টেলে। ওখানে গিয়েই মুনকে হোস্টেলে পাবো। আমি গাড়ি করেই ওকে বুঝিয়ে নিয়ে আসব তোর সাথে কথা বলার জন্য।’ শুভ্র বলল।
-‘নাহ, তোর সাথে আমিও যাব।’আদ্রাফ বলল।
শুভ্র আদ্রাফের দিকে এক পলক তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্রাফের মত একটা ছেলে একটা সাধারণ মেয়ের চাকরি ছেড়ে দেয়াতে কেন এত রিএক্ট করবে! শুভ্র এসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রাফের গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আদ্রাফ ড্রাইভিং সিটে উঠতেই শুভ্রও তাঁর পাশের সিটে উঠে পড়লো।
–
–
গাড়ি এসেই মুনের হোস্টেলের সামনে দাঁড়াল। শুভ্র ঠিকঠাক দেখে বলল,’হ্যাঁ এটাই।’
-‘তুই গিয়ে হোস্টেলের মালকিনের সাথে কথা বলে আয়, আমি এখানেই আছি ।’ আদ্রাফ বলল।
–
–
দুইমিনিট পর শুভ্র গাড়ির সামনে এসেই হাঁপাতে লাগলো। তা দেখেই আদ্রাফ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো,
-‘ আদ্রাফ, মুন আর ওর রুমমেট পাঁচদিন আগেই হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে।’ শুভ্র বলল।
-‘ কী?’কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো আদ্রাফ।
শুভ্র মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রাফের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কী করবে ও ভেবে পাচ্ছে না!
-‘তুই চিন্তা করিস না আদ্রাফ, আমরা ঠিকই খোঁজ পাবো মুনের।’
শুভ্রর কথায় কিছুটা হলেও শান্ত হলো আদ্রাফ। তাঁর এই ভাই সমান বন্ধুটি ঠিকই খোঁজ দিবে মুনের। আচ্ছা মুনের জন্য আদ্রাফের এমন পুড়ছে কেন! ও তো নারি জাতিকেই ঘৃণা করে। এর উত্তর আদ্রাফের নিজের কাছেও নেই।
সেইদিন পুরোটা দিন শুভ্র মুনের খোঁজের চেষ্টা করল।
এরপরের দুইটাদিনও মুনের স্কুল-কলেজ সব জায়গাতেই গিয়ে দেখল কিন্তু কেউই মুনের খোঁজ দিতে পারলো না। আর এদিকে আদ্রাফের বেহাল অবস্থা।
দুইদিন পরেই শুভ্র আদ্রাফের বাসায় এসে দেখল আদ্রাফ রুমেরই মেঝেতে বসে দুইহাঁটুর উপরে হাত দিয়ে ‘দ’ আকারে বসে মাথা গুঁজে রেখেছে। এই দুইদিনে অফিসেও যায়নি, কেমন যেন অগোছালো হয়ে গিয়েছে, শুভ্রর এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এটা আদ্রাফ তো?
শুভ্রকে মাথা নিচু করা অবস্থায় দেখেই আদ্রাফ মাথা তুলে মৃদু হেসে বলল,’পাসনি, তাই না?’
শুভ্র মাথা উপরে তুলে প্রিয় বন্ধুকে দেখেই আবার মাথা নিচু করে ফেলল। আজ এই বন্ধুটার জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করছে ভীষণভাবে। কিন্তু কী করবে ও?
-‘যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে চাইলেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’ আদ্রাফ মৃদু হাসির সহিত বলে উঠলো। ভীষণ অগোছালো লাগছে তাকে। চোখ লাল, চোখের নিচে ডার্কসার্কেল। আজ বুঝতে পারছে মুন ওর মনের কোন জায়গাতে ছিল। এখন শুধু আপসোস ছাড়া আর কিছুর উপায় নেই। মেয়েটা তো ওর এই জীবনটা নিয়ে সুখীই ছিল, কেন সেখানে আমি গিয়ে তাঁর জীবনের মোরটাই ঘুরিয়ে দিলাম! মুনের খোঁজ ও কীভাবে পাবে? এই এতবড়ো শহরে কোথায় খুজবে ও মুনকে? তাহলে কী সত্যিই মুন ওকে ফেলে চলে গেল! মুন ‘চলে গিয়েছে’ এটা ভাবতেই বুকটা মুচড়ে উঠলো। কোথাও যেন একটা শূন্যতা অনুভূব হচ্ছে। আদ্রাফ কী মুনকে আর কোনোদিন দেখবে না? নাহ, এটা কী ভাবছে সে। অবশ্যই দেখবে, সে মুনকে খোঁজে বের করবেই।
#চলবে ইনশাআল্লাহ