বসন্ত বিলাপ-৮ শেষ
ব্যস্ত জীবনের ব্যস্ততম দিনগুলোতে থেমে থাকার কোনো উপায় নেই। জীবন তার নিজের ছন্দে চলতে থাকে। সিলেট থেকে হাসিবের ছকে বাঁধা জীবনেও কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। সেই অফিস-বাসা, মাঝে মাঝে বন্ধুদের আড্ডা, আর বায়োডাটায় চোখ বুলানো। গত তিন মাসে দুইটা মেয়ের সাথে দেখা করলেও ফলাফল শূন্য। মনের জানালায় মাঝে মাঝে এক সদ্য কৈশোর পেরুনো মেয়ে উঁকি দিয়ে যায়। সেই অবিশ্বাসের দৃষ্টি, যেন কত অভিযোগ জমেছিল সেখানে হাসিবের প্রতি। সেদিন থানায় অনেক গন্ডগোল হয়েছিল। রুহির বাবা এসেছিলেন থানায়, তবে তিনি এসেছিলেন পরে, তার সাঙ্গপাঙ্গরা আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। তাদের হম্বিতম্বিতে পুরো থানা সরগরম। রুহি সেখানে গিয়ে আরেক বিপদে ফেলে দেয় হাসিবকে। ছুটে গিয়ে হাসিবের হাত ধরে জানায়, হাসিবের সাথেই সে পালিয়েছিল, তাকেই সে বিয়ে করতে চায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি, নাকের পানি এক করে বলে, ” তুমি বাবার ভয়ে আমার হাত ছেড়ে দিচ্ছো!” মেয়েটা যে এত নাটক জানে, পাক্কা অভিনেত্রী একেবারে! এমপি সাহেবের চ্যালামুন্ডারা যেভাবে হাসিবকে দেখছিল, তাতে বাংলা সিনেমায় ভাড়াটে গুন্ডারা যেভাবে হকিস্টিক নিয়ে দৌড়ে আসে, সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তবে সিনেমার নায়কের মতো হিরোইজম তো তার নেই। তাই এক ঝটকায় সবার হকিস্টিক হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সবাইকে ইয়া ঢুসুয়া করে দেবে, সেই আশা একেবারেই নেই। তবে এবার হাসিবের ভাগ্যলিখন তার পক্ষে ছিল। এমপি সাহেব মেয়ের স্বভাব সম্পর্কে ভালোই অবগত মনে হয়। তিনি এসে সবাইকে ঠান্ডা না করলে হাসিবের হাজতবাস নইলে হাসপাতালবাস নিশ্চিত ছিল। এমপি সাহেবকে বুঝাতে অবশ্য এস.আই. সাজিদ বেশ সাহায্য করেছে। থানা থেকে বের হওয়ার সময় রুহির চোখে চোখ পড়েছিল একবার। কী প্রচণ্ডতায় তাকিয়ে ছিল সে! যেন তার এই অবস্থার জন্য হাসিবই দায়ী। আ
হাসিব এ পর্যন্ত কম পাত্রী বাছেনি। তার পছন্দের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে, তার কোনোটাই রুহির মধ্যে নেই। তারপরও ঘুরেফিরে সেই চঞ্চল, বাচাল মেয়েটার কথাই কেন মনে হচ্ছে? জোর করে নিজের মন থেকে রুহির চিন্তা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে হাসিব। এতদিনে নিশ্চয়ই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। হয়তো এখন গদগদ প্রেমের দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে, অথবা মনের বিরুদ্ধে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এই সময়ে এসেও যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবার থেকে বিয়ে দিতে পারে, এই বিষয়টা ভাবলে অবাক লাগে হাসিবের।
ভাববে না ভাববে না করেও বার কয়েক রুহির প্রোফাইল খুঁজেছে সে ফেসবুকে। থানায় মিসিং কেসে রুহির পুরো নাম দেখেছিল, কিন্তু ওই নামে কাউকে পায়নি। হয়তো অন্য কোনো নামে অ্যাকাউন্ট। বলতে নেই, অফিস থেকে দুই দিন এক ফাঁকে বের হয়ে রুহির ভার্সিটির আশেপাশে অকারণেই ঘুরঘুর করে এসেছে৷ এই বয়সে এমন ভীমরতি কি মানায়? তার উপর ভাগুড়ে একটা মিথ্যাবাদী মেয়ের জন্য? কিন্তু কী করবে হাসিব? সেদিন এক পাত্রীর সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করার সময় বার বার তাকে রুহি বলে ডেকেছে। মেয়েটা হয়তো কিছু সন্দেহ করে নিজেই সরে গেছে।
আজকে হাসিবের ভার্সিটির এক বন্ধুর ছোটো মেয়ের জন্মদিন। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও যেতে হবে, কারণ বন্ধু- বন্ধুপত্নী দু’জনেই তার খুব ঘনিষ্ঠ। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের মতো বোরিং আর কিছু হতে পারে না। তাই কিছু হাই-হ্যালো সেরে মোবাইলেই বুঁদ হয়ে থাকার পরিকল্পনা হাসিবের। কিন্তু বিধাতারা হয়তো অন্যরকম ইচ্ছা ছিল। তা নইলে হঠাৎ করে একজনকে দেখে রুহির মতো লাগবে কেন? জর্জেটের শাড়ি পরা, চুল টেনে খোপা করা, সাথে খুব জমকালো না হলেও মোটামুটি ভালোই সজ্জিত মুখটার সাথে বাসের সেই শ্যামল স্নিগ্ধ মেয়েটির মিল কমই বলতে গেলে। বাসের সেই মেয়েটি যদি সদ্যপ্রস্ফুটিত বেলী ফুল হয়, আজকের এই সুসজ্জিতা রমণী পরিপূর্ণ ফোটা এক লাল গোলাপ। তারপরও হাসিবের চোখ আটকে গেল ডাগর ডাগর চোখ দুটোতে। এই মেয়ে রুহি না হয়ে যায় না। কিন্তু এক পলক দেখার পরেই যে হাওয়া হলো মেয়েটি, আর তাকে খুঁজে পেল না হাসিব। দুই ঘণ্টা ছিল পার্টিতে, পুরোটা সময়ই গেল সেই মেয়েটিকে খুঁজতে।
অস্থিরভাবে পুরো একটা সপ্তাহ কাটল। অফিস থেকেও ইচ্ছা করে দেরি করে ফেরে বাসায়। মা আজকাল এত খোটা দিয়ে কথা বলে, যেন বিয়ে না হওয়ার সব দায় হাসিবের একার। তারা নিজেরা কি কম বাছাবাছি করেছেন? এই মেয়ের নাক বোঁচা, তো ওই মেয়ের চুল বাদামী, কারো হয়তো বাবা নেই, কিংবা মা- ছেলে জামাই আদর পাবে না- বিচিত্র সব খুঁত খুঁজে বের করত মা। পঁচিশ, না, এই দুটো মিলে সাতাশটা বিয়ে নাকচ হওয়ার কলকাঠি একা হাসিব নাড়েনি। জামাই আদর পাবে না, এটা কোনো কথা হলো? প্রায়ই এমন শোনে হাসিব, কিন্তু সে এটা বুঝে না, তাহলে বিয়ের পর ছেলেরা শ্বশুর বাড়ি গেলে কিংবা শাশুড়ির রান্নার প্রশংসা করলে সেই মায়েরাই ছেলেকে জাদু করল বলে রব তোলেন কেন?
আজ সন্ধ্যা সাতটা থেকেই হাসিবের মা ফোন দিচ্ছে বার বার। ইদানিং রাত নয়টার আগে বাসায় যাওয়াই হয় না হাসিবের। প্রথমে ব্যস্ত থাকায় ধরতে পারেনি, পরে কলব্যাক করতেই ডেইজি রেগেমেগে বললেন, “তুমি কাহিনি করে এসে আমার ফোন ধরো না, হ্যাঁ? এই জন্যই সিলেট থেকে আসার পর থেকে পালায় পালায় থাকো? এক্ষুনি বাসায় আসো।” হাসিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলেন।
মনে মনে প্রমাদ গুণল হাসিব। সিলেটের প্রসঙ্গ কেন টানলেন আম্মু? সাথে সাথেই তানিয়াকে ফোন লাগাল সে, কিন্তু তানিয়া ফোনই ধরল না।
অগত্যা তাড়াতাড়ি কাজ গুটিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলো। অফিসভাঙা জ্যাম ঠেলে আসা কি চাট্টিখানি কথা? দেড় ঘণ্টা লেগেই গেল বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে। এর মধ্যে ডেইজি আরও চার বার ফোন করে তাড়া দিয়েছেন। ঘটনা কি জানতে বাবাকে ফোন করেও হতাশ হতে হয় হাসিবকে। সবাই মিলে হাসিবকে টেনশনে আধমরা করার যুক্তি করেছে যেন!
অ্যাপার্টমেন্টের নিচে পার্কিং এ অনেক গাড়ি। বাইরে রাস্তায়ও বেশ কয়েকটা গাড়ি। কোনো ফ্ল্যাটে মেহমান এসেছে কি? বিয়ে শাদীর ব্যাপার মনে হচ্ছে। দারোয়ানরা হাসিবকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। একজন বলল, “ভাইজান এত লেট কইরা আইছেন? ভাবীয়ায়াব তো বইসা রইছে সেই কখন থেইকা।”
“মানে?”
সে ছেলে জবাব দেবে কী, লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছে। তাকে ভালো করে জেরা করতে পারল না তানিয়ার ফোন আসার কারণে, “ভাইয়া, তোমার হলো? জলদি আসো। কতগুলো লোককে বসায় রাখছ!” বলেই ফোন কেটে দিলো।
বাসায় বেল বাজাতে হলো না, দরজা খোলাই পেল। এত এত জুতা দরজার সামনে! তার মানে এত মেহমান তাদের বাসায়? বাবা অসুস্থ নয় তো? না না, তাহলে আম্মু সিলেটের কথা বলবে কেন? ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল হাসিব।
ডাইনিং-এই আম্মুর সাথে দেখা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন গোসল করে বিছানায় রাখা পাঞ্জাবি পরে আসার। হাসিবকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে তানিয়া আর কিছু কাজিন ঠেলে হাসিবকে নাম নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। বিছানার উপর নতুন একটা পাঞ্জাবি রাখা, জামাই টাইপ পাঞ্জাবি। হাসিব গোসল করে সেটা পরে আসতেই তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন ডেইজি। বসার ঘরে ঢুকে যা দেখল, তাতে তার আত্মা উড়ে যাওয়ার জোগাড়। জলজ্যান্ত রুহি আর তার এমপি বাবা সশরীরে উপস্থিত! হাসিব চোখ কচলে আবার তাকাল, নাঃ, ভুল তো দেখছে না। রুহিই তো, নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরে লজ্জাবনত হয়ে বসে আছে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব!
হাসিবের বাবা তাকে দেখে বললেন, “কী রে, সিলেট গিয়ে এত কাণ্ড করে এলি, আর আমরা কিছুই জানলাম না! আমরা এতদিন ধরে তোর সম্বন্ধ খুঁজছি, আর আজকে বউ নিজেই বাড়িতে এসে উপস্থিত।”
“মানে কার বউ, কীসের বউ?”
“হয়েছে, আর ন্যাকামি করতে হবে না। কাজী সাহেব এসে বসে আছেন। ঝটপট কবুল বলার ব্যবস্থা করো।”
এমপি সাহেব উঠে এসে হাসিবের হাত ধরে বললেন, “বাবা, আমার মেয়ে তো তোমার কথা ভেবে কাঁদতে কাঁদতে দিনরাত এক করে ফেলেছে। গত সপ্তাহ থেকে তার খালার কাছে গিয়ে এত কান্নাকাটি করেছে, বাধ্য হয়ে তোমার খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা তোমার বাসায়ই চলে এলাম।”
রুহির পাশের ভদ্রমহিলাই মনে হয় তার খালা, বললেন, “আমার মা-মরা বোনঝিকে তোমার হাতে তুলে দিতে চাই বাবা। ও তোমাকে না জানিয়েই সিলেটের বাসে উঠেছিল, তাই না? তুমি ওকে ওর বাবার হাতে তুলে দিয়ে ঠিক কাজটাই করেছিলে। তা বাবা, এত লুকোছাপার কী দরকার? তুমি এত ভালো ছেলে, আমরা কেউ কি অমত করতাম?”
ডেইজি বললেন, “এজন্যই একের পর এক সবাইকে রিজেক্ট করছ? আমাদের বললে কি আমরা মানতাম না?” এদের সবার কথাই হাসিবের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক হাসিবের, অন্তত সবাই তাই জানে। কাহিনিটা কী?
কাহিনি বুঝার আগেই অবশ্য কাজী সাহেব বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করলেন। রুহিকে নিয়ে মহিলারা ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। হাসিব রুহির সাথে কথা বলতে চাইলে বলা হলো, একেবারে বাসর ঘরেই কথা বলতে। কী আশ্চর্য! বউযাত্রী এসেছে তার বাসায়। নানা চিন্তাভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে মনে মনে ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করছে হাসিব। এর মধ্যেই কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এই বিবাহে রাজি আছেন? থাকলে বলেন।আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” আমাদের সদা ক্যালকুলেটিভ হাসিব বিনা হিসাব-নিকাশেই কবুল বলে দিলো ফট করে।
হাসিবের এত বহুল প্রত্যাশিত বিয়ে হয়ে গেল হুট করেই, কনে আসলো বউযাত্রী নিয়ে। বাসর অবশ্য হাসিবদের বাসায়ই হবে, হাসিবকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে না।
হাসিবের ঘর আলো করে এক স্নিগ্ধ রূপসী বসে আছে বিছানার মধ্যখানে। একগাদা মেকআপ, জবড়জং শাড়ি পরা, মাথার পাখির বাসা ছাড়াতে ব্যস্ত বউ নয়। লাল একটা জামদানি শাড়ি পরা ছিমছাম সাজের মিষ্টি একটা বউ। বিয়ের আগে মনে হয় শাড়ি পাল্টেছে। একদম লাল টুকটুকে বউ মনে হচ্ছে রুহিকে। তবে রুহি তো রুহিই। আর কতক্ষণ বাংলার বধূ হয়ে থাকবে সে? হাসিবকে পাশে গিয়ে বসতেই বলল, “কী কেমন দিলাম?”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে, সিলেটে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে, শুনেছিলেন? উল্টো পুলিশকে খবর দিলেন। এখন দেখলেন তো আমি কী চীজ?”
“হ্যাঁ, তা দেখলাম। কিন্তু তুমি সবাইকে কী বলেছ বলো তো?”
“বলেছি কিছু একটা।”
“এই মেয়ে বলো।” হাসিব কিছুটা ধমকে ওঠে।
“আগে যেটা বলেছিলাম, সেটাই। আপনি অফিসের কাজে সিলেট আসছিলেন, আপনার সাথে আমার অনেকদিনের সম্পর্ক, আমিও জেদ করে আপনার পিছু পিছু সিলেটে গিয়েছিলাম। তারপর আপনি ভয় পেয়ে পুলিশের কাছে সব অস্বীকার করেছেন।”
“কিহ?” আঁতকে ওঠে হাসিব, “তুমি তোমার এই মনগড়া কাহিনি বলেছ, আর সবাই তা বিশ্বাস করেছে?”
“অবশ্যই।” ভাবের সাথে বলল রুহি। “নইলে ওই বিয়েটা ঠেকাতাম কী করে? এখন সরুন, আমি ঘুমাব।”
“বাসর রাতে কেউ ঘুমায়?” হাসিব অবাক হয়ে বলল।
“কেন? তাহলে কী করে?” সরল নিষ্পাপ অভিব্যক্তি রুহির। মনে হচ্ছে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, অথচ কেমন একটা প্ল্যানিংকে বাস্তবে রূপ দিয়ে দিলো।
“কিছু না। ঘুমাও।” হাসিব হতাশ সুরে বলে।
রুহি শুয়ে পড়লে হাসিবও যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে খাটের অন্য পাশে শুয়ে পড়ে। এই মেয়ের ঠিক নেই। কাছাকাছি থাকলে কী না কী বলবে! বিয়ে করা বউও যে এমন পল্টিবাজ হবে, তা কে জানত?
মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে কারো নিঃশ্বাসের শব্দ খুব কাছ থেকে অনুভব করে হাসিব। সেই সাথে কোমল একটা হাতের স্পর্শ তার বুকের উপরে। বসন্ত এলো বলে!
সমাপ্ত