বসন্ত বিলাপ-৫

বসন্ত বিলাপ-৫

সিলেটে আসার পর থেকেই সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো সিলেটে এসেছে হাসিব এবং একবারও বৃষ্টিবিহীন সিলেট দেখেনি। শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের কাছে এই হোটেলটার আটতলায় হাসিবের রুম। অফিসের কাজে এলে এই হোটেলেই ওঠা হয়। জানালার সামনে দাঁড়ালেই বিশাল আকাশটাকে আর ব্যস্ত শহরের জীবনযাত্রাকে একই সাথে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রশস্ত জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু শিশিরের মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা হয়। বৃষ্টির শোভা দেখতে দেখতে কারো ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হয়। ডুব দিতে ইচ্ছা হয় ভালোবাসাসিক্ত ওষ্ঠে। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা বোধহয় তার জন্য একাকী বৃষ্টিবিলাসই রেখে দিয়েছেন। বোন তানিয়া মেসেজ পাঠিয়েছে, “ভাইয়া, এবার সিলেট থেকে একটা পাহাড়ি মেয়ে বিয়ে করে আনো। এছাড়া তোমার আশা নেই। দেখো, আবার দৌড়ানি খেয়ো না।”

টেবিলের উপর একটা ওষুধের প্যাকেট আর একটা ছাতা, তবে কোনোটাই হাসিবের নয়। সাদার মধ্যে গোলাপি প্রিন্টের ছাতাটার দিকে তাকিয়ে তার মালিকের কথা মনে পড়ছে বার বার। এবার বাসে করে সিলেটে এসেছে হাসিব। নাটক-সিনেমা কিংবা গল্প-উপন্যাসে দূর যাত্রার পথ নিয়ে অনেক রোমান্টিক কাহিনি দেখা যায়। বিশেষ করে বাসে। যুবক যাত্রী, তার পাশে অচেনা রূপসী যুবতীর ভ্রমণ, সেই সাথে হৃদয়ের সম্মোহন। কিন্তু বাস্তব বড়ই নিষ্ঠুর। এই যে ছাত্র জীবনে কিংবা অফিসের জাজে এতবার ঢাকার বাইরে আসা-যাওয়া করল হাসিব, কই, একবারও তো ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না! তার পাশে বসে হয় মধ্যবয়সী ভুঁড়িসমেত ভদ্রলোক, বাসে উঠেই ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকতে থাকে নয়তো আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী সবাইকে তার ভ্রমণের সংবাদ দিতে থাকে লাউডস্পিকারে। নতুবা তার পাশে বসবে পত্রিকাপ্রেমী চাচামিয়া। যতক্ষণ আলো থাকবে, দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে পত্রিকা পড়তে থাকবে, যেন তার পত্রিকা পড়ার মধ্যেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে। মহিলা সহযাত্রী যে ভাগ্যে একেবারেই জোটেনি, তা নয়। আপাদমস্তক ঢাকা পৌঢ়া খালাম্মা, নিতান্তই বাধ্য হয়ে হাসিবের মতো যুবকের পাশে যাত্রা করেছেন, বাস চলতে শুরু করা ঘণ্টাখানেক পরেই যার বমির দমকে হাসিবের টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়ে।
দুই-একবার যুবতী সহযাত্রীর সিট থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বদলে যায়। তবে এবার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এলেও হাসিবের পাশের সীটের যাত্রী এসে না পৌঁছায় বাস ছাড়ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হচ্ছিল সবাই। মিনিট পনেরো পরে সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। বাসের দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যে প্রবেশ করল, তার দিকে তাকিয়ে সবার বিরক্তি উবে গিয়েছিল বলেই হাসিবের ধারণা। কারণ এমন মুখ দেখলে ঠোঁটে আপনাতেই হাসি ফুটবে, তাতে বিরক্তি বা অন্য বিরূপ অনুভূতির স্থান কোথায়? এক কথায় রূপসী নয় মেয়েটি, তবে লাবণ্যময় চেহারায় একটা নিষ্পাপ অভিব্যক্তি আছে, তবে তা ছাপিয়ে চোখে পড়ে বড় বড় চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। মেয়েদের বয়স হাসিব সহযে বুঝতে পারে না, তবে আন্দাজ করল কিছুতেই বিশ-বাইশের বেশি হবে না। একটা ব্যাকপ্যাক ছাড আর কোনো ব্যাগ নেই তার সাথে। মেয়েটা সিট খুঁজে হাসিবের পাশে বসতেই কিছু উৎসুক দৃষ্টি হাসিবের দিকে নিক্ষিপ্ত হলো। মেয়েটা ভীষণ সপ্রতিভ, হাসিবের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ইস, সবার দেরি করিয়ে দিলাম, না?” হাসিব বলল, “না তেমন না, এই পনেরো মিনিট মাত্র।” হাসিব নিজেও বেশ অধৈর্য হচ্ছিল এতক্ষণ, কারণ দুপুরের মধ্যে সিলেট পৌঁছেই তার সাইট ভিজিটে যেতে হবে। কিন্তু মেয়েটার সরল প্রশ্নের উত্তরে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল না। তাছাডা এই প্রথম কোনো সুন্দরী মেয়ের পাশে লম্বা যাত্রায় যাচ্ছে, একেবারে তরুণ বয়সের মতো উত্তেজনা না থাকলেও দুই একটা লাড্ডু মনের ভেতর ফুটেনি, এ কথা বলা যাবে না। মেয়েটা কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল, “সত্যি করে বলুন তো, মানুষ গালাগাল করছিল নাকি আমাকে?”
“না না, গালাগাল করবে কেন? আর আপনার নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজ ছিল।”
মেয়েটা এই কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল। আবারও কিছু আগ্রহী চোখ তাদেরকে দেখল। মেয়েটা নিজেকে সামলে ফিসফিস করে বলল, “আপনাকে বলছি, কাউকে বইলেন না, আমি আসলে ঠিক সময়েই বের হয়েছিলাম বাসা থেকে। বাস কাউন্টারের দিকে আসছি, হঠাৎ দেখি ভেলপুরিওয়ালা। ওখানেই আটকে গেলাম, বুঝলেন?”
মেয়েটার কথায় অবাক হবে নাকি সেটাই বুঝতে পারল না হাসিব। কারণ, তার কথা মোটেই বিশ্বাস করেনি সে। বলল, “আপনি এত সকালে ভেলপুরিওয়ালা পেলেন কোথায়?” “আরে, আমাদের বাসার কাছে একটা স্কুল আছে না, ওটার সামনে।”
“কিন্তু সকালে স্কুল খোলার সময়ে তো ফেরিওয়ালারা বসে না।”
মেয়েটা হাসিবের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “আপনি কি গোয়েন্দা পুলিশ? সাদা পোশাকে আছেন?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে হাসিব চমকে গিয়ে বলল, “না না, আমি হাসিব, আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি।”
কেউ নাম বললে পাল্টা নিজের নাম বলা স্বাভাবিক ভদ্রতা, তবে মেয়েটা সেটার ধার ধরলো না। আগের মতোই চোখ ছোটো করে বলল, “তাহলে গোয়েন্দাদের মতো এত জেরা করছেন কেন? যা বলছি চুপচাপ মেনে নেন।” বড্ড ঠোঁটকাটা মেয়েটা। তার সাথে আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। হাসিব পকেট থেকে মোবাইল বের করে তাতে মন দিলো, অফিসের কিছু মেইল চেক করে কাজ এগিয়ে রাখা যাক বরং।
মেয়েটিও কিছুক্ষণ নিজের মতো চুপচাপ করে বসে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “আজকে স্কুলে কী যেন একটা পরীক্ষা আছে, বুঝলেন? এজন্য মনে হয় ভেলপুরিওয়ালা সকালেই বেরিয়েছে।”
হাসিব হেসে ফেলল। মেয়েটা এতক্ষণ ধরে এই যুক্তি খুঁজতে ব্যস্ত ছিল তাহলে।
মেয়েটা আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“সিলেট, মেইন শহরে যাব। সেখান থেকে এদিক-ওদিক যাব সাইট ভিজিটে।”
“ও!”
“আপনি?”
“কেন? আমি কোথায় যাব জেনে কী করবেন আপনি? একলা মেয়ে দেখলেই এসব জানতে মন চায়, না?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হাসিব। সে তো স্বাভাবিক ভদ্রতাবশেই জানতে চাইল। তবে পুঁচকে একটা মেয়ের কাছে বার বার ধরাশায়ী হওয়া যায় না। তাই সেও পাল্টা জবাব দিলো, “আপনিও তো একলা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে এসব জানতে চাইলেন।”
সজোরে হেসে উঠল মেয়েটা আবার। “বাহ! এই তো জমে উঠেছে। চেহারা দেখে প্রথমে একটু হাঁদা ভেবেছিলাম আপনাকে, তাই খেলাচ্ছিলাম আর কী! নাঃ স্মার্ট আছেন বস।”
যেতে যেতে আরও টুকটাক কিছু কথা হয় মেয়েটার সাথে। তবে বেশিরভাগই খেয়ালী মনের ছেলেমানুষী আলাপ। হুটহাট একেকটা কথা বলে মেয়েটা বারবারই হাসিবকে ধরাশায়ী করে গেল। ভৈরবের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি দিলে বাসের আর সব যাত্রীর মতো হাসিবও নামল। মেয়েটাকে ডাকেনি, দেখা যাবে দুম করে একটা আলপটকা কথা বলে দেবে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে অর্ডার করে বসেছে, তখনই বলা নেই, কওয়া নেই, বৃষ্টি নামল। এমন সময় পাশের সিটের মেয়েটা এসে ওর পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। হাসিব অবাক হয়ে তাকাতেই অভিযোগের সুরে বলল, “অ্যাই, আপনি আমাকে না নিয়ে চলে এলেন যে?”
“ও মা, আমি আপনাকে নিয়ে আসব কেন? আপনি কি ছোটো বাবু?”
মেয়েটা দমে গিয়ে বলল, “না, এক সাথে আসছি এতক্ষণ ধরে…”
“সে তো বাসের আরও পঞ্চাশ জন যাত্রীও আসছে। সবাইকে ডেকে ডেকে নিয়ে আসব?” হাসিব নির্বিকার মুখে জবাব দিলো।
“তখন আপনাকে হাঁদা বলেছি দেখে রাগ করে আছেন?”
মেয়েটার মুখে কোনো লাগাম নেই। বাচাল মেয়ে হাসিবের সহ্য হয় না। এর আগে অন্তত তিনটা সম্বন্ধ ভেঙেছে মেয়ে বেশি কথা বলে এই কারণে। সে মেয়েটাকে বলল, “বাস কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থামবে না। নাস্তা খেলে জলদি অর্ডার করে নিন।”
মেয়েটা, এত কথা বলেও যে ভুলেও নিজের নামটা মুখ দিয়ে বের করেনি, উঠে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। খানিক পরে একটা দুইটা আইসক্রিম নিয়ে এসে একটা হাসিবের দিকে এগিয়ে দিলো। হাসিব তখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আইসক্রিমটা নিতে হলো, নইলে আবার কী বলে বসে মুখরা রমণী, তার কোনো ঠিক নেই। এমন সময় বাস ছাড়ার ঘোষণা দিলে দু’জনেই উঠে পড়ে। মেয়েটা হাসিবের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলে, “ছাতা তো আনেননি, যাবেন কীভাবে? আসুন আমার সাথে।” বলে নিজের সাদার মধ্যে গোলাপি প্রিন্টের ছাতা মেলে ধরলো। রেস্টুরেন্টের বড় ছাতাতেই ব্যবস্থা হয়ে যেতো, তবু্ও সুন্দরী তরুণীর সাথে এক ছাতার নিচে যাওয়ার আহ্বান অগ্রাহ্য করার অনুমতি দিলো না হাসিবের বুভুক্ষ হৃদয়।

সে কথা ভেবে মুখে হাসি ফুটেছে কী ফোটেনি, রুমের ফোনটা বেজে উঠল। রিসেপশন থেকে ফোন এসেছে, থানা থেকে লোক এসেছে হাসিবের কাছে। একটু অবাক হলো হাসিব। ঢাকার বাইরে ক্যাম্পেইনে আসলে স্থানীয় অফিসের লোকজনই থানার অনুমতি নেয়া সংক্রান্ত ব্যবস্থা করে রাখে, হাসিবদের এসব ঝামেলা পোহাতে হয় না। হাসিব তখনও জানে না, তার অবাক হওয়ার পালা সবে শুরু।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here