বসন্ত বিলাপ,পর্ব ১

বসন্ত বিলাপ,পর্ব ১
ইসরাত মোস্তফা

শার্টটা প্যান্টে গুঁজে দিতে দিতে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখল হাসিব। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে আরও বছর চারেক আগে। চৌত্রিশটি বসন্তের ছাপ চেহারায় না পড়লেও চুলে পড়তে শুরু করেছে। এখনও ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবকদের সাথে টেক্কা দিতে পারবে সে, কিন্তু এই বেয়াড়া চুল তো বাধ সাধছে তাতে। সিঁথিতে হাত বুলিয়ে কয়েকবার চুলগুলো হাতড়ে দেখল হাসিব। এক মাস আগেও গোণা যাচ্ছিল পাকা চুলগুলোকে, কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই। গুণতে গেলে আজ আর অফিসে যাওয়া লাগবে না। এমনকি যত্ন করে রাখা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতেও সাদা রঙের আনাগোনা। আচ্ছা, তার চুল-দাড়ি কি বয়সের প্রভাবে পাকছে? কিন্তু সেরকম বয়স কি তার হয়েছে? নাকি কোনো হরমোনের প্রভাব? কী যেন একটা হরমোনের নাম পড়েছিল স্ট্রেস বেশি হলে নাকি তার কারণে চুলে পাক ধরে। তার এক ডাক্তার বন্ধু বলছিল, ডার্মাটোলজি নিয়ে পড়ছে এখন। স্ট্রেস অবশ্য বেশিই যাচ্ছে আজকাল, অফিসে কাজের প্রেশার অনেক বেশি, সেলসের চাকরি মানেই সার্বক্ষণিক চাপের মধ্যে থাকা। একটা বহুজাতিক কোম্পানির রিজিওনাল ক্যাটাগরি ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার সে। সারাদিন ব্যস্ততায় কাটাতে হয়, টার্গেট পূরণের চাপ সর্বদাই মাথায় ঘুরে। তবে কাজের চাপের চেয়ে সামাজিক চাপই তাকে বেশি মানসিক যাতনা দিচ্ছে। কারণ হচ্ছে জীবনের চৌত্রিশটি বসন্ত তার বিবর্ণতার অভিশাপে ঘেরা, এই শক্ত দুই হাতে মুঠোয় এখনও কোনো কোমল হাত ধরা দেয়নি। গেল সপ্তাহেই এক পাত্রী তাকে বলেছিল, আপনার তো চুল পেকে যাচ্ছে, এখনও বিয়ে করতে পারেননি! বলেই হাসছিল মেয়েটি, সে হাসি ঝলমল করছিল তারুণ্যের অহংকারে। একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস বের হলো কী হলো না হাসিবের বুক চিরে। যৌবনের অহংকারে উদ্বেল তো এক সময় সে নিজেও ছিল। ভেবেছিল দেশের সেরা রূপবতী, সবচেয়ে গুণবতী, মেধাবী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সম্মানিত পিতার রাজকন্যা তার ঘরে আসবে বধূ হয়ে। কিন্তু তা তো অধরা স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল, তার মা পারলে এখন তাদের বাসার ছুটা কাজের শেফালির মায়ের মেয়ে শেফালির সাথেই তাকে বেঁধে দেন।
নাস্তার টেবিলে মা-বাবা দুজনকেই দেখা গেল নিশ্চুপ, মায়ের মুখ তো রীতিমতো থমথম করছে। জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পেল না হাসিব। হাসিবের ছোটো বোন তানিয়া ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে এসে বসল। হাসিবের প্রশ্নের উত্তর তার বাবা-মা না দিলেও তার কানে পৌঁছেছে ঠিকই। সে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “কী আর হবে, আম্মুর বান্ধবী মার্জিয়া খালার ছেলের নাতি হয়েছে।”
খুশির খবরে মায়ের মুখ ভারের কারণ বুঝতে পারল না হাসিব, সে অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, তো? তাতে কী সমস্যা?”
“সমস্যা মানে? ব্যাপক সমস্যা।” তানিয়া চশমার আড়ালে থাকা তার চোখ দুটো বড় বড় করে ইচ্ছা করে টেনে টেনে বলল।
“কী সমস্যা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না? বাচ্চা কি স্বাভাবিক না?নাকি বাচ্চার মায়ের কিছু হয়েছে?”
এতক্ষণে ফোঁস করে উঠলেন হাসিবের মা ডেইজি আহমেদ। হাসিবের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “বাচ্চা স্বাভাবিক হবে না কেন? সবার সবকিছুই স্বাভাবিক আছে। স্বাভাবিক নেই শুধু আমার কপাল। মানুষ নাতি-নাতনীর মুখ দেখে ফেলছে, আর আমি এখনও ঘরে বউ-ই আনতে পারলাম না।” বলে নিজের নাস্তার প্লেটের সাথে স্বামীর আর হাসিবের আধখাওয়া প্লেটও তুলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। হাসিবের বাবা মিজানুর রহমান হই হই করে উঠে বললেন, “আরে করো কী! আমার তো খাওয়া শেষ হয়নি এখনও।” তাতেও স্ত্রীর ভাবান্তর না হওয়ায় তিনি হাসিবের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “ আমার কী দোষ?আমি তো ঠিক বয়সেই বিয়ে করেছিলাম।” হাসিবের খাওয়াও শেষ হয়নি, তবে সে কথা বলার সাহস পেল না সে। মায়ের রাগের কারণ সে বুঝতে পারছে, মার্জিয়া খালার ছেলে নীরব তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো। তার বিয়ের খবরেও মা এরকম করেছিলেন, বিয়েতে যাওয়ার আগে যা নয় তাই বলে আলাপ-বিলাপ করছিলেন। আর এই ছেলে এখন বছর না ঘুরতেই বাপও হয়ে গেল। কেন রে বাপু, কীসের এত তাড়া তোমার? তানিয়া এসব দেখে মিটমিট করে হাসছে। কণ্ঠে কৃত্রিম হতাশা ফুটিয়ে আফসোসের সুরে বলল, “আমার বান্ধবীরা সবাই ফুপ্পি, খালামণি ডাক শুনে, তাদের ছবি দেয় ফেসবুকে। আমার মনে হয় সেই কপাল নেই।” ডেইজি আহমেদ ততক্ষণে চায়ের কাপের ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তানিয়ার কথা তার কানে গিয়েছে। তিনি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “শোনো, হাসিবের আব্বু, তুমি তানিয়ার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করো এজকে থেকেই। একটা তো আইবুড়ো হয়েছেই, আবার মেয়েকেও ঘরে বসিয়ে ঠেকতে চাই না।”
তানিয়ার মুখের হাসি এই কথায় গায়েব, তোতলাতে তোতলাতে বলল, “মা মা মানে, আমি আবার কী করলাম, আমি মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে, আমার কি এখন বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?”
ডেইজি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “তা তো তোমার গুণধর সুপাত্র ভাইয়েরও এখনও হয়নি। অনার্স পড়া অবস্থাতেই তোমার বিয়ে দেবো। নইলে ভাইয়ের মতো ঘরেই খুঁটি পেতে আমার মাথায় উঠে ধেই ধেই করে নাচবে। আর তোমার বয়সে আমি পেটে ছেলে নিয়েই অনার্সের ক্লাস করেছি।” তারপর আবার স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, “সেদিন মোনা আপা তার ননদের ভাগিনার কথা বলছিলেন না? আর্মিতে আছে ছেলেটা। তুমি মোনা আপার সাথে কথা বলো।”
তানিয়া এবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আম্মু আমি তো এখনও ছোটো, কেন এমন করছে আমার সাথে?” ডেইজি মেয়ের কান্নায় বিগলিত না হয়ে বললেন, “চোপ, তাড়াতাড়ি গিলে ভার্সিটি যা।” মিজান সাহেব মেয়ে অন্তপ্রাণ, তিনি স্ত্রীকে মিনমিন করে একবার বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন। জাঁদরেল সচিবও ঘরে এসে কেঁচো বনে যান।
হাসিব চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে দেখে লাল চা দেয়া হয়েছে, সে সাহস করে বলল, “আম্মু দুধ চা?”
ডেইজি খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “সে তোমার শাশুড়িকে গিয়ে বলো বানিয়ে দিতে।” এরপর আর কিছু বলা চলে না। অগত্যা অপ্রিয় লাল চা-ই গলাধঃকরণ করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো। চা না খেয়ে বের হওয়ার দুঃসাহস তার নেই। বের হওয়ার সময় ডেইজি মনে করিয়ে দিলেন সন্ধ্যায় অফিস শেষে এক পাত্রীর সাথে তার দেখা করতে যাওয়ার কথা আজ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here