#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৮,৯
#আমিনুর রহমান
পর্ব-৮
হাসান আমাকে চিনতে পারল তবে খুব একটা অবাক হলো না আমাকে দেখে। হাইস্কুলের সেই বন্ধুত্বটা যে অনেক আগেই সে ভুলে গিয়েছে সেটা আর বোঝার বাকি রইল না। এসএসসি পাশ করে হাসান রাজশাহী চলে গিয়েছিল তারপর থেকে তাঁর সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। এতদিন পর যখন তাঁর সাথে দেখা তখন ভেবেছিলাম সে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য দৌড়ে আসবে,আমিও দৌড়ে গিয়ে তাকে বুকে টেনে নিব। কিন্তু এমনটা হল না। হাসানের কথাবার্তার মধ্যেও কেমন জানি একটা ভাব চলে এসেছে। মানুষ যখন ভালো চাকরি করে,একটু টাকা পয়সা হয় তখন তাঁর ব্যক্তিত্বটাও কী চেঞ্চ হয়ে যায় না? হাসানকে দেখে এরকমই মনে হচ্ছে। হাসান আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না,আমার বদনামের কথাও হয়তো জানে না। স্পৃহার কাছ থেকে অন্তত এই মিথ্যা বদনামের লজ্জাটা পেতে হবে না আমাকে এটা ভেবে ভালোই লাগছে। তবে হাসান অনেকটা বদলে গিয়েছে, তাঁর কথার মধ্যে কেমন যেন অহংকার বোধ কাজ করে,এমনটা আগে করত না।
স্পৃহা আমাকে হাসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। হাসান যখন জানতে পারল আমরা দুজন একই ছাদের নিচে বসবাস করছি তবুও সে তেমন কোন রিঅ্যাক্ট করল না। অথচ আমি ভেবেছিলাম সে নেগেটিভ কিছু ভাববে,স্পৃহার সাথে তাঁর ঝগড়া হবে। স্পৃহাকে সে সন্দেহ করবে,স্পৃহাও রাগ করে তাঁর সাথে ব্রেকআপ করবে। এমন ভাবাটা যে কত বোকামি সেটা বুঝতে পারলাম আমি। স্পৃহা আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একসময় আমি নিজ থেকেই বললাম,
“আমি আপনার বয়ফ্রেন্ডকে অনেক আগে থেকেই চিনি, যদিও অনেকটা বছর আমাদের দুজনের কোন কথা হয়নি,যোগাযোগ হয়নি। তবে আমরা পাঁচটা বছর একসাথে পড়েছি।”
আমার কথার সাথে হাসান সম্মতি দিল। স্পৃহা আমাদের এতদিন পর দেখা হওয়াতে অনেকটা খুশি হল। কারণ হয়তো ওই একটাই,আমার সাথে যোগাযোগটা থেকেই যাবে। কিন্তু আমি তো তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ রাখব না। যেদিন স্পৃহা হাসানের কাছে চলে যাবে সেদিনই আমি স্পৃহার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাব অন্য কোন এক দুনিয়ায়। যেখানে স্পৃহা নামে কোন মানুষ থাকবে না। কারণ ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে স্পৃহাকে ছাড়া আমার থাকা খুব কষ্ট কষ্ট হবে। এটাকে কি বলা যায় জানি না। যদি ভালোবাসা বলা যায় তবে ভালোবাসায়,না হলে অন্য কিছু। স্পৃহারও কি আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে? আমাকে মিস করবে অনেক? নাকি হাসানের সাথে দিব্যি কাটিয়ে দিবে নিজের সুখের দিনগুলো। এমনটা হলেও অবাক হব না। কারণ স্পৃহা আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি,শুধু একজন বন্ধু ভেবেছে। যার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। এর বেশি কিছু না।
অনেকক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম আমার এখন চলে যাওয়া উচিত। ওরা দুজন অনেকদিন পর দেখা করল। একান্তে কিছু কথা বলার থাকতে পারে ওদের, যেহেতু ওরা দুজন প্রেমিক প্রেমিকা তাই গোপনীয় অনেক কিছুই থাকতে পারে তাদের মাঝে। তাই আমি তাদেরকে একা রেখে চলে এলাম। হাসান কিংবা স্পৃহা আমার চলে আসাটা আটকালো না। কারণ তারাও একটু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা চাচ্ছিল। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিলি আমাকে ফোন দেয়। সেদিনের পর মিলি আর আমাকে ফোন দেয়নি। হয়তো অভিমান করেছিল,আমি তাঁর সাথে কথা না বলে কেন ফোনটা রেখে দিয়েছি। আমিও অভিমান ভাঙানোর প্রয়োজন করিনি। তাই ফোনও দেইনি,এমনিতেও ব্রেকআপের পর মিলিকে কখনো ইচ্ছে করে ফোন দেইনি। দিতে ইচ্ছে করেনি,এই ইচ্ছে না করার কারণটাও আমি খুঁজে পাই না। হতে পারে এটার কারণ স্পৃহা কিংবা অবনি।
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই মিলি বলল।
“তুমি কোথায় এখন? আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই ইমারজেন্সি।”
আমি তখন বললাম।
“অনেক দূরে আছি দেখা করতে পারব না। কেন দেখা করতে চাও তুমি? দেখা করার তো কোন কারণ দেখি না আমি।”
তখন মিলি বলল।
“ঢাকাতেই তো আছ? এমন তো না যে ঢাকার বাহিরে আছ। দেখা করার কারণ লাগবে কেন? এতদিন পর দেখা করতে চাইলাম আর তুমি কিনা আমাকে ইগনোর করছো। এই ছিল তোমার ভালোবাসায়? আমি কি তোমার এতটাই পর হয়ে গেছি যে একটাবার দেখা করতে পারবে না আমার সাথে? এতটাই দূরে ঠেলে দিয়েছ আমাকে?”
আমার খুব রাগ হল,এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না, তারওপর মিলির এমন তেত কথা। আমি মিলিকে ধমক দিয়ে বললাম।
“ভালোবাসা জিনিসটার মানে তুমি আমার থেকে বেশি বুঝো। আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না৷ যদি পারতাম তাহলে ভালোবাসার মানুষগুলো আমাকে ছেড়ে যেত না। তুমি একটা কথা বলতে পারবা? তোমার সাথে যখন রিলেশনে ছিলাম তখন তোমার কি কখনো এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়েছে আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”
তখন মিলি বলল।
“না মনে হয়নি। তবে এখন তুমি আমাকে ইগনোর করো,আমার সাথে কথা বলতে চাও না,আমার ফোন ধরো না।”
তখন আমি মিলিকে বললাম।
“এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি না তাই এমন করি। আর আমি এখন বিবাহিত, আমার বউ আছে।”
তখন মিলি হেসে দিয়ে বলল।
“মিথ্যা বলাও শিখে গিয়েছো দেখি। যেখানে তোমারই থাকা খাওয়ার কোন জায়গা নেই,সেখানে তুমি নাকি বিয়ে করছো। হাস্যকর।”
তখন আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম।
“তাহলে তো জানোই আমার অবস্থা খুব শোচনীয়, আমার থাকা খাওয়ার মত জায়গা নেই। আমার জীবনে কেন আসতে চাইছো? অন্য কাউকে বেছে নিলেই তো পারো।”
তখন মিলি বলল।
“কারণ তোমাকে ভুলতে পারছি না তাই। তুমি কি আমাকে সত্যিই ভুলে গেছো?”
মিলির এমন কথা শুনে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আসলেই কি আমি মিলিকে ভুলে যাইনি? সবসময় তো ওই একজন মানুষকেই আমার মনে হয়। আমি জানি সে আমার না,অন্য কাউকে ভালোবাসে। তবুও কেন তাঁর জন্য আমার ভিতরটাতে হাহাকার করে? আমি মিলিকে বললাম।
“হ্যাঁ,আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছি।”
তখন মিলি মনখারাপের সুরে বলল।
“তুমি তো বলেছিল আমি তোমাকে ভালোবাসি না তাই আমি অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়াতে পেরেছিলাম। তাহলে আজ কেন তুমি আমাকে ভুলে গেল? তুমিও কি আমার মত অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছো? তাহলে তো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা বরাবরাই মিথ্যা ছিল। অথচ তুমি আমাকে মন থেকে ভালোবাসো সেই আশায় তোমার কাছে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছি আর তুমি কিনা অন্য কারো জন্য আমাকে ভুলে গেলে?”
বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না,তারপরেও বললাম।
“তুমিও তো আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভালোবেসেছিলে। কই আমি তো কোন অভিযোগ করিনি। তুমি তো তাঁর সাথেই নিজের জীবনটাকে রঙিন করতে চেয়েছিলে কিন্তু পারো নি। কারণ সে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে যদি চলে না যেত তাহলে তো তুমি ঠিকই আমাকে ভুলে তাঁর সাথে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে৷ তাহলে আমি কেন পারব না? আমার বুঝি ভালো থাকার অধিকার নেই,ভালোবাসার অধিকার নেই? আমার মনে হয় আমি তোমার সাথে ভাল থাকতে পারব না তাই তোমার সাথে আবার নতুন করে নিজেকে প্রেমের বন্ধনে বাঁধতে চাই না আমি।”
মিলির সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। এর আগে কখনো এমন হয়নি আমার। আমি মাথায় ব্যাথা নিয়েই বাসায় চলে গেলাম। ওষুধ খেলাম,সারাদিন শুয়ে থাকলাম তারপরেও মাথাব্যথা কমল না,শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙল বিকেল পাঁচটায়। তখনও স্পৃহা বাসায় ফিরেনি। তাহলে কি সে চিরদিনের জন্য চলে গেলো। আমাকে তো বলে যাওয়ার কথা। তাঁর সব জিনিসপত্র তো এখানেই আছে। এসব না নিয়ে তো সে যাওয়ার কথা না। সেই সকাল দশটায় আমি তাকে হাসানের কাছে রেখে এলাম। এখনও সে হাসানের সাথেই আছে। কি করছে তারা সারাটা দিন ধরে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল। কিন্তু চাইলেই তো আর সব জানা সম্ভব না। এটাও আমার পক্ষে জানা সম্ভব না। কি আর করবে? ভালোবাসা বিনিময় করবে এর বেশি কিছু না। আর করবেই তো, তারা প্রেমিক প্রেমিকা। এটুকু করতেই পারে। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে এমনটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে কেন সেটাই বুঝলাম না।
অনেক কিছু করেও যখন মাথাব্যথাটা কোনক্রমেই কমছিল না তখন ভাবলাম একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। শুনেছি মানুষের যখন ব্রেইন টিউমার হয় তখন মাথায় অনেক পেইন হয়। কিন্তু আমার তো এর আগে এত পেইন হয়নি কখনো। তবুও কেন জানি ভয় হতে লাগল। আমার তো আবার এরকম কিছু হল না? ব্রেইন টিউমার হলে নাকি অপারেশনে বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৫ পারসেন্ট। অপারেশন করতেও অনেক টাকা লাগে৷ হলেই বা কি? আমি মারা গেলেও তো কাঁদার মত কেউ নাই আমার। হয়তো বাবা মা জানতেই পারবে না তাদের ছেলেটা তাদের অজান্তেই তাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।
আমার এক বন্ধু ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পেয়েছিল,ওর নাম রাশেদ৷ খুব ভাল স্টুডেন্ট। ধুর কি বলি আমি,ভালো না হলে কি আর ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পায়? মাথাব্যথার সাথে সাথে কথাগুলোও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। রাশেদের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এখন ঢাকাতেই রোগী দেখে। ওর কাছে গেলে কেমন হয়? টাকাও খরচ হবে না,আমার মাথাব্যাথার কারণটাও জানতে পারব। আমার হাইস্কুল জীবনের অনেক বন্ধুরাই এখন প্রতিষ্ঠিত। আমিই শুধু কিছু করতে পারিনি। এখানেও কি আমি ব্যর্থ না? নিজের বাবা মায়ের কাছে আদর্শ সন্তান হতে পারলাম না বোনের কাছে ভালো ভাই হতে পারলাম না,ভালোবাসার মানুষের কাছে বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না। সবজায়গায় কেন জানি আমি ব্যর্থ। মৃত্যুতেও কি আমি ব্যর্থ হব? না মৃত্যুর কাছে আমি সফল হব। আমার বিশ্বাস এই স্বার্থপর পৃথিবীর সবাই আমাকে নিরাশ করলেও মৃত্যু আমাকে ভালোবেসে বরণ করে নিবে।
আমার ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। পরীক্ষাও করালাম। ভয় হচ্ছে খারাপ কিছু ধরা পড়বে হয়তো আমার। এমন সময় আমার বন্ধু আমার কাছে এসে বলল।
“এত চিন্তা কিসের? তেমন কিছুুই হবে না। বেশি টেনশনে থাকিস, আর রোদের মধ্যে ছিলি সেজন্য হয়তো এমন হয়েছে। তোর সাথে কি হাসানের কথা হয়?”
হাসানের কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। আমি গোমরা মুখে বললাম।”না,কেন বল তো?” তখন রাশেদ বলল।
“হাসান তো এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে তো মেয়েদের সাথে কথায় বলতে পারত না আর এখন ওর কয়েকটা গার্লফ্রেন্ড। হাসান রাজশাহী থেকে মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসত মিলি নামের একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে।”
মিলি নামটা শুনে বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠল। আমি যেই মিলিকে চিনি সেই মিলি নয়তো?
রাশেদ আবার বলল।
“আমিও একদিন ওদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। মেয়েটার বাসা ঢাকাতেই। পাঁচ ছয়মাস আগে মেয়েটা আমার এখানে এসেছিল। হাসানের সাথে ফিজিক্যালি রিলেশন করার কারণে মেয়েটার পেটে যে বাচ্চার জন্ম নিয়েছিল সেটা নষ্ট করতেই আমার কাছে এসেছিল তারা। তুই শুনলে অবাক হবি এই মেয়েটার সাথে এরকম একটা কাজ করার পরেও হাসানের এখনও দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড। ও মেবি ঢাকায় আসবে ট্রান্সফার হয়ে৷ আমার কাছে মেয়েটার পিকও আছে। দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি। ঘুরতে গিয়ে তুলেছিলাম। কথাগুলো বলেই নিজের ফোনে একটা পিক দেখালো আমাকে। ছবিটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। এটাতো সেই মিলি যাকে আমি চিনতাম জানতাম,এখনও চিনি। তাহলে কি আমার ব্রেকআপের পর মিলি হাসানের সাথেই রিলেশনে জড়িয়েছিল? অথচ মিলি আমাকে অশুদ্ধ বলতো আর নিজেকে বিশুদ্ধ দাবি করতো। তাহলে কি পৃথিবীর নোংরা মানুষগুলোই নিজেকে বিশুদ্ধ দাবি করে? আসল বিশুদ্ধ মানুষগুলো নিজের বিশুদ্ধতা লুকায়িত রাখে?
চলবে………
#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৯
#আমিনুর রহমান
রাশেদের কথাগুলো কেন জানি বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি। মিলি কি সত্যিই এমনটা করতে পারে? আমি তো ওর সাথে অনেকদিন রিলেশনে ছিলাম একটা চুমু পর্যন্ত খাইনি ওকে। কিন্তু বিশ্বাস না করেও তো উপায় নেই। রাশেদ তো আর আমাকে মিথ্যা বলবে না। আমাকে মিথ্যা বলে ওর কি লাভ? আর তাছাড়া ছবিগুলো তো মিথ্যা হতে পারে না। আর সে কি করে হাসানের সাথে এমন কাজ করল? মিলি কি নিজ থেকেই এমন করেছে নাকি হাসান তাকে বাঁধ্য করেছে? সবশেষে তো কাজটা সে করেছে এটাই সত্য। মেয়েরা কি তাহলে সহজসরল ছেলেদের চেয়ে প্লেবয় টাইপ ছেলেদেরকেই বেশি পছন্দ করে? স্পৃহার সাথেও কি আজ এমন কিছু হবে? না এটা আমি ভাবতে পারছি না। স্পৃহার সাথে এমন কিছু হলো হয়তো মানুষের ওপর থেকে আমার বিশ্বাসটা চিরতরে উঠে যাবে। স্পৃহাকে নিয়ে কেন জানি চিন্তা হতে লাগল। একবার ফোন করে সব বলব ওকে? যাতে করে ও হাসানের কাছ থেকে নিজেকে সেফ রাখতে পারে?
স্পৃহার নাম্বারটা বের করে কয়েকবার ফোন দিলাম কিন্তু সে ফোন ধরল না। ভয়টা যেন আরও বাড়তে লাগল। তাহলে কি স্পৃহা আর হাসান ওই একই নোংরামিতে ব্যস্ত। যেমনটা মিলি আর হাসান করেছিল। আমি স্পৃহাকে ফোনের ওপর ফোন দিয়ে গেলাম কিন্তু সে ফোন ধরল না। জানি না ফোন ধরলে তাকে হাসানের কথা বলতে পারতাম কিনা। তবুও তাকে অনেকবার ফোন দিলাম কিন্তু সে আমার ফোন ধরল না। আমার এমন অবস্থা দেখে রাশেদ জানতে চাইল কি হয়েছে আমার? আমি তাকে কিছু বললাম না। কারণ এই মুহূর্তে স্পৃহা আর হাসানের ব্যাপারটা তাকে জানাতে ইচ্ছে করছিল না। আমি রাশেদকে বললাম।
“তোর কাছে তো হাসানের নাম্বার আছে। একটু ফোন দিয়ে দ্যাখ ও এখন কোথায়,কি করছে?”
রাশেদ হাসানকে ফোন দিল কিন্তু হাসানের ফোনও বন্ধ দেখাল। কি হতে পারে স্পৃহার সাথে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম আর যাইহোক না কেন স্পৃহার সাথে যেন খারাপ কিছু না হয়। তাহলে হয়তো অনেক বেশি কষ্ট পাব। যদিও এই ছোট্ট জীবনে কষ্ট জিনিসটা কম পাইনি আমি। তবে এমন কষ্ট যেন না পাই যেটা সহ্য ক্ষমতার বাইরে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাইলেও ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। রাশেদ জানালো তেমন কোন সমস্যা নেই। আমি শুধু শুধুই অদ্ভুত সব চিন্তা করেছিলাম।
বাসায় গিয়ে দেখলাম স্পৃহা মনখারাপ করে গোমড়ামুখে বিছানায় বসে আছে। তাকে এভাবে দেখে খারাপ লাগছিল আমার। তাকে সবসময় ভালো দেখতে পারলে কেন জানি আমারও অনেক ভালো লাগে। কিন্তু তাঁর মন খারাপ দেখলে আমারও মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। আগে এমন হত না। কয়েকদিন হলো এমন হচ্ছে। আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম,
“কি হয়েছে আপনার? এমন মনমরা হয়ে বসে আছেন কেন?”
স্পৃহা আমার প্রশ্নের বিপরীতে কপাল কুচকে বলল।
“জামাই মারা গেছে তো তাই মন খারাপ?”
হাসান আর স্পৃহাকে নিয়ে অনেক চিন্তার মাঝেও আমি কিঞ্চিৎ হেসে বললাম।
“বেঁচে থাকতেই মেরে ফেললেন আমাকে? আমি তো আপনার পথের কাটা হইনি। তাহলে মারার কি দরকার? যে মানুষটা এমনিতেই মরা তাকে মেরে কি লাভ বলেন?”
আমার কথা শুনে স্পৃহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল।
“আপনার আবার কি হলো? এত ইমোশনাল হইয়েন না তো। সবসময় এত ইমোশন ভালো লাগে না। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে কিছু ফান,মাস্তি থাকা দরকার আছে। সিরিয়াসনেস জীবনকে কেমন জানি আমিষহীন মনে হয়।”
স্পৃহার এমন কথা বলার কোন আগাগোড়া খুঁজে পেলাম না। আমিও তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে বললাম।
“আমি কি সত্যিই অনেক সিরিয়াস?”
তখন স্পৃহা হেসে বলল।
“বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আপনি আমাকে ওইভাবে একা রেখে চলে আসলেন কেন?”
স্পৃহার এমন প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা আশ্চর্য হলেও মনে মনে খুব খুশি হলাম। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম।
“ওমা একা কোথায়? আপনার বয়ফ্রেন্ডের কাছেই তো রেখে এলাম। বয়ফ্রেন্ডের কাছে বুঝি নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না?”
তখন স্পৃহা বলল।
“তা করবো না কেন? বাট আপনার ওভাবে আমাদেরকে একা রেখে আসা উচিত হয়নাই। আমি চেয়েছিলাম আপনিও আমাদের সাথে সারাদিন থাকেন,আমাদের সাথে ঘুরেন।”
আমি তাকে হাসানের আসল রুপটার কথা বলতে চাইলাম। বলতে চাইলাম একটা মেয়ের সাথে তাঁর বয়ফ্রেন্ডের ফিজিক্যালি সম্পর্কের কথা। কিন্তু ভয় হলো স্পৃহা যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে। যদি ভাবে হাসানকে তাঁর চোখে খারাপ বানানোর জন্য আমি এসব বলছি। তাহলে তো ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ছবিটাও নিয়ে আসিনি। কিন্তু ছবি দেখালেই কি আর স্পৃহা বিশ্বাস করবে? হাসান তো এখন প্রতিষ্ঠিত,তাঁর সাথে এমন ছবি থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন স্পৃহাকে এই বিষয়টা আমার জানাতে হবে। আমি স্পৃহাকে বললাম।
“নিরাপদ মনে করা উচিত না। আমি মনে করি কোন মেয়েই অন্য পুরুষের কাছে নিরাপদ না। যেখানে নিজের আপনজনরাই সুযোগ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেখানে অন্য কারো কাছে নিরাপদ মনে করাটা বোকামি। আপনি বরং আপনার বয়ফ্রেন্ডের সম্পর্কে ভালোভাবে একটু খোঁজ খবর নিয়েন। বলা তো যায় না কার মনে কি আছে।”
আমার কথাগুলো শুনে যে স্পৃহা খুব একটা খুশি হতে পারল না সেটা তাঁর মলিন মুখটাই জানান দিচ্ছিল। নিজের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে কেউ খারাপটা শুনতে চায় না। সবাই ভালোটা শুনতে চায়। স্পৃহাও তেমন। স্পৃহা মলিন মুখে বলল।
“এসব বলার কারণ কি? আমার বয়ফ্রেন্ডকে আমার চোখে খারাপ বানিয়ে আপনার কি লাভ? আমি তো আপনাকে চিনি না জানি না। তবুও তো আপনার সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করছি। আপনার কাছে যদি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারি তাহলে আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে কেন নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারব না?”
স্পৃহার কথায় কোন যুক্তিসঙ্গত উত্তর খুঁজে পেলাম না আমি। তাই শুধু বললাম।
“আমার কোন লাভ নেই। আমার মনে হলো তাই কথাগুলো বললাম। আর একটা কথা। খারাপ মানুষগুলো কিন্তু প্রথমে বিশ্বাসটা অর্জন করে নেয়। সে আশ্বাস দেয় সে খারাপ কিছু করবে না। কিন্তু সবশেষে দেখা যায় বিশ্বাসী মানুষটাই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক কিছু করে বসে। বিশ্বাসী মানুষগুলোকে ধোঁকা দেওয়া এই পৃথিবীর সহজ কাজগুলোর মাঝে একটি। আর আমি আপনাকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম আপনি ফোনটা ধরেননি কেন?”
তখন স্পৃহা বলল।
“আপনার কথা ঠিক আছে। তবে আপনিও তো এখন আমার সর্বনাশ করতে পারেন তাই বলে কি আপনার সাথে থাকা বাদ দিয়ে দিব? ফোন ধরিনি,কারণ ইচ্ছে করেনি তাই।”
স্পৃহার কথাশুনে মনে হলো তাঁর তো হাসানের সাথে চলে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে আবার আমার সাথে থাকার কথা কেন তুলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“আপনি তো বলছিলেন আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা হওয়ার পর দেখা হলেই তাঁর কাছে চলে যাবেন। কিন্তু তাঁর সাথে না গিয়ে এইখানে পড়ে রইলেন যে?”
তখন স্পৃহা বলল।
“কেন? আমি থাকাতে বুঝি আপনার অনেক বেশি সমস্যা হচ্ছে?”
স্পৃহার এমন কথা শুনে তাকে বলতে ইচ্ছে হল।
“আমি তো চাই তুমি সবসময়ের জন্য আমার কাছে থেকে যাও। কিন্তু তুমি কি আমার চাওয়াটা রাখতে পারবে?”
কিন্তু আমি এটা না বলে তাকে বললাম।
“সমস্যা না,তবে আপনার পেছনে অলরেডি অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। নিজের বাবা মাও তো সন্তানের জন্য এমনি এমনি কিছু করতে চায় না। আপনি আর কয়দিন থাকবেন এখানে?”
স্পৃহা জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল।
“জানি না কতদিন থাকতে হবে। হাসান রাজশাহী থেকে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। যেদিন পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেদিন ও ঢাকাতে আসার পর ছিনতাইকারীদের হাতে পরেছিল। না হলে সেদিনই আমাকে রাজশাহী নিয়ে যেত। কিন্তু এখন যেহেতু থাকার মত অবস্থা আমার আছে তাই আর নিয়ে যাবে না। খুব তাড়াতাড়ি নাকি সে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় আসবে। ততদিন এখানেই থাকতে হবে।”
আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম। ভালোই হয়েছে ঠিকমতোই ছিনতাইকারী ধরেছিল না হলে সেদিন অনেক কিছুই হতে পারত। আমার এমন কথা শুনে স্পৃহা ধমকের সুরে বলল।
“কিসব আবোলতাবোল বলছেন? ভালোই হয়েছে মানে? ওইদিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে তো আর আপনার সাথে দেখা হত না। আমাকেও এমন অবস্থায় পড়তে হত না। আর আপনি বলছেন ভালোই হয়েছে। অদ্ভুত! ”
আমি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম।
“আপনাকে একটা কথা বলি রাগ কইরেন না।”
তখন স্পৃহা বলল।
“রাগ করার মত হলে রাগ না করে থাকতে পারব না।”
সে রাগ করবে জেনেও তাকে আমি বললাম।
“আপনার বয়ফ্রেন্ড কেমন যে আপনাকে একটা অবিবাহিত ছেলের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকতে দিচ্ছে? আমি যদি আপনার বয়ফ্রেন্ডের জায়গাই থাকতাম তাহলে কখনোই আমি আপনাকে এভাবে একজন ছেলের সাথে এক বাসায় থাকতে দিতাম না।”
তখন স্পৃহা বলল।
“সবার মনমানসিকতা তো আর এক না। হাসান আমাকে বিশ্বাস করে বলেই থাকতে দিয়েছে। কারণ সে জানে আমি এমন কিছু করব না। আর আমার একা থাকতে ভয় লাগে। সেজন্যই আপনার সাথে শেয়ার করে থাকি।”
আমি অনেক চেষ্টা করেও যখন স্পৃহাকে হাসান সম্পর্কে কোন নেগেটিভ ধারণা দিতে পারলাম না। তখন মনে মনে রাগ করে বললাম।
“যা তোর জীবন তুই নষ্ট করবি আমার বালের কি? তোর ভালো চাই আর তুই ভাব ন্যাস।”
স্পৃহার সাথে কথা বলে ঘুমাতে গেলাম কিন্তু ঘুম এলো না। ভাবলাম অবনিকে একবার ফোন দেই। বাবা মা কি সব সত্য জানে নাকি অবনি অভিমান করে কিংবা তাঁর মায়ের শোকে এখনো কিছু জানায়নি। কিন্তু অবনির মা তো জানাতে পারে। মৃত্যুর আগে মানুষ চাই নিজের ভুল গুলো শুধরে নিতে। কারো কাছে খারাপ মানুষ হয়ে কেউ কখনো মরতে চায় না। মৃত্যুর আগে সবাই চায় নিজের জানা পাপকাজ গুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে,সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চায়। সবাই ক্ষমাও করে দেয়। যতই শত্রুতা থাকুক না কেন মৃত্যু পথযাত্রী একজন মানুষকে ক্ষমা করবে না এমন মানুষ হয়তো দুনিয়াতে নাই। তাহলে আমারও কি অবনির মায়ের সাথে একবার দেখা করা উচিত,তাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত? কিন্তু আমার যে মন চায় না আমি ওই মহিলার কাছে যাই। মনের বিরুদ্ধে কি কোন কিছু করা যায়? যায় না। গেলেও আমি আমার মনকে দুঃখ দিয়ে তাঁর বিরদ্ধে যেতে চাই না। তাই আমি অবনিকে ফোন দিলাম না।
দুইদিন পর হঠাৎ করেই বাবার নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে অনেকটা চমকে গেলাম। এতদিন পর কি মনে করে বাবা আমাকে ফোন দিল এটা ভাবতেই প্রথমবার ফোনটা ধরতে পারলাম না। পরের বার যখন ফোন দিল তখন আর না ধরে পারলাম না। তবে তাদের ওপর আমার অনেক অভিমান জমা হয়ে আছে। জানি না এই অভিমান গুলো তারা ভাঙাতে পারবে নাকি আমি নিজেই আমার পাহাড় সমান অভিমান গুলোর কাছে হার মানবো। ফোন ধরার পরেই বাবা যে কথাটা বললেন সেটা হলো।
“তুমি বাসায় চলে আসো। তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার সম্পর্কে আমরাও সত্যটা জানতে পেরেছি। অনেকেই জানতে পেরেছে তুমি কাজটা করোনি। যে তোমাকে এভাবে লাঞ্চিত করেছিল আল্লাহ তাকে তাঁর পাপের শাস্তি দিয়েছে। তুমি বাসায় চলে আসো। তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
বাবার বলা কথাগুলো কেন জানি আমার ভিতরটাতে জায়গা করে নিতে পারল না। সেজন্যই হয়তো আমার পাহাড় সমান অভিমান গুলো বলে উঠল।
“আপনি তো বলেছিলেন যদি এক বছরের মধ্যে বেঁচে থাকার মতো কোন কিছু করতে না পারি। তাহলে যেন আপনার কাছে চলে আসি। কিন্তু আফসোসের বিষয় আপনার কথাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আমি নিজের বেঁচে থাকার মতো একটা অবস্থান তৈরি করেছি। এখন আমি আপনাকে ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারব। এখন কি আপনার কাছে যাওয়ার কোন দরকার আছে? আমার তো মনে হয় না।”
আমার কথাগুলো শুনে বাবা প্রচন্ড রাগ করলেন। ধমক দিয়ে বললেন।
“বেয়াদব ছেলে।”
কথাটা বলেই তিনি ফোনটা রেখে দিলেন।
বাবা ফোন রেখে দেওয়ার পর আমারও কেন জানি খারাপ লাগল। এভাবে না বললেও পারতাম। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতে লাগল। রাগটা কারো ওপর ঝাড়তে হবে। বাবার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করেছি এটা মনে রাখতে চাই না আমি। এর জন্য কারো সাথে আমার ঝগড়া করতে হবে,খারাপ ব্যবহার করতে হবে,বকা দিতে হবে। কিন্তু কাকে দিব? মিলিকে দেওয়া যায়। এই মেয়েটা আমাকে অনেক মিথ্যা বলেছে। আজকে সবকিছুর শোধ তুলব আমি। আমি মিলিকে ফোন দিব বলে বিছানায় থেকে উঠে বারান্দায় গেলাম। ঠিক তখনই অবনির ফোন পেলাম। বাট এই মুহূর্তে আমার অবনির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
চলবে………….