#প্রতিহিংসার_অনুরক্তি,০৪
লেখিকা: সালসাবিল সারা
নূরের ধারণা ছিলো সে তার তিতামুখী জোহান ভাইয়ের প্রতিহিংসার অনুরক্তি খুব সহজেই দমিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে।কিন্তু,এই কয়েকমাস যাবত নূর জোহানের কাছাকাছি গিয়ে উপলব্ধি করেছে,জোহানের মন থেকে অতীত এতো সহজে দূর হবে না।এমনকি সেই দুর্বিষহ অতীতের জন্যে নূরকেই ভুগতে হবে। রাগে-দুঃখে নূরের চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠে।সে নিজেও জানে অতীতটা শুধুই একটা ভুল ছিল।সেই ভুল সমাধান করা যেতো,
সেদিনই।কিন্তু,জোহানের জিদের কাছে সবটাই কেমন যেনো সর্বোত্তম কঠিনে পরিণত হলো। যা আজ পর্যন্ত ঠিক হওয়ার নাম নিচ্ছে না।এইসব নানান চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো নূর ভার্সিটির চওড়া রাস্তায়।
–“আমাদের মাঝের সম্পর্ক কখনোই কি ঠিক হবে না,জোহান ভাই!”
নূরের মনোকল্পনা শেষ হওয়ার পূর্বেই শাঁ করে তার পাশ দিয়ে একটা মোটর বাইক অতিক্রম করলো।নূরের বুকটা ধ্বক করে উঠেছে।গায়ের ওড়নাটা বেশামাল হয়ে পড়লো বাইকের তীব্র বাতাসের ঝলকানিতে।মুখের সামনে চলে আসা চুল ঠিক করে নিয়ে সামনে ফিরতেই নূর দেখলো,সেই বাইক থেকে বেশ সুদর্শন এক ছেলে নামছে।বুকের সাথে হেলমেট ঠেকিয়ে ছেলেটা নূরের দিকেই তাকিয়ে রইলো।নূরের মেজাজ সপ্তম আসমানে।সে ঐ ছেলের সামনে যেতেই ছেলেটা হাসিমুখে বলে উঠলো,
–“ভেরি সরি,বিউটিফুল।আমার ডার্লিংকে আমি কন্ট্রোল করতে একেবারেই পারি না।”
পরক্ষণে ছেলেটা বাইকে হাত বুলিয়ে দিলো।নূর বুঝলো,ছেলেটা তার বাইককেই “ডার্লিং” বললো।
–“চুপ থাকুন।দিন দুপুরে কি মদ গিলে রেখেছেন?আপনার এই ডার্লিং ই না,আপনার পরপারের যাওয়ার রাস্তা অতি শীগ্রই এনে দেয়!জিনিসকে লাগাম দিতে শিখুন।ননসেন্স।”
–“এই যে মিস,অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আমার একেবারে ভালো লাগে না।ভুল করেছি,সরি বলেছি।এতেও এতো লেকচার দেওয়ার কি দরকার?আপনি নিজে বেঁচে থাকেন,আমার বাঁচা মরা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”
ছেলেটি ভ্রু সংকুচিত করে বললো।
–“নিজের মরা,নিজে মরুক।বেয়াদপ কোথাকার।”
বিড়বিড় করে বললো নূর।
নূর সামনের দিকে পা এগোতেই ছেলেটা চিল্লিয়ে নূরকে বলে উঠলো,
–“আরে ম্যাডাম,ওড়না তো ঠিক করুন।ওড়নার এক সাইড জমিনে তো আরেক সাইড আসমানে উঠে আছে।”
ছেলেটার কথায় রসিকতার সুর স্পষ্ট।আর তার এই কথায় আশেপাশের সবাই খিলখিল করে হেসে উঠেছে।নূর বেশ লজ্জা পেলো।ওড়না ঠিক করে নিয়ে সামনে যেতেই সে গাছের আড়ালে পমেলকে দেখতে পেলো।যে এতক্ষণ চুপ করে সব দৃশ্য নিজের মগজে ধারণ করে নিয়েছে।নূর পমেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো,এমন সময় পমেল নিজেই সরে গেলো সেই জায়গা থেকে।নূর নিজের কপালে হাত রাখলো,
–“পমেলের আবার কি হলো?প্রত্যেকবার আমার সাথে তার দেখা হতেই আমার সাথে কথা বলতে চলে আসে।আজকের এই ঘটনার কারণে কি পমেল আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না?”
নূরের মনে প্রশ্ন হানা দিলো।
পমেলের সাথে নূরের ভালই সখ্যতা হলো অনেক আগেই। পমেলের মতো ভোলাভালা ছেলেকে নূরের মন্দ লাগে না।তাছাড়া নূরকে অনেক সাহায্য করে ছেলেটা।পমেলের কথা ভাবতে গিয়ে নূর খানিক্ষন পূর্বের কাহিনী ভুলে গেলো।ক্লাসে প্রবেশ করতেই নূর তনয়াকে দেখতে পেয়ে তার পাশে গিয়ে বসলো।তনয়া নূরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
–“কি হলো শেহজাদী!আজ তোর মুখের নকশায় আমি চিন্তার আভাস পাচ্ছি কেনো?”
নূর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
–“কিছু না।”
–“ওহ,জোহান ভাইয়ার কথা ভাবছিস?আজকাল তুই কেমন যেনো তাকিয়ে থাকিস উনার দিকে।ঘটনা কি?”
তনয়ার কথায় নূর ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করলো,
–“তোর কথার মাঝে সবসময় এই জোহান ভাই কেনো চলে আসে?”
–“আসবে নাই বা কেনো?যখনই তোদের দুইজনকে একসাথে দেখি,কেনো জানি আমার মন বলে…
তনয়া,দেখ এদের!প্রকাশ্যে ভালোবাসি না বলে নীরবেও ভালোবাসা যায়।”
নূর চমকে উঠলো তনয়ার কথায়।পরক্ষণে নূর তনয়ার হাত চেপে তাকে রসিকতার ছলে ধমকে উঠল,
–“অসভ্য।বেশি জানিস তুই?”
–“হেহে।তনয়া সব জানে।”
এরপর দুই সই তাদের নানান কথায় মশগুল হয়ে পড়লো।তবে,নূরের হাসিখুশী মুখ বেশিক্ষণ থাকলো না।ক্লাসে স্যারের প্রবেশের পাশাপাশি সেই ছেলেকে দেখে নূরের রাগের পরিমাণ আবারও আসমান সমান হলো।সবার দেখাদেখি নূর দাঁড়িয়ে পড়লো স্যারকে সম্মান জানাতে।
–“এই হলো মেহরাব।তোমাদের সহপাঠী।”
স্যার গম্ভীর কণ্ঠে বললো সবার উদ্দেশ্যে।
মেহরাব হাসলো।এই দেখে নূর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আওড়ালো,
–“বেয়াদপ একটা।”
–“বেয়াদপ কেনো?”
তনয়ার প্রশ্ন।
বেঞ্চে বসে নূর ফিসফিস করে সবটাই জানালো তনয়াকে।
–“ভারী বেয়াদপ তো!তাছাড়া এই মধ্য সময়ে এই ছেলে কিভাবে আমাদের ভার্সিটিতে ট্রান্সফার হয়ে এলো, আমি এটাই বুঝছি না।”
–“টাকা.. বস টাকা।এই দুনিয়াটাই টাকার খেলা।মানি হ্যাঁ তো সাব হ্যাঁ।দেখেই মনে হচ্ছে বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে।”
নূর বিরক্তি প্রকাশ করলো তার কথার মাধ্যমে।
পাশে ফিরে মেহরাবের সাথে চোখাচোখি হতেই মেহরাব হাত দেখিয়ে হেসে উঠলো। প্রত্যুত্তরে নূর মনে মনে একটা বিশ্রী গালি দিলো মেহরাবকে।
পরপর দুইটা ক্লাস শেষ করে নূর এবং তনয়া ক্লাস ত্যাগ করলো।বাহিরে যে কয়জন আজ সকালের ঘটনা দেখেছে,তারা নূরকে দেখেই ফিসফিস করে কিছু বলছে আর মুখ টিপে হাসছে।নূরের বুঝতে বাকি রইলো না কাহিনী কি? তনয়াও আন্দাজ করছে সবার এমন আচরণে।ক্যান্টিনে যাওয়ার রাস্তায় পমেলের সাথে দেখা হলো নূরের।এইবার পমেল নিজেই নূরকে বলে উঠলো,
–“ভাবীপা!”
–“কিসের ভাবীপা?সকালে দেখে দৌড় দিয়েছিলে আর এখন ভাবীপা ডাকছো?”
পমেল কিছু বলার পূর্বে সেখানে আগমন ঘটে মেহরাবের।সে নূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“লাক!আমার লাক বা ভাগ্য আসলেই ভালো।সকালে যেই মেয়ের সাথে পরিচিত হলাম সেই মেয়েই আমার ক্লাসমেট!আমার নাম তো জানোই।আর তোমার নাম?”
নূর বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেহরাবের দিকে।এরমাঝে পমেল বলে উঠলো,
–“এই ছেলে নাম দিয়ে কাজ কি?সকালের কান্ড কিন্তু আমি নিজ চোখে দেখেছি।”
–“উলে উলে,এই নাদুস নুদুস বাচ্চাটা কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?তোমার পছন্দ অনেক খারাপ, মেয়ে।”
মেহরাব নূরের দিকে ঝুঁকে বললো।
–“বেয়াদবির একটা সীমা থাকে।এক চড় দিয়ে সব ফাইজলামি দূর করে দিবো।মুখে কি লাগাম নেই?”
নূর প্রচুর রেগে গেলো।
–“নাহ নেই।মেহরাব কারো কথায় চুপ করে না।”
নূর কিছু বলতে নিয়েও বললো না।এইসব ছেলের সাথে তর্কে জড়িয়ে মানুষের কাছে খোশ গল্পের টপিক হতে চাই না সে।ভার্সিটির বিল্ডিং থেকে বের হয়ে নূর পমেলকে আঙ্গুল নেড়ে বলে উঠলো,
–“এইসব ছেলের সাথে তর্ক করতে যাবে না।”
পমেল সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো।নূর তার দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দেখলো তাদের থেকে কিছু দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে জোহান।মুখে তার রাগ স্পষ্ট।নূর খুশি হতে চেয়েও হতে পারলো না।জোহান তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।জোহান যেই এসে তাদের পাশে দাঁড়ালো,অমনি সেখানে মেহরাবের আগমন ঘটলো।
–“তোমার নামটা তো বললেই না,মিস?”
–“এই ছেলেই কি সকালের ছেলেটা,পমেল?”
জোহানের থমথমে কণ্ঠ।
নূর অবাক হলেও,নূরের আজ বুঝতে বাকি নেই;পমেল হলো জোহানের গুপ্তচর।জোহানের কথায় পমেল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
–“ওহ গড,তোমার কয়টা বয়ফ্রেন্ড?নাকি এরা তোমার ভাই?”
–“আসল ভাই তো তুমি।এইযে একটা মেয়ের পিছু পিছু তার নাম জানতে চাইছো, তার কেয়ার করছো,তার কয়টা বয়ফ্রেন্ড এইসব জানতে চাইছো,এইসব তো ভাইয়ের কাজ কারবার।গুড,ভালো।তোমার এই বোনটার খেয়াল রাখবে।”
মেহরাব অবাক না হয়ে পারলো না জোহানের কথায়।সে একান্ত নিজেকেই স্মার্ট ভাবতো,কিন্তু জোহানের কথা শুনে তার নিজের স্মার্টনেস তার কাছে তুচ্ছ লাগছে।
নূরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জোহান তাকে বলে উঠলো,
–“চলো।”
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নূর জোহানকে উত্যক্ত করার জন্যে তাকে বলে উঠলো,
–“আমি কেনো তোমার সাথে যাবো?আমি একা আসি একা যাবো।”
–“আমি ড্রপ করে দিবো তোমাকে?”
মেহরাব নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করলো।
–“কেনো?আমার কি পা নেই?নাকি আমার গাড়ি চড়ার টাকা নেই?আমি একা যেতে পারি।”
নূর বললো।
–“এই ছেলে!অনেক্ষণ সহ্য করেছি তোর কথা। নূরের আশে পাশেও যেনো না দেখি তোকে আমি।নাহলে..!থাক,কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিবো।”
কথাটা বলে জোহান নূরের হাত ধরে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তনয়া এবং পমেল নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো।কিন্তু থেমে রইলো মেহরাব।প্রথম দিনেই ভার্সিটিতে একটা চ্যালেঞ্জ পেয়ে বেশ খুশি সে,
–“আহ,প্রথম দিনেই চ্যালেঞ্জ! নট ব্যাড।মেয়েটাও সুন্দরী।যতোই উড়াউড়ি করো হিরো,দিনশেষে তোমার এই পরী আমার খপ্পরে পড়বে আর তুমি হারবে এই চ্যালেঞ্জ।মেহরাব মেহের না কোনো চ্যালেঞ্জ হেরেছে, আর না হারবে!”
মেহরাবের মুখে অজানা হাসি।
___________________
গাড়ি চলছে তীব্র গতিতে।নূর মুখ খিঁচে বসে রইলো।জোহানের এমন ড্রাইভিং এ বেশ বিরক্ত সে।কখনো নূর বামে ঢুলছে তো কখনো ডানে।নূর বুঝে না এই জোহানের সমস্যা কি!অনেক্ষণ চুপ থাকলেও এইবার নূরের মুখের বুলি ফুটেছে,
–“এইভাবে বেপরোয়া গাড়ি না চালালে কি তোমার খুব ক্ষতি সাধন হবে?”
জোহানের মুখ বন্ধ।নূর জোহানের দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করতেই দেখলো,জোহানের মুখমন্ডল শক্ত হয়ে আছে।তার অক্ষিজোড়া কেমন যেনো বিরক্তি আর রাগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।নূর এইবার বুঝলো তার এমন মুখশ্রীর পেছনে অবদান রেখেছে আজকের দিনের ঘটনা।নূর তার মুখ খোলার পূর্বেই গাড়ি খুব জোরে ডানে বাঁক নিলো। এতে নূর জোহানের বাম বাহুতে গিয়ে ঠেকলো।
–“সমস্যা কি ভাই তোমার?তুমি এমন করছো কেনো?নিজে তো মরবেই সাথে আমাকেও তোমার সাথে শামিল করবে এই মৃত্যু মিছিলে।আজকের ঘটনার জন্যে রেগে আছো তুমি,আমি বুঝতে পেরেছি।কিন্তু এতে আমার কি দোষ?তুমি ঐ মেহরাবকে তোমার সাথে গাড়িতে তুলে নিলেই পারতে।এরপর তাকে এমন আনাড়ি ড্রাইভিং এর শিক্ষা দিতে।কিন্তু আমাকে কেনো?আমার কি ভুল?তাছাড়া তোমার কি কাজকর্ম নেই?যখন তখন আমার ভার্সিটিতে চলে আসো।আবার আমার উপর খবরদারি করো।ব্যাপার কি?যতটুক জানি,তুমি তো আমাকে সহ্যই করতে পারো না।”
নূর কথা বলে দম দেওয়ার ফুরসত পায়নি,এর পূর্বেই সজোরে ব্রেক চাপলো জোহান,
–“মেহরাব! বাহ,নামটাও জানা আছে দেখছি। তা,কতদিনের পরিচয়?ছেলেটা যখন আজ সকালে তোর ওড়না নিয়ে সবার সামনে কথা বলেছে,সবাই অট্টহাসিতে তোকে জোকার বানিয়েছিল তখন তোর বেশ ভালো লেগেছে, তাই না?অবশ্য লাগবে না ই বা কেনো!তুই তো এইসবই চাস।ছেলেরা তোর পিছুপিছু ঘুরবে,তোর নামে কমেন্ট পাস করবে, এইসবই তোর প্রিয় তাই না?”
–“চুপ থাকো,জোহান ভাই!কিসব বলছো?সবাইকে তোমার মতো ভাবতে শুরু করেছো?তুমি কতো মেয়ের সাথে লাইন করে রেখেছো এইসব আমার জানা নেই, ভেবেছো?এতো বড় বাড়ি রেখে সাধে কি কেউ আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে?রাত বিরাতে কতো মেয়ে যে তোমার ফ্ল্যাটে আসে,এইসব আমার জানা আছে।নিজের চরিত্র আগে ঠিক করো এরপর না হয় আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে আসবে…”
–“নূর!”
জোহানের হাত উঠে গেলো নূরের সম্মুখে।কিন্তু জোহান নিজেকে সামলে নিয়েছে।নূর নিজের মুখে হাত রাখলো জোহানের হাত থেকে নিজের মুখকে বাঁচাতে।মুখে রাখা হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নূর দেখতে পেলো জোহান নিজের কপাল চেপে মাথা নিচু করে আছে।
–“ভাগ নূর ভাগ।অনেক ফালতু কথা বলেছিস।এই তিতামুখী এখন তোকে মেরেও ফেলতে পারে।”
নূরের যেই ভাবা সেই কাজ। ডোর লক খুলে নূর গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।সজোরে গাড়ির দরজা বন্ধ করে নূর জোহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“মিথ্যা আরোপ লাগাতে আমিও জানি।তিতামুখী কোথাকার।”
দাঁতে দাঁত চেপে জোহান নূরকে কিছু বলতে নিলে নূর সেদিকে তোয়াক্কা না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে একটা বাসে উঠে পড়লো,
–“যাক জানে বেঁচে গেলাম আজ।ইয়া আল্লাহ্ মালিক।”
বুকে হাত রেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো নূর।
‘
জোহানের মেজাজ বেজায় খারাপ।নূরের বলা প্রত্যেকটা কথা তার মাথায় ভনভন করছে।অফিসে গিয়ে সবার সাথে বেশ কড়া ভাষায় কথা বলছে সে।মিটিং শেষ করেই নিজের অফিসের চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো জোহান,
–“সত্যি কি নূর এবং বাকি সবার এমন মনে হয়?আমি মেয়েবাজ?মেয়েদের সাথে রাত কাটানোর জন্যেই আমি আলাদা থাকি?আমার সেই রাগ অভিমান কারো চোখে পড়লো না?যে কাজ আমি করিনি আবারও সেই কাজের জন্যে আমাকেই দোষারোপ করছে,নূর।বড্ড বাঁচাল হয়েছিস তাই না তুই?তোর এই বাঁচাল হওয়ার শিক্ষা আমি দিবো তোকে। মেয়েবাজ কি জিনিস আমি তোকে হাড়ে হাড়ে দেখিয়ে দিবো।”
জোহানের মনোভাবনার ইতি ঘটলো শালুর প্রবেশে। শালুর দিকে তাকিয়ে জোহান বলে উঠলো,
–“নক করতে শিখিয়ে দিবো আবার?”
–“তোর অফিস রুমে আসতে আমার নক করা লাগবে?কি হয়েছে বল তো?অনি থেকে শুনলাম সবাইকে আজ সমানতালে বকে যাচ্ছিস।ঘটনা কি?”
শালু বললো।
–“নূর ভাবে আমি মেয়েবাজ।মেয়েদের সাথে রাত কাটানোর জন্যেই আলাদা ফ্ল্যাটে থাকি।এইসব শুনলে আমি ঠিক থাকবো কিভাবে?কেউ তো আমাকে বুঝে না।উল্টো আমার উপর মিথ্যা আরোপ লাগিয়ে দেয়।তিন বছর আগেও ঠিক এমন হয়েছে। যার কারণে আমি ঘর ছেড়েছি। মানে আমি যা করি না তার দোষটা আমার উপরেই এসে পড়বে।”
জোহানের কড়া জবাব।
–“তুই নূরকে নিশ্চয় গায়ে লাগার মতো কিছু বলেছিস।নাহলে নূর কখনো এইসব বলবে না।তাছাড়া নূর ঠিক বলেছে।সেই সামান্য কারণে ঘর ছেড়ে তুই অন্য ফ্ল্যাটে থাকলে যে কেউ খারাপ ভাববে।অনেক হয়েছে।এইবার তুই নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যা।নাহলে তোর ভালোবাসার মানুষ থেকে আরো নানান কথা শুনতে হবে।ভালোবাসার মানুষের মুখে মধুর কথায় ভালো লাগে,কটু কথা না।”
শালু জোহানের কাঁধ চাপড়ে কথাগুলো বললো।
জোহানের কোনো হেলদুল নেই।সে যেনো এক গভীর চিন্তায় মত্ত। হয়তো শালু আর নূরের কথায় জোহান তার মনের কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিচ্ছে!
_____________
নূর বাড়ির কাজে ব্যস্ত।তার খালার বাসা থেকে মেহমান আসবে।নূরের মায়েরা তিন বোন।নূরের শত্রু, নিশি তার খালাতো বোন।নিশির পরিবার সৌদিতে থাকে।তিন বছর পূর্বের ঘটনার পর নিশির পরিবার এখনো বাংলাদেশে আসেনি।কিন্তু,এখনো নূরের মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে নিশির মায়ের।হাজার হলেও নূরের মা এবং নিশির মা আপন বোন। নাড়ির টান এতো সহজে ছিঁড়ে যায় না।
নূরের কাজ প্রায় শেষ।সেদিনের পর আজ চারদিন যাবত নূর ভার্সিটি যায়নি। অতো জরুরী ক্লাস ছিলো না তার।এছাড়াও তনয়া গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।ভার্সিটি গেলে সেই মেহরাবের সাথে তার সাক্ষাৎ হওয়ার চিন্তায়, নূর যেঁচে আর ভার্সিটিতে গেলো না।তনয়া বিহীন নূর ঐ ছেলের সাথে মোকাবেলা করতে একেবারে নারাজ।
কিছুক্ষণ পূর্বেই নূরের ছোট খালার পরিবার আসলো তাদের বাড়িতে।নূরের ছোট খালার দুই মেয়ে। জারা আর সেই ছোট মেয়ে দুইজন নূরদের ঘর মাতিয়ে রেখেছে।নূর সবকাজ এক হাতে করে যাচ্ছে।তার মা এতদিন পর বোনকে পেয়ে খোশ গল্প জুড়ে দিলো।রান্নাঘর থেকেই নূর শুনতে পেলো প্রধান ফটকে কেউ কড়া নাড়ছে।নূর চিল্লিয়ে তার মাকে বললো,
–“মা,দরজা খুলে দাও।আমি কাজ করছি।”
–“যাচ্ছি।”
জহুরার কথা শুনে নূর আবারও তার কাজে মন দিলো।মিনিট দুয়েক পর তার মা রান্নাঘরে এসে তাকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
–“জোহান এসেছে।চিনি ছাড়া চা বানিয়ে নে ফটাফট।আমি নাস্তা দিচ্ছি ছেলেটাকে।”
নূর চোখ ঘোরালো তার মায়ের কথায়।
–“একে তো মুখ দিয়ে সারাক্ষণ তিতা কথা বের হবে তার।এর মধ্যে আবার চিনি মুক্ত চা খায়। তিতার উপর তিতার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আমার জোহান ভাই উরফে তিতামুখী।”
নূর গোমড়া মুখে চা নিয়ে হাজির হলো জোহানের সামনে।জোহান এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলো নূরের পানে।নূর ছোট্ট টেবিলে চায়ের কাপ রেখে একটু সরে দাঁড়ালো।জোহান আগের ন্যায় নূরের মাকে বলতে লাগলো,
–“আন্টি,শুক্রবার সেন্ট্রাল হলের চতুর্থ ফ্লোরে চলে আসবে কিন্তু সবাই।অফিসের অন্য একটা ব্র্যাঞ্চ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তোমাদের সবার উপস্থিতি চাই।”
–“বড় আপু,আমরাও যাবো সেখানে।ইয়ে!”
জারা খেলার ছলে নূরকে বললো।
–“আরে না।কে যাচ্ছে সেখানে?তিতা মানুষের তিতার রাজ্যে আমি কিছুতেই যাবো না।”
নূর মুখ ভেংচি দিয়ে জবাব দিল।
–“নূর!কি ব্যবহার এইসব?”
জহুরা ধমকালো নূরকে।
–“আন্টি, বাসার কাজের মেয়েকে নিলে আমি মাইন্ড করবো না।”
নূরের মা হেসে উঠে পড়লো,
–“নাস্তা করো বাবা।বাসায় মেহমান আছে আমি একটু আসছি।”
–“তুমি আমায় কাজের মেয়ে বলেছো? আস্ত অসভ্য তুমি।হবে নাই বা কেনো?না জানি কোন কোন মেয়ের সাথে রাত বিরাতে মিশে এমন হয়ে গিয়েছো তুমি।গাদ্দার!”
নূরের কথায় জোহান বসা থেকে উঠে সরাসরি নূরের মুখ চেপে ধরলো দৃঢ়ভাবে,
–“আলাদা ফ্ল্যাটে থাকলেই কি কুকর্ম করা লাগে?”
–“আলাদা ফ্ল্যাটে রাতের আঁধারে চুপি চুপি কে কি করে, না করে এইসব কিছু বোঝা যায় না।শুনলাম তোমার মাকেও এইসব নানান কথা শুনতে হয়।কেমন ছেলে তুমি!তোমার মা যে এইসব ফালতু কথার জন্যে অপদস্ত হচ্ছে,তোমার কি সেদিকে নজর আছে?তুমি থাকো তোমার ইগো নিয়ে। আর তোমার বয়োজ্যেষ্ঠ বাবা মা তোমার জন্যে কষ্ট পাক।তোমার মতো স্বার্থপর ছেলে…”
–“চুপ!”
নূরকে আর কিছু বলতে দিলো না জোহান।সেদিনের মতো আজও গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লো।নূরের মুখ এখনো চেপে আছে জোহান।নূর জোহানের বুকে দুইটা চাপড় দিলো,
–“মুখ ছাড়ো।”
জোহান নূরের মুখ না ছেড়ে তাকে আরো কাছে টেনে বললো,
–“কখনো না।না তোর মুখ ছাড়বো আমি, না তোকে ছাড়বো!”
জোহানের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।
নূরের সরু ভ্রু জোড়া সংকুচিত হয়ে এলো,
–“গাদ্দার।”
–“শুক্রবার যেনো তোকে আমি প্রোগ্রামে দেখি।”
–“জীবনেও না।আমি মরে গেলেও যাবো না।”
–“কেনো?কোনো ছেলের সাথে মিটিং ফিক্স করে রেখেছিস?”
–“সবাইকে নিজের মতো ভেবো না,জোহান ভাই।”
নূরের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট।
–“নিজেকে কি ভাববো আমি, সেটা আমার ব্যাপার।কিন্তু তুই সেই তিন বছর আগের মিথ্যুক ই রয়ে গিয়েছিস।সত্যি করে বল,কোন ছেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবি?”
জোহান শয়তানি হাসি দিয়ে বললো।
–“আমার চিন্তা না করে তোমার বাবা মায়ের চিন্তা করো।ছেলের অপকর্মের জন্যে তাদের এই বয়সে কতো নাজেহাল হচ্ছে।”
–“আরেকটা বাজে কথা বলবি তো,আসল অপকর্ম তোকে আমি দেখিয়ে দিবো এখনই।”
কথাটা বলে নূরকে জোহান ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।সোফায় রাখা সুন্দর কারুকাজ করা হেলমেট তুলে নিয়ে ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো জোহান।তার ফর্সা মুখের লাল আভা দেখে নূর বুঝতে পেরেছে, নূরের বলা কথা জোহানের বেশ গায়ে লেগেছে।
–“কথায় আছে,ইমোশনাল কথায় কাজ না হলে সরাসরি অ্যাকশন নিতে হয় সেই কাজের জন্য। সবাই সবকিছু সহ্য করলেও, নিজের চরিত্রের উপর মিথ্যা দাগ, আর সেই দাগের জন্য তার মা-বাবার অপমানের কথা কেউ সহ্য করে নিতে পারে না।দেখি তিতামুখী তুমি এইবার কিভাবে একা ফ্ল্যাটে থাকো।আন্টি,এইবার হয়তো তোমার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে।কি এক ছেলেকে ভালোবাসলাম আমি!যাকে আজ পর্যন্ত বলতেই পারলাম না,তাকে আমি ভালোবাসি।উল্টো আমাদের দুইজনের মধ্যেই বাঘে মোষে যুদ্ধ লেগে থাকে।কি আছে কপালে জানিনা আমি।কিন্তু আমি আমার বাকি জীবনের জন্যে তোমাকেই চাই,জনাব তিতামুখী।”
জোহান নিজের ফ্ল্যাটে এসেছে।নূরের বলা সব কথা তার কানে বাজছে।জোহান আজ নিজের বাবা মায়ের সাথে করা কাজকর্মের কারণে অনুশোচনা করছে।বিছানায় গা এলিয়ে জোহান চোখ বন্ধ করলো,
–“মা বাবার প্রতি রাগটা আমার ভাঙতে হলেও, নূরিয়া নূর;তোমার প্রতি আমার রাগটা এতো সহজে ভাঙবে না।কিন্তু আর বেশিদিন এই রাগের শিকার করবো না আমি তোমায়।শীগ্রই তীব্র প্রতিহিংসায় দগ্ধ করে আমার প্রতিশোধের ইতি ঘটাবো আমি।ব্যাপারটা হবে কষ্টদায়ক।ঠিক যেমন কষ্ট আমি অনুভব করেছি তিন বছর আগে।এরপর হবে শুধু সুখ আর সুখ।তোমার আর আমার ভালোবাসার মিলনের সুখ।”
জোহান নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো।তার মনে চলছে নূরের জন্যে এক বিশাল পরিকল্পনা।
অন্যদিকে নূর অন্য পরিকল্পনায় ব্যস্ত।নিশিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্যে প্রাণপণে মিথ্যা বলে যাচ্ছে সে।নূরের ধারণা নিশির মুখে সব সত্যি শুনলে, তবেই জোহান নূরের প্রতি সব ভুল ধারণা দূর করতে পারবে।কিন্তু,নিশি অনড়।সে কিছুতেই আসতে চাইছে না।যার কারণে নূর সবচেয়ে বড় মিথ্যা বলে বসলো,
–“আরে জোহান ভাই নিজেই আমাকে বলেছে তোমাকে দেখতে চায় সে।তিন বছর আগের ঘটনা মিটমাট করে, সে তোমাকে পেতে চায়।যতো দ্রুত সম্ভব তুমি এসে জোহান ভাইকে বুঝে নাও।”
–“জানিস,আমিও সেই কাজের জন্যে অনেক লজ্জিত। জোহানকে ভালোবাসি বলে সেদিন তাকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম।ভেবেছি আমার কাজে সে আমার উপর কাবু হয়ে যাবে।কিন্তু সব হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। জোহানের ভালোবাসার কারণে আমি আজ পর্যন্ত অন্য কাউকে নিজের মন দিতে পারিনি।জোহান আর আমার ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে আমি আসবো বাংলাদেশে শীঘ্রই।”
নূর বড্ড খুশি হলো।নিশির সাথে কথা বলা শেষে নূর বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো,
–“আয় খলনায়িকা,আয়।তোকে আনতেই তো এতো মিথ্যা।একবার তোর মুখ থেকে সব সত্যি শুনবে জোহান ভাই,এরপর আমার প্রতি তার সব রাগ ফুস হয়ে যাবে।তখন আমার মনের কথা বলতে আমি এক মুহূর্তও দেরী করবো না আমার তিতামুখীকে।আল্লাহ্,
এইবার যেনো সব ঠিক হয়ে যায়।”
নূরের নিয়ত একদম পবিত্র আর জোহানের পরিকল্পনা প্রতিহিংসায় মাখা।এই দুইজনের মধ্যে কার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে চলেছে?
চলবে…..