#প্রতিহিংসার_অনুরক্তি-০২
লেখিকা: সালসাবিল সারা
রৌদ্রোজ্জ্বল দিন।গ্রীষ্মের প্রখর সূর্যের উত্তাপ যেনো সকলকেই ভস্ম করে দিচ্ছে।এই তীব্র রৌদ্রের ছোঁয়াকে উপেক্ষা করতে মাথার উপর ছাতা ধরে হেঁটে যাচ্ছে নূর।তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হচ্ছে যা একটু পর পর সে নিজের হাতের টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলছে।বাস স্ট্যান্ডের ছাউনির নিচে আসতেই ছাতা বটে ব্যাগে রাখলো সে।চোখ জোড়া তার প্রত্যাশিত বাসের অপেক্ষায় রাস্তার দিকে চেয়ে আছে।এই বাসের গন্তব্য তার ভার্সিটিতে গিয়ে শেষ হয়।তার মস্তিষ্ক বাসের কথা চিন্তা করলেও সে ভেবে যাচ্ছে অন্য কথা।যে কথা তিন বছর যাবত তাকে পুড়িয়ে মারে সারাক্ষণ।তিন বছর নূরের কাছে বেশ লম্বা সময় বলে মনে হয়।এই তিন বছর আগে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে যা মোটেও ঘটার কথা ছিলো না।নূর তার মনের অনুভূতি জোহানকে জানানোর আগেই ঘটে যায় সেই দুর্ঘটনা।আর নূর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জোহান ভাই।সেদিন অন্যের ভুল কথায় নূরের সহমত পেয়ে জোহানকে সবাই ভুল বুঝেছিল।পূর্বের কথা ভাবতেই নূরের চোখে পানি জমে।সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে নূরের সামনে।কয়েক পলক চোখের পাতা নাড়িয়ে চোখের পানি সামলিয়ে নিলো নূর।বাসের হর্ণের শব্দ শুনে সে অতীতের কথা থেকে ফিরে এলো।বাস স্টপের সামনে বাস থামতেই নূর উঠে পড়লো বাসে। কোণার সিটে বসে গা এলিয়ে দিলো নূর।জোহানকে তার মনের অনুভূতিটা জানানোর কথা মনে আসতেই জোহানের বাজে ব্যবহারের কথা মনে চলে এলো নূরের।এই তিন বছরে জোহান যেনো একেবারে বদলে গেলো। নূরকে যেনো জোহান চোখের বালি মনে করে,এমনটাই নূরের মাথায় চিন্তা আসে।তীব্র গরমে নূরের মুখ জ্বলছে।তাই ব্যাগ থেকে পানি বের করে মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দিলো সে।মোবাইলে ব্যাক কভারে থাকা আয়নায় নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে মুখ মুছতে লাগলো নূর।নূরের মুখের রোদে পোড়াভাব একেবারেই মিইয়ে গেলো এখন।নূরের স্কিন এখন একেবারে দাগহীন আর বেজায় উজ্জ্বল।নিজের মুখে হাত ঘষে দিলো নূর।নিজের সাথে জোহানের আগের বলা কথা ভেবে নূর নিজে নিজেই হেসে উঠলো।নূরের রোদে পোড়া মুখকে দেখে জোহান সবসময়ই নূরকে ক্ষেপিয়ে তুলতো।সেই সময় থেকে জোহান সবসময় নূরকে নিজের অনুরক্তি বলতো।তখন নূরের মাথায় এইসব কিছুর অর্থ বুঝতো না।যখন থেকে এইসবের অর্থ বুঝতে শিখেছে সে,তখনই জোহানের প্রতি নিজের অনুভূতিটা বুঝতে পারলো নূর।কিন্তু,আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে কিছুই বলেনি নূর জোহানকে।এর আগেই সবটা অদ্ভুতভাবে উলোট পালোট হয়ে গেলো নূর আর জোহানের জীবনে।বাসের জানালা দিয়ে নূর বাইরে তাকালো।প্রকৃতির পানে চেয়ে নূর আপনমনে ভাবতে লাগলো,
–“আমাদের জীবনের সবটা কেনো এমন এলোমেলো হয়ে গেলো,জোহান ভাই!কেনো তুমি এতো কঠোর হয়ে গিয়েছো আমার উপর!একবার কি সেই ভুলের জন্যে আমাকে ক্ষমা করা যায় না?তুমি আমার মনে যেই অনুভূতির সৃষ্টি করেছো,সেই অনুভূতির জায়গা আজ পর্যন্ত কেউ দখল করতে পারেনি।আমার এই অনুরক্তির অনুভূতি শুধুমাত্র তোমার জন্যেই।”
নূর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।নূরের স্মৃতির পাতায় এখন শুধু পূর্বের জোহানের হাসিমাখা চেহারা ঘুরছে।যার সেই তীব্র হাসি নূর প্রচন্ড বাজে ভাবে মিস করে।
————
বাস থেকে নামতেই নূর পুনরায় ছাতা খুললো মাথার উপর।গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে সে চারদিক।উদ্দেশ্য তার জোহানকে দেখা।নূর এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।এই দুই বছর যাবত কিছু বিশেষ দিন ছাড়া নূর প্রত্যেকদিনই জোহানকে দেখেছে এই ভার্সিটিতে,
কয়েকজন ছেলের সাথে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বসে থাকতে।হয় সে জোহানকে ছুটির সময় দেখে নাহয় ভার্সিটি শুরু হওয়ার পূর্বে দেখে।মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে নূরের সাথে,যার কারণে সে জোহানের তিক্ততার শিকার হয়।জোহান সবার সামনে একরকম স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও,নূর জানে একা অবস্থায় জোহান নূরের অবস্থা খারাপ করবে।ঠিকই হয় তাই!সেদিনের পর থেকে জোহান যেনো নূরের উপর বেশ কড়াভাবে নিজেকে পেশ করে।জোহানের এমন ব্যবহার নূরের বেশ খারাপ লাগে।কিন্তু,আজ পর্যন্ত নূর কখনোই এই ব্যাপারে জোহানের সাথে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।একটু দূরে এগিয়ে আসতেই খট করে একজন নূরের হাত চেপে ধরলো।নূর চমকিয়ে পাশ ফিরতেই দেখলো তার বান্ধুবি তনয়া দাঁত কেলিয়ে হাসছে।নূর তনয়ার মাথায় হালকা চড় দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“এইভাবে কেউ করে!ভয় পেয়েছিলাম।”
–“ইসস,কিসের ভয়? একজন তো থাকে তোর জন্যে ভার্সিটিতে।আর সে না থাকলে তার বদলে অন্যরা তো থাকে তোকে দেখে রেখে তাকে খবর জানানোর!”
তনয়া হেসে জবাব দিলো।
–“এই চুপ কর তো।আমার জন্যে কেউ নেই।আমার এমনিও কাউকে লাগবে না।কে কি করে না করে,আমার এইসব জানার কথা না।তাই তুইও চুপ থাক।”
কথাগুলো বলার সময় নূর নিজের হাত মুঠ করে নিলো। মিথ্যা বলতে গেলে নূর সদা এই কাজ করে।তবে এই বিষয়টা তনয়ার চোখে এলো না।নাহলে সে ঠিকই বুঝে নিতো,নূর এখন মিথ্যা বলছে।নূর ক্ষেপেছে দেখে তনয়া চুপ করে গেলো।নূরের অপ্রত্যাশিত নজর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষকেই খুঁজে যাচ্ছে।কিন্তু এখনো সে নূরের নজরের ত্রিসীমানায় আসছে না।কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তনয়া নূরের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো সামনে এগিয়ে যাওয়া থেকে।নূর মুখ কুঁচকে তনয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
–“আরে কি সমস্যা তোর?”
তনয়া আঙ্গুলের ইশারা করলো সামনের দিকে।নূর তার আঙ্গুল অনুসরণ করতেই সামনের দিকে তাকালো।জোহান বসে আছে তার বন্ধু শালু আর অনিকে নিয়ে।তারা বসলো ভার্সিটিতে অবস্থিত ছোট হোটেলের বাহিরে থাকা চেয়ারে।জোহান নিজ মনে সবার সাথে কথা বলছে।নূর থমকে গেলো জোহানকে দেখে।পূর্বের ন্যায় নূরের বুকটা বেশ ধরফর করছে জোহানকে দেখে।মাথা ঘুরিয়ে জোহান পাশ ফিরতেই নূরের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলো।জোহানের মুখে লেগে থাকা কিঞ্চিৎ হাসিটাও যেনো উদাও হয়ে গেলো নূরকে দেখে।নূরের বেশ পীড়া অনুভব হলো মনে।জোহান নূরকে কতো ঘৃণা করে এটা নূরের চেয়ে ভালো কেউ বুঝে না।নূর মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো তনয়ার হাত ধরে।নূর কিছু না বলাতে তনয়া আবারও তাকে বলে উঠলো,
—“আহহ,তোর প্রেমিক পুরুষ তো হাজির হয়েছে ভার্সিটিতে।নিশ্চয় তোকে দেখতে আসে রোজ।কি ঝাকানাকা তোর প্রেমিক পুরুষ!দেখলেই কেমন যেনো প্রেম প্রেম পায়।তুই যদি উনার…!”
–“কি আমার? হ্যাঁ?আমার কি?মুখে যা আসে তাই বলবি না।সে এইখানে কেনো আসে সেটা ওই জানে।আমাদের ভার্সিটিতে বহিরাগত অনেকেই আসে আড্ডা দিতে।সেও হয়তো তাদের মাঝে একজন!আর এতো ভালো লাগলে তাকে বিয়ে কর তুই, যা।”
নূর রেগে গেলো।
–“আরে যাহ!আমি কেনো উনাকে বিয়ে করবো?উনাকে বিয়ে করবি তুই।তুই যেমন উনার কথা ভাবিস তেমনি উনিও তোর কথা ভাবে।নাহলে কি কেউ প্রত্যেকদিন কোনো কাজ ছাড়া এই ভার্সিটিতে আসবে?দেখিসই তো,তোকে দেখলে কিভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে উনি।তাই…”
তনয়াকে বলতে না দিয়ে নূর বলে উঠলো,
–“হ্যাঁ,অনেক জানিস তুই।কখনো দেখেছিস সে আমার সাথে দুই অক্ষর মিঠা কথা বলেছে?এই জোহান ভাই একটা তিতামুখী মানুষ।”
কথাগুলো বলে নূর মাথা ঘুরিয়ে ফের তাকালো পেছনে।দূর থেকেই নূর আন্দাজ করতে পারছে জোহান তার দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।নূর মাথা সোজা করে সামনের দিকে তাকালো।
জোহানের কালো রঙের শার্টের উপর তার সুন্দর গায়ের রং,গঠন সবই নূরকে দূর থেকেই আকর্ষন করছে।নূর মুখে যায় বলুক না কেনো,এই জোহান ছেলেটাতেই নূরের সব ভালোলাগা আর ভালোবাসা বদ্ধ আছে।নূরের বুক চিড়ে আফসোসের নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।নূর জানেনা,নিজের এই ভালোলাগার কথা নূর আদৌ তার তিতামুখী জোহান ভাইকে প্রকাশ করতে পারবে কিনা!কয়েক বার চোখের পাতা নাড়িয়ে নূর তার চোখের পানি আড়াল করে নিলো।তনয়ার সহিত নূর ধীরপায়ে প্রবেশ করলো ভার্সিটির বিল্ডিং এ।
.
জোহানের মন খুশি হলো।যখনই সে নূরকে দেখে তার মন যতোই খারাপ থাকুক না কেনো,একেবারেই সেই খারাপ মন ভালো হয়ে যায়।কিন্তু জোহান নিজের হাসিমুখ বাহিরে প্রকাশ করে না।নূরের সামনে তো একেবারেই না।জোহান চারদিকে চোখ বুলিয়ে কিছু খুঁজে যাচ্ছে।তার চোখে সেই জিনিসটি পড়লে জোহান শালু আর অনির উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোরা সামনে যা।আমি আসছি।”
–“আমরা গেইটের বাইরে পার্কিং এ যাচ্ছি।”
শালু জবাব দিলো।
–“ওকে।”
জোহান কথাটা বলতেই শালু আর অনি হাঁটতে লাগলো গেইটের দিকে।
জোহান মোবাইল টিপে একজনকে ফোন করে আগের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।দূর থেকে সেই মানুষটির কাছে আসার দৃশ্য শান্ত চোখে চেয়ে রইলো জোহান।
দুই মিনিটের মাথায় জোহানের সামনে এসে থামলো তার এক পরিচিত ছেলে,যাকে সে ভার্সিটিতে নূরের উপর নজর রাখার জন্যে ঠিক করে রেখেছে।আগে অন্য এক ছেলে ছিলো এই কাজের জন্যে।কিন্তু ছেলেটি নিজেই নূরের সাথে অসভ্যতামো করায় জোহান ছেলেটিকে পিটিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলো।আজ পর্যন্ত ছেলেটির বাম পায়ের চিকিৎসা চলছে এবং সে এখনো হাসপাতালে আছে।এইসব সবই নূরের অজানা।
দেখতে ভদ্র ছেলেটি জোহানের সামনে এসে হালকা ঝুঁকে হাঁপিয়ে বলে উঠলো,
–“সরি ভাই,আগে খেয়াল করিনি আপনাকে।”
জোহান নিজের কপালে পড়ে থাকা চুল আঙ্গুলের সাহায্যে উপরের দিকে ঠেলে ছেলেটিকে জবাব দিলো,
–“সমস্যা নেই।কোনো খবর আছে?”
ছেলেটি হাত দিয়ে নিজেকে বাতাস করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
–“নাহ,আপুটা খুবই ভদ্র।কোনো ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে কখনোই আড্ডা দিতে দেখিনি।”
–“আরে গাধা,এটা জিজ্ঞেস করিনি।জিজ্ঞেস করেছি,
ওকে কেউ ডিস্টার্ব করে? ও কেমন মেয়ে আমি ভালো করেই জানি।”
এক হাত দেখিয়ে জোহান প্রশ্ন করলো ছেলেটিকে।
–“যতটুকু আমার দৃষ্টিতে পড়েছে,আপুটা ভদ্র আর সুন্দরী হওয়ায় কয়েকজন পিছন ফিরে দেখে উনাকে বারবার।কিন্তু কখনো বড় কোনো কাহিনী ঘটতে দেখিনি।আর বড় কাহিনী হওয়ার ইঙ্গিত বা আভাস পেলে এই পমেল আপনাকে আগেই খবর দিয়ে দিবে।”
জোহানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো।পমেলের এই কথা যেনো হজম হলো না জোহানের।সে হাত মুঠ করে পমেলকে আবারও বললো,
–“কোন ছেলে?”
জোহানের ক্রোধযুক্ত কণ্ঠে পমেল হচকিয়ে গেলো।জোহান তার ভাইয়ের বন্ধু।তার ভাইয়ের মুখে জোহানের কথা অনেক শুনেছে। এও শুনেছে,
ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে মারপিটে বা কোনো আন্দোলনে জোহানের ভূমিকা থাকতো সবচেয়ে বেশি।তাই জোহানের এমন ক্রোধ এই মুহূর্তে পমেলের কাছে ভয়ংকর লাগছে।পমেল মৃদু হেসে জোহানকে বলে উঠলো,
–“সিরিয়াস মামলা না,জোহান ভাই।অনেক ছেলেই তো এমনটা করেছে।এদের কারো চেহারা আমার মনে নেই।তবে,তারা বেশি ঝামেলার বলে মনে হয় না আমার।কারণ,অতিরিক্ত ঝামেলার হলে অনেক আগেই তারা ঝামেলা করতো।”
–“আহ,রাখ তোর ঝামেলা ঝামেলার খেলা।তোর ভাবীর উপর নজর রাখবি।ওর কিছু হলে একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না।”
জোহান কথাটা বলে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলো।
এইদিকে পমেল যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে বুকে হাত দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো,
–“মিস নূরকে আপু ডাকবো নাকি ভাবী!আমি তো আপু ডাকতাম,কিন্তু এই জোহান ভাই বললো; ভাবীর দিকে নজর রাখতে।তাহলে!ধুর পমেল একটা ডাকলেই চলবে।আমার এখন মিশন হলো এই আপুটার সরি ভাবীটার..উফ,নূর ভাবীপার খেয়াল রাখা।”
নিজের মনের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে পমেল নিজের কাজে মন দিলো।
জোহানকে দেখতেই শালু আর অনি দুইজন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করা বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জোহান তাদের দেখে ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি সমস্যা?ফিসফিস করছিস কেনো?”
অনি কিছু বলতে নিলে শালু তার মুখ চেপে ধরে তাকে বলে উঠলো,
–“কিছু না।আমরা বাইকে যাচ্ছি।তুই তোর গাড়ি নিয়ে আয়।”
শালু পা বাড়াতে নিলে জোহান গর্জন করে বলতে লাগলো,
–“অতিরিক্ত কিছুই আমার ভালো লাগে না।বলবি কি হয়েছে?”
–“ও.. ঐ কিছু না।আসলে শালু ভাবছিলো তুই যদি নূরকে বিয়ে না করিস তাহলে সেই বিয়ে করে নিবে নূরকে।”
অনির কথাটা কানে যেতেই জোহান খুব জোরে লাথি দিলো শালুর বাইকে। শালুর কলার চেপে ধরে জোহান নিজের মুখোমুখি করলো শালুকে,
–“বন্ধু বন্ধুর মতো থাকবি।আমার নূরের দিকে তাকানোর দুঃসাহস করেছিস কিভাবে তুই?শালু তুই তোর লিমিট এর মধ্যে থাকবি,নাহলে…”
জোহান নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শালুর নাক বরাবর হাত আনতেই অনি জোহানের হাত ধরে ফেলে,
–“আরে..এমন করছিস কেনো তুই?শালু শুধু মজা করছিলো।আমরা জানি তুই তাকে কতো চাস নিজের জীবনে।কিন্তু তুই যে নূরকে কষ্ট দিস,এটা সত্যি যে তোর এই কাজ না আমার ভালো লাগে আর না শালুর।তাই তোকে..”
–“চুপ কর।এইসব মজার কিছু না।আমার নুড়ি পাথর শুধুই আমার।সে শুধুমাত্র তার ভুলের শাস্তি পাচ্ছে।আর ভবিষ্যতেও পাবে,যতদিন না আমার অতীত আমি ভুলতে পারবো।তবে কিভাবে তাকে ভালোবাসতে হয়,এটা আমার জানলেই চলবে।তোদের নূরের প্রতি এতো চিন্তার দরকার নেই।অফিসে চল।কাজে মন দে।”
জোহান গাড়িতে উঠে পড়লো।মিনিটের মধ্যেই তার প্রাইভেট কার দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগলো।সবকিছু মিলিয়ে জোহানের ক্রোধ এখন সাত আসমানে উঠেছে।
–“তোকে মানা করেছিলাম এইসব করতে।দিলি তো ওর মাথা খারাপ করে!তুই জানিস নূরকে সেই অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে জোহান।এই ভুল আর করিস না।”
অনির চিন্তিত কণ্ঠ।
হেলমেট পড়তে পড়তে শালু হেসে অনিকে জবাব দিলো,
–“শালা খুব ভালোবেসে নূরকে।তাদের ঝামেলা না হলে নিশ্চিত এখন সে নূরের জামাই হিসেবে থাকতো।কেনো যে সে দিনটা এসেছিলো তাদের জীবনে! ঐ মা* মাইয়্যা আমাদের দয়ালু বন্ধুকে পাষাণে পরিণত করেছে।আর এই কারণে বেচারা নূর প্রতিনিয়তই জোহানের কটূক্তির শিকার হয়। ঐ মাইয়্যা আমার সামনে আসলে চাকার নিচে ফেলতাম এরে।”
–“জোহান এর প্রতিহিংসার অনুরক্তি হলো নূর।ওদের এই ভালোবাসা আমাদের মাথায় ঢুকবে না।ওদের মধ্যে সব ভালো হোক আমি এটাই চাই।বাদ বাকি আল্লাহ্ ভরসা।তুই ওদের নিয়ে আর কখনো ফাজলামো করবি না।আর ঐ মা* মাইয়্যা তো সেই ঘটনার পর ওদের সামনে আসেইনি।জোহান এরে পেলে একেবারে পিষে ফেলবে।এখন জলদি বাইক স্টার্ট দে।জোহান বস নাহলে সবার সামনেই আমাদের ঝাড়বে।”
অনির শান্ত জবাব। অতঃপর দুইজনই অফিসের পথে রওনা দিলো।
———–
জোহান ক্লান্ত শরীরে এসেছে নূরদের বাড়িতে।নূরের বাবা অসুস্থ থাকায় দুই বছর যাবত কাজে যেতে পারছে না।তাই নূরের বাড়ির খরচের জন্যে জোহান বেশ ভালো অঙ্কের টাকা দিয়ে আসে নূরের মাকে।নূরের পরিবার এটা নিতে অস্বীকার করলে জোহান বেশ রেগে যায়।আর এই রাগের কাছে হার মেনে নূরের মা জহুরা এই টাকা নেয়। জোহানের বাবাও সবসময় নূরের পরিবারকে বেশ সহযোগিতা করে সবদিক দিয়ে।জোহান নূরদের বাড়িতে গিয়ে দেখে উঠানে তার বাবার গাড়ি।তাই জোহান ভিতরে না ঢুকে বাহির থেকেই জারাকে ডেকে উঠলো,
–“জারা!বেবি,ভাইয়া এসেছি।”
জারা জোহানের ডাক শুনে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এলো।হাতের কিছু নাস্তা সে জারার দিকে এগিয়ে দিতেই জারা খুশি মনে সেগুলো হাতে নিলো।আনোয়ারা আর জহুরা দুইজন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।জহুরা বেশ আহত সুরে জোহানকে বললো,
–“এইসবের কি দরকার ছিলো বাবা!”
–“আমি কি তোমার ছেলে না আন্টি?আমাকে কি পর মনে হয়?”
জহুরা দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে তাকে জবাব দিলো,
–“অবশ্যই ছেলে তুমি আমার।আসো,ফ্যানের নিচে বসবে। যা গরম পড়ছে বাহিরে!”
জোহান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
–“নাহ,আমার কাজ আছে।এইদিকে যাচ্ছিলাম ভাবলাম তোমাকে এগুলো দিয়ে যায়।”
জোহান পকেট থেকে খাম বের করে খামটি জহুরার হাতে ধরিয়ে দিলো।জহুরা সংকোচ মুখে খামটি নিলো জোহান থেকে।এরপর অনুনয়ের সুরে জোহানকে বললো,
–“এখনই বাসায় আসবে তুমি।নাহলে এইসব আমি আর নিবো না।তোমার আংকেল দেখতে চাইছে তোমাকে।তাছাড়া তোমার মা অসুস্থ।মায়ের সাথে একটু কথা বলো।”
জহুরা কথাগুলো বলে জারাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।জোহান শান্ত চোখে তার মাকে প্রশ্ন করলো,
–“ওষুধ খাও না কেনো?”
–“যে ছেলে মায়ের থেকে দূরে থাকে,তাকে আমি কি উত্তর দিবো?আমি ভালো আছি।”
আনোয়ারা বললো।
–“দেখছি কতো ভালো আছো।ওষুধ খাবে ঠিক মতো।”
জোহান বাহিরে থাকা রুমে বসতে নিলে আনোয়ারা আবারও বলে উঠলো,
–“বাসায় কবে আসবি?”
–“কেনো আসবো?আবারও আমাকে সবার সামনে অপমান করার জন্যে?অন্য মেয়ের কথায় আমাকে বাবার চড় খাওয়ার জন্যে?নূর না বুঝে অন্য কারো কথায় আমাকে দোষী বানিয়ে দেওয়ার জন্যে?যাবো কেনো আমি ঐ বাড়িতে?”
জোহান চোখ গরম করে প্রশ্ন করলো তার মাকে।
–“বুঝতেই যখন পারছিস সব ভুল ছিলো,নূর মেয়েটাও না বুঝে ভুল করেছে,তাহলে কিসের রাগ এতো তোর?মেয়েটাকে কেনো এইভাবে কষ্ট দিস তুই?”
–“কারণ, নূর আমাকে অবিশ্বাস করেছিলো।ওর উচিত ছিলো আমাকে বুঝা, আমার পাশে দাঁড়ানো।কিন্তু সে কি করলো?না বুঝে না শুনে আমার দিকে আঙুল তুলেছে।ওর ভুল এতটুকুই আমাকে সে বিশ্বাস করেনি।আর না বিশ্বাস করেছিলে তোমরা।সেই মেয়ে আমার সামনে যেদিন আসবে তার শেষ দিন হবে এই দুনিয়ায়,যার জন্যে আমার সাথে আমার ভালোবাসার সবার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে।বাসায় তখনই ফিরবো যখন আমি অতীত ভুলতে পারবো।এর আগে পার্মানেন্টলি আমি বাড়ি ফিরবো না।তুমি তো অসুস্থতার বাহানায় আমাকে কয়েক ঘণ্টা রেখে দাও সেই বাড়িতে।বিশ্বাস করো মা, ঐ বাড়িতে ঢুকলে সেদিনের সব কথা আমার মাথায় আসে।আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ হয় না।”
আনোয়ারা আঁচলে মুখ চেপে ধরলো।চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই সেখান থেকে প্রস্থান করলেন তিনি।কারণ,ছেলের সাথে সেদিন মোটেও ভালো করেনি সে; এটা আনোয়ারা বেশ জানে।নিজের ছেলের জিদ সম্পর্কে জেনেও সেদিনের করা তাদের ভুলের জন্যে আজ পর্যন্ত ছেলের জিদ ভাঙতে না পারায় ভেতরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো আনোয়ারা।
নূর ভার্সিটি শেষে তার এলাকায় দুটো টিউশন করায়।সেই টিউশন থেকে তার আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো।উঠানে জোহান আর তার বাবার গাড়ি দেখে একটু চমকে গেলো সে।সেদিক থেকে নজর সরিয়ে উঠানের একপাশে থাকা পানির কল থেকে হাত মুখ ধুয়ে নিলো সে। হাত থেকে পানি ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে কদম ফেলতেই থেমে গেলো নূর।জোহান দ্রুত ঘর থেকে বের হচ্ছিলো।এইভাবে জোহানকে দেখে নূরের সেই অস্থিরতা জেঁকে ধরলো তাকে।জোহান দ্রুত এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো।নূরের অস্তিত্ব টের পেয়ে সে নূরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই জোহানের নজর থমকে গেলো নূরের পানিতে লেপ্টে থাকা মুখে।অস্থিরতায় নূর উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরতেই জোহানের ভেতর নড়ে উঠলো। নূরদের বাড়ির সামনে ছোট লাইট লাগানো আছে।সেটা থেকে বিদ্যমান আলোর ছটা নূরের উজ্জ্বল মুখকে এই সন্ধ্যার আবছা আলোয় আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।জোহানের চোখে ঘোর লেগে যায়।সে দুই নূরের দিকে দু কদম এগিয়ে যেতেই নূর দুই কদম পিছিয়ে গেলো। নূর আতঙ্কিত হয়ে নিজের ওড়না শক্ত করে ধরলো।জোহান যেনো নিজের মাঝে নেই।সে নূরের দিকে আরেকটু এগিয়ে যেতেই নূর তাকে বলে উঠলো,
–“কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?”
জোহান যেনো চমকে উঠলো নূরের কথায়।সে এইবার ঘোরমুক্ত হলো।মুহূর্তেই অনিচ্ছাকৃত নিজের মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে সে নূরকে হিংসাত্মক কণ্ঠে বলল,
–“সারাদিনের করা পাপ কি এই কলের পানিতে ধুয়ে যাবে?সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক উপভোগ করেছিস তাই না?দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক টায়ার্ড তুই।কেমন যেনো ঘৃণা লাগছে তোকে দেখতে।”
মুহূর্তেই নূরের চোখ ভরে এলো।জোহানের এমন গা নাড়ানো হিংসাত্মক কথা সবসময় শুনে সে,যখন তার সাথে জোহানের দেখা হয়।নূর ছলছল দৃষ্টিতে জোহানের দিকে তাকাতেই জোহানের বুকটা কেঁপে উঠলো অনুশোচনায়। তাও সে নূরকে আবারও বললো,
–“কি মিথ্যা কথা বলবি এটাই ভাবছিস তাই না? হাহ,
তোর মতো মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথা বানাতে এতো সময় লাগে বুঝি?স্ট্রেঞ্জ!”
জোহান চলে যেতে নিলে নূর এইবার নিজের মুখ খুললো,
–“আমি মিথ্যা বলিনি কখনো।আমাকে প্রমাণের সাথে যা দেখানো হয়েছিল ছোট মেয়ে হিসেবে আমি সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম আর সেটাই বলেছিলাম সবাইকে।এখানে আমার কোনো দোষ নেই।আর মিথ্যা কথা তো বলো তুমি।আমার নামে আগেও মিথ্যা বলতে এখনো বলো।শুধু পার্থক্য, আগে আমাকে নিজের অনুরক্তি বলে বোকা বানাতে আর এখন আমার চরিত্রের ব্যাপারে নিজের মনে মিথ্যা খেয়াল তৈরি করে আমাকে অপমান করো।তুমি সত্যি একটা তিতামুখী। আক্রোশে তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে।তুমি…”
জোহান রেগে ফেটে পড়লো।দেরী না করেই সে নূরের দুই বাহু আকড়ে ধরলো,
–“একদম চুপ।আমি কখনো মিথ্যা বলি না।আর অনুরক্তি?হাহাহা! নূরিয়া নূর,তুই আমার জন্যে শুধুমাত্র আমার প্রতিহিংসা।আর কিছুই না। অনুরক্তির অনুভূতি কবেই পালিয়েছে তোর আসল রূপ দেখে। মিথ্যুক মেয়ে একটা!”
জোহান খুব জোরে নূরের বাহু চেপে ধরায় নূর নিজের কান্না দমাতে পারলো না।সে হুহু করে কেঁদে উঠলো,
–“হাত ছাড়ো।ব্যাথা পাচ্ছি আমি।আর আমি সত্যি বলছি সেদিন আমি মিথ্যা বলিনি।সেদিন…”
নূরের মুখে ব্যথার কথা শুনে জোহান থমকে গেলো।দ্রুত সে নূরের বাহু ছেড়ে দিয়ে নূরের চুল হালকা টেনে তাকে জবাব দিলো,
–“সেদিনের কথার…গুষ্টি কিলাই।”
নূরকে ছেড়ে জোহান নিজের গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছে।লুকিং গ্লাসে কান্নারত নূরকে দেখে জোহান বেশ জোরেই ঘুষি দিলো তার গাড়ির স্টিরিং এ।মনে মনে জোহান হাজার কথা বলে যাচ্ছে, যা শুধু একমাত্র জোহানই জানে।
চলবে…..