প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-১০

প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-১০
#ফাবিহা_নওশীন

||

রুহানি ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকল। রনকের পাশে ধপ করে বসতেই রনক রুহানির দিকে চেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুহানি রনকের চমকে উঠা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

ব্যাগ রেখে বলল,
“কি রে ভূত দেখেছিস? ভয় পেয়েছিস? বুকে থু থু দে।”

রনক এর আগে যখনই ভয় পেয়ে যেত বুকে থু থু দিত। তাই রুহানি আজ ওকে বুকে থু থু দেওয়ার কথা বলল।

রনক মুচকি হেসে বলল,
“তুমি তাহলে এসেছো। যাক সুবুদ্ধি হয়েছে।”

রুহানি মুখ বাকিয়ে বলল,
“তুই তো পন্ডিত। বাকি সবাই বোকা।”

রুহানি বইপত্র বের করে বলল, “গ্যাপগুলো পূরণ করে দিস। পাশটা তো করতে হবে। তোর কাছে তো আর টিউশন পড়তে পারব না, টাকা কই।”

রনক ওর কথা শুনে বিরক্ত হলো তারপর বলল,
“বন্ধুত্বের মাঝে টাকা পয়সার কথা কেন আসছে? আমি আগের মতোই তোমাকে পড়াব।”

রুহানি বলল,”ওকে তবে সেটা ভার্সিটিতেই। আর হ্যাঁ শোন নুশাকে বলেছি তোর জন্য টিউশন দেখতে। ওর অনেক পরিচিত জন আছে, কাজিন আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।”

রনক অবাক হয়ে রুহানির দিকে তাকাল। তারপর আলতো হাসল। রুহানি এই অবস্থায়ও ওর কথা ভাবছে। কি অদ্ভুত মেয়ে!

রুহানির বন্ধুরা ওদের কথা বলতে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কি যেন বলছে।

ব্রেকের সময় রুহানির বন্ধুরা রুহানিকে ঘিরে ধরল। রুহানি ওদের ঘিরে ধরার কারণ বুঝতে পারছে না।
“ঘটনা কি তোদের? এভাবে ঘিরে ধরলি কেন? ভীড় সরা আমার পড়াশোনা আছে।”

রুহানির এক ফ্রেন্ড বলে উঠল,
“রুহানি সত্যি কথা বলত তো ঘটনা কি? এই রনকের সাথে স্যার যেদিন থেকে বসালো তুই আর রুহানি রইলি না। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনা পড়াশোনা করে পাগল। রনকের সাথে চিপকে থাকিস। কি চলছে?”

রুহানি না বুঝতে পেরে কনফিউজড হয়ে বলল,
“কি চলবে?”

ওরা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তারপর বলল,
“প্রেম করছিস না তো?”

রুহানি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। রাগে ওর গা শিরশির করছে।
“পাগল হয়েছিস না-কি? উল্টো পাল্টা কি বলছিস? ও আমার ফ্রেন্ড। এই সম্পর্কটাকেও ছাড় দিবি না? বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কের তামাশা উড়াচ্ছিস? ছিহ! আর এছাড়া আমার বিয়ে ঠিক জানিস না তোরা?”
শেষের লাইন বলে রুহানি থমকে গেল। ওর বিয়ে ঠিক! বিয়ে! আদৌ কি বিয়ে করবে?

রুহানি ব্যাগ নিয়ে হনহন করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। ওর বন্ধুরা চুপসে গেল। রুহানির সাথে এই মজাটা করা যে একদম ঠিক হয় নি বুঝতে পারছে আর সরি ফিল করছে।

.

রুহানি পুকুর পাড়ে সিড়িতে বই খুলে বসেছে। পাশেই রনক। রনক ওকে আগের পড়া গুলো দেখিয়ে দিচ্ছে।
“রুহানি এই বইয়ে কঠিন করে দেওয়া। আমি লাইব্রেরি থেকে অন্য বই নিয়ে পড়েছি। ওটা একদম ইজি। তুমি বসো আমি বইটা নিয়ে আসি।”

রুহানি রনককে থামিয়ে বলল,
“তুই বস আমি নিয়ে আসছি। একটু হাওয়া খেয়ে আসি।”

রুহানি বইয়ের নাম জেনে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। রনক পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকাল।
ফালাক লাইব্রেরীর শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বই নেড়েচেড়ে দেখছে। রুহানি লাইব্রেরীতে গিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ও ফালাকের চোখে পড়তেই আড়চোখে তাকাল। রুহানি শেলফে কি একটা খুঁজছে। কিছু সময় পর রুহানি শেলফ থেকে বই খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে আবারো নিঃশব্দে বাইরে চলে গেল। ফালাক রুহানিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। চুপচাপ এলো একটা বই নিল আর চলে গেল? কি করে সম্ভব?
ফালাক শেলফে বই রেখে রুহানির পেছনে পেছনে বেড়িয়ে গেল।

রুহানি বই দিয়ে সূর্যকে ঢাকার চেষ্টা করে হাঁটছে। ফালাক বেশ কিছু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। রুহানি পুকুর পাড়ের কাছে যেতেই ফালাক রনককে বসে থাকতে দেখল। ফালাক দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি গিয়ে রনকের পাশে বসে বই দিয়ে বলল,
“নে তোর বই।”

রনক বই সূচিপত্র দেখছে। রুহানি টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছে টিস্যুটা ফেলে দিল।
রনক পেজ বের করে পড়াতে শুরু করল। রুহানি পূর্ণ মনোযোগ দিল।

ফালাক দূর থেকে রুহানিকে এত মনোযোগী আর স্থির দেখে অবাক হলো। রুহানি পড়াশোনার প্রতি এতটা সিনসিয়ার কবে থেকে হলো? বিষয়টা ফালাককে বেশ ভাবাচ্ছে।

ফালাকের খটকা লাগছে। রুহানি আবার রনকের সাথে প্রেম করছে না তো?
ফালাক কেমন অদৃশ্য এক জ্বলন অনুভব করছে। কেন জ্বলছে বুঝতে পারছে না।

.

রনক আর রুহানি এক সাথে ক্লাসে যাচ্ছে। ব্রেক শেষ। রনক হটাৎ ফালাককে দেখতে পেল। ফালাক তরিঘটি করে কোথাও যাচ্ছে। রনক ফালাককে ডাকল।
“ফালাক ভাই!”

রুহানি রনকের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। ফালাককে কেন ডাকছে? ফালাক পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রনককে দেখল। সাথে রুহানিকে দেখে মুখ ভার করে নিল। তাড়াহুড়োর ভাব দেখিয়ে বলল,
“হ্যা বলো।”

“ধন্যবাদ ভাই। আজকে আপনি ইশার কাজের প্রতিবাদ করেছেন। দেখেছো রুহানি তোমাকে বলেছিলাম না ফালাক ভাই খুব ভালো মানুষ?”

রুহানি মুখ বাকাল। তারপর বলল,
“ভালোর ছিরু। প্রতিবাদ করেছে এখন এওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।”

রুহানির কথা শুনে ফালাক দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল,
“রনক, ওর জায়গায় যে কেউ থাকলেই আমি প্রতিবাদ করতাম। মানবতা বলে কিছু তো আছে। আমি আর সবার মতো অমানবিক, নিষ্ঠুর না। মানুষের প্রতি জুলুম, অবিচার করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। আর তোমার এই বন্ধুর মতো অকৃতজ্ঞ নই। মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শিখে নি। আমি আসছি। আমার কাজ আছে। মানুষের মতো আজাইরা থাকি না।” (রুহানির দিকে তাকিয়ে)

ফালাক রুহানির দিকে আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর আবারো ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল। রুহানি হা করে চোখ বড়বড় করে ওর যাওয়ার দিকে তাকাল। রনক বুঝতে পারল না কোন রাগ ঝেড়ে গেল রুহানির উপর।

রুহানি রনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছিস কত কথা শুনিয়ে গেল? তুই আবার বলিস ভদ্র ছেলে। অসভ্য একটা।”

রনক বলল,
“মনে হয় কাজের প্রেশারে আছে। তাই….”

রুহানি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি এমন কাজ করে যে এত প্রেশার?”

রনক স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আরে উনি অফিস করে রোজ। ভার্সিটির পর বাকি সময় অফিসে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। পড়াশোনা ও কাজের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল।”

“গরিব না-কি? দেখে তো মনে হয় না।”

রুহানির কথা শুনে রনক হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“গরিবরাই শুধু কাজ করে? উনার বাবার বিজনেস। ভাইয়ের বাবা অসুস্থ। তাই একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তার উপর। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিজনেস সামলায়।”

রুহানির সেদিনের পার্টির কথা মনে পড়ল। ফালাককে একটা বিজনেস পার্টিতে দেখেছিল। তাহলে সেদিন সেখানে ওর নিজের কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিল। বাহ! পড়াশোনা করে আবার বিজনেসও সামলায়? আর আমি বাপের টাকা উড়িয়েছি। বিনিময়ে এক ছিঁটা পরিশ্রম করি নি। আজ তার ফল ভোগ করছি।

রুহানি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এতকিছু কি করে জানলি?”

“একদিন আমার সাথে কথা হয়েছিল। সেদিন বলেছে। আসলে উনাকে লাইব্রেরীতে পড়তে দেখেছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বাড়িতে পড়ার সময় পান না। কেন পান না সেটা জিজ্ঞেস করতে সব খুলে বলেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। আমি ভাবতাম আমাদের বয়সী নিন্মবিত্তরাই পরিশ্রমী। কিন্তু না। সেদিন উনার সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। সবার জীবনেই একটা গল্প আছে।”

“হুম, চল ক্লাসে যাই।”

ফালাক গাড়িতে ওঠে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। প্রচুর রাগ লাগছে। রুহানির এমন বাঁকা বাঁকা কথা ফালাকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। সাথে অভিমানও। এক পাহাড় অভিমান যেন ওর উপর ভর করেছে। ফালাক গাড়ি স্টার্ট দিল। অফিসে কাজ আছে প্রচুর।

.

রুহানি, রুহানের স্কুল থেকে ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে৷ রুহানির মনে হচ্ছে এতক্ষণ স্বপ্নরাজ্যে ছিল। এখন এসে পড়েছে সেই করুণ বাস্তবতার মাঝে। দোতলার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানের হাত ধরে ভেতরে গেল।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ির পেছনের ঝুপ থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। রুহানি বাবার সাথে দেখা করার জন্য রুমের কাছে গিয়ে কান্নার শব্দ পায়। দরজা ভেড়ানো ছিল তাই কান্নার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। রুহানি ভালো ভাবে শোনার চেষ্টা করছে।
রুহানির মা কাঁদছে।
“রুহানিকে কি করে এই কথাটা বলব? আমার মেয়ের কি হবে? ওর ভবিষ্যতটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? ওর জন্য আমরা কিছু করতে পারব না? আমি আর এসব দেখতে পারছি না।”

রুহানির বাবা ধরা গলায় বলল,
“সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। সবাই টাকা চিনে। নয়তো যে আহিলের বাবা তার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল সে আজ এভাবে এই বিপদের দিনে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে পারে? আমি তাকে ফোন করেছিলাম যাতে আমাকে সাহায্য করে কিন্তু না সে রুহানির সাথে আহিলের বিয়ে ভেঙে দিল। আমার এতদিনের স্বপ্ন রুহানির বিয়ে দেব আজ সব শেষ করে দিল।”

“আমার মেয়েটার কি হবে? ওর কি ভালো ঘরে বিয়ে হবে না? ওকে কি সারাজীবন এই বোঝা বইতে হবে?” এই কথাগুলো বারবার বলে রুহানির মা কাঁদছে।

“আমি পারলাম না। ব্যর্থ আমি, আমি ব্যর্থ বাবা। আমি আমার মেয়েকে সুখী দেখতে পারলাম না। এর চেয়ে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল।”

রুহানির চোখেও পানি জমেছে। মেইন ডোর খুলে বাইরে চলে গেল। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ল। অঝোরে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে৷ কেন কাঁদছে জানা নেই।
বাবা মায়ের কান্না দেখে? তাদের কষ্ট দেখে? না নিজে রিজেক্ট হয়েছে তাই?

রুহানি সবেমাত্র অনার্সে এডমিশন নিয়েছে। বাবা একদিন ডেকে বলল,
“ওর বিয়ে ঠিক করা। তাই ও যেন খেলার বশেও কাউকে মন দিয়ে বসে না থাকে। ভার্সিটিতে হাসি-আনন্দ যা খুশী করুক কিন্তু প্রেম-ভালোবাসায় যেন না জড়ায়।”

রুহানিও কখনো প্রেম ভালোবাসায় জড়ায় নি। আহিলের ছবি দেখে অপছন্দ করার মতো কিছু পায় নি। একদিন শুধু আহিলের সাথে কথা বলেছিল। বলেছিল ওর স্বাধীনতা চাই। যখন বিয়ে হবে তখনই যেন কর্তৃত্ব দেখায় এর আগে নয়। তারপর রুহানি নিজের মতো থেকেছে। এতকিছুর মধ্যে ওর বিয়ে ঠিক এটা মাথায় কখনো আসতো না। কিন্তু ওর বাবা-মার অপেক্ষা ছিল শুধু গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা। তারপর ধুমধামে ওর বিয়ে দেবে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here