প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-৭
#ফাবিহা_নওশীন
||
রুহানি হসপিটালের কডিটোর জুড়ে দৌড়াচ্ছে আর চোখের পানি মুছছে। পুরো মুখ কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। দেখে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। আশেপাশে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কে অবাক হয়ে ওকে দেখছে তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আর না আছে খেয়াল। রুহানি নিজের মতো দৌড়াচ্ছে।
বাবা কোথায়, কিভাবে, কত নাম্বার রুমে আছে কিছুই জানা নেই। শুধু জানে তিনতলায় আছে। বাবাকে খোঁজে না পেয়ে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর ফুপিয়ে কেঁদে দিল। নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আশেপাশের মানুষ ওকে এভাবে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আর নিজেদের মতো ফিসফিস করছে।
কেউ কেউ ওর সামনে এসে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? কিন্তু রুহানি উত্তর দিচ্ছে না। চুপ করে কেঁদেই যাচ্ছে। একজন ওকে উঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ও শক্ত হয়ে বসে আছে। কান্নার মাঝে বাবা শব্দটা কয়েকবার উচ্চারণ করল। এতে করে উপস্থিত লোকজন বুঝল ওর বাবার কিছু হয়েছে।
রুহানির মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে ধরে দাঁড় করালো। রুহানির মা নিজেকে যতই শক্ত রাখার চেষ্টা করুক না কেন চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারছে না। রুহানিকে ধরে উঠাল।
রুহানি কিছু বলার আগেই ওর মা বলল,
“আমরা বাবার কাছে যাচ্ছি।”
রুহানি কাঁদতে কাঁদতে কেবিনের সামনে গেল। ১৫ বছরের রুহান পাশের বেঞ্চিতে বসে আছে। মা আর বোনকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কাদো কাদো হয়ে বলল,
“মা, বাবার কন্ডিশন ভালো না। আমার খুব ভয় করছে।”
ওর মা বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবার কিছু হবে না। ভয় পাস না।”
রুহানি বারবার বাবার কাছে যেতে চাইলেও ডাক্তার পারমিশন দিল না। রুহানির মা ওকে আর রুহানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল জোর করে।
রুহানি বিছানায় শুইয়ে ছটফট করছে। রাতটাকে বেশ লম্বা আর ভয়ংকর মনে হচ্ছে। রাতের এই গাঢ় অন্ধকার যেন ওকে গিলে খাচ্ছে। তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে। অস্থির অস্থির লাগছে। এই প্রথম কোন রাতকে এতটা ভয়ংকর লাগছে। এটা সেটা ভেবে পুরো নির্ঘুম একটা রাত কাটাল। মাথা ভারী হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এর পর থেকে প্রতিটা রাতই ভয়ংকর কাটবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের রাতগুলো হয়তো নির্ঘুমই হয়।
রুহানি দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবছে দু-তিন দিন আগের কথা। রনক হুট করে বাড়িতে চলে যায় আর বাড়িতে পৌঁছে রুহানিকে ফোন করে জানায় ওর বাবা হসপিটালে তাই ও কিছুদিন রুহানিকে পড়াতে পারবে না।
রুহানি “ওকে” বলে রেখে দেয়। এর পর আর ওর বাবার খোঁজ করে নি। একটা বারের জন্য ফোন করে নি। আসলে নিজের ব্যস্ত জীবনে ওর বাবার কথা ভাবার ফুরসতই মিলে নি। আজ রুহানির মনে পড়ছে। মনে পড়ছে হয়তো সেদিন রাতে রনকও ওর মতো ছটফট করেছে। ওর ও হয়তো ভয়ংকর রাত কেটেছে। রনকের অবস্থানটা আজ অনুভব করতে পারছে। রুহানি প্রথমে ফোন হাতে নিয়ে বাবার খোঁজ নিল তারপর রনককে ফোন করল।
একবার রিং বাজতেই রনক ফোন রিসিভ করল। ফোন রিসিভ করতেই রুহানি জিজ্ঞেস করল,
“আংকেল কেমন আছে?”
রনক মৃদু হেসে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে। তবে অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কি যে টেনশন আর ভয়ে কাটিয়েছি পুরো পরিবার। একমাত্র আল্লাহ জানে। আমি দুয়েক দিনের মধ্যে চলে আসব।”
“কিছুদিন থেকে আয়। আংকেলের খেয়াল রাখ।” রুহানির গলা ধরে আসছে। রুহানির ধরা গলা খেয়াল করে রনক চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানি কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”
রুহানি কেঁদে দিল। এই মুহুর্তে ওর এমন একজন বন্ধু দরকার যে ওর অবস্থাটা বুঝতে পারবে। যে ওর কষ্টগুলো অনুভব করতে পারবে। আর সে হচ্ছে রনক। রুহানি কেঁদে দিল। রনক ওর কান্না শুনে বিচলিত হয়ে পড়ল। রুহানিকে যতদূর চিনে কঠিন মনের মানুষ। এত সহজে কাঁদার মেয়ে ও নয়।
রনক চুপ করে রুহানিকে কান্নার সুযোগ করে দিল। রুহানি কান্না থামিয়ে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে রনক স্তব্ধ হয়ে গেল।
তারপর বলল,”রুহানি, নিজেকে শক্ত করো। এটা ভেঙে পড়ার সময় না। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আংকেল দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমি বিকেলে চলে আসছি।”
রুহানি কাঁদতে কাঁদতে ফোন কেটে দিল।
রুহানি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলের সামনে গেল। পুরো বাড়িটা নীরব, নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। রুহানির বুকে চাপ দিচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে পারছে না।
পানি মুখে দিয়ে ফ্রেন্ড গ্রুপে একটা ম্যাসেজ করে হসপিটালের জন্য বের হয়ে গেল।
।
ফালাক ভার্সিটিতে এসে রুহানিকে খুঁজছে। আজ রুহানিকে একবার পাক। কিন্তু রুহানিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো ভার্সিটি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পেল না। তারপর বিরক্তি নিয়ে লাইব্রেরীতে পড়া শেষ করে ক্লাসে গেল। ক্লাস শেষে রুহানিকে খুঁজছে কিন্তু পায় নি। ভার্সিটি শেষ হওয়া পর্যন্ত রুহানিকে খোঁজ করল কিন্তু পেল না। অবশেষে বুঝতে পারল রুহানি আসে নি।
ফালাক মনে মনে বলল,
“ব্যাপার না। আজ আসো নি তো কি হয়েছে! আসবে তো।”
রুহানি ডাক্তারের কাছ থেকে পজিটিভ কোন উত্তর পেল না। সারাদিন হসপিটালে ছিল। রুহানি নিরাশা নিয়ে বসে আছে। কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না। দু’হাতে মাথা চেপে ধরল।
রনক দৌড়ে রুহানির সামনে এসে থামল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। রুহানি চোখ তুলে তাকাল। রুহানির বিমর্ষ মুখ দেখে রনকের মনটা কেমন জানি করে উঠল। রুহানিকে এভাবে এর আগে দেখে নি।
।
কেটে গেছে দু-তিন দিন। রুহানি ড্রয়িংরুমে টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আগামী কাল সব প্রপার্টি নিলামে উঠবে। পাশেই রুহান বসে আছে। ওর পলকহীন দৃষ্টি মেঝের দিকে।
“রুহানি মা!”
রুহানি মাথা তুলে তাকাল। ওদের এই অবস্থায় ওদের কোন আত্মীয়স্বজন এগিয়ে আসে নি। সবাই জেনে গেছে ওদের সব প্রপার্টি নিলামে উঠবে। কাজের লোকেরা পর্যন্ত চলে গেছে। নতুন আশ্রয়, নতুন কাজের জন্য। কেয়ারটেকার আংকেল এসেছেন। রুহানি তাকে দেখে শুকনো হাসল।
আতাউর রহমান রুহানির কাছে এসে বলল,
“কোথায় যাবে ঠিক করেছো?”
রুহানি দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ওর চোখের পাপড়ি ভারী হয়ে আসছে। টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
রুহানি ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কান্না আঁটকাতে পারছে না। রুহান বোনের অবস্থা দেখে উঠে চলে গেল। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।
রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা এখনো হসপিটালে। আমাদের চাচা-ফুপু নেই। মামা আছে একজন। আমি জানি তার জন্যই আজ আমাদের এই অবস্থা। এটা জানার পরেও আমি তাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করে নি। আমাদের একটুও খোঁজ নেয় নি। আমি কি করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কখনো এমন সিচুয়েশনে পড়ি নি। তাই কি করে কি হ্যান্ডেল করব কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজেদের বাড়ি, সব ছেড়ে কোথায় যাব? কি করব? রাস্তার ভিখারি হয়ে গেলাম আংকেল। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সব শেষ করে দেই।” রুহানি আবারও কাঁদতে লাগল।
“মা এমন কথা বলো না। তোমার মা, ভাই ওদের কি হবে? তোমার বাবার এই অবস্থা। তোমার মা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। এখন তুমি যদি এমন করো তাহলে তাকে কে সামলাবে? তোমার ছোট ভাইটা ওকে কে দেখবে? তোমাকে হতে হবে তোমার পরিবারের বটগাছ। যার ছায়াতলে সবাইকে রাখতে হবে। তোমাকে সকল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে হবে। আর এ লড়াইতে তোমাকে জিততে হবে। তোমার পরিবারের জন্য জিততে হবে।”
“আংকেল আমি কি করে করব? আমি কি পারব? সে যোগ্যতা কি আমার আছে? আমি কি করে আমার পরিবারকে রক্ষা করব? কি করে পরিবারের পাশে দাঁড়াব? কি করব? কি যোগ্যতা আছে আমার?”
আতাউর রহমান আশ্বস্ত করে বলল,
“সেটা সময় বলে দেবে। সময় আর পরিস্থিতি তোমাকে যোগ্য করে তুলবে। শুধু কঠিন পরিস্থিতি থেকে পালানোর চেষ্টা না করে পরিস্থিতিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে শিখো।”
রুহানি চোখের পানি মুছে বলল,
“আগামীকাল সব হাতছাড়া হয়ে যাবে তারপর আমরা কোথায় যাব? কোথায় থাকব? আমি, রুহান, মা আর বাবা! বাবার রিলিজ হওয়ার পর কোথায় নিয়ে যাব?”
“মা, কি বলব? এই বাড়িতে কিংবা এরকম বাড়িতে তো….
থেমে গেলে। রুহানি শুকনো হাসল। তারপর বলল,
” জানি আংকেল। আমাদের আর সে অবস্থা নেই।”
আতাউর রহমান কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“আমার পরিচিত একজন আছে যারা বিদেশে থাকে। ওদের এক আত্মীয় নিজের মেয়েকে নিয়ে ও বাড়িতে থাকে। তোমরা চাইলে উপর তালা ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। কিছুদিন না-হয় থাকলে ওখানে তারপর ভালো না লাগলে অন্য কোথাও শিফট হয়ে যেও। তবে বাড়ির পরিবেশটা সুন্দর।”
রুহানি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ঠিক আছে। মায়ের সাথে আপনার কথা বলিয়ে দেব। মা যদি বলে তাহলে আমরা ওখানে শিফট হয়ে যাব।”
.
রুহানি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারল ওর বাবা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আর ও মা দুদিন যাবত এটা ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে যাচ্ছে। রুহানির মনোবল যেন আবারও ভেঙে গেল। দু’ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছে। বাবার এ অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। সব হারিয়েও এত কষ্ট পায় নি যতটা কষ্ট আজ পাচ্ছে।
ফালাক দু-তিন দিন রুহানিকে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন রুহানিকে খুঁজছে কিন্তু রুহানির দেখা নেই। হটাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল? ফালাক কারো কাছ থেকে জানতেও পারছে না আর না পারছে কাউকে জিজ্ঞেস করতে।
চলবে….
(হয়তো হুট করে ঘটনার মোড় ঘুরে যাওয়ায় ভালো লাগছে না। বাট এটাই গল্পের মেইন থিম।)