জীবন_সায়াহ্নে,পর্ব_৪ শেষ

জীবন_সায়াহ্নে,পর্ব_৪ শেষ
মারজানা হোসেন রোজী

দিন দিন মতিহার বানুর প্রতি তার ছেলে কামাল আর তার ছেলে বউ বিপাশার ব্যবহার এতটাই খারাপ হচ্ছে, এতটাই অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠেছে যে মতিহার খুবই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। ছোট ছেলের বউ লরা বারবার তাকে ফোন দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মতিহারের পক্ষে লরার কথা মানা কোনদিনই সম্ভব না। এমনিতেই সারাজীবন চরিত্রে যে কলঙ্কের দাগ লেগেছে তা নিয়ে কম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়নি তাকে । নতুন করে কোনো কালি জড়াতে চায় না সে।

বেশ কিছুদিন ধরে মতিহারের অ্যাজমার সমস্যাটাও বেড়েছে। তাছাড়া এ বছর ঠান্ডা পড়েছেও বেশ। তার উপর ঘর গৃহস্থলীর কাজকর্ম তো আছেই। ক’দিন যাবতই খুক খুক করে কাশে মতিহার। কিন্তু এ দিকে কোন খেয়াল নেই কামাল বা বিপাশা কারোরই।
আজ খাবার টেবিলে বসে মতিহার কাশতে কাশতে প্রায় বমি করে দেবার মত অবস্থা! কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে সে দৌড়ে বেসিনে চলে গেল। বেসিনে যেতেই হড়হড় করে বমি করে ভাসিয়ে দেয় সে।

মতিহারকে বমি করতে দেখে বিপাশা কামাল সবারই খাবার অবস্থা আর রইল না। কামাল এগিয়ে গিয়ে তার মায়ের মাথায় পানি দিতে উদ্যত হল। বিপাশা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে আর রাগে কটমট করছে। নিরব আর নিশুতিও আছে আশেপাশেই। নিশুতিও এগিয়ে এলো তার বাবাকে সাহায্য করতে। মতিহার বানু কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে তার ছেলে এবং নাতনিকে সেখান থেকে চলে যেতে।

প্রতিদিনের মত সেদিন আর খাবার টেবিল গোছানোর দায়িত্ব পালন করতে পারল না মতিহার । বিপাশা রান্নাঘরে যেয়ে থালা বাসন পরিষ্কার করছে আর রাগে গজগজ করছে। নিশুতিও অবশ্য আজকে তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

কামালের ঘুমে চোখটা বুজে আসছে ঠিক সেই সময় রাগে গজগজ করতে করতে রুমে প্রবেশ করল বিপাশা।

– কি ব্যাপার! নবাব আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?

– চোখ বন্ধ অবস্থায় কামাল শুধু বলল, হুম!

– ঘুমাবেই তো! নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাও! এই ঠান্ডার মধ্যে এতগুলি থালা-বাসন ধুতে হতো তাহলে বুঝতে ঘুম কীভাবে আসে?

– থালাবাসন ধোয়া নিশ্চয়ই আমার কাজ না!

– তবে কি আমার কাজ? তুমিও সারাদিন অফিস করো আমিও সারাদিন অফিস করি। দুজনই একই রকমের পরিশ্রম করি বাহিরে। আয়-রোজগারও প্রায় সমান দুজনের। তবে বাসার কাজের সময় এত পার্থক্য কেনো? থালা-বাসন পরিস্কার যদি তোমার কাজ না হয় তাহলে এটা আমারও কাজ না।

– একটা কাজের লোক রেখে নিলেই তো পারো।

– লোক রেখে নিলেই তো পারো, কত সহজে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি লোক রাখতে তো চাই। আমার তো টাকা দিতে অসুবিধা নেই। অসুবিধা তো তোমার মা! আজ পর্যন্ত একটা মেয়েও তার কাছে টিকতে পারে না। প্রত্যেকটা মেয়ের কোনো-না-কোনো খুত ধরে বাসা থেকে তিন চার দিন পর বের করে দেয়। আরে বাবা! বুড়ো মানুষ আমি কোথায় পাব? তাছাড়া বুড়ো মানুষ নিয়ে এসে আমি ঘরে আরেকটা ঝামেলা বাড়াতে চাইনা!

– মা কেনো রাখে না মেয়েগুলোকে তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো। তারপরও কেনো বলছ একথা! তোমার ছেলের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তুমি জানো না!

– জানব না কেন? বেয়াদব ছেলে একটা! একদম দাদির মতোই হয়েছে!

– এসব কি বলছ? কার সাথে কাকে মিলাও!

– বুঝেছি তোমার মায়ের কথা বলেছি তো তাই তোমার খুব গায়ে লেগেছে। আচ্ছা, তুমি নিজের চোখে দেখলে যে তোমার মা কতটা অসুস্থ!

– অসুস্থ তো দেখলাম।কালকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাও।

– ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। কে নিয়ে যাবে, আমি?

– হ্যাঁ, তুমি। তো! কি সমস্যা?

– তুমি ভালো করেই জানো আমার পক্ষে কালকে সম্ভব না। কালকে ফরেন ডেলিগেটসদের সাথে আমাদের মিটিং আছে। আমি রাত দশটা পর্যন্ত বিজি থাকব। আমাদের কোম্পানি বেশ বড় একটা ডিল পেতে যাচ্ছে। আমার কালকে মিটিংয়ে এটেন্ড থাকা খুবই জরুরী।
তুমি চলে যেও মাকে নিয়ে!

– নিজেরটা ঠিকই মনে রেখেছো। তোমার মনে নেই আমি কালকে চিটাগং হয়ে যাচ্ছি তিন দিনের জন্য।

– ও হ্যাঁ, তাইতো!

– তাহলে নীরব বা নিশুতি কাউকে বলে দিও!

– কামাল, নীরব বা নিশুতি কেমন তুমি জানো না? তাছাড়া ওদেরও ক্লাস থাকতে পারে! ওরা হয়তো যাবে না। তাছাড়া ওরা এসব মেডিকেল রেস্পন্সিবিলিটিস বোঝার মতো হয়নি। তুমি এক কাজ করো আবুল ড্রাইভারকে সকাল সকাল আসতে বলো। ওনাকে নিয়ে যেতে বলো। টাকা পয়সা যা লাগে দিয়ে দিও। আবুলকেও কিছু এক্সট্রা টাকা দিও। ও খুশি হবে। না হলে আজকাল এসব ঝামেলার দায়িত্ব নেয় কে, বলো!

– কিন্তু…

কামাল কথা শেষ করার আগেই খুক খুক করে কাশতে কাশতে মতিহার বানু ছেলে আর ছেলের বউয়ের রুমে প্রবেশ করল।

মাকে আসতে দেখে কামাল উঠে বসল।

– কি ব্যাপার, মা? কিছু বলবে তুমি?

– হ্যা! তোদের বিরক্ত করতে এলাম। কাশিটাতো থামছেই না। একটা কাজ করতে পারবি? দারোয়ানকে একটা ফোন দে! বাসায় লবঙ্গ নেই। আমাকে কয়টা লবঙ্গ এনে দিতে বল। ওটা মুখে রাখলে কাশি কিছুটা হলেও কমবে। না হলে আমি সারারাত ঘুমাতে পারব না।

– ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি। তুমি রুমে যাও। আমি দারোয়ানকে ফোন দিচ্ছি।

মতিহার বানু চলে যাচ্ছিলেন আবার কি মনে করে পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললেন,

– আর হ্যাঁ, আমাকে নিয়ে তোদের এত চিন্তা করতে হবে না, বাবা। আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। হাতে পায়ে একটু সরিষার তেল মালিশ করলে আর আদার রস, লবঙ্গ এগুলো খেলে আমি ঠিক হয়ে যাব।

– ওহ, আপনি তাহলে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন, মা।

– বউমা, কথা শুনছিলাম বললে ভুল হবে। তোমরা যখন কথা বলছিলে আমি দরজা পর্যন্ত এসে তোমাদের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কথার মধ্যে কি করে রুমের মধ্যে ঢুকি, বলো!
তোমরা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করো। এত চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি।

কথাগুলো বলতে বলতে এক বুক অভিমান নিয়ে মতিহার বানু তার রুমের দিকে চলে যাচ্ছিলেন তখন বিপাশা পিছন থেকে আবার বলে উঠলেন,

– ঐ বুড়ো লোকটার সাথে কি এখনো যোগাযোগ আছে আপনার?

– না না, কি বলছো? আমি এখন বাইরে যাই না!

– তাহলে আপনি সকাল-বিকাল হাঁটেন কোথায়?

– বিকেলে পারলে একটু ছাদে যাই। আর বাসার মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করি। ভয় নেই, আমি তোমাদের মান ইজ্জত নষ্ট করব না।

– মান ইজ্জত আর বাকি আছে কিছু যে আপনি সেটা নষ্ট করবেন?

– তাও সত্যি কথা! মান ইজ্জৎ আছেই বা কোথায়?

আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে মতিহার বানু তার রুমে চলে গেল। এ কেমন সন্তান সে পেটে ধরেছে? বিপাশা না হয় পরের মেয়ে। সে না হয় তাকে না বুঝে। কিন্তু কামাল তো তার নিজের পেটের সন্তান। এত কেনো টাকা পয়সার পিছনে ছুটতে হবে? মায়ের সাথে বসে এক মুহূর্ত কথা বলার সময় নেই। অসুস্থ মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সেটাও তার সময় হয় না। মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে তাই দায় পড়ে ডাক্তারের কাছে পাঠাতে চায়। তাও ড্রাইভারের সাথে। নিজে থেকে তোর একটুও মন কাঁদে না রে! তোর মায়ের অসুস্থতার সময় পাশে যেয়ে একটু বসতেও সময় হয় না? কেমন লাগছে মায়ের তাও জানতে মন চায় না? এই সন্তানের জন্য এত কষ্ট করেছে ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছে আজ মতিহার!

পরের দিন সকালে প্রচন্ড পেটে ব্যথায় মতিহার বানু গোংরাচ্ছে! তার গোংরানির শব্দ শুনে কামাল এগিয়ে গেল। মতিহার বানুর এমন অবস্থা যে সে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। বাধ্য হয়ে কামাল ডাক্তারকে বাসায় ডাকল।
আধা ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার চলে আসে। ডাক্তার মতিহার বানুর প্রেসার, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য সব রিপোর্ট দেখে তখনই মতিহার বানুকে হাসপাতালে নিতে বলল কামালকে। কামালের তো মাথায় হাত! তাকে যেতে হবে চিটাগংয়ে। আর এখন এই হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি কিভাবে সম্ভব!

মতিহার বানুর সব ধরনের টেস্ট করতে করতে আর ডাক্তারের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ইমিডিয়েটলি মতিহার বানুর পিত্তথলির অপারেশন করার কথা বলা হলো। সেদিন আর চিটাগংয়ে যাওয়া হলো না কামালের। মেজাজ খুব গরম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বিপাশার অপেক্ষা করছে।
রাত দশটার কিছু পরে বিপাশা বাসায় ফিরল। আজ বাসায় রান্নাবান্না আর কিছু হলো না দেখে কামাল বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করল। মতিহার বানু নিজেই নিজেকে নিয়ে নড়তে পারছে না সেখানে সে রান্না করবে কিভাবে?
বিপাশা অফিস থেকে ফেরার পরে নামকাওয়াস্তে একবার শাশুড়ির রুমে যেয়ে তার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে এল।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই রাতে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন কামাল বিপাশার উদ্দেশ্যে বলল,

– মায়ের শরীরের অবস্থা তো দেখলেই খুব বেশি ভালো না! ডাক্তার বলেছে পিত্তথলিতে যে পাথর হয়েছে ওটা নাকি বেশ সমস্যা তৈরি করছে। বেশকিছু দিন পার হয়ে গেছে এ জন্যই সমস্যাটা বেড়েছে। মা অবশ্য আমাদেরকে অনেক আগেই বলেছিল, আমরাই গায়ে লাগাই নি। এখন যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ওসব বলে আর লাভ কি? অপারেশনটা খুব বড় কিছু না। নরমাল অপারেশন। কিন্তু মার ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার আছে এজন্য একটু সমস্যা! তার ওপরে এজমার সমস্যাটা তো আছেই!

– এতকিছু আমাকে কেন শোনাচ্ছ? অপারেশন করতে হবে অপারেশন করো! শহরের সবচাইতে ভালো হাসপাতালে ভালো কেবিনে রেখে চিকিৎসা করো। তাতে তো আমার কোনো অসুবিধে নেই। তাহলে বারবার এতকিছু শুনানো আমাকে কি দরকার?

– বিপাশা, টাকা পয়সা যে এখানে ফ্যাক্ট না সেটা তুমি নিজেও ভালো করে জানো! আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে তুমি অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নাও। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সেখানে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য একজন সাথে থাকতে হবে। সেটা তুমি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই, যে তাকে বলব। আমার কোন বোনও নেই। সো, যা করার তোমাকেই করতে হবে। প্লিজ, কোন ধরনের সিনক্রিয়েট করবে না এবার।

– হোয়াট? আমি সিনক্রিয়েট করি আর আমি এক সপ্তাহের ছুটি নেব? এটা তুমি ভাবলে কি করে?
তুমি ভালো করেই জানো আমাদের অফিসে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ঢুকেছে। আর আমি কত বড় গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে আছি সেটাও তুমি জানো। এক সপ্তাহ কেনো আমার পক্ষে একদিনের ছুটি নেওয়াও সম্ভব নয়। তুমি বরং এক কাজ করো তুমি ছুটি নিয়ে নাও। তোমার মায়ের সাথে হাসপাতালে থাকবে।

– বিপাশা তুমিও জানো যে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ক্যানসেল করে আজকে ঢাকায় থেকেছি। আমি মিটিং পোস্টপন্ড করেছি দু’দিনের জন্য। আমি সর্বোচ্চ গেলে আর দু’দিন থাকতে পারব। এরপরে আমাকে যেতেই হবে না হলে কত বড় ক্ষতি হবে আমাদের কোম্পানির সেটা তুমি ভালো করে বোঝো। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে মায়ের কাছে একজন মেয়ে মানুষ থাকা দরকার। মায়ের সব কাজ তো আমি পারব না করতে। এজন্যই তোমার থাকা দরকার।

– আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি তোমার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। আর আমারটার গুরুত্ব নেই। যাই হোক এখন এক কাজ করো। একটা মেয়ে মানুষের দরকার তাই তো! আমাদের যে কাজ করে বুয়াটা ওকে বলে দেখো না! টাকা দিলে রাজি হয়ে যাবে থাকতে। তাছাড়া আজকাল অনেক নার্স পাওয়া যায়। টাকার বিনিময়ে ওরা থাকে পেশেন্টের সাথে। খোঁজ নিয়ে দেখো।

– বিপাশা, মা আমাদের। বুয়া বা নার্স রেখে যে কাজ করবো, ওরা যেটা করবে সেটা কী আমাদের মতো করে করবে? মা তো সারাজীবন তোমার সংসারের খেটে গেল তাই না! এই ক’টা দিন মায়ের জন্য তুমি পারবে না স্যাক্রিফাইস করতে?

– বাহ! সুযোগ পেয়ে খোটা দিয়ে দিলে! সংসারটা আমার? তোমার না? তুমি কি তোমার মায়ের ছেলে না? ছেলের সংসারে সে এত দিন খেটেছে। এখানে তার কাছে তো আমার কোনো বা দায়বদ্ধতা নেই।
আমার বান্ধবীর শশুর কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়েছিল ওরা একটা নার্স রেখেছিল। খুবই ভালো। ঘরের মানুষের মত করেই দেখাশোনা করে। আমি ওর কাছে খোঁজ নিয়ে নার্সের সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপাতত ওনাকে দিয়ে কাজ চালাও। পেমেন্টটা একটু বেশি নেয় কারণ সার্ভিস ভালো দেয়। ওটা সমস্যা না। তাছাড়া নিরব নিশুতি ওরা তো আছেই। ওরা মাঝে মাঝে যেয়েই দেখে আসবে মাকে।

– বাহ! কত সুন্দর সলিউশন করে ফেললে। বিদ্রূপের সাথে বলল, কামাল। দেখো! যেহেতু তুমি থাকতে পারবেই না নার্সের সাথে যোগাযোগ করো। আমার আর কিছু বলার নেই।

– তোমাকে তো সেদিনই বলেছি তোমার মা দিনদিন খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মানবদেহ যন্ত্রপাতির মত। ম্যাশিনারিস পুরানো হয়ে গেলে যেমন আজকে এটা, কালকে সেটা নষ্ট হতে থাকে, মানুষের দেহও ঠিক তেমনি। এভাবে প্রতিদিনই মা অসুস্থ হবে আর তার জন্য কে বাসায় থাকবে চাকরি বাকরি ছেড়ে? একসময় তাকে দেখার জন্য বা সাথে সার্বক্ষণিক লোকের প্রয়োজন হবে! এভাবে বাইরের একজন মানুষ নার্স বা দিয়ে তো সারাক্ষণ তাকে দেখাশোনা করানো সম্ভব হবে না। আমি যেটা বলেছি সেটাই করো। মাকে ওল্ড হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এখন অনেক ভালো ভালো মানের ওল্ডহোম পাওয়া যায়। মান্থলি তুমি যদি একটা হাই অ্যামাউন্ট ওদেরকে দাও মাকে ওরা খুব ভালোভাবে দেখেশুনে রাখবে। তাছাড়া আমরা প্রতিমাসেই তো মা’র সাথে দেখা করে আসব। মাঝে মাঝে মাও আসবে আমাদের এখানে। ওখানে মায়ের সমবয়সী অনেক বন্ধু বান্ধবী মিলে যাবে। তাদের সাথে তার গল্পগুজব করে সময়টা ভালো কাটবে। বাসায় তো সারাদিন ওই রুমের মধ্যে একা একা ঘুপচি পরিবেশে বসে থাকে। এজন্যই তো আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
জামালের তো কোনো মাথাব্যথা নেই। সেতো দূর দেশে যেয়ে উঠেছে।
কি কথা বলছ না যে! চুপ করে আছ কেনো?আমি তোমার মায়ের ভালোর জন্যই বলছি। আমি তোমার মায়ের শত্রু না।

আজ কামালের চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে।

– আমার মা আমাদেরকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে। তাকে সেই সম্মান আমরা দিতে পারিনি। জীবনে অনেক ভুল করেছি। আজ যখন হাসপাতালের বেডে মাকে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া দেখলাম, বুকের মধ্যে কেমন যেন হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠল। যে মা আমাদেরকে বুকে আগলে ধরে এত বড় করেছেন, এমনকি আমার ছেলে মেয়ে দুটোকেও সে নিজের হাতে এত বড় করেছেন। তার জন্য সময় খুঁজে পাই না আমরা। আজ সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে অমনি আমরা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাচ্ছি ডাস্টবিনে।

– হোয়াট? ডাস্টবিন? ওল্ড হোম কে তুমি ডাস্টবিন বলছো? আর ইউ ম্যাড?

– নো, আ’ম নট ম্যাড! আ’ম কমপ্লিটলি ওকে!

– তবে কি বলতে চাইছ তুমি? মাকে ওল্ড হোমে পাঠাবে না! বেশ তো! ক’দিন পরে দেখবে কোন বুড়োর হাত ধরে তোমার মা চলে গিয়েছে? ক্যারেক্টারলেস লেডি!

– বিপাশা, আমি এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। ঠিক আছে। তুমি যখন চাচ্ছ মাকে ওল্ড হোমে পাঠালে তুমি ভালো থাকবে। ওকে, ফাইন। আমি মাকে ওল্ড হোমে দিয়ে আসব। কবে দিয়ে আসতে হবে জানিও! ও হ্যা! ট্রিটমেন্টের পরে একটা ডেট করো। ট্রিটমেন্টটা হোক, কিছুটা সুস্থ হোক! তারপরে দিয়ে আসব। তবুও প্লিজ এভাবে আর আজেবাজে কথা বলো না। আমার মা তো! তাই শুনতে খুব কষ্ট হয়! তবে তুমি নিজেও এমন দিনের জন্য প্রস্তুত থেকো! আজ আমাদের ছেলেমেয়েও দেখছে সবকিছু।

কথাগুলো বলতে বলতে কামালের গলাটা ধরে আসলো। সে রুম থেকে বেরিয়ে তার মায়ের রুমের দিকে রওনা হলো।

তার মায়ের কথা শুনে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। মতিহার বানু জামালের সাথে ফোনে কথা বলছে।

– না রে বাবা! ইতালিতে আমি যাব না। ইতালিতে বেঁচে থাকলে যাব তোর বাচ্চাকাচ্চা হলে। একবার ইতালি যাওয়ার শখ আছে। কিন্তু, সারাজীবন থাকতে পারব না। এই দেশ আমার মা! এই মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস নিতে চাই। আমাকে জোর করিস না। আমি পারব না। তোরা পারিস থাকতে কারণ তোরা এই দেশটাকে আমার মতো করে ভালোবাসতে পারিসনি। আমি, তোর বাবা, তোর মামারা এই মাটির জন্য যুদ্ধ করেছি। এই দেশকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। শুধুশুধু আর জোর করিস না। আমি যেমন আছি থাকতে দে! ওরা আমাকে যথেষ্ঠ ভালবাসে। কামাল, বিপাশা ওরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি নিজে থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চাই। ওখানে আমার মন ভালো থাকবে। তুই লরাকে বোঝা! ও কিসব পাগলের মত কথা বলে! ছিঃ!
তোরা মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবি? আমাকে আর এসব কথা বলে বিব্রত করিস না।
কথা শেষ করার আগেই নিজে থেকে ফোন কেটে দিলো মতিহার । আর কথা বললে মতিহার কান্না থামাতে পারবেনা এজন্যই হয়তো এমনটা করেছে।

সবই শুনছিল বাইরে দাঁড়িয়ে কামাল। তারা তো এখন পর্যন্ত তার মাকে বৃদ্ধাশ্রম রেখে আসার কথা বলেই নি। সে কী করে জানল? তবে কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে? বুকের ভেতরে হু হু করে কেঁদে উঠলো তার। মায়ের সামনে যেতেও লজ্জা পাচ্ছে সে।

ঘরে যেয়ে সে বিপাশাকে সাফ জানিয়ে দিলো বিপাশা আর চাকরি করতে পারবে না। আগামীকালই চাকরি ছেড়ে আসবে। তার মাকে দেখাশোনা করাই এখন বিপাশার চাকরি। বিপাশার যত টাকা লাগবে সে দিবে। পৃথিবী উল্টিয়ে গেলেও সে তার মাকে ওল্ডহোমে দিয়ে আসতে পারবে না। জীবনে যা ভুল করেছে সেতো আর শুধরাতে পারবে না। বাকি জীবন না হয় মাকে সাথে নিয়েই বাঁচতে চায় সে!

এ কথা বলার সাথে সাথে ঘরে আগুন ধরে যাবার মত অবস্থা! বিপাশা অকথ্য ভাষায় কামালের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে। কামালও আজ বসে নেই। সেও যা মুখে আসছে তাই বলছে বিপাশাকে। অবস্থা একসময় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়।
ছেলেমেয়েরাও অবাক এমন ঘটনা দেখে।
মতিহার বানু এগিয়ে এসে বোঝানোর চেষ্টা করে সে নিজেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চায়।

কামালের কথা একটাই সে মরে গেলেও তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দিবে না। বিপাশা রেগে গিয়ে ভাংচুর শুরু করে। তার কথা এসব নিয়ে কথা যখন উঠেছেই, তাকেই যখন সবকিছুর জন্য দোষ দেয়া হচ্ছে, সে নিজেই তাহলে এ বাসাতে থাকবে না। সে তার মায়ের বাসায় চলে যাবে।

দু’জনের কেউই শান্ত হওয়ার নাম নেই। মতিহার বানু যে অসুস্থ এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা দুজনের কারোরই নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে মতিহারের। এতটা অবাঞ্ছিত সে, ভাবতেই নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসছে তার। এতটা অবাঞ্ছিত তার নিজের কাছে নিজেকে সেনা ক্যাম্পে বসেও মনে হয়েছে কিনা তার সন্দেহ । তার অসুস্থতা নিয়ে কারো চিন্তা করার সময় নেই। ছেলে-বউ দুজনে মিলে যুদ্ধ করায় ব্যস্ত। সে জানে এখানে সে থাকলে এভাবে চলতেই থাকবে। কারণ এতদিন ছেলে আর বউ দুজনের নৌকা একই পালে চলত! কিন্তু এখান পাল আলাদা হয়েছে। একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে দুই দিকে টানতে থাকলে নৌকাতো চলবেইনা, উল্টা পাল ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই দু’মুখো বাতাস বন্ধ করা খুব দরকার এখন।

সারারাত ভেবে সে লরার সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে বাধ্য হলো। এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চায় সে।

আজ ১৬ই ডিসেম্বর! ছুটির দিন! বাসার পরিবেশ শান্ত খানিকটা। বিপাশা, কামাল, তাদের ছেলে মেয়ে সবাই বাসাতে! কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলেই বিপাশা হতভম্ব হয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে জামাল আর লরা । এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে এরা বাংলাদেশে এসেছে দেখে বাসার সবাই অবাক হয়ে যায়। এমনকি মতিহারও এ বিষয়ে কিছুই জানত না।

জামাল এতদিন পরে দেশে ফিরেছে, সাথে নতুন বউ বাসায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ঘন্টাখানেক পরে সবার সাথে নতুন বউয়ের পরিচয় পরিচিতি, আপ্যায়ন পর্ব শেষ হলে হঠাৎ জামাল সবার উদ্দ্যেশ্যে জানায় আজকে তার মায়ের বিয়ে। যে ঘরে তার মায়ের স্বাধীনতা নেই, উঠতে বসতে নানান অপবাদ মাথায় চাপানো হয়, যে ঘরে মায়ের কষ্টগুলিকে ছুঁয়ে দেখার কেউ নেই, মাকে চিকিৎসা করানোর মত সময় কারও কাছে নেই, যেখানে তার মা সম্পূর্ণ অবাঞ্চিত হয়ে পড়ে আছে সেই ঘরে থাকার কোনো মানেই হয় না!

সবাই সবচাইতে বেশি অবাক হলো যখন জামাল আর লরার সাপোর্টে আলিম ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। আলীমকে দেখার সাথে সাথে বাসার পরিবেশ আরো ভারী হয়ে উঠল।

কামাল আর বিপাশা ভুলে যায় যে জামাল এত বছর পরে বিদেশ থেকে ফিরেছে। তারা তাকে এবং তার নতুন বউকে নানান ভাবে অপমান, অপদস্ত করতে শুরু করে। জামাল বিদেশে থেকে নিজেদের দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি সব শিকেয় তুলেছে এমন নানান কথা!

মতিহার বুঝতে পারছে এসব কথা আলিমই তবে জানিয়েছে জামালকে। সে তো এতকিছু কোনোদিনই বলেনি জামালকে। কারণ সে কষ্টে মাঝে মাঝে এসব কথা আলিম ভাইয়ের সাথেই শেয়ার করত। লোকটাকে জামালের ফোন নাম্বার দেয়াটাই বোকামি হয়েছে তার।

বিপাশা মতিহার এবং আলিমের মত সত্তরোর্ধ একজন মানুষকে এত বাজে ভাবে অপমান করল যেটা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কামালের চোখ রক্তবর্ণ। কি বলবে এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারছে না। জামালের প্রতিটি অভিযোগই তো সত্যি। কোন মুখে কথা বলবে সে? মায়ের পায়ের কাছে ধপ করে বসে পড়ে কামাল। মতিহার দুই হাতে টেনে তুলে বলে, আমি নিজে থেকেই এই নিষঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি চাই, বাবা! তোদের উপর কোনো রাগ অভিমান নেই। ভালো থাকিস তোরা। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দে! কথাগুলি বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল মতিহার। কামাল সবই বুঝতে পারল। মায়ের মত সেও ফোঁপাতে লাগল।

মতিহার কামালের থেকে জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছোট ছেলে জামালের পাশে এসে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে কাজী সাহেব এসে উপস্থিত হন। জামাল আর লরা এই কঠিন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও খুব শান্তভাবে মতিহারকে অনেক কষ্টে কবুল বলিয়ে তাদের বিয়ে দেন।

নিরব আর নিশুতি দাদীকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত করছে। দাদীকে কিছুতেই যেতে দিবে না তারা।

ছেলের বাসা থেকে বিদায় হয়ে যাচ্ছেন মতিহার বানু। তার কান্নায় আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে বাবার বাড়ি থেকে কন্যা বিদায় হচ্ছে।
পাথরের মূর্তির মত দূরে দাঁড়িয়ে আছে বিপাশা। কামাল অথর্ব হয়ে পড়ে আছে। কী হচ্ছে চারপাশে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। চোখের পলকে কী থেকে কী হয়ে গেল। সবার কাছে হাতজোড় করেও লাভ হলো না তার।

জামাল আর তার বউ লরা হোটেলে উঠেছে এটা জেনে আলিম জামালের দুই হাত চেপে ধরে আবদার করে মতিহারকে বধূবরণর দায়িত্ব যেন লরা নেয়। অধিকারের সাথেই সে জামালকে অনুরোধ করে হোটেল থেকে মালপত্র সব নিয়ে তার বাসাতে ওঠার জন্য। বাংলাদেশে সে যতদিন থাকবে সে যেন তার মায়ের কাছেই থাকে! এজন্য জোর অনুরোধ করল জামাল আর লরাকে। তাছাড়া আগামী সপ্তাহে স্কয়ার হাসপাতালে তার মায়ের অপারেশনের ব্যবস্থা করে রেখেছে আলিম। এ সময়ে জামাল আর লরা পাশে থাকলে তাদের মা খুব ভালো থাকবে, সাহস পাবে!
মতিহারও যেন এটাই চায়। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে জামাল।

জামাল এই প্রস্তাবটা নাকচ করতে পারেনি আজ!
আজ তার মায়ের বিজয় দিবস! মুক্তির ক্ষণ! এই ক্ষণে মায়ের চাওয়া অপূর্ণ রাখবে কী করে!

সত্যি সেদিন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ভিনদেশী মেয়ে, এক বাংলাদেশি বীরাঙ্গনার পুত্রবধূ, লরা।

মতিহার পেলো এক নতুন জীবন, নতুন নাম! পেলো তার দুঃখ সুখের সাথী! জীবন সায়াহ্নে এমন দিনও তার জীবনে আসবে সে কোনোদিন কল্পনায়ও ভাবেনি। সেকি কারো প্রতি কৃতজ্ঞ হবে, নাকি রাগ করবে সেই অনুভূতিটুকুও যেন আজ নিথর!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here