প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা,পর্বঃ ০৩

প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা,পর্বঃ ০৩
জাহান আরা

আফজাল সাহেব মুখ কালো করে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন।আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না,আমার এতো বড় প্রমোশন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

দুপুরে অনুর স্কুলে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষ করে ২ বোন বাড়ি ফিরে এলাম,বাড়ি আসতেই মায়ের চিল্লানি শুরু।

আমিঃ কি করেছি আমি,কেনো এমন করছো।
মাঃ তুই কোন আক্কেলে ১০ কেজি মিষ্টি একসাথে কিনে পাঠালি আমাকে সেটা বল,প্রমোশন হইছে তাই বলে এতো মিষ্টি??
এতো মিষ্টি তুই খাবি বসে বসে।

আমি বুঝতে পারলাম কে এই কাজ করেছে কিন্তু মা’কে তো সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।

আমিঃ মা মিষ্টি আমি কিনি নাই অফিস থেকে বস কিনে পাঠাইছে।

মাঃ সত্যি বলছিস??
আমিঃ হ্যাঁ সত্যি।
মাঃ তাইলে এক কাজ করিস,আগামী শুক্রবার তোর বসকে দাওয়াত করিস বাসায়,আমি তোর প্রমোশন উপলক্ষে ভালো মন্দ রান্না করবো।

আমিঃ মা কোনো দরকার নাই এসবের,তুমি রান্না করো আমি আর অনু খাবো।

মাঃ যা বলেছি তাই করবি,বেশি বুঝবি না।

আমিঃ মা শুনো,আমরা হচ্ছি নিম্ন মধ্যবিত্ত, ওনারা কতো বড়লোক,ওনারা খাবার খায় ৫ তারা হোটেলে আমাদের গরীব ঘরের রান্না ওনাদের গলা দিয়ে নামবে না।
কেনো জিদ করছো অকারনে,আমরা কি তাদের লেভেলের নাকি??

মাঃ বুঝছি।

মা যে কি বুঝছে তা আমি টের পেলাম পরের দিন।

পরেরদিন অফিসে যাওয়ার পরেই দেখি মা হাজির অফিসে।
আমি বুঝে গেছি মা কেনো এসেছে।

আমি তাকিয়ে দেখছি মা আমার সামনে দিয়ে বসের কেবিনে যাচ্ছে কিন্তু আমার কিছু করার নাই এখন আর।

কিছুক্ষণ পরে মা বের হয়ে এলো, মুখটা হাসিহাসি।

মা যেতেই বসের ফোন,কেবিনে ডেকেছে।

আমার হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো।

আস্তে আস্তে গেলাম।

বসঃ বসুন প্লিজ।

কোনোমতে বসলাম আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে,বস এখন কি বলবে আমাকে??

বসঃ নিন পানি খান,গলা শুকিয়ে গেছে মনে হয়।

আমিঃ না আমি ঠিক আছি।

বসঃ একটু আগে কে এসেছিলো দেখেছেন??

আমিঃ জ্বী হ্যাঁ, আমার মা।
বস আমি সরি,আমার মা হয়তো আপনাকে আমাদের বাসায় যেতে বলেছে,কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি মা’কে অনেক বুঝিয়েছি।
আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত, সমস্যা নাই আপনার যেতে হবে না আমি মা কে বুঝিয়ে বলবো

বসঃ আপনার আর কিছু বলার আছে?

আমিঃ জ্বী মানে না বস

বসঃ আমি আগামী শুক্রবারে যাচ্ছি।
দয়া করে আমাকে টেক্সট করে দেন এড্রেস টা।

আমি এড্রেস টেক্সট করে দিয়ে মন খারাপ করে বের হয়ে এলাম।

বসকে সমাদর করার মতো কিছুই তো নেই আমাদের।

এই কয়েকদিন সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা পাচ্ছি না,আমার খুব অস্থির লাগছে কেনো যেনো।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বাসায় যেতেই দেখি মা রান্নাঘরে,বাজার ঘোচাচ্ছে।

আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “জমিদার বেটি,বাজার গুলো আলাদা করে পাঠানো লাগে সাথে করে নিয়ে আসলে কি আপনার ইজ্জত কমে যেতো??”

আমি বুঝতে পারলাম সে আছে এখনো।
আমার মন ভালো হয়ে গেলো হঠাৎ করেই এখন আর তাকে আমি ভয় পাই না,বরং তার উপস্থিতি টের না পেলে আমার একা লাগে খুব।

শুক্রবার সকাল থেকেই মা রান্নায় লেগে গেলেন,বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা’কে এতো উৎসাহ নিয়ে রান্না করতে দেখি নি।মায়ের এরকম হাসোজ্জল মুখ অনেক দিন পরে দেখলাম।কেনো জানি খুব ভালো লাগছে দেখতে।

কিছুক্ষণ পরেই বসের কল এলো।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম
বসঃ ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছেন?
আমিঃ জ্বী ভালো।
বসঃ আমি কি সাথে করে একজন গেস্ট নিয়ে আসতে পারি,যদি কিছু মনে না করেন আপনারা??

আমিঃ অবশ্যই পারেন,একজন কেনো,আর কেউ থাকলে ও আনতে পারেন প্রব্লেম নাই।
বসঃ না আর কেউ নেই,আমার একজন স্পেশাল মানুষ আসবে আমার সাথে। আচ্ছা রাখছি,একটু পরেই বের হবো আমরা।

আমি মা’কে গিয়ে রান্না ঘরে বল্লাম

মাঃ মনে হয় বৌ নিয়ে আসবে,ভালোই হবে।আসুক না,আয়োজন তো কম করছি না।

আমি অনুকে সাজিয়ে দিলাম।নিজে কি সাজবো ভাবছি।
আমি অপেক্ষা করছি সে পছন্দ করে দেয়ার জন্য। কেনো জানি আমি দিন দিন তার উপর নির্ভর হয়ে যাচ্ছি।

আমার ধারণা মিথ্যা না একটু পরেই সেই ঘ্রাণ টা ফিরে এলো,আমার বিছানার উপর একটা হলুদ শাড়ি।
তারপর আবার সে মিলিয়ে গেলো।

আমিও শাড়ি পরে নিলাম।

কিছুক্ষণ পরেই কলিংবেলের শব্দ শুনে গেলাম,দরজা খুলতেই দেখি বস সাথে একজন মুরুব্বী দাড়িয়ে আছে। সাথে অনেক ফলফলাদি,মিষ্টি,অন্যান্য প্যাকেট।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম
মুরুব্বিঃ ওয়ালাইকুম সালাম।
বসঃ উনি আমার বাবা,আমার বস।

আমি হা করে রইলাম,আমি কখনো ভাবতেই পারি নি বড় বস কে নিয়ে আসবে উনি।

আমিঃ জ্বী স্যার আসুন,ভিতরে এসে বসুন।

ওনাদের কে বসার রুমে বসতে বলে আমি রান্নাঘরে গেলাম মায়ের কাছে। অনু ততক্ষণে ওনাদের সাথে গিয়ে গল্প জুড়ে দিছে।

মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করছি,সব রান্না শেষ এখন সব ঘুচিয়ে নিচ্ছি।
এক ফাকে গিয়ে ওনাদেরকে নাশতা দিয়ে এলাম।

সব রেডি করে ওনাদেরকে খাবার টেবিলে ডাকতে এসে যা দেখলাম তার জন্য আমি একটু ও প্রস্তুত ছিলাম না।

অনু বড় বসে পিঠের উপর উঠে বসে আছে,উনি ঘোড়া হয়ে বসে আছে,বস বসে বসে হাসতেছে,আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম,এভাবে বাবা আমাদের পিঠে নিতো,সেই ছোটো বেলায় এভাবে বাবা ঘোড়া হতো আমার জন্য,অনু বাবাকে খুব একটা কাছে পায় নি,অনুর ৩ বছর বয়সেই বাবা মারা যায়,এখন অনুর ৭ বছর।

আমিঃ ছি!! অনু কি করছো তুমি,নেমে এসো,উনি আমার বড় স্যার,তুমি এ কি করলে???
বড় স্যারঃ এই মেয়ে তুমি ওকে বকছো কেনো,আমি ওকে বলেছি আমার পিঠে উঠতে কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো।
আমিঃ স্যার কি বলছেন আপনি,ওর কতো বড় স্পর্ধা!!

বসঃ আমার তো ভালোই লাগছে,আমি মানুষ টা বড় নিসঙ্গ,সারাদিন ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম,একটা মাত্র ছেলে,ছেলেটা বড় হওয়ার আগেই ওর মা কে হারিয়ে ফেললাম তার পর আর কোনোদিকে খেয়াল দিই নি,রাফিকে নিয়েই জীবন পার করে দিছি।

বাসায় কেউ নেই যে সময় কাটাবো তাই আজ রাফি আসার সময় বল্লাম আমাকে ও নিয়ে আসতে।
তুমি মা ওকে বকা দিও না,আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে।

আমি ছোট স্যারের দিকে তাকালাম,ওনার চোখ দুটো কেমন ভেজা ভেজা।

আমিঃ খেতে আসুন স্যার।
বড় স্যারঃ তুমি আমাকে আংকেল বলে ডেকো আমি তো তোমার অফিসের বস না,আমার সাথে ফর্মালিটি করতে হবে না
আমিঃ জ্বী স্যার।
বড় স্যারঃ কি বল্লে??
আমিঃ সরি আংকেল।

সবাই মিলে খেতে বসলো,আংকেল কে দেখলাম তৃপ্তি সহ খেলো,মা নিজে সবাইকে পরিবেশন করছে।
কিন্তু বসের দিকে যতোবার তাকাচ্ছি ততোবারই আমার কেমন যেনো লাগছে,ওনার চোখে পানি,ওনি চোখের পানি লুকানোর জন্য খেতে পারছে না,লজ্জায় উপরে তাকাতেও পারছে না।
আমি একটা ট্যিসু হাতে নিয়ে বসের পাশে গিয়ে দাড়ালাম,টেবিলের নিচ দিয়ে ওনার দিকে ট্যিসু বাড়িয়ে দিলাম,উনি হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিলো,তারপর মাথা উপরে উঠালো।

ভালো করে খেতে ও পারলো না।কি জানি হয়তো রান্না পছন্দ হয় নি।আমার নিজেরই খুব লজ্জা লাগলো।

খাওয়া দাওয়ার পর আমি বারান্দায় গাছগুলো দেখতে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর বস এলো।

বসঃ ধন্যবাদ
আমিঃ কেনো স্যার?
বসঃ সবার সামনে আমাকে লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য,ট্যিসু এগিয়ে দেয়ার জন্য।
আমিঃ আপনার কি খাবার পছন্দ হয় নি স্যার,আপনি কিছুই খেলেন না।
বসঃ বিষয় টা সেটা না,আনন্দে কান্না এসে গেছে আমার।তোমার তো মা আছে,প্রতিদিন মায়ের হাতের রান্না খেতে পারো মায়ের আদর যত্নে দিন কাটে তোমার,তুমি অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে তোমাকে কল দিয়ে খবর নেয়ার মানুষ আছে,কিন্তু আমার মা নেই।তাই কান্না এসে গেছে,ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত আমার খাবার টেবিলে আমার পাশে কেউ দাড়িয়ে থেকে যত্ন করে খাওয়ায় নি আমাকে।
আমার যদি মা থাকতো,মা যদি ছেড়ে না যেতো তাহলে তো আমি ও এরকম মায়ের আদর পেতাম,আসলে মায়ের আদর কেমন হয় আমি জানি না সেটা।
তাই কান্না এসে গেছে।

আমিঃ মানুষ কে কখন মারা যায় তা কে বলতে পারে বলুন

স্যারঃ না অনিতা আমার মা মারা যায় নি,আমার মা বেঁচে আছে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।

আমিঃ বেঁচে আছে তাহলে কোথায়,তাহলে বললেন যে ছোটো বেলায় হারিয়ে ফেলেছেন??

স্যারঃ আমার মা আমি ছোটো থাকতেই অন্য কারো সাথে চলে গেছে বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে,বাবা তখন এতোবড় ব্যবসায়ী ছিলো না,তাই মা বাবাকে পছন্দ করতো না।
মা চলে যাওয়ার পর বাবার জিদ বেড়ে যায় দিন রাত পরিশ্রম করে বাবা প্রতিষ্ঠিত হন,আমাকে বাহিরে রেখে পড়ালেখা করান,ফলস্বরূপ আমি বাবা মার আদর পেলাম না।একটা নিঃসঙ্গ জীবন বাবা কাটাচ্ছে,আর আমি মা বাবা থেকে ও তাদের আদর ছাড়া দিন কাটাই,তাই আজ আন্টির আদর দেখে আমার কান্না এসে গেছে।

আমি ভাবতাম ওনারা কতো সুখে আছে কিন্তু আজ দেখছি ওনার তো সবচেয়ে বড় অভাব,আদর ভালোবাসার অভাব।

বিকেলে ওনারা চলে গেলো।

পরদিন অফিস যেতেই দুপুরে বস ডাকলো।
আমিঃজ্বী বস বলুন
বসঃ আপনি বাড়ি যান,আজকের জন্য আপনার ছুটি।
আমিঃ কিন্তু কেনো বস,আমার তো এখন কাজ আছে,আমার তো ছুটি লাগবে না।
বসঃ তবু ও যান আজ আপনার ছুটি দিলাম আমি।আর শুনেন,বাসায় গিয়ে এই প্যাকেট টা দেখবেন।

আমি কি করবো,প্যাকেট হাতে নিয়ে শেষে বাড়ি ফিরে এলাম।
অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই দেখি আংকেল বাসায়।আংকেল কে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম ।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম আংকেল।
আংকেলঃ ওয়ালাইকুম সালাম মা। যাও তুমি ফ্রেশ হও,আমি আপার সাথে কথা বলতে এসেছি।

আমি ভিতরে চলে এলাম।

মা কিছুক্ষণ পরে আমার রুমে এলো,মিষ্টি নিয়ে।

আমিঃ হঠাৎ মিষ্টি কেনো??
মাঃ নে খা,পরে বলছি।
আমিঃ বলবা তো আগে।
মাঃ খেতে পারস না তুই??
আমি খেলাম।
মাঃ সুখবর আছে।
আমিঃ কি??
মাঃ তোর বিয়ে ঠিক করে ফেললাম,তোর আংকেল সেই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে…
আমিঃ মানে কি,কার সাথে,আমাকে না বলে তুমি কিভাবে বিয়ে ঠিক করো??
মাঃ ছেলে কে,একটু পরেই দেখবি ছেলে আর ছেলের বন্ধুরা আসবে।
আমিঃ কি শুরু করছো তুমি,কি বলো এসব??
মাঃ হ্যাঁ আমি সব রান্না বান্না করে রেখেছি।আজকেই তোকেই রিং পড়িয়ে যাবে।
বসের দেয়া প্যাকেট টার দিকে তাকিয়ে মা বললো,এটা কিসের প্যাকেট?
আমিঃ বস দিছে কি জানি কি আছে

মা নিজেই খুললো প্যাকেট

মায়ের জন্য একটা শাড়ি,আমার জন্য একটা নীল শাড়ি,অনুর জন্য একটা জামা।

মাঃ নে তো যা,এই শাড়ি টা পর আজকে।
আমিঃ পারবো না,আমি অন্য শাড়ি পরবো।আমার শাড়ি পছন্দ করে দিবে একজন।
মাঃ কে দিবে পছন্দ করে??
আমিঃ না কেউ না,আমিই একটা পড়বো।
মাঃ তুই এই নীল শাড়ি টাই পড়বি,বেশী কথা বলবি না।

বলেই মা চলে গেলো।

আমি বিছানার দিকে তাকাতে দেখি একটা কালো শাড়ি।

আমি এখন কি করবো,নীল শাড়ি নাকি কালো শাড়ি, কোনটা পড়বো??

কালোটাই বেছে নিলাম।
মা এসে দেখেই রেগে গেলো,কালো শাড়িটি খুলে নিয়ে নীল শাড়িটি পড়িয়ে দিলো নিজেই।

আমার মনে হলো তাহলে বস জানতো আজকে আমাকে দেখতে আসবে,এজন্যই আমাকে ছুটি দিছে।

বাহিরে সবাই এলো,কথা শুনা যাচ্ছে। একটু পর বাহিরে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখি বস সহ অনেক ছেলে বসে আছে।ছেলে তাহলে বসের বন্ধু কেউ।
সবাই নীল পাঞ্জাবি পরা।

কিন্তু পাত্র কে??
সবার পাঞ্জাবির দিকে তাকাতেই একটা পাঞ্জাবি চেনা লাগছে,আমার শাড়ির ডিজাইন আর পাঞ্জাবির ডিজাইন একই রকম।
তাহলে সেই পাত্র।
মুখের দিকে তাকাতেই আমি তাকিয়েই রইলাম।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here