নীলচে তারার আলো,সূচনা_পর্ব
নবনী_নীলা
হিয়া ঘরে এসেই দরজা বন্ধ করে দিল। প্রচন্ড গরম লাগছে তার,এক্ষুনি একটা গোসল দিতে হবে। হিয়া ব্যাগটা এক পাশে রেখে সবে মাত্র জামার চেইনটা হাল্কা খুলতেই কেউ বলে উঠলো,” এই মেয়ে কে তুমি? আমার ঘরে কি করছো?”
ভারী আওয়াজটা যে, কোনো ছেলের সেটা বুঝতেই হিয়ার বুকটা কেপে উঠলো। শক্ত করে জামার খোলা অংশ চেপে ধরে ঘুরে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো সে। কোমরে তোয়ালে জড়ানো একজন কপাল ভাজ করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার গায়ে মুক্তোর মতন পানির বিন্দু চিক চিক করছে। ভেজা চুলগুলো কপালে এসে পরেছে। হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে জামার অংশটি আরো শক্ত করে চেপে ধরে পিছাতে লাগলো। ছেলেটি আরেকটু এগিয়ে এসে চেয়ারের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে শক্ত চোখে বললো,” কি হলো এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? কে তুমি? আমার রুমে এসেছো কেনো?”
ছেলেটার কথাটার গম্ভির্যতায় হিয়ার অসস্তি হচ্ছে। সে কি ভুল করে অন্যকারোর রুমে চলে এসেছে? তাকে তো বলা হয়েছে দোতলার ডান দিকের শেষের ঘরটা। হিয়া ঘাবড়ে গেলো, একে তো কে না কে,তাও আবার ঘরে তোয়ালে পরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। হিয়া পিঠের চেইনটা কোন ভাবে লাগাতে পারলেই দৌড় দিয়ে বের হয়ে যাবে। নইলে এভাবে বের হবে কি করে? যদি বদ লোক হয়, তোয়ালে পরে ঘুরে বেড়ানো ছেলে আর কতই বা ভদ্র হবে।
হিয়া চুপ করে থাকায় শুভ্র এবার রেগে গেলো। কোথা থেকে একটা মেয়ে তার ঘরে এসে এভাবে দাড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে তারও জবাব নেই। এমনিতেই তার রূমে সে কাউকে আসার অনুমতি দেয় না তারওপর কালকে থেকে তার মেজাজও বিগড়ে আছে। এই মেয়ে কি কথা বলতে পারে না? শুভ্রর বিরক্তি লাগছে, সে ধমকের সাথে বলে উঠলো,” কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো? Get out from here”
শুভ্রর ধমকের সাথে হিয়ার বুক কেপে উঠলো। লোকটা এভাবে হুংকার দিচ্ছে কেনো? সে কি চুরি করতে এসেছে নাকি। চেইনটাও বদজ্জাত এই মুহুর্তেই খারাপ হতে হলো। হিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। অসহ্য লাগছে নিজেকে, না দেখেই রূমে চলে এসেছে সে।কোনো উপায় না পেয়ে চুল খুলে পিঠটা ঢেকে দিয়ে, তাড়াহুরোয় বের হতে গিয়ে দরজার সাথে বাড়ি খেলো। দরজাটা দেখি এই লোকটার মতন হুট করেই পিছনে চলে এলো। অসহ্য!
হিয়া বের হয়ে আসতেই শুভ্র সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো। সে শব্দে যেনো পুরো বাড়ি কেপে উঠলো। এই লোকটা এমন কেনো? হিয়া বিরক্তির একটা নিশ্বাস ফেললো পরক্ষনেই মনে পড়লো রূমের ভিতরে তার ব্যাগটা সে ফেলে এসেছে। এবার! উফফ, নিজেকেই নিজের চর মারতে ইচ্ছে করছে তার। আবার তোওয়ালে ওয়ালাটার চেহারা দেখতে হবে! হিয়া কোনো উপায় না পেয়ে দরজায় টোকা দিলো। খুব আস্তে করেই দিলো। কোনো সাড়াশব্দ এলো না ভিতর থেকে। আরো একবার টোকা দিলো। হিয়া এবার হাত কচলাতে শুরু করলো। লোকটা কি বয়রা নাকি? দরজায় নক করা হচ্ছে শুনতে পাচ্ছে না? সে কি আবার নক করবে? যদি আবারো চেঁচায়? আর না ভেবেই হিয়া আবারো দরজায় টোকা দিতেই রাগী চোখে শুভ্র দরজা খুললো। পরনে এখনো তোয়ালে, মাথার চুলগুলো হাল্কা ভেজা। শুভ্র স্থির চোখে জিজ্ঞেস করলো,” কি চাই তোমার? জ্বালাচ্ছ কেনো আমাকে?”
শুভ্রর কথা শুনে হিয়ার ভ্রু কুচকে গেলো। রাগও হচ্ছে প্রচুর কিন্তু রাগটা সে চেপে গেলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ঘরের ভিতরে ঈশারা করে নিচু গলায় বললো,” আমার ব্যাগটা।”
” what?”, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো শুভ্র। মেয়েটা কথাও বলতে পারে! বাহ্। কিন্তু হিয়া এতো নিচু স্বরে বললো যে শুভ্র কিছুই বুঝলো না। ভারী যন্ত্রণা করছে মেয়েটা।
হিয়া একটা ঢোক গিলে বললো,” আমার ব্যাগটা আপনার রূমে ফেলে এসেছি।”
” হ্যা, তাহলে সোজাসুজি বললেই পারো ব্যাগ লাগবে। আমার সময় নষ্ট করছো কেনো? আমার সময়ের দাম আছে।”, বলেই শুভ্র ব্যাগ আনতে ভিতরে চলে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
এই বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে থেকেই হিয়ার অসস্তি বাড়ছে। এইটা তার শ্বশুরবাড়ি আইনত সেটাই। যা তার অসস্থির মূল কারণ। সে হয়তো পৃথিবীর প্রথম মেয়ে যে কিনা কার সাথে তার বিয়ে হয়েছে, সেটা বিয়ের দুদিন হবার পরও জানতে পারলো না। মানুষটা দেখতে কেমন সেটাও সে জানে না। নিয়তির এক অদ্ভুত খেলার পুতুল এখন সে। নিয়তি তার সাথে যা খেলবে তাকে সেটাই মেনে নিতে হবে।
দুবছর আগে গাড়ী অ্যাকসিডেন্টে হিয়া তার বাবা, মা ও ছোট ভাইটাকে হারিয়েছে। খুব সচ্ছল ফ্যামিলির মেয়ে হলেও মা বাবার মৃত্যুর পর তার জায়গা হয়েছিলো ছোটো মামার বাড়িতে। ছোটো মামা খুব ভালো মানুষ হলেও মামীর দুচোখের বিষ ছিলো হিয়া। মামা তাকে কলেজে ভর্তি করাতে চাইলো মামীর অশান্তিতে মামা আর সাহস করলো না। এসএসসিতে গোল্ডেন পাওয়া হিয়ার আর কলেজে পড়া হলো না। কতো রাত সে যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সেটা শুধু সে জানে। মামীর মুখে এমন সব কথা সে শুনেছে যেটা শুনার পর বহুবার সে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে।
তারপর হুট করে তার এমন বিয়ের ঘটনা। যা এখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। কয়েকদিন আগে বাবার এক বন্ধু তার খোজ নিতে তার মামার বাড়িতে আসে l লোকটাকে তার চেনা চেনা লাগলো বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন রবীউল আংকেল। ক্লাস সেভেনে থাকতে হয়তো তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। মামা চিনতে পেরে বেশ যত্নআত্তি করলেন। হিয়ার ধারণা মামাই রবীউল আংকেল কে বলেছে যে করে হোক তাকে যেনো এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ ছোটো মামা হিয়াকে প্রচুর স্নেহ করে। এর ফলস্বরূপ হয়তো মামীর অমতেই এই বিয়ের আয়োজন। বিয়ের পর তার মামাতো বোন রূপা এসে বলেছিলো তার বর নাকি খুব সুন্দর দেখতে। কিন্তু হিয়ার সেটা মনে হয় না হবে হয়তো কোনো দাড়িওয়ালা বুড়ো ব্যাটা। কিন্তু হিয়ার বিয়ে যে রবীউল আংকেলের ছেলের সাথে হয়েছে সেটা সে বিয়ের পর জানতে পারে। ওনার ছেলেটাও কি বুড়ো? হবে হয়তো। সেটা এখণ ভেবেই বা কি হবে।
হিয়া অনেক্ষন হলো দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে লোকটার দরজা খোলার নাম নেই। লোকটা ইচ্ছে করে তাকে দাড় করিয়ে রাখে নি তো? আর কতক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকতে হবে! এতক্ষণে রহিমা খালা চলে এলো। হিয়াকে এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে ছুটে এলো চিন্তিত গলায় বলল,” আহা রে, এইখানে দারাইয়া আসেন কেনো? আপনারে তো কইলাম শেষের রুমটা আপনার। চুলায় ভাত বসানো আসিলো, এই জন্য দেরী হইসে আইতে।”
” কিন্তু শেষের রুমটায় তো তালা দেওয়া।”, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো হিয়া। রহিমা খালা মাথায় হাত দিয়ে ফেললো,” আহা রে, আমি তো চাবি আনতেই ভুইল্যা গেসি। একটু কষ্ট কইরা খাড়ান।”, বলেই তিনি সিড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চাবি হাতে উপড়ে উঠে রুমটা খুলে দিল হিয়াকে তারপর বললো,” এইটা অখন থেকে আপনার রুম। আইচ্ছা আমি যাই বড় সাহেব বলছে আপনার খাবারের বেবস্থা করতে।” বলেই তিনি ছুটতে লাগল। মহিলাটাকেই হয়তো এ বাড়ির সব কাজ করতে হয়, ভেবেই হিয়ার মায়া লাগছে।
রুমটা হিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে কারণ সঙ্গে কি সুন্দর লম্বা একটা বারান্দা। এই ঘরটা কি লাইব্রেরী ছিলো? বিশাল একটা বুকশেলফ। একপাশে একটা বেড তার পাশে সুন্দর একটা টেবিল। রুমটা ভালো কিন্তু তার ব্যাগ? হিয়া রুম থেকে বাহিরে এসে আবার তাকালো, দড়জাটা এখনো বন্ধ। কি করবে এবার সে! এই রূমে তালা মারা ছিলো তাই সে ঐ রূমে ঢুকেছিল। কে জানতো যে এমন বিপদ হবে?
হিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। লোকটা তাকে আর কতক্ষন দাড় করিয়ে রাখবে কে জানে? দরজায় আরেকটা টোকা দেওয়া দরকার। হিয়া এগিয়ে গিয়ে আরেকবার নক দেওয়ার আগেই হুট করেই দরজা খুলে লোকটা বের হয়ে এলো। পরনে এখন আর তার তোয়ালে নেই নেভী ব্লু শার্ট আর জিন্স। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর হাতে একটা সাদা এপ্রন। চশমার কারণে চেহারায় যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে। চশমা পড়ার পর কি সব ছেলেই এমন সুন্দর হয়ে ওঠে? এক মিনিট সে এসব কি ভাবছে? ছি: ছি! এই লোকটা তাকে এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখে,এখন সেজেগুজে বের হয়েছে। একটা মেয়ে যে বাহিরে দাড়িয়ে আছে সেটা সে একবারও ভাবলো না! হিয়া গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,” আমার ব্যাগ?”রাগ তো তার প্রচুর হচ্ছে কিন্তু সেটা দমিয়ে রেখেছে সে।
” কে তুমি?”, দুই হাত গুজে প্রশ্ন করলো শুভ্র। শুভ্রের এই ব্যাবহার হিয়ার রীতিমত অসহ্য লাগছে। মানছে যে ভুল করে সে তার ঘরে এসেছিল তাই বলে এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখে আবার প্রশ্ন করবে সে কে? হিয়া চাইছে না রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে কারণ উনি হয়তো এই পরিবারেরই কেউ। কিন্তু এবার তার কপালে ভাঁজ পড়ল কথা না বাড়িয়ে হিয়া আবার নিজের ব্যাগ চাইতেই শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো হিয়ার দিকে। হিয়া বিরক্তি নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কতক্ষন! লোকটা চাইছে টা কি?
শুভ্র কিছুক্ষণ পর নিজের রুম থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসে সজোরে মেঝেতে ফেললো। হিয়া চমকে তাকালো। লোকটার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ সে বুঝে উঠতে পারছে না। হিয়ার চোখে পানি চলে এলো। এই ব্যাগে তার বাবা মার ছবি ছিলো কথাটা মনে পড়তেই রাগে তার শরীর কাঁপতে লাগলো। লোকটার সাহস কত বড়! হিয়া প্রচন্ড রেগে বললো,” আপনি ব্যাগটা নীচে ফেললেন কেনো এভাবে? মানছি ভুল করে আপনার রূমে গিয়েছিলাম তাই বলে আপনি এমন দুর্ব্যবহার করবেন? ঐ ব্যাগে আমার…..”
বাকিটা বলে শেষ করার আগেই শুভ্র এগিয়ে এসে কড়া গলায় বললো,” ভুল করে এসেছো নাকি ইচ্ছে করে? অবশ্য তোমার মত মেয়েদের থেকে আর কি ই বা এক্সপেক্ট করা যায়? শুনে রাখো এইসব নোংরা ট্রিকস আমার উপর কাজ করবে না…।”
শুভ্র আরো কিছু বলার আগেই রবীউল সাহেব প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলো,” শুভ্র…! মুখ সামলে কথা বলো।” তিনি হিয়ার খোজ নিতে উপরে আসায় শুভ্রের বলা সব শুনে ফেলেন। প্রচন্ড রেগে আছেন তিনি।
কিন্তু শুভ্র সে ধমক গায়ে মাখলো না ” আমাকে বলে লাভ নেই। বিয়েটা আমি তোমার কথায় বাধ্য হয়ে করেছি তার মানে এই না যে এই মেয়েকে আমি বউ হিসাবে মানবো। আমার জীবনটা তোমার হাতের মোয়া নয়। আমি সেটাই করবো যেটা আমার ইচ্ছে। তাই এইসব ট্রিকস খেলা বন্ধ করে দিও” বলেই রাগী চোখে একবার হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বেড়িয়ে গেলো। হিয়া অবাক হয়ে শুভ্রর চলে যাওয়া দেখছে। এই লোকটার সাথে তার বিয়ে হয়েছে? ভাবতেই সাড়া শরীর শিউরে উঠলো তার।
[ চলবে ]