নিরব সে,২২শ পর্ব,২৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
২২শ পর্ব
–আমাকে সব বল, এতদিন যেই কথাগুলো বলতে চাইছিলে।
–আমি বলব, ডাক্তার সাহেব?
নিজের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আরেকটা উত্তর পেয়ে খুশি হল না ওয়াফিফ। সে রেগে গেল। তবু নিজের রাগ কমাতে চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজের মনে মনে কয়েকবার বলল –
”এতদিন আমি ওকে ভুল বুঝেছি, ও রাগ করতেই পারে। ওকে? কিন্তু আমার রাগ করা যাবে না।”
তারপর চোখ খুলল সে। সামনে জিনিয়াকে দেখে এই প্রথমবার তার অন্যরকম অনুভূতি হল। চাঁদের আলো না হোক, লাইটের আলোতেও খারাপ লাগছে না। আগেও জিনিয়াকে অনেকবার দেখেছে সে। কিন্তু এভাবে ভেবে দেখে নি ওয়াফিফ। সে হা করে তাকিয়ে রইল জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া নিজেও ওয়াফিফ কে অনেকদিন পর সামনাসামনি দেখে কান্না করবে করবে অবস্থা। তার চোখের কোণে পানি জমছে। কিন্তু তবুও কান্না করছে না। করবে কেন সে? এতদিন ধরে একবারও খোঁজ নেয় নি ওয়াফিফ। তার সামনে নিজেকে দুর্বল হিসেবে জিনিয়া নিজেকে প্রকাশ করতে রাজি নয়।
ওয়াফিফ এর ধ্যান তখন ভাঙল যখন ওর মুখের সামনে দিয়ে একটা মাছি ভনভন করতে করতে উড়ে গেল। এমন রোম্যান্টিক সময়ে অন্য মিউজিক শুনে তার খেয়াল হল সে কোথায় আর কেন এসেছে। এবার সে নিজের মনে মনে মাছিটাকে এই জন্য ধন্যবাদ জানালো যে সে খোলা মুখ পেয়ে মুখের ভিতর ঢুকে যায়নি। ভদ্র মাছি।
তারপর সে আবার জিনিয়ার সামনে ঠিক হয়ে দাঁড়াল। জিনিয়াকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে পড়ল। জিনিয়া তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে ওয়াফিফের কি হয়েছে। ওয়াফিফ কথা বলা শুরু করল,
–জিনিয়া দেখো…
বলেই কি দিয়ে কথা শুরু করবে সেটাই ভাবতে থাকল ওয়াফিফ। জিনিয়া তার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে আছে। ওয়াফিফ মাথা তুলে আবার জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–কি?
জিনিয়া এর জবাব দিল,
–আপনিই তো বললেন দেখতে, তাই দেখছিলাম।
–তুমি … তুমি না। আচ্ছা, জিনিয়া, এবার সিরিয়াস একটা কথা বলি, মনোযোগ দিয়ে শুনো। তুমি সেদিন জাবিরের সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলে, কিন্তু আমি দেখিনি। আর পরে চেকও করা হয় নি কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি জাবিরের কাছে ফিরে যেতে চাও। আর এটা ভাবার কারণ তার কিছুদিন আগে ছবি ফিরে এসেছিল আর ওর কথা মনে পড়াতেই আমার মনে ভয় চলে আসে যে তুমিও আমার সাথে একই কাজ করবে, সেই জন্যই আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। বলতে গেলে তোমার প্রতি অভিমান হয়েছিল আমার। তাই আমি ওরকম ব্যবহার করে ফেলেছিলাম তোমার সাথে। এমন করা উচিত হয় নি। আমার ভেবে দেখা উচিত ছিল। সব বিচার বিবেচনা করে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তখন ওই পরিস্থিতিতে ছিলাম না, তাই তোমার উপর নিজের সব রাগ ঝেড়ে ফেলেছিলাম। আমি অমনটা করতে চাই নি। কিন্তু তোমার সাহে জাবিরকে দেখার পর আমার আরও বেশি রাগ হয়েছিল। তাই আমি কি করেছি না করেছি আমি নিজেই জানি না আর…
ওয়াফিফ আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিনিয়া ওয়াফিফকে জড়িয়ে ধরল। জিনিয়ার জন্য এতটুকু কথাই অনেক ছিল। জিনিয়া শুধু এটাই চাচ্ছিল যেন ওয়াফিফ তাকে বিশ্বাস করে। আর সেটা ওয়াফিফ করেছে। শুধু বিশ্বাস করে নি, জিনিয়াকে নিজের কাজের ব্যাখ্যা দেওয়াকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছে, সে চেয়েছে জিনিয়াকে নিজের কথা বলার সুযোগ দিতে। এটাই অনেক। জিনিয়া আজ ওয়াফিফের বুকে নিজের মুখ লুকিয়ে কান্না করে দিল। কিন্তু এবার জাবিরের জন্য না, ওয়াফিফের জন্য। বেশ কিছু সময় কান্না করার পর জিনিয়া ধীরে ধীরে শান্ত হয়। তবুও সে ফুঁপিয়ে চলেছে। আর ওয়াফিফ তাকে সামলাচ্ছে। জিনিয়া নিজেকে ঠিক করে সেভাবেই বসে রইল। ওয়াফিফ জিনিয়াকে আগের থেকে ভালো অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল,
–এখন ঠিক লাগছে?
–হুম।
–এবার আমাকে বলবে কি বলতে চেয়েছিলে?
–হুম।
–তুমি এতদিন আমার থেকে দূরে থেকেও হুম এর থেকে বেশি কিছু বলা শিখতে পারলে না জিনিয়া।
–হুম।
বলেই যখন জিনিয়া বুঝতে পারল ওয়াফিফ তাকে কি বলেছে সে ওয়াফিফের বুকে হালকা ঘুষি মারল। ওয়াফিফ ও নিঃশব্দে হেসে দিল। সে আবার বলব,
–আর এই নিয়ে তুমি আমার থেকে আলাদা থাকতে এসেছিলে যাতে নিজের কি কি বলতে চাও সেটার জন্য সাহস জোগাড় করতে পারো।
–আপনি জানলেন কি করে?
–তোমাকে আমি তোমার থেকেও ভালো বুঝি জিনিয়া, শুধু আমাকে তুমি বুঝলে না, আর ওই বাড়িতে একা ফেলে চলে আসলে।
হতাশ সুরে বলে উঠল ওয়াফিফ। ওয়াফিফের বলার ধরন শুনে জিনিয়া আবার হেসে ফেলল।
–আমি আপনাকে একা ফেলে আসলাম মানে?
–এই তো, আমাকে একা রেখে নিজের বাবার বাড়ি চলে এলে।
–আপনি না…
–আমি কি?
–উহুম।
–এখন আবার উহুম মানে কি?
–উহুম।
-আচ্ছা, বুঝছি। তুমি হুম থেকে উহুম বলা শুরু করেছ।
–উহুম।
একটু রেগে বলে উঠল জিনিয়া। ওয়াফিফ এবার বলল,
–আচ্ছা আর জ্বালাচ্ছি না। এবার তো সব বলে ফেলো। রাত অনেক হয়েছে। বেশি রাত জাগা তোমার জন্য ঠিক না। আর আজ রাতে না বলতে পারলে তুমি ঘুমাতেও পারবে না। তাই ঝট করে বলে ফেলো তো জিনিয়া।
-তেমন কিছু না। কয়েক দিন ধরে জাবির বার বার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি না করেছি। সেসব আপ্নাকেও বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপনি আমার কোন কথাই শোনেন নি। আর তারপর আমার বান্ধবী রাইসার সাথে কথা বলি। ও আমার আর জাবিরের সম্পর্কে সব জানত তাই। ও আমাকে বলে এক দিনে কথা বলে সব শেষ করতে। আমিও তাই মনে করি। এজন্য আপনার কাছে অনুমতি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখনও আপনি আপনার ছবির সাথে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আমি আমার বান্ধবিকে নিয়ে সেখানে যাই । আর সব কথা শেষ করি। জাবির আর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
–তোমার বান্ধবী কোথায় ছিল? আমি তো শুধু তোমাদের দুজনকে দেখলাম।
–আসার আগে ও ওয়াশরুমে গিয়েছিল। তখন দেখে থাকতে পারেন।
–বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি জেলাস জিনিয়া? তখন যেভাবে বললে, আমার ছবি।
–হুম।
–সিরিয়াসলি?
–না না। আমি কেন জেলাস হবো। আমি কিছু না। কিন্তু আপনি আমাকে জাবিরের সাথে দেখে রেগে গিয়েছিলেন?
–মেইবি আমি জেলাস ফিল করেছিলাম।
–অ্যা ।
–অ্যা না, হ্যাঁ, হতেই পারে, তুমি আমার ১০ টা না, ৫ টা না , একটা মাত্র বউ হও, তোমাকে নিয়ে জেলাস হবো না তো কাকে নিয়ে হবো?
–জানি না।
–আচ্ছা, আজ আল তোমাকে জ্বালাচ্ছি না, কাল থেকে আবার হবে। এখন আমি যাই, কাল নিতে আসব। ব্যাগ গুছিয়ে রেখ। আর যদি এখানে থাকার প্ল্যানিং করে থাক তাহলে বলে দিচ্ছি, আমিও এখানে তোমার সাথে থেকে যাবো। কিন্তু মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার। বাই বাই। দরজা লাগিয়ে দেও।
বলেই এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা না করে ওয়াফিফ চলে গেল। জিনিয়া কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বুঝল আসলে এতক্ষণ কি কি হল। তারপর সে গিয়ে দরজা লাগিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল।
।
।
।
৪ মাস পর,
–জিনিয়া, এই জিনিয়া, কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি রেডি হও, আমাদেকে হাসপাতালে যেতে হবে।
–আসছি।
–হ্যাঁ, তো সেটাই বলছি, আসো না।
ওয়াফিফের কথা বলতে বলতে জিনিয়া হাজির। ওকে ধরে রেখেছে আফিয়া রহমান। আফিয়া রহমানই ওকে রেডি হতে সাহায্য করছিলেন। ওয়াফিফ জিনিয়াকে দেখে আবার হা করে রইল। আফিয়া রহমান সেটা দেখে আসতকরে থাপ্পড় মারলেন ছেলের গালে।
–মুখ বন্ধ কর, আর আলহামদুলিল্লাহ্ বল, হা করে তাকিয়ে না থেকে।
–মা।
–কি মা? এটা আমার মেয়ে আর তুই আমার ঘর জামাই।
–মা।
–এতো ম্যা ম্যা করিস না তো, ছাগল বলে ডাকবে সবাই।
–আম্মাজান।
–আচ্ছা, যা এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে না। আর সাবধানে যাবি। জিনিয়াকে না নিয়ে গেলে হত না, দরকার হলে ডাক্তার ঘরে আনতে পারতি।
–নাহ মা, ঘরে আনলে শুধু ডাক্তার না, পুরো হাসপাতাল তুলে আনতে হবে চেক আপের জন্য। তাই তোমার বউ মা কে সরি, মেয়েকে নিয়ে যাই ? সাবধানেই নিয়ে যাবো।
–কিসের ডাক্তার হয়েছিস তুই? নিজের বউ এর চেক আপ করে দিতে পারলে তো আর ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগত না।
–আর অপমান করো না মাতা, অলরেডি বোটম লাইন পার করে গিয়েছে। জিনিয়া চল, নাহলে পুরো এলাকা ডেকে এনে এবার আমার সুনাম শুরু করবে মা।
বলেই জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে গেল ওয়াফিফ। জিনিয়ার এখন ৮ মাস চলছে। ওয়াফিফ আর জিনিয়া ছাড়া কেউ জানে না যে এটা ওয়াফিফের সন্তান না। তবুও ওয়াফিফ যেভাবে জিনিয়ার খেয়াল রাখে, একবারও মনে হয় না যে ওয়াফিফ আসল বাবা না। জিনিয়াও রোজ শুকরিয়া জানায় সৃষ্টিকর্তাকে। আর রোজ ভয়ে ভয়েও থাকে। তবু কিছু বলে নি কারণ ওয়াফিফ তাকে চুপ করে থাকতে বলেছে। ওয়াফিফ তো এই কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছে যেন।
জিনিয়াকে নিয়ে চেক আপে যাওয়ার জন্য ওয়াফিফ আবার ড. আফসানা রায়ের কাছে গেল। উনি জিনিয়ার সম্পর্কে সব জানেন। আর ওয়াফিফের বন্ধু হওয়ায় আজ পর্যন্ত সব গোপন রেখেছেন।
অন্যদিকে ওয়াফিফের হাসপাতাল থেকে একটা ব্যাগ দিয়ে যায় ওয়াফিফের এক কলিগ। বাসায় আফিয়া রহমান ছিলেন শুধু তাই তিনিই সেটা নিয়ে নেন। ওয়াফিফের ঘরে রেখে আসার সময় সেটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় আফিয়া রহমা সেটা এক এক করে আবার ব্যাগে রাখতে শুরু করেন। সব ছিল পেশেন্টের রিপোর্ট। হঠাৎ একটা কাগজে জিনিয়ার নাম দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি ভালো করে চোখ বুলালে নিজেই অবাক হয়ে যান। সাথে রাগ এসে ভর করে তার মধ্যে।
চলবে।
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
২৩শ পর্ব
ওয়াফিফ জিনিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকছিল। দরজায় বেল বাজাতেই আফিয়া রহমান সাথে সাথে দরজা খুলে দেন। যেন তিনি দরজা খোলার জন্যই সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়িতে ঢুকতেই একটু শব্দ করেই আফিয়া রহমান দরজা বন্ধ করে দেন। ওয়াফিফ অবাক হলে প্রথমে তেমন পাত্তা দিল না। ওরা দুজন ঘরে যাচ্ছিল, এমন সময় আফিয়া রহমান আটকালেন ওদের। ওয়াফিফ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আফিয়া রহমান টেবিলের উপর থেকে কাগজ নিয়ে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
–আজ তোর হাসপাতাল থেকে একটা ব্যাগ দিতে এসেছিল। সেটা হাত থেকে পড়ে গেলে ব্যাগে থাকা সব কাগজ পড়ে যায়। আমি সেটা গুছিয়ে রাখার সময় এটা পাই। এটা কি আমাকে বলবি?
জিনিয়া তখনও আফিয়া রহমানের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে ভাবছিল আসলে কি হয়েছে। কিন্তু যখন একটা কাগজ নিয়ে কথা বলতে দেখল তখনই ভয় পেয়ে গেল। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। কাগজটা কি সেই কাগজ?
ওয়াফিফ কিছুক্ষণ নিজের মায়ের দিকে তাকাল, তারপর নিজের হাতে থাকা কাগজের দিকে তাকাল। মাথায় একটু জোর দিতেই বুঝতে পারল বাড়িতে ব্যাগ আসার রহস্য। ওয়াফিফ কিছু রোগীর রোগ সম্পর্কে আরও গবেষণা করার জন্য সেগুলো ব্যাগে ভরে বাসায় পাঠিয়ে দিতে বলেছিল তার কলিগকে। সেগুলো নিয়ে রাতে চিন্তা করত সে। কিন্তু এর আগে সে জিনিয়ার রিপোর্টটার কি করা যায় সেটাই ভাবছিল। এটা রেখে দেবে নাকি নষ্ট করে ফেলবে সেটা নিয়ে দোটানায় ছিল সে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু সেটা করেও লাভ ছিল না। ওর মেডিকাল হিস্ট্রি চেক করলেই বোঝা যেত সব। তাই রেগে গিয়ে সেটা নিজের কেবিনের টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরেছিল। তারপর রোগীর রিপোর্ট আসে। রোগীতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেটা লকারে রেখে দেওয়ার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তার। এই জন্যই হয়তো তার কলিগ ভুলে সব কাগজ একসাথে ব্যাগে ভরে ওয়াফিফের বাসায় পাঠিয়ে দেয়।
নিজের ভুলে যাওয়ার রোগ কবে থেকে হল সেটাই ভাবছে ওয়াফিফ। একটাই উত্তর পেল, সে কি সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে যেমনটা জিনিয়া বলে? কিন্তু ৩১ তো তেমন বেশি বয়স না। সে চাইলেই এখন পিএইচডি ডিগ্রী নিতে পারবে। অবশ্য পড়ারও কোন বয়স হয় না।
আফিয়া রহমান ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে নিজে শান্ত হয়ে থাকতে পারলেন না। ছেলের এই রিপোর্ট দেখে যেমন কাজ করার কথা ছিল, তেমনটা না করতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে যান। ছেলে অতিরিক্ত পরিমাণে শক খেয়ে এমন অনুভুতিশুন্য হয়ে গিয়েছে কি না জানার জন্য ছেলেকে ডাক দেন,
–ওয়াফিফ।
–হ্যাঁ মা বলো।
–এসব কি?
–জিনিয়ার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট।
–এখানে কি লেখা আছে?
–জিনিয়া কবে থেকে প্রেগন্যান্ট।
–কবে থেকে?
–আমাদের বিয়ের ২ সপ্তাহ আগে থেকে।
নিজের ছেলের কাছ থেকে এমন ইন্টার্ভিউ এর মতো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আরও রেগে যান আফিয়া রহমান। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেন,
–এবার তুই এর মানেটা বুঝা আমাকে? কি করে কি হল? জিনিয়ার সাথে তোর আগে দূর দূর পর্যন্ত কোন যোগাযোগ ছিল না আমি জানি। বিয়ের আগে তোদের একবারও দেখা হয় নি। কিন্তু তোদের বিয়ের আগেই যেহেতু জিনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল তার মানে তার গর্ভে অন্য কারো বাচ্চা। কিন্তু কার আর কিভাবে? বিয়ের আগে কেন আমাদের এসব বলা হয় নি? আর এতদিন ও সবার কাছ থেকে লুকিয়েছে কেন? তুই ও তো এসব কিছুই জানতিস না? নাকি তুইও জানিস এসব? এতদিন ধরে যাকে নিজের বাচ্চা বললি সেসব কি তুই জানতি?
–হ্যাঁ মা, আমি জানতাম সব।
–তাহলে আমাকে কেন বললি না? কি এমন হয়েছে যার জন্য তুই এই কাজ করলি? আমাকে বোঝাতে পারবি?
আফিয়া রহমানের কথাগুলো খুব শান্ত কণ্ঠে বললেও সেগুলোর গভীরতা অনেক ছিল। তার সাথে আফিয়া রহমানের অনুভূতি মিশে ছিল যাতে রাগ অভিমান জমেছে, হয়তো কিছুটা ঘৃণাও। নিজের মায়ের কাছে এসব শুনতে হবে সেটা ওয়াফিফ আগেই জানত। জিনিয়া এসব শোনার পর থেকেই কান্না করে যাচ্ছে নিঃশব্দে। আফিয়া রহমান তার ছেলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সবটা জানার আশায়। ওয়াফিফ তার মা এর হাত ধরে সোফায় বসালো। তারপর গ্লাসে পানি ভরে সেটা আফিয়া রহমানের সামনে ধরল। আফিয়া রহমান প্রথমে না করলেও পরে ওয়াফিফের কথা শুনে এক ঢোকে পুরো পানি শেষ করে গ্লাসটা আবার ওয়াফিফের হাতে ধরিয়ে দিলেন। ওয়াফিফ গ্লাসটা টেবিলে রেখে আফিয়া রহমানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলতে শুরু করল,
–মা দেখো, আমি যা বলছি সব মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমার প্রশ্ন ছিল আমি এসব জানলাম কি করে? এর উত্তরে বলব, জিনিয়া আমাকে প্রথমেই সবটা জানিয়ে দিয়েছিল, আমাদের বিয়ের আগেই। গায়ে হলুদের দিন ও আমাকে কল করেছিল আমার সাথে দেখা করবে বলে। আমি ওর সাথে দেখা করার জন্য রাজি হই। ওইদিন ও সরাসরি নিজের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে সব জেনেই আমার সাথে দেখা করেছিল। সবার আগে ও কথাটা আমাকেই জানিয়েছিল। নিজের বাবা মা কিংবা যে সন্তানের বাবা তাকেও বলে নি ও। আমাকে ভরসা করে বলেছিল। আর আমি শোনার সাথে সাথে ওদের দুজনের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি প্রথমে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করলেও পরে আমি নিজে থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলাম, তাই বিয়ের কোন অনুষ্ঠানে কিছু বলিনি। এবার আসি তোমার আরেকটা প্রশ্নে, জিনিয়া কেন প্রেগন্যান্ট। জিনিয়া একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতো, ৩ বছর ধরে। কিন্তু হঠাৎ করেই ছেলেটার জিনিয়াকে ভালো লাগে না তাই সে চলে যায়। জিনিয়াকে তাকে সতিই অনেক ভালবাসত, তাই সে এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু ছেলেটা যে বিশ্বাস তাকে দিয়েছিল সারাজীবন খেয়াল রাখার সেটা ভেঙে চলে যায়। কিন্তু জিনিয়ার প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়টা ছিল দুজনের অজান্তে। ওরা যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন তারা যেই খাবার খেয়েছিল সেটার সাথে কিছু ওষুধ মেশানো হয়েছিল আর জন্য সেই পরিস্থিতির তৈরি হয়। আর জ্ঞান ফেরার পর ছেলেটা সেটা অস্বীকার করে। এর মধ্যে জিনিয়া সম্পূর্ণই ভিক্টিম ছিল। ওর দোষ ছিল না। ও শুধু ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তাদের সম্পর্ক ঠিক রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিনের আগে ওরা জীবনে কখনো এমন কাজ করে নি যাতে কারো কোন অসম্মান হয়। তাই শুধু অজান্তে ঘটা একটা ভুলের উপর ভিত্তি করে আমরা কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে পারি না। মা তুমি তোমার দিক দিয়ে ভেবে দেখো, আজ যদি তোমার মেয়ের সাথে বা নিজের সাথেই এমন ঘটত তাহলে তুমি কি ভাবতে?
–আমি জানি না।
–তুমি এখন রেগে আছো মা?
হেসে কথাটি বলল ওয়াফিফ। জিনিয়া তখনও অবাক হ্যে তাকিয়ে আছে। ওয়াফিফ এমন সিরিয়াস মুহূর্তে হাসছে কি করে আর কেন? ওয়াফিফ এসব বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো বলতে থাকল,
–মা দেখো, মেয়েটা নিজ ইচ্ছা থেকে এসব করে নি, কিন্তু ও প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছে। এখন পরিস্থিতিটার মধ্যে দিয়ে তুমি আমি কেউ যাই নি। তাই আমরা জানি না তখন কেমন লাগে। কিন্তু জিনিয়া গিয়েছে। আমি হাসপাতালে রোজ এমন পেশেন্ট পাই, যাদের অবস্থা আরও খারাপ, অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আবার বেঁচে থাকতে চায়, আফসোস করে। কিন্তু তাদের সবাইকে আমরা বাঁচাতে পারি না। সেদিক থেকে তুমি কিংবা আমি কিন্তু খুব ভালো পরিস্থিতিতে আছি। কিন্তু যারা এমন ঘটনার শিকার তাদের সবার দোষ থাকে না। তারা কত কিছু সহ্য করে। দেখ তোমাকে আমি বলেছি আমি বিয়ে করব না, গত ৩ বছর ধরে। তাও তুমি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছ আমার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করেছ আমি কেন বিয়ে করব না? না, করো নি। আমি আজ বলছি, আমি বিয়ে করব না বলেছিলাম কারণ আমি আরেকজনকে ভালবাসতাম। কিন্তু সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়। তবুও আমি তাকে ভালোবেসে গিয়েছি। তার সাথে বিচ্ছেদের ৪ বছর পরও বিয়ে করি নি। সেই ক্ষেত্রে ভালোবাসা যদি সত্যিই হয় তাহলে জিনিয়ার নিজের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জাবিরের সাথে দেখা করতে যাওয়া স্বাভাবিক, আর এর পরের ঘটনার জন্য জিনিয়া দায়ী ছিল না। সেদিক থেকে দেখলে আমিও তো আমার ভালোবাসার সাথে এমন করতেও পারতাম। ভেবে দেখ, তোমার ছেলে অন্য কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করল, তাহলে তোমার কেমন লাগবে। এখন যেদিক থেকেই ভেবে দেখো না কেন, আমার করা কাজটা তোমার কাছে ভুল মনে হবে না। তোমাদের আমি তখনই বলতে চাই নি কারণ আমি তখন প্রস্তুত ছিলাম না। আমি একটু সময় নিচ্ছিলাম। কিন্তু কি করে বলব বা শুরু করব বুঝছিলাম না। তাই তোমাদের বলা হয় নি। আর যদি বল জিনিয়ার দোষ তাহলে তোমাকে আমি বলব, জিনিয়া প্রায়ই আমাকে বলে তোমাদেরকে কথাটা বলার। কিন্তু এতো দিন আমিই ওকে মানা করেছিলাম বলতে কারণ আমি নিজে তোমাদের বলতে চেয়েছিলাম। আর জিনিয়া যেরকম মেয়ে, সে যে কথাটা বলতে পারবে না সেটা তুমি নিজেই জানো।
এবার বল তোমার কি মনে হয়?
–আমি জানি না, তোরা ভুল করেছিস।
–মা, এখন তোমার কাছে আমার সব কথাই ঠিক মনে হচ্ছে আমি জানি, কিন্তু আমাদের সমাজ কি বলবে সেটা ভেবেই তুমি এমন কথা বলছ। তাই আমি বলব তুমি তোমার সময় নেও। আমরা অপেক্ষা করব সেদিনের যেদিন তুমি সব ঠিক করে বুঝতে পারবে। আমরা সেদিনেরই অপেক্ষা করব। তার আগ পর্যন্ত আমি জিনিয়াকে নিয়ে আমার হাসপাতালের এপার্টমেন্টে থাকব। এখন জিনিয়ার অবস্থা এই সব চিন্তা নেওয়ার জন্য নয়। আর তোমার এতো চিন্তা করলেও শরীর খারাপ করবে। তার থেকে ভালো তোমরা একে অপর থেকে আলাদা থাকো। তুমি নিজে সময় নেই আর সবটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি আমার মাকে চিনি। তার ধারণা এক দিন ঠিক হবেই। আর তোমরা দুজন সামনাসামনি থাকলে এখন তোমার রাগ বাড়বে জিনিয়ার প্রতি, আর বুঝতে আরও বেশি সম্য লাগবে। তুমি বাবার সাথে কথা বল। সবার সাথে কথা বল। তারপর ধীরে সুস্থে নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের জানাও। আর আমি জিনিয়ার সাথে থাকছি তার মানে এই না যে তোমার ছেলেকে তোমার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে জিনিয়া। ও প্রেগন্যান্ট, ওর সাথে একজন মানুষ না থাকলে যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। আর আমি তোমার সাথে রোজ দেখা করতে আসব। আজ আসি।
বলেই ওয়াফিফ মাকে সালাম দিয়ে জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে গেল । আফিয়া রহমান তখনও দাঁড়িয়ে রইলেন আর ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চলবে।