সারপ্রাইজ (২)

সারপ্রাইজ (২)
Farzana Trina

এমন সময় শোরঘোল শোনা গেলো।
নিশ্চয়ই তারা চলে এসেছে। আমি কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। বিছানার উপর লেপ্টে বসে ছিলাম বিধায় শাড়ির অবস্থাও খুব বেশি ভালো নেই। কুঁচকে গেছে। ঐদিকে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করছেনা। চাচাতো বোন ইজমা আর আমার ছোট বোন ইতু এসে আমাকে রান্নারুমে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলাম রকমারি পিঠা-পায়েসের আয়োজন করা হয়েছে।
সাথে আছে শরবত।
আমার কাজ হচ্ছে এই শরবতের ট্রে হাতে নিয়ে তাদের সামনে যাওয়া। তারপর টেবিলে ট্রে রেখে সবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে এক এক করে শরবত বিলানো। মানে একেবারে হাতে ধরিয়ে দেওয়া আরকি।
কি অস্বস্তিকর অবস্থা।

আমি নানুকে বললাম,
– একেবারে হাতে উঠিয়ে দেওয়ার কি আছে? সামনেই তো রাখবো। নিজেরা তুলে খেতেও পারবেনা?

আম্মু রেগে আগুন হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– দেখছেন? দেখছেন মেয়ের কথাবার্তার ধরণ? সবসময়ই অয় এইভাবেই কথা বলে। আমাদের বংশে তো এমন মাইয়্যা একটাও নাই। এই মেয়ে তাইলে এমন হইলো কেন বলেন তো আম্মা?

নানু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আপুজান, তুমি এইভাবে কথা কওয়া কমাইয়া দেও। মাইয়্যা মানুষদের এত উঁচু গলায় কথা কওয়া নিষেধ। এত রাগ ও করা যাইব্যো না। এইগুলা আমগো পরিবারের হজ্ঞলে জানে। আমগো পরিবারে এইসব চলে না। তুমি এমনে কথা কইলে তো সংসারে টিকতে পারবা না। আমগো পরিবারের কোনো মাইয়্যাগো সংসার এইপর্যন্ত,এহনো ভাঙেনাই। শুধুমাত্তর এই গুণের জইন্য।

চুপচাপ হাতে শরবতের ট্রে নিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আব্বু কথা বলছে। সাথে নানা, মামা, চাচারাও আছেন। এই পরিস্থিতিতে আমি ইচ্ছা করলেই আমার হবু জামাইয়ের মুখ এক পলক দেখে নিতে পারি। অন্য কেউ হলে তাই_ই করতো।
কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে না।
অমন সময় আমার ডাক পড়লো।
আম্মা ঢেলে বললেন,
– ঐ মাইয়্যা! কী ভাবতেছোস এখন? যা??

আমি তাড়াহুড়ো করে হাঁটা শুরু করলাম।
যেভাবে প্রতিদিন সকালে ক্লাস আওয়ারের জন্য বেরিয়ে পড়তাম সেভাবেই হাঁটা ধরলাম।
শাড়ি অতিরিক্ত নিচে করে পরানো হয়েছিলো বিধায় কুচিগুলো কোনোভাবে আমার পায়ের সাথে প্যাঁচিয়ে যায়। ফলপ্রসূ,তাদের সবার সামনে আমি অবলিলায় পড়ে যাই ধপাস করে। একদম ঠিক তার সামনে এসেই পড়েছিলাম, যিনি আমার শ্বশুরমশাই হওয়ার কথা।

শরবতের গ্লাসের সব শরবত আমাকে ভিজিয়ে একাকার করে দিলো।
ইশ! কি বিচ্ছিরি অবস্থা!
লোকটার ভাই,বোন আর মা আমার দিকে নাক কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তারা পারে না তো এখনি উঠে চলে যায়।
আমার আব্বু হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আম্মু ততক্ষনে কান্নাকাটিতে ভেঙে পড়ে ভেতরে চলে গেছেন।

আব্বু এসে দাঁত গিজমিজ করতে করতে আমাকে তুলতে যাচ্ছিলেন। তখনই ভদ্রলোকটা মানে যে আমাকে দেখতে এসেছেন, তিনি আর তার বাবা এসে আমাকে উঠালেন।
আমার পায়ে ছিলো অনেক উঁচু জুতা।
যে জুতা পরে আমি আমার জীবনে কোনোদিন হাঁটিনি।

লোকটার বাবা খুব স্নেহের গলাতেই বললেন,
– মা, একটু দেখে চলতে হয় তো! যাও! তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে চেইঞ্জ করে আসো। আর হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা পরবে যেটাতে তুমি কম্ফোর্টেবল। কেমন?

আমি মাথা নাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালাম।
জুতার উচ্চতা এতটাই সীমাহীন যে আমি ঠিক করে দাঁড়াতেই পারছিনা। আর ফ্লোরে চিনির তৈরী শরবত পড়ে আরো পিচ্ছিল আকার ধারণ করে আছে। আর এভাবে ছোট-বড় সবার সামনে পড়ে যাওয়া লজ্জ্বায় কাঁপছি রীতিমত।
আমি চশমা ছাড়া একটু কমই দেখি।
কিন্তু সেই চশমা ও আমার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বিধায় আমি দেখেশুনে হাঁটতেও ব্যর্থ।

লোকটার আব্বা আবার তাড়া দিলেন,
– কী হলো? যাও? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!

কিন্তু আমি উনাকে কিভাবে বোঝাই যে আমি কেন এখনো দাঁড়িয়ে আছি! হাঁটতেই তো পারছিনা,যাবো কিভাবে!
পড়ে যাওয়ায় হাতেও ব্যাথা পেয়েছি।
মনে মনে বলে যাচ্ছি,
“হায়, আল্লাহ্‌! আমাকে রক্ষা করো!”

আব্বা জোর গলায় বললেন,
– কী হলো চারু? তোকে ভেতরে যেতে বললেন না উনি? কথা কানে যাচ্ছেনা নাকি?

আমি তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরলাম।
আবার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি যাচ্ছি অমন অবস্থায় আমাকে দেখতে আসা লোকটা আমার কাছে এসে কানে -মুখে বললেন,
– জুতাজোড়া খুলেই চলে যান। আমি দাঁড়াচ্ছি। আমার পেছন দিয়ে খুলেই দৌঁড় দেন। সাবধান কেউ যেন না দেখে।
শুনে আশ্বস্ত হলাম।
তাই করলাম যা সে বললো।
জুতা খুলেই দৌঁড়!

লোকটার আব্বার সাথে আমার আব্বুর অনেক অনুনয়- বিনিময় হলো।
আব্বাকে উনি জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনার মেয়েটা নিতান্তই ছেলে মানুষ! এত বড় হয়ে গেছে,বোঝাই যাচ্ছেনা।
আব্বু বললেন,
– আমি আমার সর্বোচ্চ শিক্ষা দিয়ে তাকে বড় করেছি ভাইজান। এখনো একটু ছেলেমানুষি রয়ে গেছে,কিন্তু আমার মেয়েটা কিন্তু অনেক নরম মনের মানুষ। নিজের মেয়ে বলে বলছি না। আসলে আমি ওকে খুব ভালো করেই চিনি। যেমন ধরেন আমার ছোট মেয়েটা,ইতু, ও কিন্তু একদমই তার বিপরীত। ও আমার নীতি,শিক্ষা ততটা রপ্ত করতে পারেনি হয়তো। কিন্তু আমার দুই মেয়ের মনই কিন্তু ভীষণ নরম।
উনি হেসে বললেন,
– আপনার মেয়েটাকে আজকে একটু বেশিই শাসন করেছেন মনে হচ্ছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে। এজন্যই হয়তো এরকম একটা কান্ড পাঁকিয়ে ফেলছে।

দুজন মিলে একযোগে হাসলেন।

আমাকে দেখতে আসা লোকটার নাম প্রান্ত আহমেদ। তো ভদ্রলোকের মা হঠাৎ করে বলে উঠলেন,
– তা ভাই, মেয়েকে ঘরের কাজকর্ম কিছু শিখিয়েছেন তো? না মানে মেয়ের কাজের নমুনা যা দেখলাম… তাতে তো.. আসলে.. ভরসা করে উঠতে পারছিনা! কিছুই কি পারেনা নাকি?
বলি,বোকাসোকা মেয়ে গছিয়ে দিচ্ছেন না তো?

আব্বু খুব অনুনয়ের স্বরে বললেন,
– না না! কি বলেন! আপা আসলে.. বড় মেয়ে তো.. বড়ই আদরের। তাই কোনোদিন তাকে রান্নাঘরে পাঠায়নি তার মা। তবে সে নিজে নিজেই টুকটাক শিখে নিয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার মেয়েটা পড়াশোনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া গান, আঁকা-আঁকির প্রতি ও আসক্ত। লিখালিখি ও ভালোই করে।

মহিলা মুখ ঘুরিয়ে বললো,
– গান, আঁকা-আঁকি, লিখালিখি এসব দিয়ে কি হবে ভাই! আমরা তো ঘরে বউ নিবো, কোনো শিল্পী না। এমন তো নয় যে আমরা তার শৈল্পিক গুণ দেখেই তাকে ঘরে তুলবো। এইটার জন্য তো টিভি,বই_ই যথেষ্ট। মেয়েকে পড়াশোনা জানলেই চলবে আপাতত। আর সেদিকেও তো মনে হয় বেশি সুবিধা করতে পারেনি এখনো! শুনেছি মেয়ে নাকি উচ্চ মাধ্যমিকে প্লাস পায়নাই? আমার ছেলের কথা তো জানেন_ই। কোনোকিছুতেই সিলভার নাই। সব গোল্ডেন। হুম।
এখন বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য গেছে।

প্রান্তের বাবা জোর গলায় চেঁচিয়ে বললেন,
– আহ! নাহার! তুমি চুপ করবে?
আব্বু কিছুটা শান্ত গলায় বললেন,
– কেন? বায়োডাটা কি আপনাদের দেওয়া হয়নি? এমন হলে তো আগেই বলে দিতে পারতেন।
প্রান্তের মা চোখ উল্টিয়ে বললেন,
– দেখতে আসছিলাম আরকি। দেখতে আসা মানেই তো আর বিয়ে ঠিক করে ফেলা না। তাইনা?
এরকম কথাবার্তা শুনে আব্বু ভীষণভাবে আহত হলেন।

এমন সময় বোনের সাথে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম একটা সাদা রঙের থ্রি-পিস পরে।
ঢুকেই দেখলাম, প্রান্ত নামের এই লোকটা মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আব্বুকে এতক্ষন কি বলেছে না বলেছে এসবের কিছুই আমার কানে এসে পৌঁছায় নি।
কারণ মাত্রই ঢুকলাম।
আমাকে ঢুকতে দেখেই ভদ্রলোকের বাবা বলে উঠলেন,
– এসো মা, এসো।
আমি এবার শরবত নিয়ে এসেছি।
সবার কাছে গিয়ে গিয়ে দিয়ে আসলাম।
সবাই নিলেন শুধুমাত্র ভদ্রলোকের মা আর তার বড় মেয়ে ছাড়া।
উনার ছোট ভাইটাকে ভালোই লাগলো।
আমি তার কাছে যেতেই সে সুন্দর করে হেসে আলতো স্বরে বললো,
– ভাবী!
আমি ও তাকে হাসি ফেরত দিলাম।

সবাই মিলে কিছুক্ষন এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো আমাকে।
তন্মধ্য ভদ্রলোকের মা জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি কি গানটান প্রফেশন হিসেবে নিবা নাকি?
আমি বললাম, -না।
উনার বড় মেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– তা, শুনলাম লিখালিখি ও করো। লেখিকা হইবা নাকি?
– জ্বী না,তেমন ইচ্ছা নেই। তবে দেখা যাক। যেদিকে আল্লাহ ভাগ্য রাখছে ওদিকেই যাবো। ইনশাল্লাহ্।
ভদ্রলোকের মা জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
– চাকরী-বাকরী করবা নাকি বিয়ের পর? উচ্চ শিক্ষা নেওয়া জরুরি,তাই তা নিবা। সন্তানের মঙলের জন্য। কিন্তু এর বেশি না। বাইরে ঘুরাঘুরি করা যাইব্যো না।
ভদ্রলোকের আব্বা বললেন,
– মা, তুমি কি চাকরী করতে চাও বিয়ের পর?

আমি আস্তে করে সম্মতি জানালাম,
– হ্যাঁ।
উনি বললেন,
– কিন্তু আমার ছেলেতো আমেরিকায় চলে যাবে তোমাকে নিয়ে। তাহলে তো মা তোমার এই চিন্তা বাদ দিতে হয়..
আমি কিছু বললাম না।
মাথা নিচু করে রইলাম।
আব্বু নীরব হয়ে বসে রইলেন।
হুঁ,হ্যাঁ কিছুই বলছে না দেখে আমি ক্রুদ্ধ হলাম।

হঠাৎ ভদ্রলোক(প্রান্ত) অনুনয়ের স্বরে আবদার করে বললেন,
– আব্বা, আমি কি উনার সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে পারি?
বলা মাত্রই সম্মতি পেলেন তিনি।

আমরা ছাদে চলে আসলাম।
উনার দিকে তাকানোর সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।
কিছুক্ষন পর উনিই মৌনতা ভঙ্গ করে বললেন,
– আপনাকে সাদা রঙে বেশ ভালো মানায়।
– ধন্যবাদ।
– আচ্ছা, আপনি হাসেন না কেন? এই পর্যন্ত একবারের জন্যও হাসতে দেখলাম না! কারণ কী বলেন তো?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here