অনুভূতির_সংঘাত_১৪(অন্তিম পর্ব)
ছামিনা_বেগম
– আপনাদের এতো তাড়াহুড়ো করে শিফট করানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত ।
আজিম হকের কথায় মৃদু হেসে শেফালী বেগম বললেন ,
– না না । সেরকম কিছু নয় । আসলে আমাদের বাড়ির কাজ ও শেষ । এই সপ্তাহেই আমাদের ওবাড়িতে শিফট হওয়ার প্ল্যান ছিল ।
– আসলে , মেয়ের বিয়ে তো সামনে । আত্মীয় স্বজনরা আসবে । তার ওপর আমার বড়ো দাদাও আসছে পরিবার নিয়ে ।
শেফালী বেগম সহ সবাই চমকে তাকালো । বৃষ্টি নিজেও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আব্বুর দিকে । এই সিদ্ধান্ত কখন নিলেন উনি ? সে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইল আজিম হকের দিকে । আজিম হক আবার বললেন ,
– ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন । দিন তারিখ ঠিক হলে আপনার ওখানে দাওয়াত পাঠাব । সপরিবারে আসবেন কিন্তু ।
শেফালী বেগম হেসে বললেন ,
– জি। অবশ্যই ।
তুলন বারবার হাই তুলছে দেখে পুতুল শেফালী বেগমকে বলে তুলনকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো ।সিড়ি বেয়ে ওঠার সময়ই পেছন ডাক শুনে ঘুরে দাড়াল ।
খাওয়া দাওয়ার পর রোজ একটু হাটাহাটি করার অভ্যাস আছে ঈশানের । পুতুলকে বেরিয়ে আসতে দেখে সেও এগিয়ে গেল । হাত নাড়িয়ে বলল ,
– হেই …
পুতুল কিছু বলল না । তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ঈশানের দিকে । বৃষ্টির বিমের কথা শুনে মনটা ফুরফুরে হয়ে এসেছিল। কিন্তু এই রাত দুপুরে এই ছেলে ডাকছে কেন ? সপ্রশ্ন তাকিয়ে বলল ,
– কোনো দরকার ?
ঈশান হতচকিয়ে গেল । সত্যিই তো কি দরকার ? ও ভেবে ছিল পুতুল ভদ্রতা দেখিয়ে হলেও সামান্য হেসে কথা বলবে । কিন্তু পুতুল তার ধারকাছ দিয়েও গেল না । বরং কন্ঠের রুক্ষতা ধরে রেখে আবার বলল,
– কি হলো ? ডাকলেন কেন ?
– এমনিতেই , আলাপ করার জন্য ।
– এই রাত দুপুরে আমার সঙ্গে আপনার আলাপ করতে ইচ্ছে হলো ?
ঈশান কৌতুক বোধ করল । যখন থেকে মেয়েটাকে দেখেছে সে তখন থেকেই ওর থমথমে গোমরা মুখ খানা বেশ আকর্ষণ করছিল ওকে । সবার কথা বলার সুবাদে নামখানাও ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে । একেবারে সার্থক নামকরণ । সত্যিই পুতুলের মতো দেখতে সে । ছোট ছোট চোখ গুলো সামান্য গোলাকৃতির । নাকটা সরু কিন্তু তীক্ষ্ণ । ঘাড় সমান চুল গুলো ছেড়ে রাখা । গোলগাল মুখ খানা মনে রাখার মতো । সে খানিকটা কৌতুক মিশিয়ে বলল ,
– কেন , আপনি বুঝি রাতে কথা বলেন না ?
পুতুল বেশ বিরক্ত হলো ।ঈশান আবার বলল ,
– উই আর নেইবারস । ধরুন রাস্তাঘাটে কোথাও দেখা হলো । অথবা কোনো সমস্যায় পড়লেন । কিন্তু সেভাবে পরিচয় পর্বটা সম্পন্ন না হওয়ায় ডাকতে পারলেন না । অবশ্য , এটা আমার ক্ষেত্রেই হওয়ার চান্স বেশি । তাই বলতে পারেন নিজের তাগিদেই পরিচয় পর্বটা সারতে এলাম । ……
ঈশান একটু থেমে আবার বলল ,
– হাই , আমি ঈশান, আপনাদের নতুন নেইবার ।
– হাই ।
তীব্র অনিচ্ছা সত্বেও বলল পুতুল । কিন্তু এরপর কথা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বা ইচ্ছে কোনোটাই অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে । তুলনকে কোলে নেওয়ার কারণে হাত টনটন করছে , ঝিম ধরে গেছে । সে সিড়ির ধাপে পা দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ঈশান সামনে চলে এলো । তুলন পুতুলের ঘাড়ে মাথা রেখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে ছিল । ঈশান মিষ্টি করে হেসে ওর দিকে হাত নাড়িয়ে বলল ,
তুলনের দিকে তাকিয়ে বলল ,
– হেই সুইটহার্ট , নাম কি তোমার ?
তুলন ঘাড় সোজা করে বলল ,
– তুলন আহমেদ ।
বলেই সে আবার নেতিয়ে পড়ল পুতুলের কাধে । ঈশান পুতুলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল ,
– আচ্ছা , পরিচয় পর্বটা না হয় থাক । এবার বলুন আপনি আপুর সাথে রুড বিহেভ করছিলেন কেন ?
– কারণ সে সেটাই ডিজার্ভ করে ।
কাঠকাঠ স্বরে জবাব দিল পুতুল । ঈশান সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল ,
– মানে ? কি বলতে চাইছেন ?
-সেটা না হয় নিজের বোনকেই জিজ্ঞেস করুন ।
বলেই আর এক মুহুর্ত দেরি করল না পুতুল । ঈশানকে সম্পূর্ণ অগ্ৰাহ্য করে তরতর করে উঠতে লাগল উপরে । চলতে চলতেই শুনতে পেল ঈশান বলছে ,
– ঠিক আছে সে না হয় আমি জেনে নেব । কিন্তু মিস ধানিলঙ্কা, নিজের পরিচয়টা যে অসম্পূর্ণ থেকে গেল । আর একদিন জানার সুযোগ হবে কি ?
পুতুল নিরুত্তর রইল । ঈশান ঘাড়ের পেছনে হাত চালিয়ে মৃদু হাসল । আচ্ছা , এত ভালো লাগছে কেন ওর ? এলোমেলো পা ফেলে আনমনেই হেসে উঠল । বাগানে রঙবেরঙের ফুল ফুটেছে । সেখান থেকে একটা লাল জবা ছিড়ে নিয়ে পাপড়ি গুলো ছিড়তে লাগল । ঘাড় ঘুরিয়ে দোতলায় চোখ রাখল । সব দরজা জানলা বন্ধ । তবুও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগল ওর ।
*****
– তুমি কি করতে চাইছ বলো তো আব্বু ? আবার কি প্ল্যান চলছে তোমার মাথায় ? প্লিজ খুলে বলো আমাকে । যাতে আমি আগেভাগেই নিজেকে সামলে নেওয়ার একটা সুযোগ অন্তত পাই।
ঘুমানোর আগের ওষুধ খেয়ে মাত্রই শোবার পায়তারা করছিলেন আজিম হক ,মেয়ের কথায় মৃদু হাসলেন । বললেন ,
– কিসের প্ল্যানের কথা বলছিস ? আর আমি প্ল্যান করব কেন ?
-তাহলে তুমি কার বিয়ের কথা বললে ? ঈশানের নিশ্চয়ই নয় !
আজিম হক মুখে হাসি ধরে রেখেই বললেন ,
– ও তো এখনো ছোট ।
– তাহলে ..?
মেয়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসলেন আজীম হক । গলায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন ,
-দেখ বৃষ্টি , তুমি এখন আর ছোটটি নেই যে ধরে ধরে সব কথা বুঝিয়ে দিতে হবে । সাতাশ পেরিয়ে এবার আটাশে পড়েছ । তোমার বয়সী বাকি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখো । তারা সবাই দিব্যি ঘর সংসার সামলাচ্ছে । তোমার বাবা হিসেবে তোমাকে সুপাত্রস্থ করা আমার কর্তব্য । এতদিন তুমি ব্যবসা ব্যবসা করে প্রত্যেকবার আমার কথা এড়িয়ে গেছ । আমি কিচ্ছু বলিনি । কিন্তু এবার আমি নিজে হাতে আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই । আমি আশা করি তুমি এবার আর বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে না । সাইফ , খুব ভালো ছেলে। তা তুমি নিজেও জানো । ছোট থেকে একসঙ্গে বড়ো হয়েছ তোমরা । ও এতদিন তোমার মুখ থেকে হ্যাঁ শোনার অপেক্ষা করেছে । কিন্তু তোমার মত পাল্টায়নি । কিন্তু এবার আমি আর কোনো বাহানা শুনতে চাই না । তুমি বিয়ে করবে আর সেটা সাইফকেই । এইটাই ফাইনাল । এবার যাও , রেস্ট করো ।
– এটা আমার লাইফ আব্বু । আমি কি করব না করব সেই ডিসিশন নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার । তুমি প্রতিবার এমন সেচ্ছাচারিতা করতে পারো না!
আজিম হক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে । বললেন ,
-আমি কি করতে পারি কি পারি না সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা আছে তোমার । কাজেই আর বলার প্রয়োজনে বোধ করছি না । তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে । বুঝে গেছ নিশ্চয়ই । এবার ঘুমাও গিয়ে । অনেক রাত হয়েছে ।
– আব্বু !!
বৃষ্টি চাপা আর্তনাদ করে উঠল । কয়েক পলক শান্ত হয়ে তাকিয়ে রইল আজিম হকের দিকে অথচ বুকের ভেতর সুনামি হচ্ছে । সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই আজিম হকের কথায় থমকে দাড়াল ,
– তোমার কি মনে হয় যার জন্য অপেক্ষা করছ সেও তোমার অপেক্ষায় বসে আছে ?
বৃষ্টি কিছু বলল না । কিন্তু শিমুলের কথা উঠতেই মাথার ভেতরটা কেমন ফাকা ফাকা লাগতে লাগল । নিজের ঘরে ফিরে ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে এলিয়ে দিল বিছানায় । চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল সাত বছর আগের সেই দিনকে । সেদিন মার্কেট থেকে ফিরে শিমুলের সাথে পার্কে গিয়েছিল ঘুরতে । স্বপ্নের মতো একটা দিন ছিল সেদিন । কিন্তু শেষটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো । ট্রাফিকে আটকা পড়ে বিরক্ত হওয়া আজিম হকের চোখ পড়েছিল পার্কের খোলামেলা পরিবেশে নিজের কন্যার হাত ধরে রাখা ছেলেটির দিকে। বাড়ি ফিরে থমথমে মুখে অপেক্ষা করছিলেন কন্যার । বৃষ্টি দুরুদুরু বুকে বাবার সামনে এসে দাড়িয়ে ছিল । ভয় , উৎকণ্ঠায় প্রান তখন ওষ্ঠাগত। না জানি আব্বু কি বলবে ? কিন্তু ওর চিন্তার থেকেও দ্রুত গতিতে নিজের আধিপত্যের সীমানা দেখিয়েছিলেন আজিম হক । গমগমে কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন ,
– ছেলেটা কে ?
– ওর নাম শিমুল ।
– কি করে ?
-আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে । সিনিয়র ।
– বাবা কি করে ?
– জানি না ।
তাচ্ছিল্যমাখা সুরে হেসে উঠেছিলেন আজিম হক । বরাবরই দাম্ভিক তিনি । এই কথাটা জানে বৃষ্টি । নিজের স্ট্যাটাস , মর্যাদা সর্বদাই যার কাছে সবার আগে প্রাধান্য পায় । সেই বাবার থেকে বরাবরই একটু দুরত্ব রেখে এসেছে বৃষ্টি । তবুও সামান্য হলেও মনের গভীরে কোনো এক কোণে এক টুকরো আশার প্রদীপ ধিকিধিকি করে জ্বলছিল এই আশায় যে নিজের একমাত্র কন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নূন্যতম সম্মান টুকু অন্তত দেবেন তিনি । কিন্তু বৃষ্টিকে নিরাশ করে আজিম হক বলেছিলেন ,
– শুনেছি , মোবারক আহমেদ একটা বেসরকারি অফিসে একাউন্টিং পদে কাজ করছেন । সবাই তাকে বিশ্বস্থ জেনে এসেছে এতদিন । তুমি কি চাইবে এই বয়সে উনি জালিয়াতির কেসে ফেসে গিয়ে জেলের ঘানি টানুক অথবা ধরো শিমুল কোনো মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে নিজে কয়েক বছরের জন্য জেলের পেছনে চলে গেল । কত কিছুই তো হতে পারে , তাই না ?
বৃষ্টি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ছিল চিরচেনা মানুষটার দিকে । ক্ষমতার দম্ভ তার মনুষ্যত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে । তাই বলে এতটা নিচে নামবেন তিনি ? বৃষ্টি হাত জোড় করে , বাবার পায়ে পরে , অনেক অনুনয়- বিনয় করে , কান্নাকাটি করে , অনুরোধ করেও লাভের লাভ কিছুই হয়নি । আজিম হককে টলানো যায়নি । ফলস্বরূপ রাত পোহালেই ওকে শহর ছাড়তে হয়েছিল । এরপর পাঁচটি বছর আর এমুখো হয়নি বৃষ্টি । প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও পরে তা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আসলে অনেক দিন থেকে একটা অসুখ বা ব্যাথা নিত্যদিনের সঙ্গী হলে আস্তে আস্তে তার সাথে আমাদের সখ্যতা তৈরি হয়ে যায় । পরে তা না থাকলে বা সেড়ে গেলেই বরং খালি খালি লাগে । শিমুলের ভালো থাকার কথা ভেবে , ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে বৃষ্টি ধীরে ধীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিল বাবার ব্যবসায় । আর ঘরে ফিরে বাবা-ভাই মিলে তিনজনের সংসারে আপনাআপনিই গৃহিণী বনে গিয়েছিল ।
স্মৃতি বড়ো আজব অসুখ । কখনোই মানুষকে একা ছাড়ে না । বৃষ্টি চোখ খুলে তাকাল । ঘরের বড়ো আলোটা নিভিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে উত্তর মুখি জানালাটা খুলে দিল । এক পশলা শীতল বাতাস এসে চিবুক ছুয়ে গেল বৃষ্টির । আরামে চোখ বুঝল সে । আকাশে বুঝি মেঘ করেছে । অন্ধকারে চারপাশটা নিঝুম হয়ে থাকলেও লনের বড়ো সোডিয়াম বালভের আলোটায় সব কিছু স্পষ্ট দৃশ্যমান । বাইরের পরিবেশ যতটা না ঝিম ধরা তার থেকেও দ্বিগুণ গতিতে তান্ডব চলছে বৃষ্টির হৃদয়ে। জীবনটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে ওর । আজ শিমুলের অনুপস্থিতি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে শিমুল ক্ষমা করেনি ওকে । বৃষ্টির খুব জানতে ইচ্ছা করল , আচ্ছা শিমুল কি ওকে ঘৃণা করে ? করে হয় তো । আর তাই বোধ হয় বৃষ্টির মুখদর্শন করতেও তার আপত্তি । আর তাই কাজের বাহানায় নিজেকে আটকে ফেলেছে সে । খোলা জানালার দিয়ে ধেয়ে আসা শিরশিরে বাতাসেও দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল বৃষ্টির । জানালা বন্ধ করে ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো । এক পলক তাকাল দ্বিতীয় তলার দিকে । পুরো বাড়িটাকে একটা দৈত্য মনে হতে লাগল ওর ।
লনের কাছেই একটা পুরোনো কাঠাল গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাধিয়ে দেওয়া আছে সেখানে শুয়ে পড়ল বৃষ্টি । মেঘের দল গুরগুর আওয়াজ তুলে গর্জন করে যাচ্ছে । আজ মাকে ভীষণ মনে পড়ছে ওর । মা থাকলে হয় তো আজ পরিস্থিতি অন্য রকম হতো । আব্বু নিশ্চয়ই এমন করত না । বৃষ্টির খুব ইচ্ছে করল মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে । ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলতে- ‘ আমার জীবনটা শুধুই আমার । আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি । তুমি আমাকে জোর করতে পারো না আব্বু ।’ কিন্তু বলা হলো না । চিৎকার করে বলার মতো মনের জোর বা সাহস কোনোটাই নেই বৃষ্টির । আর লড়বেই বা কার জন্য ? শিমুলের জন্য ? নিজের ভাবনার বহর দেখে নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল বৃষ্টি । যে বৃষ্টি নিজেই একসময় শিমুলকে ছেড়ে চলে গেছে সেই শিমুল কি আর তার জন্য বসে আছে !সে তো দিব্যি সংসার করছে । কেন যেন হঠাৎ করেই শিমুলের ওপর ভীষণ অভিমান হলো বৃষ্টির । মানছে , বৃষ্টি না হয় সেই সময় ভয় পেয়েছিল বাবার প্রভাব প্রতিপত্তি , তার ক্ষমতাকে। কিন্তু শিমুল তুমি কেন একটিবারের জন্যেও আমাকে খুঁজলে না ? কেন একটি বার ও আমার সাথে যোগাযোগ করলে না ? তুমি কি আমায় ভালোবাসোনি ? বাসলে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে কি করে ? কেন জোর দেখিয়ে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে আমাকে দাবি করলে না ?
শিমুলকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে কত কত প্রশ্ন করল বৃষ্টি । কল্পনার শিমুল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল । সেই হাসি কল্পনা করে বৃষ্টি আর একবার ভাঙল ভেতর থেকে । নিজেকেই বোধ হয় প্রবোধ দিল । তুমি আসোনি ভালো করেছ শিমুল ? আমার দাম্ভিক বাবার সামনে তুমি টিকে থাকতে পারতে না । ক্ষমতার নেশায় তিনি অন্ধ । তুমি জানো না শিমুল , আজও জীবনের অন্তিম সময়ে এসেও অসুখ তার দর্প চূর্ণ করতে পারেনি । তিনি চিরটা কাল একি রকম রয়ে গেছেন । বৃষ্টি বেদীর উপর শুয়ে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে । বোবা কান্নার দল এসে ভীড় জমালো চোখের কার্ণিশে ।
*****
শহরের নিশ্চুপ পথে পথহারা পথিকের মতো একবার এ গলি একবার সে গলিতে উদ্দেশ্যহীন হয়ে গাড়ি ছুটিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতের পাশে গাড়ি দাড় করালো শিমুল । ব্যাক সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝল । যখনই নিজেকে একা মনে হয় , চারপাশটা সব কিছু থেকে মন উঠে যায় তখন একটু স্বস্থির আশায় এভাবেই গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যে হীন ভাবে বেরিয়ে পড়ে সে । ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে শিমুলের । ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে ওর । জল পিপাসা নয় , কারো সঙ্গের তেষ্টা । কিন্তু কাকে চাইছে সে ? রাধাকে ?
ভাবতেও কেমন একটা ঘিনঘিনে অনুভূতিতে ছেয়ে গেল শিমুলের মন । নিজের চরিত্রে যেন নিজেই একসময় এক দলা কালি লেপ্টে দিয়েছে সে । অনেক ঘষামাজা , অনেক ধোয়াধোয়ির পরেও সেই কালির অস্পষ্ট দাগ এখনো বিদ্যমান । আজ পুতুলের কথায় তা হারে হারে টের পেয়েছে শিমুল । সত্যিই বোধ হয় কিছু দাগ কখনোই মেটে না । পুতুলের মুখে বৃষ্টির কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সে । মনে পড়ে গিয়েছিল বৃষ্টির চলে যাওয়ার পর ওর বান্ধবীদের ঠাট্টা তামাশা , উপহাস গুলো । কি দুর্বিষহ দিন ছিল সে সব ! শিমুল আশ্চর্যান্বিত হয় এই ভেবে যে আজ এত গুলো বছর পেরিয়েও ওই একটা নাম কিভাবে ওর তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশ্বাসের ভীত নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ! তবে শিমুল জানে না ভাগ্যের এই অদ্ভুত বিড়ম্বনায় আসল দোষী টা কে ? সে না কি রাধারাণী ? তবুও দুজনেই সমান দোষী অহনার কাছে ? আজ ওর ভুল , না না পাপের কারণেই অহনার শূন্যতা প্রতিটি ক্ষণে দুঃসহ জ্বালায় পোড়াতে থাকে । নিজেকে মুক্তি দিতেই হোক আর শাস্তি দিতেই হোক শিমুল একবার , অন্তত একবার বৃষ্টির মুখোমুখি হতে চায় । সে জানে না সেই সন্ধিক্ষণে কি হবে ? কি জিজ্ঞেস করবে ? কিন্তু তবুও শিমুল বৃষ্টির সামনে দাড়াতে চায় ? দেখিয়ে দিতে চায় যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে একসময় রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল বৃষ্টি সেই শিমুলের বর্তমান অবস্থান কতটা মজবুত ।
ভাবনার মাঝেই কখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে সে খেয়াল নেই শিমুলের । জানালার কাচে ঠকঠক আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল রেইনকোট পড়া একজন লোক নক করছে । শিমুল সর্তক হয়ে গেল । চারপাশে তাকিয়ে দেখল ওর গাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা পুলিশ জীপ দাড়িয়ে আছে । শিমুল বুঝল এ লোক চোর ডাকত নয় , পুলিশ কর্মী , টহল দিতে বেরিয়েছে । সে কাচ নামিয়ে কথা বলেই জানাল সে চলে যাচ্ছে এখনি । শুনে পুলিশটি চলে গেলে শিমুল ফেরার পথ ধরল ।
হক বাড়ির গ্যারেজে গাড়ি রেখে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই শিমুলের মনে হলো কেউ আছে আসেপাশে । কারণ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও একটা কন্ঠস্বর মিহি সুরে ধরা দিচ্ছে কানের পর্দায়। কে কাঁদছে ? পরক্ষণেই মনের ভ্রম মনে করে সে সামনে পা বাড়ালেও কি মনে করে যেন ঘুরে তাকালো । চারপাশে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে লনের সোডিয়াম আলোয় বৃষ্টির ফোটা গুলোকে সাদা সাদা মনে হল ওর । মুষলধারে বৃষ্টির ফোটা বৃষ্টির কণা তখন শিমুলকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছে । সে এক এক পা করে শব্দের উৎস অনুসরণ করে কাঠাল গাছের বেদীর সামনে গিয়ে থমকে দাড়াল । গাছের নিচে কে শুয়ে আছে ওটা ? স্নায়ুতন্ত্র বেয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল শিমুলের । তবে ভয় নামক অনুভূতির কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে শিমুল ভালো করে খেয়াল করতেই জমে গেল বরফের মতো । এ যে বৃষ্টি !ও এখানে ভিজছে কেন ? তার রাতদুপুরে ! স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা টা মাথায় এসে গেল শিমুলের । তারপরেই মনে হলো , এ আর এমন কি বিষয় ! বরং এটাই স্বাভাবিক । বৃষ্টি তো এমনি । রাতদুপুরেও সে ভালো লাগছে না বলে ছাদে কিংবা বাগানে হাটাহাটি করত । আর সেই সময়টায় নিশাচরের মতো ফোনের বিপরীতে বসে বৃষ্টির সঙ্গ দিতে হতো শিমুলকে ।
– রা….
অবচেতন মনে বৃষ্টিকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল শিমুল । আড়ষ্টতায় জড়োসড়ো হয়ে গেল । তার পর নিজের ঘরে ফেরার জন্য ঘুরে দাড়াতেই নিজের নাম শুনে থমকে দাড়িয়ে গেল ।
– আমি বুঝি অস্পৃশ্য হয়ে গেছি , তাই না শিমুল ? আমার ছায়া মাড়াতেও আজ তোমার ঘৃণা হচ্ছে ?
পদধ্বনি কানে যেতেই চোখ মেলে একজন পুরুষকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি । ঝটপট উঠে বসে তাকিয়ে ছিল দীর্ঘ যুবকটির দিকে । ঘন বরষার মাঝেও পেছন থেকে দেখে অবয়বটাকে চিনতে ভুল হয়নি বৃষ্টির ।
শিমুল চোখ বন্ধ করে অহনার মুখটা মনে করল । তারপর ঘুরে দাড়িয়ে বলল,
– কেমন আছ ?
– এই কথাটা বুঝি আমার জিজ্ঞেস করার কথা ?
শিমুল হাসল ।
– ঠিক বলেছ । তোমারই জিজ্ঞেস করার কথা । কিন্তু আমার তোমার কথা জানতে ইচ্ছে করছে । কেমন আছ তুমি ? নিশ্চয়ই ভালো আছ । অবশ্য ভালো থাকারই কথা । কি বলো ?
শিমুলের কথার সুক্ষ্ম খোঁচাটা নিরবে হজম করল বৃষ্টি । চোখ নামিয়ে বলল ,
– আমাকে ক্ষমা করা যায় না শিমুল ?
– আমাদের মাঝে আর কিছু অবশিষ্ট নেই বৃষ্টি । তাই ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না ।
– কিছুই কি নেই ?
– আছে কি ?
শিমুলের পাল্টা প্রশ্নে বৃষ্টি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল এই নতুন শিমুলকে । আগের শিমুল ওকে সবসময় রাধারানি বলে ডাকত । নিজের পুরোনো নামটাকে মনে করে কান্না করে ফেলল বৃষ্টি । শিমুল বদলে গেছে ভাবতেও বুক ফেটে চৌচির হতে চাইল । মনে হলো কেউ বুঝি সূচের ডগা দিয়ে ওর হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে । চোখ দিয়ে গরম নোনা জল বয়ে গেল কিন্তু প্রকৃতি বুঝি লুকিয়ে ফেলতে চাইল বৃষ্টির অশ্রু বিন্দু । তাই বৃষ্টির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল আকাশের অশ্রু নাকি বৃষ্টির চোখের অশ্রু ঠিক ঠাহর করা গেল না । বৃষ্টি ধরা যাওয়া গলায় বলল ,
– যদি আর একটা সুযোগ চাই , দেবে ?
শিমুল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখল সামনে সিক্ত বসনা মেয়েটিকে । তবে তার আকুড়ি ভরা কন্ঠ শিমুলের ভাবণ ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো না । শিমুল বুঝল সে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে । বলল ,
– সাতটা বছর অনেক সময় বৃষ্টি । এই সাত বছরে আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে । আমি বিয়ে করেছি , আমার একটা মেয়ে আছে । আমি এখন পরিপূর্ণ । অহনা নেই আমার জীবনে ঠিকই কিন্তু তবুও সে আমাকে পূর্ণ করে দিয়ে গেছে । এই এক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি জানো । আমার আর কিছুর দরকার নেই ।
বৃষ্টি ক্রন্দনরত অবস্থায় তাকিয়ে রইল শিমুলের দিকে । এই শিমুলকে ওর বড্ড অচেনা লাগছে । শিমুল আবার বলল ,
– আমাদের ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেই হোক , আমাদের চলার পথটা আলাদা হয়ে গেছে । আর আমরাও অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি । সেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয় । আমি তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারব না । আমাকে ক্ষমা করে দিও ।
আর দাড়ালো না শিমুল । আজ বড়ো হালকা লাগছে নিজেকে । বড়ো বড়ো পা ফেলে নিজের ঘরে ফিরে গেল সে । পেছনে ফেলে গেল এক ভগ্ন হৃদয় রমনীকে । হয় তো চাইলেই সে ওই ভগ্ন হৃদয়কে জোড়া লাগাতে পারত । কিন্তু সব চাওয়া চাইতে নেই । কিছু কিছু জিনিস অপূর্ণতাতেই সুন্দর । হয় তো এভাবেই একজীবনে অহনার জমে থাকা ঋণগুলো শোধ করতে পারবে সে । অহনা যে নিজে না থেকেও শিমুলের বেঁচে থাকার সবথেকে মূল্যবান কারণটা দিয়ে গেছে ।
সমাপ্ত