অনুভূতির_সংঘাত_১২
ছামিনা_বেগম
পুতুলের একের পর এক প্রশ্নে শিমুল হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে ছিল । যখন সবটা বুঝল তখন সে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই । আসলে অহনার মৃত্যু শিমুলকে আপনজনেদের কাছ থেকে শত যোজন দূরে ছিটকে ফেলেছে । সেখানে শিমুল চাইলেও আর ফিরতে পারবে না । তাই নিরবতাকেই শেষ আশ্রয় করে নিয়েছে সে । পুতুল যখন জবাব পেতে মরিয়া হয়ে ছিল তখন শিমুল একবার শুধু তাকিয়ে ছিল বকুলের দিকে । শিমুলের সপ্রশ্ন চাহনিতে বকুল চোখ নামিয়ে নিয়ে ছিল । বলার মতো কিছু যে তার কাছেও নেই অথবা আছে । আর যেটা আছে সেটা এই মুহূর্তে বলা সমীচীন নয় ।
বকুল তখন সদ্য দাদার অফিসে জয়েন করেছিল । সেই কামাল মিঞার ছেলেকে বলেছিল একটা ভালো বাসার সন্ধান দিতে । বাড়ি খুঁজে পাওয়ার পর বাকি সব পেপার ওয়ার্ক নিজ হাতে সম্পন্ন করেছিল বকুল । কিন্তু সে তখনও জানতে পারেনি কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই বাড়িতে । যখন জানল ততদিনে ওরা সপরিবারে হকবাড়ির উপরতলায় সংসার পেতে বসে আছে । নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই বকুল তখন নিজেকে বুঝিয়েছিল পুরোনো ক্ষত খুচিয়ে ক্ষতি বই লাভ কিছু হবে না । কিন্তু এ তো শেষ মুহূর্তে এসে হাটে হাড়ি ভাঙার মতো ফলাফল । শিমুলের দৃষ্টিতে তাই চোখ মেলানোর সাহস হয়নি বকুলের । তাই পুরো সময়টায় চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল এক কোনায় ।
শেফালী বেগম শক্ত মানসিকতার মানুষ । কিন্তু অহনার মৃত্যু তাকেও অনেকখানি ভেঙে দিয়েছিল । কারণ তিনি নিজে অহনাকে ছেলের জন্য পছন্দ করেছিলেন । বড়ো মিষ্টি মেয়ে ছিল অহনা । নিজের মেয়ের সাথে কখনো তাকে তুলনা করেননি তাই । কিন্তু নিজের ছেলের এমন নোংরা রুপ সহ্য করাও যে ভীষণ কঠিন ছিল । তবুও নাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে ক্ষমা করে ছিলেন তিনি । যতই হোক মাতৃ হৃদয় ছেলের শত অপকর্মের পরেও তাকে স্নেহ থেকে বঞ্চিত করতে দেয়নি । কিন্তু এবারের দৃশ্যটা তাকেও হতবাক করে দিয়েছে । শিমুলের নীরবতায় তিনি ধপ করে বসে পড়লেন সোফায় । নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত । তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ । তাৎক্ষণিক কর্তব্য সমন্ধে ভাবলেন কিছু সময় । তারপর উঠে দাড়িয়ে সবাইকে তাড়া দিয়ে বললেন ,
– ওনারা হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন । আর দেরি করা ঠিক হবে না ।
-কিন্তু মা ….
পুতুলের কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদেশ করল শেফালী বেগম ,
-যা, তৈরি হয়ে আয় ।
-আমি যাব না কোথাও ।
একগুয়ের মতো করে বলল পুতুল । শেফালী বেগম শীতল চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে । কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তুলন পুতুলের হাত ছুটিতে ঘরে দৌড়ে গেল । ক্ষণিক পরেই দৌড়েই ফিরে এলো,তার হাতে ধরা একটা নতুন জামা । শেফালী বেগমের সামনে দাড়িয়ে জামা বাড়িয়ে দিয়ে বলল ,
-দাদি , আমি দাব ।
তুলনের নিষ্পাপ মুখ খানি দেখে শেফালী বেগম নরম হলেন । স্মিত হেসে তুলনকে কোলে নিয়ে ভেতর ঘরে গিয়ে ওকে তৈরি করে দিলেন । অগত্যা পুতুলকেও নতুন পোশাক পড়ে তৈরি হতে হল । আর যাই হোক তুলনকে একা ছাড়তে পারে না সে । যদিও বাড়ির সবাই থাকবে সেখানে তবুও মনের ভেতর খুতখত থাকবেই একটা । কোনো মতেই ওই মেয়ের ছায়া সে পড়তে দেবে তুলনের ওপর ।
******
সূয্যি মশাই এসে সদ্য উকি দিয়েছিল দার্জিলিংয়ের কাঠের কটেজটায় । জানালার কাচ ভেদ করে সাদা পর্দার গাঢ় আস্তরণের ভেতর দিয়ে আলোর কিরণ এসে শিমুলের চোখ ছুয়ে দিয়েছে । আলোর এমন অযাচিত স্পর্শে চোখ কুঁচকে এসেছিল শিমুলের । বিরক্ত ও হয়েছিল খানিকটা । কিন্তু সূয্যি মশাইয়ের কি সেই খেয়াল আছে ? সে দিব্যি আলোর ঝলকানি বাড়িয়ে দিয়ে শিমুলকে বিরক্ত করতে লেগেছিল । সকালের আয়েশী ঘুমটাকে এভাবে নষ্ট করার কারণে বেজায় চটেছিল শিমুল । খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও উঠে বসেছিল । পাশেই ঘুমুচ্ছে অহনা বিড়াল ছানার মতো করে বেশ আদুরে ভঙ্গিতে । গালের নিচে এক হাত রেখে অপর হাতটি বালিশে রাখা । কোমড় অব্দি কম্ফোর্টার তুলে দেওয়া । তার ওপর দিয়েই ওর চার মাসের হালকা স্ফীত উদর দৃশ্যমান । শিমুল রুম সার্ভিসে কল করে সকালের নাস্তার অর্ডার দিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই পাহাড়ের মৃদু শীতল হাওয়া ওকে সাদরে সম্ভাষণ জানালো । দূরে দুই পাহাড়ের সন্ধিস্থলে সূর্যটা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছিল । মুগ্ধ হওয়ার মতো দৃশ্য সেটা । ব্যস্ত শহরের উচু উচু অট্টালিকার ভীড়ে এমন মোহনীয় সৌন্দর্যের অবলোকন কখনোই সম্ভব নয় । শিমুলের খুব ইচ্ছে করল অহনাকে ডেকে দেখায় । কিন্তু ওকে অমন আদুরে হয়ে ঘুমুতে দেখে আর একটা ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল । এই মুহুর্তটাকে মুঠো বন্দি করে রাখতে তুলে নিল নিজের সদ্য কেনা নিকন জেটফাইভ মিররলেস ক্যামেরাটা । প্রথমে সূর্যোদয় তার পর চুপিচুপি ক্যামেরা ঘোরালো অহনার দিকে । ধীরপায়ে এগিয়ে গেল বিছানায় । অহনার খোলা চুলের কয়েক গাছি তখন মুখের ওপর এসে পড়েছিল । শিমুল ক্যামেরা ওর মুখের ফোকাস করে পটাটপ কয়েকটা ছবি তুলে নিল । তারপর খুঁজেপেতে একটা উপযুক্ত জায়গা বের করে ক্যামেরাটা সেট করল যাতে অহনার প্রতিটা রিয়াকশন ক্যামেরাবন্দি হয়ে যায় । শিমুল বিছানায় বসে আলতো স্পর্শে অহনার কপালের এলো চুল সরিয়ে দিয়ে একটা চুমু দিল কপালে । নরম স্বরে ডাকল ,
– এই অহনা ? এই অনা, উঠে পড়ো । ওয়েক….. আপ ।সি , সাম ওয়ান ইগারলি ওয়েটিং টু মিট ইউ । কাম ওন ডিয়ার । ওঠোওও ….
-উমমমম…আড়মোড়া ভেঙে অহনা আর একটু চেপে এলো শিমুলের দিকে । ওর উরুর ওপর মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল দেখে শিমুল দুষ্টু হাসল । কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল ,
– এই কি করছ ? ও দেখছে তো ? ছিঃ লোকে কি বলবে বলো তো ?
প্রথমে কথাটাকে অতটা পাত্তা না দিলেও সত্যি কেউ দেখছে ভেবে তৎক্ষণাৎ শিমুলকে ছেড়ে দিয়ে ঝটপট উঠে বসল অহনা । বিস্ফোরিত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে মুখ ভার করে অভিমান করল । কিন্তু পরক্ষণেই আবার শিমুলকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝল সে । শিমুল চট করে অহনার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল ,
– গুড মর্নিং ডিয়ার ।
– গুড মর্নিং , মিস্টার হাবি ।
– সত্যি ও দেখছে কিন্তু …
– চুপ করে থাকো তো …ঘুমুতে দাও ।
– সত্যি বলছি কিন্তু । দেখছে আমাদের । পরে কিন্তু বলতে পারবে না যে আমি কেন আগে বলিনি …..
অহনা ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ সৃষ্টি করে মাথা তুলে চাইল ।
-কোথায় ? কে দেখছে ?
শিমুল হাতের ইশারায় ক্যামেরার দিকে তাকালে অহনা বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে নিজের পরিহিত কাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । যদিও সব ঠিকই ছিল সব তবুও অস্বস্তি হচ্ছে তার । শিমুলের উরুতে একটা চাপড় মেড়ে বলল,
-আগে বলবে না , ভিডিও করছ ?
শিমুল হাসল । চট করে অহনার ঠোটে চুমু দিয়ে বলল,
– এই ফোলা ফোলা চোখ , তেলেতেলে মুখ আর অগোছালো চুলেও তোমায় ভীষণ আদুরে দেখায় । তাই কেমন দেখাচ্ছে তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে । আমি আমার বৌকে তার সব রূপেতেই ভালোবাসি । নাও এবাই হাই বলো !
অহনা মিষ্টি করে হাসল । দুহাতে চুলগুলো মাথার পেছনে ঠেলে দিল । ক্যামেরার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে দু হাত নেড়ে বলল ,
– ” হাই, গুড মর্নিং ।… আর কি বলব ? ”
– “যা খুশি …”
অহনা এক মুহুর্ত ভাবল । তার পর পেটে হাত রেখে বলল ,
– হ্যালোও ! একটা সুন্দর সকালে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম । আপনারা দেখতে পাচ্ছেন , কত সুন্দর মিষ্টি রোদ উঠেছে পাহাড়ের কোলে । আমরা তিনজন আজ অনেক -অনেক ঘুরব । অনেক মজা করব । আর ……আর কি করব ?
শেষের কথাটা শিমুলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল অহনা । এই মুহূর্তে আর কিছু মনে পড়ছে না ওর । শিমুল চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করতেই সজোরে পেটে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো অহনা । শিমুল ‘আউ’ শব্দ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লে অহনা লজ্জায় অন্য দিকে ফিরে চাইল । ঠিক তখনই রুম সার্ভিসের লোক এসে কলিং বেল টিপলে হাফ ছেড়ে বাঁচল অহনা ,,,,
ল্যাপটপের ডিজিটাল পর্দায় এক একটা দৃশ্য শিমুলকে অতিতের পাতায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে । অহনার হাস্যরত মুখখানাতে দৃষ্টি রেখে শিমুলের ঠোঁটের কোণটাও সামান্য প্রসারিত হল । কষ্ট ভোলাতে এ যেন ক্ষণিকের ওষুধ । আকাশে আজ চাঁদের ঘনাঘটা নেই । মিশমিশে অন্ধকারে ডুবে আছে ধরনি ঠিক শিমুলের মনের মতো । তখনের পুতুলের করা প্রশ্ন গুলোর সত্যিই কোনো জবাব ছিল না শিমুলের কাছে । অহনার মৃত্যু ওর জীবনের সমস্ত রঙ একেবারে ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে । তখন তুলন না থাকলে হয়তো এত এত অপরাধ বোধ , দ্বিতীয় বার হৃদয়ভাঙার কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত না । ভালো থাকার জন্য তাই আকড়ে ধরেছিল একমাত্র আত্মজা তুলনকে । বাকি সময়টায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে কাজের মধ্যে । কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা তাই সফলতা ছুঁতে দেরি করেনি । কিন্তু শিমুল নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি ।
অহনাকে বিয়ের পরেও শিমুলের অন্তকরণে সুপ্তভাবে কিন্তু দীপ্ত হয়ে বৃষ্টির বিচরণ ছিল । এ সত্য অস্বীকার করার সাধ্য নেই শিমুলের । কিন্তু প্রথম যেদিন তুলনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারল শিমুল সেদিন থেকে একটু একটু করে কিভাবে যেন সবকিছু বদলে যেতে শুরু করেছিল । যেই মেয়েটা ওর অংশকে নিজের মাঝে ধারণ করে একটু একটু বড়ো করতে তুলছে সেই মেয়েটাকে ভালো না বেসে পারেনি শিমুল । ভালোবাসা হয়তো রং বদলায় !তাই তো জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো গোলগাল মুখের মিষ্টি মেয়েটাকে ভালো বেসে ছিল শিমুল । তারপরেই অহনার হাত ধরে জানতে পেরেছিল জীবনে একমাত্র ভালোবাসা বলে কিছু হয় না । যা থাকে তা হলো জেদ এবং মনের একপাক্ষিক উদাসীনতা । আমরা আমাদের নিজেদের তাগিদেই নতুন করে ভালোবাসতে পারি । নিজের আত্মজার খেয়াল রাখতে গিয়ে শিমুল তাই ধীরে ধীরে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল অহনার দিকে । তুলনের আগমন শিমুল আর অহনার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল । সেই নতুন শুরুটায় শিমুল এতটাই মজে ছিল যে পুরোনোকে সমূলে উপড়ে ফেলার কথা মনেই পড়েনি । আর তাই কাল হয়ে দাড়াল । অতিতকে সামনে এনে নিয়তি বড়ো নির্মম ভাবে শিমুলের থেকে অহনাকে কেড়ে নিল ।
ল্যাপটপের স্ক্রিনে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভারী হয়ে এলো শিমুলের । মাথা যন্ত্রণায় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো । কয়েক ফোটা জল ও কি গড়িয়ে পড়ল ?
( চলবে …..)