অনুভূতির সংঘাত- ১
ছামিনা_বেগম
-“অহনা ? অহনা ? আমার ব্ল্যাক বেল্টের ঘড়ি টা কোথায় ? ”
– “ড্রয়ারেই তো আছে ।একটু খুঁজে দেখতে পারো না । আমি এই শরীর নিয়ে কত দিকে দৌড়াব বলো তো ? ”
– “আমি পাচ্ছি না যে ….”
নয় মাসের অন্তসত্ত্বা ভারী শরীরটাকে ধীরেসুস্থে ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল অহনা । ক্লজেটের ড্রয়ার খুলে কালো বেল্টের ঘড়িটা বের করে চোখ গরম করে তাকাল শিমুলের দিকে ।
– খুঁজেছিলে তুমি ?
প্রত্তুত্তরে একটা আলাভোলা হাসি দেয় শিমুল । অহনা শিমুলের হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দিতে দিতে অনুযোগ করে ,
– তুমি বোঝো না কেন বলো তো ? এই ভারী শরীর নিয়ে আমার এমনিতেই চলতে ফিরতে কষ্ট হয় । আর তুমি জেনেবুঝে আমাকে এত হয়রান করাও ! ”
-” কি করব বলো ? তুমি তো নড়তেই চাও না জায়গা থেকে । তোমার কথা শুনলে যে এদিকে আমার রোজকার পাওনা বাকি থেকে যায় । ড্রয়িং রুমে সবার সামনে তো আর তা আদায় করা যায় না । ”
-” যাহ ,দুষ্টু । কদিন পরে মেয়ে আসছে , এখনো তোমার বাদরামি যায় না, না ?
হালকা সুরে শাসন করে দেয় অহনা , মুখে তার প্রশ্রয়ের হাসি । শিমুল পত্নীর কপালে চুমু একে দিয়ে হাটু গেড়ে বসে । অহনার স্ফীত উদরে হাত বুলিয়ে একটা গভীর চুমু দিয়ে বলে ,
-“দেখেছ মাম্মাম , তোমার আম্মি এখনি কত অলস হয়ে গেছে ? আমি যে সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকব , এদিকে যদি আমার মাম্মাম টা দেখা করে না যাওয়ার জন্য রেগে থাকে আমার ওপর তখন কি হবে ? আমার মাম্মামের আব্বুটা কষ্ট পাবে না, বলো ?
অহনা মৃদু টানে চুল টেনে দেয় শিমুলের ।
-ইস !কি খারাপ তুমি ? ও শুনতে পাচ্ছে না সব ? তুমি এখনি আমার নামে মেয়ের কাছে নালিশ করছ ? বাপ মেয়ে এখনি আমাকে দল ছাড়া করতে চাইছ, হ্যাঁ ?
শিমুল হেসে বলে ,
-“শোনো মাম্মাম , আম্মির কথা একদম শুনবে না বুঝছে ? আম্মির এখন রাগ করার রোগ হয়েছে ? কথায় কথায় রাগ দেখায় আবার অভিমান করে । এত রাগ অভিমান আমি একা সামলাতে পাচ্ছি না, বুঝেছ ? তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো তো । তখন আমরা দুজনে মিলে আম্মির রাগ গুলো ভাগ করে নেব ,ঠিক আছে । ……এখনি আসি আমি । লক্ষ্মী হয়ে থাকবে । আম্মিকে একদম জ্বালাতন করবে না । ঠিক আছে ? ”
স্ত্রী এবং অনাগত কন্যার সাথে দুষ্টু মিষ্টি আলাপ করে শিমুল অফিসে চলে গেল । শেফালী বেগম ওরফে শিমুলের মাও অহনাকে তৈরি হতে বলল । আজ মান্থলি চেক আপের দিন । সকাল সকাল বকুল নাম লিখিয়ে ভার্সিটি চলে গেছে । ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে উনিশ নম্বরে তাদের সিরিয়াল পড়েছে । তাই একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে । শাশুড়ির কথায় অহনা ঝটপট তৈরি হয়ে গেল ।
প্রাসাদসম মতো বিশাল বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে বাল্যস্মৃতিতে ডুবে আছে বৃষ্টি । ইট রঙা বাড়িটির প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কিছু মধুর বাক্যালাপ । পাঁচ বছর আগে যখন এই শহর ত্যাগ করেছিল তখন এত জাকজমক হয়ে ওঠেনি চারপাশটা । শহুরে বিলাসিতা থাকলেও গ্ৰামের নির্মলতা ধুয়ে মুছে যায়নি তখনো । রাস্তার পাশে ফুটপাত ধরে হাটলে এখনকার মতো নর্দমার ময়লা জলের গন্ধ নাকে আসত না । যানবাহনের দৌরাত্ম্য তখনো বৃদ্ধি পায়নি ।বর্ষার দিনে তাই অনায়াসেই পাকা রাস্তায় বৃষ্টিবিলাস করা যেত সব বান্ধবীরা মিলে । অথচ আজ সেই পুরোনো মফস্বল শহরটির চিহ্ন নেই । চারিদিকে উচুঁ উচুঁ অট্টালিকা দৈত্যের ন্যায় পাহারা দিচ্ছে ।
এবারও এই শহরে ফেরার কোনো ইচ্ছা ছিলো না বৃষ্টির । শহর ছাড়ার আগে নিজের জীবনের এক সুন্দর অতীত সে নিজ হাতে কবর দিয়ে গেছে । তার অমোঘ টান আজও বর্তমান । যা এখানে এসে আরো তরতাজা হয়ে উঠেছে । আচ্ছা সেই মানুষটা কি ওকে ভুলে গেছে ? হয়তো গেছে !যাওয়ারই কথা । বিষাক্ত জিনিসের মায়া করে যে লাভ হয় না কোনো । আর বৃষ্টি তো তার জীবনের এক বিষাদময় অধ্যায়ের নাম । কিন্তু তবুও ফিরতে হলো এখানে । গ্ৰামের দিকটায় কিছু লোক ওদের সম্পত্তিতে জবরদখল করে বসেছে । বড়ো আব্বু সেগুলো সামলাতে পারছিলেন না । কারণ সেই সম্পত্তির কাগজপত্র সব আব্বুর লকারে আছে । সেই সমস্যা মিটমাট করতেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে ফিরতে হয়েছে । এই চারদিন সেসব নিয়েই এত ব্যস্ততা গেছে যে ঠিক মতো দম ফেলার জায়গা ছিলো না । আজ অবশ্য এর একটা দফারফা হয়ে গেছে । আসল কাগজপত্র দেখে ওই লোকগুলো আর বাড়াবাড়ি করেনি । সকালেই ওদের পক্ষের উকিলকে সঙ্গে করে সব সমস্যা মিটিয়ে এসেছে বৃষ্টি , সঙ্গে বড়ো আব্বু ছিলো ।
বিভোর হয়ে থাকতে থাকতে কখন যে বড়ো আব্বু এসে পাশে দাড়িয়েছে বুঝতে পারেনি বৃষ্টি । গলা খাকড়ি দিয়ে তিনি তার অস্তিত্ব জানান দিলে বৃষ্টি সচকিত হলো। বড়ো আব্বু নাজিম হককে দেখে মৃদু হাসলো সে ।
– তুই কি শুক্র বারেই চলে যাবি ? আর কটা দিন থেকে যেতে পারতি !
– না , বড়োআব্বু , সেটা সম্ভব নয় । জানোই তো, আব্বুর শরীরটা আজকাল ঠিক থাকে না । মাসে মাসে চেক আপ করতে হচ্ছে । ইশানের জিম্মায় রেখে এসেছি । ওর ও টেস্ট ম্যাচ সামনে । তাই থাকতে পারব না । আবার নানুমনির সাথেও দেখা করে যেতে হবে । মামা সাথে যেতে বলেছিল কিন্তু আমি আর একদিন এখানে থাকতে চাচ্ছি । ”
-বেশ । আমি তোর ইচ্ছেয় বাধা দেব না । তবে তুই এখানে আর কটা দিন থাকলে ভালো লাগত ।
– বড়ো আব্বু , মিতুল বলছিল , এই বাড়িটা নাকি ডেভেলপাররা চাইছে । আপনি কি ভাবছেন ?
– এই বাড়িটা তো আমার একার নয় । আজিমের মতামতটাও নিতে হবে । তবে আমার ইচ্ছে নেই । এই ঐতিহ্যময় ‘হক বাড়ি’র প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে এর আভিজাত্য প্রকাশ পায় । আমি চাইছি না কোনো মানুষ বা যন্ত্র এর ঐতিহ্যে আঘাত করুক । থাকুক ‘হক বাড়ি ‘এর চিরাচরিত ঐতিহ্য নিয়ে । আমাদের নেক্সট জেনারেশনদের তো আমাদের পারিবারিক ইতিহাস সম্পকে জানা উচিত , তাই না ?
নাজিম হক হালকা হাসলেন । বৃষ্টি কিছুটা লজ্জা পেল ।
– পরের সপ্তাহে আমি আর তোমার বড়োমা ব্যঙ্গালোরে যাচ্ছি আজিমকে দেখতে । সাইফ ও আসবে সেখানে ।
-ওহ , হ্যাঁ । সাইফ ভাইয়া বলেছিল আমাকে । আপনারাও নাকি ইউ এস সিফ্ট করবেন ?
– সাইফ , ইনান তাই চাইছে । দেখা যাক কি হয় ..!
– রেশমি আপা কেমন দেখছ ?
উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে থাকে অহনা । ডাক্তার রেশমি আক্তার আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে বেবির মুভমেন্ট চেক করছে । সামনের ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে গর্ভস্থ শিশুর প্রতিচ্ছবি। রেশমি সম্পর্কে অহনার দূর সম্পর্কের বোন হয় । তাই বেআইনি কাজ হওয়া সত্ত্বেও ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ করেছে সে । গর্ভস্থ সন্তানের ছবি দেখে মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলল অহনা । ওর শাশুড়ি শেফালী বেগম পুত্রবধূর হাত চেপে ধরেলেন । আবেগ সামলাতে না পেরে তার চোখের কোল বেয়ে ঝরে গেল কয়েক ফোঁটা আনন্দাশ্রু ।
– বেবির মুভমেন্ট তো খুব ভালো দেখাচ্ছে । ধারনা করছি আগামী পঁচিশ সেপ্টেম্বর আমাদের ডেলিভারি করতে হবে । এর আগেও পেইন হতে পারে । আপনি সতর্ক থাকবেন ।
– পঁচিশ সেপ্টেম্বর ! আর মাত্র ছয় দিন ?
– হুম । আপনার বংশধরের খুব তাড়া দেখছি দুনিয়া দেখার । আপনি তৈরি থাকুন, বুঝলেন আন্টি ? সে আসছে ,,
– আলহামদুলিল্লাহ , সে তো নয় মাস আগে থেকে তৈরি হয়ে আছি , মেয়ে ।
ডাক্তার রেশমির চেম্বার থেকে বেরিয়ে অহনা বায়না জুড়ল সে বাচ্চার জন্য কিছু কেনাকাটা করবে । প্রথমে শেফালী বেগম ওর শারীরিক অবস্থা দেখে মানা করলেও পরে ওর খুশি দেখে রাজি হয়ে গেলেন । শপিং মলের কিডস্ কর্ণারে গিয়ে বেঁছে বেঁছে সেরা জুতো , জামা , তোয়ালেটা কিনলো অহনা । দুপুর পেরিয়ে ফিরল একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে । আর এতেই ঘটলো বিপত্তি । এত জিনিস রাখার জায়গা নেই ঘরে । শেফালী বেগমের পরামর্শে শিমুলের বইয়ের আলমারি এবং বুক শেল্ফটা সরিয়ে স্টোর রুমে নিয়ে যাওয়া হলো । এমনিতেও শিমুলকে রাত জেগে কাজ করতে হয় । কয়েকদিন পর বাচ্চা আসলে ওর সমস্যা হতে পারে ভেবে স্টোর রুমটাকেই ঝেড়ে মুছে স্টাডি রুম বানিয়ে দিতে বললেন ছোট মেয়ে পুতুলকে । মায়ের কথা মতো পুতুলও নেমে পড়ল কাজে , ওকে সাহায্য করতে হাতে হাত লাগালো অহনা ।
-ভাবি ! তুমি একটু বসে থাকো তো , এত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না তোমার । না হলে আম্মু আমাকেই বকবে এসে !
– সারাদিন তো বসেই থাকি । আর কত বসে থাকব ? এমনিতেও আমার এসব করতে ভালোই লাগছে ।
পুতুল সরু চোখে তাকায় । বলে ,
-ডাক্তার আপা কিন্তু তোমাকে ভারী কাজ করতে বারণ করে দিয়েছে । আর তুমি আজকে অনেক ছুটোছুটি করে শপিং করেছ । চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি ক্লান্ত । তাও এসব করছ কেন ? বললাম তো, আমি করে ফেলব সব । তুমি যাও । রেস্ট করো গিয়ে ।
-ঠিক আছে বাবা । আর ছুটছি না । খুশি তো ? আমি বরং বই গুলো সাজিয়ে রাখি ।
পেটের ওপর আলতো হাত রেখে অহনা বেরিয়ে গেল । পুতুল সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় । এতো ক্লান্ত থাকার পরেও এতো জীবনীশক্তি আসে কোথা থেকে !! আল্লাহ মালুম !
এক এক করে টেবিলের ওপর জমিয়ে রাখা বইয়ের স্তুপ র্যাকে সাজিয়ে রাখছে অহনা । হঠাৎ একটা হার্ডকভার র্যাকে রাখতে গিয়েও কি মনে করে আবার বের করে আনে । কারণ কালো রঙের শক্ত কভারের ওপর রুপোলি রঙে জ্বলজ্বল করছে ‘ Nightmare 2016’ লেখাটি । অহনা কৌতুহল দমন করতে না পেরে পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখতে লাগল । ডায়েরিটা পুরোনো হওয়ায় পৃষ্ঠার রং হলদেটে বর্ণ ধারন করেছে , বল পেনের লেখা গুলো প্রতি পৃষ্ঠার উভয় দিকে হালকা ছাপ ফেলেছে । কয়েক লাইন পড়েই অহনা কৌতুহলী হয়ে উঠল ।
– কি দেখছো ভাবি ?
-এই ডায়েরিটা ! তোমার দাদা গল্প লিখত নাকি ?
-কি জানি ! আমি তো এমন শুননি কখনো । তবে একদিন দিনলিপি লিখতে দেখেছিলাম । আসলে দাদা টাইমটেবল মেনে পড়াশোনা করত তো সবসময় । তাই অনেক কয়েকটা জমে গিয়েছিল । দাদার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর মা সেসব ফেলে দিয়েছে । তবে এটা কিভাবে যেন এড়িয়ে গেছে !
– এড়িয়েছে , ভালো হয়েছে । দেখা যাক না এ থেকে কোন মনি মুক্তো বের হয় ?
ভ্রু নাচিয়ে বলল অহনা । পুতুল হেসে ফেলল । বললো ,
-ছিঃ ভাবি । অন্যের ডায়েরি লুকিয়ে পড়া কিন্তু মারাত্মক অপরাধ ।
-আচ্ছা ,তাই ? কিন্তু বুনু সেই অন্য লোকটা কিন্তু আবার বর হয় ।
-দেখো ,দেখো । কিছু খুঁজে পেলে আমাকেও জানিও !!
অহনা মুচকি হেসে ডায়েরি হাতে নিজের ঘরে ফিরে গেলে পুতুল নিজের কাজে লেগে পড়ল।
শিমুল ফোন করেছিল , ওর নাকি আজ ফিরতে দেরী হবে । তাই অহনাকে অপেক্ষা করতে বারণ করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলল । বিকেলে ডায়েরি টা পড়ার জন্য নিয়ে আসলেও ক্লান্ত থাকার দরুন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে । রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাই আবার বসেছে ডায়েরি হাতে । মানুষের মন বড়োই কৌতুহলী । বিশেষ করে যা নিষিদ্ধ তার প্রতিই যেন আগ্ৰহ দ্বিগুন হয়ে যায় । অহনা মনে মনে পুলকিত হচ্ছে । রহস্য উন্মোচনের এক অদম্য নেশা যেন চেপে বসেছে ওর মাঝে , পৃষ্টা উলটে পড়া শুরু করলো সে …..
কয়েকদিন থেকেই পড়ার চাপ ভীষণ বেড়েছে । বারিণ স্যার আমার নাম দিয়ে দিয়েছে সেমিনারে । তার জন্য পেপার রেডি করতে হচ্ছে । রোজ নাকে মুখে কোনোরকমে দুটো খাবার গুজে দৌড়তে হচ্ছে ভার্সিটি । আজ আবার সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল । ক্যাম্পাসেই আটকে গেলাম । পাঁচটায় একটা টিউশনি আছে ও পাড়ায় । ভিজে ভিজে তো আর পড়াতে যাওয়া যাবে না । কি যে বিরক্তিকর ! এদিকে বিকেল নেমেছে । ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকাই বলতে গেলে । লাইব্রেরীর একটা বই নেওয়া ছিল সেটা ফেরত দিয়ে আনমনে হাটছিলাম করিডোর দিয়ে হঠাৎ একটা কন্ঠস্বর শুনে আমার পা জোড়া আটকে গেল । কান পেতে শুনলাম আমার ডানদিকের বন্ধ ঘরটা থেকে কারো গানের সুর ভেসে আসছে । আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম সেদিকে । দেয়ালে হেলান দিয়ে বিভোর হয়ে শুনলাম সেই কোকিল কন্ঠের সুরের লহরী । আমি বুদ হয়ে রইলাম গানের প্রতিটি শব্দে…
” সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই।
একলা রাধে জল ভরিতে যমুনাতে যায় ,
পিছন থেকে কৃষ্ণ তখন আড়ে আড়ে চায় ।
জল ভরো ,জল ভরো রাধে ও গয়ালের ঝি ,
কলস আমার পূর্ণ করো রাধে বিনতি ।
কালো মানিক হাত পেতেছে চাঁদ ধরিতে চায়
বামন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায় ? ”
কখন যে গান শেষ হয়েছে আর কখন যে মেয়ে গুলো বেরিয়ে গেছে আমি খেয়াল করিনি । ঘোর ভাঙলো ওদের উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনে । দেখলাম মেয়েদের একটি দল করিডোর দিয়ে হেটে যাচ্ছে । ওদের মধ্যে একটি মেয়ে কৌতুক করে সুর করে গাইলো ,
“এমনো অঙ্গের ও বিষ যে ঝাড়িতে পারে
সোনার এই যৌবন খানি দান করিব তারে ।
হাসির ফোয়ারা উঠল মেয়েদের দলে । সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটি মেয়ে সুর তুললো ,
আমার মতো সুন্দর রাধে যদি পেতে চাও
গলায় কলসি বেঁধে যমুনাতে যাও ।
অন্য একটি মেয়ে গাইলো ,
কোথায় পাবো হার কলসি কোথায় পাবো দড়ি ?
তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি ।
দ্বিতীয় মেয়েটি এবার ওদের সামনে এগিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনে পা ফেলতে ফেলতে সুর করে গাইলো ,
কালো মানিক হাত পেতেছে চাঁদ ধরিতে চায় ,
বামন কি আর হাত বাড়ালেই চাঁদের দেখা পায় ?
বামন চাঁদ ধরতে পারে কি না এ নিয়ে বিস্তর সংশয় আছে । কারণ সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে । বর্তমানে মানুষ চাঁদ চলে যাচ্ছে । তবে আজ এই মুহূর্তে আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম এক শ্যামাঙ্গি রাধার বাক পটু দুই আঁখিতে । আমি ভুলে গেলাম আমার টিউশনি আছে আজ । ঠায় দাড়িয়ে রইলাম তার পথের পানে যতক্ষণ না সে মিলিয়ে গেল ভার্সিটির প্রবেশদ্বারের ভাঁজে ।
ধপ করে ডায়েরি বন্ধ করে রাখলো অহনা । ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে । প্রবল আগ্ৰহ নিয়ে পড়া শুরু করলেও এখন হিংসে হচ্ছে সেই শ্যামাঙ্গির প্রতি । কেন শিমুল তোমায় ভালোবাসবে ? কেন তুমি শিমুলকে মুগ্ধ করলে , বলো ? ভীষণ আবেগী মেয়েটার চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো । তবুও পরে কি হলো জানার তীব্র আকাঙ্খা থেকে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না সে ।
(চলবে )