অফুরন্ত প্রণয়,১৭ শেষপর্ব
তারিন_জান্নাত
ইয়াশাকে বিধ্বস্তরূপে ড্রয়িংরুমের দিকে আসতে দেখে থমকে গেলেন ইউসুফ সাহেব। আরিফা তখন চায়ের কাপে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো।মিনু আরা আজ সকাল সকাল নিজের বোনকে দেখতে গিয়েছে। যারফলে আজ সকালের চা টা আরিফাকে করে দিতে হচ্ছে। ইয়াশার বিধ্বংসীরূপে দেখে সেও হতবাক হয়ে যায়।চায়ের কাপটা ইউসুফ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো আরিফা।ইউসুফ সাহেবের দৃষ্টি তখন তাঁর একমাত্র মেয়ের দিকে।চায়ের কাপটা হাতে না নিয়ে চেয়ে থাকলেন নির্নিমেষ।ইয়াশা বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে এসে তার বাবার পায়ের কাছে বসে পড়লো।অকস্মাৎ ইউসুফ সাহেবের পা-জোড়া দুর্বল হস্ত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইয়াশা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
–” বাবা আমাকে ক্ষমা করো।নওশাদের ব্যাপারে আমার অনেক আগে তোমাকে জানানো উচিত ছিলো। তুমি আমাদের ভুল বুঝোনা বাবা।”
ইউসুফ সাহেব মেয়ের কথা শুনে অগোচরে হালকা হাসলো।পাশে আরিফাও মিটমিট হাসতে লাগলো।সে সম্পূর্ণ ব্যাপারে অবগত।তার সাহায্যে নওশাদ এতটা করতে সক্ষম হয়েছে।ইয়াশার কান্না বেগ তখনো স্থির।ইয়াশা পূনরায় বলে,
–” বাবা আমাদের মধ্যে খারাপ কোন সম্পর্ক নেই।কিন্তু আমি উনাকে ভালোবেসে ফেলেছি এ কয়দিনে।যা করা আমার একদম উচিৎ হয়নি।কিন্তু আমার মনের কাছে আমি হেরে গেছি বাবা।আমাকে ক্ষমা করো। আমি জাবিরকে বিয়ে করে ঠকাতে চায় না বাবা।”
ইউসুফ সাহেব আরিফার দিকে তাকালো।আরিফা বিষম খেয়ে তাড়াতাড়ি ফলের ঝুড়ি থেকে একটা কলা নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।ইউসুফ সাহেব ইয়াশার মাথায় পরম যত্নে হাত রাখলো।ইয়াশা এতে যেনো সাহস পেলো। মাথার হাত পেয়ে কান্না চাপানোর প্রচেষ্টা চালালো। ইউসুফ সাহেব বললেন,
–” ইয়াশা! আমি সব জানি।নওশাদ আমাকে সব জানিয়েছে। এও জানিয়েছে যে সে তোকে ভালোবাসে। আমার কোন আপত্তি নেই।ছেলে হিসেবে নওশাদ চমৎকার। আর আমার মেয়ের জামাই হিসেবে তো আরো দ্বিগুন চমৎকার। তুই তৈরি হয়ে আয় নওশাদকে খুঁজতে যেতে হবে।হঠাৎ করে রাগ করে চলে গেছে।”
ইয়াশা তব্দা খেয়ে উঠে দাঁড়ায়।চোখমুখে বিশাল বিমূঢ়তা।কথাগুলো তার বিশ্বাস করতে বুক কাঁপছে। তার বাবা কি করে নওশাদের কথায় সম্মতি জানালো ভেবে কূল হারিয়ে ফেলে ইয়াশা।যেখানে বছর খানেক আগে একটা পুলিশ কেইস হয়েছিলো তার বাবার।একটা ছেলেকে পেটানোর দ্বায়ে।ছেলেটা সন্ধ্যার পর থেকে বাড়ির বাইরে ঘুরাঘুরি করতো।লোকে জানতে পেরে ছেলেটার ব্যাপারে তার বাবার কাছে জানতে চাইলো।ইউসুফ সাহেব সেদিন সে কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে যান।ছেলেটাকে একদিন বেধড়ক মারধর করেন। বৃত্তবান পরিবারের ছেলে হওয়ায় পরিবার থেকে মামলা হয়।অনেক কষ্টে সেই কেইস ধামাচাপা দেন ইউসুফ সাহেব।সে ভয়ে সেদিন নওশাদকেও বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলো।দ্বিতীয়বার পুলিশ কেইস হওয়া থেকে রক্ষা পেতে।
মেয়ের ভাবুক ভঙ্গিমা মুখ দেখে ইউসুফ সাহেব হালকা উচ্চকন্ঠে বললেন,
–” যাও তৈরি হয়ে এসো।”
ইয়াশা ইয়াশা চোখ নামিয়ে মিনমিন গলায় বলল,
–” বাবা বিয়েটা?
ইউসুফ সাহেব হেসে বললেন,
–” জাবিরের বিয়েটা সুমনার সাথে হচ্ছে।তাদের পরিবার থেকে জানিয়েছে সে-কথা।আমি ভীষণ খুশী। আমার মৃত ভাইয়ের মেয়েটার কোন কূল-কিনারা হতে যাচ্ছে।”
বলে ইউসুফ সাহেব অফিসের ব্যাগটা নিয়ে রুমে চলে গেলেন। আজ আর অফিসে যাবেন না।
যাওয়া অসম্ভব!
দুরুদুরু বুক নিয়ে হাঁটছে ইয়াশা। আজ তার বাবাকে দেখে সে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে।ছোটবেলার সেইসব কড়া শাসনের কথার জন্য সে খুব অভিমান করতো।সেসব স্মৃতি সে ভুলতে চাইছে। কড়া শাসনে রেখেও মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দেয় কয়জন বাবা?
ইয়াশার আজ মুখ ফুটিয়ে বলতে চাচ্ছে,
–” আমি তোমাকে অনেক অনেক
আর অনেক ভালেবাসি বাবা।”
বড়-রাস্তায় উঠলে রাস্তার অপরপাশে মুখোমুখি তিনচারটা দোকান দেখা গেলো।তন্মধ্যে একটা দোকানে নওশাদকে বসা অবস্থায় দেখতে পেলো ইয়াশা।লজ্জায় চোখ নামালো ইয়াশা।বাবাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে সে।ইয়াশা চায় তার বাবা যেনো সর্বপ্রথম নওশাদকে দেখে তাকে জানায়।
হলোও তাই।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ঠোঁটের কাছ থেকে কাপ সরালো নওশাদ।চোখ তুলতেই দেখলো ইউসুফ সাহেবকে।পাশে সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা যুবতিকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো সে।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চায়ের বিল চুকিয়ে ইউসুফ সাহেবের দিকে মুখ ফিরে দাঁড়ালো।হাতের মাস্কটা পড়ে নিলো কৌশলে। চলে যেতে উদ্যত হতে গেলো সে,পরে দেখলো ইউসুফ সাহেব ইয়াশার হাত ধরে রাস্তার এই প্রান্তে আসছে।নওশাদ দাঁড়ানোর প্রয়োজনবোধ করলো।মাথা নিচু করে শার্টের গুটানো হাতটা পূনরায় গুটাতে লাগলো। ততক্ষণে ইউসুফ সাহেব সোজা নওশাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।ইউসুফ সাহেবের পেছনে ইয়াশা নিজেকে আঁড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ সেটা দেখে নাক ফুলালো হালকা। গম্ভীর মুখে ইউসুফ সাহেবের
উদ্দেশ্যে বলল,
–” আঙ্কেল আপনি এখানে? কিছু বলবেন?”
ইউসুফ সাহেবের প্রশস্ত হাসলো,মুখে বলল,
–” তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার মেয়েকে কখন তোমার হাতে তুলে দিবো?যদি বলি আজ সেই শুভ দিন তাহলে কী তোমার আপত্তি আছে?”
নওশাদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ইয়াশার সামনে কথাটা তুলায় মূলত নওশাদে এই বিব্রতবোধ।নাহলে এসবের দ্বার ধারে কে? এটা তো তারজন্য সুখকর মুহূর্ত।নওশাদ চাপা হাসলো। বলল,
–” জ্বি!”
ইউসুফ সাহেব ইয়াশার হাত ধরে পেছন থেকে টেনে আনলেন।এরপর ইয়াশার হাতটা নওশাদের পুরুষ্ট হাতের তালুতে বসিয়ে দিলো। শক্ত চামড়ার উপরে নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পেয়ে নওশাদ তৃপ্তিদায়ক হাসি দিলো,সঙ্গে দিলো কৃতজ্ঞতার হাসি।
দু’হাতের দিকে তাকিয়ে ইউসুফ সাহেব বললেন,
-” আমার কাছে সবার চেয়ে জরুরি মেয়ের ভালো থাকা।আর আমার মেয়ের ভালো থাকাটা তোমাতে বিদ্যমান। যাও আজ সারাদিন তোমাদের ছুটি। ঘুরাফেরা করো,আনন্দ করো,অবশেষে সন্ধ্যার পূর্বে বাড়ি ফিরে এসো।”
নওশাদ হালকা হেসে বলল,
–” আঙ্কেল মেয়েকে তো আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।পরবর্তী সময়ের অনুমতিটা আশা রাখছি আপনি চাইবেন আমার কাছ থেকে।”
ইউসুফ সাহেব চোখে হাসলো।এতক্ষণে নওশাদের অভিমানের মূল কারণটা বুঝতে পেরেছেন উনি।নিঃশব্দে জায়গা প্রস্তান করলেন।উদ্দেশ্য নিজের অসুস্থ শালীকে দেখতে যাবেন।এবং ফেরার পথে স্ত্রী মিনু আরা সব জানাবেন।
তুলতুলে নরম হাতে চাপ দেওয়ার লোভ সামলালো না নওশাদ। চেপে ধরে বলল,
–” আঙ্কেল নিজেই আপনাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।এবার কী করবেন? কোথায় পালাবেন?”
ইয়াশা উত্তর না দিয়ে ড্যাবড্যাব করে নওশাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরক্ষনে হেসে উঠলো।
নওশাদ হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে বলল,
–” হাসছেন কেন? জোকস্ শুনিয়েছি আমি?”
ইয়াশা হাসতে হাসতে সামনের দিকে চলে
যেতে যেতে বলল,
–” আপনি না চলে যাচ্ছিলেন? যান যান রাস্তা ওইদিকে।” [পেছনের দিকে রাস্তাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল]
–” আচ্ছা টুটি কোথায়? ওকে নিয়ে আসতেন।
ইয়াশা হাস্যময় মুখে চলতে চলতে বলল,
–” আছে খাঁচায় বন্দি।আসার সময় দেখেছিলাম।
নওশাদ দ্রুত বেগে এগিয়ে ইয়াশাকে নিজের দিকে ফেরালো।আশেপাশে কাউকে না দেখে ঝট করে ইয়াশার মাস্ক নামিয়ে ফেললো।
সাথে সাথে ইয়াশার হাসি থেমে যায়। এবং অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।নওশাদ ইয়াশার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করলো। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টিস্যু বের করে ইয়াশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–” আল্লাহ! আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য লিপস্টিক পড়েছেন? তাও আবার লাল। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।জলদি মোছেন।আমি সত্যি ইমপ্রেস হয়েছি।কিন্তু বেসামাল হতে চায় না।”
নওশাদের কথার ভঙ্গিমা দেখে ইয়াশা আবারও হাসতে লাগলো। নওশাদ ইয়াশার ধূসর চোখ, ফোলা ফোলা গালের মধ্যমণি ছোট নাক, এর হালকা নিচে রঙিন অধরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো।প্রথম দর্শনে কে বলে মেয়েটা মোটা। মেয়েটা তো আস্ত আদুরে নরম তুলতুলে একটা বিড়ালছানা মাত্র।নওশাদ চোখ সরিয়ে ইয়াশার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। ইয়াশা নওশাদের বাহু জড়িয়ে তাতে মাথা টেকালো। হাতের ভাঁজে হাত রেখে একে অপরের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো অফুরন্ত প্রণয়ের…!
(সমাপ্ত)