অফুরন্ত প্রণয়,১১,১২
তারিন_জান্নাত
১১
ইউসুফ সাহেব হাতের লুঙ্গিটা নওশাদের হাতের দিলেন। নওশাদ হালকা হেসে লুঙ্গিটা হাতে নিলো।যদিও সে কখনো লুঙ্গি পড়েনি। ইউসুফ সাহেবকে সরানোর জন্যই লুঙ্গির কথাটা বলেছে। লুঙ্গি হাতে নিয়ে নওশাদ চেহারায় কঠিন্যভাব এনে বলল,
–” আঙ্কেল আপনার মেয়ে ভীষণ বেয়াদব। বড়দের রেসপেক্ট করেনা।”
ইয়াশা ভয়ে আঁতকে উঠলো। ইউসুফ সাহেব বিস্মিত হলেন নওশাদের কথায়।উনার জানামতে ইয়াশা একদম শান্তশিষ্ট এবং ভদ্রমেয়ে। বড়দের যথেষ্ট রেসপেক্ট করে।ভুল ভাঙাতে ইয়াশার দিকে তাকিয়ে নওশাদকে প্রশ্ন করে,
–” কেন বাবা? কী করেছে আমার মেয়ে?”
নওশাদ নাকমুখ কুঁচকে এক করে বলল,
–” আপনার মেয়েকে বলেছি উনার ফোনটা যাতে আমাকে দেয়।আশ্চর্যের বিষয় উনি বলছেন উনার নাকি ফোন নেই।এটা মানা যায়? আপনি জিজ্ঞেস করুন আঙ্কেল উনি ফোন কেন দিচ্ছেন না আমাকে।” ইয়াশা মনে মনে ক্ষেপে যায় ভীষণ নওশাদের বলা মিথ্যে কথাটা শুনে।ইউসুফ সাহেব মুখে থমথমে ভাব এনে কিছুসময় নীরব থাকলেন।এরপর বললেন,
–” ওর কাছে সত্যিই ফোন নেই।তুমি চাইলে আমার ফোন নিতে পারো। তোমার কী সব মনে পড়েছে?”
নওশাদ ভাবুক ভঙ্গিমায় চেয়ে বলল,
–” কী মনে পড়বে?”
–” ফোন চাইছো যে?”
–” আসলে আমি থানায় ফোন করতে চাই।তারা যাতে আমার পরিবারের খোঁজ এনে দেয়। আমার নিশ্চয় একটা পরিবার আছে।পরিবাহীন তো নয় আমি। তাই পুলিশকে বলবো আমার নিঁখুজ হওয়ার খবরটা যাতে আমার ছবি সমেত পেপারে ছাপানো হয়। আইডিয়া ভালো না আঙ্কেল?”
ইউসুফ সাহেব ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নওশাদের দিকে তাকালেন।উনার মনে হচ্ছে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন।ব্লাড প্রেশার তরতর করে বাড়তে লাগলো যেনো। তন্মধ্যে নওশাদ আবারও বললেন,
–” আঙ্কেল খবরে এটাও ছাপানো হবে যে আমি আহত অবস্থায় আপনার বাড়ির সামনে পড়ে ছিলাম। আঙ্কেল ফোন টা দিন তো।”
ইয়াশার এই পেট ফেটে হাসি আসতে চাইলো। দুঃখের বিষয় সে এখন হাসতে পারছেনা।তার বাবাকে এমন জালে ফাঁসতে দেখতে তার ভালোই লাগছে। নওশাদ বেশ ভালোই জব্দ করেছে ভাবতেই ইয়াশা পুনরায় দৃষ্টি মেলে নওয়াদের দিকে তাকালো। নওশাদের চোখাচোখি হলে সে দ্রুত চোখ সরায়।নওশাদের এমন ধারালো দৃষ্টির থেকে রক্ষা পেতে সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্দেত হয়।দরজার কাছাকাছি গেলেই নওশাদ বলে,
–” ইয়াশ! এখানাকার থানার নাম্বারটা দিন তো। কয়টা বাজে এখন উনাদের পাওয়া যাবে?”
ইয়াশা দাঁতের সাথে দাঁত পিষে বলে,
–” ইয়াশা!”
নওশাদ প্রতিউত্তরে হাসলো ইয়াশার দিকে চেয়ে।
ইউসুফ সাহেব পাশের সোফাটায় বসলেন। চোখমুখে চিন্তা উপচে পড়ছে তাঁর। নওশাদ মনে মনে ভীষণ আনন্দিত।ভালোই ফাঁদে পড়েছে ভদ্রলোক।এবার হাড্ডি-পিত্তি জ্বালিয়ে তবেই যাবে সে।
ইউসুফ সাহেব অনেক্ষণ পর মুখ খুললেন,
–” শোন বাবা, তুমি তো এখন আহত।অনেক জায়গায় আঘাত পেয়েছো একটু সুস্থ হও তারপর পুলিশকে আমি নিজেই জানাবো।”
–” বলছেন আঙ্কেল?”
–” হ্যাঁ বলছি,তুমি নিশ্চিন্তে এখানে থাকতে পারো।কিছুদিন পর আমার মেয়ের বিয়ে।বিয়ের অনুষ্ঠান চুকে যাক।তারপর নাহয় যেও?”
নওশাদ মন খারাপ করে বললে,
–” আপনার বাড়ি লোক যদি আপত্তি করে আঙ্কেল?”
–” করবেনা কেউ কিছু,আমি আর ইয়াশা সামলে নেবো। আচ্ছা তোমাকে কী নামে ডাকা যায়।একটা নাম অন্তত রাখা যায়, কী বলো?”
নওশাদ ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
–” নওশাদ নামটা কেমন? আপনি চাইলে এই নামটা ডাকতে পারেন।”
–” এটা কার নাম? তোমার?
— ” না না হঠাৎ মনে পড়লো।”
ডাইনিংরুম থেকে মিনু আরা উচ্চ স্বরে বলে উঠেন,
–” কই গো? কোথায় তুমি? খেতে আসবেনা?”
ইউসুফ সাহেব তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন। এই কর্ণারের রুমটি সবচেয়ে বড় রুমটি ইয়াসিরের।ইয়াশার রুমের সোজাসুজি। ফলে বাকি রুম থেকে তাদের কেউ এখান দেখতে পাবেনা।
ইউসুফ সাহেব বলেন,
–” নওশাদ তুমি থাকো।আমি খেয়ে আবারও আসবো তোমাকে দেখতে। ওহ আল্লাহ তুমিও তো না খাওয়া।”
ইয়াশা বলে উঠে,
–” বাবা তুমি খেয়ে এসো।তুমি আসলে নাহয় আমি উনার জন্য খাবার নিয়ে আসবো।”
ইউসুফ সাহেব মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়িয়ে খেতে চলে যান। বাবা যেতেই ইয়াশা কটমট দৃষ্টিতে নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদও ইয়াশার চাহনি দেখে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। হালকা চাপ দিয়ে আধখোলা দরজাটা আঁটকে দিলো নওশাদ। এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও এবার ভীষণ পাচ্ছে ইয়াশা। যত যা-ই হোক মানুষটির সাথে স্বাভাবিক কোন সম্পর্ক নেই তার।তাই নিজে স্বাভাবিক থাকার প্রশ্নই আসেনা। ইয়াশা নওশাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” আপনি কেন এসেছেন বলুনতো?আমাকে
বিপদ ফেলতে?”
–” প্রথমতো পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন না।আমার দিকে তাকিয়ে বলুন?”
ইয়াশা ধূসর চোখজোড়া আলতো করে তুলে বলে,
–” দেখুন, কাল আপনি চলে যাবেন এখান থেকে। আপনার এখানে কোন কাজ নেই। আর যাওয়ার সময় ফোনটা আর বাকিসব জিনিসগুলোও নিয়ে যাবেন।”
নওশাদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।রাগকে
দমন করে শান্ত কন্ঠে বলে,
–” আমি এখন অসুস্থ। কাল যাওয়া অসম্ভব। আর আমি আপনার বিয়ে খেতে এসেছি। এমনি কোন পরিচয়ে আসতাম।এজন্যই তো এতসব করতে হলো।”
ইয়াশা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো নওশাদের দিকে। বিয়ে খাওয়ার জন্য এতসব কাহিনী করলো।অদ্ভুত তো।
ইয়াশা বলল,
–” আপনি অসুস্থ?ফাইজলামি করেন?বাবার সাথে তো দিব্যি পটরপটর কথা বলছেন।যেনো মুখে খৈ ফুটেছে।” এতটুক বলে ইয়াশা হঠাৎ থামলো,এরপর সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল,
–” এক মিনিট? বিয়ে খেতে এসেছেন মানে? আপনি আগে থেকে জানতেন আমার বিয়ের ব্যাপারে? কে বলেছে?”
নওশাদ সম্পূর্ণ কথাটা এড়িয়ে বলল,
–” উঁহু! আমি তো এসেছি বুঝাপড়া করতে। আপনার বাবাকে বলতে এসেছি, উনার শান্তশিষ্ট মেয়ে আমার সাথে এতদিন যাবৎ প্রেম করে শেষ পর্যন্ত বিবাহ করতে যাচ্ছে অন্যজনকে। এটা অপরাধ।গুরুতর অপরাধ। প্রমাণ চাইলে ফোনের মেসেজ দেখাতাম।আর ফাহিম তো আছেই।”
নওশাদের প্যাঁচালো কথায় ইয়াশা বাকহারা হয়ে যায়।সে প্রতিক্রিয়া করতে ভুলে যায়।কোনটাকে মূখ্যম কারণ হিসেবে ধরবে সে জায়গায় তালগোল হারিয়ে ফেলে ইয়াশা।নওশাদ যে তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ তথ্য জোগাড় করে এখানে পা রেখেছে বুঝতে বাকি রইলো না তার। ইয়াশা নিস্তব্ধ মুখে দরজা খুলে চলে যেতে চাইলো। নওশাদ আঁটকালো না। পেছন থেকে শুধু বলল,
— ” রাতে রুমে আসবেন কিন্তু কথা আছে। আমি অপেক্ষা করবো।”
ইয়াশা প্রতিউত্তর করলোনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তাই নওশাদ আবারও চাপা কন্ঠে বলে,
–” আমি ক্যারেক্টালেস নই। নির্ভয়ে আসতে পারেন।”
ইয়াশা চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।দরজার আঁটকানোর সময় নওশাদের চোখাচোখি হয়।নওশাদের শীতল চাহনি দেখে হৃদয়ের মধ্যে কেমন যেনো অনুভূত হলো তার।সম্পূর্ণ নতুম এই অনুভূতি। ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ইয়াশা দরজা আঁটকালো। নওশাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেও দরজা আঁটকালো।ফোনটা বের করে সময় দেখে নিলো।ওয়াসরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলো। ব্যাথার জায়গায় চিন চিন করে উঠলো।স্বইচ্ছায় মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আজই প্রথম তার। কপালের ক্ষতস্থানটা সত্যি হলেও মাথা বেয়ে ছুঁইয়ে পড়া রক্ত গুলো ছিলো কৃত্রিম।
সকালের রান্নাঘরে চা-নাস্তা বানাচ্ছিলেন মিনু আরা।ইয়াশা তখন ছাদে। ইয়াশার বাবা ঘুম থেকে উঠেনি। আর বাকিরা, ইয়াশার কাকিরা,সুমনা,তনয়া,আরিফা ওরা সকলে তখন ঘুমে আচ্ছন্ন।
সকালের সময়টা তখন নিরিবিলি। প্রশান্তিময়। মিনু আরার কাজে ব্যাঘাত ঘটলো শান্ত পুরুষালি কন্ঠে,
— ” আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন আছেন? এক কাপ চা হবে?
মিনু আরা পিলে চমকে উঠলেন।অকস্মাৎ সুদর্শন লম্বাটে যুবক দেখে উনি চরমভাবে ভয় পেয়ে যান।
ভয়ে আর্তনাদ করে উঠে,
–” আল্লাহ গো!’
তৎক্ষনাৎ শরীরে ভাড় ছেড়ে ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মিনু আরা। নওশাদ নিজেও এমন কাণ্ডে হকচকিয়ে যায়। মায়ের চিৎকার শুনে ইয়াশাও সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে লাগলো।নওশাদ মিনু আরার দিকে চেয়ে বললো,
–” আরে আন্টি ভয় পেতে গেলেন কেন? আমি তো আপনার মেয়ের উড-বি হাসবেন্ড।”
পায়ের শব্দ কর্ণগোচর হলে পেছন ফিরে তাকায় নওশাদ।ইয়াশার হালকা গোলাপি মশৃণ ফোলা গাল দেখে তার বুকের ভেতরে ঝড় উঠে গেলো হঠাৎ। ইয়াশা নওশাদকে দেখে ভ্রু-কুঁচকালো,
— “আপনি এখানে?”
নওশাদ কঠিন স্বরে বলে,
–” রাতে আপনাকে আসতে বলিনি? আসেননি কেন?আমি আপনার বাবাকে সব বলে দিবো। শুধু অপেক্ষা করুন।”
নওশাদ একটু থামলো। এরপর প্রসঙ্গ বদলে বলল,
–” আপনার মা বেহুশ হয়ে গেছে।হুস ফেরাতে হবে।”
ইয়াশা মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। দেখতে সত্যিই তার মা অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে।
ইয়াশা নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” তাকিয়ে আছেন কেন? হেল্প করুন।”
নওশাদ আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
–” আমার কোলে সর্বপ্রথম আমার বউ উঠবে।
বউয়ের- মা নয়।”
বলেই নওশাদ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালোনা। ইয়াশা হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে বোকার মতো চেয়ে থাকলো নওশাদের যাওয়ার পানে।
(চলবে)
‘অফুরন্ত প্রণয়’
#তারিন_জান্নাত
১২.
সকাল সকাল এমন একটা কাণ্ড ঘটবে জানলে ইউসুফ সাহেব আগেবাগেই উনার স্ত্রী মিনু আরা-কে সব জানিয়ে রাখতেন।উনার না জানানোর ফল এরূপ হতে পারে ধারণাও ছিলোনা।
মিনু আরা থমথমে মুখ নিয়ে একবার ইউসুফ সাহেব, আরেকবার ইয়াশার দিকে তাকালেন।সর্বশেষ নজর দিলেন নওশাদের দিকে।
মিনু আরা বললেন,
–‘ তুমি কিন্তু এখনো বলোনি ছেলেটা কে?”
ইউসুফ সাহেব গম্ভীর চোখে নওশাদের দিকে তাকালেন। নওশাদ সেটা লক্ষ করে হঠাৎ
কেশে উঠে বলে,
–” আন্টি আমি নওশাদ। ঢাকা থেকে এসেছি। আর ইউসুফ আঙ্কেল হচ্ছেন আমার বাবার বন্ধু।”
ইয়াশা কেমন করে যেনো তাকালো নওশাদের দিকে। নওশাদ নিজের নামটা সঠিক বলেছে।তাহলে কী পরিচয়টাও সঠিক? নাকি কোন ঠকবাজ আল্লাহ জানে।ইয়াশার নওশাদকে বিশ্বাস করতে মন চাইছেনা।নেহাৎ তার বাবা বুঝে যাবে তাই এতো নাটকীয় আচরণ করতে হচ্ছে তাকে।
মিনু নওশাদের কথা শুনে ইউসুফের দিকে তাকালো।
ইউসুফ সাহেব মাথা নাড়ালেন। মিনু আরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,বললেন,
–” বাড়িতে নতুন একজন মেহমান এসেছে অথচ তুমি আমাকে জানাচ্ছো এখন।”
মিনু নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” বাবা তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছেন?”
–” জ্বি আন্টি ভালে আছেন।”
–” কে কে আছে তোমার বাড়িতে?”
–” সবাই আছে আন্টি।
–” তোমরা কয় ভাই বোন?”
–” আমার একটা ছোটবোন আছে শুধু।’
মিনু আরা বিমোহিত হলেন নওশাদের কথায়। ব্যবহারে কী মিষ্টান্ন ভাব।ছেলে দেখতেও সুন্দর। এমন একটা ছেলে যদি নিজের মেয়ের জন্য পেতেন।অথচ মেয়ের হবু স্বামীর গায়ের রঙ চাপা।ইঞ্জিনিয়ার হলে কী হবে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
ইউসুফ সাহেব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
–‘ বাবা তোমার কী সব মনে পড়েছে?”
–” না তো।আমি তো আন্টি যাতে আপনাকে সন্দেহ না করে সেজন্যই এতসব বললাম।”
–” ওহ আচ্ছা।…কিন্তু আমাকে কেন সন্দেহ করবে?”
–” সেটাতো আমি বলতে পারবোনা আঙ্কেল। তবে আপনার চেহারায় কেমন আতঙ্কের চাপ ছিলো।”
ইয়াশা উল্টো দিকে ফিরে নিঃশব্দে হেসে দিলো।
ইউসুফ সাহেব গম্ভীর মুখে নিজের রুমে চলে গেলেন।আজ অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে উনাকে। ইয়াশা ও চলে যেতে পা বাড়ালো,
–” এ্যাই মেয়ে..”
নওশাদের কথা আঁটকে গেলো।মুখ দিয়ে আর শব্দ উচ্চারণ করলোনা। সুমনা,তনয়া,আরিফা এসে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়।চেহারায় এখনো ঘুমঘুম ভাব। ড্রয়িংরুম এমন সুদেহী সৌম্যদর্শনের ন্যায় যুবক দেখে হকচকিয়ে গেলো তারা।দু-চোখ কচলে পুনরায় তাকালো। না স্বপ্ন নয় বাস্তব।
নওশাদ ঘাড় বাঁকা করে তাকালো সুমনা,তনয়ার পেছনে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়ানো আরিফার দিকে।মিষ্টি হেসে সে এগিয়ে গেলো সেদিকে। ইয়াশা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
নওশাদ আরিফার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসলো। পকেট থেকে একটা ডেইরি-মিল্ক চকলেট বের করে আরিফার দিকে
বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“দিস ইজ ফর ইউ সুইটি।”
আরিফা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো একটু।
এরপর চকলেটটা নিয়ে নিলো।পরপরেই নওশাদ গলির ভেতরে দিয়ে চলে গেলো। সুমনা,আর তনয়া হা করে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। নওশাদ যেতেই সুমনা আরিফার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,
–” ছেলেটা কে? তোকে চকলেট দিলো কেন?”
আরিফা চকলেটে একটা চুমু খেয়ে বলল,
–” আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?নিজে গিয়েও তো জানতে পারে।”
চকলেটে চুমু খেতে দেখে সুমনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ইয়াশা আর তনয়া হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।সুমনা কন্ঠে কঠিন্যতা ঢেলে বলল,
–” এসব কী অসভ্যতামি? চকলেটে চুমু
খাচ্ছিস কেন?
আরিফা লজ্জামিশ্রিত হাসি হেসে বলে,
–” তোমাদের হবু বোন জামাই সে আপু।মানেটা এবার বুঝে নাও।”
আরিফা আর দাঁড়ালোনা চলে যেতে চাইলো,
তার আগে ইয়াশা এসে আরিফার হাত ধরে সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো,
–” কী ব্যাপার বলতো? তুই উনাকে আগে থেকে চিনিস?”
–” আগে থেকে চিনতে যাবো কেন? দেখোনি প্রথম দেখায় আমাকে চকলেট দিলো। নিশ্চয় আমাকে পছন্দ হয়েছে। দেখো আপু ছোট বোনের লাভ স্টোরিতে বাঁধা দিতে এসো না প্লিজ।”
আরিফা চলে গেলো।সুমনা আরিফার কথায় ফুঁসে উঠে। তনয়া নিরব দর্শকমাত্র। ইয়াশা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো,
বিড়বিড় কন্ঠে বলল,
–” আসতে না আসতে আমার বোনের মাথা
খারাপ করে দিয়েছে দেখছি লোকটা।”
সুমনা কি যেনো ভেবে নিজের পরনের কাপড়ের দিকে তাকালো।ইশ টার্কিশ কালারের সূতির জামাটা আজই পড়তে হলো তাকে। এজন্য হয়তো ছেলেটা তাকে পছন্দ করেনি। সুমনা চট করে কিছু একটা ভাবলো,এরপর ইয়াশার পাশে এসে বসে বলল,
–” ইয়াশা ছেলেটা কে?”
ইয়াশা মাথা থেকে হাত সরিয়ে সুমনার মুখের দিকে তাকালো।বুঝতে চাইলো সুমনার মাথাটাও খারাপ হয়নি তো। ইয়াশা শান্ত স্বরে বলল,
–” বাবার বন্ধুর ছেলে।”
–” ওহ!”
ইয়াশা রুমে প্রবেশ করতে যাবে তার আগেই একটা ফুটবল এসে তার মাথার সাথে ভারি খেলো। মাথায় হালকা ব্যাথাও পায় সে। পেছন ফিরলে দেখে নওশাদ ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইয়াশা বলটা হাতে নিলো। নওশাদ বলল,
–” খেলবেন? ফুটবল।”
ইয়াশা নাক ফুলিয়ে বলটা ছুঁড়ে মারলো নওশাদের দিকে।তার আগেই নওশাদ দরজা বন্ধ করে দিলো।
ডাইনিং টেবিলে সবাই বসলো নাস্তা করতে। ইউসুফ সাহেব নওশাদকে ডাকলেন। নওশাদ এসে ডাইনিং এ দাঁড়ালো। ইউসুফ সাহেব উনার দুই ভাই-বউয়ের সঙ্গে নওশাদের পরিচয় করালেন। নওশাদ কুশল বিনিময় করে আরিফার পাশে চেয়ারে বসলো।
মাথা তুলতেই দেখা মিলল অদ্ভুত দুই রমণীর,
নওশাদ মনে মনে বলল,
–” বলিউডের কারিসমা আর মাধুরী।”
নওশাদ ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে আরিফার ফ্লেটে ব্রেড তুলে দিলো।সকলেই স্বাভাবিক। ইউসুফ সাহেব সেসব মনে নিলেন না।আপাততে কোন জামেলা না হোক সেটায় কামনা। শেফালির চোখ ছানাবড়া ছেলেটাকে নিজের মেয়ের পাশে দেখে মনে মনে চক কসলেন একটা। সবাই কথা বলছে টুকটাক। কিন্তু ইয়াশা চুপ। নওশাদ আঁড়চোখে তাকায়না।খাওয়ার মাঝে সরাসরি চোখ তুলে ইয়াশার দিকে তাকাচ্ছে। ইয়াশা বুঝতেও পারছে।নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে আজ তার। না পারছে খেতে না পারছে নওশাদের দৃষ্টিতে লাগাম লাগাতে। কথার মাঝে নওশাদ বলে,
–” আঙ্কেল আপনি অফিসে যাবেন? আমিও যাবো আপনার সাথে।”
সবার নজর এবার নওশাদের উপর পড়লো।
ইউসুফ সাহেব বললেন,
–” কেন বাবা? এখানে সমস্যা হচ্ছে?”
–” না তবে এতজন লেডিস্ দের মধ্যে থাকতে বোর ফিল করবো।তাছাড়া কিছু কেনাকাটা
করতে চাইছি।”
–” আমি আজ দ্রুতই ফিরে আসবো।বিকেলের দিকে আমার শশুড় বাড়ির লোকজন আসছে কেনাকাটা করতে।তুমিও নাহয় সে সময় কিনে নিও।”নওশাদ আর প্রতিউত্তর করলোনা।শেফালির হঠাৎ করে বলে উঠে,
–” তোমার কপালে কী হয়েছে?
নওশাদ কপালের বেন্ডেজ-কৃত জায়গায়
হাত রেখে বলে,
–” কিছুনা আন্টি আসার সময় ছোট একটা আ্যকসিডেন্ট হয়েছিলো।”
দুপুর দেড়টার মধ্যে সকলের লাঞ্চ শেষ হয়। ইয়াশা নিজের রুমে বই পড়ছিলো। আজ আরিফা আসছনা দেখে ইয়াশা চিন্তায় পড়ে গেলো।অন্যসময় মেয়েটা ভাত খেয়েই এসে তার পাশে শুয়ে থাকতো। ইয়াশার মস্তিষ্ক চিন্তার পাহাড় গড়লো। আজ টিবির কোন সাউন্ড আসছেনা।ইয়াশা বই বন্ধ করে দ্রুত রুম থেকে বের হলো।ড্রয়িংরুমের লাইটও ওফ।ইয়াশা যাওয়ার আগে মুখোমুখি রুমটার দিকে একবার তাকালো।দরজা আঁটকানো। বাড়িটা কেমন যেনো নিস্তব্ধ ভূতুড়ে বাড়িতে রূপ নিয়েছে।কারো কোন সাড়াশব্দ নেই।ইয়াশা সব রুম চ্যাক করলো। বাকি থাকলো টিবির রুম।সেখানে গিয়েই ইয়াশা স্তব্ধ হয়ে যায়।চোখেমুখে অদম্য বিস্ময় এবং অনুসন্ধিৎসু..?
বাড়ির মহিলা-মেয়ে সদস্যগুলো প্রত্যেকে এক খাটে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। এতোগুলো রুম খালি অথচ তারা সবাই একবিছানায় ঘুমোচ্ছে।যেনো জন্মজন্মান্তর তারা কেউ ঘুমায়নি।ইয়াশা ভীষণ অবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা দুপুরে আরিফা বাদে কেউ ঘুমায়না।সকলের চোখ টিবিতে নিবদ্ধ থাকে। সে নিজেও ঘুমায় না। তবে আজকের এই ঘুমন্ত দৃশ্য কেমন যেনো রহস্যজনক লাগলো তার।ঘুমাচ্ছে ঠিক তাও আবার একি সময়ে?
তখনি কানের পাশ থেকে নওশাদ মৃদু
কন্ঠে বলে উঠে,
–” আরে বুঝতে পারছেন না তো কিছু? আসলে সবকটাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি।”
ইয়াশা মাথা ঘুরতে লাগলো হটাৎ। ধূসরচোখজোড়া অস্রুশিক্ত হয়। কম্পিত কন্ঠে ইয়াশা বলে,
–” কেন করছেন আপনি এসব? কী লাভ হচ্ছে? আমি-ই বা কী ক্ষতি করেছি আপনার?”
ইয়াশার অস্রুশিক্ত চোখ দেখে নওশাদে মস্তিষ্ক হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যায়। নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে তার। একসময় মস্তিষ্ক একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় তার। তীব্র ব্যাকুলতা কন্ঠে ঢেলে বলে,
–” আম স্যরি! আমি চেয়েছি আপনাকে অধিকার ছাড়া কখনো স্পর্শ করবোনা। আম স্যরি এগেইন।”
বলেই নওশাদ টিবির-রুমের দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে দিয়ে। এরপর ইয়াশার দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্তে কি হয়েছে টের পায়না ইয়াশা। নিজেকে নওশাদের উষ্ণ বাহুডোরে বন্দি আবিষ্কার করলো সে। নওশাদ ইয়াশাকে আষ্টেপৃষ্টে
জড়িয়ে রেখে বলে,
–” আমি সত্যিই চলে যাবো।আজকেই চলে যাবো। আপনি শুধু আপনার বাবাকে বলুন আপনি এ বিয়েতে রাজি নন। তাহলেই আমি চলে যাবো।”
ইয়াশা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। নওশাদের মুখের দিকে তাকালো।টকটকে লাল হয়ে আছে নওশাদের মুখ। ইয়াশার কিঞ্চিৎ অবাক হলো।
নিজেকে সামলে বলে,
–” এটা সম্ভব না। আর আমিও বিয়েতে রাজি।”
নওশাদ দাঁতের সাথে দাঁত চেপে কঠিন চোখে ইয়াশার দিকে তাকালো। পাশে দেওয়ালে হাত দ্বারা সজোরে আঘাত করে বলল,
–” ঠিক আমিও দেখছি এ বিয়ে কীভাবে হয়? সবচেয়ে বড় কথা আমার সাহস সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই। এবার দেখবেন নওশাদ কী করে? ”
নওশাদ সোজা ছাদে চলে যায়। ইয়াশা অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকলো তার যাওয়ার পানে। ইয়াশা নিজেও চায় বিয়েটা ভেঙে যাক। যেকোরেই হোক।তবে সেটা নিজের দ্বারা অসম্ভব।
(চলবে)