অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৩,৪
তারিন_জান্নাত
পর্ব-৩
নিস্তব্ধ অন্ধকারকে চাপিয়ে সূচনা হয় নতুন দিনের।চারিদিকে হালকা অন্ধকারচ্ছন্ন আমেজ। অর্থাৎ মিষ্টি স্নিগ্ধময় ভোর।এই সময়টা ছাদে আসলে শীত শীত অনুভূত হয়। মন ফুরফুরে হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দূর-দূরান্তে হতে ভেসে আসে পাখিদের কলরব। নিস্তব্ধ এই ভোরে শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়া ইয়াশার দৈনন্দিন কাজ। ভোরের সতেজতা চা পানের সাথে উপভোগ করে সে।
ইয়াশা ছাদে এসেছে অনুমানিক একঘন্টা হতে চলল বোধহয়। চায়ের কাপটা রেখে আবারও হাঁটায় মনোযোগ দিলো।গলায়, কপালে হাত রাখতেই টের পেলো সে ঘামছে। যার অর্থ তার শরীর ক্লান্ত হওয়া পথে। তবে তাকে থেমে গেলে চলবে না।
তার মায়ের কড়া আদেশ, রোজ সকালে একঘন্টা হাঁটতে হবে। মোটা শরীরটার যদি কোন গতি হয় তবেই মিনু আরা হাফ ছেড়ে বাঁচেবেন।
ঝুড়ি থেকে খরগোশ জোড়া বের করলো ইয়াশা। জন্মদিনে তার ভাইয়ের থেকে পাওয়া উপহার। ইয়াশার ভাই ইয়াসির বছর তিন এক আগে বিদেশ পারি দেয় পড়াশোনার জন্য।
খরগোশের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে নিচে নামলো ইয়াশা। দেওয়াল ঘড়িতে সময় সাতটা। সোফায় বিপরীতমুখী হয়ে বসা মহিলাকে দেখে এগিয়ে গেলো ইয়াশা। মহিলার চেহারা দেখে চিনতে পারলো। মহিলাটি তাদের প্রতিবেশি। মিনু আরা মেয়েকে
দেখে বললেন,
–” আম্মু তোমার আন্টির জন্য নাস্তা নিয়ে এসো।”
ইয়াশা ছোট করে হেসে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।
প্রতিবেশি মহিলা ইয়াসমিন ইয়াশার দিকে এক পলক চেয়ে মিষ্টি হেসে মিনুকে বললেন,
— ” ভাবি মেয়ে তো মাশা-আল্লাহ দেখতে ভালোই আপনার।তা বিয়ে-শাদির ব্যাপারে ভেবেছেন কিছু?”
মিনু মৃদু হেসে বললেন,
–” না ভাবি। এখন কিছু ভাবছিনা।মেয়ে পড়াশোনা করছে করুক।আমার বড় ছেলে দেশের বাইরে থেকে ফিরলে ভাববো।”
ইয়াসমিন কিছুসময়ের জন্য চুপ থাকলেন,
এরপর বললেন,
–” ভাবি আপনি যদি আপত্তি না করেন আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাচ্ছিলাম।”
–” জ্বি!”
–” আমার বাপের বাড়ি তো মুরাদপুর জনেন। বিশাল সম্পত্তি আমার বাপ-ভাইদের। আমার ভাইয়ের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, দেখতে শুনতে খুবই ভালো।বিবাহ উপযোগী।তো আমি চাইছি ইয়াশাকে আমার ভাইয়ের ঘরে নিয়ে যেতে।আপনার আর ভাইজানের আপত্তি না থাকলে দেখাদেখির ব্যাপারটার আয়োজন করতাম আর কী।” বলেই হাসলেন।
মিনু আরা কিছুসময় ইয়াসমিনের মুখপানে চেয়ে থাকলেন।মনে মনে বললেন এজন্যই সকাল সকাল বাসায় এসে উপস্থিত। এরপর মুখে বললেন,
–” ইয়াসিরের বাবা আসলে কথা
বলে দেখবো ভাবি।”
মিনু আরার কথার মাঝে ইয়াশা ট্রে ভর্তি নাস্তা এনে মাঝখানে সেন্ট্রাল টেবিলে রাখলো।এতক্ষণের কথোপকথনে ইয়াশার কর্ণগোচর হয়েছে।তাই সে এক মুহূর্তে না দাঁড়িয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়।ঠোঁটের কোণে শ্লেষাত্মক হাসি। এবারে সে আর কোন পাত্র পক্ষের সামনে যাবেনা। নিজের শরীরটাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছে। আগে গায়ে লাগলেও এখন শরীরের চামড়াটা মনে হয় গন্ডারের চামড়ায় রুপান্তরিত হয়েছে।কারো কোন বিদ্রুপও আর গায়ে লাগেনা তার।
মাথায় আঘাত লাগতেই রেগে পেছনে তাকালো ইয়াশা। ফাহিম হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশা চেহারায় ল্যাপ্টে থাকা ক্রোধ সরিয়ে মৃদু হাসলো।
ফাহিম বলল,
— “কিরে ময়নাপাখি! মুখটা এমন করে
রেখেছিলি কেন?”
ইয়াশা ছোট করে বলল,
–” কিছুনা,এমনি।”
ফাহিম ইয়াশার বিছানায় বসতে বসতে বলল,
— ” আমার বাপের বউ তোরে যাইতে বলছে।”
ইয়াশা ফিক করে হেসে দিলো,বলল,
–” অনেক ভালো চাকরি পেয়েছিস তো।”
–” হুহ! ভালো চাকরি? এরচেয়ে দারোয়ানগিরি অনেক ভালো।”
ইয়াশা স্বশব্দে হেসে বলল,
— ” ছিঃ এটা তোর সাথে যায়? তোর সাথে তো যাবে মেথরগিরি। একদম পার্ফেক্ট।”
ফাহিম নাক ফুলিয়ে তাকায় ইয়াশার দিকে।ইয়াশা হাসতে হাসতে তার মায়ের কাছে চলে যায়। ফাহিম ইয়াশাকে হাসতে দেখে নিজেও হাসলো। এরপর পকেট থেকে কাগজের টুকরাটা ইয়াশার বইয়ের ভাঁজে রেখে দিলো।
মায়ের থেকে অনুমতি নিলো ইয়াশা। তার ফুফির বাড়ি যাওয়ার জন্য। ফাহিম হচ্ছে ইয়াশার ফুফাতো ভাই।
ইয়াশা মিল্ক পুডিং এর প্লেটটা ফাহিমের হাতে দিলো।
–” এই নে পুডিং খা।আর এখান থেকে যা।”
ফাহিম নিঃশব্দে চলে গেলো। দুজনে সময়বয়সী। ফাহিম ইয়াশার সাতদিনের বড়। দু’জনে একি কলেজে পড়াশোনা করে।
ইয়াশার ফুফির বাড়ি পায়ে হেঁটে যেতে আধঘন্টা মতো সময় লাগে। বলতে গেলে ফাহিমদের বাড়ি কাছাকাছি-ই। ইয়াশা ফাহিমে জিজ্ঞেস করলো,
–” কয়টা বাজে?”
— “আটটা উনিশ।”
একটু থেমে ফাহিম বলল,
— “এ তুই ফোন নিবি কবে রে? আজকালকার জামানায় একটা পোলা-মাইয়াও নাই ফোন চালায় না।আর তুই সেই পড়ে আছিস নব্বই শতকের যুগে।”
ইয়াশা ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিলো,
–” বাবা একবার কিনে দিতে চেয়েছিলো। আমি না করেছিলাম তাই আর কখনো বলেনি। হয়তো মন থেকে দিতে চায় না বাবা। নাহলে আমাকে ফোনের প্রয়োজনীয়বোধটা বুঝাতে পারতো। তাই নয় কী?আর আমিও প্রয়োজনবোধ করছি না”
ইয়াশা ম্লান হাসলো। রাস্তা বলতে গেলে একদম নিরিবিলি। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা চলাচল করতে দেখা যায়। তার মাঝেই ঘটলো এক অন্য রকম ঘটনা। কালো রঙের টি-শার্ট পরিহিতা এক যুবক এসে দাঁড়ালো ইয়াশা আর ফাহিমে সামনে। ইয়াশা ভ্রু কুঁচকে পিছিয়ে যায়। ফাহিম তাকালো ইয়াশার দিকে। দুজনে চোখাচোখি হয়।চেহারায় হতবিহ্বলের চাপ। কালো মাস্কের আড়ালে যুবকটি ইয়াশার চোখের দিকে চেয়ে হাসলো। ফাহিমকে আপাদমস্তক চেয়ে যুবকটি বলল,
–” আমরা কী একান্তে কথা বলতে পারি?”
ফাহিম ইয়াশাকে একচোট দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগে ইয়াশা বলল,
–” ফাহিম আমার কারো সাথে একান্ত কোন কথা নেই।…চল।”
ইয়াশা চলে যেতে চাইলো। যুবকটি তা দেখে ক্ষীণ হাসলো। চারপাশে তাকিয়ে বলল,
–” ইয়াশা! আমি অধিকারবিহীন কোন নারীকে স্পর্শ করিনা। আশা রাখবো আপনি আমার কথাটা শুনবেন। আর নয়তো অনাধিকার চর্চা হয়ে যাবে কিন্তু।”
ফাহিন তাড়া দিয়ে বলল,
— ” উনি কি বলতে চাচ্ছেন শুনে আয় তো।”
ইয়াশা ফাহিমের কথাটা শুনলোনা। ধূসর চোখজোড়ায় বিস্ময়ের চাপ। তার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তাহলে এই যুকটিকেই সে গতকাল আঘাত করেছিলো। ইয়াশার এবার ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো। অচেনা মানুষটা কী চায় সেটা বোধগম্য হচ্ছেনা তার। ফাহিম খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। নওশাদ ইয়াশার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। ইয়াশা নির্নিমেষ চেয়ে থাকলো অচেনা যুবকটির দিকে।
ইয়াশার ধূসর চোখে চোখ রেখে নওশাদ বলল,
–” আপনি অবুঝ নন। এতক্ষণে ধারণা করতে পেরেছেন হয়তো আমি কে? তবে আমার অভিসন্ধি ঠিক কী সেটা বুঝতে পারছেন না? তাই তো?
ইয়াশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।নওশাদ চোখে হাসলো। বলল,
–” পার্পেল কালারটায় আপনাকে অসাধারণ লাগছে।”
ইয়াশা আবারও চমকালো যুবকটির কথায়।নওশাদ কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
–” কালকে আঘাতটা আপনি কোথায় করেছেন জানেন? সোজা হৃদপিণ্ডে।”
নওশাদ হাতে থাকা মাঝারি আকারের রেপিং পেপার মুড়ানো বাক্সটি ইয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ইয়াশা যন্ত্র মানবীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। ভাবভঙ্গি এমন যে সে অচেনা যুবকটির কাছ থেকে জিনিসটি নিতে চাচ্ছে না। নওশাদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ো ইয়াশাকে বলল,
–” মানুষজন চেয়ে আছে। এটা রাখুন। রাতে খুলবেন তার আগে নয়।”
ইয়াশা অদ্ভুত বোকামিটা করে ফেললো। হাত বাড়িয়ে বাক্সটি নিয়ে নিলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য ইয়াশা থমকে গেলো। বাক্সটি হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকালো। অচেনা যুবকটি চলে যাচ্ছে। রেখে যায় একজোড়া ধূসর প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি।
নওশাদ যেতেই ফাহিম এগিয়ে এসে বলল,
— ” ছেলেটা কে? কী বলল তোকে? হাতে এটা কী?
ফাহিম নিতে চাইলে ইয়াশা বাক্সটা দ্রুত ব্যাগে রেখে দিয়ে বলল,
–” বাসায় চল সব বলছি।”
ইয়াশার মনটা কেমন যেনো করছে। বুঝতে পারছেনা কী হচ্ছে? মানুষটা কে হতে পারে সেটা জানার কৌতূহল হলো খুব। সবশেষে আক্ষেপ এসে মনে ভীড় করলো। অচেনা যুবকটির মুখটায় তো দেখা হলো না তার।
(চলবে)
‘অফুরন্ত প্রণয়’
#তারিন_জান্নাত
৪.
বিকেলের রোদমিশ্রিত প্রহর।মিষ্টি মিষ্টি রোদ শরীরে মাখাতে বেশ ভালো লাগছে ইয়াশার। আজ আর তার বাসায় ফেরা হলোনা। একমাত্র ফুফির অনুরোধ রাখতেই হলো তাকে।ইয়াশার ফুফি সাহেদা খানম ভীষণ ভালোবাসে ইয়াশাকে। উনার অন্যান্য ভাতিজা-ভাতিজীর চেয়ে ইয়াশাকে আলাদা চোখে দেখেন। ইয়াশা একমনে চেয়ে আছে দূর প্রান্তে।ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে সাহেদা ইয়াশার মুখপানে চেয়ে থাকলেন কিছু মুহূর্ত। একদম উনার মায়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে ইয়াশার মুখে। সাহেদা এগিয়ে এসে ইয়াশার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
–” আম্মাজান, এই নে তোর প্রিয় পোস্ত বাদাম ফ্লেবারের আইসক্রিম। ফাহিমকে দিয়ে আনিয়েছি।
ইয়াশা আইসক্রিমের বাটিটা হাতে নিলো।
–“ফুফি ফাহিম কোথায় দেখছিনা যে।”
-” ঘুমোচ্ছে।এতো করে ডাকলাম দুপুরে খাওয়ার জন্য উঠেনি।এখনও শুয়ে আছে হয়তো। মাঝেমাঝে ছেলেটার কী যে হয় আল্লাহ জানে।”
–” হয়তো শরীর খারাপ।”
–” আচ্ছা তুই থাক আর কিছুক্ষণ।সন্ধ্যার আজানের আগে নেমে যাবি কিন্তু।”
ইয়াশা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। সাহেদা খানম চলে যান নিচে। ইয়াশা আইসক্রিম খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো।একটু পর ফাহিম উঠে ছাদে আসলো। গটগট পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ইয়াশা। ফাহিম হেঁটে তার দিকে আসছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে।ইয়াশা ভ্রু কুঁচকালো।ফাহিম কাছাকাছি আসতেই ইয়াশা তার কপালের হাত রেখে বলল,
–” কি রে চোখমুখের এই অবস্থা কেন? জ্বর তো আসেনি।”
ফাহিম ইয়াশার হাতটা সরিয়ে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
— “গায়ে হাত দিবি না আমার।”
ইয়াশা কিটকিটিয়ে হেসে বলল,
–” ঠিক আছে ঠিক আছে।”
–” ছেলেটা কে বললি না যে?তোর সব কথা এই পর্যন্ত আমার সাথে শেয়ার করেছিস।তাহলে এ ব্যাপারে বলছিস না কেন? কী লুকাচ্ছিস?”
ইয়াশা কন্ঠে একরাশ বিরক্তি ঢেলে বলল,
–” উফ! বলেছি তো চিনি না। তার উপর ওই লোকটার চেহারাও দেখিনি।আর আজই প্রথম সাক্ষাৎ। ”
ফাহিম শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলল,
–” চমৎকার! তুই বলছিস চিনিস না।আর ওই ছেলেটা প্রথম সাক্ষাতে তোকে একটা গিপ্ট বক্স ধরিয়ে দিলো। আর তুই? না চিনলে ছেলেটার জিনিস নিলি কেন? ছুঁড়ে ফেলতে পারিস নি?”
ইয়াশা করুনচোখে চেয়ে বলল,
–” লোকটার কথাবার্তা নাছোড়বান্দা টাইপ।আমি নিতে না চাইলেও উনি হয়তো জোর করে দিতেন। তাই সময় নষ্ট না করে নিয়ে নিলাম।”
— “আচ্ছা মানলাম,এখন দে বক্সটা আমাকে দে।”
ইয়াশা ভাবলেশহীন গলায় বলল,
–” ব্যাগে আছে যা নিয়ে নে।”
ফাহিম সময় নষ্ট না করে ছুটে চলল ইয়াশার ব্যাগ থেকে বাক্সটি নেওয়ার উদ্দেশ্য। ফাহিমের যাওয়ার পানে চেয়ে ইয়াশা হাসলো। এরপর নিচে তাকাতেই হঠাৎ কেঁপে উঠলো ইয়াশা।ঠোঁটের হাসিটা নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়। ব্ল্যাক মার্সিডিস কারের দরজাটা মেলে দিয়ে বসে আছে নওশাদ। ইয়াশা চোখ সরালোনা। নওশাদের চোখজোড়া উন্মুক্ত। বাকিসব ঢেকে রেখেছে। ইয়াশার মনে ইচ্ছে জাগলো নিচে গিয়ে সরাসরি লোকটির চেহারা দেখার।সুযোগ থাকা সত্বেও সে এমন করবেনা।
ফাহিমদের বাড়িটা একটা স্কুলের মাঠের পেরিয়ে।মাঠের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে এসে বেশ খোলামেলা জায়গায় তাদের বাড়িটি।এইদিকে কোন বাড়িঘর নেই ফলে নওশাদকে কেউ সন্দেহ করবেনা। একটু পর নওশাদ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।গাড়ির দরজাটা আঁটকালো। ইয়াশা কৌতূহলী চাহনি নিবদ্ধ রাখলো অচেনা যুবকটির উপর। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সুদেহী,সুদীর্ঘ সৌম্যদর্শনের ন্যায় সুদর্শন যুবকটিকে। শরীরের গঠনটা চোখ বিঁধছে ইয়াশার। প্রশস্ত বুকটা সাদা-কালো শার্টের আঁড়ালে ঢেকে আছে। ইয়াশা কেমন যেন মোহে পড়ে যাচ্ছে।সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই উপলব্ধি করছে।
নওশাদ আশেপাশে ভালোভাবে দৃষ্টি বুলালো। এরপর পেছনের সিটের দরজাটা খুলল। এরপর সরাসরি আবারও ইয়াশার দিকে তাকালো। এইবারে ইয়াশা তব্দা খেয়ে চোখ সরালো। নিজেকে নির্লজ্জ উপাধি করতে মন চাইলো তার। কিন্তু এ মুহূর্তে সে নিজেকে সংযত রাখতে পারছেনা। এরপর পুনরায় দৃষ্টি রাখলেই সে খেয়াল করে পাঁচ-ছয় জন মতো ছেলেমেয়ে এদিকে আসছে। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই নওশাদ বিশটির মতো লাভ শেইফের সাদা,হালকা গোলাপি,লাল,এবং আকাশি রঙের বেলুন বের করলো। ইয়াশা কিংকর্ত্যবিমূঢ় দৃষ্টিপাত করলো। বেলুনের উপর ইয়াশার বিশেষ ঝোঁক আছে ছোটবেলা থেকে।কিন্তু মানুষটা কীভাবে জানলো?
নওশাদ ছেলেমেয়েগুলো কিছু বলল। বাচ্চাগুলো হঠাৎ আমোদিত হয়ে বেলুনগুলো একত্রে নিয়ে ইয়াশার কাছাকাছি এগিয়ে এসে সব উড়িয়ে দিলো। একসঙ্গে এতগুলো বেলুন উড়তে দেখে ইয়াশা নিজেকে আঁটকাতে পারলোনা। আচমকা হেসে উঠলো সে। নিষ্পাপ,স্নিগ্ধ,আর মুগ্ধময় হাসি। নওশাদ চেয়ে থাকলো বিড়ালচোখীর ফোলা ফোলা গালের মাঝখানে পাতলা,সরু অধরের হাসি। একদম গুলুমলু। নওশাদ মনে মনে আওড়ালো,
–” আমার দেখা সবচেয়ে সেরা সুন্দরী তুমি। গুলুমলু সুন্দরী।”
এক পর্যায়ে ইয়াশা বেলুনের উপর ইংরেজী শব্দের কয়েকটা লেখা দেখতে পেলো। সব শব্দ একত্রে মিলিয়ে পড়লো,
–” আই ইউল মিস ইউ!”
এটাও পড়ে হাসলো। বেলুনগুলো একসয়ম উড়তে উড়তে গন্তব্যহীন হয়ে গেলো। হাসিমাখা ঠোঁট নিয়ে নিচে তাকালো সে। হঠাৎ সবকিছু শূন্য দেখলো সে। না আছে বাচ্চাগুলো,আর না আছে সেই গাড়িটি। আর…? সে অচেনা যুবকটি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সবাই উধাও। যেনো এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিলো,কল্পানার জালে আবদ্ধ ছিলো।আকাশপানে তাকালো আবাও। দুয়েকটা বেলুন এখনো উড়ছে,বাকিগুলো নিশ্চিন্হ।
ইয়াশা ছাদ থেকে নেমে গেলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো টিবি চলছে। তবে কেউ নেই। বাড়ি একদম নিস্তব্ধ। কিচেনে গিয়ে ফুফিকে খুঁজলো। ওয়াসরুমের দরজার শব্দ আসতেই সেদিকে তাকালো ইয়াশা।ফাহিম মাত্র গোসল সেরে বের হচ্ছিলো। ইয়াশা জিজ্ঞেস করলো,
–” ফুফিকে দেখেছিস?”
–” মা নেই বাজারে গিয়েছে মনে হয়।”
ইয়াশা হঠাৎ কিছু ভাবলো।এরপর বলল,
–” বাক্স পেয়েছিস?কী ছিলো সেটাতে?”
–” ধূর! ছেলেটা বোধহয় পাগল,নইলে সাইন্স ফিকশন বই কেউ উপহার দেয়? বিশেষ করে মেয়েদের। বইটা আমার কাছেই থাক…।”
ইয়াশা ক্ষীণ হাসলো,মাথাটা কাথ করে ফাহিমের কথায় সায় দিলো।
তাউসিফ-নুসরাতের রিসেপশনে ছিলো আজ। সেই রিসোর্টেই। ইমরোজ,সায়ন বহুক্ষণ ধরে নওশাদকে খুঁজছে। ফোন দিয়ছিলো ইতিমধ্যে কয়েকবার।ফোন আন-রিচিভল। এদিকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তারা ঢাকায় ফিরে যাবে। বিদায় জানাবে কক্সবাজারকে।আরো কয়েকদিন থাকার প্ল্যান ছিলো তাদের। কিন্তু নওশাদের বাবার দরকারি তলব। তাই আজ ফিরতে হচ্ছে। তবে সুযোগসন্ধানী থাকবে তারা।সময় ফেলে ছুটে আসবে। অবশ্যই নওশাদ সে স্কোপটা রেখেই যাচ্ছে। যাতে আসতে হয়।
নওশাদকে আসতে দেখেই ইমরোজ কান থেকে ফোন নামালো। সায়ন নওশাদকে দেখে হালকা কেশে বলল,
— ” কিরে প্রেমিকপুরুষ ‘রহিম মিয়া’ কোথায় ছিলি এতক্ষণ। ”
নওশাদ প্রতিউত্তর করলোনা।সায়নের মাথায় জোরে একটা চাটি দিলো। সায়ন মাথায় ঘষতে ঘষতে বলল,
–” ধূর! বিছানায় হিসু কইরা দিমু আবার।”
নওশাদ, ইমরোজ স্বশব্দে হেসে উঠলো।
(চলবে)