অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-১
তারিন_জান্নাত
খাওয়া-দাওয়ার শেষ পর্যায়ে নওশাদের চোখ যায় মুখোমুখি টেবিলে বসা একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিলো। চোখের পলক ফেলে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো সে।আরেকটুর জন্য ধরা পরে যায়নি।
— “কী মামা ওইদিকে কী দেখস?”
সায়নের কথায় নওশাদ তার স্বভাব মতো দৃষ্টি স্থির করে বলল,
— “কী দেখছি?”
— “আমি কী জানি? তুই তো তাকায় ছিলি।”
বলেই সায়ন পেছনে তাকালো। সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পড়েনি। তাই সে পুনরায় খাওয়া মনোযোগ দিলো। নওশাদের দৃষ্টি হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো। মনটা আকুপাকু করতে লাগলো মেয়েটির দিকে তাকাতে। কী আদুরে মুখ বিড়ালচোখী মেয়েটির।
–” ওই আলুর বস্তা এখনো খাওয়া হয়নি? জলদি খা।”
মোটা একটা মেয়েলি কন্ঠ কানে আসতেই ক্রুর দৃষ্টিসমেত পাশে তাঁকালো নওশাদ। মেয়েটিকে দেখে চোখ কুঁচকে ফেললো সে। ততক্ষণে সায়নও মেয়েটির দিকে তাকালো।
— ” আলুর বস্তা কাকে বললো রে?”
নওশাদ নির্বিকার কন্ঠে বলল,
— জানিনা।
ফোন আসায় সায়ন উঠে একপাশে চলে গেলো। এবার নওশাদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। পুনরায় দৃষ্টি রাখলো মুখোমুখি বসা মেয়েটির দিকে। মোটাসোটা আদুরে মেয়েটিকেই আলুর বস্তা বলেছিলো তখন। নওশাদের রাগ হয় অনেক। মেয়েটি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষণ সে একাই খাচ্ছিলো।বান্ধবীরা তাকে রেখেই উঠে পড়েছিলো।মেয়েটি নিচু হয়ে টেবিলের নিচে ডুকলো। নওশাদ ভীষণ অবাক হয়। সঙ্গে কৌতূহল। আজ প্রথম কারো প্রতি এতো কৌতূহল জাগলো তার।তাও আবার একটা মেয়ের প্রতি। একটু পর মেয়েটি নিজের জুতা জোড়া বের করে ঘাসের উপর রাখলো।হালকা পেস্ট কালারের গাউনটা একটু উপরে তুলে জুতাজোড়া পায়ে পড়ে নিলো। নওশাদ বেশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়েটির কার্যকলাপ লক্ষ করলো।
মেয়েটি এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
–” আমার খাওয়া দেখলে তোর হিংসে হয় জানি। কিন্তু এতোটা হিংসে হয় জানতাম না।”
মিতুল চাপা গর্জন তুলে বলল,
–” কী বলতে চাইছিস?”
ইয়াশা ক্রুর হেসে মিতুলকে পাশ কাটিয়ে রিসোর্টের দিকে এগুলো।অবশ্যই যাওয়ার সময় মিতুলকে ধাক্কা দিতে ভুললো না। মিতুল রেগেমেগে ইয়াশার দিকে তাকালো। কোন এক অদ্ভুত কারণে সে ইয়াশাকে সহ্য করতে পারেনা।নওশাদ শুধু শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। মিতুলের ধাক্কাটায় নওশাদের হুস ফিরলো যেনো। নওশাদ উঠে দাঁড়িয়ে ভাবলো ইয়াশার পিছু যাবে। কিন্তু সায়ন এসে তাতে ব্যাঘাত ঘটালো।
— “ওইদিকে কই যাস,চল ইমরোজ ডাকছে।”
নওশাদ গলা ঝেড়ে বলল,
–” তুই যা আমি আসছি।একটা কাজ আছে।”
— ” কী কাজ চল আমিও যাবো।”
–” না না,তুই যা আমি এখনি চলে আসবো।”
নওশাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করলো। রিসোর্টের ভেতরে মেহমান ভর্তি। স্টেজে বর-কনে ফটোশুটে ব্যস্ত। নওশাদ তার লম্বাটে শরীর নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলালো। ডানহাত মুঠোবন্দি করে তীক্ষ্ণ চোখে আরেকবার আশেপাশে চেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠলো।দ্বিতীয় তলায়ও মেহমান। তবে যাকে খুঁজতে এলো তার হদিস পেলো না সে। নামার সময় মিতুলের মুখোমুখি হলো। মিতুল একপাশে দাঁড়িয়ে হা করে নওশাদের দিকে চেয়ে থাকলো।না তাকিয়ে নওশাদ বুঝতে পারলো মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। নওশাদের রাগটা নিমিষেই দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।নিচে নামতেই সায়ন আর ইমরোজ দুজনের মুখোমুখি হলো। ইমরোজ নওশাদকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–” কিরে এতো অস্থির লাগছে কেন তোকে?”
নওশাদ এবার চোখমুখ করুন করে বলল,
–” দোস্ত একটা মেয়েকে খুঁজছি, পাচ্ছিনা কিছুতেই।”
সায়ন আর ইমরোজ দুজনে চমকে উঠলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নওশাদের দিকে তাকালো। হঠাৎ দুজনেই ফিক করে হেসে উঠলো। সায়ন মজার ছলে বলল,
–” দোস্ত! তুই আর মেয়ে? আরে এটা তো আমাকে চড় মেরে বললেও আমি বিশ্বাস করবোনা।যে তুই কোন মেয়েকে খুঁজছিস।”
সায়নের বলতে দেরী চড় পড়তে দেরী হয়নি। নওশাদের হাতের চড় খেয়ে সে অবাক হয়ে গেলো।
নওশাদ তীব্র কন্ঠে বলল,
— ” মেরেছি চড়, এবার বিশ্বাস হচ্ছে?”
নওশাদ এক মুহূর্তে না দাঁড়িয়ে রিসোর্টের বাইরে চলে আসলো। সায়ন আর ইমরোজ বোকার মতো চেয়ে থাকলো শুধু। পরে বুঝলো অবস্থা নিশ্চয় বেগতিক।নাহলে তাদের শান্তশিষ্ট বন্ধু হঠাৎ এতোটা ডেস্পারেট হয়ে যেতো না।
নওশাদ বাইরে এসে চারপাশে তাকালো।তারপর পার্কিং এড়িয়াই এসে গাড়ির দরজাটা খুলে ভেতরে বসে পড়লো। নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল,
–” আশ্চর্য! আমি এতো অস্থির হচ্ছি কেন?
‘ইজ ইট লাভ এট ফার্স্ট সাইট’ ও মাই গড!” বলেই নিজের মাথায় হাত রাখলো নওশাদ।
ইয়াশা নিচ তলায় এসে রিদিতাকে ডাকলো। রিদিতা হচ্ছে ইয়াশার ঘনিষ্ঠ বন্ধবী।আর মিতুল হচ্ছে রিদিতার ফুফাতো বোন। সে সুবাদে ইয়াশার সাথে মিতুলের পরিচয়। ইয়াশা এসেছে রিদিতার বড় বোন নুসরাত এর বিয়েতে। নুসরাতের শশুড় বাড়ি সিলেটে। নুসরাতের বর তাউসিফ। আর তাউসিফের বন্ধু হচ্ছে নওশাদ,সায়ন,ইমরোজ। নওশাদ,সায়ন,ইমরোজ তিনজনে ঢাকায় থাকে।আর তাউসিফ বর্তমানে সিলেটে তার পারিবারিক ব্যাবসা সামলায়। পড়াশোনার সূত্র ধরেই তাদের পরিচয়।
রিদিতা এগিয়ে এসে ইয়াশাকে বলল,
–” কি রে ডাকছিস যে?”
–” রিদি আমাকে বাসায় যেতে হবে। অলরেডি দশটা বাজে।বাবা জানেনা আমি বিয়েতে এসেছি।তাই বাবা আসার আগে আমাকে চলে যেতে হবে।”
রিদির চোখেমুখে হঠাৎ চিন্তার চাপ দেখা গেলো।
সে বলল,
–” স্যরি রে আমার খেয়াল ছিলোনা তোর বিষয়টা।ঠিক আছে চল আমি তোকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছি।দাঁড়া তুই।”
রিদি আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো।স্টেজের সামনে ক্যামেরা হাতে দাঁড়ানো তায়েফকে দেখে রিদি ডাকলো। তায়েফ এগিয়ে এসে ইয়াশার দিকে এক নজর তাকিয়ে রিদিকে বলল,
–” কী?”
— “ভাইয়া,ইয়াশাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিবি?
দেরী হলে আঙ্কেল রাগ করবে।”
তায়েফ বলল,
–” ঠিক আছে,এসো ইয়াশা।”
তায়েফ ক্যামেরাটা রিদিতার হাতে দিয়ে বলল,
–” ক্যামেরাটা সামলে রাখিস।কাউকে দিবিনা।”
রিদিতা হেসে মাথা নাড়লো। তার ভাই ক্যামেরাটাকে যতটা ভালোবাসে ততটা হয়তো অন্যকেউ ভালোবাসবেনা।
সায়ন আর ইমরোজ পার্কিং লটে এসে নওশাদকে খোঁজে পেলো৷ নওশাদ ড্রাইভিং সিটে চুপচাপ বসে আছে। সায়ন আর ইমরোজ এসে পেছনের সিটে বাসলো।তিনজনে চুপচাপ বসে রইলো।সায়ন একটু পর পর ইমরোজকে ইশারায় কিছু বলছে।ইমরোজ মৃদু মৃদু হেসে নওশাদকে দেখছে। একটু পর হঠাৎ নওশাদ নড়েচড়ে বসলো। দৃষ্টি সামনে দাঁড়ানো বিড়ালচোখী মেয়েটির দিকে। সায়ন আর ইমরোজ ব্যাপারটা খেয়াল করলো। সায়ন তার স্বভাব মতো আচমকা গেয়ে উঠলো,
” আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম,
“মন তো আর সহে না…
ইমরোজ চাপা হাসলো। নওশাদ শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়লো সায়নের দিকে।যার অর্থ ‘দেখে নিবো তোকে’
ইমরোজ গলা ঝেড়ে বলল,
–” দোস্ত! আই থ্যিংক সামনের ওই মোটা মেয়েটাকে তুই খুঁজছিলি।”
সায়ন ফিচেল হেসে বলল,
–” তারমানে এই মেয়েকেই আলুর ব..”
নওশাদের চোখ রাঙানোতে সায়ন চুপ মারে। নওশাদ সামনের দিকে তাকিয়ে ইমরোজকে বলল,
— ” ইমরোজ, সি ইজ টু মাচ কিউট।”
ইমরোজ মিটিমিটি হেসে বলল,
–” প্রেমে পড়েছিস?
–” জানিনা,তবে মেয়েটাকে দেখতে ভালোই লাগছে।”
সায়ন ফোঁড়ন কেটে বলল,
–” তাহলে এতো অস্থির হইয়া কাজ নাই মামা।মাইয়া চলে যাচ্ছে। এখন রিসোর্টে চল। তাউসিফ নিশ্চয় আমাদের খুঁজছে।”
সায়নের কথায় নওশাদ হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তায়েফ ইয়াশাকে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।ভয়ে বুক কাঁপছে ইয়াশার। তার বাবা যদি বাসায় থাকে আজ। যদি জানতে পারে সে বিয়েতে এসেছে তাহলে হয়তো বাড়ির বাইরে আর পা ও রাখতে দিবেনা।তায়েফ ইয়াশার দিকে এক পলক চেয়ে আবারও গাড়ি চালানোতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
মাঝরাস্তায় ইয়াশা নেমে গেলো। বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি করে যাওয়া অসম্ভব। তার উপর তার বাবা যদি দেখে ফেলে। ইয়াশা নামতেই তায়েফ গাড়িয়ে ঘুরিয়ে চলে যায়। ইয়াশাকে একা নামতে দেখে নওশাদ বিচলিত কন্ঠে সায়নকে বলল,
–” তোরা গাড়িতে থাক।আমি আসছি।”
সায়ন বলল,
–” প্রেমে পরস নাই,আবার মাইয়াটার জন্য হঠাৎ উতলা হয়েও পড়েছিস।এসব কী মামা?হঠাৎ এক দেখায় কখনো প্রেম হয়? এটাও কী সম্ভব?
পাশ থেকে ইমরোজ সরল গলায় বলল,
–“সম্ভব।”
ইমরোজের দৃষ্টিপটে কাঙ্ক্ষিত মিষ্টি মুখশ্রী ভেসে উঠলো। নওশাদকে বলল,
–” তুই যা।আমরা আছি।
আর আমাদের ভাবীর সব তথ্য জোগাড় করে তবেই ফিরবি। নওশাদ হাসলো ছোটকরে। নিঃশব্দে পা ফেলে এগোতে লাগলো ইয়াশার পিছু।
(চলবে ?)
আসসালামু আলাইকুম!