অদ্ভুত_নেশা,পর্ব_০৯
আদির_রায়
১৯.
অপারেশনের পর ছোঁয়ার জ্ঞান ফিরার কোন কন্ডিশন দেখা যাচ্ছে না৷ ডাক্তার বলে দিয়েছে এক ঘন্টার মাঝে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাবে৷
সবাই ছোঁয়ার কেবিনে পায়েচারী করছে৷ সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছাঁপ। সকলে ঘেমে একাকার। এত কিছু হয়ে যাচ্ছে তপেসের কোন খোঁজ নেই৷ সিদ্ধার্থ অনেক বার তপেসকে ফোন করেছে। কিন্তু তপেস ফোন তুলে নি।
ছোঁয়ার মা কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফুরিয়ে ফেলছে৷ ছোঁয়ার মায়ের দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ তার এক মাত্র মেয়ে তারই চোখের সামনে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে৷ ময়ের মন বলে মেয়েকে রেখে তাকে যেন ভগবান নিয়ে যায়৷ এজন্য পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না৷
— আমার মেয়ের কখন জ্ঞান ফিরবে ডাক্তার? ছোঁয়ার বাবা ক্ষেপে উঁচু গলায় বলে ডাক্তারকে৷
— দেখেন আমরা ডাক্তার। মানুষের জীবন বাঁচানো আমাদের কাজ৷ ভগবানের উপর আস্থা রাখেন ছোঁয়ার কিছু হবে না৷
— আপনি বলে দিয়েছেন এক ঘন্টার মাঝে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাবে৷ আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখেন মেয়ের শোকে কেমন পাথর হয়ে গেছে৷ অচল পয়সার মতো দাঁড়িয়ে আছে৷
— দেখেন এখন আমাদের হাতে ১০ মিনিট সময় আছে৷ প্লিজ আপনারা এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আস্থা রাখেন৷
— আর কত আস্থা রাখবো৷ ছোঁয়ার ২ দিন থেকে কোন রেসপন্স নেই৷ প্লিজ ডাক্তার আমার বোনকে ভালো করে দেন৷ আমি আপনার বাসায় সারাজীবন গোলাম হয়ে থাকবো৷ (সিদ্ধার্থ)
মা বাবার পরেই ভাইয়ের অবস্থান৷ প্রতিটি ভাইয়ের কাছে তার বোন এক একটা কলিজার টুকরা। বোন ছাড়া প্রতিটি ভাই অচল। যেসব ভাইদের বোন নেই তারা বুঝতে পারে বোন না থাকা কতটা কষ্টের৷ বোন ভাইকে যেমন সব বিপদ থেকে আগলে রাখে তেমনি ভাই বোনের জন্য সব বিপদে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে৷
— শান্ত হও সিদ্ধার্থ। তোমাদের ভালোবাসা ছিন্ন করে কেউ যেতে পারবে না৷ দেখ ছোঁয়া ঠিক ভালো হয়ে যাবে৷
–রিয়া চিৎকার করে বলে উঠে আন্টি ছোঁয়া হাতের আঙ্গুল নড়াচ্ছে।
— প্লিজ সাইট দেন৷ এখন বিরক্ত করবেন না৷ এখন কোন ক্ষতি হবে না ছোঁয়ার। আপনারা প্লিজ এখন শান্ত হন৷
সকলের চোখে জল। এটা কোন শোকের জল না৷ এটা হলো খুশির জল। মানুষের কষ্টে যেমন চোখে জল আসে তেমন অতিরিক্ত আনন্দেও চোখে জল আসে। সকলের মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে।
মার কোলে দু বছরের বাচ্চা যেমন হাসলে মনে হয় পৃথিবী হাসছে। পৃথিবীর সকল সুখ নেমে আসে তেমন তাদের হাসিতে পৃথিবীর সকল সুখ নেমে এসেছে তাদের হাতে।
ছোঁয়া পিন পিক করে চোক মেলছে। চোখ মেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কেন সে চোখ খোলার চেষ্টা করছে সে নিজের জানে৷ এমন কিটিক্যাল পরিস্থিতিতে চোখ খোলার কোন দরকার আছে কি৷ তার জ্ঞান ফিরেছে এটাই কি বেশি নয়৷ কিন্তু ভালোবাসা এটা বুঝতে চায় না। পাহাড় যতই উঁচু হক না কেন ভালোবাসা দিয়ে সে পাহাড় জয় করা সম্ভব।
ছোঁয়ার চোখ খোলে চোখের ইশারায় ডাক্তারকে অক্সিজেন মাস্ক খোলে দিতে বলে৷ ডাক্তার ইশারা বুঝতে পেরে অক্সিজেন মাস্ক খোলে দেয়৷ ছোঁয়া সকলের দিকে এক বার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে৷ ছোঁয়ার চোখ শুধু কাকে খোঁজজে জানা নেই৷ হ্যাঁ ছোঁয়ার চোখ আর কাউকে না অধিরকে খোঁজছে৷ তার ধারণা এখানে সে আছে৷
— মা তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে না তো।ছোঁয়ার মা ছোঁয়ার গালে আলতো করে ভালোবাসা পরশ এঁকে।
— মা আমার কি হয়েছিল? অনেক কষ্টে ছোঁয়া কথা বলে৷
— প্লিজ এখন কেউ তাকে বিরক্ত করবেন না৷ আপনাদের প্রার্থনা বিফলে যায় নি৷ এখন খুব তারাতাড়ি ছোঁয়া সুস্থ হয়ে যাবে৷ প্লিজ আপনারা এখন বাহিরে যান৷
একে একে সবাই বাহিরে চলে যায়।কিন্তু এখনও ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ছোঁয়ার মা ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোঁয়াও দু চোখ ভরে তার মাকে দেখে যাচ্ছে। মায়ের মন চায় না মেয়েকে এভাবে রেখে যেতে৷ এক পা বাড়ালে দু পা পিছিয়ে নেয় ছোঁয়াকে দেখার জন্য।
— প্লিজ ম্যাম বাহিরে যান(নার্স)
— আমাকে আর একটু থাকতে দাও না।
— ম্যাম বুঝার চেষ্টা করেন৷ আপনারা এখানে থাকলে ছোঁয়া আপনাদের এমন অবস্থা দেখে দুর্বল হয়ে পড়বে৷ তার রেসপন্সের জন্য প্লিজ বাহিরে যান৷
ছোঁয়ার মা এক বুক কষ্ট নিয়ে ছোঁয়ার কেবিন থেকে চলে যায়। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা চলে যায়নি৷ চলে গেছে মায়ের দেহটা৷ মা রয়ে গেছে ছোঁয়ার কাছে।
২০.
ছোঁয়া এখন অনেক সুস্থ। সে কথা বলতে পারে। ছোঁয়া শুধু তপেসের কাজ কর্ম ভেসে আসছে৷ যে তাকে এত ভালোবাসতো সেই তপেস কিনা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে৷ কেন তপেস তাকে মারতে চায়৷ সেটা জানার অদম্য ইচ্ছা পূষন করে রেখেছে মনের এক গহীন কোনে।
আজ ছোঁয়াকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে হসপিটাল থেকে। আর রইল ছোঁয়ার বিয়ের কথা৷ ছোঁয়া বলে দিয়েছে সে এখন বিয়ে করতে প্রস্তুত নয়৷ কিন্তু কাউকে তপেসের আসল পরিচয় বলেনি৷
ঘুমের মাঝে ছোঁয়া বুঝতে পারে আজও সেই অদ্ভুত লোকটি এসেছে৷ তাকে খুব যত্ন করে জড়িয়ে ধরে আছে৷ আজ তার জড়িয়ে ধরার মাঝে নেই কোন রাগ নেই কোন অভিমান।আছে শুধু ভালোবাসা। হ্যাঁ অধির প্রতিটি রাতেই এসেছে ছোঁয়ার কাছে। সে প্রতিদিন ছোঁয়ার খুব খেয়াল রেখেছে।কখন কি লাগবে তার জোগান দিয়েছে অধির৷
ছোঁয়া অধিরের স্পর্শ পেয়ে চোখে জল আসে৷ ছোঁয়া ভাবতে পারেনি তার মা বাবার পর কেউ তাকে এত বেশি ভালোবেসে আগলে রাখবে৷
— সুইটহার্ট তুমি কাঁদছো কেন?
— আমি কাঁদছি আপনি কোন আমার সামনে আসেন না৷ এভাবে ছায়া হয়ে কেন থাকেন?
— আমি ঠিকই তোমার কাছে আসব।একটু অপেক্ষা কর।
— ডাক্তার আঙ্কেল আমাকে সব বলেছে আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। সবার সামনে আসেন আমার সামনে আসেন না কেন?
— সেটা তো আমার দায়িত্ব। আমি তোমার জন্য করব না তো কার জন্য করবো৷ তুমি আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস। তোমাকে আঁকড়ে ধরেই আমি বেঁচে আছি।
–আপনাকে একটা কথা বলব?
— হুম তোমার যা মন চায় তাই বল।
— আপনি কেন আমার পিছনে পড়ে আছেন।
— তোমাকে আমি আমি সেই সত্য যুগ থেকে ভালোবাসি৷ তোমার ভালোবাসার জন্যই আমি এখানে এসেছি৷
— কি বলছেন আবুলের মতোন?
— তোমার সত্য যুগের কোন কথা মনে নেই৷
— আপনার মাথা ঠিক আছে কি?
— আমার মাথা সম্পুর্ন ঠিক আছে৷
— তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে যান৷ আমি আপনাকে ভালোবাসি না৷
— কেন আমাকে ভালোবাস না৷ আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নয়৷
— আমি সেটা বলতে চায় নি৷
— তাহলে তুমি কি বলতে চাও?
— দেখেন আমি হলাম মানব৷
— সমস্যা কি?
— কিন্তু আপনি অদৃশ্য অদ্ভুত একটা লোক৷ আমাদের মাঝে কোন মিল নেই৷ কি করে ভালোবাসবো অাপনাকে।
— যেভাবে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
— ভালোবাসার জন্য দুইটা মনের মিল থাকতে হয়৷ এখানে আমাদের মাঝে তেমন কোন মিল নেই৷
— আমাদের উদ্দেশ্য এক৷ তাই আমাদের ভালোবাসা কেউ আটকি রাখতে পারবে না৷
— আপনি ভুল ভাবছেন।
— আমি কোন ভুল ভাবি না৷
— আপনাকে আমার পরিবারের কেউ এক্সেপ্ট করবে না৷ কিছুতেই তারা আমাকে অদৃশ্য অদ্ভুত লোকের সাথে তুলে দিবে না৷
— তাহলে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বল।
ছোঁয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ছিল এতক্ষণ অধির৷ কিন্তু ছোঁয়া বুঝতে পারে সে আজও অদৃশ্য হয়ে আছে৷ অধির অদৃশ্য হয়ে থাকলেও ছোঁয়া অধিরের পরশ বুঝতে পারে৷
ছোঁয়া অধিরের দিকে ফিরে দেখে অধিরের মুখ ছাড়া সবই দেখা যাচ্ছে। মানে অধির মায়াজালে নিজের মুখকে লুকিয়ে রেখেছে৷
— তুমি আমার মুখ তখনই দেখতে পাবে যখন তোমার মনে কোন দ্বিধা থাকবে না৷
— আপনি কেন আমার কাছ থেকে আপনার মুখ লুকিয়ে রাখেন৷
— সময়ের কাছে সব কিছু ছেড়ে দাও৷ সময়ই একদিন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবে৷
— তাহলে কি আপনি কোনদিন আমাকে আপনার ফ্রেস দেখাবেন না৷
— কে বলছে দেখাব না৷ এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ছোঁয়া জানে তার কাথায় সায় না দিলে এর বিপরীত হবে৷ ছোঁয়া অধিরের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।অধির ছোঁয়ার মাথায় খুব যত্নে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়৷
২১.
ছোঁয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে তার ব্যাগ খুব সুন্দর করে গুছানো৷ আজও টেবিলের উপর একটা নীলা চিরকুট।
ছোঁয়া খুশি মনে চিরকুট টা খুলে৷
প্রিয় ছোঁয়া ❤
শুভ সকাল। তোমার দিনটা যেন আজ খুব ভালোভাবে কাটে৷ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় আর কারো সাথে কোন শয়তানি করবে না৷ মন দিয়ে লেখাপড়া করবে৷ আমি তোমার উপর সব সময় নজর রাখবো৷
ইতি
তোমার মনের মানুষ
অধির🖤
ছোঁয়া এসব উপদেশ শুনে বিরক্ত হয়ে যায়। আমি আমার মন মতো চলবো তোর কি সালা ভুত। তোর কথামতো আমি চলবো না৷ তুই কি করবি। আমি তোকে ভয় পায়।
ছোঁয়া আজ এক মাস পর আবার ভার্সিটিতে পা রাখছে। ছোঁয়ার কাছে সব কিছু নতুন মনে হচ্ছে। কিন্তু কোন?
সেই বটগাছ নিজ অবস্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। ভার্সিটির সব ফুলের বাগান আগের মতোই আছে৷ ঘাসের উপর বসে সবাই কথা বলছে৷ কিন্তু কেন আমার কাছে নতুন লাগছে৷
এটাও তো নয় ভার্সিটির দালান এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় অবস্থান করছে। আগের মতোই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রতিটি বেঞ্জ ঠিক অবস্থানেই আছে৷এসব ভাবনার মসগুল হয়ে আছে ছোঁয়া।
— কি রে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? (রিয়া)
— এমনেই অনেক দিন পর আসলাম তো তাই সব কিছু একটু দেখে নিচ্ছি।
— দেখার কি আছে? তুই তো সব জায়গায় সবার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলতি৷ তাহলে আজ কি হলো?
— কিছু না৷
— চল ক্লাসে যায়।
— তুই যা।
— তুই যাবি না।
— না।
— কেন?
— একটা কাজ আছে।
– কিসের কাজ?
— পরে জানতে পারবি।
— না বললে তোকে এখানে রেখে যাবো না।
— পরে তোকে সময় করে সব বলবো৷
— আমিও তোর সাথে যাব
–প্লিজ এমন করিস না।
— তাহলে বল কি কাজ?
— আমি এখন এক জায়গায় যাব।
— কই যাবি৷
তোকে আমি কিছুতেই বলব না আমি তপেসের সাথে দেখা করতে যাব।এখন একটা উপায়ে তোর কাছ থেকে ছাড়া পেতে হবে।
— বললি না কই যাবি?
— আসলে আমি এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাব।সে আমাদের ভার্সিটি চিনে না। তুই মন দিয়ে ক্লাস কর৷ আর সবকিছু আমাকে বলে দিস৷
ছোঁয়া আর কোন কথা না বলে চলে যায়।জানে এখানে থাকা মানে হাজার টা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া।
–
–
–
ছোঁয়া তপেসদের বাড়িতে যায় সরাসরি। তপেস রুমে বসে একের পর এক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। ছোঁয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তপেস সিগারেট খায়৷ খেতেও পারে যে মানুষ ভালোবাসাকে মেরো ফেলতে পারে নিজ হাতে।
— আসতে পারি।
— কে?
— ছোঁয়া।
ছোঁয়া নাম শুনেই তপেস খুব তেড়ে আসে ছোঁয়ার দিকে।
চলবে,,,