.এক_ফালি_রোদ
৭ম_পর্ব
ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। স্যার বোর্ডে কিছু লিখছেন। সেই ফাকে পেছনের দরজা দিয়ে চাইলে ঢুকে পড়তে পারবে। যা ভাবা তাই কাজ। যেই না পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে তখন ই কানে আসে,
– সামনের দরজা খোলা আছে, কোনো দরকার নেই পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকা। আপনি চাইলে সামনের দরজা দিয়েই ঢুকতে পারেন। কেনো অযথা বেঞ্চ পেরিয়ে কষ্ট করে ঢুকবেন!
কথাটা কানে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। ক্লাসের সবার চোখ এখন প্রাপ্তির দিকে। ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। বেশ অস্বস্তি লাগছে। এই প্রথম পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে যেয়ে ধরা পড়েছে সে। ভাগ্যটাই কি খারাপ! প্রথমবার করতেই ধরা খেয়ে গেছে। অন্যরা সারা বছর করে অথচ ধরা তো দূরে থাক, কেউ বুঝেও না।
– মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে রোলটা বলেন, এটেন্ড্যান্স দিতে হবে
লোকটার কথাটা কানে আসতেই মাথা তুলে তাকায় প্রাপ্তি। মাথা তুলে তাকাতেই মুখ হা হয়ে যায়। কারণ তাদের এই ফটোগ্রাফার স্যার আর কেউ নয় বরং সেই লোকটি যার সাথে তার দু দু দিন দেখা হয়েছে কিন্তু একটা সাক্ষাৎ ও আনন্দময় হয় নি। বরং লোকটার সাথে তার কথা কাটাকাটি ই হয়েছে। মাথায় তার একটা চিন্তাই এলো,
” গেলো রে প্রাপ্তি, এবারে সেমিষ্টারের রেজাল্ট। রিটেক তো নিশ্চিত”
– কি হলো বললেন না যা? আপনার রোল?
– ১৭
আমতা আমতা করে কথাটা বললো প্রাপ্তি। লোকটা তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। তারপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– প্রাপ্তি ইসলাম, বসে যান আমি কাউকে এখানে পানিস্মেন্ট দিতে আসি নি। সিট ডাউন। আমি আপনাদের এই কোর্সের টিচার। আমার নাম অয়ন সিকদার। আমি মূলত ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ ছবি তুলি। আমি এই ভার্সিটি থেকেই আর্কিটেকচার এ বি.আরক কমপ্লিট করেছি। এবার ক্লাস শুরু করি? কি বলো?
বলেই ক্লাস শুরু করলো অয়ন। প্রাপ্তি চুপ করে বসে পড়লো। তার দৃষ্টি অয়নের দিকে স্থির। একটা কালো শার্ট এবং প্যান্ট পরিহিত শ্যামবর্ণের সুঠাম শরীরের লোকটাকে আজ যেনো অন্যরকম লাগছে। আজ তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোকে বেশ স্টাইল করে কেটে এসেছে। চুলগুলো আর আওলাঝাওলা নেই, চোখে চশমার বদলে লেন্স। লোকটাকে আজ এক সপ্তাহ পর দেখছে সে। আজ যেনো চেনাই যাচ্ছে না তাকে। গত দুবার ই বেশ মনমরা লাগছিলো তাকে। কিন্তু আজকে তেমন লাগছে না। তার চোখে একটা অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে। তার প্যাশন তার চোখে ধরা পড়ছে। ফটোগ্রাফিকে সে কতোটা ভালোবাসে সেটা যেনো তার চোখে স্পষ্ট। অয়ন প্রজেক্টরে কিছু ছবি দেখিয়ে বলতে শুরু করে,
– আপনাদের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে আপনারা ফাইন আর্টস এর স্টুডেন্ট হয়েও কেনো ফটোগ্রাফি শিখবেন। কারণ ফটোগ্রাফি ও একটা আর্ট, একটা নির্জীব ছবিও মাঝে মাঝে জীবন্ত হয়ে উঠে। একটা তুলি যেমন টুডি পেপারে একটি পেইন্টিংকে জীবন্ত করে তুলতে পারে। ঠিক তেমন একটা ক্যামেরার ক্লিক ও কোনো ছবিকে জীবন্ত করে তুলতে পারে৷ আপনাদের সেটার জন্য বুঝতে হবে সঠিক আলো, সঠিক ফোকাস আর সঠিক এংগেল। এখানে কিছু রয়েছে, আপনারা চাইলে সেগুলো দেখতে পারে। একই ছবি আমি বিভিন্ন আলো, বিভিন্ন ফোকাসে এবং বিভিন্ন এঙ্গেলে তুলেছি। একই অবজেক্ট কিন্তু কতোটা পার্থক্য লাগছে। তাই না?
অয়ন সুবক্তার মতো ক্লাস নিয়ে যাচ্ছে, আর পুরো ক্লাস তার পড়ানোর ধরনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কি জানি একটা আছে লোকটার মাঝে যা সবাইকে আকর্ষিত করছে। প্রাপ্তিও ব্যাতিক্রম নয়। ক্লাসের মাঝেই একটা স্টুডেন্ট বলে উঠে,
– স্যার আপনি আর্কিটেকচার এ পড়া সত্ত্বেও কেনো ফটোগ্রাফি কেনো বেঁছে নিলেন?
– উমমম……কারণ আমি এই প্রফেশনটাকে ভালোবাসি। তুমি যদি তোমার প্রফেশন ভালোই না বাসো তাহলে তুমি সেখানে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবে। আমিও হয়ে গিয়েছিলাম প্রথমদিকে, বাট এখন আমার স্যালারি কম হলে ও আমি এই প্রফেশনটাকে ভীষন ভালোবাসি। এখন লেকচারে মন দাও।
মুচকি হেসে আবার ক্লাস শুরু করলো অয়ন। আজ যেনো অয়নের নতুন এক রুপ দেখতে পেলো প্রাপ্তি। এক নতুন রুপ, যেখানে নেই কোনো রাগ, নেই কোনো জেদ। শান্ত নদীর মতো লাগছে অয়নকে। প্রাপ্তির সবথেকে আকর্ষণীয় লেগেছে অয়নের শান্ত হাসিটি। গত দুদিনে এই হাসিটি সে দেখে নি। রাগী মানুষদের হাসি নাকি সবচেয়ে সুন্দর হয়, অয়ন ও তাদের ব্যাতিক্রম নয়। দেখতে দেখতে কখন যে পঞ্চাশ মিনিট পার হয়ে গেলো তা যেনো বুঝতেই পারলো না প্রাপ্তি। ক্লাস শেষে যখন অয়ন বেরিয়ে যেতে নিলো তখন প্রাপ্তি তার পিছু পিছু যেয়ে বললো,
– স্যার একটা কথা ছিলো, একটু সময় হবে।
অয়ন প্রাপ্তির কথা শুনে থমকে গেলো। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তির মুখ ইতস্ততবোধ। কপালে ঘাম জমছে। কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।
রান্নাঘরে শেফালি বেগমের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাইসা। বিয়ের জন্য দুইটা সপ্তাহ ছুটি নিয়েছে সে কলেজ থেকে। কাল থেকে কলেজ খোলা। শেফালি বেগমকে কথাটা এখনো বলা হয় নি তার। এখন তো নিজের বাসায় নেই সে। তাই শাশুড়ীর অনুমতির প্রয়োজন এই ব্যাপারে। রাইসা বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে বলবে। তখনই শেফালী বেগম প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
– রাইসা মা, কিছু বলবে? কখন থেকে দেখছি কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছো!
– মা আসলে
– হুম বলো, শুনছি আমি
– কাল থেকে আমার কলেজ খুলে যাবে। আসলে ছুটি নিয়েছিলাম তো!
– তো? আমাকে কেনো বলছো?
– আপনার অনুমতি লাগতো মা
– ধুর বোকা মেয়ে, বিয়ের সময় জানতাম। তুমি টিচার। এখন একটা মেয়ে টিচার হয়ে কি বাসায় বসে থাকবে না কি? তুমি আবরারকে বলে দিও কালকে তোমাকে নিয়ে যাবে সে। ঠিক আছে?
আবরারের কথা শুনতেই নিমিয়ে যায় রাইসা। বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও তাদের সম্পর্কের কোনো ইম্প্রুভ হয় নি। বরং ধীরে ধীরে তাদের মাঝের অদৃশ্য দেয়াল যেনো বেড়েই চলেছে। ঘৃণার আস্তরণ কমার বদলে বাড়ছে। এখন অবশ্য আবরার তার উপর কোনো জোর করে না। কোনো অত্যাচার করে না। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নি। যতক্ষণ আবরার রুমে থাকে রাইসা যেনো জড়বস্তুর মতো রুমে থাকে। থেকেও নেই। ইচ্ছে হলে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়, ইচ্ছে না হলে দেয় না। আবরার এটাই মেনে নিয়েছে। তারও যেনো জোর করতে ইচ্ছে হয় না। রাইসা মাথা কাত করে সবজি কাটতে লাগলো। বাড়ির কেউ ই জানে না তার এবং আবরারের সম্পর্কটা ঠিক কেমন, রাইসা বা আবরার ও চায় না তাদের সম্পর্কে কারোর কোনো সন্দেহ হোক। রাইসা এবং শেফালি বেগম রান্নায় ব্যস্ত তখনই বাড়ির কাজের মেয়েটা ছুটে আসে।
– ভাবী, আম্মা, বড় ভাইজান জানে কেমন করতাছে!
মেয়ের এমন ডাকে হাতটা কেপে উঠে রাইসার। হাতে থাকা ছুরিটায় আঘাতে আংগুলের কিছুটা অংশ কেটে যায়৷ আবরার তো অফিসে গিয়েছে। এতো সকাল সকাল তো তার আসার কথা নয়। শেফালী বেগম এবং রাইসা হাতের কাজ ফেলে ছুটে যায় দরজার কাছে। দরজার কাছে যেতেই দেখে……………….
চলবে
[পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি