রঙ চা
পর্বঃ২৫,২৬(শেষ)
মাহফুজা মনিরা
কাঁচের বাহিরে একটা পেলব দুপুর। ব্যস্ত শহর টাকে আরো ব্যস্ত করে তুলছে যেনো। শান একটা রেস্টুরেন্টের দোতালায় বসে সেই ব্যস্ত শহর দেখতে ভীষণ ব্যস্ত। সূয্যিমামা উঠার আগেই এসব মানুষের দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। কিসের এতো কাজ তাদের! শান বুঝতে পারেনা।
“এই যে মিস্টার…”
শান চমকে তাকায়। ঘোর কেটে দায়সারাভাবে বলে,
“আরে মিস নম্রতা। আসুন আসুন। বসুন না…!”
শান উঠে চেয়ার ঠেলে তাকে বসার আমন্ত্রণ জানায়। ধীরভাবে বসতে বসতে নম্রতা বলে,
“আমি কি খুব দেড়ি করে ফেললাম!”
শান হেসে মাথা নাড়ায়।
” না না। আমিই বোধহয় দ্রুত চলে এসেছি।”
নম্রতা উত্তরে হাসি ছুড়ে দেয়। শান একটু ওয়েটার কে ডেকে নম্রতার দিকে তাকায়।
“কি খাবেন?”
নম্রতা কিছুক্ষণ মেনু কার্ডের দিকে চোখ বুলায়। তারপর বলে,
“একটা স্ট্রং কফি। আর কিছু না।”
ওয়েটার তার কার্ডে অর্ডার লিখে শানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“স্যার আপনি?”
“একটা ব্ল্যাক কফি।”
“ওকে স্যার।”
ওয়েটার বয় চলে যায়। আর শান পুরোপুরি ভাবে তাকায় নম্রতার দিকে। এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সে আর নম্রতা কফিশপে এসেছে। প্রথম বার শানই অফার করেছিল নম্রতাকে। নম্রতাও তার এই নতুন বন্ধুকে না করেনি। কিন্তু এবার ডেকেছে স্বয়ং নম্রতা।
নিরবতা ভেঙে শান বললো,
“ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার জন্য ডেকেছো। এখন চুপ কেনো। বলো কি বলবে।”
নম্রতা প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথাটা বলার জন্য মোটামুটি একটা প্রিপারেশন নেয়৷ তারপর ক্ষীণ গলায় বললো,
“আমি একটা মিথ্যা বলেছি এতদিন তোমাকে।”
শানের কপাল নিজ থেকেই কুঁচকে যায়।
সে বিষ্মিত গলায় বলে,
“কি মিথ্যে কথা?”
“আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি প্রায়াণের জীবন থেকে সরে এসেছি।”
“হুম তো?”
“আসলে আমি সরে আসিনি শান। আমি এখনো ওর জীবনে আছি। আর ওর জীবনেই থাকতে চাই বিধায় আমি আর আন্টি মানে প্রায়াণের আম্মু…”
শান একটু বিধ্বস্ত হয় কথাটা শোনার পর। সে ভেবেছিল একটা সঠিক সময় এলে নম্রতাকে নিজের ভালোবাসার কথা বলবে কিন্তু…!
শান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“কি করেছো তোমরা?”
“আমি কিছুই করিনি।আন্টিই করেছে যা করার। ভদ্র শাশুড়ি সেজে প্রায়াণ আর স্ত্রী কে দূরে দূরে রেখেছে এতদিন। এবং আই থিংক ওরা ওদের দাম্পত্য জীবনও শুরু করতে পারেনি এখনো।”
নম্রতার চোখ চকচক করে উঠে। সে বলে চলে,
“শুনলাম কাল রাতে নাকি দুজনে ঝগড়া করে আলাদা রুমেও ছিলো। আমার কি মনে হয় জানো শান? খুব বেশিদিন টিকবে না এই সম্পর্ক। যেভাবে হুট করে হয়েছিল,সেভাবে হুট করেই ভেঙে যাবে। আর তখন….তখন প্রায়াণ শুধুই আমার। আর আমি শুধুই প্রায়াণের।”
নম্রতার ঐ চকচক করতে থাকা চোখে শান একধরনের পৈচাশিকতা দেখতে পায়। শানের ভেতর টা হঠাৎই প্রচন্ড ঘৃণায় তলিয়ে যায়। সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে এখন,সুন্দর চেহারার অধিকারী রা সবসময় সুন্দর মনের অধিকারী হয়না।
শান কে নিম্নমুখী হয়ে বসে থাকতে দেখে নম্রতা প্রশ্ন করে,
“কি ব্যাপার কিছু বলছো না যে!”
শান মুখ তুলে তাকায়। থমথমে মুখ করে বলে,
“তুমি না একটা মেয়ে নম্রতা? এক তরফা ভালোবাসায় এতটাই পাগল হয়ে গেছো যে ভালো মন্দ কিছুই বুঝে আসছে না তোমার? প্রায়াণ যেখানে তোমাকে ভালোইবাসে না,সেখানে তুমি ওকে কেনো জোর করে নিজের করতে চাচ্ছো? জোর করে কি ভালোবাসা হয় নম্রতা??”
নম্রতা চুপ।
শান বললো,
“আজকে যখন তুমি আমাকে একটা সত্যি বললেই তখন আমিও একটা সত্যি বলি। প্রথম যখন তোমাকে দেখেছিলাম,তখন থেকেই তোমার জন্য একটা ভালোলাগা কাজ করতো আমার। এরপর তোমার সাথে মিশতে গিয়ে,চলাফেরা করতে গিয়ে,কথা বলে, ধীরে ধীরে তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম। ইয়েস আই লাভ ইউ নম্রতা।”
নম্রতা চমকে তাকায়। শান একটুও বিচলিত হয় না। বলে,
“কিন্তু কই? আমি কি তোমাকে জোর করে পেতে চাচ্ছি? আমার ভালোবাসাও তো একতরফা। এখন আমারও উচিত না তোমার মতো তোমাকে জোর করে পাওয়ার?? তাই নয় কি নম্রতা?”
নম্রতা ক্রুর দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকায়। শান হেসে বলে,
“কিন্তু আমি তো তোমাকে জোর করে পেতে চাইনা। কারন আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয়না নম্রতা। তাই তোমাকেও একটা কথাই সাজেস্ট করবো,শুধু শুধু অন্যের সুখের সংসার নষ্ট করো না।”
নম্রতা ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কঠিন গলায় বলে,
“আমি কি করবো না করবো তা আমার ব্যাপার। একটা ভালো ফ্রেন্ড ভেবেছিলাম তোমাকে। অন্য কিছুই না আর কিছু হবেও না। আজকের পর থেকে আমার সাথে কন্টেক্ট করারও চেষ্টা করবে না তুমি। বায় ফরেভার।”
হনহন করে নম্রতা চলে যায়। নম্রতা চলে যেতেই শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ওয়েটার বয় দুটো কফি নিয়ে আসে তখনি। অনুনয়ের সুরে বলে,
“সরি স্যার। আমাদের ম্যানেজমেন্ট এ একটা সমস্যার কারনে দেড়ি হয়ে গেলো। এক্সট্রিমলি সরি।”
শান আলগা হেসে পকেট থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট বের করে। ওয়েটারের হাতে দিয়ে বলে,
“কফির আর প্রয়োজন নেই।”
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা চা খাচ্ছিল নিশুতি। প্রায়াণ এসে তার পাশে দাঁড়ায়।
“এখনো রাগ আমার উপর? ”
নিশুতি কিছু না বলে মাথা নাড়ে শুধু। প্রায়াণ দু’হাতে তাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“সরি রাঙাপরী। কালকে রাতে মাথা ঠিক ছিল না। কেনো যে ওমন রিয়েক্ট করেছিলাম তোমার উপর নিজেও জানিনা। সরি জান। আর হবে না।”
নিশুতি প্রায়াণের মাথায় ছোট করে গাট্টা মেরে বললো,
“ইটস ওকে। আমি বুঝেছি। কিন্তু তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে চাই প্রায়াণ।”
প্রায়াণ মুখে একটা সিরিয়াস ভাব এনে বললো,
” হুম বলো।”
নিশুতি চায়ের কাপ টা গ্রিলের উপর রাখে। নিচু স্বরে বলে,
“আমার কেনো যেনো খালি মনে হয় তোমার আম্মু ইচ্ছে করে আমাকে আর তোমাকে দূরে দূরে রাখে প্রায়াণ। আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হোক তা উনি চায় না। উনি বোধহয় এখনো চায়,নম্রতাই তোমার বউ হোক। এমন কেনো মনে হচ্ছে আমার প্রায়াণ?”
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“কারন তোমার এই ভাবনা গুলো ঠিক। তাই। আমারও এই ভাবনাই মনে আসে খালি। মা আসলেই একটু বেশি বেশি করতেছে।”
“কি হবে প্রায়াণ? এভাবে চললে তো একটা সময় আমাদের আলাদা…”.
নিশুতি কথা শেষ করার আগেই প্রায়াণ তার মুখ চেপে ধরে।
ধমকে বলে,
” আউল ফাউল কথা বলবা না। আর তুমি চিন্তা করো না।আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করবোই করবো।”
নিশুতি প্রায়াণের বুকে মাথা রাখে। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
“আমার খুব ভয় হচ্ছে।”
প্রায়াণ নিশুতির মাথায় হাত রাখে। শান্ত গলায় বললো,
“চিন্তা করো না। আমি কিছু একটা করবো খুব দ্রুতই।”
.
চলবে….
রঙ চা
শেষ পর্ব
মাহফুজা মনিরা
খাবার টেবিলে যেন বোমা ফাটলো প্রায়াণের কথায়। প্রায়াণ আবারও বললো,
“আমি নম্রতাকে বিয়ে করতে চাই।”
প্রেমা পিউ চমকে উঠে। প্রত্যুষ উঠে আৎকে। বিষ্ময়ে মিনু শেখ এর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কি একটা অবস্থা! জালাল শেখ অনেকটা চেঁচিয়ে বলেন,
“তোর বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্টির মধ্যে কেউ জীবনে দুই বিয়া করলো না। আর তুই দুই বিয়া করতে চাস? সমস্যা কি তোর?”
নিশুতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। প্রেমা একহাত দিয়ে নিশুতির হাত শক্ত করে ধরে রেখে প্রায়াণের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোর নাট বল্টু ঢিলা হইয়া গেছে ভাইয়া? পিউ যা তো স্ক্রু ড্রাইভার নিয়া আয়। ভাইয়ের মাথার নাট টাইট দি।”
পিউও সুন্দর মতো উঠে দাঁড়ায়। প্রেমাই ধমকে উঠে,
“বলদ বস।”
পিউ মাথামুণ্ডু বুঝে না কিছুই। ফ্যাচফ্যাচ করে বললো,
“কি হইছে? তুমিই না বললা আনতে!”
প্রেমা রাগী দৃষ্টিতে তাকায় পিউ’র দিকে। পিউ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে পড়ে তার চেয়ারে। প্রত্যুষ প্রায়াণের হাতের উপর হাত রাখে। ক্ষীণ গলাহ বললো,
“তোর বড় ভাই এখনো বিয়ে করলো না। তুই অলরেডি একটা করছিস। এখন আরো করতে চাচ্ছিস! মানে সমস্যা কী তোর? আমি বুঝতেছি না।”
প্রায়াণ কারো কথার জবাব দেয় না। চুপসে বসে থাকা মিনু শেখ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“মা আমি তোমার বান্ধবীর মেয়ে নম্রতাকে বিয়ে করতে চাই। আয়োজন করবা না?”
মিনু শেখ কঠিন গলায় গর্জে উঠলো,
“আমাকে বলতাছিস ক্যান? বিয়ে করবি ভালো কথা। তর বাপ ভাই আছে না? তাদের বল। আমাকে বলোস কেন?”
প্রায়াণ মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
“কারন তুমিই তো চাও আমি নম্রতাকেই বিয়ে করি। এবাড়ির বউ করে আনি। এই কারনেই তো আমার আর নিশুতির দাম্পত্য জীবন টাকে শুরু করতে দিচ্ছো না। আমাদের এক হতে দিচ্ছো না। তাই তোমার ইচ্ছা টাই পূরণ করবো। কি ঠিক আছে? তুমিই আয়োজন করো সব তাহলে।”
প্রায়াণের কথা শুনে মিনু শেখ কঠিন চোখে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বাকিরা সবাই চমকে গেছে এসব শুনে। নিশুতির ফোঁপানো কান্না থেমে যায়। সেও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রেমার হাত ধরে।
মিনু শেখ রাগী গলায় বললেন,
“এসব আবোল তাবোল কিসব বলতেছিস? আমি কেনো তোদের দাম্পত্য জীবন শুরু করতে দিবো না??”
প্রায়াণ মুখে হাসি রেখেই বললো,
“আমি নম্রতাকে বিয়ে করতে চাই এটা শুনে সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে কেনো এরকম ডিসিশন নিলাম আর তুমি শুনে কি বললা? বিয়ে করবি ভালো কথা! মানে তোমার আগ্রহও নেই এসব ব্যাপারে যে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছি। যেহেতু আমি অলরেডি ম্যারেড। নম্রতাকে বিয়ে করবো এটা শুনেই তুমি খুশি হয়ে গেছো তাইনা?? আর প্রতিদিন রাতে নিশুতি কে তোমার রুমে এটা ওটা কাজে ব্যস্ত রাখা। আমার কাছাকাছি আসলেই তোমার কাজ পড়ে যায়। এসব কি মা? আমি কি কিছু বুঝি না??”
জালাল শেখ চমকিত হয়ে প্রায়াণ কে জিজ্ঞেস করে,
“প্রতিদিন রাতে নিশুতি তোর মায়ের রুমে থাকে?”
“হুম। মা ই ডেকে নিয়ে যায় নানান কাজের ছলে। এমনকি বাসর রাতেও….”
জালাল শেখ এর মুখ হা হয়ে যায়। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তার বউয়ের দিকে। মিনু শেখ মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার সুন্দর শ্বাশুড়ি সাজার কাজ টা বিফলে গেলো একেবারেই।
জালাল শেখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“মিনু কি সমস্যা তোমার? তুমি কি ওদের কে মেনে নিতে পারছো না?”
মিনু শেখ মাথা নাড়ায়। এখন আর অভিনয় করে লাভ নেই। নিজের অভিনয়ে নিজেই ফেসে গেছে।
হালকা ক্ষীণ কণ্ঠে মিনু বলে,
“আমি চাই নম্রতাই আমার ছেলের বউ হোক। প্রায়াণের বউ হোক।”
প্রায়াণ টেবিলে হাত দিয়ে বারি মেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার গা কাঁপছে। মিনু শেখ তার মা না হয়ে অন্য কেউ হলে, এতক্ষণে কতগুলো যে কথা শুনিয়ে দিতো। তার ইয়ত্তা নেই।
প্রায়াণ গমগমে গলায় বললো,
“নম্রতা কে না কে,তার জন্যেই চেয়ে গেলে সব। আর তোমার ছেলে,কার সাথে সুখে থাকবে কী না থাকবে। সেটা একবারও ভাবলে না? কেমন মা তুমি?? আমি কি কখনো বলেছিলাম নম্রতাকে আমি ভালোবেসেছি? নাকি নম্রতার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল? শুনো মা…সুন্দর চেহারা হলেই হয় না। সুন্দর একটা মন লাগে। নম্রতার সেই মন নেই। ওর মনে কুটলতা,কুৎসিতে ভরা। ওরকম মেয়েকে আমি কোনোদিনই ভালোবাসিনি। আমার ফ্রেন্ড ছিল জাস্ট ঐ পর্যন্তই শেষ।”
সাময়িক থামে প্রায়াণ। তারপর আবার বলে,
“নিশুতি মনে প্রাণে চাইছে তোমার মন জুগাতে। তোমার বাড়ির বউ হতে। আর তাই,বিবাহিত হয়েও সে তার নিজের সুখের কথা চিন্তা করে নি। তুমি যখনি ডেকেছো,সে প্রতিবাদ করেনি। রাও করেনি। চুপচাপ চলে গেছে তোমার কাছে। আচ্ছা মা,তুমিও তো বিবাহিত। তুমিই একটাবার ভেবে দেখো না,যেই রা নিয়ে প্রতিটি মেয়ের একটা আলাদা স্বপ্ন থাকে। সেই রাতে তোমার শ্বাশুড়ি নিজ ইচ্ছায় তোমাকে তোমার স্বামীর থেকে আলাদা করে রাখলো। কেমন লাগতো তখন??”
মিনু শেখ সোজা চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়।
প্রায়াণ বলে চলে,
“অথচ নিশুতি, একটা টু শব্দ ও করেনি তোমার কর্মকাণ্ডে। আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম তুমি এসব ইচ্ছে করে করছো। আমাকে আর ওকে দূরে রাখার জন্য। কিন্তু কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম নিজে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু নাহ,তুমি তো তোমার কাজ চালিয়েই যাচ্ছো। থামার নাম গন্ধ নেই। আর তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। আমি আর নিশুতি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
মিনু শেখ আর নিশুতি বাদে উপস্থিত সকলেই চমকে তাকায় প্রায়াণের দিকে। জালাল শেখ ধমকে উঠে,
“কি বলিস এগুলা?”
প্রত্যুষ এগিয়ে এসে প্রায়াণের কাধে হাত রেখে বলে,
“ঐ ব্যাটা মাথার তার কি সব ছিড়ছে?”
প্রেমা আৎকে উঠে বললো,
“ভাইয়া ভুল সিদ্ধান্ত নিও না।”
প্রায়াণ ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আমি অনেক ভেবেই নিয়েছি। সব সম্পর্কের মূল্য আছে,দাম আছে,দায়িত্ব আছে। আমিও সেই দায়িত্ব পালন করতে করতে মায়ের কর্মকান্ড বোঝার পরেও কিছু বলিনি। কিন্তু সে তো তার ছেলে আর তার সম্পর্কের মূল্য দিলো না। সে দাম দিয়েছে তার বান্ধবীর মেয়ের সম্পর্কে!! আর তাই,আমি এবার আমার বউয়ের সম্পর্কের মূল্য দিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
নিশুতির দিকে তাকিয়ে,কোমল কণ্ঠে প্রায়াণ বললো,
“মেয়েটা সব ছেড়ে আমার হাত ধরে এবাড়িতে এসেছে। তাকে সুখে রাখার দায়িত্ব টাও আমার। আমি একজন মানুষ হয়ে অন্য মানুষের কষ্ট কি করে না বুঝে থাকি?”
প্রেমার চোখ ছাপিয়ে জল ভরছে।
সে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে আফসোস এর গলায় বললো,
“ভাইয়া তোর মতো যদি সবাই বুঝতো তাহলে আমাদের মেয়েদের স্বামীর সংসার টা মনে গেথে থাকতো সুখের পরশে…দুঃখ কে মনে আগলে সংসার করতে হতো না।”
প্রায়াণ মৃদু হাসে প্রেমার কথা শুনে। পিউ দৌড়ে এসে প্রায়াণের একহাত ধরে। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
“ভাইয়া তুমি সত্যিই চলে যাবা?”
প্রায়াণ আলতো হাতে পিউ’র গাল ছুঁইয়ে বলে,
“আমি রোজ নিয়ম করে প্রেমার ফোনে ফোন করবো। কিছু লাগলে বলিস আমাকে। আর বড় ভাইয়া তো আছেই। কাঁদিস কেনো পাগলি?”
প্রত্যুষ এসে প্রায়াণের কাঁধে স্নেহের হাত রাখে।
“কোথায় উঠবি?”
“আমি আগে থেকেই বুঝেছিলাম এমন কিছু হবে। তাই এই সামনের এলাকাতেই একটা ছোট ফ্লাট নিয়েছি। সেখানেই যাবো। আর ও ভাইয়া,তোর অফিসে আমার জবের কথা বলছিলি না? দেখিস তো আবার হয় কীনা..!”
প্রত্যুষ ব্যথাতুর নয়নে হাসলো। বললো,
“ঐ জব টা তোকে দেওয়াবোই। তুই চিন্তা করিস না। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলবি। কেমন?”
প্রায়াণ মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়।
মিনু শেখ বাদে বাকি সকলের দোয়া আর ভালোবাসা নিয়ে প্রায়াণ নিশুতি তাদের নিজেদের সংসারের পথে পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় প্রায়াণ মিনু শেখ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভালো থেকো মা। আমার কথা মনে পড়লে নম্রতাকে ডেকে নিও। আমার থেকেও তো সেই বেশি…!”
তারপর আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দুজনে বেরিয়ে যায়।
______________________________
৪ মাস কেটে গেছে।
প্রায়াণ তার আর নিশুতির ছোট্ট সংসার টা নিয়েই ব্যস্ত এখন। মিনু শেখ আর কখনো ছেলের কথা মনে করেন নি। তাই প্রায়াণ ও জিদ ধরেছে যেদিন তার মা তার ভুল বুঝবে সেদিনই ফিরবে ও বাড়িতে…
হয়তো মা ছেলের মান অভিমানের পালা,শেষ হবে একদিন। নম্রতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে গিয়েছিল শানের কাছে। কিন্তু তখন শান বিবাহিত। এরকম কুৎসা ভরা একটা মেয়েকে একমুহূর্তের জন্য ভালোবাসা যায় ঠিকই কিন্তু সারাজীবন এর সঙ্গী বানানো যায় না।
জালাল শেখ,প্রত্যুষ,প্রেমা,পিউ প্রায় রোজই আসে প্রায়াণের বাড়িতে। ইফতিও আসে মাঝে মাঝে। আজহার হোসেন আর শারমিন হোসেন ওদের সুখের সংসার দেখে হিংসেই জ্বলে পুড়ে মরে মাঝে মাঝে। কিন্তু করার তো কিছুই নেই…!
______________________________
জানালার বাহিরে একটা নিস্তব্ধ বিকেল। মাঝে মাঝে রিকশার টুংটাং আর গাড়ির শাঁ করে চলে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে….৪ তালার এই বিল্ডিং এর ৩ তলায়। ব্যস্ত শহরের সেই নিজস্ব শব্দ শুনতে শুনতে গুনগুন করছে নিশুতি। চুলোয় গরম পানি। এক চামচ….আর আধা চামচ চা পাতি ঢেলে দিলো সেই পানিতে। কিছুক্ষণের অপেক্ষা… তারপরই একটা কড়া ঘ্রাণ নাকের কাছে এসে ধাক্কা দিতে লাগলো। নিশুতি নিজ মনেই ভাবে, জীবন টাও তো এই রঙ চায়ের মতন। এক চামচ দু চামচ করে শ্রম,ধৈর্য,ইচ্ছাশক্তি আর ভালোবাসা মেশালে,জীবন থেকেও একটা সুন্দর মিষ্টি কড়া ঘ্রাণ বের হয়।
হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে নিশুতিকে। নিশুতির এলোথেলো চুলের ভাঁজে মুখ গুঁজে দেয় তার। এই স্পর্শ নিশুতির চেনা…এই ছোঁয়া নিশুতির চিরজীবনের….
নিশুতি মৃদু হেসে বললো,
“কি জনাব? সারাদিন এভাবে চিপকে থাকলে আমার সাথে,লোকে বলবে বউ পাগল।”
প্রায়াণ নিশুতির ঘাড় থেকে মাথা তুলে তাকায়। নিশুতির গালে নিজের গাল ঘষতে ঘষতে বললো,
“যাদের হিংসে হবে আমাকে দেখে তারাই বলবে। এন্ড আই ডোন্ট কেয়ার।”
নিশুতি হাসলো প্রায়াণের কথা শুনে। প্রায়াণ কে ঠেলে সরিয়ে চুলোর আগুন নিভালো। দুটো কাপে গরম রঙ চা ঢালতে ঢালতে বললো,
“তোমার কাপে ক’চামচ চিনি দেবো?”
প্রায়াণ নিশুতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, মুখে দুষ্টু হাসি এনে বললো,
“চিনি লাগবে না। একবার তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া দাও। তাতেই ডায়াবেটিস হয়ে যাবে আমার…”
সমাপ্ত
শিক্ষনীয় বিষয়
একটা মেয়ে তার বেড়ে উঠার পরিবেশ,তার নিজের বাবা মা ভাই বোন পরিজন সব ছেড়ে একটা ছেলের ভরসায়,তার হাত ধরে একটা নতুন পরিবেশে আসে। হোক সেটা লাভ ম্যারেজ,অথবা এরেঞ্জ ম্যারেজ। আমি প্রতিটা ছেলের কাছে একটা কথাই বলতে চাই, এই গল্পের প্রায়াণের মতো হও। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক বুঝতে শিখো। আপনার মা,আপনার আপন ভেবে ভাববেন সবসময় সেই ঠিক আর আপনার সাথে আসা এই মেয়েগুলো বেঠিক। যদি সব ছেলেরা প্রায়াণ হতো তবে কোনো মেয়েকে স্বামীর সংসারে গলায় ফাসি লাগিয়ে মরতে হতো না আই থিংক। জানেন তো,একজন নারীর পাশে তার স্বামী যদি এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়,আর কোনো শক্তির প্রয়োজন পড়েনা সে নারীর…স্বামী হন,পশু না..