রঙ চা
পর্বঃ১৭,১৮
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
ফোন কেটে দিয়ে দৌড়ে প্রায়াণের সামনে এসে দাঁড়ায় নিশুতি। প্রায়াণ ধমকায়,
———-এতো তাড়াহুড়ো কিসের! একটু আস্তে ধীরে আসা যায়না? পরে হাত পা মচকালে তখন কেমনে ঘুরবা?
সেই ধমকানির এক আনাও নিশুতি তার গায়ে লাগায় না। বরং উল্লাসিত কণ্ঠে বললো,
———-ইফতি রাজী হয়েছে। তার মানে আমরা কাল ঘুরতে যাচ্ছি। রাইট?
প্রায়াণ মাথা ঝাকায়,
———-হুম রাইট।
নিশুতি খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠে। চিল্লিয়ে বললো,
———ইয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াহুউউউউউউ।
প্রায়াণ দায়সারাভাবে তাকায় নিশুতির দিকে। তার চোখ যেন বলছে,এতটা বাচ্চা স্বভাবের কেমনে হইলা তুমি!
অথচ নিশুতি সেই চোখের ভাষা পড়ে না। সে খুশিতে বাক বাকুম করতে করতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
রাত টাও নিশুতির অস্থিরতায় কাটে। তার ইচ্ছে করছে এখুনি রওনা হয়ে যাক ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রায়াণ খেয়ে দেয়ে সবে মাত্র বিছানায় শুয়েছে। নিশুতি এসে তার পাশ ঘেঁষে বসে। হালকা কণ্ঠে বললো,
———–প্রায়ু।
প্রায়াণ চমকায়। নিশুতি তার নামের অর্ধেক করে ডাকছে! হাউ সুইট…!!
প্রায়াণ উঠে বসে। সেও আহ্লাদী কণ্ঠে জবাব দেয়,
———হুম নিশু বলো।
নিশুতি ঢং করে হেলে দুলে বলতে লাগলো,
———কখন রওনা দিবো আমরা? আর কতক্ষণ পর?
প্রশ্নটা শুনে প্রায়াণের নিজেকে গুলি মেরে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। না হলেও ১২ বার নিশুতি এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে,আর প্রায়াণ প্রতিবার বলেছে যে সকালে তারা রওনা হবে। তারপরেও মেয়েটার একই প্রশ্ন!!
প্রায়াণ আহ্লাদী রোমান্টিক ভাব সরিয়ে বিরক্তি ভাব ফুটায় চেহারায়। শুতে শুতে বলে,
———জীবনেও রওনা দিবোনা। ঘুমাও এখন।
নিশুতি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে প্রায়াণের উল্টো পাশ ফিরে শোয়। প্রায়াণ কি বোঝে না,সে এই প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে আর তাই,তার এতো উল্লাস,এত আনন্দ! কেনো বোঝে না ছেলেটা! বাজে ছেলে,পচা ছেলে,হাদা ছেলে,গাধা ছেলে….
নিশুতি মনে মনে একের পর এক বকে যায় প্রায়াণ কে।
বেশ কিছুক্ষণ পার হয়। নিশুতির ঘুম আসছে না কিছুতেই। সে একবার আঁড়চোখে প্রায়াণকে দেখে। সে উল্টো দিকে ঘুরে আছে। হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিশুতির মেজাজ গরম হয়। নিজের ঘুম আসছে না,আর আতেল টা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। বদ ছেলে!
নিশুতি উঠে পা টিপে টিপে বারান্দার দিকে এগোতে নিলেই প্রায়াণের কণ্ঠ শোনা যায়।
———এত রাতে বারান্দায় গেলে পা দুইটাই ভেঙ্গে ফেলবো। চুপচাপ বিছানায় এসে শোয়, ঘুমাও। নাইলে ঘুরতে নিয়ে যাবো না। কোথাও না।
নিশুতি ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো কাইকুই করে। তারপর একা একাই এসে আবার বিছানায় শোয়। তার ইচ্ছে করছে লাত্থি মেরে প্রায়াণ কে খাট থেকে ফেলে দিক। শালা খাটাস!!
নিশুতি একাই রাগে গজগজ করতে থাকে। একদম নিঃশব্দে। তারপর একটা সময় নিজেও ঘুমের রাজ্যে পারি জমায়।
.
.
ভোর ৬ টা।
প্রায়াণের হাত ধরে টানছে কেউ। প্রায়াণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ জোড়া মিটমিট করে খুলে দেখে নিশুতি বসে আছে।
প্রায়াণকে চোখ খুলতে দেখেই নিশুতি তোরজোর লাগায়।
——–উঠো না। ঐ…উঠো না। ঘুরতে নিয়ে যাবা না?? ঐ প্রায়ু। উঠো না…উহহহ উঠো না..!!!
প্রায়াণ নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে নিশুতির দিকে। আসলেই মেয়েটার মাথা খারাপ। সকাল ৬ টায় কে ঘুরতে যায়!! উফ…
প্রায়াণ উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে বললো,
———–এখন না, ১০ টার সময় বের হবো। এখন ঘুমাও।
নিশুতির রাগে জিদে গায়ের চামড়া ফেটে যাচ্ছে সব। সেই রাত থেকে সে অপেক্ষা করছে সকাল হওয়ার,ঘুরতে যাওয়ার আর এখন যখন সকাল হলো তখন কিনা বলছে আরো পরে!! উফফফফফফোওওও…
নিশুতি দ্রিম করে কিল বসিয়ে দেয় প্রায়াণের পিঠে। প্রায়াণ লাফিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে। একদম অবিশ্বাসের চোখে তাকায় নিশুতির দিকে। নিশুতি সে চোখের ভাষা উপেক্ষা করে। গরম চোখে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে। প্রায়াণ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
———-কি হইছে তোমার কি সমস্যা?? কিলাচ্ছো কেনো??
———-ঘুরতে যাবো।
———-আমি কি বলছি যে নিবো না?? এখন ঘুমাও। বললাম না আরো পরে বের হবো!!
প্রায়াণ অনেকটা চেঁচিয়ে বললো কথাটা। নিশুতি আর কিছু বললো না। মুখ ভার করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ইচ্ছে করছে লবণ ছাড়াই রান্না করে খাক এই বেয়াদব ছেলেটাকে। ইডিয়ট, শয়তান, শুটকি, কাইল্লা, লম্বা ভূত……….
হাজার হাজার গালিতে প্রায়াণ কে ভরিয়ে দেয় নিশুতি কিন্তু সব মনে মনে।
.
.
সাড়ে ১০ টা বেজে গেছে। অথচ নিশুতি কে টেনেও উঠাতে পারছে না প্রায়াণ।
প্রায়াণ বিরক্তি নিয়ে বললো,
———-কাল থেকে জ্বালাচ্ছো ঘুরতে যাবার জন্য আর এখন নিজেই উঠছো না!! উঠো নিশু। ঘুরতে যাবা না??
নিশুতি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
——–উম উম৷ আরেকটু ঘুমাই না ইফতি।প্লিইইইজ।
প্রায়াণ কপাল চাপড়ায়। নিশুতির কানের কাছে মুখ নিয়ে একটু জোরেই বললো,
——–আমি প্রায়াণ। তোমার ভাই না!!! উঠোওওও…ঘুরতে যাবায়ায়ায়া না?????
নিশুতি ধড়মড় করে উঠে বসে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে নিজেরই কাছে আর প্রায়াণ কে ভিলেইন। তার এতো সুন্দর ঘুমটা ভাঙানোর জন্য একমাত্র দায়ী এই বেয়াদব টা!
নিশুতি আবারো কয়েকটা গালি দেয় প্রায়াণ কে।তবে মনে মনে। প্রায়াণ হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বলে,
——–ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। শীতের পোশাক পড়িয়েন আর সাথে আরেকসেট কাপড় নিয়েন। আমরা বের হবো। জলদি করেন।
নিশুতি ঘুম ঘুম চোখেই উঠে বাথরুমে যায়। প্রায়াণ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলে।
.
.
নিশুতি চিল্লিয়ে বললো,
———-এই বড়লোকের বাচ্চা,আমি গাড়িতে যাবো না। আমরা একপ্রকার ট্যুরে যাচ্ছি। সো আমি লোকাল ভাবে যাবো। গাড়ি রিসোর্টেই থাক।
প্রায়াণ অনেক বোঝানোর পরেও নিশুতি রাজী হয়না। সে লোকাল ভাবেই যাবে,আর এটাই ফাইনাল। প্রায়াণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিসোর্টে ঢুকে। চেক আউট করে ফেলে তাদের রুম। এখানে আর ফিরে আসবে না তারা। তারপর ঢাকায় ফোন করে গাড়ির এড্রেস জানিয়ে দেয় তার ফ্রেন্ড কে। সে পড়ন্ত দুপুর নাগাদ এসে গাড়ি নিয়ে যাবে।
নিশুতি রিসোর্টের বাহিরে একটা ছোট্ট বেঞ্চে বসে পা দুলাচ্ছে অনবরত। কালো টপস উইথ প্লেইন জিন্স আর মাথায় পশম ওয়ালা টুপি পড়েছে একটা। ছোট খাটো একটা বিড়ালের বাচ্চার মতো দেখাচ্ছে তাকে।
প্রায়াণ দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ঘেমে নেয়ে একাকার। শরীর জবজব করছে তার৷ একটা ফ্রেশ শাওয়ার নিতে পারলে ভালো হতো। সে এসে নিশুতির পাশে বসে। নিশুতি চিপস খেতে খেতে বললো,
———কাজ শেষ?
প্রায়াণ ছোট করে বললো,
——–হু।
——-এবার আমরা যাবো কীসে?
———সি এন জি তে। আসতেছে। ওয়েট।
নিশুতি আর কথা না বলে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। খানিকবাদে একটা সিএনজি আসে। তারা দুজনেই উঠে বসে তাতে। গন্তব্য তাদের পান্থুমাই ঝর্ণা। বিছানাকান্দি থেকে সেখানে সিএনজি তে করে যাওয়া যায় সহজেই। লোকাল জন প্রতি ১০০ টাকা করে আর রিজার্ভ গেলে ৬০০ টাকা।
নিশুতি উঠেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় প্রায়াণের উদ্দেশ্যে…
——–কতক্ষণ লাগবে যেতে?
——–প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো।
নিশুতি আবার চিপস খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
পাহাড়ি এলাকার এঁকেবেকে যাওয়া পথ ধরে ধরে সিএনজি ছুটছে তার আপন গতিতে। কখনো সমতল ভূমি,কখনো বা উঁচু নিচু…নিশুতির বেশ ভালো লাগছে।
সে সিএনজি থেকে বাহির দেখতে দেখতেই বললো
——-কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? আই মিন যেখানে যাচ্ছি জায়গাটার নাম কী?
———পান্থুমাই ঝর্ণা।
———হোয়াও। নামটাই কত সুন্দর! না জানি জায়গা টা কত সুন্দর হবে!
প্রায়াণ নিশুতির এক হাত চেপে ধরে। নিশুতি তখন মুখ ঘুরিয়ে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ বলা শুরু করে,
——–বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে মেঘালয় এর কোলে এক অসম্ভব সুন্দর গ্রাম – পান্থুমাই। এটি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন এর একটা গ্রাম। পেছনে মেঘালয় পাহাড় ও বয়ে চলা পিয়াইন নদীর পাড়ে এই গ্রামটি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর একটি।
নিশুতি মুগ্ধ হয়ে শুনছিল প্রায়াণের কথা গুলো। সে উল্লাসিত গলায় বললো,
——–এতো সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে! আল্লাহ,আমি না অজ্ঞান হয়ে যাই দেখে!
বলেই ফিক করে হাসলো নিশুতি। প্রায়াণ ও হাসলো। দুষ্টুমি গলায় বললো,
———এখুনি এতো অজ্ঞান হও! গর্ভবতী হলে তো বোধহয় সারাদিন অজ্ঞান হয়েই থাকবা!
নিশুতি কথাটা শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায়। সে কটমট করে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে।।প্রায়াণ মৃদু হেসে বলে,
——–আ’ম জোকিং!
নিশুতি আবার বাহিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
——-ইটস ওকে।
.
.
দেখতে দেখতে পৌঁছে যায় তারা তাদের গন্তব্যে। নিশুতির খুশি যেন আঁটছে না প্রাণে। সিএনজি থেকে নামতেই একটা উতলা বাতাসে দোল খেয়ে উঠে তার পুরো শরীর। শিহরিত হয়ে উঠে নিশুতি। প্রায়াণ ভাড়া মিটিয়ে বললো,
——–সামনে চলো।
নিশুতি তার হাত দিয়ে প্রায়াণের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। প্রায়াণ স্মিত হেসে বলে,
———ভয় নেই। এখানে তোমাকে হারাতে দিবো না।
উত্তরে নিশুতি কিছু বলে না। শুধু হাসে।
ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে স্থিরচিত্র হয়ে গেছে নিশুতি। প্রায়াণ তাকে আপাদমস্তক অবলোকন করে যাচ্ছে খালি।
একটা সময় প্রায়াণ দেখে নিশুতির চোখ চিকচিক করছে। জল ছাপিয়ে উঠছে চোখে। প্রায়াণ অবাক হয়। নিশুতিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,
——-কাঁদছো কেনো আবার!
নিশুতি ভাঙা ভাঙা গলায় জবাব দিলো,
——–অনেক খুশি হলে আমার কান্না পায়। জানো না?
প্রায়াণ দায়সারাভাবে হাসলো। নিশুতির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
——–আসলেই তুমি পাগল। একটা বড় পাগল।
নিশুতি প্রায়াণের কথা গায়ে মাখালো না। সে দৌড়ে চললো সামনের দিকে। তার পিছু পিছু প্রায়াণও এগিয়ে চললো।
সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝমঝমিয়ে পানির ধারা নিচে পড়ছে। নিশুতি সেখানে গিয়ে প্রথমে হাত ভিজায়,তারপর পা। প্রতিবার পানির স্পর্শে শিউরে উঠে সে। কি ঠান্ডা!!
প্রায়াণ একটু দূরে দাঁড়ানো। জোরে বললো,
——–ভিজিয়ো না। ঠান্ডা লেগে যাবে।
নিশুতি সে কথা শুনলো কিনা কে জানে! সে প্রায়াণের সামনে এসে বললো,
———আমার সাথে আসো। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো??
প্রায়াণ নাকোচ করে।
——–তুমিই যাও। আমি এখানেই ঠিক আছি।
নিশুতি কপট রাগ দেখায়।
——–যাবা না?
প্রায়াণ “না” বলার আগেই নিশুতি তাকে টেনে নিয়ে চলে। ঝর্ণার সামনে গিয়ে ধাক্কা দেয় জোরে। প্রায়াণ পিছলে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। তবে পুরো শরীর ভিজে যায় একদম। নিশুতি খিলখিল করে হেসে উঠে। প্রায়াণ ঝর্ণার বাহিরে এসে কোমড়ে হাত গুঁজে বললো,
——-তবে রে! আমাকে ভিজিয়ে হাসা হচ্ছে??
সেও নিশুতির হাত টেনে তাকে বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসে। নিশুতি লজ্জায় নতজানু হয়। প্রায়াণ নিশুতির নাকে নাক ঘষে বলে,
———ভিজলে দুজন একসাথে ভিজবো।
চলবে….
রঙ চা
পর্বঃ১৮
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
একটা বড় পাথরের উপর বসে রোদে দুজনের শরীর শুকিয়ে নিচ্ছে দুজনেই। নিশুতি হাপাচ্ছে খুব। পানি নিয়ে খুব দাপাদাপি করেছে এতক্ষণ। প্রায়াণ মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
———বলেছিলাম এতো বেশি দাপাদাপি করিও না। কে শুনে আমার কথা! এখন হাপাচ্ছো তো ঠিকি!
নিশুতি উত্তর দিলো না। শুধু মুখ ভেংচি দিলো প্রায়াণ কে দেখিয়ে।
প্রায়াণ আহাজারি করে বললো,
———এই যে মুখ ভেংচালে না? ধম্মে সইবে না হুহ!!
নিশুতি এই কথার উত্তরেও কিছু বললো না। আবারো মুখ ভেংচি কাটে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে। প্রায়াণ ও হাসে। নিশুতি হাসতে হাসতেই পেটে হাত চেপে বলে,
———খুব ক্ষিদে লাগছে।
———-একটু জামা কাপড় গুলো শুকিয়ে নাও তারপর আমরা খাওয়ার আয়োজনে যাবো।
———-কিন্তু আমার সাথে তো কাপড় আছে। তোমার সাথেও তো আছে!
প্রায়াণ ভুলেই গিয়েছিল যে তারা রিসোর্ট থেকে সব কিছু নিয়ে এসেছে তাদের। প্রায়াণ জিভ কেটে বলে,
———সরি ভুলে গেছিলাম। ব্যাগ কই আমাদের?
নিশুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঙুল উচিয়ে দেখায় একটু দূরে থাকা ব্যাগ গুলো কে। প্রায়াণ দায়সারাভাবে হেসে বলে,
———-বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো। অনেক কিছুই মনে থাকে না আর!
প্রায়াণ উঠে গিয়ে ব্যাগ দুটো নিয়ে আসে। তারপর নিশুতিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
———চলো।
নিশুতি উঠে দাঁড়ায়।
প্রায়াণ বলে,
———এখান থেকে ৭-৮ মিনিটের দুরত্বে একটা রেস্তোরাঁ আছে। ভালো মানের। সেখানেই যাওয়া যাক।
নিশুতি বলে,
——–আচ্ছা।
তারপর দুজনেই হেটে যাত্রা শুরু করে। রেস্তোরাঁতে আসার পথে একটা খোলা জায়গা চোখে পড়ে নিশুতির যেটা ঢালু হয়ে পান্থুমাই ঝর্ণার দিকে চলে গেছে। নিশুতি উৎসুক হয়ে বললো,
———এটা কী?
প্রায়াণ খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে বলে,
———একটা খোলা জায়গা। দেখছোই তো!
নিশুতি বিরক্ত হয়ে বলে,
———–উফ। আমিও তো দেখতেছি সেটা। এখানে কি হয় বা এটা কি কোনো ঘোরার জায়গা সেটা জিজ্ঞেস করলাম!!
———–নাহ তেমন কোনো ঘোরার জায়গা না। এখানে মানুষ তাবু টানিয়ে রাতের পান্থুমাই শহর টাকে উপভোগ করে আর কি। এটা পান্থুমাই ঝর্ণার ই একটা অংশ বলতে পারো।
———ও আচ্ছা!
নিশুতির চোখ চকচক করে উঠলো। সে আহ্লাদী কণ্ঠে বললো,
———আমরাও তো এখানে তাবু টানিয়ে থাকতে পারি তাইনা??
প্রায়াণ সোজাসাপ্টা ভাবে বললো,
———-না। তুমি একটা মেয়ে আর আমি একটা ছেলে।
নিশুতি মুখ গোমড়া করে বললো,
———-আচ্ছা।
.
.
গরম ভাতের সাথে ২৯ পদের ভর্তা দেখে নিশুতি যারপরনাই অবাক। এতো ভর্তা সে তার বাপের জন্মেও দেখেনি।
সে ফিসফিস করে প্রায়াণ কে বললো,
——–এতো ভর্তা অর্ডার করেছো কেনো! আমরা খাবো কিভাবে!
প্রায়াণ হেসে বললো,
———এখানে যারা খেতে আসবে সবাইকে এটা পরিবেশন করা হয়। সবাই তো আর সব খেতে পারে না। যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা নিয়ে খায়। এবং সেই অনুযায়ী বিল পে করে। বুঝছো?
নিশুতি ঠোঁট উল্টে বললো,
——–ওওও আচ্ছা।
নিশুতি নিলো ডিম আর ধুনিয়া পাতার মিক্স একটা ভর্তা আর প্রায়াণ নিলো শুটকি ভর্তা। পেটপুরে খেলো দুজনে।
তারপর বিকেল টা পান্থুমাই গ্রাম ঘুরে কাটালো তারা।
নিশুতি যাই দেখতে,তাতেই অবাক হচ্ছে। এ যেন এক নতুন প্রকৃতি, নতুন কালচার, নতুন মানুষ জন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। আকাশের নীলিমা নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে ঢেকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
নিশুতি একটা চুড়ির দোকানের সামনে দাঁড়ানো। প্রায়াণ তাকে এখানে রেখে কোথাও যেন গিয়েছে কিছু কিনতে। নিশুতির মেজাজ গরম হচ্ছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বাদেই প্রায়াণ ফিরে আসে। হাতে তার বড় ব্যাগ। নিশুতি কিছু প্রশ্ন করার আগেই প্রায়াণ বললো,
——-চুড়ি পছন্দ করেছো? কোনটা কিনবা বলো?
নিশুতি হা হয়ে বললো,
——–কিসের চুড়ি? তুমি আমাকে বলছিলা কোনো চুড়ি পছন্দ করতে?
———তো তোমাকে চুড়ির দোকানের সামনে রেখে গেলাম কি করতে! যে বসে বসে চুড়ি পছন্দ করবা তাইনা?
নিশুতি মুখ কালো করে বললো,
——–আমি কোনো চুড়ি ফুড়ি পছন্দ করিনি।
প্রায়াণ আতংকিত চোখে এদিক ওদিক তাকায়। নিশুতির একদম পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে,
———ফুড়ি বলে না সোনা। ফুড়ি মানে মেয়ে। এটা এখানের আঞ্চলিক ভাষা। আবার পড়ে লোকে ভাব্বে আমরা মেয়ে পাচারকারী!! বেদম কিলান কিলাবে তখন। তোমাকেও আমাকেও।
নিশুতি বিরক্তি নিয়ে বললো,
——-আচ্ছা আর বলবো না।
প্রায়াণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর দোকানের ভেতর ঢুকে নিজে পছন্দ করে এক ডজন কালো চুড়ি কিনে দেয় নিশুতি কে। নিশুতির বেশ পছন্দ হয়। তারপর দুজনে আবার হাটা ধরে।
হাটতে হাটতে সেই রেস্তোরাঁয় আসে দুজন। যেখানে দুপুরের খাওয়া সেড়েছিল। সেখান থেকেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় তারা। তারপর সেই খোলা জায়গায় যায়।
নিশুতি হাসফাস লাগিয়ে দেয়। টেনে টেনে বলে,
——— আমি আর হাটতে পারবো না আল্লাহ। আমার ঠ্যাং ব্যথা করতেছে।
প্রায়াণ বললো,
——–আর হাটতেও হবে না। এখানেই বসো। যা করার আমিই করছি।
নিশুতি নিচে বসে পড়ে ঘাসের উপরে। বসতেই আবার লাফিয়ে উঠে। প্রায়াণ ইশারায় বলে, “কী?”
নিশুতি দায়সারাভাবে হেসে বলে,
——–ঘাসের উপর শিশির জমেছে। অনেক ঠান্ডা।
প্রায়াণ হাসলো নিশুতির কথা শুনে। শেষমেশ নিশুতির আর বসা হয় না। সে দাড়িয়েই থাকে। আর প্রায়াণ দ্রুত দ্রুত কাজ সাড়ে।
.
তাবু দেখে নিশুতির মুখ হা হয়ে যায়। সে কি কোনোদিনও ভেবেছিল কোনো একরাতে এত সুন্দর জায়গায় খোলা আকাশের নিচে তাবু গেড়ে সে শুয়ে থাকবে!!
জীবন ভীষণ রহস্যময় আর মানুষকে তার রহস্য দিয়ে অবাক করে দিতে যেন ভালোই লাগে তার।
নিশুতিও অবাক সাথে খুশিও। সে প্রায়াণ এর এক হাত চেপে বললো,
———-তুমি না বলছিলা তাবু করবে না তাহলে??
প্রায়াম মৃদু হেসে বলে,
———-আরে ওটা বললে তো তুমি জানতেই তাহলে সারপ্রাইজ হতো না আর। এই জন্য তখন ওটা বলেছি। আর আশেপাশে দেখো,আমাদের মতো আরো কত তাবু আছে এখানে।
নিশুতি আশেপাশে খেয়াল করে। জায়গা টা বেশ খোলা আর বড় হওয়ায় অনেক দূরত্ব রেখে রেখে এক একটা তাবু গাড়া। প্রতিটার ভেতরেই লাইট জ্বলছে। মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ নিশুতির চোখেই পড়েনি এসব। নিশুতি আরো খুশি হয়ে যায়। যাক,তারা তাহলে এখানে একা না। তাদের মতো আরো অনেকেই আছে!
.
.
রাত বাড়ছে। সাথে ঠান্ডাও। বাজার থেকে কিছু শুকনো লাকড়ি কিনে নিয়ে এসেছিল প্রায়াণ। তাই দিয়ে আগুন জ্বালায় সে তাবুর বাহিরে। নিশুতি আগুনের পাশেই গুটিশুটি মেরে বসে। ঠান্ডায় তার জমে যাওয়ার মতো অবস্থা।
প্রায়াণ তার অবস্থা দেখে বললো,
———ঢাকায় থাকো তো তাই ঠান্ডা কি জিনিস টের পাও না। যারা পার্বত্য এলাকায় থাকে তারা বোঝে ঠান্ডা কি জিনিস।
নিশুতি কাঁপা ঠোঁট নিয়ে বললো,
——–আজকে আমি ঠান্ডায় মরে যাবো। আর আমার পোস্ট মর্টামে লেখা থাকবে সব তোমার দোষ। কে বলছিল আমাকে এই খোলা আকাশের নিচে রাখতে। আল্লাহ গো। খোদা গো। মাবূদ গো…
প্রায়াণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
——–যা বাবা!! তুমিই না প্রথমে বলছিলা তাবুর কথা!!
——–আমি কি জানতাম এতো ঠান্ডা পড়ে রাতে। রিসোর্টেও তো বোঝা যায়নি। তুমি আমাকে বলবা না ঠান্ডার কথা।
প্রায়াণ বিরবির করে বললো,
——–যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর!! এখন সব আমার দোষ হয়ে গেলো। বাল!
নিশুতি জোরে চিল্লিয়ে বললো,
——–হু বাল। ব আকার ল বাল।
বলতে বলতেই ঘাসের উপর ধুম করে শুয়ে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় প্রায়াণ হতবাক। কি হলো এটা!
প্রায়াণ দ্রুত নিশুতির পাশে এসে তাকে ধাক্কা দেয়।
———নিশুতি….নিশু…এই নিশু…
নিশুতি গভীর ঘুমে। প্রায়াণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাজাকোল করে নিশুতিকে তুলে তাবুর ভেতরে শুইয়ে দেয়। তারপর নিজে এসে কতক্ষণ আগুন পোহায়। তারপর নিজেও তাবুর ভেতর চলে যায়।
.
.
রাত বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে ঠকঠক করে কাপছে নিশুতি। যদিও গায়ের উপর অনেকটা মোটাসোটা কম্বল দেওয়া তার। যেটা সন্ধ্যায়ই কিনেছে প্রায়াণ। তবুও নিশুতি কাপছে। প্রায়াণ ব্যাগ থেকে তার মোটা জ্যাকেট টা বের করে নিশুতির গায়ের উপর দিয়ে তার উপর কম্বল চাপা দেয়। নিশুতি তবুও কাপছে। প্রায়াণ সাতপাঁচ ভেবে নিজেও কম্বলের ভিতর ঢুকে পড়ে। ইতস্তত করলেও নিশুতিকে শক্ত করে চেপে ধরে। একদম শক্ত করে। যেন তাদের দুজনের ভেতর থেকে বাতাস টাও না যাওয়া আসা করতে পারে।
.
নিশুতি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ প্রায়াণের চোখে ঘুম নেই। সে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট এর আলোয় নিশুতির ঘুমন্ত চেহারা খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। আচ্ছা,এখন যদি নিশুতির ঐ এলো চুলের আড়ালে থাকা কপালে প্রায়াণ একটা অধর স্পর্শ বসিয়ে দেয়,তবে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
চলবে….